ব্যথিত হৃদয় এটি হৃদয় গলে সিরিজের ২১ নং বই।
ব্যথিত হৃদয় ( ইসলামিক উপন্যাস বই)
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
এম. এ. [ফাস্ট ক্লাস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়]
দাওরায়ে হাদীস [ফাস্ট ক্লাস, বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড]
প্রাক্তন শিক্ষক, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর-১২ ঢাকা।
শিক্ষা সচিব, নূরিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা, সাটিরপাড়া, নরসিংদী।
ফোনঃ ০১৭১২-৭৯২১৯৩, ০১৯২৩-২২৯০৯৬।
সম্পাদনায়ঃ আ খ ম ইউনুস
সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিবেশনায়ঃ ইসলামিয়া কুতুবখানা
৩০/৩২ নর্থ হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা—১১০০।
প্রকাশকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মোস্তফা।
ইসলামিয়া কুতুবখানা
মূল্যঃ ১০০ টাকা মাত্র।
আপনি যদি বইটি কিনতে চান তাহলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করুন।
পূর্বকথা—
ব্যথিত হৃদয়! কার হৃদয়ে এত দুঃখ, এত ব্যথা, এত বেদনা? এ ব্যথা কি শুধু উপন্যাসের প্রধান চরিত্রে সাকিবের? না, এ ব্যথা কেবল সাকিবের নয়। নয়, তার পিতা কিংবা বাল্যবন্ধু সাকিলের। বরং, এ ব্যথা সাকিবের, এ ব্যথা সাকিবের মতো প্রতিটি বিবেকবান নারী—পুরুষের। এ ব্যথা গোটা মুসলিম উম্মাহর।
আসুন, আমরাও হৃদয়ের গভীরে এ ব্যথা অনুভব করি। সেই সাথে এ ব্যথা উপশমের জন্য নিজ নিজ সামর্থ অনুসারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের তাওফীক দাও। আমীন। ছুম্মা আমীন।
দোয়া প্রত্যাশী
মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
১০.০৪.২০০৭।
সম্পাদকের কথা।
ব্যথিত হৃদয়! একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নির্ভর উপন্যাস। ধর্মীয় বিশ্বাস নির্ভর উপন্যাস কেমন হতে পারে তা হৃদয় গলে সিরিজের পাঠক মাত্রেরই জানা আছে। কিন্তু যারা সিরিজের বই ইতোপূর্বে পড়েন নি, তারা ব্যথিত হৃদয়—এর কয়েকটি অনুচ্ছেদ পড়লেই মর্মে মর্মে উপলব্দি করতে পারবেন।
একটি সামাজিক উপন্যাসের যে সকল গুণ—বৈশিষ্ট্য থাকা ব্যথিত হৃদয়—এ সে সকল বৈশিষ্ট্য সমহিমায় বিদ্যমান।
পার্থক্য শুধু এতটুকু যে—আমাদের নামকরা ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে যেখানে নফসানিয়্যাত তথা কুপ্রবৃত্তিকে প্ররোচিত করার উপাদানে পূর্ণ, বিশ্বাস নির্ভর উপন্যাস ব্যথিত হৃদয় সেখানে কুপ্রবৃত্তিকে নির্মূলে নিমগ্ন।
বিত্তের চেয়ে চিত্তের মূল্য অনেক বেশি। বিত্ত দিয়ে চিত্তকে জয় করা যায় না। কিন্তু চিত্ত দিয়ে বিত্তকে করতলগত করার হাজারো উদাহরণ আছে। তাই ব্যথিত হৃদয়—এর লক্ষ্য বিত্ত নয়—চিত্ত। উপন্যাস মননকে স্পর্শ করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে ব্যথিত হৃদয় যতুটুকু মননকে তার চেয়ে চিত্তবৃত্তিকে বেশি বিদীর্ণ করে।
লেখকের রচনাশৈলী, গল্পের গাঁথুনি, উপস্থাপনা এবং বিষয়বস্তু নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দর ও সুচিন্তিত। ব্যথিত হৃদয়—এর সম্পাদনা করতে গিয়ে লেখকের এই উদ্যোগকে চিত্তবৃত্তির সংস্কার সাধন বলে মনে হয়েছে। আমি তাঁর ইহ ও পরকালীন কল্যাণ কামনা করছি।
আ খ ম ইউনুস (সহকারী অধ্যাপক)
দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। (ঢাকা ১৩.০৪.২০০৭।)
এক : ব্যথিত হৃদয়!
চারিদিকে সুবহে সাদিকের আবছা অন্ধকার। পাখির কূজনে এখনো মুখরিত হয়নি পরিবেশ। শীতের কুহেলী পর্দা সরতে শুরু করেছে। প্রকৃতি বুঝি ঋতুরাজ বসন্তকে হাতছানী দিয়ে ডাকছে। তারই আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছে ভোরের ঝিরঝির বাতাসে। দূর মসজিদের ঐ মিনার হতে ভেসে আসছে—আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।
আযানের সুমিষ্ট আওয়াজের ঘুম থেকে জেগে ওঠে সাকিব। বাথরুমের কাজ সেরে সুন্দর করে অনু বানায়। তারপর ধীর পদে এগিয়ে যায় মসজিদ পানে। ভোরের নির্মল পবিত্র হাওয়া বেশ ভালো লাগে তার। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় মসজিদে এসে উপস্থিত হয় সে। দু’রাকাত সুন্নত পড়ে শরীক হয় ফজরের জামাতে। নামাজ শেষে মায়ের শেখানো দোয়াগুলো পাঠ করে। অতঃপর এক পা দু’পা করে হাঁটতে থাকে বাড়ি অভিমুখে।
সাকিব দশ বছরের হৃষ্টপুষ্ট বালক। দেখার মতো চেহারা। খুবই শান্ত । গত তিন বছর আগে মমতাময়ী মাকে হারিয়েছে সে। খালেদা তার একমাত্র বোন। বোনটির বয়স চার বছর। ওকে সে সীমাহীন আদর করে। স্নেহ করে। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে।
সকাল থেকে কেবল মায়ের কথা মনে পড়ছে সাকিবের। পেটব্যাথা নিয়ে ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন আব্বু। তারপর তিনদিন যাবত মায়ের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সাকিব তার মায়ের জন্য অনেক কান্না কাটি করেছে। মা মা বলে চিৎকার করেছে। ঘণ্টার পর ঘন্টা পথপানে চেয়ে রয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে মাকে এক নজর দেখার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। অনেকের নিকট কাকুতি—মিনতি করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিরাশ হয়েছে। কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নি। কেউ তাকায় নি তার অশ্রুসিক্ত চোখের পানে, রক্ষা করে নি তার অনুরোধ—আবদার।
সাকিবের মা তিনুদিন পর বাড়ি ফিরেছেন। তবে জীবন নিয়ে নয়, লাশ হয়ে। গাড়ীতে চড়ে নয়, সাদা চাদরে ঢাকা খাটিয়ার শুয়ে। সাকিব তখন বুঝতে পেরেছে, স্নেহময়ী মা চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। আর কোনোদিন তাকে মা বলে ডাকতে পারবে না সে।
ও পাড়ার শাকিল সাকিবের একমাত্র বন্ধু। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। সাকিব মাঝে—মধ্যে শাকিলের সাথে ওদের বাড়ি যায়। দেখে, শাকিলের মা শাকিলকে কত ভালোবাসে! কত আদর—যত্নে ভালো ভালো খাবার খাওয়ায়। কিনে দেয় কত রং—বেরংয়ের জামা। এসব দীখে সাকিবের বালকমন হু হু করে কেঁদে ওঠে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়ে সে। বাঁধভাঙ্গা পানির মতো কচি চোখের কোণ দিয়ে অশ্রু ধারা বয়ে যায়। মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়—আহ! আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমিও এরূপ আদর পেতাম, ভালো ভালো খাবার খেতাম, নতুন নতুন জামা পড়ে স্কুলে যেতাম।
সাকিবের পিতার নাম আতাউর রহমান। এলাকার বড় গৃহস্থ। জোত—জমির কোনো অভাব নেই। ধান—চালে গোলা ভর্তি থাকে সারা বছরই। এলাকার প্রধান মাতবরদের মধ্যে তিনিও একজন। বয়স পয়তাল্লিশে পৌঁছেছে। শরীর স্বাস্থ্যও ভালো। তাই স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আঠার বছরের যুবতী, অনিন্দ্য সুন্দরী রাশেদা খানমকে নববধূ করে ঘরে তুলতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি তার।
ফজরের নামাজ শেষ বাড়ির পথ ধরেছিল সাকিব। কিন্তু পথিমধ্যে মায়ের কথা মনে হওয়ায় বাড়ি আর যাওয়া হয় নি। রাস্তায় কিনারে একটি প্রকান্ড গাছের নিচে বসে পড়ে। সেখানে বসেই অতীতের নানা কথা স্মরণ করছিল সে। সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠেছিল, সৎ মায়ের নিষ্ঠুর আচরণের নির্মম চিত্রটিও। যা ঘটেছিল গতকাল এ সময়ের একটু পরেই।
এসব কথা চিন্তা করে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছিল সাকিব। আর অস্ফুট স্বরে বলছিল, মাগো..মা..! আমাকে তুমি একা ফেলে কেন চলে গেলে মা? কেন আমাকে এই নির্মম অত্যাচারের মুখে ঠেলে দিলে, কেন আমাকে বেদনার সাগরে ভাসিয়ে একাকি হারিয়ে গেলে…? চিরতরে যখন চলেই যাবে তাহলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও নি কেন মা?
এখানে একা বসে কি করছ সাকিব? স্কুলে যাওয়ার তো প্রায় সময় হয়ে এল।
শাকিলের কথায় সম্বিত ফিরে পেয় সে। তাড়াতাড়ি জামার এক প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় । তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে—শাকিল এসছ? মনে মনে ভাবছিলাম, তুমি এলে খুব ভালো হতো। সকালের এই মিষ্টি রোদে তোমাকে নিয়ে গল্প করা যেত। আল্লাহ পাক যখন আমার ক্ষুদ্র এই আশা পূর্ণ করেছেন, তো আর দাঁড়িয়ে কেন, বসে যাও। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলি।
শাকিল সাকিবের চেয়ে দু’বছরের বড়। তবে সহপাঠি হওয়ার কারণে সে তাকে নাম ধরেই ডাকে। ছোট বেলা থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। একে অপরের সুখ—দুঃখের সাথী। যেদিন সাকিবের মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিল শাকিল, সেদিন সেও ভীষণ মর্মাহত হয়েছিল। হৃদয়ের গভীরে অনুভব করেছিল চিনচিন ব্যথা। যা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়েছিল টপটপ করে।
সাকিবের কান্না—বিধৌত চেহারা শাকিলের সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি। তাই বসতে বসতে সে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল—সাকিব! কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন তুমি?
কই, না তো!
না না, তুমি আমার কাছে গোপন করছ। ঐ যে জামা দিয়ে চোখ মুছলে?
ও তাই! মায়ের কথা মনে পড়েছিল কিনা সেজন্য.. .. .. ।
শুধু কি সেজন্য? নাকি ওয়ে সাথে আরো কিছু সংযোগ হয়েছে?
তা হয়তো হয়েছে। তবে এসব কথা তোমার শুনে লাভ নেই ভাই!।
বন্ধুর দুঃখের কথা যদি বন্ধু না শুনতে পারে, তাহলে সেখানে বন্ধুত্ব কিসের শুনি!
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এর দ্বারা আবার অন্যের দোষচর্চা হয়ে যায় কি না, সে দিকটাও তো খেয়াল রাখা দরকার।
তুমি ঠিক কথাই বলেছ। আজকাল মানুষ কারণে—অকারণে দোষচর্চা করে। গত জুম্মার বয়ানে হুজুরের মুখে শুনেছি—গীবত বা দোষচর্চা করা নাকি ভয়ানক অপরাধ।
তুমি কি গীবতের সংজ্ঞা জানো?
জানবো কোত্থেকে! স্কুলে কি আর এসব ধর্ম-কর্মের কথা গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়? তবে হুজুরের মুখেই সেদিন গীবতের পরিচয় পেয়েছিলাম। তিনি গীবতের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন—গীবত হলো, কারো অগোচরে তার এমন সব কথা বলা যেগুলো শুনুল সে অপছন্দ করবে। তিনি আরো বলেছেন, মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে গীবতকারীকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণকারীর সাথে উপমা দিয়েছেন।
হ্যাঁ, একথা আমিও শুনেছি। সেজন্যেই তো এত বড় কষ্টের কথা তোমার মতো সুহৃদ বন্ধুর কাছেও বলতে দ্বিধাবোধ করছি।
তুমি তো আর ইচ্ছা করে কিংবা কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে বলছ না। তুমি বলছ দুঃখের কথা বলে মনটা একটু ফ্রেশ করতে।
দেখ শাকিল! তারপরও আমার পক্ষে এসব কথা বলা সম্ভব হবে না। তুমি শুধু এতটুকু জেনে রাখো, আমার আর স্কুলে যাওয়া হবে না হয়তো।
সেকি! কি হয়েছে তোমার? খালুজান নিষেধ করেছেন বুঝি!
আব্বু নিষেধ করবেন কেন? তিনি তো আজ তিন দিন যাবত বাড়িতেই নেই।
তাহলে?
সেটিই তো গীবত হয়ে যাওয়ার ভয়ে বলতে পারছি না। সেদিন এক কিতাবে গীবত সম্পর্কে তিনটি হাদীস পড়েছি। হাদীসগুলো পড়ার পর আমার ভেতরে এত বেশি ভয় ঢুকেছে যে, কারো ব্যাপারে মুখ খুলতে আমার দারুণ ভয় হুয়।
হাদীস গুলো তোমার মনে আছে কি?
আছে।
বলো তো।
প্রথম হাদীসটি হলো, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমরা অপরের গিবত করা থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করো। কেননা, গীবতের ভিতর তিনটি মারাত্মক বিপদ রয়েছে। এক. গীবতকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না। দুই. তার কোনো নেক আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। তিন. তাকে অসংখ্য পাপরাশির বোঝা বহন করতে হয়। দ্বিতীয় হাদীসটি হলোঃ হযরত আনাস রাযিঃ বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, মিরাজের রাত্রে আমি এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যারা নিজেদের মুখমন্ডল বিরাট আকারের ধারাল নখের দ্বারা আঁচড়াচ্ছিল এবং গলিত পচা লাশ ভক্ষণ করছিল। জিবরাঈল আলাইহি সালামকে এদের পরিচয় জানতে জিজ্ঞেস করলে জবাবে তিনি বললেন—এরা দুনিয়াতে [অন্যের গীবত করে] মরা লাশের গোশত খেত। আর তৃতীয় হাদীসটি হলো, হুজুর সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কারো [গীবত করে তার] গোশত ভক্ষণ করেছে, কিয়ামতের দিন তার সম্মুখে গীবতকৃত ব্যক্তির গোশত পেশ করা হবে এবং বলা হবে—এই আন্ব, দুনিয়াতে যার জীবিত অবস্থায় গোশত ভক্ষণ করেছিলে, আজ তার মৃতদেহের গোশত ভক্ষণ করো। অতঃপর তাকে এই পঁচা গোঁশত খেতে বাধ্য করা হবে। নাউযুবিল্লাহ।
তুমি তো গীবত সম্পর্কে সাংঘাতিক ভয়ানক শাস্তি সম্বলিত হাদীস শুনালে সাকিব!
হ্যাঁ, তবে আফসোসের বিষয় হলো, এতসব জেনেও মানুষ গীবত থেকে বিরত থাকে না। কিতাবে আমি এ কথাও পড়েছি যে, কোনো ব্যক্তির দেহ, বংশ, কথা, কাজ এমনকি তার পোষাক—পরিচ্ছদ ও আরোগণের সাথে সম্পর্কিত হলেও তা গীবত বলে পরিগণিত হবে।
সাকিব! কাউকে হহেয় করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তুমি তোমার দুঃখের কথাটা এ নিয়তে বলো যে, আমার কাছে বললে তোমার মনটা একটু হালকা হবে এবং তোমার কি করা উচিৎ এ নিয়ে একটা বুদ্ধি বের করা যাবে।
এরপরেও সাকিব তার দুঃখের কথাগুলো বলতে রাজী হলো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাকিলের পীড়াপীড়িতে সে একরকম বাধ্য হয়েই বলল—
গতকাল সকালে আমার সৎ মা আমার সব বই—খাতা পুড়িয়ে দিয়েছেন।
কী বললে! তোমার সৎ মা তোমার বই—খাতা পুড়িয়ে দিয়েছেনে? কেন? কেন পুড়লেন? তুমি কি কিছু করেছিলে?
না, আমি কিছুই করি নি। আব্বু বাড়িতে না থাকায় তার কাছে স্কুলের বেতন চেয়েছিলাম। বলেছিলাম? মা! সামনে আমার বার্ষিক পরীক্ষা। আগামী বিশ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ না করলে পরীক্ষা দিতে পারব না। আব্বু তো রাজশাহী গেছেন। ফিরতে আট—দশদিন দেরী হবে। তিনি আসতে আসতে বেতন দেওয়ার সময় শেষ হয়ে যাবে। তাই যেভাবেই হোক আপনি আমাকে বেতনটা দিয়ে দিন। যাতে আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারি।
জবাবে তিনি বললেন? শাকিলের প্রশ্ন।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিনি রাগে আগুন হয়ে চোখ দুটি বড় করে আমার পড়ার রুমে ঢুকলেন। আমিও পিছনে পিইছনে ঢুকতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। তিনি আমার দু’গালে দুটি শক্ত চড় বসিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন। তারপর আমার বই—খাতাগুলো হাতে নিতে নিতে তাচ্ছ্যিল্যের সুরে বললেন—বেতন! বেতন দিব তোকে!! রাখ বেতন দিচ্ছি। এ বলে তিনি হনহন করে ঘুর থেকে বের হয়ে জ্বলন্ত চুলোয় বইপত্রগুলো নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর বললেন, “এই শয়তান! তোকে আমি বেতন দেব কোন দুঃখে রে? তোর লেখাপড়া গোল্লায় যাক তাতে আমার কি? তুই লেখাপড়া শিখে বড় হবি, তারপর আমার ও আমার ছেলেমেয়েদের উপর মাতবরি করবি—এটা আমি কখনো চাই না। তাই আজ থেকেই তোর লেখাপড়ার বারটা বাজালাম। আমার সামনে তুই কোনদিন লেখাপড়ার নাম নিবি না। আমি জানি, তোর বাপ বাড়িতে এলেই তিলকে তাল বানিয়ে তুই এসব তোর বাপের নিকট বলবি। কিন্তু মনে রাখিস, এসব বলে কোনো লাভ হবে না। কারণ আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তোর বাপের নেই। তারপরও যদি বলিস, তাহলে তোকে আর আস্ত রাখব না। আমার ভাইদের দিয়ে তোর হাড্ডি গোশত আলগা করে ছাড়ব।
কথাটা মনে রাখিস কিন্তু, বুঝলি?”
সৎ মায়ের এ কথাগুলো বলতে বলতে সাকিবের কণ্ঠ বাম্পরুদ্ধ হয়ে এল।
চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু।
শুধু গতকালই নয়, সাকিব হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই লেখাপড়ার খরচ নিয়ে রাশেদা খানম তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করেন। সে লেখাপড়া শিখে আলোকিত মানুষ হবে, স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা তিনি মোটেও কামনা করেন না। ছোট বালক হলেও সাকিব তা ঠিকই বুঝতে পারে। সেজন্য কোনো জিনিস বিশেষ করে লেখাপড়ার খরচ কখনোই সে ছোট মার কাছে চায় না। গতকাল অবশ্য অপারগ হয়েই তার কাছে বেতন চেয়েছিল।
সাকিব কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তার ঘটনা বলা শেষ করে একটু থামল। তারপর হৃদয়ের গহীন হতে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, শাকিল! সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাড়ি থেকে চলে যাব।
কখন?
আজই।
সাকিবের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে শাকিল যেন আকাশ থেকে পড়ল। কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে অশ্রুভেজা নয়নে তাকিয়ে থাকে সাকিবের মুখের দিকে। তারপর বিস্ময়ের স্বরে বলে—
কোথায় যাবে সাকিব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
কোথায় আর যাব! দেখি শহরে গিয়ে কোনো কাজকর্ম পাই কিনা। মা যখন নেই, বাপও যখন ছোট মার কথামত চলেন, তখন আমার মতো হতভাগার সংগ্রাম করেই তো জীবন ধারণ করতে হবে। তাছাড়া, যে মা আমাকে বাড়ির চাকরের মর্যাদাও দেন না, সব সময় কেবল তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য করেন, তার কাছে না থেকে, দূরে কোথাও চলে গিয়ে খেটে খাওয়াও অনেক ভালো।
শাকিল কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা আর হলো না। সাকিব দূরের একটি লঞ্চ দেখিয়ে বলল, ঐ যে শাকিল লঞ্চ এসে গেছে। আমি এবার যাই, বলে সন্মুখপানে দৌড়াতে লাগল।
ঘটনার আকস্মিকতায় শাকিল হতভম্ব হয়ে যায়। কিছুক্ষণ সে অবাক হয়ে সাকিবের চলে যাওয়া পথপানে তাকিয়ে থাকে। তারপর সম্বিত ফিরে পেতেই সেও সাকিবের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু এতক্ষণে সাকিব বেশ দূরে চলে গেছে। এমনকি শাকিল লঞ্চঘাটে পৌঁছার পূর্বেই সে লঞ্চে চড়ে লোকদের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
শাকিল দৌড়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। বহু কষ্টে ঘাটেও পৌঁছল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হলো না। সে দেখল, লঞ্চটি তার সম্মুখভাগ ঘুরিয়ে এতক্ষণে নদীর মাঝখানে চলে গেছে। শাকিল তার ছোটবেলার বন্ধুকে ডাকল। চিৎকার করে বলল, সাকিব! যেওনা বলছি, যেওনা। দাঁড়াও। দাঁড়াও সাকিব, যেওনা…।
এ সময় সাকিব লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে শাকিলকে বিদায়ী সালাম জানাল। বলল, বিদায় বন্ধু, বিদায়! দোয়া করো, তোমার এ বন্ধু যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আত্মনিয়োগ করতে পারে দেশ, ধর্ম ও জাতির সেবায়।
শাকিল অশ্রুসজল নয়নে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রিয়তম বন্ধুকে বাধ্য হয়ে বিদায়ী অভিবাদন জানাল। বন্ধুর বিরহে বিসর্জন দিল বাঁধভাঙ্গা অশ্রু। অবশেষে অনন্যোপায় হয়ে এক বুক বেদনা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এল।
দুই
বিরামহীন কয়েক ঘন্টা চলার পর লঞ্চটি ঢাকা সদরঘাট টার্মিনালে এসে থামল। লোকজন নামতে শুরু করল। লঞ্চের দরজায় প্রচন্ড ভীড়। সাকিব এক পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যাত্রীদের অবতরণ শেষে সাকিব পা রাখল ঢাকার মাটিতে।
সাকিব যদিও প্রায়মারীর গন্ডি ছাড়িয়ে হাইস্কুলের দোর গোড়ায় পা রেখেছিল, কিনতি এতো বড় শুহরে কোনোদিন সে আসে নি। অজানা অচেনা শহর। কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই স্থির করতে পারে না সাকিব। ক্ষুধায় অস্থিইর। পকেটে পয়সাও নেই। যা ছিল, লঞ্চ ভাড়া দিতেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তাহলে উপায়!
চারিদিক লোকে লোকারণ্য। লোকজনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু সে তো কাউকে চিনে না। সাকিব রাস্তার ডানপাশ দিয়ে হাঁটছে। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন সে। হঠাৎ সাদা ধবধবে বড় রকমের একটি মারুতি গাড়ি তার পাশে এসে ব্রেক করে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে আসেন কোর্ট—টাই পরিহিত মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক।
লোকটিকে কিছু একটা বলবে সে সাহসও পাচ্ছে না সাকিব। এদিকে ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণাও সহ্য করতে পারছে না সে। অবশেষে কোনো উপায়ান্তর না দেখে বলেই ফেলল—
একটু সাহায্য করবেন স্যার? আজ সারাদিন কিছুই খায় নি আমি। বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু খেতে পারলে প্রাণটা বাঁচে। একটু দয়া করুণ স্যার!
ভদ্রলোক সাকিবের মায়াবী চেহারা পানে চোখ তুলে তাকান। তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগটা খুলে বিশ টাকার একটি নোট তার জাতে গুঁজে দিয়ে ব্যস্ত পদে চলে যান।
টাকাটা পেয়ে সাকিবের কচিমন আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই মক্তবে পড়াকালীন উস্তাদের মুখ থেকে শোনা একটি কথা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। ফলে তার সব আনন্দ নিমেষেই হাওয়ায় মিশে যায়।
সাকিব সাহেবের পিছু নেয়। উদ্দেশ্য, টাকাটা ফেরত দেওয়া। কিন্তু সাহেব ততক্ষণে একটি তিনতলা বিল্ডিং—এ হারিয়ে গেছেন। নীচ তলার গেটে রাইফেল হাতে দুই প্রহরী দাঁড়িয়ে। এদের দেখে এক পা এগুতেও সাহস হয় না সাকিবের।
সাকিব আবার চিন্তায় নিমগ্ন হয়। ভাবে সে, এ আমি কি করলাম! আমি তো জোয়ান ছেলে। কাজ করে খাওয়ার মতো শক্তি আমার আছে। তাহলে কেন আমি আরেকজনের কাছে হাত পাতলাম? মক্তবের উস্তাদজী না বলেছেন—ভিক্ষা করা, পরের নিকট হাত পাতা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। অন্যের নিকট হাত পাতার চেয়ে খেটে খাওয়া অনেক ভালো। সেদিন উস্তাদজী নবীজির একখান হাদীসও শুনিয়েছিলেন। নবীজি বলেছেন—উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম।
সাকিব সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর কারো কাছে হাত পাতবে না। না খেয়ে মরে গেলেও না। এখন থেকে সে কাজ করেই খাবে। কিন্তু পথঘাট না চেনা এক নতুন শহরে চাইলেই তো আর কাজ পাওয়া যায় না!
বাপ যেখানে গ্রামের একজন বিত্তশালী গৃহস্থ তার ছেলে সাকিব আক একটি কাজের আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে। নিজের মনের কথা খুলে বলছে। কিন্তু কেউই অপরিচিত গ্রামের ছেলেকে কাজ দিতে রাযী হচ্ছে না। দিচ্ছেনা মাথা গোঁজার মত এতটুকু ঠাঁই। অবশেষে কাজ না পেয়ে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে রাস্তার ফুটপাতে আশ্রয় নেয় সাকিব। তারপর ক্লান্ত দেহটিকে সঁপে দেয় ঘুমের কোলে। সত্যিই সে এক করুণ দৃশ্য!
পরের দিন কাজের সন্ধানে আশাভরা হৃদয় নিয়ে আবার বের হয় সাকিব। ঘুরতে থাকে এ গলি থেকে সে গলি, এপথ থেকে সেপথে। মনে মনে ডাকতে থাকে আল্লাহকে। বলে, ওগো দয়াময় প্রভু, করুণার আধার! তুমিতো দেখছো, আমি কত অসহায়! তুমি ছাড়া সাহায্য করার মত আমার কেউ নেই। আমি তোমার দয়ার মুখাপেক্ষী। তুমি আমাকে ছোট একটি কাজ হলেও জুটিয়ে দাও। যেন কারো কাছে আমাকে হাত পাততে না হয়।
ঘুরতে ঘুরতে বেলা প্রায় শেষ হয়ে এল। অস্তগামী সূর্যের শেষ কিরণ এসে পড়ল সাকিবের মুখে। এখনো তার কাজের কোনো ব্যবস্থা হয় নি। কোথাও মিলে নি একটু আশ্রয়। খানিক বাদেই সূর্য অস্তমিত হবে। এমন সময় সাকিব দেখল এক বৃদ্ধা জথর জ্বালায় অস্থির হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর অবিরাম বলে চলছে—বাবা! একটি টাকা দ্যান। আমি বড়ই ক্ষুধার্ত। বাবা! একটু খাবার দ্যান।
বৃদ্ধার এই হৃদয়—আকুতি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। ইথারে—পাথারে ভেসে চলছে করুণ মূর্ছনা তুলে। গাছপালা, তরুলতাও যেন তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদছে।
বৃদ্ধার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেক নারী পুরুষ। কিন্তু কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। যে যার যার মতো হেঁটে চলে যাচ্ছে। অথচ এদের মধ্যে এমন অনেকেই হয়তো আছেন যাদের পকেট ভর্তি টাকা আছে, আছে বাটি ভর্তি খাবার। মুখে রসালাপের সীমা নেই। তথাপী কোনো আদম সন্তান সামান্যতম কৃপা করছে না ঐ মহিলাটিকে।
এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সাকিব আশ্চর্য হয়। ভাবে, মানুষ তো মানুষের জন্য। একজনের দুঃখে আরেকজন দুঃখি হবে, বিপদাপদে এগিয়ে আসবে—মানবধর্ম তো এমনই হওয়া উচিৎ। কিন্তু এ আমি কী দেখছি! কত ভদ্রলোক হেসে হেসে এদিক দিয়ে চলে যাচ্ছেন অথচ এই বৃদ্ধার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজনও তারা বোধ করছেন না? তার মর্মস্পর্শী করুণ আর্তনাদ কারো কর্ণ কুহরে প্রবেশ করছে না। সাকিব ভাবে, এদের মধ্যে কি তাহলে মানবতা বলতে কিছুই নেই? তারা কি বুঝে না ক্ষুধার জ্বালা কত কঠিন, কত মারাত্মক? হয়তো তারা বুঝে না। আর বুঝবেই বা কি করে? তারা তো কখনো অভাবে পড়ে নি, ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে নি। তবে আমি বুঝেছি। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। জঠর জ্বালা সে এক অসম্ভব জ্বালা। সকল জ্বালার উপরে এ জ্বালাই প্রবল হয়ে ওঠে, যদি কয়েক বেলা পেটে দানাপানি না পড়ে। গতকাল না খেয়ে একথাটি আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আরও বুঝেছি তখন, যখন আমার ছোট মা প্প্রয়োজনের চাইতে অর্ধেকেরও কম ভাত দিয়ে আমার দিকে কঠিন নযরে তাকাতেন। যেন আমি তার কাছে আর ভাত চাওয়ার সাহস না পাই। ফলে কিছুক্ষণ পরেই আমার ক্ষুধার যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করত। আমি তখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকতাম। কিন্তু ভয়ে কিছুই বলতে পারতাম না। এ কারণেই আমি জানি ক্ষুধার জ্বালা কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর!
এসব ভাবতে ভাবতে সাকিব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে দৌড়ে গিয়ে হোটেল থেকে গতকালের বেঁচে যাওয়া টাকাগুলো দিয়ে দুটো পরটা ও সামান্য ভাজি কিনে মহিলার পাশে গিয়ে হাজির হয়। তারপর নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিয়ে হোটেল থেকে এক গ্লাস পানি এনে পান করায়। মহিলা খানা খেয়ে তৃপ্তিবোধ করে। সেই সাথে সাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিতে থাকে—বাবা! আল্লাহ তোমাকে বড় করুক। হায়াত দারাজ করুক। তোমার মনের আশা পূর্ণ করুক।
সাকিব ভেবে – চিনতে স্থির করেছিল, আজ যদি কোনো কাজ না পায় ত্তাহলে পকেটের টাকাগুলো দিয়ে কিছু কিনে খেয়ে ঘুমিয়ে থাকবে সে। কিন্তু তা আর হলো না। পকেট শূন্য থাকায় সামান্য পানি পান করেই তাকে ঘুমিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
হাদীসে শরীফে আছে—“তোমরা জমীনবাসীদের উপর রহম করো, তাহলে আসমানের অধিবাসী আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রহম করবেন।”
সাকিব আল্লাহর এক অসহায় বান্দির উপর দয়া প্রদর্শন করেছে। নিজে উপোস থেকে তাকে খাইয়েছে। তার ক্ষুধার যন্ত্রণাকে সে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে। তাই আল্লাহ পাক সাকিবের প্রতি দয়াপরবশ হলেন। আপন রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দিলেন। ধীরে ধীরে একদিন তাকে পৌঁছে দিলেন উন্নতির সুউচ্ছ শিখরে।
তিন।
হোটেলের সামনের চেয়ারে বসে হাজী বশীর সাহেব ধুমায়িত চাপের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তার সামনের দিয়ে একটি ছেলেকে চলে যেতে দেখে তাকে ডাকলেন। বললেন, এই ছেলে! বাড়ি কোথায়? নাম কি তোমার? এখানে কিজন্য ঘোরাফেরা করছ?
সাকিব তার পরিচয় দিল। শহরে আসার উদ্দেশ্য জানাল। বশীর সাহেব বললেন—
হোটেলে কাজ করতে পারবে?
পারব, ইনশাআল্লাহ। আমার কি কাজ হবে স্যার?
আক আর কি! চা—নাস্তা এগিয়ে দিবি, কাপ—পিরিচগুলো ধুয়ে—মুছে ঠিক রাখবি। মাঝে মধ্যে ঘর ঝাড়ু দিবি, এই তো। এ ধরণের ছোটখাটো কাজই তোমাকে দিয়ে করাব।
ঠিক আছে স্যার।
এবার একটা ঠাঁয় খুঁজে পায় সাকিব। কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নুয়ে আসতে চায় বশীর সাহেবের দিকে। যোগ দেয় হোটেলের কাজে। সে খানে পুরো দিন কাজ করে। সারাদিনের বিরামহীন পরিশ্রমে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সাকিব। তাই গভীর রাতে দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় যেতেই গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়ে সে।
হোটেল বয়ের কাজ করলেও এক ওয়াক্ত নামাজও কাযা করে না সাকিব। সে হোটেল মালিক বশীর সাহেবের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করে। কোনো ওয়াক্তে মালিক না থাকলে একাই সে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসে। অবশ্য কাজের চাপে প্রায়ই তার জামাত ছুটে যায়।
ধীরে ধীরে সিঙ্গারা ভাঁজা, পরাটা ভাঁজা এবং চা তৈরির কাজটাও রপ্ত করে নেয় সাকিব। তাছাড়া অল্প দিনের মধ্যেই গেঁয়ো চালচলন, কথাবার্তা ছেড়ে শহুরে ধাঁচে নিজেকে গড়ে নেয় সে। এখন তার থাকা—খাওয়ার কষ্ট যদিও আর নেই, কিন্তু তবু তার মনটা ভালো নেই। সর্বদাই কেমন একটা উদাস উদাস ভাব।
সকালে হোটেলের সামনে দিয়ে ব্যাগ হাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যায়, তখন তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাকিব। স্মৃতির সূত্র ধরে টান দিতেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা বিদ্যালয় ও খেলার সাথীদের চেহারাগুলো। বিশেষ করে বাল্যবন্ধু শাকিলকে সে কিছুতেই মনের আড়াল করতে পারে না। তখন কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। কিছুই তখন ভালো লাগে না তার। মন চায় আবার লেখা পড়া করতে। কারণ, হোটেলের কাজ তার জ্ঞানপিপাসু মনকে স্বস্তি দিতে পারে না। এভাবে বিভিন্ন চিন্তায় দিন গড়িয়ে রাত হয়। কাজ শেষ আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলতে থাকে তার জীবনের মূল্যবান মুহুর্তগুলো।
গভীর রজনী। ঘোর অন্ধকার পৃথিবী আচ্ছন্ন। জন—প্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। পথ, ঘাট, নগর, প্রান্তর নীরব—নিথর, নিস্তব্ধ। প্রকৃতি শান্তির সুখময় ক্রোড়ে নিদ্রিত। কেবল কতগুলো নিশাচরের শব্দ মাঝে মধ্যে তার শান্তি ভঙ্গ করছে।
সাকিব একটি চৌকিতে শুতে আছে। হঠাৎ সে স্বপ্নে দেখে, তার পরলকগত মা শিয়রে বসে তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর মমতার সুরে বলছেন, বাবা! লেখাপড়া ছেড়ে কেন তুমি হোটেলের কাজ করছ? তুমি তো এখানে এসে জামাতের সাথে ঠিকমত নামাজও পড়তে পারছ না। আমি চেয়েছিলাম তুমি লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আমার ইচ্ছা ছিল, প্রায়মারী পাশ করার পর তোমাকে মাদরাসায় ভর্তি করে দিব। সেখানে তুমি হাফেজ হবে। আলেম হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে। আত্মনিয়োগ করবে পবিত্র ধর্ম ইসলামের প্রচার—প্রসারে। কিন্তু সে আশা তো আর পূরণ হলো না। মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাকে চলে আসতে হলো। শোন বাবা! জীবনে বড় হতে হলে অএঙ্ক কষ্ট ত্যাগ—তিতিক্ষা। কষ্ট ও ত্যাগ ছাড়া জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। বড় মাপের মানুষ হওয়া যায়। আজ আমরা যাদেরকে মনীষী বলি, তাদের জীবনী পাঠ করে দেখো, তারা বড় হওয়ার জন্য, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য কত কুরবানী করেছেন, কত বিপদাপদ ও কষ্টের পাহাড় ডিঙ্গিয়েছেন। কত শক্ত বাধার প্রাচীর অতিক্রম করেছেন। মনে রেখো, যারা যত বেশি কষ্টসহিষ্ণু ও ত্যাগী হয় তারাই পরবর্তীতে ততোধিক সফলতা লাভ করে। উজ্জ্বল করে দেশ ও জাতির মুখ। তারাই জগতে স্বরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকে। সকলের স্মৃতিতে হয়ে থাকে চির অমর, চির অম্লান।
একটি কালো বিড়াল খালি পাতিলটার কানায় পা দিতেই ভীষণ শব্দ করে পাতিলটা নিচে পড়ে যায়। ভয় পেয়ে দড়ফড় করে জেগে ওঠে সাকিব। অন্ধকারে চোখ কচলাতে কচলাতে বলতে থাকে—‘মা! মা! তুমি কোথায় গেলে মা। তোমার এই দুঃখী ছেলের হৃদয়স্পর্শী করুণ কথাগুলো শুনে যাও মা। ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? জানো মা! তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আব্বু আর আমাকে একটুও আদর করেন না। নতুন জামাও কিনে দেন না। কেমন যেন হয়ে গেছেন তিনি। প্রায় দিনই আব্বু ছোট মা’র কথা শুনে আমাকে মারপিট করেন। আর ছোট মা তো কয়েক ধাপ এগিয়ে। তুমি দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর এমন কোনো দিন যায় নি যেদিন আমি তার পিটুনি খায়নি; গালমন্দ শুনি নি। তুমি যদি এলেই মা, তাহলে আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলে মা!’
বলতে বলতে সাকিব হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
পাখির কলকাকলিতে রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়। উঁকি দেয় সোনালী আলো। ধীরে ধীরে চারিদিক ফর্সা হয়ে উঠে। কিন্তু সাকিবের আজ একটুও ভালো লাগছে না। মনটা তার ব্যাথায় টনটন করছে। কাজে বিঘ্ন ঘটছে বারবার। সারাক্ষণ কানে বাজছে মায়ের কথাগুলো—শোন বাবা! জীবনে বড় হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয়………..।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সাকিব । বলে—না, আমাকে এভাবে হোটেলের কাজ করলে চলবে না। যেভাবেই হোক লেখাপড়া আমাকে শিখতে হবে। মায়ের আশা পূরণ করতে হবে। এসব কথা ভেবে হোটেলের কাজ শেষ হতে না হতেই সে জামাটা গায়ে দিয়ে বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। তারপর গত মাসের বেতনের টাকা দিয়ে ইসলামিয়া কুতুবখানা, আল—কাউছার প্রকাশনী, দারুল উলূম লাইব্রেরী ও আল হিকমাহ পাবলিকেশন্স থেকে বেশ কয়েকটি ধর্মীয় বাংলা বই কিনে আবার চলে আসে আপন আশ্রয়ে।
দিনে সাকিবের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। তাই রাতকেই সে লেখাপড়ার জন্য বেছে নেয়। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখনই তার বই পড়া শুরু হয়। তার উদ্দেশ্য হলো, আপাতত ধর্মীয় বই—পুস্তুক পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার জন্য মনটাকে আরেকটু মজবুত করা।
কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বই পড়ে সাকিব। অনেক সময় চোখ দুটো আপনা আপনি বুঁজে আসতে চায়। কিন্তু জোর করে নিজেকে পড়াশুনায় নিমগ্ন রাখে সে। কখনো হাত মুখ ধুয়ে, কখনো বা হাঁটাহাঁটি করে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করে। তদুপরি মায়ের স্বপ্ন যেন বাস্তবায়িত হয় সেজন্য প্রায়ই সে মহান প্রভুর দরবারে কেঁদে – কেটে দোয়া করে। হৃদয়ের গভীর থেকে আকুল আবেদন জানায়। এভাবেই সাকিব এগুতে থাকে আপন লক্ষ্য পানে।
চার
হোটেল মালিক হাজী বশীর উদ্দীনের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুজন বড়। একজনের নাম আব্দুস সালাম। অপর জনের নাম রফিকুল ইসলাম। মেয়েটি সবার ছোট। ওর নাম নাঈমা আখতার। সাকিব যখন হোটেলে কাজ নেয়, তখন নাঈমার বয়স ছ বছর। বেশ চঞ্চল ও চটপটে মেয়ে সে। দেখতেও বেশ সুন্দরী। পাঁচ বছর বয়সে সে ‘সবুজ কুঁড়ি কিণ্ডার গার্টেনে’ ভর্তি হয়। স্কুলে আসা যাওয়ার সময় প্রথম প্রথম কাজের বুয়া তার সাথে থাকত। বুয়াই তার আনা নেওয়ার দায়িত্বে নিয়েজিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে হাজী সাহেব সাকিবকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলে দেন যে, এখন থেকে প্রতিদিন তুমি নির্দিষ্ট সময়ে নাঈমাকে স্কুলে আনা—নেওয়া করবে। এ কাজের জন্য তুমি আলাদা পয়সাও পাবে।
সাকিব রাযী হয়। হাজী সাহেবের প্রস্তাবকে সে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়। কারণ যিনি আশ্রয় দিয়েছেন, কাজ দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন, অসহায়ের সহায় হয়েছেন তাঁর কোনো কথাকে তো উপেক্ষা করা যায় না। সেদিন থেকেই সাকিবের নতুন ডিউটি শুরু হয়। সে তাঁর এ অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়মিত পালন করতে থাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
পাঁচ
হাজী সাহেবের বড় ছেলে আব্দুস সালাম বেশির ভাগ সময় হোটেলেই থাকে। হাজী সাহেব কোথাও চলে গেলে সে ক্যাশে বসে। এছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই তাঁর। ইচ্ছা করলে সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করা ছাড়াও নানাবিধ ইবাদত-বন্দেগীতে সময় কাটাতে পারে। মাঝে মধ্যে হাজির হতে পারে কাকরাইল মার্কাস মসজিদের শবগোজারীতেও। কিন্তু না, এসব সে কিছুই করবে না। শুধু টই টই করে সময় নষ্ট করবে। হাজী সাহেব নামাজের জন্য তাকে যে বলেন না, তা নয়। কিন্তু তা অনেকটা রেওয়াজী বা দায়সারা গোছের বলার মতোই। ছেলে নামাজ না পড়লে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হবে, কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে, সাপ—বিচ্ছুতে কামরাবে ইত্যাদি আযাবের কথা চিন্তা করে যেভাবে দরদ নিয়ে বলা দরকার তা তিনি কখনোই বলেন না। একথাটা ছোট বালক সাকিবও বুঝতে পারে।
আজ শুক্রবার। বহুদিন পর সাবান মেখে গোসল করে সাকিব। নতুন জামা আর টুপি পড়ে হোটেলের কাছে আস্তেই আব্দুস সালাম জিজ্ঞেস করে—
কিরে সাকিব! নামাজ পড়তে যাবি?
হ্যাঁ, আজ তো জুমুআর নামাজ। মসজিদে যেতেই হবে। জামাত ছাড়া তো আর জুমুআর নামাজ পড়া যায় না। নামাজ শেষ করে অল্প সময়ের মধ্যেই চলে আসব আমি।
যা। তাড়াতাড়ি যা।
আপনিও চলুন না? আজ জুমুআর দিন। এ দিনটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। জুমুআর নামাজ নাকি অনেক ফজীলতের। হুজুরদের মুখে শুনেছি।
অতটুকু ছেলে নিয়মিত নামাজ পড়ে অথচ ত্রিশ বছরের যুবক হয়েও আমি এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না—কথাটি ভাবতেই এক রাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরে আব্দুস সালামকে। সাথে সাথে কোনো এক অজানা আশংকায় ঘাবড়ে যায় সে। মনে মনে বলে—না, আমাকেও নামাজ পড়তে হবে। রোজা রাখতে হবে। নেক আমল করতে হবে। নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নেই। নামাজ—রোজা ও নেক আমল ছাড়া সঙ্গে তো আর কিছুই যাবে না।
খানিক পর আব্দুস সালাম মসজিদে রওয়ানা দেয়। তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেই হতবাক হয় সাকিব। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। শুধু সাকিবই নয়, অবাক হয় আশে পাশের দোকানীরাও। পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, আরে! দেখো দেখো, আব্দুস সালাম নামাজ পড়তে যাচ্ছে। আল্লাহ পাক তাকে হেদায়েত দিয়েছেন। কবুল করেছেন।
সেদিন থেকে আব্দুস সালাম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। নামাজের সময় হলে সাকিবই তাকে ডেকে মসজিদে নিয়ে যায়। আব্দুস সালাম সাকিবকে বলে রেখেছে, তুমি মসজিদে যাওয়ার সময় অবশ্যই আমাকে নিয়ে যাবে। তাঁর কথায় সাকিব বেশ খুশি হয়। নিজেকে ধন্য মনে করে। হাজার শোকর আদায় করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে।
ছয়
সাকিব নাঈমাকে স্কুলে আনা—নেওয়া করে দু’বছর যাবত। সাকিবের বয়স এখন বার। নাঈমার বয়স আট। সাকিব নাঈমাকে নিয়ে পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই স্কুলে চলে যেত। স্কুল কাছে হওয়ায় হেঁটেই আসা—যাওয়া করে ওরা। আকাশ খারাপ থাকলে মাঝে মধ্যে রিক্সায়ও চড়ে।
প্রথম প্রথম নাঈমার সাথে সাকিবের তেমন একটা কথা হতো না। বিশেষ প্রয়োজন না হলে দুজনই চুপচাপ থাকত। এ অবস্থাটা বজায় ছিল প্রায় তিন মাসের মতো।
তিন মাস পরেই এক রাতে সাকিব তাঁর মাকে স্বপ্নে দেখে। মায়ের বলে যাওয়া কথাগুলো সাকিবের হৃদয়ে ঝড় তুলে। তাই তো পরের দিনই সে বাংলাবাজারে ছুটে গিয়ে কয়েকটি বই কিনে এনেছিল।
যা হোক, সাকিব রীতিমত তাঁর পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন তাঁর মনে একটি ভাবনা উদয় হয়। সে ভাবতে থাকে, নাঈমাকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতে আমার প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিনিট সময় ব্যয় হয়। এই সময়টুকু বেকার নষ্ট করে লাভ কি! আমি যদি নাঈমার সাথে আলাপ করে তাকে গল্প শোনার জন্য রাযি করাতে পারি তবে তো এক কাজে দু’কাজ হয়ে যাবে। একদিকে সময়টা কাজে লাগবে, আর অপর দিকে তাকে উপদেশমূলক গল্প শোনানোর দ্বারা উভয়েরই ফায়েদা হবে তাছাড়া গল্প বলা ও শোনার ফাঁকে কোন সময় যে আমাদের পথ চলা শেষ হয়ে আসবে তাও টের পাওয়া যাবে না।
একদিন সাকিব নাঈমাকে বলল, নাঈমা! আমি আজ তোমাকে একটই সুন্দর গল্প শোনাব।
আপনি বুঝি অনেক গল্প জানেন?
অনেক না জানলেও কিছু কিছু জানি।
আমি তো কোনো গল্প জানি না। আপনি কোত্থেকে গল্প শিখেছেন?
বই পড়ে শিখেছি।
আচ্ছা, আপনি তাহলে বই পড়তে জানেন!
এই তো, স্রষ্টার করুণা ও মায়ের দোয়ায় কিছুটা পারি।
আপনি বই পড়েন কোন সময়? আপনাকে তো কখনো বই পড়তে দেখি নি।
তুমি যখন ঘুমিয়ে যাও তখন আমি জেগে থেকে মজার মজার গল্প পড়ি।
ওমা! আপনি তাহলে ঘুমান না?
ঘুমাই। প্রতি রাতে বেশ কয়েকটি গল্প পড়ে তারপর ঘুমাই।
ঠিক আছে। এখন গল্প বলা শুরু করুণ।
সাকিব গল্প বলে শেষ করলে নাঈমা পরিতৃপ্ত হয়ে খুশিতে বাগবাগ হয়ে যায়। মনে হয় এত সুন্দর গল্প কখনো সে শুনে নি। সে সাকিবকে বলে—আপনি এত সুন্দর গল্প জানেন অথচ এতদিন আমাকে বলেন নি কেন? রাতে ঘুমানোর সম্য প্রতিদিন আমি আম্মুকে গল্প বলার জন্য কত পীড়াপীড়ি করি। কিন্তু কোনো দিন আমাকে একটি গল্পও শোনান নি। মাঝে মধ্যে বড় ভাইয়া অবশ্য দু’একটা গল্প বলেন, কিন্তু আপনার গল্পটি যেমন ভালো লেগেছে, ভাইয়ার বলা গল্প এমন ভালো লাগে নি। আচ্ছা সাকিব ভাই! আপনি যে বই থেকে গল্প পড়েন সে বইটির নাম কি?
নাম জেনে তোমার লাভ কি? তুমি কি পড়তে পারবে?
এখন পড়তে না পারলেও কিছুদিন পর তো পড়তে পারব?
হ্যাঁ, তা অবশ্য পারবে।
আপনি কিন্তু বইটির নাম এখনো বলেন নি।
ও হ্যাঁ, বইটির নাম হলো, যে গল্পে হৃদয় গলে।
বাহ, ভারী সুন্দর নাম তো! এ বইটি কি আমাকে দেখাবেন?
শুধু দেখাবই না, পড়তেও দেব। তবে এখন নয়। যখন তুমি সুন্দর করে বাংলা রিডিং পড়তে পারবে তখন দেব।
এখন কি তাহলে দেখতেও দিবেন না?
হ্যাঁ, দেখতে দেব। আজ বাসায় যাওয়ার পরই তোমাকে দেখাব।
ঠিক আছে। তবে এখন কিন্তু আমার সাথে একটি ওয়াদা করতে হবে।
ওয়াদা!
হ্যাঁ, ওয়াদা।
কি ওয়াদা করতে হবে আমাকে?
আপনাকে আজ থেকে এ ওয়াদা করতে হবে যে, প্রতিদিন আমাকে স্কুলে যাওয়া আসার সময় কমপক্ষে দুটি করে গল্প শোনাবেন।
ও আচ্ছা তাই! আমি তো মনে করেছি, কোনো কঠিন কিছু আমাকে করতে হবে। ঠিক আছে ওয়াদা দিলাম।
মনে থাকে যেন।
অবশ্যই মনে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
সেদিনের পর থেকে সাকিব তাঁর ওয়াদা মত প্রতিদিন দুটি করে গল্প শোনায় নাঈমাকে।
সাত
নিয়মিত নামাজ পড়ার কারণে মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে বেশ পরিচয় হয়ে গেছে সাকিবের। সেই সাথে জম্ম নিয়েছে একটা গভীর আন্তরিকতা। একদিন কথা প্রসঙ্গে ইমাম সাহেব সাকিবকে জিজ্ঞেস করেন—
সাকিব! তুমি কি কুরআন শরীফ পড়তে পার?
জ্বী-না। আমাদের পাড়ার মসজিদে প্রতিদিন সকালে কুরআন শরীফ শিক্ষা দেওয়া হতো। আমি কায়দা শেষ করে আমপারা শুরু করেছিলাম। তারপরেই আমার জীবনে ঘটে যায় ঐ ঘটনা যা আমি আপনাকে গত কয়েকদিন আগে শুনিয়েছিলাম। হুজুর! আমার না কুরআন পড়তে খু-ব-ই ইচ্ছে করে। সেদিন একটি কিতাবে দেখলাম, পবিত্র কুরআনের একটি হরফ পাঠ করলে একটি নেকী হয়। আর একটি নেকী নাকি দশটি নেকীর সমান।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই পড়েছ। তাছাড়া কুরআন শরীফ পড়া শুদ্ধ না হলে তো নামাজই সহীহ হবে না। তুমি কি কোনো সূরা মুখস্থ পারো?
হ্যাঁ, মক্তবে থাকতেই হুজুর আমাকে কয়েকটি সূরা মুখস্থ করিয়েছিলেন। হুজুর আমাকে সাবাস দিয়ে বলেছিলেন, সাকিব! তুমি তো মাশাআল্লাহ সবার আগে সূরাগুলো মুখস্থ করতে পেরেছ। সেজন্য তোমার উপর আমি অনেক খুশি।
অবশ্য তোমার পড়ায় কিছু কিছু ভুল এখনো রয়ে গেছে। এবার সেই ভুলগুলো শুদ্ধ করার চেষ্টা করো। জবাবে আমি বলেছিলাম, জ্বী হুজুর, অবশ্যই চেষ্টা করব।
তারপর? থামলে কেন? বলে যাও।
তারপর কী বলব হুজুর! সুরাগুলো আর শুদ্ধ করা হলো না। এ অবস্থায়ই আমি ঢাকা চলে এলাম।
আচ্ছা সাকিব! তুমি কি এখন আমাকে একটি সূরা শুনাতে পারবে?
পারব না কেন হুজুর! আমি তো ল্পদিন ধরে ভাবছি যে, আপনাকে আমার মুখস্থ করা সব ক;টি সূরা শুনাব। কিন্তু একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ, আজ যখন আপনি নিজ থেকেই শুনানোর জন্য বলেছেন, তখন এটাকে আমার সৌভাগ্য ছাড়া আর কি বলতে পারি, বলুন?
ঠিক আছে এবার তাহলে পড়া শুরু করো।
সাকিব সুললিত কণ্ঠে সূরা ফাতিহা পাঠ করে শুনাল। ইমাম সাহেব বললেন, মাশাআল্লাহ সুন্দর হয়েছে। আরেকটি সূরা শুনাও তো। সাকিব সূরা নাস পড়ল। এভাবে এক এক করে মোট পাঁচটি সূরা শুনাল। ইমাম সাহেব সূরা শুনে মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, সাকিব! তোমার ঐ মক্তবের হুজুরের কথাই ঠিক। তোমার পড়ায় কিছু ভুল রয়ে গেছে। তবে তোমার চক্তি বিগলিত কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হওয়া তিলাওয়াত শুনে আমি কিন্তু সত্যিই বিমোহিত হয়েছি।
হুজুর! আপনি একটু আগে বললেন, কুরআন তিলাওয়াত সহীহ-শুদ্ধ না হলে নামাজই হয় না। তাহলে যাদের তেলাওয়াত শুদ্ধ নয়, তারা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তারা কি তিলাওয়াত শুদ্ধ করার আগ পর্যন্ত নামাজ ছেড়ে দিবে?
তুমি একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছ। এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার প্রশ্নের জবাব হলো, যাদের তিলাওয়াত সহীহ নেই, এমনকি সূরা ফাতেহা সহ চার পাঁচটি সূরাও শুদ্ধ করে পড়তে পারে না, কিংবা একটি সূরাও মুখস্থ নেই, তাদেরকেও নামাজ পড়তে হবে। নামাজ মাফ নেই। তবে এভাবে যে, যারা একটি সূরা কিংবা নামাজের কোনো দোয়া-কালামই মুখস্থ পারে না তারা নামাজের সব জায়গায় সুবহানাল্লাহ বলে নামাজ শেষ করবে। আর যাদের তিলাওয়াত সহীহ নেই, তারা যেভাবে পারে সেভাবে পড়েই নামাজ আদায় করে নিবে। তবে যতটুকু কিরাআত শুদ্ধ করে না জানলে নামাজই হয় না অন্তত ততটুকু কিরাআত সহ নামাজের প্রয়োজনীয় দোয়া কালাম শিখার জন্য উভয় প্রকার লোককেই আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। যদি তারা যথাযথ চেষ্টা করে তাহলে আশা করা যায় যে, উপরিউক্ত নিয়মে নামাজ আদায় করার দ্বারাও তাদের নামাজ মেহেরবান খোদা কবুল করে নিবেন। তবে তারা যদি যথাযথ চেষ্টা না করে এভাবে নামাজ আদায় করে তবে তাদের নামাজ শুদ্ধ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কথাটি বুঝতে পেরেছ তুমি?
জ্বী হুজুর, বুঝতে পেরেছি। আল্লাহ আপনাকে অশেষ নেকী দান করুন।
হুজুর! আপনার কথা শুনে আমার খুব ভয় হচ্ছে যে, না জানি আমার এতদিনের একটি নামাজও আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নি।
যা হবার তো হয়েচি গেছে। এখন তুমি কিভাবে তোমার পড়া সহীহ করবে সে চেষ্টা করো।
জ্বী হুজুর। সে কথাটাই আমি বলতে চাচ্ছি। আমি এখন পরিস্কার করে বুঝতে পেরেছি, কুরআন শরীফ শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। হুজুর! রাত আটটার পর আমার কোনো কাজ নেই। আগে রাত এগারটা পর্যন্ত আমার ডিউটি ছিল। গত সপ্তাহে হাজী সাহেব আমার উপর সীমাহীন দয়া করেছেন। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘সাকিব! তুমি ছোট মানুষ। আমি লক্ষ্য করের দেখেছি, এত রাত পর্যন্ত কাজ করতে তোমার অনেক কষ্ট হয়। তাই আগামী কাল থেকে তোমার ডিউটি হবে রাত আটটা পর্যন্ত । সেদিন হাজী সাহেবের কথাটি শুনে আমি কত যে আনন্দিত হয়েছিলাম, তা আপনাকে ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারব না। হুজুর! আমাকে পড়ানোর জন্য আপনার কি একটু সময় হবে?
সময় না থাকলেও সময় করে নিতে হবে। একজন মুসলমান আল্লাহর কালাম পড়তে চাইবে, আর আমি সময় না থাকার অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দিব, এটা কখনো হতে পারে না। তুমি এক কাজ করো। আগামীকাল থেকেই পড়া শুরু করে দাও। এশার নামাজের পর থেকে নয়টা পর্যন্ত পড়বে। আমি ঐ সময়ের কাজগুলো অন্য সময় সেরে নিব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে হুজুর। এই মহানুভবতার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এটা মহানুভবতা নয় সাকিব। এটা আমার ঈমানী দায়িত্ব। আমার মনে চায় কি জানো? আমার মনে চায়, এ শহরের সেসব মুসলমান শুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে আমি আল্লাহর কালাম শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে সাহায্য করি। দিনরাত তাদের পিছনে মেহনত করি। আহা, আমার যদি এত ক্ষমতা ও সামর্থ্য থাকত! বড় দরদ নিয়ে কথাগুলো বললেন ইমাম সাহেব।
বহুত শোকরিয়া হুজুর। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমি আগামীকাল থেকেই যথাসময়ে পড়তে আসব।
ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার কারণে হোটেলে ফিরতে সাকিবের একটু দেরী হয়ে যায়। এতে বশীর সাহেবের ছোট ছেলে রফিক ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে—নামাজ পড়তে এতক্ষণ লাগে নাকি শুনি! আর কোনোদিন এরূপ করলে তোমার চাকরির বারটা বাজিয়ে ছাড়ব। যত্তসব!
সাকিব বিনীত কণ্ঠে জবাব দেয়—
ইমাম সাহেবের সাথে কুরআন শরীফ শিক্ষার ব্যাপারে একটু কথা বলেছিলাম। তাই ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।
ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি সিঙ্গারাগুলো ভেজে ফেলো।
দ্রুত জামা খুলে কাজে লেগে যায় সাকিব। আজ সে মহাখুশি। কারণ কাল থেকে সে ইমাম সাহেবের কাছে কুরআন শরীফ শিখতে যাবে।
এশার নামাজের পর আমপারা খুলে বসে সাকিব। ভালই পড়ে সে। ইমাম সাহেবের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অল্প দিনের মধ্যেই বেশ উন্নতি করে ফেলে। সারাদিন হোটেলের কাজে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সাকিব। এশার পর ছুটি পেলে আবার কুরআন শরীফ শিখতে যায়। সেখান থেকে এসে আবার বই পড়তে বসে।
একদিন রাতে মনোযোগ সহকারে আমপারা পড়ছে সাকিব। হঠাৎ সে হুজুরকে প্রশ্ন করে বসে—
হুজুর! আমি কি হাফেজ হতে পারব?
কেন পারবে না! যারা হাফেজ তারা তো তোমার মতোই মানুষ। তা হঠাৎ করে এ প্রশ্ন?
হুজুর! এটা আমার মায়ের তামান্না। ক’দিন আগে মাকে খাবে দেখেছি। তিনি বলেছেন, আমাকে হাফেজ ও আলেম বানানো তাঁর নাকি জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল।
কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
ইমাম সাহেব খানিক ভাবলেন। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সাকিব অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। যে কোনো পড়া একবারের বেশি দু’বার তাকে বলতে হয় না। তাঁর স্মরণ শক্তি খুবই প্রখর। এরূপ মেধাসম্পন্ন ছেলেদেরই হাফেজ ও আলেম হওয়া উচিৎ।
ইমাম সাহেব বললেন, আমি তাহলে তোমার মালিক অর্থাৎ হাজী বশীর সাহেবের সাথে আলাপ করে দেখি।
জ্বী আচ্ছা বলে সাকিব মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ায়।
আরো কিছুক্ষণ পড়ার পর সেদিনের মতো পড়া শেষ করে আপন আস্তানায় চলে আসে সাকিব।
আট
ইমাম সাহেবের নাম মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ। বাড়ি শরিয়তপুর জেলায়। গত পাঁচ বছর আগে তিনি কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেছেন। তারপর থেকে তিনি এই মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে আজিমপুর মাদরাসায় হাদীসের দরসও দেন তিনি। তাঁর ছাত্র ও মসজিদের মুসল্লিরা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। প্রাণভরে ভালোবাসে। কোনো কারণে দু একদিন অনুপস্থিত থাকলে তাদের মনটা যেন কেমন কেমন করে। মনে হয় কী একটা দুর্বল বস্তু যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে।
পরদিন হাজী বশীর সাহেবের সাথে সাকিবের পড়াশুনা নিয়ে আলাপ করতেই তিনি বলে ওঠলেন—না, না আমি তাকে বাধা দেব কেন? সে যদি মাদরাসায় পড়তে চায়, তবে আমি বরং তাকে সহযোগিতা করব। সাকিব মা হারা সন্তান। খুবই অমায়িক ও ভদ্র। সে যদি চেষ্টা করে হাফেজ হতে পারে, আলেম হতে পারে, দাঁড়াতে পারে নিজের পায়ে, তাহলে সেটাতো মহাখুশির কথা। উচ্ছসিত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন হাজী বশীর সাহেব।
তাহলে তাকে আগামী বুধবারেই মাদরাসায় ভর্তি করে দিয়ে আসি হাজী সাহেব?
হ্যাঁ, ও যখন পড়তে ইচ্ছুক তখন আর অনর্থক দেরী করে লাভ কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি করে দিন।
ইমাম সাহেব সাকিবকে মাদরাসায় ভর্তি করার সুসংবাদ দিয়ে নিজ কাজে চলে যান। এদিকে সাকিব এ অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।
কৃতজ্ঞতা আদায় করে মহান স্রষ্টার। অপেক্ষায় থাকে আগামী বুধবারের।
নয়
আজ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রি। বই পড়তে পড়তে রাত গভীর হয়। অথচ সাকিবের চোখে ঘুমের লেশ মাত্র নেই। এ যেন কিসের এক প্রতিক্ষা!
দরজা খুলে বাইরে আসে সাকিব। পূর্ণিমার রাত। দালান-কোটা, রাস্তা—ঘাট সব কিছুই রূপালী আলোয় উদ্ভাসিত। নীরব নিস্তব্ধ পৃথিবী। চতুর্দিকে শুধুমাত্র ঝি-ঝি পোকার একটানা ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। স্নিগ্ধ-শীতল ঝিরঝিরে বাতাস শরীরে আদরের পরশ বুলিয়ে মৃদুমন্দ গতিতে বয়ে চলছে। গাছের পত্র-পল্লবগুলো সমীরনের আলতু ছোঁয়ায় গাইছে আনন্দের গান।
সাকিবের দৃষ্টি তখন নিঃসীম নিলীমায়। সে কল্পনার পঙ্খিরাজে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। যেখানে কোনো বাধা নেই। নেই কোনো জবাবদিহিতা।
এ সময় ছোট বেলার বেশ কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে সাকিবের মানসপটে। মনে পড়ে পরম শ্রদ্ধাভাজন মায়ের কথা, ছোট্ট বোন খালেদার কথা, মনে পড়ে প্রিয় বন্ধু শাকিলের কথা, মনে পড়ে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কথা। সেই সাথে মনে পড়ে বিমাতার কিছু নিষ্ঠুর আচরণ ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কথা। মায়ের মৃত্যুর পর একদিন সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল। তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা সাকিবকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে সাকিব! কাঁদছিস কেন? ক্ষুধা পেয়েছে?
হ্যাঁ, সেদিন কিন্তু সাকিব ক্ষুধার কারণেই কেঁদেছিল। তবু সে মহিলার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। দিতে পারে নি। মুখ খুলে বলতে পারে নি যে—ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়েই আমি কাঁদছি। কারণ, ছোট মা রাশেদা খানম তখন দাঁড়ানো ছিল তাঁর কাছেই। সাকিব যদি জবাব দিত , তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বলতেন, কি বললি তুই? নিমুক হারাম কোথাকার! পেটের ক্ষুধায় কাঁদছিস? তুই না একটু পূর্বে গলা পর্যন্ত খেয়ে গেলি? মূলত এ ভয়েই সাকিব সেদিন কিছু না বলে চুপ থেকেছিল।
এ ঘটনার দিন সাকিব খেয়েছিল ঠিকই। সেটা ছিল দুপুরের খাবার। কিন্তু খাবারের পরিমাণ এত কম ছিল যে, বিকেলেই তাঁর ক্ষিধে লেগে গিয়েছিল। ঘটনা হলো, সাকিব খেতে বসলে চেহারাটা কালো করে রাশেদা খানম প্রথমে সাকিবের প্লেটে অল্প কটি ভাত দেয়। সেগুলো শেষ গেলে সাকিব আবার ভাত চায়। রাশেদা খানম আবারো চেহারাটা কালো করে দু’চামচ পরিমাণ ভাত সাকিবের প্লেটে ছুড়ে মারে। সাকিবের পিতা তখন ঘরে ছিল না। তাছাড়া সে অনেকটা লাজুক প্রকৃতির ছেলে। তাই মায়ের এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আবার ভাত চাওয়া সম্ভব হয় নি তাঁর। সুতরাং সেদিন তাকে একরকম অভুক্ত থেকেই খাওয়া থেকে উঠে যেতে হয়েছিল।
সেদিনের পর থেকে এ ধরণের ঘটনা একদিন-দু’দিন নয়, প্রায়ই ঘটত। এমন কি রাশেদা খানম সাকিবের গায়ে হাত তুলতেও কোনোরূপ পরওয়া করত না। একবার সাকিবের পিতা তিন মাসের জন্য বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে ছিলেন। বাড়িতে ফিরে সাকিবের দিকে তাকাতেই আঁৎকে উঠেন। তাঁর দু’চোখ আড়ষ্ট হয়ে যায়। একি অবস্থা হয়েছে সাকিবের! জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেছে তাঁর কচি দেহখানা। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে কপালের চার পাশে। চোখ দুটো বসে গেছে। কালো হয়ে গেছে মুখখানা। পিঠের কয়েক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন বিদ্যমান। গায়ের জামা ছিঁড়ে গেছে। পিঠের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। আতাউর রহমানের বুকে যেন একটি ব্যাথা মোচড় দিয়ে ওঠল। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে নিলেন তিনি। তারপর সাকিবের কাছে জানতে চাইলেন, তোমার এ অবস্থা কেন? সাকিব তখন কিছু না বলে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। অবশেষে অনেকবার বলার পর সে যখন সবকিছু খুলে বলল, তখন তিনি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। স্ত্রীকে লক্ষ্য করে কেবল এতটুকু বলেছিলেন, রাশেদা! সাকিব তোমার সৎ ছেলে বলে তাঁর সাথে তুমি এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলে? এমন ভাবে তাকে মারতে পারলে? পারলে প্রয়োজনীয় খানাপিনা থেকে তাকে বঞ্চিত রাখতে? আচ্ছে তুমিই বলো, তোমার গর্ভের সন্তান হলে তুমি কি পারতে তাঁর সাথে এমন অমানবিক আচরণ করতে?
জবাবে তখন রাশেদা খানম হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, আমি যা করার করেছি। প্রয়োজনে আরো করব। ওর হাড্ডি আমি গুড়ো করে ছাড়ব। তুমি আমাকে কিছু করতে পারলে কইরো।
আতাউর রহমান বললেন, তোমার মতো বাঘিনী বউকে আমার মতো ভীরু পুরুষেরা কি-ই-বা করতে পারবে! তবে মনে রেখো, অত্যাচারের সাজা কিন্তু দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয়।
এসব স্মৃতি মন্থন করতে করতে বিছানায় ফিরে এসে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে সাকিব। পাখির প্রভাতী গানে ঘুম ভাঙ্গে তাঁর। পূর্বাকাশের কোল ঘেঁষে একটি লাল রেখা দিনের আগমনী বার্তা দিয়ে সকলকে সুপ্রভাত জানায়। হাজী সাহেবের বাগান থেকে ভেসে আসা কামিনী ফুলের সৌরভে এক মনমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এখন খুব ভাল লাগছে সাকিবের। ফজরের নামাজের কিছুক্ষণ পর সকালের নাস্তা সেরেই সে যাবে মাদরাসায় ভর্তি হতে। আবার সে ফিরে পাবে ছাত্র জীবন!
বেলা আটটার দিকে তিন সেট কাপড় নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন হাজী বশীর সাহেব। বলেন, এই নাও সাকিব। তুমি পড়তে যাবে শুনে খুশি হলাম। আল্লাহ তাআলা তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। আমার ছেলেগুলোকে লেখাপড়া শিখানোর জন্য অনেক চেষ্টা-তদবীর করলাম। টাকা পয়সাও কম খরচ করি নি। কিন্তু কোনো ফল হলো না। ছোট ছেলেটাতো কথাই শোনে না। কোথায় থাকে, কোথায় কি করে সে-ই জানে। খাবার সময় হলে চুপটি মেরে খেয়ে আবার বের হয়ে যায়। সারাদিন আর পাত্তা থাকে না।
ইমাম সাহেব মাদরাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে চলে আসেন। তিনি দরজার সামনে দাঁড়াতেই হাজী সাহেব সালাম দিয়ে বললেন, আসুন হুজুর আসুন। এই কে আছিস? হুজুরকে নাস্তা দে।
না, হাজী সাহেব। আমি এই মাত্র নাস্তা সেরে এসেছি। সাকিব যদি নাস্তা না খেয়ে থাকে তাহলে তাকে খাইয়ে দিন। সময় খুব কম। ওকে ভর্তি করে আমার ক্লাসে যেতে হবে।
ইমাম সাহেবের চা এগিয়ে দিয়ে নাস্তা খেয়ে নেয় সাকিব। তারপর কাপড়ের পুটুলিটা হাতে নিয়ে বিদায়ের জন্য হাজী সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ায়। হাজী সাহেব সাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলেন, যাও বাবা। আল্লাহ তোমার সহায় হউন। তুমি বড় হও। অনেক বড় হও। দেশ ও জাতির সেবায় নিজকে নিয়োজিত রাখো—সব সময় দয়াময় মাবুদের কাছে এই দোয়াই করবো।
সাকিবের দু’গণ্ড বেয়ে ক্ষীণ দুটি অশ্রুধারা নীরবে বয়ে যায়। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্বপ্নে শ্রুত মায়ের কথাগুলো। নতুন জীবনেরর আশায় ইমাম সাহেবের পিছু পিছু চলতে থাকে সাকিব। পিছনে পড়ে থাকে হোটেলের কর্মময় জীবনের অসংখ্য স্মৃতি। যে স্মৃতি তাকে কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়।
দশ
নাঈমা এখন সুন্দর করে রিডিং পড়তে পারে। তাঁর রিডিং পড়া বেশ স্বচ্ছ ও পরিস্কার। যত কঠিনই হোক না কেন, সে খুব দ্রুত অনর্গল পড়ে যেতে পারে। কোথাও আটকায় না সে।
মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর সাকিব প্রায়ই হাজী সাহেবের বাসায় আসত। এ আসার পিছনে যতটা না সাকিবের ইচ্ছা কাজ করত তাঁর চেয়ে বেশি কাজ করত হাজী সাহেবের স্নেহমাখা নির্দেশ। মাদরাসায় ভর্তি হতে যাওয়ার দিন হাজী সাহেব পরম মমতায় সুরে বলেছিলেন—বাবা! তুমি কিন্তু প্রতি মাসে দু তিন বার না পারলেও অন্তত একবার হলেও আমাদের দেখে যেও। আমরা কিন্তু তোমাকে কখনো ভুলতে পারব না।
সাকিব তখন বলছিলেন, চাচাজান, আমি যে কোনো মূল্যে আপনার আশা পূর্ণ করব ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য খাস করে দোয়া করবেন।
একদিন সাকিব কোনো কাজে নাঈমাদের বাসায় গিয়ে দেখল, নাঈমা তাঁর পড়ার টেবিলে বসে গুনগুন করে একটি বাংলা বই দ্রুত পড়ে যাচ্ছে।
সাকিব তাকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে বলল, পড়া বেশ জমে উঠেছে দেখছি!
সাকিবের আওয়াজ পেয়ে নাঈমা ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকায়। সাকিবকে দেখতে পেয়ে কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় যেন! কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য।
পরক্ষণেই সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে, বেশি না পড়ে উপায় নেই যে!
মানে! সাকিবের কথায় কৃত্রিম বিস্ময়।
মানে হলো, ভালো করে পড়তে না পারলে ম্যাডাম বকা দেন। তাছাড়া…।
থামলে কেন? বলো।
না মানে বলছিলাম যে, ভালো করে রিডিং পড়তে না পারলে আপনার গল্পের বইও তো পড়তে পারব না।
ও সে কথা তুমি এখনও মনে রেখছ!
জ্বী, মনে রেখেছি।
তা একটু পড়ে শোনাও তো দেখি কেমন পড়তে পার!
নাঈমা আবারও লজ্জা পায়। তথাপী সে বইয়ের একটি পৃষ্ঠা সুন্দর করে সাকিবকে পাঠ করে শোনায়।
এতটুকুন মেয়েকে এত সুন্দর ও শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা পড়তে দেখে সাকিব বিস্মিত হয়। মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নাঈমার মুখপানে। তারপর সেই পৃষ্ঠা থেকে সে তাকে কয়েকটি প্রশ্ন ও শব্দের বানান জিজ্ঞেস করে।
নাঈমা দেরী না করে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে চটপট উত্তর দেয়। নির্ভুল ভাবে শব্দগুলো বানান করে।
অতঃপর ইংরেজী বই থেকে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করলে সেখানেও নাঈমা স্বীয় দক্ষতার পরিচয় দেয়। এমন সুন্দর করে উত্তরগুলো প্রদান করে মনে হয় সে যেন এইমাত্র উত্তর গুলো মুখস্থ করে এসেছে।
পড়া শোনার পর্ব শেষ হলে নাঈমা বলল, সাকিব ভাইয়া! এবার কি আমি আপনার বই পড়ার উপযুক্ত হয়েছি?
হ্যাঁ, খুব উপযুক্ত হয়েছ।
তাহলে নই কখন পাচ্ছি?
পাবে। অতি তাড়াতাড়িই পাবে।
একটা তারিখ দেন না?
তারিখ দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমি এদিকে আসব।
তখন তোমার জন্য বই নিয়ে আসব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে বলে নাঈমা হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা সামান্য কাত করে। তারপর বলে, ভাইয়া! খেয়াল করে আনবেন কিন্তু। না হয় খুব কষ্ট পাব আমি।
কষ্ট পেতে হবে না। আমি অবশ্যই তোমার জন্য হৃদয় গলে সিরিজের বই নিয়ে আসব।
হৃদয় গলে সিরিজের বই মানে? তখন না বললেন বইটির নাম যে গল্পে হৃদয় গলে!
ওহু! তোমাকে তো সে কথাটা বুঝিয়ে বলা হয়নি। তাই ব্যাপারটি তুমি বুঝতে পারনি। আসল ব্যাপার হলো, ;হৃদয় গলে’ হলো চরিত্রগঠনমূলক একটি সুন্দর সিরিজের নাম। অর্থাৎ একই লেখকের এ বইগুলো একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। আর যে গল্পে হৃদয় গলে হলো সেই সিরিজেরই প্রথম তিনখন্ড বইয়ের নাম। এবার বুঝেছ?
বুঝেছি। তো অবশিষ্ট বইগুলোর নাম কি?
একেকটার একেক নাম। তুমি যখন পড়বে তখন সাথে সাথে নামও জেনে নিতে পারবে।
কয়েকটি নাম বলুন না।
তুমি দেখছি বই পড়ার আগেই নাম মুখস্থ করে নিতে চাও।
মুখস্থ করা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো, নামগুলো শুনলে পড়ার আগ্রহটা হয়তো আরো বেড়ে যাবে।
তা অবশ্য ঠিক।
বলুন তাহলে।
যেমন, যে গল্পে অশ্রু ঝরে, যে গল্পে হৃদয় কাড়ে, যে গল্পে জুড়ে, যে গল্পে মানুষ গড়ে, যে গল্পে ঈমান বাড়ে, নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী, হৃদয়বিদারক করুণ কাহিনী, সোনালী সংসার ইত্যাদি।
আচ্ছা ভাইয়া! এই সিরিজের সব গুলো বইয়ের মধ্যেই কি গল্প আছে?
হ্যাঁ, দু একটা বাদে সবগুলোই গল্পের বই।
উহ! তবে তো আমি অনেক গল্প পড়তে পারব। তাই না ভাইয়া!
ঠিকই বলেছ তুমি। তবে শুধু গল্প পড়লেই চলবে না।
আর কি করতে হবে? নাঈমার প্রশ্ন।
গল্প পড়ে আমল করতে হবে।
তা তো অবশ্যই। গল্প শুনে আমল না করলে কি আর আমি আব্বু আম্মুর এত বাধ্য হই!
তাঁর মানে! সাকিবের কণ্ঠে বিস্ময়।
মানে হলো, ওই যে আপনি আমাকে হৃদয় গলে সিরিজের বই থেকে পিতা মাতার খেদমত ও তাদের কথা মান্য করা সম্পর্কে কয়েকটি গল্প শুনিয়েছিলেন, সেগুলো শুনেই তো আমি এখন পিতা—মাতার বাধ্য সন্তান।
এবার তাহলে ঘটনাটা বুঝতে পারলেন?
হু, বুঝেছি। আল্লাহ তোমাকে শুধু পিতা মাতা নয়, ভাইদের সহ বড়দের কথাও মেনে চলার তাওফীক দান করুণ।
পিতা মাতা আর দুইভাই ছাড়া আমার বড় কে আছে যার কথা আমাকে মেনে চলতে হবে?
তোমার এ প্রশ্নের জবাব আজ নয়। সময় মত পেয়ে যাবে। আজ তাহলে আসি। কেমন?
আচ্ছা আসুন। আল্লাহ হাফেয।
সেদিন নাঈমার মায়াবী চাহনি আর তীক্ষন মেধার পরিচুয় পেয়ে তাঁর প্রতি একটা হৃদয়ের টান অনুভব করে আপন গন্তব্যে ফিরেছিল সাকিব!
এগার
সাকিব লেখাপড়ায় বেশ ভাল। মাত্র দেড় বছরে হেফয শেষ করেছে সে। তারপর জামাত বিভাগে ভর্তি হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর একটি ক্লাসও বাদ যায় নি। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হওয়াকে সে নিজের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছে। প্রতিদিন সে ভালোভাবে পড়া মুখস্থ করে আসে। যেসব ছাত্র ক্লাসের পড়া ভালো করে বুঝতে পারে না, সে তাদেরকে আবার বুঝিয়ে দেয়। সে সবাইকে বলে দিয়েছে, পড়া সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যার জন্য আমি তোমাদের পাশে আছি। তোমরা যে কোনো সময় নির্দ্বিধায় আমার কাছে আসতে পারো।
সময় আপন গতিতে গতিময়। এর ঘুর্ণায়মান চাকাটি কখনো ক্লান্ত হয় না। চলতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কার সাধ্য আছে তাঁর পথ রুখে দাঁড়াবার!
কালের এই পরিক্রমায় সাকিব ধীরে ধীরে বড় হয়। সেই সাথে প্রতিটি ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে আজ সে ইফতা বিভাগের নামকরা ছাত্র। গতবছর দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষায় বোর্ডের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সে।
সাকিবদের ক্লাসে নিয়মিত আসতেন তাদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুফতি শফীউল্লাহ সাহেব। তিনি খুব মিশুক প্রকৃতির লোক। নামকরা এক আল্লাহর ওলী থেকে প্রায় এক যুগ আগে খেলাফত প্রাপ্ত হয়েছেন। সর্বদা তাঁর মুখে আল্লাহর জিকির লেগেই থাকে। ঠোঁট দুটি নড়তে থাকে অবিরতভাবে। তাঁর বিনম্র আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র সত্যিই ঈর্ষাণীয়। ছাত্রদেরকে তিনি আপন সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। আদর করেন। এজন্য সব ছাত্রই নিঃসংকোচে মনে উদয় হওয়া বিভিন্ন প্রশ্ন তাঁর নিকট করে। তিনি হাসিমুখে জবাব দেন। অতি জটিল বিষয়গুলোও খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দেন। তাঁর একটি বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে যুগোপযোগী আলেম বানানোর জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চ্চালান। মজবুত ঈমান ও পরিপূর্ণ আমলদার তৈরির ফিকির করেন।
একদিন মুফতি সাহেব যথারীতি ক্লাস করলেন। যাওয়ার পূর্বে ছাত্রদের বললেন, আচ্ছা! তোমরা তো মাশাআল্লাহ আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর অসীম শক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছ। জানোও অনেক কিছু। আমি আগামীকাল তোমাদের মুখ থেকে এ বিষয়ে কিছু শুনতে চাই। কী বলো তোমরা?
ছাত্ররা বলল, জ্বী হুজুর। আমরা তৈরি থাকব।
সাকিবদের ক্লাসে মোট বারজন ছাত্র। সবাই মেধাবী এবং যুগ সচেতন আলেম। ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী হওয়া ছাড়াও দুনিয়ার উত্থান-পতন ও অবস্থা সম্পর্কে বেশ ওয়াকেফহাল তারা। পরদিন মুফতি সাহেব ক্লাসে এসে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রশ্ন করে নির্ধারিত বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা শুনলেন। সবশেষে তিনি সাকিবকে লক্ষ্য করে বললেন, মাওলানা সাকিবুল হাসান! তুমি বলো তো, সুখি জীবন লাভের উদ্দেশ্যে উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তালার উপর একজন মুমিন ও কাফেরের বিশ্বাস কেমন হয়ে থাকে?
সাকিব দাঁড়িয়ে যায়। সবার দৃষ্টি তখন সাকিবের মুখের দিকে। কক্ষে পিনপতন নীরবতা। আধঘন্টা পরেই আছরের আযান হবে। সুতরাং এর মধ্যেই সাকিবের মূল কথাগুলো বলে শেষ করতে হবে। সে বলতে থাক—
সুখী জীবন সবাই কামনা করে। সুখী ও স্বাচ্ছন্দময় জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ শারীরিক সুস্থতা ও দুনিয়াবী বস্তু—সামগ্রী হাসিল করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। এ চেষ্টা কাফেররা যেমন করে, মুমিনরাও করে। তবে এ ব্যাপারে একজন মুমিন ও কাফিরের মাঝে আক্বিদা-বিশ্বাস ও ধ্যান—ধারণার ক্ষেত্রে আকাশ পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। যদিও মুমিন ব্যক্তি দুনিয়াবী কোনো কার্যসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ও উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে, কিন্তু মুমিনের হৃদয়ে সর্বদাই এ বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকে যে, এসব মাধ্যম ও উপকরণ ওসিলামাত্র। এগুলোর দ্বারা কিছুই হবে না, হতে পারে না—যদি আল্লাহ তাআলা চান। আবার তিনি যদি চান, তবে কোনো আসবাব ও উপকরণ ছাড়াই সব কিছু হতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কোনো কার্য হাসিল হওয়ার ব্যাপারে মুমিনগণ একমাত্র আল্লাহ তাআলার উপরই ভরসা করে এবং তাঁর প্রতিই তাদের নিবদ্ধ রাখে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি বেকার থাকে, আর সে চাকরীর প্রত্যাশী হয়, তাহলে সে চাকুরী পাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে এবং চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠানে আবেদনপত্র জমা দেয়। তৎসঙ্গে প্রয়োজনে সুপারিশ করানো সম্ভব হলে, সুপারিশও করায়। এসব হচ্ছে বাহ্যিক কার্যকলাপ, যেখানে একজন কাফের ও একজন মুমিনের কোনো পার্থক্য নেই।
কিন্তু এ বিষয়ে আক্বিদা-বিশ্বাসস ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তা হলো-কাফির ব্যক্তি নিজের কর্মদক্ষতা, আবেদন পত্র নির্ভুল হওয়া এবং উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা সুপারিশ করানো ইত্যাদির উপরই ভরসা করে থাকে এবং এসব উপায়-উপকরণগুলোকেই কার্য হাসিল হওয়ার একমাত্র মাধ্যম বলে মনে করে। পক্ষান্তরে একজন মুমিন যদিও চাকুরীর জন্য এসব উপায় উপকরণ গ্রহণ করেন, কিন্তু কার্যসিদ্ধির জন্য একমাত্র আল্লাহ তাআলার উপরই ভরসা করেন।
অনুরূপভাবে অসুখ—বিসুখ হলে আরোগ্য লাভের জন্য ডাক্তার দেখানো, ঔষধ সেবন এবং দাক্তারের বিধি-নিষেধ মান্যকরণ ইত্যাদি যদিও একজন মুমিন ও কাফের উভয়েই গ্রহণ করে থাকে, কিন্তু উভয়ের আক্বিদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে রয়েছে অসামান্য ফারাক। তা এই যে, একজন কাফের, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সঠিক হওয়া, উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা, ডাক্তার অভিজ্ঞ হওয়া প্রভৃতির উপরই ভরসা করে থাকে। কিন্তু একজন মুমিন আরোগ্য লাভের ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তাআলার উপরই ভরসা পূর্ণ আস্থা ও ভরসা করে থাকেন। তিনি এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, আল্লাহ যদি আরোগ্য দান করেন, তবেই ডাক্তারের চিকিৎসা ও ঔষধের দ্বারা আরোগ্য লাভ হতে পারে। আর তিনি যদি আরোগ্য দান না করেন, তবে দুনিয়ার যত বড় ডাক্তার আর উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিই অবলম্বন করা হউক না কেন, কোনো কিছুই কাজে আসবে না।
এমনিভাবে কৃষিকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি মুমিন-কাফের উভয়েই করে।
তবে কাফের ব্যক্তি এসব ক্ষেত্রে উন্নত পদ্ধতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকেই সফলতার সোপান বলে মনে করে। সে মনে করে, যদি উপযুক্ত সময়ে নিয়মানুযায়ী কৃষি বীজ বপন করা যায়, প্রয়োজনীয় পরিচর্চা করা যায়, সার-পানি ঠিকমত দেওয়া যায়, উপযুক্ত পরিবেশে দক্ষ লোক দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করা যায়, তাহলে এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই কামিয়াব হওয়া যাবে।
পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তি বিশ্বাস করে, ব্যবসায় লাভ হওয়া, কৃষিপণ্য ঘরে তোলা ইত্যাদি তখনই সম্ভব যখন আল্লাহ তাআলা চাইবেন। যদি আল্লাহ পাক না চান, তবে কৃষি পদ্ধতি যত উন্নতমানেরই হউক না কেন, ব্যবসা-বাণিজ্য যত অত্যাধুনিক সিস্টেমেই করা হউক না কেন, তা কখনোই সফলতার মুখ দেখবে না। বরং দিন দিন কেবল অবনতির দিকেই যেতে থাকবে।
নবী করীম (সাঃ) আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন যে, রোগ হলে তোমরা ঔষুধ সেবন করো, বিভিন্ন কাজ ও সমস্যা সমাধানের জন্য উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ করো, কিন্তু আরোগ্য লাভ বা কার্যসিদ্ধির ব্যাপারে তোমাদের ভরসা ও আস্থা যেন বস্তুত প্রতি না হয়, বরং একমাত্র আল্লাহর উপরই যেন হয়।
বস্তুত লক্ষ্য উদ্দেশ্য সঠিক হওয়ার মধ্যেই দীনদারীর মূল তত্ত্ব নিহিত আছে। বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার শক্তি ও ক্ষমতার উপর ভরসা করে কোনো কাজ করে তখন ঐ কাজ তাঁর দীনদারী ও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আর যদি উক্ত কাজটি দুনিয়ার বস্তু—সামগ্রীর উপর ভরসা করে করা হয়, তবে তা দুনিয়াবী কার্য বলে গণ্য হয়। সুতরাং মানবজীবনে কৃতকার্য হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে—জীবনের প্রতিটি কার্য সমাধার ক্ষেত্রে বস্তু ও আসবাব থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহ পাকের শক্তি ও ক্ষমতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা এবং এই আস্থা ও ভরসা স্থাপন করা যে, যা কিছু হচ্ছে এবং যা কিছু হবে, সবই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হচ্ছে এবং হবে। আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছাড়া বস্তু ও উপকরণের এককভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, বস্তুত যখন কোনো কিছুই এককভাবে করার ক্ষমতা নেই, তাহলে আল্লাহ তাআলা বস্তুত মধ্যে বিভিন্ন প্রভাব দিতে রেখেছেন কেন? যেমন, আগুনের মধ্যে পুড়ানোর ক্ষমতা, পানির মধ্যে ডুবানোর ক্ষমতা, ঔষধের মধ্যে রোগ আরোগ্যের ক্ষমতা ইত্যাদি। এর সহজ জবাব এই যে, এসকল বস্তুত মধ্যে আল্লাহ তাআলা এজন্যেই প্রভাব সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, মানুষের দৃষ্টি কি এসব বস্তু ও উপকরণের মধদ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, নাকি মানুষ এসকল বিষয়ের অন্তরালে মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, তা পরীক্ষা করে দেখা।
তবে দুঃখের বিষয় এই যে, বাস্তবে তালাশ করলে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাসের বেলায় আজকাল অনেক মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন কাফের যেমন বস্তুত উপর ভরসা করে, তেমনি অনেক মুমিনও বস্তুত উপর ভরসা করে বসে থাকে। তাদের দৃষ্টিও কাফেরদের ন্যায় বস্তু ও উপায়-উপকরণের উর্ধ্বে ওঠে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায় না। এ যে মুমিন জীবনের কত বড় ব্যর্থতা, দুনিয়া ও আখেরাতে কত বড় ক্ষতির কারণ, তা ভাবতে গেলে শরীর শিহরিয়ে ওঠে। দু’চোখ দিয়ে নেমে আসে অশ্রু-বন্যা।
তাই আমাদের উচিৎ হবে, সকল কাজ ও সমস্যা সমাধানের জন্য সামর্থানুযায়ী প্রয়োজনীয় সবকিছু করার পরও মহান আল্লাহ তাআলার উপরই ভরসা করা এবং দুনিয়ার চীজ ও আসবাবকে আল্লাহ তাআলার হুকুমের দাস বলে জ্ঞান করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন আমীন।
এ বলে সাকিব তাঁর কথা শেষ করে।
সাকিবের সংক্ষিপ্ত অথচ বিষয়ভিত্তিক সারগর্ভ আলোচনা শুনে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়। হতবাক হন মুফতি শফীউল্লাহ সাহেবও। তিনি চিন্তা করতে থাকেন, এই সোনার ছেলেকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারলে তাঁর দ্বারা আল্লাহ চাহে তো, দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ সমাধা করা সম্ভব হবে।
কিছুক্ষণ পর আছরের আযান শুরু হলে সবাই নামাজের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
বার
প্রায় আট মাস পরের কথা। সাকিব ইতোমধ্যে ইফতা বিভাগ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পাশ করে মুফতি হয়ে বের হয়েছে। বের হয়েছে তাঁর সাথীরাও। পড়াশুনা শেষ করার পর বার জনের সবাই মুফতি সাহেবের হাতে বায়আত হয়েছে। সেই সাথে তাকে মুরব্বী হিসেবে মেনে নিয়ে এ কথার অঙ্গীকার করেছে যে, তারা সর্বদা তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলবে। তাঁর পরামর্শ না নিয়ে কেউ কিছু করবে না।
মুফতি শফীউল্লাহ সাহেব এই আট মাস চিন্তা করেছেন। ফিকির করেছেন। বারবার ভেবেছেন, অন্যদের সাথে পরামর্শ করেছেন—কিভাবে প্রতিভাবান এই ছেলেগুলোকে কাজে লাগানো যায়। কিভাবে তাদের দ্বারা দীনের বড় কোনো খেদমত আঞ্জাম দেওয়া যায়।
স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে কায়মনোবাক্যে ফিকির করতে থাকে, চেষ্টা করতে থাকে, কাকুতি মিনতি করে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকে তখন আল্লাহ আপক তাকে সাহায্য করেন। সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুলে দেন। হযরত মুফতি সাহেবের বেলায়ও তা-ই হলো।
গভীর চিন্তা ও পরামর্শের পর মুফতি সাহেব তিনটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তা এই যে—
১। এ বছর কাকরাইলের ‘তিন দিনের জোর’ থেকে বারজনের সবাইকে তিনি এক বছরের জন্য তাবলীগ জামাতে পাঠিয়ে দিবেন।
২। জামাত থেকে ফিরার পর তিনি মাওলানা সাকিবুল হাসানকে প্রধান বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে একটি গবেষণা কেন্দ্র খুলবেন। যেখানে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সমস্যা ও তা সমাধানের বিভিন্ন উপায় নিয়ে প্রত্যহ আলোচনা করা হবে। এই গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরবর্তীতে নির্ধারণ করা হবে।
৩। সবাইকে ঢাকা শহরে অবস্থিত কাছাকাছি কয়েকটি মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। গবেষণা কেন্দ্রটি হবে মাঝামাঝি কোনো স্থানে।
সেখানে কম্পিউটার ছাড়াও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও বই-পুস্তক থাকবে। এই কেন্দ্রে তারা প্রতিদিন বিকালে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও মতবিনিময় করবে।
তের
সাকিব ও তাঁর সাথীরা মুফতি সাহেবের সিদ্ধান্তকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়। তাদের কথা হলো, হুজুরকে যখন মুরব্বী বানিয়েছি, তাঁর কাছে যখন সব কিছু সমর্পন করেছি, সুতরাং তাঁর সিদ্ধান্ত মানার মধ্যেই আমাদের কামিয়াবী ও সফলতা নিহিত আছে। অবশ্য মুফতি সাহেবও তাদের পরামর্শ করে সিদ্ধান্তগুলো পাকা করেছেন।
সাল শেষ হলো। সাকিব ও তাঁর সাথীরা এই এক বছরের মধ্যে দেশের প্রায় সব কটি জেলায় জামাত নিয়ে ঘুরাফেরা করেছে। শহর, গ্রাম, পার্বত্য অঞ্চল—এক কথায় কমবেশি সময় সব খানেই তারা লাগিয়েছে। বছরের এই দীর্ঘ সফরে কতভাবে যে তারা খোদায়ী মদদ বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর কোনো ইয়াত্তা নেই। এই সময় লাগানোর দ্বারা তাদের ঈমান-আমলে যেন নতুন করে রঙ্গ লেগেছে। চরিত্র—মাধুর্য যেন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতসব উপকারিতা ছাড়াও এই সফরের মাধ্যমে তাদের সব চেয়ে বড় ফায়দা হয়েছে তাহলো, উম্মতের দরদ ও ভালবাসা তাদের অন্তরে আরো শক্তভাবে গ্রোথিত হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গোটা উম্মতকে কিভাবে সৎপথে আনা যায়, কিভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যায়—এই ফিকিরে তারা গটা দিন অতিবাহিত করতে থাকে।
উম্মতে মোহাম্মদী বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি সাকিবদেরব অত্যধিক দরদ ও ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, তারা বছর ব্যাপী এই দীর্ঘ সফরে এমন অসংখ্য মুসলমান পেয়েছেন, যারা ঠিকমত কালেমাটা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারে না। আর যেসব লোকেরা কালেমার উচ্চারণও ঠিক হয় না, শরীয়তের অন্যন্য হুকুম-আহকাম সম্পর্কে তাদের কতটুকু জ্ঞান আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। লোকদের এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সাকিবরা মনে দারুণ ব্যথিত হয়, চোখ ফোটে কান্না আসতে চায়। তাই তখন থেকেই তারা প্রতিজ্ঞা করে, মৃত্যু পর্যন্ত তাবলীগের এই মোবারক কাজের সাথে জড়িত থাকবে। মাদরাসায় পড়ানোর সাথে সাথে সাধারণ মানুষকেও নামাজ-কালাম শিখাবে, ঈমান-আমলের তালীম দিবে। দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে আখেরাতমুখি করার চেষ্টা করবে।
তাবলীগ জামাত থেকে ফিরার কয়েকদিনের মধ্যেই সাকিবদের খেদমতের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মুফতি শফীউল্লাহ সাহেব এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে একথা স্থির করেছেন যে, সাকিবরা সবাই মাত্র দুটি করে হাদীসের ক্লাস করাবে। বাকী সময়টুকু তারা গবেষণা, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, যুগোপযুগী বই-পুস্তক রচনা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রভৃতি কাজে ব্যয় করবে। তাছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কাকরাইল মারকাজ মসজিদে রাত্রিযাপন ছাড়াও তাবলীগের দৈনন্দিন ও সাপ্তাহিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে।
চৌদ্দ
ঢাকা ফকিরাফুল। আব্দুল মালেক মার্কেটের চতুর্থ তলা। সাকিব ও তাঁর সাথীরা পরামর্শ মোতাবেক সেখানেই তাদের গবেষণা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। সেন্টারের নাম রাখে, আল ফালাহ ইসলামী রিচার্স সেন্টার। এই সেন্টারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুফতি শফীউল্লাহ সাহেবকে রাখা হয়। উদ্বোধনের দিন মুফতি সাহেব ছাড়াও ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশের নামকরা ও বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল সেই রিচার্স সেন্টার। মেহমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম আসেন সর্বজন প্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব দৈনিক নয়া দিগন্তের সহ-সম্পাদক মাওলানা লিয়াকত আলী সাহেব। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসেন প্রবীণ ভাষাসৈনিক প্রফেসর আব্দুল গফুর, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ও মাওলানা যাইনুল আবেদীন । রিচার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মাওলানা সাকিবুল হাসানের কালিমাতুশ শোকরের মাধ্যমে সাদাসিধেভাবেই শুরু হয় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। এরপর মেহমানরা সবাই একের পর এক রিচার্স সেন্টারের কার্যক্রম বেগবান করার উপায় নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। সেই সাথে এর ধারাবাহিক উন্নতি ও সমৃদ্ধইর জন্য দোয়া ও সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এসব বিশিষ্ট জনের অপরিসীম আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখে সাকিবরা মুগ্ধ হয়। সব শেষে সভাপতির মূল্যবান ভাষণ ও দোয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
পনের
হাজী ভবন। এই অত্যাধুনিক পাঁচতলা ভবনের মালিক হাজী বশীর সাহেব। স্ত্রী-পুত্র ও একমাত্র মেয়ে নাঈমাকে নিয়ে তিনি দু তলায় বসবাস করেন। বাকি তলাগুলো ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। প্রতি মাসে হোটেলের আয় ছাড়াও বাসা ভাড়া বাবদ বেশ টাকা আয় হয় তাঁর। সাকিবের পড়াশুনা থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ তিনিই বহন করেন। অবুশ্য মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব এবং সাকিবের মুরব্বী মুফতী শফীউল্লাহ সাহেবও মাঝে মধ্যে সাকিবের হাত খরচের জন্য দু’চারশ টাকা তাঁর হাতে উঠিয়ে দেন। সাকিব অবশ্য তাদের টাকা নিতে চায় না। কিন্তু তাদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত না নিয়ে পারে না।
সাকিব প্রতিমাসে নিয়মিত হাজী সাহেবের বাসায় আসত। কখনো খরচের টাকাত জন্য। কখনো বেড়ানোর জন্য। সাকিব যখনই আসত, নাঈমার জন্য বই নিয়ে আসত। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন হয়ে গেল, সাকিব হাজী সাহেবের বাসায় আসবে আর তাঁর হাতে বই থাকবে না, এ যেন কল্পনাও করা যায় না। একদিন অতি ব্যস্থতার দরুণ সাকিব বই না নিয়েই চলে এসেছিল। সেদিন অবস্থা এই হয়েছিল যে, গোটা হাজী ভবনে নাঈমা আছে কি নেই, তা বুঝা যাচ্ছিল না। পরে খোঁজ নিউএ জানা গেল, এটা নাকি বই ছাড়া চলে আসার নগদ শস্তি! এরপর থেকে অবশ্য সাকিব আর কখনোই এ ভুলটি ক্লরে নি।
আগে হাজী সাহেবের ঘরে কোনো ধর্মীয় বই ছিল না। একবার হাজী সাহেব একটি বই এনেছিলেন। কিন্তু ঘরের কারো মধ্যে এ বইয়ের কদর পরিলক্ষিত না হওয়ায় কয়েকদিন পর বইটি যে কোথায় গেল, কেউ বলতে পারল না। কিন্তু নাঈমা বই পোড়া শুরু করার পর সে যপখন মা বাবা ও ভাইদের কাছে বলত যে, বইটি খুব সুন্দর, পড়তে খুব মজা লাগে, তখন থেকেই একটু একটু করে সবার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এমনকি এক পর্যায়ে পরিবারের সবাই বই পাগল হয়ে যায়।
খুশির কথা এই যে, সাকিবের অব্যাহত মেহনত ও প্রচেষ্টা, উপদেশমূলক কথাবার্তা আর বিভিন্ন ধর্মীয় বই–পুস্তক পড়ার দরুণ ফলাফল এই দাঁড়াল যে, হাজী পরিবারের সবাই পাক্কা নামাযী হলো। দীনদার হলো। হাজী সাহেব ও তাঁর দুই ছেলে তিন চিল্লা সময় লাগাল। এখন তারা নিয়মিত সাপ্তাহিক গাশত করে। কাকরাইলের শবগোজারীতে শরীক হয়। ঘরে ফাযায়েলের তালীম চালু করে। খাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলের পরিবর্তে দস্তরখানের সুন্নত জারী হয়।
তাছাড়া আরো খুশির কথা এই যে, চিল্লায় গিয়ে আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম উভয়ে দাঁড়ি রেখেছিল। সেই সাথে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল তাদের পোষাক-আশাক এবং চালচলনও। চিল্লা থেকে আসার পর তাদের এ অবস্থা দেখে কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে বলেছিল, আরে! এ হলো ক্ষণিকের মুসল্লি। দেখবে কয়েকদিন পর সব উধাও। দীনদারী কোথায় যে যাবে খুজেও পাবে না। কিন্তু আল্লাহর হাজারো শোকর যে, তাবলীগ থেকে সময় লাগিয়ে বাড়ি আসার পর তাদের দীনদারী ও পরহেজগারী উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। কমে যায় নি বিন্দু পরিমাণও। আর কমবেই বা কি করে? তারা তো সময় লাগিয়ে এসে তাবলীগের কাজ ছেড়ে দেয় নি। বরং এ নবীওয়ালা কাজকে তারা আরো গুরুত্বের সাথে আঁকড়ে ধরেছে। তাদের কথা হলো, যে কাজের ওসিলায় আমরা দীন পেয়েছি, অতীতের নোংরা জীবন পরিত্যাগ করে নতুন জীবন লাভ করেছি, হৃদয়ে জ্বালিয়েছি হেদায়েতের মশাল, অন্তরে পেয়েছি তুলনাহীন প্রশান্তি–সেই কাজ আমরা ছাড়ব কি করে? সব কিছুরই বিনিময় হলেও আমরা এ কাজকে ধরে রাখব। মৃত্যু পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যাব। যারা এ কাজের গুরুত্ব ও ফজীলত সম্পর্কে বগত নয়, তাদেরকে তা জানাব। আল্লাহর রাস্তায় সময় দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে হাতে পায়ে ধরব। তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করব, দাওয়াতে তাবলীগের এই মেহনত–আপনি, আমার সকলের জিম্মাদারী। জান, মাল ও সময়ের সহীহ ব্যবহার শিক্ষা করার জন্য এটি একটি উত্তম পদ্ধতি।
তাবলীগ সম্পর্কে হাজী পরিবারে এই সুন্দর ও সঠিক ধারণা সৃষ্টি হওয়ার ফলে মাসের চার সপ্তাহের মধ্যে তিন সপ্তাহই তারা বাপ ভাই থেকে একজন একজন করে মাসিক তিন দিনের নেসাব পূর্ণ করে। এ নেসাব কখনোই তাদের মিস হয় না। তাছাড়া হাজী সাহেব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মাঝেমধ্যে মাস্তুরাতের জামাতেও বের হন। আর নাঈমা! সে তো ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর আলেমা হয়ে দীনের প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করার জন্ এমন পাগল হয়েছে যে, তাকে মহিলা মাদরাসায় ভর্তি না করা পর্যন্ত কেউ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল না।
ষোল
সাকিবের বন্ধু শাকিল এখন পূর্ণ যুবক। সে ইতোমধ্যে কোনো রকমে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। স্কুলে পড়াকালীন ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর বেশ নাম-ডাক ছিল। কিন্তু কলেজে ওঠে প্রেম রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর লেখাপড়া গোল্লায় উঠেছে। এই রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে সে এখন নিঃস্ব, রিক্ত ও পরিত্যক্ত এক পথের ফকির। সে এক করুণ ইতিহাস! সে এক জীবন্ত কাহিনী!!
শাকিল কুমিল্লা থাকে। শহরের এক কলেজে পড়াশুনা করে সে। সেদিন ছিল ছুটির দিন। ঘরে বসে সময় কাটতে চাচ্ছে না। কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। হঠাৎ কী মনে করে ঘর থেকে বের হলো সে। মন্থর গতিতে সামনে চলছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, তা সে নিজেই জানে না। উঙ্কু-শুঙ্ক চুল। মলিন মুখমন্ডল। জীর্ণ-শীর্ণ কংকালসার দেহ। করুণ-বেদনাভরা উদাস তাঁর দৃষ্টি।
এদিকে সাকিব কোনো এক কাজে কুমিল্লা এল। তাঁর ইচ্ছা ছিল, কাজটা শেষ করেই সে বাসে চড়ে ঢাকা চলে যাবে। কিন্তু যাওয়া আর হলো কই!
সাকিব যখন বাসের টিকেট কাটার জন্য কাউন্টারে গেল তখন অপ্রত্যাশিভাবে দেখা হয়ে গেল ছোট বেলার বন্ধু শাকিলের সাথ। দীর্ঘদিন পূর্বে বাড়ি থেকে চলে আসার পর শাকিল যেমন সাকিবকে খুঁজতে গিয়ে গোটা ঢাকা শহর চষে ফিরেছে, তেমনি সাকিবও বন্ধু শাকিলকে এক নযর দেখার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষানিয়ে সময় কাটিয়েছে। সে যেখানেই যায়, শাকিলের বয়স ও চেহারার সাথে মিল খায় এমন কোনো ছেলেকেই দেখলেই তাঁর দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু এতদিন কারো আশা পূর্ণ হয়নি। আজ বহু বছর পর এই প্রথম তাদের সাক্ষাৎ ঘটল।
শাকিলকে দেখে সাকিব যেন তাঁর চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বাল্যবন্ধুকে পেয়ে সে যেমন খুশি হলো তেমনি তাঁর শুকনো মলিন মুখ ও হাড্ডিসার দেহের দিকে তাকিয়ে তার হৃদয় কেঁপে ওঠল। সাকিবের দেহ, লম্বা পাঞ্জাবী, ঘন দাড়ি আর বেশভুষার পরিবর্তনের কারণে শাকিল যদিও তাকে প্রথম দেখায় চিনতে পারল না, কিন্তু সাকিব তাঁর বাল্যবন্ধুকে ঠিকই চিনতে পারল। সে শাকিলকে দেখেই ‘বন্ধু শাকিল! তুমি কেমন আছ’ বলে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরল। গলার কণ্ঠ শুনে শাকিলও তাকে চিনে ফেলল। পরস্পর পরিচয়ের পর তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ যে আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিয়েছিল তা তারা নিজেও জানে না।
দুই বন্ধু মিলে অনেক কথাবার্তা বলল। সাকিব তাঁর পিতা, ছোট মা ও বোন খালেদার খোঁজ খবর নিল। তারপর এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল–
শাকিল! তোমার শরীরের এ অবস্থা কেন? তোমাকে দেখে খুবই কষ্ট লাগছে আমার।
শাকিল বলল, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। লম্বা কাহিনী।
চলো ঐ মাঠে গিয়ে বসি। তারপর তোমার কাহিনী শুনি। বেশি দেরী করা যাবে না। জরুরী কাজ আছে। আজই আমাকে ঢাকা ফিরতে হবে।
কী বললে! আজই তুমি ঢাকা ফিরবে> অসম্ভব।
অসম্ভবের কি আছে এখানে। ঐ তো কাউন্টার দেখা যায়। সেখানে গিয়ে টিকেট কাটব, তারপর বাসে চড়ে চলে যাব। অনেকটা হাস্যোচ্ছলেই কথাটা বলল সাকিব।
তা তো যাওয়া যাবে! তবে আমি যেতে দিলে তো!! মনে রেখো, ছোট বেলায় ঐ ভুল আমি আর পুনরায় করতে চাই না।
কোন ভুলের কথা বলছ তুমি?
ঐ যে তুমি দৌড়ে এসে লঞ্চে উঠে গিয়েছিলে। আর আমি হাদারামের মতো তোমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আহা, আমি যদি সেদিন সে ভুলটিও না করতাম, আমি যদি সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে তোমাকে ধরে ফেলতাম, তাহলে এতদিন পর্যন্ত আমাকে বন্ধু হারানোর বেদনা বয়ে বেরাতে হতো না।
তা এখন কী করতে চাও তুমি?
কী করতে চাই মানে? তুমি এখন আমার সাথে থাকবে। খাওয়া দাওয়া করবে। তোমাকে নিয়ে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাব। সেখানেই আমরা রাত্রিযাপন করব। সারারাত ঘুমাব না। জেগে থেকে তোমার কাহিনী আমাকে শুনাবে আর আমার কাহিনী তোমাকে শুনাব। বুঝলে?
রিচার্স সেন্টারের একটি কাজে আজই সাকিবকে ঢাকা ফেরারকথা ছিল। কিন্তু বন্ধুর আবেদনকে সে প্রত্যাখান করতে পারল না। তাছাড়া শকিলের জীবন কাহিনী শোনার জন্য তাঁর মনটাও আনচান করছিল।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর সাকিব সংক্ষেপেতাঁর কাহিনী বলে শেষ করল। হোটেল বয় হওয়া থেকে শুরু করে কুরআন শরীফ শিখা, হাফেজ হওয়া, আলেম হওয়া, মুফতি হওয়া, তাবলীগ জামাতে এক সাল সময় লাগানো, রিচার্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা–কোনো কিছুই বাদ দেয় নি সে। এসব শুনে শাকিল বলল, সাকিব! তোমার জীবনটাই কাজে লাগল। আল্লাহ তোমাকে আরো সম্মান দান করুন।
এরপর শাকিল শুরু করল তাঁর জীবন কাহিনী বলা। প্রথমেই সে একটি কবিতার দুটি লাইন আবৃত্তি করল–
প্রহর শেষের রাঙা আলো এখন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছি আমি আমার সর্বনাশ
তারপর বলল, সাকিব! কোনো এক উর্বশী নারীর আঁখি পল্লবে নিজের সর্বনাশ আবিস্কার করে দূরদর্শী কবি উপরের উক্তিটি করেছেন। কবি বড়ই ভাগ্যবান। কারণ তিনি আগেভাগেই নারীর চোখে আসন্ন সর্বনাশের ছায়া দেখে ফেলেছেন। অতঃপর তিনি সমূহ ক্ষতি হওয়ার আগেই সাবধান হওয়ার কিংবা কেটে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু আমি? আমি এক হতভাগা, নাদান। এক সুন্দরী নারীর কবলে পড়ে আমার আজ সবকিছু শেষ। শরীর, স্বাস্থ্য সবই হারিয়েছি আমি। এমনকি সুস্থ-সুন্দর চিন্তা করার শক্তিও আমার নেই।
সাকিব! তুমি জানো যে, আমি ছিলাম অস্বচ্ছল এক গরীব পিতার সন্তান। বাবা-মা পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছিল না বলে স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পর শহরে এসে এক স্বচ্ছল পরিবারে জায়গীর মাস্টার হিসেবে ঠাঁই পেলাম। ধীরে ধীরে দু’তিনটি টিউশনি জুটে গেল। সেই সুবাদে মাস শেষে বেশ কিছু টাকা পয়সা আসতে শুরু করল। এদিকে ধনী গৃহে জায়গীর থাকতে পারায় তাদের পুকুরের রুই মাসের পেটি এবং খোয়ারের মুরগীর গিলা-কলিজা খেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই আমার হাড্ডিসার দেহ বেশ তরতাজা হয়ে ওঠল। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে সকল গ্রাম্যতা ছেড়ে ওঠে চলনে-বলনেও ক্রমশ আপ-টু-ডেট হয়ে উঠলাম। এককালে যে ছেলে ছেঁড়া-ফাটা কাপড় পড়ে স্কুলে যেত, পায়ে দেওয়ার মতো জুতোও যার সবসময় জুটত না, আস্তে আস্তে সেই ছেলের গায়ে ওঠে আসতে লাগল হাল ফ্যাশনের জামা, জিন্সের প্যান্ট, দামী ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস, গলায় স্বর্ণের চেইন আর পায়ে মূল্যবান জুতো। গ্রামে থাকতে যার তিন বেলা আহার জুটত না, সেই আমিই হয়ে গেলাম শহরের প্রিন্স। এহেন প্রাচুর্যের অবস্থায় আমার কিছু ইয়ার-বন্ধুও জুটে গেল। এভাবে ঠাঁটবাট আর আরাম-আয়েশে আমার দিনকাল বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’ বলে একটি গ্রাম্য প্রবাদ আছে। আমার অবস্থাও ঠিক তাই হলো। আমার মনে জাগ্রত হলো প্রেম করার সখ। আহা, আমি যদি এই সর্বনাশা প্রেম না করতাম!
আমার এ কাহিনী বড়ই নির্মম। ভালোবাসা আমাকে এতটা আঘাত দেবে বুঝতে পারি নি। বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবুও বলব। এজন্য বলব, যাতে বর্তমান যমানার যুবক যুবতীরা এ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ অবৈধ প্রেম–ভালোবাসা থেকে বিরত থাকার প্রেরণা পায়। তোমার কাছে আমার আবেদন থাকবে, তুমি যখন তোমাদের রিচার্স সেন্তার থেকে কোনো বই বের করবে, তাতে তুমি আমার এই জীবন কাহিনীও অন্তুর্ভুক্ত করবে। কেমন?
ঠিক আছে। তোমার এ কাহিনী যদি শিক্ষণীয় হয় , তবে তোমার আবেদন অবশ্যয় রাখব, ইনশাআল্লাহ। সাকিব বলল।
তারপর শাকিল আবার শুরু করল–
আমি কয়েকটি যুবতী মেয়েকে পড়াতাম। তারা সবাই ছিল ক্লাস টেনের ছাত্রী। আমি ইচ্ছা করলে ছেলেদের পড়িয়েও নিজ খরচা চালাতে পারতাম। কিন্তু মেয়েদের পড়িয়ে, তাদের সাথে কথা বলে যে আরাম আর শান্তি পাওয়া যায়, তা কি ছেলেদের পড়িয়ে পাওয়া যায়! মূলত এই শয়তানী চিন্তা আর প্রেম করার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই আমার সর্বনাশের মূল কারণ।
আমার বিলাশী চালচলন আর আয়েশি আচার-আচরণ দেখে মেয়েরা মনে করত, আমি গ্রাম থেকে আগত কোনো জোতদার পুত্র। অবস্থা এমন ছিল যে, অনেক মেয়েই আমার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। মনে হয়, আমি ছিপ ফেললেই টোপ গিলে ফেলবে। কিন্তু আমার নযর ছিল অনেক উপরে। আমার সূত্র হলো, মারব তো গন্ডার, ধরবো তো রুই। তাই এসব কম সুন্দরী মেয়েকে আমি পাত্তা দিতাম না।
প্রেম করার জন্য আমি শহরের সবচেয়ে ধনী ও সুন্দরী মেয়েটিকে বেছে নিলাম। তাঁর নাম শিল শশী। তাঁর রূপের বন্দনা করতে গেলে একটা উপন্যাসই লেখা যায়। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলা যায়, রাজকন্যার মতোই সুন্দরী ছিল সে। শহরের রাস্তা দিয়ে সে যখন উড়নটা গলায় পেঁচিয়ে বেআব্রু হয়ে রাজহংসীর মতো গর্দান বাঁকিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে হাঁটত তখন সহস্র যুবকের মুগ্ধ দৃষ্টি আছড়ে পড়ত তাঁর মাথা থেকে পদযুগলে।
আমি যে বাসায় লজিং থাকতাম সেখান থেকে দশ মিনিটের পথ হাঁটলেই শশীদের বাড়ি। আমি তাদের বাসার সম্মুখ দিয়েই প্রতিদিন কলেজে যেতাম।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, যে করেই হোক শশীকে জয় করবই। এরপর আমি বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চালালাম। আমি যে তাকে ভালোবাসি সে কথা তাকে বুঝাতে চাইলাম। কিন্তু বিধি বাম। সে আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমার হৃদয়ের আকুতি বুঝতে পেরেও আমাকে অবহেলা করল। তাঁর সাথে আমার খুব বেশি দেখা হত না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতাম। রূপে মুগ্ধ হতাম, গুণে পাগল হতাম। সে আমাকে দেখত কিনা জানি না। তবে মনে হত, দেখেও না দেখার ভান করত। আমার মনকে আমি যতই বুঝাতাম, ততই সে আরো পাগল হয়ে উঠত। তাকে জয় করতেই হবে–এ ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। অবশেষে সকল লাজ-লজ্জার আথা খেয়ে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে তাকে একটা প্রেমপত্র দিলাম। কিন্তু আমার দুর্বল মনকে আহত করে সে তা প্রত্যাখ্যান করল। আমি সাংঘাতিক দুঃখ পেলাম। চোখে পানি এসে গেল। মনে মনে বললাম, আমি কি তাহলে হেরে গেলাম? জীবনে তাকে ছাড়া কাউকেই ভালোবাসি নি। অথচ সে কিনা আমার ভালোবাসা বুঝল না। আমার হৃদয়ের আকুতিকে অবহেলা করল। আমি আহত হলাম। বিমর্ষ হলাম। তবে আবারো প্রতিজ্ঞা করে বললাম, শশীকে আমার পেতেই হবে। আহা, আমি যদি তখনো ফিরে আসতাম।
প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে আবার মাঠে নামলাম। সে আমাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। একে একে আরো দশটি পত্র দিলাম। অবশেষে অনেক সাধনা, সময় ও এনার্জি ক্ষয় করার পর কন্যা আমার প্রতি সদয় হলো। আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলো। বলল, আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হবে চাইনিজ রেস্তোরাঁয়। নীরব-নিভৃত পরিবেশ!
সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না। শশীকে নিয়ে চোখের তারায় স্বপ্ন বুনে বুনেই নির্ঘুম রাত পার করলাম। পরদিন চেহারায় যথেষ্ট ঘষামাজা দিয়ে নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় গিয়ে হাজির হলাম, শশীও এল। তবে একা নয়। তাঁর সাথে একহালি বান্ধবী। মনে মনে বললাম, আমি তো এমনটি চাইনি। অবশ্য শশী আমাকে একথাও বলেনি যে, সে একা আসবে। যাহোক, ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শশী হেসে বলে-কেমন আছেন?
শশীর এতটুকুন কথায় আমার মনে আনন্দের জোয়ার জাগে। সেই আনন্দ আমার হৃদয়ে একটা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যায়। বুকের ভেতর এক সাথে ফুটে ওঠে হাজার গোলাপের হাজারো কলি।
সবাই মিলে একটা টেবিলে বসে খাবার অর্ডার দিলাম। গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা আর স্যুপের বাটিতে চুমুক দিয়ে সমুয়টা ভালোই কাটল। কিন্তু বেয়ারা যখন বিল নিয়ে এল তখন আমি প্রমাদ গুণলাম। অবশ্য আমার পকেটে তখন টিউশনি থেকে প্রাপ্ত হাজার দুয়েক টাকা ছিল। বিল অবশ্য দেড় হাজার টাকার বেশি হলো না! কিন্তু মনটা খচখচ করে ওঠল। কেননা এ তাকা দিয়ে আমার পনের দিন চলার কথা। অথচ আজই……।
সেই থেকে শুরু। কত গল্প, কত প্রেম। কথা কথা, কত উপকথা!
শশীর সাথে আমার নিয়মিত দেখা হত নদীর পাড়ে, পার্কে, হোটেলে, এখানে-ওখানে। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখে বন্ধুরা ঈর্ষা করত। কিন্তু রাদেরকে কখনোই বলতাম না যে, এই ঘনিষ্ঠতার খেসারত হিসেবে পুরো মাসের টিউশনীর টাকা সপ্তাহেই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নেওয়া শুরু করি। শশী তখন আমার কাছে নেশার মতো। ওকে একদিন না দেখলে আমার দিন ফুরাতে চায় না। রাত পোহাতে চায় না। সারারাত নির্ঘুম কাটে। কিন্তু ওর সাথে ডেটিং এর খরচ যোগাতে আমার অবস্থা শোচনীয়। প্রায়ই একে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে হত। মার্কেট থেকে কিনে দিতে হত এটা-ওটা। ক্রমে আমার ঘড়ি, আংটি, সোনার চেইন সবই গেল। বন্ধুরাও ধার দেওয়ার ভয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
শশীর সাথে প্রেম করতে করতে আমার পড়ালেখা শিখেয় উঠল। পড়ালেখার চেয়ে ওর সাথে গল্প করতেই তখন বেশি ভালো লাগত। এমনি করতে করতে পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষার কোনো প্রস্তুতি নিই নি। তবুও পরীক্ষা দিলাম। শেষ পর্যন্ত ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো।
শাকিল একটু দম নিল। তারপর আবার শুরু করল–গত কয়েকমাস আগে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। একদিন শশীকে ওদের বাসা থেকে একটু দূরে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে লজিং বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি ওদের পাড়ার ঈর্ষাকাতর কয়েকজন যুবক আমার দিকে তেড়ে আসে। তারপর চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে আমাকে। তাদের সবার হাতে লাঠি। একজনের হাতে পিস্তল। আমি তখন একা। হাতেও কিছু নেই। তাই মোকাবিলা করার সাহস -পেলাম না।শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার! আমাকে তোমরা আটকালে কেন? আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি।
ক্ষতি করিস নি মানে? তুই আমার মুখের খাবার কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছিস! আয় এদিকে আয়। প্রেম কাকে বলে শিখিয়ে দেই।
এ বলে তাদের মধ্য থেকে নেতা গোছের ছেলেটি আমাকে টানতে শুরু করল। আমি যেতে চাইলাম না। অমনি সবাই আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আঘাতে জর্জরিত করত লাগল বিরামহীন ভাবে। এক পর্যায়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু তাদের মনে রহম গেল না। আরো জোরে পেটাতে লাগল। আমি বললাম, তোমরা যা বলো, তা-ই মানব, তবু আমাকে মেরো না। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। আমার মাথা ফেটে রক্ত বের হলো। শরীরের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। বাম হাতের দুটি আঙ্গুল ভেঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ পর আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। পরদিন যখন আমার হুঁশ ফিরে তখন দেখলাম, আমি হাসপাতালের বেডে শোয়া।
এ পর্যন্ত বলে শাকিল একটু বিরতি দিলে সাকিব জিজ্ঞেস করল, ঘটনা কি এখানেই শেষ?
জবাবে শাকিল বলল, না এখানেই শেষ নয়। আরো আছে।
বলো।
শাকিল বলতে লাগল, সাকিব! আমার বড় দুঃখ লাগে এজন্য যে, আমি সাতদিন হাসপাতালে ছিলাম; কিন্তু শশী আমাকে একদিনও দেখতে এল না। ওর এই নির্দয় আচরণ আমাকে প্রচন্ড আহত করল। আমার কোনো দুঃখ থাকত না যদি ও অন্তত একটিবার আমাকে দেখতে আসত। সকল ব্যথা আমি ভুলে যেতাম নিমিষে। অবশেষে ছিয়দিনের মাথায় শরীরটা যখন একটু সুস্থ হলো, তখন বেডে থেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে এগার পৃষ্ঠার একটি গদ্য রচনা করে শশীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে প্রথমেই আমি শশীদের বাড়ি গেলাম। কিন্তু সে আমার সাথে দেখা করল না। একটি কথাও বলল না। শেষ পর্যন্ত অপমানিত হয়ে তাদের বাসা থেকে ফিরে এলাম। পরে আমি তাঁর বান্ধবী থেকে শুনলাম, সে নাকি আমাকে কখনোই বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি। আমি এত নিচু প্রকৃতির লোক! এটা জানলে নাকি আমার সাথে সে কথাই বলত না।
শশীর বান্ধবীর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের সামনে দুলে ওঠল সারা পৃথিবী, বুকটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপতে লাগল গোটা দেহ।
সাকিব! এটা ঠিক যে, আমি কখনো মুখ খুলে বলতে পারি নি–ভালোবাসি।
কিন্তু আমার এ দ্বিধা–সংকোচের সুযোগ নিয়েই আমাকে জনমের মতো খেলিয়েছে ওই মেয়ে। সে আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। সে আমার স্বাস্থ্য, সম্পদ আর টাকা–পয়সাই কেবল নষ্ট করে নি, আশ্রয় থেকেও বঞ্চিত করেছে।
সাকিব! তোমাকে কি আর বলব। সেদিন যখন এক বুক কষ্ট নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে জায়গীর বাড়িতে ফিরি, তখন তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, চরিত্রহীন কোনো ছেলেকে ওরা আর এ বাড়িতে রাখবে না। তাই বাধ্য হয়ে সেদিনই আমাকে জায়গীর বাড়ি ছাড়তে হয়েছিওল। সাকিব! নষ্ট এই ভালোবাসার কারণে আজ আমি আশ্রয়-প্রশ্রয় হারিয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখছি। আহা, কত সুখেই না ছিলাম! কিন্তু অবৈধ ভালোবাসা আজ আমাকে পথের ভিখারী বানিয়ে দিয়েছে।
শাকিলের জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে সাকিবের চোখে পানি এসে যায়। সে বারবার রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ মুছে। বলে, শাকিল! আল্লাহ পাক যেভাবেই হোক তোমাকে এই অভিশপ্ত পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ঘটনা আরো বহুদূর গড়াতে পারত। এর পরিণতি হতে পারত আরো ভয়ঙ্কর। এ ধরণের একটি ঘটনা আমারও জানা আছে। সময় হলে তোমাকে একদিন বলব। আল্লাহ পাকের শোকর যে, তোমাকে তিনি সঠিক বুঝ দান করেছেন। বুঝার তাওফীক দিয়েছেন যে, নর-নারীর বিবাহপূর্ব প্রেম-ভালবাসা কারো জন্যেই কল্যাণ বয়ে আনে না। আনতে পারে না। আনে কেবল-অশান্তি, অকল্যাণ, অমর্যাদা ও রাশি ররাশি পাপ। তাই আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করো। আর বিগত জীবনের এই পাপ্পের জন্য তওবা করো।
শাকিল বলল, হ্যাঁ, আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। দোয়া করি, তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন। তুমিও আমার জন্য দোয়া করিও।
সতের
পরদিন বাসে করে রওয়ানা দিল সাকিব। বাসে প্রচন্ড ভীড়। ভীড় তো থাকবেই। কোথায় ভীড় নেই? যেদিকে দৃষ্টি যায় সেদিকেই ভীড়। পথে-ঘাটে ভীড়, বাজারে-বন্দরে ভীড়, দোকানে-মার্কেটে ভীড়, পার্কে-সিনেমায় ভীড়, গ্যালারী-কনসার্টে ভীড়। এমন কি আবুল মিয়ার জোড়াতালি মার্কা চায়ের দোকানেও ভীড়। তবে হ্যাঁ, একটি স্থান আছে যেখানে ভীড় নেই। অথচ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হলো মসজিদ আর সর্বোনিকৃষ্ট স্থান হচ্চে বাজার।
লোকাল বাস। সিট পাওয়ার কথা না। তারপরেও ভাগ্যের জোরে একটি সিট মিলে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাকিব। সীটে বসে দোয়া পড়ে নেয়। যানবাহনে আরোহনের দোয়া। সুবহানাল্লাযি সাখখারা লানা হা-যা ওয়া মা কুন্না লাহু…..।
গাড়ী চলতে শুরু করেছে। সাকিব বসে বসে জিকির করছে। এটা সাকিবের অভ্যাস। সে একদন্ড সম্য নষ্ট করে না। তাসবীহ পকেটে থাকে। সবসময় থাকে। বিশেষ করে সফরের সময়। তাসবীহ সঙ্গে থাকলে সময় সুযোগে জিকির করা যায়। তাসবীহ ছাড়া সফর করে না। তাঁর ডাইরীতে লেখা সফরের সামানার শীর্ষেই আছে তাহবীহ, মিসওয়াক ও টয়লেট পেপারের কথা।
সাকিবের মাথা নিচু। এক সময় সে মাথা উঠায়। দু’জন বৃদ্ধ লোক তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে । তারা সিট পান নি। বাসে ধাক্কাধাক্কি চলছে। এ অবস্থায় দেহের তাল সামলানো বড় কঠিন। তবু তারা শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে উপরের রডখানা মজবুত করে ধরে রেখেছেন।
সাকিবের পাশে এক মাদরাসার ছাত্র। নাম সোহেল। ঢাকা যাবে। খানিক আগে সাকিব তাঁর পরিচয় নিয়েছে। সে মাদরাসা দারুর রাশাদে পড়াশুনা করে। এবার চতুর্থ বর্ষে। বি এ পাশ করার পর মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সালমান সাহেব নাকি তাকে খুব আদর করেন।
দু’জন বৃদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাকিব আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর দেখাদেখি উঠে দাঁড়ায় পাশের ছাত্রটিও। সাকিব প্রবীণ ব্যক্তিদ্বয়কে বসতে অনুরোধ করে। বলে, আপনারা বসুন। আপনারা আমাদের মুরব্বী। পিতৃস্থানীয় লোক। ইসলাম ধর্মে বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রবীণ ব্যক্তিদ্বয় বসতে চান না। একজন বলেন–বাবা! তোমরা বসো। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো অসুবিধা হবে না।সাকিব ও সোহেল উভয়ে অবাক হয়। চেয়ে থাকে তাদের মুখপানে। তারপর আবারও অনুরোধ করায় তারা বসতে বাধ্য হন।
বৃদ্ধদ্বয়ের মধ্যে যিনি আগে কথা বলেছিলেন তিনি সাকিবদের অবাক হওয়া দেখে আবার বললেন, বাবা! আমাদের কোনো অসুবিধা না হওয়ার কথা শুনে তোমরা হয়তো আশ্চর্য হয়েছ। এখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি আসলে একথা এজন্য বলেছি যে, আমাদের যুগে আমরা কত ভালো ভালো খাবার খেয়েছি, খাঁটি দুধ ও পুষ্টিকর ফলমূল আহার করেছি। আর তোমরা? তোমরা তো এসবের কিছুই পাচ্চ না। সব খাবারেই এখন ভেজালের মিশ্রণ আছে। আমাদের সময় গরীবরাও উৎকৃষ্ট মানের খাবার ও ফলমূল খেতে পারত। কিন্তু এখন সেগুলোর দাম গরীবদের নাগালের বাইরে। তোমরা ভালো ভালো খেতে পাও না বলেই বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না। অল্পক্ষণ পরেই ঝিমিয়ে পড়ো। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেয়েই আজ তোমদের এই অবস্থা। তবে তোমাদের সুন্দর বিবেক আছে বলেই আজ আমাদের বসতে দিয়েছ। নইলে প্রায়ই তো আমরা বাসে আসি। সিট পাই না। দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু কই, সেখানে তোমাদের চেয়ে স্বাস্থ্যবান যুবকরাও তো বসতে বলে না!
প্রবীণ লোকটি থামলেন। চশমটা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে নিলেন। তাঁর কথাগুলো শুনে পাশের সিটে বসা আরেক ভদ্রলোক হেসে বললেন, চাচা! আপনার দু’খানা কথা একদম খাঁটি। আমার একটি ছেলে এবার এইচ, এস, সি পরীক্ষা দেবে। খানাদানা আমি ভালোই দেই। সেও খায়। কিন্তু স্বাস্থ্য হয় না। সবাই তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাকে। চড়া দামের জন্য তো ফল-ফ্রুট কিনতেই পারি না। এসবের দাম শুনলেই পকেটের মানিব্যাগ হা করে থাকে।
ভদ্রলোকের কথা শুনে সবাই ফিক করে হেসে ওঠে। তিনি আরো বললেন, গত কয়েক বছর আগেও শিক্ষক ও গুরুজনদের অনেক সম্মান ছিল। আমি দেখেছি, কোনো ছাত্র বিপরীত দিক থেকে আসতে থাকা শিক্ষক বা গুরুজনকে দেখামাত্র মাথা হেঁট করে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে থাকত। সাইকেলে আরোহণ অবস্থায় দেখলে সাইকেল থেকে নেমে যেত। তারপর কাছে এলে শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে সালাম দিত। আর বর্তমানে? বর্তমানে তো ছাত্রদের দ্বারাই শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। অপমানিত হচ্ছেন। যুগ যে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে! কলির যুগ বোধ হয় এটাকেই বলে!
গাড়ির লেডিস সীটে বসেছিলেন অপরুপ সুন্দরী এক মেয়ে। বয়স ষোল কি সতের হবে। হাতে বই পুস্তক দেখে মনে হয় কোনো কলেজের ছাত্রী মেয়েটির সাজসজ্জা চোখে পড়ার মতো। একমাত্র সাকিব ও সোহেল ছাড়া গাড়ির সবাই বারবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। ওরা পিছনের সিটে থাকায় ব্যাপারটি ওদের নযরে আসছে। এরই মধ্যে গাড়িখানা দুতিন বার মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া থেকে বঁচে গেল। সাকিব ব্যাপারটি চিন্তা করল। ভাবল, তবে কি ড্রাইভার সাহেব মাতাল! কিন্তু না, ড্রাইভারকে মাতাল বলে মনে হলো না। গাড়ীর ইঞ্জিনজনিত কোনো ক্রটি নিয়েও সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, খুব বেশি হলে হবে গাড়িটা রাস্তায় নামানো হয়েছে। আর গাড়ীতে যাত্রীও মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। তাহলে কারণটা কি? বারবার গাড়িটি দুর্ঘটনার শিকার হতে যায় কেন?
একটু পরেই সাকিব কারণটা খুঁজে পায়। সে লক্ষ্য করে দেখল, সেই নযরকাড়া অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটিই হলো মূল সমস্যা। কারণ সবার সাথে সাথে ড্রাইভারের দৃষ্টিও সেই মেয়ে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। আর তাই এই বিপত্তি।
নানাবিধ রসালাপের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। প্রায় আধ ঘন্টা বাস চলার পর দুটি সীট খালি হয়। সাকিব ও সোহেল সেখানে বসে। আবার তাদের মধ্যে কথা শুরু হয়। কথা বলতে বলতে সোহেল সাকিবের সাথে বেশ ফ্রী হয়ে যায়। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তারা আলোচনা করে।
এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে সহশিক্ষা নিয়েও কথা হয়।
সাকিব জিজ্ঞেস করে, ভাই! আপনি তো উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত। আচ্ছা, আপনার দৃষ্টিতে সহশিক্ষা ব্যবস্থাটা কেমন?
‘সহশিক্ষা’ শব্দট শোনা মাত্রই একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোহেল। কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় সে। মনে হয় একসাগর কষ্ট এইমাত্র তাঁর হৃদয়ে উথলে উঠেছে।
সাকিবের প্রশ্নের জবাবে সোহেল বলে, ভাইজান! সহশিক্ষা আমি মোটেও পছন্দ করি না। পছন্দ না করার কারণ হিসেবে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। তাছাড়া একটি নির্মম সত্য ঘটনার কারণেও সহশিক্ষা ব্যবস্থাকে আমি চরমভাবে ঘৃণা করি। শুনবেন কি আপনি সেই ঘটনা?
শুনব না মানে? অবশ্যই শুনব। গত কয়েক দিন আগে আমাদের রিচার্স সেন্টার থেকে একটি সেমিনার স্মারকের পাশাপাশি আরেকটি বইও প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই বইয়ের খোরাকের জন্য আমি এ ধরণের কিছু সত্য ঘটনা তালাশকরছি। আপনি এখন যে ঘটনাটি শুনাবেন, আশা করি, সেটিও আমাদের বইয়ে স্থান পাবে। তাছাড়া আপনার এ ঘটনা বলার দ্বারা সফরের একঘয়েমী ভাবটা দূর হবে।
সোহেল হালকা একটা কাশি দিয়ে গলাটা একটু পরিস্কার করে নেয়। তারপর বলতে থাকে–
আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। আমি তাকে দোস্ত বলে ডাকি। আমি অনেকদিন তাকে একা একা হাঁটত দেখেছি। চেহারামলিন। চোখ দেখে মনে হত একটু আগেই সে চোখ ভরে কেঁদেছে। তবে কোনোদিন এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। আমি অনেকবার তাঁর রুমে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে পেয়েছি। ঘুমিয়ে থাকলেও তাঁর চোখ দুটি ছিল অশ্রুসিক্ত। তখনও তাকে আমি ডিস্টার্ব করি নি। একদিন তাকে সাহসকরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আরে দোস্ত! এত পেরেশান থাকো কেন? সে আহ করে একটা ঠান্ডা হাওয়া মুখ থেকে নির্গত করে। তারপর একটা নিষ্প্রভ মুচকি হাসি দিয়ে বলে–
চিরসুখি জন, ভ্রমে কি কখন,
ব্যথিতের বেদনা, বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে,
কভু আশি বিষে, দংশেনি যারে?
তাঁর এ কবিতা শুনে আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম। তাঁর মনটাকে হালকা করার জন্য বললাম, মনে হয়, তুমি কবি। কখন থেকে কবি হলে দোস্ত? কোনো ডুবলিকেট প্রেমে পড় নাই তো?
সে কোনো উত্তর দিল না। চুপ মেরে বসে রইল। আমি বললাম, কি দোস্ত! মন খারাপের কারণটা কিন্তু এখনি বলো নি। তবে মনে রেখো, আমি কিন্তু আজ তোমার এ রহস্য উদঘাটন না করে যাচ্ছি না।
এতকিছুর পরও সে কিছুতেই বলতে চাইল না। অবশ্য পরে অনেক পীড়াপীড়ির পর সব কিছু সে খুলে বলল। বলতে লাগল–
আমার ছিল এক নিকটাত্মীয়। আমি তাকে স্নেহ করতাম, ভালোবাসতাম। তাঁর সাথে আমার পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়া ছিল অসম্ভব। হারাম। কারণ সে ছিল আমার মাহরাম আত্মীয়। মেয়েটি যখন একদম ছোট তখন তাঁর মা তাকে আমার মায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে যায়। সেই ছোটকাল থেকেই আমি তাকে আদর সোহাগ করতাম। যেহেতু আমার কোনো ছোট বোন ছিল না, তাই বোনের অকৃত্রিম স্নেহ-আদরও তাঁর ভাগ্যে জোটে। সেও আমাকে খুব সম্মান করত। শ্রদ্ধা করত।
মেয়েটির নাম লাবণী। মায়ের কথা অনুযায়ী সে আমাদের গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া শুরু করে। সেখানকার পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর হাইস্কুলে ভর্তি হয়। হাইস্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে।
দিন যায় রাত আসে। এভাবে কয়েক বছর কেটে যায়। লাবণী আসতে আসতে বড় হতে থাকে। আমি লাবণীকে এত বেশি ভালবাসতাম যে, তাঁর হালাল ভালোবাসার মধ্যে ডুবে থেকে অন্য মেয়ের সাথে অবৈধ ও হারাম প্রেম করা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখি। তাই আমার মনের মধ্যে অন্য কোনো মেয়ের চিন্তাও আসে নি।
আমি নিজেকে পবিত্র রাখতে যেমন তাঁর ভালোবাসা নিয়েই অন্যসব নাজায়িয ভালোবাসা থেকে বিরত থাকি, তেমনি আমি চাইলাম, সেও আমার মহব্বত ধরণ করে অন্য সব অবৈধ প্রেম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। তাই একদিন আমি তাকে ডেকে বললাম, লাবণী! আমার সাথে তোমার একটি ওয়াদা করতে হবে। করবে?
সে বলল, আপনার সব কথাই আমি পালন করতে প্রস্তুত।
আমি বললাম, স্কুলে তুমি নিত্য নতুন অনেক বন্ধু পাবে। হয়তো কোনো সুদর্শন ছেলে তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করবে। তখন তুমি এ নাজায়েয পথে পা বাড়াবে না–এ ওয়াদাটুকুই তোমাকে আজ করতে হবে।
লাবণী বলল, কী যে বলেন আপনি! এটা কি কোনোদিন সম্ভব? আমি আপনার নিকট ওয়াদা দিচ্ছি, কোনোদিন এ পথে চল্ব না। আমি কেবল আপনার দোয়া চাই।
আমি বললাম, আমিও তোমার সামনে অঙ্গীকার করছি যে, কোনো ভিন্ন মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলব না।
শোন লাবণী! আমরা পরস্পর এজন্য ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে, তোমার জন্য যেমন পর পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ, আমার জন্যও বেগানা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করা পাপ। আমরা যদি শরীয়ত অনুমোদিত আমাদের আন্তরিক মহব্বত্বে সম্পর্ক বজায় রাখি তাহলে আমরা আধুনিক তারুণ্য ও যৌবনের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া থেকে বেঁচে যাব, বেঁচে যাব নিজকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করা থেকে, ইনশাআল্লাহ।
এরপর কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। আমি মাঝে মধ্যে তাকে ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিতাম। বলতাম। লাবণী! ওয়াদা যেন ঠিক থাকে। স্মরণ রেখো, আমি সব সময় তোমার সামনে উপস্থিত না থাকলেও মহান আল্লাহ লাক কিন্তু সব সময় তোমার সাথে আছেন।
একবার কোনো এক কাজে আমাকে বেশ কয়েজ মাস বাইরে থাকতে হলো। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে লাবণীর মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মনে হলো এ লাবণী যেন সে লাবণী নয়। চিন্তা করলাম, তাঁর হৃদয়ে কারো ভালোবাসার নীড় রচিত হয় নি তো? আমি লাবণীকে ডাকলাম। বললাম–
লাবণী!
জ্বী।
তোমার কিছু হয় নি তো?
জ্বী না।
তোমাকে কেউ কিছু বলে নি তো?
জ্বী না। আমি তখন আর কিছুই বললাম না। কারণ সে আবার মনে কষ্ট পেয় যায় কিনা সে ভয় আমার ছিল। আমি কখনোই চাইতাম না, আমার কোনো কথা বা আচরণ দ্বারা সে কষ্ট পাক।
আঠার
এর কয়েকদিন পরেই আসল রহস্য উদঘটিত হলো। আমি যে বিষয়ে আশঙ্কা করছিলাম, অবশেষে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তাই হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সে বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর এক ক্লাসমেটের প্রেমে পড়েছে। চাপ দেওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে সেই প্রেমিকের আটটি প্রেমপত্রও পাওয়া গেল। এরপর যখন তাঁর মুখ থেকে শুনলাম যে, সে নিজেও ঐ ছেলেকে চার পাঁচটি চিঠি দিয়েছে, তখন কিন্তু আমি আর আমার ভিতরে ছিলাম না। আমি আঘাত সহ্য করতে না পেরে তাঁর সামনেই ছোট্ট শিশুটির মতো কেঁদে ফেলেছিলাম। কারণ, আমি মনে করেছিলাম, শুধু ছেলেটিই তাঁর নিকট চিঠি লিখেছিল।
এ ঘটনায় আমার মনোবল একদম ভেঙ্গে যায়। একসঙ্গে ছীরে যায় হৃদয়ের সবকটি তাঁর।
সাকিব এতক্ষণ তন্ময় হয়ে সোহেলের কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার সে বলল–
তারপর?
তারপরের কাহিনী বড়ই করুণ। বড়ই লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ।
লাবণীর প্রেমিকার নাম পলাশ। একদিন পলাশের পরিবার এ সম্পর্কের কথা জেনে গেল। জেনে গেল লাবণীর পিতা-মাতাও। উভয় পরিবার ছিল বেশ স্বচ্চল। কিন্তু সমস্যা লাবণীদের পরিবারের কেউই যেমন পলাশকে মেনে নিতে রাজি নয়, তেমনি পলাশের পরিবারও লাবণীকে মেনে নিতে রাজী নয়।
সামনে উভয়ের এস, এস, সি পরীক্ষা। ২০০০ সালের ১৫ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হবে। দুদিন আগে এডমিট তোলার জন্য লাল্বণী স্কুলে এসেছে। এসেছে পলাশও। সেদিন তাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়, পরীক্ষার পরের দিনই তারা গোপনে বিয়ে করে ফেলবে। তাদের বাসর হবে চিটাগাং-এর এক আত্মীয়ের বাসায়। লাবণী ও পলাশ উভয় খুশি। কিন্তু তারা জানতো না যে, তাদের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে না। বরং এটাই তাদের শেষ কথাবার্তা, শেষ সাক্ষাৎ।
কোনো এক মাধ্যমে ওদের সিদ্ধান্তের কথাটা লাবণীর আব্বার কানে গিয়ে পৌঁছাল। রসায়ন পরীক্ষার দিন দেখা গেল,। লাবণি অনুপস্থিত। ও পরীক্ষা দিতে না আসায় সকলের মনে কৌতূহল জাগল। আর পলাশ হলো সাংঘাতিক রকমের অস্থির। সে আধ ঘন্টার বেশি পরীক্ষার হলে থাকতে পারল না। বাথরুমের যাওয়ার নাম করে সেই যে গেল, আর ফিরে এল না। পরীক্ষা শেষে পলাশের বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, পলাশ হাসপাতালে আছে।
ঘটনা হলো, পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে পলাশ লাবণীদের বাড়িতে গিয়েছিল। তখন লাবণীর ভাই ও চাচারা তাকে জনমের মতো পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পলাশের বাবা পুরো বিষয়টা থানায় জানালেন এবং পলাশের ঘাড়ে প্রচন্ড আঘাত পাওয়ায় তাকে ঢাকা নিয়ে এলেন। এই ঘটনার পর লাবণীর পিতা তাকে ঘরে আটকে রাখে। কোথাও যেতে দেয় না। এমন কি আত্মীয়-স্বজনদের বাসায়ও না।
লাবণীর পিতা ছেলে খোঁজতে থাকেন। একসময় তিনি মনের মতো ছেলে পেয়েও যান। তাই দেরী না করে তিনি বিয়ের তারিখও ঠিক করে ফেলেন।
এদিকে দীর্ঘ এগারো মাস হাসপাতালে থাকার পর পলাশ বাড়ি ফিরল। সে লোকমুখে শুনতে পেল, আর তিনদিন পর লাবণীর বিয়ে। একমাত্র ছেলে হিসেবে পলাশের মা পলাশকে শপথ করিয়েছেন যে, লাবণীর বিয়েতে সে কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না।
লাবণীর বিয়ের সংবাদ শুনে পলাশ তাঁর বন্ধুদের বলেছিল, বুকের ভিতর তাঁর রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো সে আর বেশিদিন বাঁচবে না।
লাবণীর বিয়ের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পলাশ তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথেই ছিল। সারাদিন কিছুই খায়নি সে। বিকালে একবার সে তাঁর বন্ধুকে বলেছিল, আচ্ছা! লাবণী কি আমার কথা একবারও ভাবছে না?
রাত প্রায় তিনটা। ধীরে ধীরে পলাশ ঘর থেকে বের হয়। তারপর অন্ধকারে খোলা আকাশের নীচে বসে কাদতে থাকে। যে পলাশ জীবনে সবচেয়ে বেশি বয় কুরত অন্ধকারকে, সে-ই আজ অন্ধকারে বসে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে! বাকি রাতটুকু পলাশ আর ঘুমায় নি। যতই ভোর হচ্ছে ততই এক অজানা অস্থিরতা এসে পলাশকে গ্রাস করছে। তাঁর বুকটা হাহাকার করছে।
ফজরের নামাজের পর পরই একটি খবর পলাশের হৃদয়টাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছে। সে বিশ্বস্তসূত্র খবর পায়, লাবণী আত্মহত্যা করেছে।
পলাশ দৌড়ে ছুটে যেতে চাইল। কিন্তু বাড়ির সবাই তাকে জোর করে ধরে রাখল। তাকে কতক্ষণ ধরে রাখা যাবে?
পলাশের নামে কেস হলো। তবে তাকে আর গ্রেফতার করার প্রয়োজন হয় নি। পরের দিন ওই একই সময়ে সেও আত্মহত্যা করে চিরবিদায় নিল এই পৃথিবী থেকে। অবৈধ প্রেমের নিষ্ঠুর পরিণতি হিসেবে ঝরে গেল দুটি তাজা প্রাণ!
বন্ধু! আমার লাবণী খুব ভালো মেয়ে ছিল। তাঁর এমন কিছু সৎ গুণ ছিল যা অন্য মেয়েদের মধ্যে বিরল। সহশিক্ষার এ পরিবেশ তাকে নষ্ট করেছে–এ আমি শপথ করে বলতে পারি। তাঁর আত্মা হয়তো অনেক যুদ্ধ করেছে ঐ পরিবেশের সাথে। হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আমার সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করতে। কিন্ত না, সে পেরে ওঠতে পারে নি। সে পরাজিত হয়েছে ঐ পরিবেশের কাছে। অবশেষে গলাফল যা হওয়ার তাই হলো।
বন্ধু তুমিই বলো তো, সে কিভাবে পারবে ঐ পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে, যে পরিবেশে সে দিনের আটটি ঘন্টা কাটায় উঠতি বয়সের ছেলেদের সাথে? সেখানে তাঁর সব বান্ধবীরা নিজ নিজ বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে? সে যখন দেখছে , তাঁর বান্ধবীরা সবাই নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী বন্ধু ঠিক করে নিয়েছে, তখন সে কতদিন একলা একজন হয়ে দিন কাটাতে পারবে? উপরন্তু সেখানে কোনো বাধাও নেই, বরং পরোক্ষভাবে এক ধরনের উৎসাহ পাওয়া যায়। বন্ধু! তুমিই বলো, এহেন পরিস্থিতিতে কতদিন সে কৃত প্রতিশ্রুতি বলবৎ রাখতে পারবে? এ স্কুলের পরিবেশই লাবণির মনকে নষ্ট করেছে। তাঁর পবিত্র আন্তরকে কলুষিত করেছে।
ধিক! শত ধিক!! এমন শিক্ষানীতি ও শিক্ষার পরিবেশের উপর।
বঁধু! আমি এখনো আমার ওয়াদার উপর অবিচল আছি। আর আমার জন্য এটা খুব সহজ। কারণ আমি মাদরাসায় পড়াশুনা করি। যেখানে অবৈধ প্রেম করার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি সেখানে প্রেম-ভালোবাসা গড়ে তোলার কোনো পরিবেশও নেই।
এখন পথে-ঘাটে তাঁর বয়সী কোনো স্কুল ছাত্রী হঠাৎ নযরে পড়লে প্রাণটা হু হু করে কেদে ওঠে। তাই আমার মনে চায়, আমি এই মেয়েদের অভিভাবকদের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি–আপনারা আপনাদের আদরের মেয়েদেরকে সহশিক্ষার হাইস্কুলে পাঠাবেন না। ওখানে গেলে ওদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওরা আপনাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা চুরমার করে দিবে। নারীর অপূর্ব ভূষণ-লজ্জাশীলতাকে বিদায় জানাবে। বেপর্দায় চলতে অভ্যস্ত হবে। বাড়িতে পাওয়া নৈতিক ও ঈমানী দীক্ষাগুলো ওখানে গিয়ে হারিয়ে আসবে। কারণ, ওখানকার পরিবেশটাই এরকম। ওখানে পাঠালে আপনারা তাদের উপর জুলুম করবেন। আমার অনুরোধ কেউ যেন তাঁর বড় মেয়েকে ছেলেদের স্কুলে না পাঠায়। এই স্কুলের পরিবেশই আমার লাবণীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমার লাবণীর অন্তরকে পাল্টে দিয়ছে।
এতটুকু বলে সোহেল সাকিবের পূর্ণরূপে তাকায়। সে দেখল, সাকিবের চোখ দুটো ভিজে ওঠেছে।
সোহেলের কথা শেষ হলে সাকিব বলল, ভাই সোহেল! আল্লাহর হুকুম না মানার কারণেই আজ এ ধরণের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার জম্ম হচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সহশিক্ষা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম। কেননা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে পর্দাকে ফরজ করা হয়েছে। আর সহশিক্ষা দ্বারা সর্বপ্রথম এই বিধান লঙ্ঘিত হয়। অতঃপর এ থেকে সৃষ্টি হয় হাজারো সমস্যা। রচিত হয় তোমার শোনানো ঘটনার মতো নানাবিধ দুঃখজনক ঘটনা। আল্লাহ পাক সকল মুসলমান ভাইবোনদের কে একথাটি বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুক।
সোহেল বলল, আমীন।
এতক্ষণে বাস সায়েদাবাদ চলে এসেছে। বাস থেকে নেমে সাকিব বলল, ভাই সোহেল! তোমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় আকজের ভ্রমণটা যেমন ভালো লাগল, তেমনি তোমার বলা ঘটনা থেকে আমার চিন্তার জগতেও এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হলো। যা আমার গবেষণা সেন্টারে দারুণ কাজে আসবে। দু’একদিনের মধদ্দ্যেই আমার সাথীদের সাথে পরামর্শ করে ‘সহশিক্ষা’ ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা’ এবং এ জাতীয় কিছু বিষয় নির্ধারণ করে এসব বিষয়ের উপর একটি আলোচনা সভার আয়োজন করব। উক্ত আলোচনা সভায় নির্ধারিত বিষয়ের উপর দেশের খায়াতিমান ইসলামী চিন্তাবিদগণ যে মূল্যবান আলচনা পেশ করবেন, তা দিয়ে আমরা আমাদের রিচার্স সেন্টারের পক্ষ থেকে একটি সেমিনার স্মারক বের করব। আশা করি তুমিও সেদিন আসবে। তোমার অগ্রীম দাওয়াত রইল। তারিখটা তোমাকে পরে জানাব। এবলে সালাম ও বিদায়ী মোসাফাহা করে প্রত্যেক যার যার গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা দিল।
উনিশ
পিতার অবহেলা আর ছোট মা’র নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে বুকভরা অভিমান নিয়ে সাকিব চলে এসেছিলে ঢাকায়। এটা পনের বছরের আগের কথা। সাকিবের বয়স এখন পঁচিশ। তরতাজা যুবক। প্রতিষথিত ব্যক্তি। সুনামের সাথে মাদরাসায় হাদীসের দরস দেয়। রিচার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান। তাঁর অধীনে কাজ করে বহু লোক। আয় উপার্জন খুব একটা কম নয়। ঢাকা শহরে স্ত্রী নিয়ে চলার মত সামর্থ্য তাঁর আছে। মুফতী শফীউল্লাহ সাহেব তাঁর বিয়ে নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত ফিকির করছেন।
এদিকে সাকিব চলে আসার পর তাঁর সৎমায়ের গর্ভে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জম্ম নেয়। ছেলেটি বড়। মেয়েটি ছোট। দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান তিন বছর। মেয়েটির নাম লাবণী। ছেলেটির নাম সেন্টু। সাকিবের পিতার ইচ্ছে ছিল, উভয়কে মাদরাসায় ভর্তি করে এলমে দ্বীন সিখাবেন। আলেম বানাবেন। কিন্তু জেদী ও আধুনিক স্ত্রী রাশেদা খানমের কারণে তা আর সম্ভব হলো না। তাঁর কথা হলো, দু’পয়সার মুন্সি-মৌলভী বানিয়ে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে লাভ কি? আল্মে-উলামারা কি সরকারী কোনো চাকরী করতে পারে? পারে কি হাজার হাজার টাকা রোজগার করতে? পক্ষান্তরে স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করলে স্ববলম্বী হওয়া যায়। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো যায়। সম্মানজনক পদে চাকুরী করে অসংখ্য টাকা কামানো যায়। বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া যায়। সমাজে দাঁড়ানো যায় মাথা উচু করে।
সেন্টু ও লাবণীর নাম রাখা নিয়েও স্বমী-স্ত্রীতে কথা কাটাকাটি হয়েছে। সাকিবের আব্বা চেয়েছিলেন, একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করে তাদের জন্য সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখবেন। কিন্তু রাশেদা খানম অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরেই বলেছিলেন, তুমি শুধু হুজুর হুজুর করো। হুজুররাই কি সব কিছু জানে? আমরা কি কিছুই জানি না? ছেলে মেয়েদের নাম রাখার জনু হুজুরদের যেতে হবে কেন? আমাদের কাছে কি নামের কোনো অভাব আছে? আর সুন্দর অর্থবোধক নামের কথা বলছ! এ যুগে আর এসবের প্রয়োজন নেই। আগের জামানার লোকজন এসব আলতু ফালতু কাজে সময় নষ্ট করত। শুনতে ভাল শোনা যায় এমন একটি ছোট্ট নাম রাখলেই হলো। এত অর্থটর্থ খুঁজে কোনো ফায়দা নেই। বুঝলে!!
তবে তো মনে হয় তুমি আমার নামটি পছন্দ করো না। আতাউর রহমান তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রাশেদা খানমকে অনেকটা শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন।
ঠিক কথাই বলেছ। তোমার জম্মের সময় আমি সেখানে থাকলে আর নাম রাখার ব্যাপারে আমার কোনো কর্তৃত্ব থাকলে এ নাম আমি কখনোই রাখতে দিতাম না।
তাহলে কী রাখতে আমার নাম শুনি।
উজ্জল।
উজ্জল!
হ্যাঁ। তোমার নাম উজ্জ্বল রাখতাম।
এরূপ নাম রাখার হেতু?
তোমার গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল কি না তাই ।
সাকিবের আব্বা স্ত্রীকে চটাতে চান না। সুন্দরী বউ রাগ করে চলে গেলে আবার কোন বিপদে পড়তে হয় কে জানে! তাই তিনি কথা আর সামনে না বাড়িয়ে খামোশো হয়ে যান।
বিশ
সাকিবের সাথে দেখা হওয়ার কয়েকদিন পর শাকিল বাড়িতে যায়। শরীরটা তাঁর বেশ দুর্বল। তবু বিকালে হাঁটতে হাঁটতে সসাকিবের আব্বার সাথে দেখা করে। কুশল বিনিময়ের পর বলে, চাচা!! গত কয়েকদিন আগে সাকিবের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু এলো না। সে বর্তমানে ঢাকায় থাকে। এই নিন তাঁর ঠিকানা। এ বলে ছোট্ট একটি কাগজের টুকরা এগিয়ে দেয় শাকিল।
নিখোঁজ হওয়ার পর দীর্গদিন পর্যন্ত আতাউর রুহমান সাহেব সাকিবকে খোঁজে ফিরেন। এখানে সেখানে যান। ফোন করেন। আত্মীয়-স্বজনদের জানান। সত্যি বলতে কি, সুন্দরী স্ত্রী রাশেদাকে পেয়ে তিনি সন্তানদের প্রতি অনেকটা অমনোযোগী হয়ে গেলেও সাকিবকে হারিয়ে অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি। তাঁর এ অবস্থা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল। পরে অবশ্য লাবণী ও সেন্টু জম্ম হওয়ার পর তাঁর এ অবস্থাটা কেটে গিয়েছিল।
শাকিলের সাথে কুমিল্লায় সাক্ষাৎ কালে সাকিব তাঁর কাছে এ ওয়াদা দিয়ে এসেছিল যে, ঢাকায় ফিরে একটু অবসর হয়েই দু’চার দিন সময় নিয়ে সে বাড়িতে যাবে। শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখবে। স্কুলের সহপাঠি ও খেলার সাথীদের সাথে সাক্ষাৎ করবে।
সাকিব বাড়ি যাওয়ার জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করেছে। সেই তারিখ আসতে আর মাত্র একদিন বাকি। আগামীকাল্ই সেই তারিখ। সাকিব তাঁর কাজ-কর্ম অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছে। কি কি সঙ্গে করে নিয়ে যাবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। ঠিক এমন সময় তাঁর পিতা এসে হাজির। পিতাকে দেখে বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো লাফিয়ে উঠে তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাকিব। এক অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। তবে এ কান্না ব্যথার নয়–আনন্দের; এই কান্না বেদনার নয়–মহামিলনের, এই কান্না সুখের। চোখের পানিতে বেশ কিছুক্ষণ উভুয়ের বুক ভাসল। সত্যিই এ এক অভূতপূর্ব মিলন দৃশ্য!
একুশ
পরদিন পিতাপুত্র যখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছল তখন গ্রামের লোকজন সাকিবকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সেই ছোট্ট সাকিব এখন কত বড় হয়ে গেছে! গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই সাকিবকে দেখে খুশি হলো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাকে দোয়া দিতে লাগল।
এই আনন্দ আর খুশিভরা দিনেও একটি মানুষের মুখে হাসি নেই। কেমন যেন একটা বিমর্ষ ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভিতরে ভিতরে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তিনি।
কে সে লোকটি! কে হতে পারে সে?
রাশেদা খানম। হ্যাঁ, রাশেদা খানমের মুখে আজ হাসি নেই।
যেদিন তিনি শাকিলের মুখে সাকিবের বেঁচে থাকার সিংবাদ শুনেছিলেন, সেদিনই তাঁর চেহারা কালো হয়ে গিয়েছিল। প্রতিহিংসার এক বহ্নি শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠেছিল তাঁর হৃদয় মন্দিরে।
আজ রাশেদা খানম মনে মনে বারবার বলছেন, আহা, যদি এই সাকিব নামের অপদার্থটার কোনো খোঁজই না পাওয়া যেত! যদি ওর অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যেত! সে না থাকলে তো আমরাই এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হতাম। কিন্তু এখন!
বাড়িতে এসে পা রাখতেই সাকিবের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সৎমায়ের নির্মম আচরঙুলো। ফলে সাকিবের চোখ দুটি তখন শুঙ্ক ছিল না। কেউ লক্ষ্য করলে দেখতো, সে আখিঁ দুটিতে কি অসহ্য বেদনা ফুটে ওঠেছিল। কিন্তু নিজকে সামলে নেয় সাকিব। মনে মনে মাকে সে ক্ষমা করে দেয়। ভাবে, আল্লাহ পাক যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। কারণ তখন যদি সৎমা আমার সাথে এরূপ আচরণ না করতেন, তবে হয়তো আমার জীবন অন্যভাবে পরিচালিত হতো। এতদিনে আমি হয়তো শার্ট-প্যান্ট পড়নেওয়ালা কোনো সরকারী কর্মকর্তা হতাম। দাড়ি মুণ্ডানো কোনো ফাসেক হতাম! আলেম ও হাফেজ হওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার হতো না। এমনকি হয়তো একথাও জানতে পারতাম না যে, দাড়ি রাখা ওয়াজিব। না রাখলে কিংবা ছাঁটাছাটি করলে কবীরা গোনাহ হয়।
সাকিব সৎমায়ের ঘরে গিয়ে তাকে সালাম দেয়। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। কিন্তু এই অহংকারী মহিলা আপন কর্মে ব্যস্ত থেকেই কোনোরকম দায়সারা গোছের জবাব দেন। সৌজন্য হিসেবেও তিনি সাকিবের সামনে এসে দুটি কথা জিজ্ঞেস করলেন না। এতদিন কোথায় ছিল, কেন সে ফিরে এলো না, কিভাবে কেটেছে তাঁর দিনগুলো–কিছুই তিনি জানতে চাইলেন না। অথচ তাঁর কারণেই সাকিব আজ পনের বছর যাবত আপন জম্মস্থান ছেড়ে দূরে, বহুদূরে অবস্থান করছে!
সাকিব দশদিন বাড়িতে ছিল। বাড়িতে গিয়ে সে শুনল, লাবণী নামের তাঁর একটি সৎবোন ছিল। সে মারা গেছে। কিভাবে মারা গেছে?–এই প্রশ্ন যখন সাকিব করল তখন তাকে শোনানো হলো ঐ কাহিনী যে কাহিনী সে শোনেছিল মাদরাসা দারুর রাশাদের ছাত্র সোহেলের মুখ থেকে। ঘটনা শুনে সাকিব বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়। তাঁর চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে।
বাড়িতে অবস্থান কালে সাকিব কয়েকবার তাঁর সৎভাই সেন্টুকে ও ছোট বোন খালেদাকে মাদরাসায় ভর্তি করার ব্যাপারে পিতামাতার সাথে আলাপ করেছে। বলেছে, ওদেরকে আমি ঢাকায় নিয়ে যাই। সেখানে ভাল মাদরাসায় ভর্তি করে দেব। সমস্ত খরচও আমি বহন করব।
যাও নিয়ে যাও। আমার কোনো আপত্তি নেই। বললেন, সাকিবের পিতা আতাউর রহমান সাহেব। আর খরচের কথা বলছ? খরচ তোমাকে দিতে হবে না। আমিই মাসে মাসে টাকা নিয়ে যাব অথবা মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে.. .. .. .. ।
আতাউর রহমান সাহেব তাঁর কথা শেষ করতে পারলেন না। রাশেদা খানম ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠলেন, খালেদার ব্যাপারে তোমরা যা মনে চায় করো। কিন্তু আমার সেন্টুকে আমি দেব না। ওকে আমি ব্যারিস্টার বানাব।
সাকিব ও তাঁর পিতা রাশেদা খানমকে অনেক বুঝাল। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তাঁর কথা একটাই। কোনো অবস্থাতেই সে তাঁর একমাত্র ছেলেকে মৌলবী বানাবে না। ফকীরী বিদ্যা(!) শিখাবে না। জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাকে ব্যারিস্টার কিংবা বড় কোণো অফিসার বানাবে। রাশেদা খানমের এ কঠোর মনোভাবের কারণে শুধু খালেদাকে নিয়েই সাকিব ঢাকায় চলে আসে। অতঃপর তাকে নাঈমার সাথে একই মাদরাসায় ভর্তি করে দেয়।
বাইশ
ঢাকা আসার পর সাকিবের ব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কয়েকদিনের মধ্যে সাথীদের সাথে সে পাঁচবার বৈঠক করে। মুফতি সাহেবের সাথ বারবার যোগাযোগ করে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেয়। সাকিব এবং তাঁর সাথীদের মাথায় এখন কেবল একটাই চিন্তা–কিভাবে দেশের প্রখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের রিচার্স সেন্টারে একত্রিত করে একটি সেমিনারের আয়োজন করা যায় এবং সেমিনারের পর সবার মূল্যবান বক্তব্যগুলো বই আকারে প্রকাশ করে দেশের প্রতিটি মুসলিম নরনারীর হাতে পৌঁছে যায়।
দেখতে দেখতে সেমিনারের তারিখ এসে গেল। আজ বহু প্রত্যাশিত সেই সেমিনার যার জন্য সাকিব ও তাঁর সাথীদের সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তবে এই কষ্টের জন্য তারা মোটেও দুঃখিত নয়। কারণ তারা জানে যে, বড় ধরণের ত্যাগ ও কষ্ট ছাড়া বড় কিছু অর্জন করা যায় না।
সাকিব তাঁর হোটেল মালিক হাজী বশীর সাহেব, মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ, বাল্যবন্ধু শাকিল ও মাদরাসা দারুর রাশাদের ছাত্র সোহেল সহ বিশেষ বিশেষ লোকদের কাছে আগেই দাওয়াত নামা পাঠিয়ে দিয়েছিল। দাওয়াত পেয়ে সকলেই যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছে। তাছাড়া অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার বেশ আগেই অসংখ্য লোকের আগমনে পুরো হলরুম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। তারা সাকিবের বিশাল রিচার্স সেন্টার, হাজারো প্রকারের কিতাবপত্র, ২০ টি কম্পিউটার সহ অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে।সোহেল তো বলেই ফেলেছে, ভাই! বর্তমান জমানায় আপনার মতো আলেমই দরকার। আপনার মধ্যে তো আমি একজন দাঈর সবগুলো গুণই দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ আপনাকে আরো বেশি করে দীনের খেদমত করার তাওফীক দান করুন।
সাকিব সোহেলকে শাকিলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে চা-নাস্তা খাওয়ানোর কথা বলে সে একটু বাইরে যায়। এই ফাঁকে শাকিল ও সোহেলের মধ্যে বেশ আলাপ জমে ওঠে। এক পর্যায়ে শাকিল সোহেলকে জিজ্ঞেস করে–ভাই! কিছুক্ষণ আগে আপনি দাঈ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে এও বলেছেন যে, সাকিব ভাইয়ের মধ্যে নাকি দাঈর সব গুণাবলীই বিদ্যমান। এখন আপনার কাছে আমার জানার বিষয় হলো, দাঈ শব্দের অর্থ কি?
এবং দাঈর গুণাবলী-ই বা কি?
সোহেল বলল, দাঈ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো, আহবান কারী। আর পরিভাষায় দাঈ বলা হয়, ঐ ব্যক্তিকে যিনি মানুষকে সত্যের পথে, আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের পথে এক কথায় –ইসলামের পথে আহবান করেন।
আর একজন দাঈর সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তাঁর মনের মধ্যে সব সময় একটা জ্বলন থাকতে হবে। অর্থাৎ সবসময় তাঁর অন্তরে এ চিন্তা বিরাজ করবে যে, কী করে বিপথে পরিচালিত প্রতিটি মানুষকে সঠিক পথে আনা যায়। কি করে তাদেরকে জাহান্নামের পথ থেকে উঠিয়ে জান্নাতের পথে তুলে দেওয়া যায়।
এছাড়া একজন দাঈর মধ্যে আরো কয়েকটি গুণ থাকতে হবে। যথাঃ
১। দাঈর কাজকর্ম ও আচার – আচরণগুলো হবে সুন্দর।
২। তাঁর ভাষা হবে মিষ্ট ও সুস্পষ্ট।
৩। যুগের চাহিদা সম্পর্কে তিনি হবেন সম্যক ওয়াকেফহাল । অর্থাৎ তিনি যে যুগে বাস করেন সে যুগের মানুষদের রুচি-অভিরুচি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী তাদেরকে দীনের পথে আহবান করবেন।
আজকের সভার সভাপতির আসন অলংকৃত করছেন মুফতি শফীউল্লাহ সাহেব।
সকাল দশটা বাজার সাথে সাথে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সভার কার্যক্রম শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মেহমানরা পূর্ব নির্ধারিত নিজ নিজ বিষয়ের উপর তাদের মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন। কেউ আলোচনা করেন সহশিক্ষা নিয়ে, কেউ আলোচনা করেন মুসলমানদের বর্তমান পশ্চাদপদতার কারণ ও তাঁর প্রতিকার নিয়ে, আবার কেউ আলোচনা করেন মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। সবশেষে হামদ ও সালাতের পর সাকিব তাঁর ভাষণ শুরু করে। সে তাঁর বক্তব্যে বলে–
সম্মানিত সভাপতি, হাযরাতে উলামায়ে কেরাম ও বেরাদারানে ইসলাম! আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমাকে আলোচনা করার জন্য যে বিষয়টি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তা হলো, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার। উক্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আমি বলব, ইসলামে নারীকে যে ইযযত ও সম্মান দিয়েছে, আর কোনো ধর্ম-দর্শন তা দিতে পারে নি। পৃথিবীর সকল জাতি–ধর্ম, বিদ্যা-দর্শন নারীকে ছোট করেছে, মানহীন করেছে, পরিণত করেছে সস্তা বেসাতিতে। পক্ষান্তরে ইসলামই একমাত্র জীবনাদর্শ, যা নারীকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে সমাসীণ করেছে, করেছে জীবন – সভ্যতার সমান ভাগীদার।
প্রিয় শ্রোতামন্ডলী! খুটিয়ে দেখলে সহজেই অনুমিত হয় যে, জীবন-সভ্যতার সমান ভাগীদার এই নারী শারীরিক বল-বীর্য, গঠন-সৌষ্ঠব, মানসিক কর্মক্ষমতা, মনন-চিন্তা, সৃজন ও আবিস্কারের পুরুষের চাইতে দুর্বল। উথচ ইস্প্লাম তাকে জীবন জলসায় এনে তুলে ধরেছে, যাতে সে ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে না পারে আমি দুর্বল, আমি হতবল, আমার রন্দ্রে রন্দ্রে বাজে সদা ভীরুতার চাপা সুর।
মুহতারাম ভাইগণ! একজন নারী জীবনে তিনটি স্তর অতিক্রম করে। প্রথম স্তর হলো, শৈশব থেকে কৌশোর পর্যন্ত। দ্বিতীউ স্তর হলো, যৌবনকাল। আর তৃতীয় স্তর হলো, বার্ধক্য। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, এই তিনটি স্তরের প্রতিটিতেই নারী অন্যের ভরসায় প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত তাঁর বাল্যকাল কাটে মা-বাবার স্নেহ-ভালবাসা ও ভরাট যত্নে। মা-বাবার এই মমতাময় ছায়ার নীচে তাঁর জীবন কাটে স্বর্গীয় নিরাপত্তায়। অতঃপর যৌবনে পদার্পন করার পর ‘স্বামী’ নামক এক কর্তব্যনিষ্ঠ পুরুষ এসে কাঁধে তুলে নেয় তাঁর সকল চাওয়া পাওয়ার দায়িত্ব। অতঃপর বার্ধক্যের দুয়ারে কদম ফেলতেই শত শ্রদ্ধা, মমতা ও হৃদ্যতার ডালি নিয়ে পদতলে উপস্থিত হয় আদরের ছেলে-মেয়েরা। ইসলাম নারীকে এভাবেই দেখেছে আদ্যোপান্ত। এক কথায়–জীবনের পদে পদে তাকে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা আর শ্রদ্ধাসহ আগলে রাখার, দেখাশুনা করার মানুষ জোগান দিয়েছে ইসলাম।
নারী যখন জীবনের প্রথম স্তরে অবস্থান করে তখন তাঁর সম্পর্কে ইসলাম বলেছে, কন্যাসন্তান তোমাদের জন্য পুণ্যমালা-নেকীসমূহ । আর ছেলেদের সম্পর্কে বলেছে, ছেলে সন্তান তোমাদের জন্য আল্লাহর নিয়ামত। এর জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো অর্থাৎ ছেলেরা আল্লাহর নেয়ামত । যদি এদের কদর না করো, তাহলে শাস্তি পেত হবে। কিন্তু কন্যাদের সম্পর্কে বলেছেন, এরা সরাসরি তোমাদের জন্য নেকী-পুণ্যমালা। নেকী যেভাবে মানুষকে বেহশতে নিয়ে যায়, এই কন্যারাও তাদের পিতা-মাতাকে বেহেশতে পৌঁছে দেবে। মূলত এভাবেই ইসলাম কন্যাদের প্রতি মা-বাবার দৃষ্টি, দরদ, আন্তরিকতা ও মমতকে আকর্ষণ করেছে। উৎসাহিত করেছে তাতদের মাধ্যমে নিজেদের পরকালের ধনবান করে তুলতে।
এমনিভাবে নারী যখন জীবনের দ্বিতীয় স্তরে উপনীত হয় এবং বধূ হয়ে স্বামীর ঘরে যায় তখন তাঁর সম্পর্কে ইসলাম বলেছে, তোমাদের মাঝে সর্বাধিক কামেল ও পূর্ণ ঈমানের অধিকারী ঐ ব্যক্তি যে সর্বাধিক চরিত্রবান এবং যে তাঁর স্ত্রীর সাথে স্পদাচপ্রপণ করে। (তিরমিযী)
অর্থাৎ উত্তম ও পূর্ণ মুমিন যে , যার চরিত্র উত্তম ও পবিত্র। আর চরিত্র উত্তম তারই, যে তাঁর স্ত্রীর সাথে প্রাণপূর্ণ, প্রেমভরা কোমল আচরণে অভ্যস্ত। স্ত্রীর কোনো ভুল ক্রটি হয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় না। বরং মমতার শীতল পরশ তাকে ধৈর্যধারণ করতে বাধ্য করে।
তারপর নারী যখন জননী হন, তখন তাঁর প্রতি সন্তানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে অত্যন্ত কঠিনরূপে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের পায়ে নিচে সন্তানের বেহেশত। তাই সন্তান মায়ের আনুগত্যে যতটা সচেষ্ট হবে, ততটাই বেহেশতের নিকটবর্তী হবে। আর অবাধ্য হবে যতখানি, বেহেশতের সুবাসিত প্রাঙ্গণ থেকে দূরে সরে পড়বে ঠিক ততখানিই।
মানব দেহের সর্বাধিক স্বল্প মর্যাদাপূর্ণ বরং সবচেয়ে মানহীন অঙ্গ হচ্চে পা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের এই সবচেয়ে কমমূল্যের অঙ্গ পায়ের তলায়ই তোমার বেহেশত। সুতরাং এই মায়ের মূল্য যে কত, তা সহজেই অনুমেয়।
পক্ষান্তরে আমরা যদি অন্যান্য ধর্ম-দর্শনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ইসলাম পূর্বকালে ইহুদীদের দাপট ছিল প্রচন্ড। কিন্তু তাদের সমাজ দর্শনে নারী ছিল চরমভাবে অবহেলিত। তাদের সামাজিক আইনে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিধান অনুমোদিত ছিল। তাই কোনো পিতা জাহেলী যুগে নিজের কন্যাকে জীবন্ত প্রোথিত করলে তাঁর কোনো বিচার হতো না।
গ্রিক দর্শন মন্থন করলে বুঝা যায়, কোনো নারী স্বামী সংসারে আসার পর তাকে দাসীরূপে বিবেচনা করা হতো। বরং মর্যাদা ছিল দাসীরও নীচে। সামান্য ক্রটি কিংবা অপরাধে স্বামী তাঁর স্ত্রীর গর্দান উড়িয়ে দিত পারত। আর এটাছিল তাঁর বিধিবদ্ধ ও অনুমোদিত অধিকার। সামান্য অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ নারীকে ঘোড়ার পায়ের সাথে বঁধে ক্ষমতাধর স্বামী দ্রুত গতিতে হাঁকিয়ে নিয়ে যেত ঘোড়া। আর অসহায় অবলা স্ত্রীর কোবল নরম দেহ কংকরের আঘাতে রক্তাক্ত হতো, ক্ষতবিক্ষত হতো। কিন্তু রা’ করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর।
তারপর এলো ইসলাম। ইসলাম নারীকে করল মহা মর্যাদাবান। ঘোষণা করল, নারী নাড়ীর ধন, পরকালের সম্পদ, অপরিসীম কল্যাণের আঁধার। নারী নরের সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী, আত্মার একান্ত আত্মীয়। বরং নারীই মহান জননী।
প্রিয় উপস্থিতি! নারী মানব ও মানব সভ্যতার অর্ধাংশ। তাই সভ্যতার বিকাশ ও নির্মাণে মানবগোষ্ঠির পদচারণা ঘটেছে যত অঙ্গনে, নারী তাঁর অংশীদার ও সঙ্গী হয়েছে সদাসন্তর্পণে। পুরুষ সংসার পেতেছে, নারী দিয়েছে তাতে সার্বক্ষণিক শ্রম। পুরুষ সমাজ গড়েছে, নারী দিয়েছে তাতে হৃদ্যতার প্রাণ, পুরুষ শাসন করেছে দেশ, সভ্যতা, যুদ্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রেই নারীর অবদান অসামান্য, সূর্যের আলোর মতো বৃদ্ধমান।
অপরাধীরা অপরাধ চর্চার পথ মুক্ত করতে যখনই সভ্যজনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে , সমাজের বীর পুরুষেরা মহাপরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। তখন নারীরাও ঘরে বসে থাকেনি। মানবতা, সভ্যতা ও সত্যের প্রতি অসীম প্রেম, বিশ্বাস ও অনুরাগ নিয়ে তারাও এগিয়ে এসেছেন বীরঙ্গনার বেশে। কখনো বা বীর দর্পে অবতীর্ণ হয়েছেন সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে। কখনো বা নিজের কলজে ছেঁড়া ধন আদরের দুলালদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন আল্লাহর পথে, দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। ইতিহাস তাদের নাম আজো গর্বের সাথে স্মরণ করে।
প্রিয় শ্রোতৃমণ্ডলী! নারী প্রেমময়ী, নারী প্রেমের আকর। জগতে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, স্নেহ-ভালবাসা ও মমতা প্রতিষ্ঠায় নারীর অবদান সীমাহীন। নারী যখন কাউকে ভালোবাসে, তখন হৃদয়ের গভীরতায় ঢুকেই তাকে ভালোবাসে। হৃদয়ে সঞ্চিত তপ্ত খুনে জ্বালিয়ে রাখে প্রেমের প্রদীপ। পার্থিব এই ছোট্ট পৃথিবীর সব কিছুই তখন তাঁর কাছে হয়ে পড়ে একেবারে মূল্যহীন। প্প্রেম-ভালোবাসার এই প্রাণময় ভূবনে নারীর ত্যাগের স্বাক্ষর জগৎব্যাপী। পৃথিবীর সকল সভ্যসমাজই তা জানে, প্রত্যক্ষ করে প্রতিনিয়ত।
সম্মানিত সুধী! বর্তমান সভ্য পৃথিবীর একটি বড় জিজ্ঞাসা হলো, নারীর অবস্থান কোথায় হবে? ঘরে না বাইরে! সুরক্ষিত অন্দর মহলে না অতক্ষিত শিল্প-ভূবনে-যেখানে আলো অন্ধকার, ভাল-মন্দ, সভ্য-অসভ্য সবাই এক সাথে গলাগলি করে বসবাস করে।
মতামত উভয় দিকেই আছে। যুক্তিরও কোনো শেষ নেই। সুতরাং ওসব যুক্তিতর্ক আর মতলবী কথার উর্ধ্বে ওঠে এই নারী-পুরুষের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর কাছেই তাঁর সমাধান চাওয়া অধিক নিরাপদ ও বিবেকসিদ্ধ। কারণ, যিনি যা তৈরি করেন, আবিস্কার করেন, নির্মাণ করেন তিনিই সেই জিনিষ সম্পর্কে অন্যের চাইতে ভালো জানেন, এ ব্যাপারে বেশি জ্ঞান রাখেন তিনিই। উদাহরণ স্বরূপ একটি গাড়ির ক্তহাই ধরুণ। সর্বপ্রথম যিনি গাড়ি আবিস্কার করেছেন, তখন গাড়িস ব্যাপারে সেই আবিস্কারকর্তার যতটুকু জ্ঞান ছিল, ততটুকু জ্ঞান কি তখন আর কারো ছিল? অর্থাৎ গাড়িটি কিভাবে চালাতে হবে, কিভাবে রাখতে হবে, কিভাবে উহাকে ড্রাইভ করলে চালক ও আরোহী উভয়ের জন্য মঙ্গল হবে, কিভাবে উহাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি তিনি যেমন জানতেন, সেরূপ কি অন্য কেউ জানতো? না। জানতো না। হ্যাঁ, পরবর্তীতে তিনি নিজে যখন অন্যদেরকে এ ব্যাপারে জ্ঞান দিয়েছেন, শিখিয়েছেন তখন তারা জানতে পেরেছে।
সুতরাং আল্লাহ পাক যখন মানুষ নামক এ গাড়ি তৈরি করেছেন, বানিয়েছেন, তখন তিনিই যে উহার কল্যাণ-অকল্যাণের ব্যাপয়ারে অধিক ভালো জানেন, সে সম্পর্কে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। বরং উপরি উক্ত উদাহরণের আলোকে একথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায় যে, মানুষ নামের এ গাড়ি কিভাবে চললে, কোথায় থাকলে ভালো থাকবে, তা মহান আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভালো জানেন।
প্রিয় শ্রোতামণ্ডলী! উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে গেল যে, নারীর অবস্থান কোথায় হবে, তা মহান রাব্বুল আল্লাহ তাআলাই পরিপূর্ণভাবে জানেন এবং তিনি যা জানেন, সেটাই হবে গ্রহণযোগ্য। কারণ নারীর সৃষ্টিকর্তা তো তিনিই। তাই আসুন, আমরা এবার লক্ষ্য করে দেখি, নারী কোথায় থাকবে কোথায় অবস্থান করবে, সে সম্পর্কে মহান প্রভু কি বলেছেন। তিনি বলেছেন–
“তোমরা তোমাদের ঘরেই অবস্থান করো। আর প্রাচীন মূর্খযুগের নারীদের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না। ” [আযহাবঃ৩১]
আলোচ্য আয়াত থেকে একথা পরিস্কার ভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ পাক চান, নারীরা তাদের বাড়ির ভেতর অবস্থান করুক। কারণ, গৃহকর্ম নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও সম্পাদনের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যেই তাদের সৃষ্টি। তাই তারা গৃহে, গৃহকর্মে, গৃহ সৌন্দর্য নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এই তো কাম্য।
অধিকন্তু এই কারণেই আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে ‘আহলে বাইত’ তথা ঘর ওয়ালী বলে সম্বোধন করেছেন। বলেছেন, স্ত্রীরা হলো ঘরের মালিক। যেমন আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী হযরত সরা রাঃ কে আইলে বাইত শব্দে স্মরণ করেছেন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনসঙ্গিনী আমাদের আম্মাজানদেরকে আহলে বাইত বলেছেন। এর অর্থ হলো, নারীরাই ঘরের অভিভাবক ও পুরিচালক। ঘরের নিয়ন্ত্রণ, পরিচর্যা ও পরিচালনা দায়িত্ব তাদেরই। এ মর্মে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, স্ত্রী তাঁর স্বামীর ঘরের অভিভাবক। [বুখারী]
এই হাদীসের অর্থ খুবই স্পষ্ট। দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার। অর্থাৎ নারীর ভূবন হলো সুরক্ষিত সংসার জগৎ। এই জগতের শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা ভাবাই তাঁর কাজ। স্বামী-সন্তানের পরিচর্যা ও গৃহ কর্মের শিল্পময় অভিভাককত্বের জন্যেই আগমন তাঁর এই সুন্দর পৃথিবীতে। এই লক্ষ্য ও বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে যারা সক্ষম হয়েছে, তারাই মূলত সফল, সার্থক ও কল্যাণময় জীবনের অধিকারী–এই জগতে এবং পরকালেও।
পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ তাআলার এই সুন্দর ফায়সালার আআভাময় সত্যকে উপলদ্ধি করতে অক্ষম হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে বিতাড়িত শয়তান ও স্বীয় নফসের কুমন্ত্রণায়, আল্লাহ পাক কর্তৃক নির্ধারিত এই সুরক্ষিত আবাস ঘরকে মনে করেছে বদ্ধ খাঁচা–তাা বিফল, ব্যর্থ ও অশান্তির আকর। দুনিয়ার জীবনে তারা হাজারো পেরেশানী ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হবে, আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শস্তি।
প্রিয় হাজেরীন! আজকাল অনেকেই বলে থাকেন, মেয়েরা বাড়ির ভেতর আবদ্ধ পরিবেশে অবস্থান করলে তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাবে। বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে মৌলিক কথা হলো, প্রথমেই প্রতিটি মুসলমানকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ পাক যেভাবে সমগ্র জাহানের মালিক, সুস্থতা-অসুস্থতারও তিনিই মালিক। অর্থাৎ এই বিশাল পৃথিবীর সবকিছু যেভাবে তাঁর নির্দেশের অধীন, তেমনি স্বাস্থ্য, ব্যাধি, সুখ, শান্তি সবই তাঁর নির্দেশের অধীন। সুতরাং আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করতে গিয়ে কেউ রোগ-ব্যাধির প্রকোপে পড়বে এটা কেবল অবাস্তবই নয় অযৌক্তিকও বটে। বরং যারা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে প্রভু হিসেবে বরণ করে নিয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য, সুখ, সমৃদ্ধি সবই নিহিত ওই সুরক্ষিত ঘরের ভেতর, আল্লাহর আইন মান্য করার ভেতর। আর যারা মুখে আল্লাহ স্বীকার করলেও প্রকৃত অর্থে শয়তানকে গ্রহণ করেছে বন্ধুরূপে, বদ্ধ সুরক্ষিত অঞ্চলে তারা নিজেদেরকে আবদ্ধ-আক্রান্ত, অসুস্থ-ব্যাধিগ্রস্থ ও পীড়িত মনে করবে এটাই স্বাভাবিক।
মুহতারাম শ্রোতৃমণ্ডলী! ‘পর্দার বিধান নারী-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’–এ ধরণের উক্তি সত্যের অপলাপ ও একশ ভাগ মিথ্যা বৈ কিছু নয়। কারণ আজ চৌদ্দশ বছর যাবত মুসলিম মা–বোনের পর্দার বিধান মেনে আসছেন। পর্দা যদি সত্যিই নারীদের জন্য স্বাস্থ্যহানীর কারণ হতো, তাহলে তো পর্দানশীন প্রতিটি নারীই থাকতো রুগ্ন, অসুস্থ্য, ব্যাধিগ্রস্থ। তারা হতো দুর্বল, শক্তিহীন ও অক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা কি তাঁর উল্টো নয়? জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, পর্দানশীল মেয়েদের তুলনায় বেপর্দা নারীর স্বাস্থ্য অধিক দুর্বল।
পর্দা যদি নারী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতো, তবে তো পুরুষের তুলনায় নারী মৃত্যুর হার বেশি হতো। অথচ স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট কিন্তু সে কথা বলে না।
পর্দা যদি নারী স্বাস্থ্যের পরিপন্থি হতো, তাহলে পর্দানশীন মেয়েদের বাচ্চারা বেপর্দা নারীদের বাচ্চাদের চেয়ে বেশি সবল ও সুস্থ হতো না। অথচ স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, বেপর্দা নারীর সন্তানএর তুলনায় পর্দানশীন নারীর সন্তানই অধিক সুস্থ ও সবল থাকে।
আসল কথা হলো, পর্দার বিধান পালন নয়, পর্দার বিধান বর্জনই নারী স্বাস্থ্যের অবনতির মূল কারণ। এটা আমার নিজের কথা নয়, পাশ্চাত্য মনীষীরাই একথা স্বীকার করে গেছেন। তারা বলেছেন, পর্দা পরিহারের ফলে সহনশীলতা, বিচার-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান বিপন্ন হয়। তাই পাশ্চাত্য নারীরা এশীয় নারীদের তুলনায় অধিক পরিমাণে আত্মহত্যা করে থাকে।
বাস্তব সত্য হলো, ‘পর্দার বিধান মেনে চলা এবং অবাধ মেলামেশা থেকে দূরে থাকা নারী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’–এ উক্তির সপক্ষে আজ পর্যন্ত একটা যুক্তিও খোঁজে পাওয়া যায় নি। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান বর্জনে নারীর স্বাস্থ্যহানী ও চেহারার কোমলতা বিনষ্ট হয়, তা অনেকেই স্বীকার করেছেন।
প্রিয় উপস্থিতি! আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই–যা পরীক্ষিত সত্যও বটে–কোনো নারী যদি আল্লাহ তাআলার আদেশ মান্য করে ঘরবাসিনী হয়ে যায় এবং ঘর-দোরের নিয়ন্ত্রণ ও কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব স্বীয় কাঁধে তুলে নেয়, তাহলে তাকে স্বাস্থ্যগত ব্যায়ামের লক্ষ্য হলো–১. শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হওয়া, ২. দেহ ঘর্মাক্ত হওয়া, ৩. দেহের পরতে পরতে কর্মক্লান্তি অনুভূতি হওয়া। মূলত এ কয়টি কার্য হাসিলের জন্যই ব্যায়াম করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো নারী যদি ঘর-সংসারের কাজকর্ম নিজ হাতে আঞ্জাম দেয়, স্বামীর খেদমত ও স্বীয় সন্তানের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিজেই শ্রম নিবেদন করে, ঘর-দোর নিজেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সচেষ্ট হয়, তাহলে একদিকে যেমন তাঁর সিন্তানেরা সুন্দর ও চমৎকার ভবিষ্যৎ নিয়ে গরে ওঠে, তেমনি তাঁর শরীর, স্বাস্থ্য, মন-চিন্তাও থাকে সবল ও পূতঃপবিত্র। মূলত আজকের এই আধুনিক পৃথিবীও সেই স্বাস্থ্যবতী, কর্মপ্রেমী ও সংসার প্রিত নারীদের দিকেই তাকিয়ে আছে–যাদের হাতে গড়া সুস্থ-সবল সন্তানেরা অশান্ত, যুদ্ধমুখর এই পতিত পৃথিবীকে শোনাবে নতুন স্বপ্নের কথা, কল্যাণময় সৃষ্টি ও বিপ্লবের কথা।
মোট কথা, নারী যদি তাঁর নির্ধারিত আপন ভূবনে এসে যায়, তবেই সে পাবে পূর্ণ নিরাপত্তা-যেখানে তাঁর জীবন, সম্ভ্রম ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাকে ভুগতে হবে না কোনো সংশয়ে। নিশ্চয়ই ঘরই নারীর ভুবন, নিরাপদ ইলাহী আশ্রয়।
সজল, কলেজ ও ভার্সিটির শিক্ষিত ভাইবোনদের জন্য আজ আমাদের দুঃখ হয়। কেননা তাদের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে না জেনে, পাশ্চাত্যের প্ররোচনায় ইসলাম ও ইসলামী বিধি-বিধান যেমন, পর্দা, নারী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে মিথ্যা সমালোচনা করে ভ্রান্ত পথে ধাবিত হচ্ছেন। আর তাদেরই সমালোচনায় প্রভাবিত হয়ে কিছু নারীও আজ শ্লোগান দিচ্ছে–
“পর্দা প্রথা মানবো না, বদ্ধ ঘরে থাকব না”। আমি ঐসব মেয়েদের জিজ্ঞেস করতে চাই, হে নারী! কে তোমাকে বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেছে? পর্দার বিধান তো তোমার অমঙ্গল কিংবা ক্ষতির জন্য দেওয়া হয়নি, বরং এ বিধান তো দেওয়া হয়েছে তোমার ইজ্জত ও নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরেই। তদুপরি ইসলাম তো তোমাকে জরুরী প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া তো পুরুষেরাও ঘর থেকে বের হতে চায় না। তবে তুমি কেন বিনা প্রয়োজনে হাটে-ঘাটে ঘুরে বেড়াবে” নর শিকারের জন্য? কেন? তোমার বর্তমান স্বামী যদি তোমাকে তৃপ্ত করতে না পারে তাহলে কোর্টের মাধ্যমে তাকে তালাক দিচ্ছ না কেন? এবং মনের মনের মতো একজন পুরুষ বেছে নিয়ে বিয়ে বসতে লজ্জা করছ কেন? এতে তো ইসলাম তোমাকে বাধা দিচ্ছে না, বরং তোমার পক্ষেই রায় দিচ্ছে।
ইসলাম বলেছে–দরকারে হাটে যাবে, মেডিকেলে যাবে, গাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে যাবে। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করবে। যাওয়া যদি আবশ্যক হয়, যাবে না কেন? যাবে। কিন্তু যুবকদের মাথাটা খাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনের ছুতোয় ঘরের বাইরে বের হয়ে শালীনতা নষ্ট করা বা বেহায়া হওয়াটা ইসলাম অনুমোওদন করে না।
ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করে–অন্ধকার যুগের ললনাদের মতো অশ্লীল ঢংয়ে রাস্তায় বের হওয়াকে। নিষেধ করে-পাতলা ফিনিফিনে কাপড় পরে, ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে, ঠোঁটে লিপিস্টিক, গালে রুজ, ভ্রু যুগলে কাজল দিয়ে সেই রকম ভাবে সেজেগুজে, আধুনিক স্টাইলে কেশ বিন্যাস করে উলঙ্গ মস্তক নিয়ে ঘুরাফেরা করতে।
আমি আজ সকল মুসলিম মা-বোনকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, হে মুসলিম নারীরা! তোমরা সমান অধিকারের শ্লোগান তুলে যেভাবে দিগ্মবরী নৃত্য আরম্ভ করে দিয়েছ, সেই সমান অধিকার তো ইসলাম তোমাদেরকে চৌদ্দশ বছর পূর্বেই প্রদান করেছে। শুধু তোমাদের দৈহিক সামর্থ্য ও কাঠামোর কথা বিবেচনা করেই ইসলাম তোমাদের দায়িত্ব, কর্ম ও পোষাক নরদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
হে ললনা! তুমি যখন আলট্রামর্ডান পোষাক পরে সর্বাঙ্গে প্রসাধনী লেপে পথে প্রান্তরে, পার্কে–মার্কেটে ঘুরাফেরা কর এবং শত শত পুরুষের সামনে দিয়ে গা ঘেঁষে চলো তখন তুমিই বলো তো, শতকরা কতজন পুরুষ তোমার দিকে তাকায় না? তাদের এ দৃষ্টি সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? এ দৃষ্টি কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক?
হে যুবতী! আমি জানি, তুমি যদি সত্যপ্রিয় হও তাহলে প্রশ্নের জবাবে তুমি বলবে, ‘আমার অনুভব হয়, নরগণ যেন আমাকে আক্রমণ করে বসবে’। আর তোমারও মনেও একটা বিকৃত কামাচারের ভাব সৃষ্টি হয় নিশ্চয়ই।
তাছাড়া এই কুদৃষ্টির ফলাফল এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারাই ব্যভিচারের পথ খুলে যেতে পারে। কারণ, দেখা থেকে যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে দেখা, তারপর চোখ লাগা, তারপর কামানলের উৎপত্তি আর তার পরই যতকিছু ঘটার ঘটে থাকে। সুতরাং দেখতেই যদি না পারত, তাহলে ব্যভিচার পর্যন্ত পৌঁছার কোনো প্রশ্নই ওঠত না। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুক।
সম্মানিত শ্রোতৃমণ্ডলী! আমার বক্তব্য দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছেন। আমি আর.. .. .. ।
‘না, না আপনি বলে যান। আমাদের খুব ভালো লাআগছে। এমন মূল্যবান কথা আমরা সারাদিন শুনতেও রাযি আছি।’ সাকিব তাঁর মুখের কথা শেষ করার আগেই উপস্থিত জনতা সমসবরে বলল।
সাকিব আবার শুরু করল। বলল, আপনারা যখন শুনতে আগ্রহী, তাই আরো দু’চারটা কথা বলি। এ পররায্যে আমি আপনাদের সামনে মামা-ভাগীনির একটা চমৎকার গল্প শুনাতে চাই। কী বলেন আপ্নাররা, শুনতে রাযি আছেন?
গল্পের কথা শুনে সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। সেই সাথে বিকট আওয়াজে বলল, বলুন হুজুর বলুন। সামরা তো শুন্তেই এসেছি। এমন সারগর্ভ ও হৃদয়গ্রাহী কথা আমরা পাবো কোথায়!
সাকিব তাঁর গলাটা একটু পরিস্কার করে বলতে লাগল–
নরসিংদী জেলা সদরের অন্তর্গত বালি গ্রামে একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটির একমাত্র মামা বি.বাড়িয়া সদর হাস্পাতালের বড় ডাক্তার। নাম ডাঃ মাজহারুল ইসলাম। প্রায়ই তিনি একমাত্র ভাগীনী আয়েশা আখতারকে দেখতে যেতেন। বিশেষ করে প্রতি ইংরেজী মাসের শেষ শুক্রবারে আলোকবালি যাওয়াটা তাঁর রুটিনে পরিণত হয়েছিল। তিনি যখনই ভাগীনীকে দেখতে যেতেন, তখন তাঁর জন্য আর কিছু না পারলেও একখানা গল্পের বই অবশ্যই নিয়ে যেতেন।
একদিনের ঘটনা। শ্রাবণের বারি তখনো বর্ষিত হচ্ছিল অঝোর ধারায়, অথচ দিনের শেষ বিকেলে অতিবাহিত হচ্ছে। সেই যে সকাল থেকে শুরু এখনো বন্ধ হওয়ার কোনো নাম-গন্ধ নেই। এমন দিনে মানুষ বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে ঘর থেকে বের হয় না।
দিনটা ছিল শুক্রবার। তাও আবার শেষ শুক্রবার। সুতরাং বৃষ্টি মাথায় করে হলেও মাজহার সাহেবকে আজ আলোকবালী যেতে হবে। কারণ ভাগিনীটা নিশ্চয়ই মামার অপেক্ষায় পথ পানে চেয়ে আছে। একবার না গেলে, পরের বার সে মামার কাছেই আসবে না। অভিমান করবে। মুখ ভয়ার করে বসে থাকবে। অতএব কী আর করা!
বৃষ্টিমুখর এ অলস বিকেলে আয়েশার একমাত্র সাথী মামার দেওয়া কোনো বই। আয়েশা জানে, তাঁর মামা এ বৃষ্টির দিনেও আসবেন। তাই সে জানালার কাছে একটি বই খুলে পড়তে পড়তে মামার প্রতিক্ষায় সময় কাটতে থাকে।
আয়েশা একটি গল্প শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখতে চেষ্টা করে, তাঁর মামাকে দূরে, বহুদূরে আসতে দেখা যায় কি না। কিন্তু না, মামা আসছেন না। বারবার তাঁর দৃষ্টি গিয়ে ঐ নীল আকাশে গিয়ে স্থির হয়। তখন সে মনে মনে ভাবে, ঐ বিরাট আকাশ আর বিশাল পৃথিবীর স্রষ্টা কত মহান! কত অসীম তিনি। দিগন্ত জুড়ে তাঁর সৃষ্টি। তাঁর রহম-রকম সৃষ্টির প্রতিটি অনু-পরমানুতে বিদ্যমান। তাঁর নিয়ন্ত্রণ কত সুনিপুণ-যার সাক্ষী এ বিন্যস্ত বর্ষণ ধারা।
আয়েশা যখন গল্পের বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মহান মাবুদের কারিগরী কৌশল ও সৃষ্টিশৈলী নিয়ে ভাবছিল, তখনই হঠাৎ দেখা গেল, মামা এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছেন ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে। ডান হাতে ছাতা আর বাম হাতে সপিং ব্যাগ ভর্তি কিছু জিনিষ। আয়েশা বুঝে ফেলে, এ ব্যাগে আর যাই থাকুক, তাঁর প্রিয় লেখকের নতুন কোনো বই তো নিশ্চয়ই আছে।
মামার নিয়ে আসা এ মূল্যবান বইগুলোকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে আয়েশা হাত পেতে গ্রহণ করে। সে তাঁর মামাকে একবার দু বার নয়, বারবার বলেছে, মামা! বই আমার অবসরের সাথী, জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সুতরাং বই না এনে আপনি আর যাই আনুন কেন, আমি কিন্তু মোটেও খুশি হবো না।
সেদিন মাজহার সাহেব ঘরে ঢুকেই আয়েশার হাতে শপিং ব্যাগটা তুলে দেন। বলেন, নে। তোর জন্য আজ হৃদয় গলে সিরিজের ১৯ ও ২০ নং খন্ডটি নিয়ে এলাম। ব্যাগের ভিতর একটি দৈনিক পত্রিকাও আছে। ট্রেন থেকে নেমে নরসিংদী রেল স্টেশন থেকে পত্রকাটি কিনেছি। পড়ার সুযোগ হয় নি। তাই ওটাকে নষ্ট করিস না। জরুরী প্রয়োজনে আমাকে তা পড়তে হবে।
বৃষ্টিতে পত্রিকাটি প্রায় ভিজেই গিয়েছিল। আয়েশা পত্রিকাটি ব্যাগ থেকে খুলেই দেখল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপানো হয়েছে একটি নারী মিছিল। মিছিলের অগ্রভাগে কতগুলো মহিলা হাত উচিয়ে যেন চিৎকার করে আছে। অবশ্য মিছিলের অবস্থা দেখে বুঝাই যাচ্ছে, মহিলার সংখ্যা বেশি হবে না। তবু যেন এ স্বল্প কয়েকজন মহিলা রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে। বয়স্কা এসব মহিলার চেহারায় দাম্ভিকতার ছাপ স্পষ্ট।
আয়েশা ছবির নীচের লেখাটি পড়ল। পড়ে বুঝল, মিছিলটা নারী মুক্তি আন্দোলনের মিছিল।
ডাঃ মাজহাব সাহেব ততক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। আয়েশা মিছিলের ছবিটা মামাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল–
মামা! ওদেরকে কে বন্দী করেছে?
কেন রে আয়েশা! এমন প্রশ্ন করছিস কেন?
এই যে তারা মুক্তি চাচ্ছে। বন্দী না হলে কি আর মানুষ মুক্তি চায়?
আয়েশার কথায় মাজহার সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন–
ওরা তো তো তোদের জন্যেই কাজ করছে। তারা মিছিল করছে, তোদের অধিকার, তোদের মুক্তি, তোদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার জন্য।
এ কথা শুনে আয়েশা যা বুঝার বুঝে নিল। সেই সাথে এও অনুভব করছে, মামা যদিও তাঁর কথাগুলো ব্যঙ্গ করে বলেছেন, তথাপী এ বিষয়ে তাঁর মনে কত যে দুঃখ, কত যে ক্ষভ পুঞ্জিভূত হয়ে পর্বতসম উচু হয়ে আছে, তাঁর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। মামার কাছ থেকে এ সম্পর্কে আরো কিছু জেনে নেই। তাই সে মামাকে আবার বলল, মামা! কথাটা ভালো করে বুঝতে পারলাম না। দয়া করা একটু খুলে বলুন।
মামা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আয়েশা! স্বাধীনতা শব্দটি বড়ই মজার, বড়ই শ্রুতিমধুর। সকলেও স্বাধীন থাকতে চায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে কেউ আবদ্ধ হতে চায় না। কিন্তু যে ব্যক্তি আগে থেকেই স্বাধীন, সে যদি আবার স্বাধীনতার দাবী করে বসে তাহলে তাঁর এই পদক্ষেপ হাস্যকর নয় কি? আয়েশা! ইসলাম পূর্ব যুগে নারীরা স্বাধীন ছিল না। পুরুষের গোলামী করেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ইসলাম কোনো আন্দোলন ছাড়াই তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছে। সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামী আইনে নারীরা এখন স্বাধীন। তাই স্বাধীনতার নতুন ভাবে তাদের ভকোনো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। কোনো মুসলিম নারী যদি স্বিয় অধিকার আদায়ের জন্য, স্বাধীনতা লাভের জন্য আন্দোলের ব্রতী হয়, তাহলে বুঝতে হবে–হয়তো সে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ; ইসলাম তাকে যে অধিকার দিয়েছে সে সম্পর্কে সে বেখবর, নয়তো সে সবকিছু জেনে বুঝে পশ্চিমাদের থেকে টাকা খেয়ে তাদের দালালী করছে।
একথা বলার সাথে সাথে চতুর্দিকে থেকে শ্লোগান ওঠল, নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার। পশ্চিমাদের দালালরা হুঁশিয়ার, সাবধান। যদি তোমরা ভালো চাও, এদেশ ছেড়ে চলে যাও। নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবর।
শ্লোগানের ফাঁকে সাকিবও একটু জিরিয়ে নেয়। সামনে রাখা পানিটুকু খেয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়। তারাপর সে আবার বলতে থাকে–
বেরাদারানে ইসলাম! আমার প্রশ্ন হলো-কেন নারীরা এভাবে অর্ধউলঙ্গ হয়ে রাস্তায় হাত উচিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বেড়াবে? কেন তারা রাস্তায় দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের হাসির খোরাক হবে? কেন তারা মাথায় ঘোমটা ফেলে মাজায় আঁচল বেঁধে কখনো বা পুলিশের পিটুনি খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফিরবে? তার কোন স্বাধীনতা চায়? কিসের মুক্তি চায়? কী ওদের দাবী?
দাবী আদায়ের জন্য তারা যে পথ অনুসরণ করে চলেছে, সেপথ যে বড় দুর্গম, কণ্ঠকাকীর্ণ । সে পথে যে বিরম্বনার অন্ত নেই, বরঞ্চনার শেষ নেই।
অথচ নারী, সে তো ফুলের বাগিচা। সে তো চলবে ফুলঝরা পথে। তাঁর পথ তো কুসুমাস্তীর্ণ। কিন্তু যে পথ সে আজ অবলম্বন করেছে সে পথে চলে কি পারবে স্বাধীনতার বিজয় কেতন ব্যক্তি জীবনে উড়তে? সম্ভব হবে কি মুক্তির মিনারে পৌঁছা এসব মিলিছকারীদের? পারবে কি অধিকার নামক অবাস্তব সোনার হরিণ ধরতে?
জানি, তা কখনো সম্ভব নয়। কারণ তারা ভুল পথে এগিয়ে চলেছে। আর ভুল পথে চলে কখনো মনযিলে মাকসুদে পৌছা যায় না। তারা মনে করছে, পাশ্চাত্য নারীদের মতো বলগাহীন অশ্বের ন্যায় চলতে পারাটাই বুঝি আসল স্বাধীনতা। এতেই বুঝি মুক্তি, এখানেই বুঝি জীবনের সব আনন্দ আর সফলতা লুকিয়ে আছে।
তাদের এ ধারণা ভুল। তাদের এ পদক্ষেপ তাদের অসার চিন্তারই ফসল।
আসল কথা হলো, পাশ্চাত্যে জগত নারীরা প্রকৃত অধিকার দানের ব্যর্থ হয়েছে। নারীকে স্বামীর সোহাগ, পিতার স্নেহ, ভাইয়ের আদর ও সন্তানের ভক্তির মতো বিরল সম্মান পাশ্চাত্য জগৎ দিতে পারেনি। পাশ্চাত্যের নারীরা আজ স্বামী ও সংসারের অধিকার হতে বঞ্চিত। তারা খুঁজে পাচ্ছে না নারীত্বের মর্যাদা, পাচ্ছেনা গৃহ-সংসারের সুখ-শান্তি। বুঝতে পারছে না, পুরুষের অভিভাবকত্বে নারীর মর্যাদা কত বেশি ও কত কল্যাণকর। তাই পাশ্চাত্যের নারীরা অধিকারের জন্য রাস্তায় নামে, দাবি আদায়ের জন্য মিছিল নিয়ে বের হয়। কাজের জন্য সংগ্রাম করে।
পাশ্চাত্য জগতে নারী-পুরুষের মাঝে ভালোবাসার গভীরতা নেই। তাই তাদের বৈবাহিক সম্পর্কও হয় ভঙ্গুর ও ঠুনকো। তারা পরিবারের কারো কাছ থেকেই প্রকৃত আদর সোহাগ ও স্নেহ পায় না। আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত এসব নারীরা স্বাবলম্বী হতে চায়। দাঁড়াতে চায় নিজ পায়ে। কারণ সেখানকার পরিবেশ ও অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আয়-উপার্জন ব্যতীত নিজ পরিবারেও নারীরা চরমভাবে অবহেলিত ও ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে। সাধারণ সম্মানটুকুও তারা পায় না। রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান থেকে শুরু করে পারিবারিক আইনে পর্যন্ত একজন নারীকে পুরুষের সমক্ষক হয়ে কাজ করতে হয়। তবেই খাবার মিলবে । নচেৎ নয়। এটার নামই কি সমান অধিকার? না, এটা মূলত সমান অধিকার নয়। বরং এটা হচ্ছে, ঘরে বসে খাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে গুরুদায়িত্বের বোঝা মাথা পেতে গ্রহণকরণ। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ নসীব করুণ।
সম্মানিত ভাইগণ! আজ পশ্চিমা নারীরা এতই অসহায় যে, স্কুল জীবন থেকেই তারা সম্ভ্রম হারাতে শুরু করে। এরপর লিভ টুগেদারের শিকারের হয় যুবতী থাকা অবস্থায়। বিনিময়ে তারা কী পায়? কিছুই না। সেখানকার নারীরা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ নিয়ে। বাসায় যখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন, তখন তাঁর কাজ করে দেওয়ার মতো কেউ নেই। নেই কোনো সহযোগী। ফলে বাধ্য হয়ে তাকেই সব কাজ করতে হয়। তদুপরি সন্তান জম্ম দেওয়া ও লালন পালনের কাজটিও তাকেই হয়। গর্ভকালীন সময়ে, মাসিক চলাকালে এমনকি সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর অসুস্থ অবস্থায়ও তাকে জীবন সংগ্রামের ঘানি বিরামহীন ভাবে টেনে যেতে হয়। কেউ তাকে সহায়তা করে না, কেউ তাকে সাহায্য করে না। কে করবে তাঁর সহায়তা? কে করবে সাহায্য? কে আছে তাঁর?
পিতা-মাতা? না, না পিতা-মাতা আসবে কোত্থেকে! তাদেরকে তো বৃদ্ধ বয়সে প্রবীণ সদন বা প্রবীণ আশ্রালয়ে দিনাতিপাত করতে হয়।
স্বামী মহোদন? না, তাও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কারণ সেখানে স্বামী বলে অনেকেরই কেউ নেই। সেখানে আছে বয়ফ্রেণ্ড। আর বয়ফ্রেণ্ড থেকে কি স্বামীর মতো সোহাগ-ভালোবাসা, সাহায্য সহানুভুতি কখনো আশা করা যায় ? কেননা সেতো সম্ভোগী, লম্পট। নিজের স্বার্থটুকু আদায় হলেই কেটে পড়তে চায়।
অনুরূপ ভাবে সন্তান-সন্তুতির শ্রদ্ধা-সুহযোগিতাও পাশ্চাত্য নারীরা পায় না। যে সন্তান জানে, সে তাঁর বাবা-মার লাম্পট্যের অবৈধ ফসল, সে সন্তান কখনো তাঁর বাবা মাকে শ্রদ্ধার নযরে দেখতে পারে না। পারে না আন্তরিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেও।
প্রিয় শ্রোতামণ্ডলী! প্রতারক বুদ্ধিজীবীদের সস্তা শ্লোগানে প্রতারিত হয়ে ঘর ছাড়ার কারণে পশ্চিমা নারীদের আজ সতীত্ব-সম্ভ্রম কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সেখানকার নারীরা যথেচ্ছ ভোগের পাত্র। সামান্য কটি ডলারের বিনিময়ে তারা ইজ্জত-সম্মান বলিয়ে দিচ্ছে পুরুষের কাছে। পশ্চিমা সমাজের পুরুষেরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত শার্ট-প্যান্ট-হ্যাট দিয়ে গোটা শরীর ঢেকে রাখে। অথচ কোমল অঙ্গ ও মসৃণ ত্বক বিশিষ্ট নারীদেরকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। আজ সেখানকার মহিলাদের নিজের শরীরটুকু পর্যন্ত ঢাকার স্বাধীনতা নেই। তাঁর সর্বাঙ্গ খোলা। এমনকি প্রচন্ড শীতের মৌসুমে যখন পুরুষরা হ্যাট-কোট লাগিয়ে স্যুটেড বোটেড হয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ইউরোপ আমেরিকার শোভা বর্ধন করে, তখনো সেখানকার মহিলাদের দেখা যায় হাঁটু থেকে নীচের পুরো অংশ খোলা। কনকনে শীতের কারণে ঠকঠক করে কাঁপছে। তথাপী পুরো শরীর আবৃত করার অনুমতি তাদের নেই। অনুমতি থাকবেই বা কিভাবে! শীতকাল বলে কি যুবতী নারীর উদোম শরীরে দৃষ্টি ফেলার মজা থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়? কেউ যদি ঢাকে তাহলে পুরুষদের দৃষ্টিতে সে হয়ে যায়–আনকালচালর্ড, আনসিভিলাইজড অথবা ব্যাগডেটেড।
নারি স্বাধীনতার প্রবক্তাদের মধুর শ্লোগান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নারীরা তো রাস্তায় বেরিয়ে আসল ঠিকই কিন্তু তারা কখনো ভেবে দেখেনি যে, এই চটকদার বুলি ও মায়াকান্না দ্বার এসব পুরুষদের মতলবটা কি? একবারও তার চিন্তা করে দেখল না যে, কোট-টাই পরা এসব ভদ্রবেশি লম্পটেরা কেন নারীদেরকে রাস্তায় নামাতে চায় আসলে এসব পুরুষেরা পণ্যদ্রব্যের মতো ভোগের সামগ্রীরূপে যথেচ্ছা ভোগ করার জন্যেই নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি রাস্তায় টেনে এনেছে, অফিস-আদালতে নিজেদের পাশের সীটে বসার জায়গা করে দিয়েছে। ওরা নারীদের হাত ধরে ঘরে তুলে নি; বরং ঘর থেকে টেনে এনে রাস্তায় নামিয়েছে। ফলে এর দুঃখজক পরিণতি তাদেরকে আজ বিনা বাক্য ব্যয়ে বরণ করে নিতে হচ্ছে।
প্রিয় হাজেরীন! নারী স্বাধীনতার প্রবক্তারা অবলা নারীদেরকে বুঝিয়েছিল, তোমরা এতদিন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ ছিলে। এখন আর আবদ্ধ থাকার মোটেও প্রয়োজন নেই। এখন স্বাধীনতার যুগ। এই স্বাধীনতা তোমাদেরও পাওনা। সুতরাং তোমরা ঘরের এই বন্দীশালা থেকে বের হয়ে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করো। এতদিন পর্যন্ত তোমাদেরকে রাজনীতির লাল ঘোড়া থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এখন তোমরা বাইরে বের হয়ে জীবনকে আচ্ছামত ভোগ করো। স্বাধীন ভাবে বিচরণ করো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
এই চমকদার শ্লোগনটি নারীদের কাছে বেশ ভালো লাগে। তাই তারা ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে যায়। আর পুরুষরা যখন তাদেরকে নিয়ে অফিসের ক্লার্ক বানায়, মডেল গার্ল বানায়, ব্যবসার উন্নতির জন্য তাকে সেলস গার্ল হিসেবে নিয়োগ দেয়, ভূষিত করে অপরিচিত পুরুষের প্রাইভেট সেক্রেটারীর মর্যাদায়।
সম্মানিত উপস্থিতি! আপনাদের সামনে কষ্টের কথা আর কি বল্ব? আজ পশ্চিমারা নারীকে মর্যাদা দানের নামে কী পরিমাণ মর্যাদাহীন করেছে তা ভাবতে গেলেও গা শিহরিত হয়ে ওঠে। আজ নারীর সতীত্ পশ্চিমা জগতে যত সস্তা, অন্য কোনো জিনিস মনে হয় তত সস্তা নয়। আপনারা যদিন কখনো ইউরোপ আমেরিকা সফর করেন তবে দেখবেন, নারী অধিকারের নামে সেখানকার মেয়েদেরকে ঘর থেকে করে সমাজের যত ছোট ও নিকৃষ্ট মানের কাজ আছে তাঁর সবই তাদের দ্বারা করানো হচ্ছে। সেখানকার রেষ্টুরেন্ট গুলোতে আপনি পুরুষ ওয়েটার খুব কমই পাবেন। হোটলে মুসাফিরের কামড়া ঝাড় দেওয়া, বিছানার চাদর বদনালো, রুম সার্ভিসের দায়িত্ব সবই মহিলাদের কাঁধে ন্যস্ত । মোট কথা, পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করে না।
আমার ভাবতে কষ্ট হয়, কোনো নারী যদি তাঁর পরিবার–পরিজন আর ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তাঁর এ সুন্দর জীবনকে বলা হয় আবদ্ধ জীবন। সেটাকে বলা হয় গোঁড়ামী আর সেকেলে কাজ। অথচ এই নারীই যখন অল্প কটি টাকার বিনিময়েব বিমানবালা হয়ে হাজার পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়ে তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করে, তখন সেটা হয় আধুনিকতা আর স্বাধীনতা, তাঁর এই জীবন হয় স্বাধীন জীবন। বাহ! কী চমৎকার দর্শন।
কোনো নারী যখন তাঁর স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবন কাটায়, পিতা-মাতা, ভাই-বোনের জন্য সংসারের বিভিন্ন কাজ করতে থাকে তখন তাকে আখ্যায়িত করা হয় বন্দীশালার বন্দিনীরূপে।
অথচ এই নারীই যখন পর পুরুষের জন্য রান্নাবান্না করে, তাঁর ঘর-দোর পরিস্কার করে, হোটেল আর জাহাজে তাদের পরিচর্যা করে, দোকানে বসে মুচকি হাসি দিয়ে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং অফিস আদালতে হাজারো পুরুষের মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যে তাদেরই ফুটফরমাস পালন করে জীবন কাটায়, তখন সে হয়-স্বাধীন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত! এরই নাম নাকি প্রকৃত স্বাধীনতা ও সমুন্নত মর্যাদা। বাহ! কি সুন্দর লজিক!
মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো পুরুষের জন্য যদি তাঁর কার্যক্ষেত্রটি বন্দীশালা না হয়, তাহলে কোনো নারীর জন্য তাঁর সংসার নামক কর্মক্ষেত্রটি কোন যুক্তিতে বন্দীশালা হবে?
সাকিব এতটুকু বলার পর হঠাৎ মাইকের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে হৈ চৈ শুরু হয়। কেউ কেউ বলে ওঠে, ইস! কেমন একটা মুহূর্তে মাইকটা ডিস্টার্ব করল। কেউ কেউ মাইক অপারেটরকে ধমকাতে ধমকাতে বলে, কেমন মাইক তুমি নিয়ে এসেছ যে, হঠাৎ মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়?
অপারেটর বলল, ভাই! মেশিনারী জিনিস। এমন একটু একটু আধটু অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। এ বলে সে সামান্য চেষ্টা চালাতেই মাইক পুনরায় সচল হয়ে ওঠল।
সাকিব আবার শুরু করল–
ভাইগণ! নারী স্বাধীনতার প্রবক্তারা আজ জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করে যে, নারীদের যোগ্যত ও মেধার কল্যাণে আমাদের সমাজ যতটুকু অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, তাদেরকে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রেখে সংার কর্মে ব্যস্ত রাখার দরুণ ততটুকু হয় নি। উন্নতি অগ্রগতির পথে পুরুষরা যতটুকু শক্তি-সামর্থ্য খরচ করছে, নারীরাও যদি পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই পরিমাণ শক্তি সামর্থ্য ও মেধা খরচ করত, তারা যদি ঘর থেকে বেরিয়ে অফিস আদালত, হাসপাতাল-রেল ষ্টেশন ও এয়ারপোর্টসহ সকল কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাহলে উন্নয়নের চাকা আরো দ্রুত হতো। আমরা পৌঁছে যেতাম উন্নতির চরম শিখরে। তারা আরো বলে যে, পর্দা একটি উবরোধ ব্যবস্থা। এর দ্বারা নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। জীবন ও জগতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে বৈষয়িক জীবনধারাকে। পৃথিবীর অর্ধেক জনশক্তি নারীকে অবরুদ্ধ করে মানবজাতির সর্বনাশ করা হয়েছে। কেউ কেউ তো একটু আগে বেড়ে এ কথাও বলে ফেলেন, পর্দা ব্যবস্থাই নাকি নারী নির্যাতনের মূল কারণ। নাউযুবিল্লাহ।
এসব কথার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, নারী পুরষের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পুরুষরা যে কাজ করবে নারীদেরকেও সে কাজ করতে হবে।
একথা গুলো মুলত সেই পশ্চিমাদের গালভরা বুলি, যারা নারীর অধিকার নিয়ে লড়ছেন। কাঁপিয়ে তুলছেন নারী স্বাধীনতার জন্য রাজপথ।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, নারী পুরুষ উভয়কে যদি একই কাজের জন্য সৃষ্টি করা হতো তাহলে উভয়ের শারীরিক গঠনের মধ্যে এত তারতম্য কেন? পুরুষের গঠন প্রণালী ভিন্ন, নারীর গঠন প্রনালী ভিন্ন। পুরুষের মেজাজ আলাদা, নারীর মেজাজ আলাদা, পুরুষের যোগ্যতা আর নারীর যোগ্যতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। মহান আল্লাহ তাআলা উভয়কে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, উভয়ের গঠন প্রকৃতির মধ্যেই মৌলিক পার্থক্য পাওয়া যায়। সুতরাং একথা বলা যে, নারী পুরুষের গঠনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তাই উভয়কে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের উন্নতির চাকাকে বেগবান করার জন্য সব ধরণের কাজ করে যেতে হবে–এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং চোখে দেখা জিনিসকে অস্বীকার করার নামান্তর। কেননা এই চর্ম চোখে দেখা যাচ্ছে যে, নারী পুরুষের গঠন প্রণালীর মধ্যে কত পার্থক্য!
মানুষের জীবন দুটি ভিন্ন ধারায় বিভক্ত। একটি হলো বাড়ির ভিতরে, আরেকটি হলো বাড়ির বাইরে। আর এ দুটি ধারাই এমন যে, কোনো একটির অনুপস্থিতিতে একটি সুন্দর পরিবার গঠন মুসকিল। বাড়ির ভেতরের ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরী তেমনি বাড়ির বাইরের কাজকর্মও। যখন এই উভয় প্রকার স্ব স্ব স্থানে সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকবে তখন মানুষের জীবনও স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু এ দুটি কাজ থেকে যদি একটিকে বাদ দেওয়া হয় অথবা অসম্পুর্ণ রাখা হয়, তাহলে মানবজীবনের ছন্দময় গতিও বাধগ্রস্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে বাধ্য হবে।
নারী পুরুষের কাজকে আল্লাহ পাকই বণ্টন করে দিয়েছেন। পুরুষের দায়িত্ব দিয়েছেন বাড়ির বাইরের কাজ। যথাঃ রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করা, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। পক্ষন্তরে, গৃহের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছেন মেয়দেরকে। তারাই এটাকে সামাল দেবে।
এ তো গেল শরীয়তের হুজুম। বিবেক বুদ্ধি দ্বারা যদি নারী পুরুষের সৃষ্টিগত পার্থক্য চিন্তা করা হয় তাহলে বিবেকও একথার সাক্ষ্য দেবে যে, নারীকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটাই তাঁর জন্য যুক্তিযুক্ত ও কল্যাণকর। কেননা পুরুষের গায়ে যতটুকু শক্তি আল্লাহ পাক দিয়েছেন, নারীকে ততটুকু দেন নি। আর গৃহের বাইরের যত কাজ সব গুলির মধ্যেই শক্তি প্রয়োজন। সুতরাং সৃষ্টি কৌশলের তাগাদাও এতাই যে, পুরুষ বাইরের কাজ করবে আর নারীরা ঘরের কাজ করবে।
আমরা যদি হুযরত সাহাবায়ে কেরামের দিকে তাকাই তাহলে আমাদের সামনে এ দৃশ্যই ভেসে ওঠবে। যেমন, হযরত আলী রাযী, এবং হযরত ফাতেমা রাযি, এভাবেই নিজেদের কর্ম বণ্টন করে নিয়েছিলেন। হযরত আলী রাযি. বাইরের কাজ করতেন আর তাঁর প্রিয়তম সহধর্মিনী হযরত ফাতেমা রাযি. ঘরের কাজ যথাঃ আটা পিষা, কুয়া থেকে পানি তোলা, ঘর ঝাড় দেওয়া, খানা পাকানো ইত্যাদি তিনি করতেন।
প্রিয় শ্রোতৃমণ্ডলী! মজার বিষয় হলো, যারা নারী স্বাধীনতার বুলি আউড়িয়ে নারীদেরকেও পুরুষদের কাজে অংশীদার বানাতে চায়, তাদের এসব কথার জবাব দিয়েছেন, তাদেরেই এমন কিছু নারী-সহকর্মী যারা এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন এবং এই আন্দোলনকে সফলকাম করার জন্য ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আফসোস স্বাধীনতার সেই সোনার হরিণ তারা ধরতে পারেন নি। বরং উল্টো স্বাধীনতার এই স্পৃহা তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলকে আরো মজবুত করেছে, উন্নতির রঙিন স্বপ্ন তাদেরকে আরো পিছনে ঠেলে দিয়েছে। তা এভাবে যে, প্রথমে তো তারা শুধু স্বামীর অধীনে ছিল, কিন্তু এখন তারা বস কিংবা কর্মকর্তাদের কথায় উঠাবসা করছে। তাদেরকে খুশি করার জন্য দিন দিন ফ্যাশন পরিবর্তন করছে। তাদের ইশারায় নাচছে, তাদের জন্য গাইছে। এমনকি মজলিশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নিজের সতীত্ব পর্যন্ত বিলীন করে দিতে হচ্ছে। এরই নাম কি স্বাধীনতা? এ-ই কি শত বছরের আন্দোলনের ফসল?
প্রিয় উপস্থিতি! মার্লিন মোনরু নামের ইউরোপীয় নায়িকা ছিল। সিনেমা জগতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তাঁর বিত্ত-বৈভবের কোনো অভাব ছিল না। তাঁর বাহ্যিক শান-শওকত আর সম্মান প্রতিপত্তি দেখে তাঁর বান্ধবীও চেয়েছিল চিত্র জগতে পা বাড়াতে। একথা জানতে পেরে মার্লিন তাঁর আপন মনোভাব ব্যক্ত করে বান্ধবীর নিকট একটি চিঠি লিখে। কিন্তু চিঠি আর পাঠানোর সময় হয় নি তাঁর। এর আগেই সে আত্মহত্যা করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। তাঁর আত্মহত্যার পর তল্লাশীর সময় এই চিঠিখানা পাওয়া যায়।
চিঠিতে লেখা ছিলঃ প্রিয়! আমার বাহ্যিক জাক-জমক আর ঠাঁট-বাট দেখে তুমি ধোঁকা খেও না। এ জগতে আমার চেয়ে হতভাগা আর অন্য কোনো মহিলা আছে বলে মনে হয় না। আমার জীবনে মা হওয়ার আশা ছিল। এটা ছিল আমার সবচেয়ে বড় আশা। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। আমার স্বপ্ন ছিল, আমার বাড়ির আঙ্গিনায় শিশুদের কলরব হবে। তাদের হৈ চৈয়ে বাড়ি-ঘর মুখরিত থাকবে। কিন্তু আজ আমার ,বাড়ি-বাগান ঘর-দোয়ার সবই বিরান। একটি শিশুও আমার বাড়তে নেই। তাদের শিশুসুলভ দুষ্টমী আর চঞ্চলতায় আমার বাড়ি-ঘর মুখরিত হয় না।
বোন! আমি চেয়েছিলাম সতী–সাধ্বী নারীর মতো পবিত্র জীবন যাপন করতে। যে জীবনে থাকবে–প্রেমময় স্বামীর বুকভরা ভালোবাসা, মাতা-পিতার অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা, ভাই-বোনের আদর-সোহাগ। কিন্তু আমার সে ইচ্ছা ভেঙ্গে চুরে খান খান হয়ে গেছ, মিশে গেছে ধূলোর সাথে। এখন এ চাকচিক্যময় দুনিয়া প্রতিমুহূর্তে আমাকে দংশন করে চলেছে। যা সহ্য করা আমার জন্য একেবারেই অসম্ভব। তাই আমি দুনিয়া থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে বিদায় বেলায় তোমাকে বারবার একটি কথা সতর্ক করে যাচ্ছি–নারী স্বাধীনতার এ ভয়ঙ্কর পথে কখনো তুমি পা রেখো না। কারণ এ পথের উপরের আবরণটি চমকদার আর নযরকাড়া হলেও ভিতরটা অনেক কুৎসিত, সীমাহীন কদাকার। তাঁর এ ভয়ঙ্কর পথে না গিয়ে তুমি বরং সাদাসিধে পবিত্র জীবন যাপনে ব্রতী হও। নারীর জন্য এতাই সবচেয়ে বড় সফলতা, এটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অঙ্গন।
মুহতারাম শ্রোতৃমণ্ডলী! নারী স্বাধীনতার উপর এই মন্তব্য কোনো মাওলানা মুফতির নয়, বরং এমন এক মহিলার যিনি নারী স্বাধীনতার জগতেই লালিত পালিত হয়েছেন, ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন সেখানেই। অতঃপর সেই স্বাধীনতার দিকে আহবান করেছেন অন্য নারীদেরকে। কিন্তু পরিশেষে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, চৌদ্দশত বছর আগে মুসলমানদের উম্মী নবী সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের যে অধিকারের কথা ঘোষণা করে গেছেন, সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। আমাদের মা-বোনেরা যদি এসব ভুক্তভোগী মেয়েদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত তাহলে কতই না ভালো হত। নারী স্বাধীনতার শ্লোগান আসলে যে তাদেরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার অপকৌশল ও বড় রকমের চক্রান্ত তা যদি তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হত তাহলে কতই না মঙ্গল হতো। তাদের ইহকালীন জীবনে বইতে থাকতো শান্তির সুবাতাস আর পরকালীন জীবন হতো অশেষ কল্যাণময়।
আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে সোভিয়েত উইনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম পেরেস্ত্রইকা। এটি সারা দুনিয়ার বহুল আলোচিত একটির গ্রন্থ। উক্ত গ্রন্থে তিনি পরিস্কারভাবে লিখেছেন যে, আমাদের পশ্চিমা দেশগুলিতে নারীদেরকে ঘর থেকে বের করা হয়েছে। তাদের এই ঘর ছেড়ে ভের হওয়ার কারণে আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা লাভবান হয়েছি সত্য, উৎপাদনও সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে-একথাও অস্বীকার করার জো নেই, কিন্তু এই উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের পারিবারিক প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদ্দরুণ আমাদেরকে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে যা ঐ উৎপাদনের চাইতে অনেক বেশি।
এমন উদাহরণ আরো অনেক দেওয়া যাবে। এখন আমার কথা হলো, উপরের কথাগুলো যুদি আমি একা বলতাম, তাহলে হয়তো কেউ বলতে পারতেন যে, এসব একপেশে কথা আপনি আপনার গোড়ামীর কারণে বলছেন। কিন্তু তাদেরই লোক মার্লিন মোনরু ও প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ যখন এসব কথা বলছেন, তখন তো আর আপনারা আমাকে দোষারোপ করতে পারেন না। বলতে পারেন না, আপ্নিব গোড়ামীর কারণে এসব বলছেন।
সম্মানিত হাজেরীন! আমার অত্যন্ত দুঃখ হয় তখন, যখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো নামকরা পণ্ডিতের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়–‘পর্দা নারী শিক্ষার অন্তরায়, উচ্চ শিক্ষার পরিপন্থি’।
এ ব্যাপারে আমার প্রথম কথা হলো –আসলে এ উক্তি একেবারেই অবাস্তব।
এর কোনো মৌল ভিত্তি নেই। একননা ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক বিদূষী মহিলার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে যাদের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কাছে অনেক পণ্ডিতকে হার মানতে হয়েছে। এসব মহিলারা নিজেরাই কেবল শিক্ষিত ছিলেন না, বরং শত শত নরনারীকে তারা বিদ্যা ও জ্ঞানের অমৃত পরিবেশন করে গেছেন। যেমন, যহরত আয়েশা, হযরত আমেনা রামালিয়্যাহ, হযরত কারীমা বিনতে আহমাদ, হযরত ফখরুণ নিসা শাহিদা, হযরত উলায়্যাহ বিনতে হাসসান, হযরত ফাতেমা, হযরত হাফসা বিনতে সিরীন রহ, । লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই জ্ঞান-পাণ্ডিত্য অর্জন করার জন্য তাদের কিন্তু পর্দা ছাড়তে হয় নি।
মেয়েরা সাধারণত বার বছর বয়সের আগে সাবালিকা হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটি মেয়ে পর্দার বয়সে পৌঁছার আগেই পড়াশুনার জন্য পাঁচ/সাত বছর সময় পেয়ে যাচ্ছে? আমার প্রশ্ন হলো, এই পাঁচ সাত বছর সময় কি প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য কম সময়? পর্দা-বিধানের বাধ্যবাধকতা আসার আগেই তো এই উল্লেখিত সময়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সেরে নেওয়া যায়। এই সময়ে পর্দাই যখন নেই, তখন পর্দাকে নারী শিক্ষার অন্তরায় বলে অভিযোগ উত্থাপন করা বোকামী নয় কি? হ্যাঁ, এরপর থাকে উচ্চ শিক্ষার কথা। তাতেই বাধা কোথায়? যেখানে সহশিক্ষা নেই, নারী পুরুষের একত্রে উঠাবুসা নেই, যেখানে শুধুমাত্র নারী শিক্ষিকা ও নারী কর্মচারী দ্বারা গার্লস স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি পরিচালিত, সেখনে পর্দার সাথে উচ্চশিক্ষার জন্য যাতায়াতে তো ইসলাম বাধা দেয় না। সুতরাং ‘নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পর্দা একটি বড় রকমের বাধা’ বলার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?
উপরি উক্ত আলোচনার উপসংহারে আমি বলতে চাই, পর্দা ব্যবস্থা অবরোধ নয়, নয় শিক্ষা অর্জন কিংবা উন্নতির পথে বাধা। বরং পর্দা হলো, নারীর মান সম্মানের রক্ষাকবচ, মর্যাদার গ্যারান্টি, মুক্তির প্রতীক। নারী জাতির মান সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই ইসলামের পর্দা ব্যবস্থা । যে সব নারীরা বেপর্দা চলে সেসব দেশের অধিবাসীদের নৈতিক মান এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেখানে নারীর সাওতীত্বের কোনো বালাই নেই, মাতৃত্বের কোনো মর্যাদা নেই। সন্তানের কোনো পরিচয় নেই, রক্ত সম্পর্কের ভেদ নেই, আত্মীয়তার কোনো বন্ধন নেই। জাত নেই, কুল নেই, নেই কোনো মনুষ্যত্ব। সেসব দেশ ভরে গেছে জারজ সন্তানে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
সম্মানিত ভাইগণ! আমি আর আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত করতে চাই না। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে কথাগুলো বুঝে তদানুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুণ। আমীন। আর সবশেষে আনাদেরকে আরেকটি সুসংবাদ জানাতে চাই। তা এই যে, আজকের এই সেমিনারে প্রদত্ত বক্তব্যগুলো বই আকারে ছাপানো হবে। আপনারা কি তাতে খুশি নন?
সবাই তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যাঁ অবশ্যই খুশি। সাকিবের আলোচনা শেষ হওয়ার পর সংক্ষিপ্ত দোয়ার মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে সেমিনারের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়।
তেইশ
দোয়ার পর হাজী বশির সাহেব দাঁড়িয়ে যান। তিনি দু’কদম এগিয়ে এসে সাকিবকে জড়িয়ে ধিরে আনন্দ গদগদ কণ্ঠে বলতে ইয়হাকেন–মাওলানা সাকিব! সামনাসামনি নাকি কারো প্রশংসা করা ভালো নয়। তবে এতটুকু কথা তোমাকে না বলে পারছি না যে, আজকের এই অনুষ্ঠানটা আমার কাছে এতই অর্থবহ ও ভালো লেগেছে যে , তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। বিশেষ করে তুমি এত সুন্দর আলোচনা করেছ যা ইতিপূর্বে আমি কোথাও শুনি নি। সত্যি বলতে কি, তুমি তোমার বক্তব্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছ, এসব প্রশ্ন আমারও ছিল। আমিও মনে করতাম, ইসলামের নারীর মর্যাদা কম, পর্দার বিধান নারী-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, পর্দা নারী শিক্ষার অন্তরায়। তাছাড়া নারী স্বাধীনতার ব্যাপারেও আমার অন্তরে বেশ খটকা ছিল। কিন্তু তোমার আলোচনা দ্বারা আমার মন একদম পরিস্কার হয়ে গেছে। এখন আর আমার মনে কোনো প্রশ্ন নেই।
কথা বলতে বলতে এতক্ষণে তারা রিচার্স সেন্টারের অফিস রুমে এসে পৌঁছে যায়। সেখানে যাওয়ার পর মেহমানদেরকে উত্তমরূপে আপ্যায়ন করা হয়। আপ্যায়ন শেষে আবার জমে উঠে কথাবার্তা। কথা শুরু করেন হাজী সাহেবই। তিনি মুফতি মাওলানা সাকিবুল হাসানকে লক্ষ্য করে বলেন–
মাওলানা সাকিব! তুমি আমার ছেলের বয়সের লোক। তোমার কাছে আমি একটি আবদার করতে চাই। আশা করি তুমি আমার আবদার রক্ষা করবে।
সাকিব বলল, জ্বী বলুন হাজী সাহেব। আমি যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে আপনার আবদার রক্ষা করতে চেষ্টা করব।
হাজী সাহেব বললেন, মাওলানা! আল্লাহ পাক আমাকে অনেক টাকা পয়সা দিয়েছেন। ধন-দৌলত দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, একমাত্র হজ্ব ছাড়া দীনের কোনো উল্লেখযোগ্য কাজে আমি আমার পয়সা খরচ করি নি। আজ এখানে এসে কেন জানি আমার মনের ভিতর এক অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়েছে। মন যেন বারবার আমাকে বলছে–হাজী সাহেব। আজ থেকে আপনি দীনের কাজে টাকা-পয়সা ব্যয় করতেব থাকুন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। সুতরাং আমি এখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আগামী দিনগুলোতে আমার টাকা পয়সা ধর্মীয় কাজে ব্যয় করব। আর তোমার বই ছাপানোর কাজে অংশ গ্রহণ করেই আমি এর সূচনা করতে চাই। অর্থাৎ আজকের এই অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্যগুলোকে একত্র করে তোমরা বই আকারে প্রকাশ করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছ, তাঁর সম্পূর্ণ খরচ আমি বহন করতে চাই। তোমাদের এই রিচার্স সেন্টারের পক্ষ থেকে যদি ভবিষ্যতে আরো কোনো বই বের কর, তবে এর ব্যয়ভারও আমি বহন করব ইনশাআল্লাহ। আশা করি তুমি আমাকে মাহরুম করবে না।
হাজী সাহেবের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত সবাই একসাথে উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠল–আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন।
সাকিব বলল, হাজী সাহেব! আমরা অবশ্য বই ছাপানোর প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। সে টাকা দিয়েই…..।
সে টাকা তোমরা সেন্টারের অন্য কাজে ব্যয় করো। তবু আমার আশা তোমরা অপূর্ণ রেখো না। সাকিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাজী সাহেব বললেন।
ঠিক আছে। আল্লাহ আপনার আশা পূর্ণ করুণ। সাকিবের আলোচনা শুনে হাজী সাহেব যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি বিমোহিত হয়েছিলেন উপস্থিত সমস্ত লোক। মনে হয়, তাঁর বয়ান শুনে সবার অন্তরে এমন একটি বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ইসলাম কিংবা ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে যে কোনো সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে পাওয়া যাবে। হয়তো এই সুধারণার বশবতী হয়েই তারা মাওলানা সাকিবের আরো কিছু প্রশ্নের অবতারণা করে। জানতে চায় এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব। সাকিব অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেসব জবাব প্রদান করার পর সকলেই খুশি মনে সেখান থেকে বিদায় নেয়।
চব্বিশ
নাঈমা ও খালেদা উভয়েই এ বছর দাওরায়ে হাদীস পাশ করেছে। শুধু পাশই করে নি, গোটা বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে তারা প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। নাঈমা প্রথম হয়েছে। খালেদা দ্বিতীয় ।
আরো মজার কথা হলো, দারুর রাশাদের ছাত্র মুহাম্মদ সোহেল শিকদারও একই পরিক্ষায় ছেলেদের মধ্যে প্রথম হয়ে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, তাদের এ ফলাফলের পিছনে অনেকখানিই রয়েছে সাকিবের ভূমিকা। সত্যি বলতে কি, ওদের তিনজনের পিছনেই সাকিব বিভিন্নভাবে এ পরিমাণ মেহনত করেছে যা বর্ণনাতীত। নিয়মিত পড়াশুনার খোঁজ-খবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় কিতাবাদি কিনে দেওয়া, নিজের করা নোটখাতা ফটোকপি করে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও গুরুত্বের সাথে সাকিব গোটা বছর আঞ্জাম দিয়েছে। সে এসব কাজে মোটেও ক্লান্তিবোধ করে নি। তাছাড়া প্রয়োজনীয় উপদেশ ও দিক নির্দেশনামূলক কথাবার্তা তো আছেই।
খালেদা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর অসংখ্য বার আতাউর রহমান সাহেব ঢাকায় এসেছেন। এভাবে বারবার আসা যাওয়ার মাধ্যমে মুফতী শফীউল্লাহ সাহেব, মসজিদের ইমাম আব্দুল ওয়াদুদ এবং হোটেল মালিক হাজী বশীর সাহেবের সাথে তাঁর বেশ সখ্যতা ও আন্তরিকতা গড়ে এঠে। এমনকি এক সম্য তা এরূপ পর্যায়ে পৌঁছে যে, তিনি ঢাকায় এলে মুফতি সাহেব ও ইমাম সাহেবের বাসায় অন্তত এক বেলা করে হলেও আথিতেয়তা গ্রহণ না করে বিদায় নিতে পারতেন না। আর হাজী সাহেবের বাসায় তো দু একদিন বেড়াতেই হতো। তাই আতাউর রহমান সাহেব ঢাকা আসলে অন্তত দুদিন সময় অবশ্যই জাতে নিয়ে আসতেন ।
গত কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে ফিরার সময় আতাউর রহমান সাহেব সাকিবকে লক্ষ্য করে বললেন, বাবা সাকিব! খালেদা তো এবার পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করল। বিয়ের বয়সও হয়েছে তাঁর। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, এমতাবস্থায় উপযুক্ত মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখাও আমি ভালো মনে করি না। তাই বলছিলাম কি, তুমি যদি ওর বিয়ের ব্যাপারে একটু ফিকির করতে তাহলে খুব ভালো হতো। আমি তো গ্রামের মানুষ। তোমাদের লাইনে লেখাপড়া কিংবা পরিচিতি কোনোটাই আমার নেই। তাই তোমার উপরই আমি খালেদার বিয়ের দায়িত্ব অর্পণ করতে চাই। ওর বর হিসেবে তুমি যাকে পছন্দ করবে আমরা তাই মেনে নিব।
খালেদার জন্য সাকিব বেশ আগে থেকেই সোহেলকে পছন্দ করে আসছিল। সে জন্য সে গোপনে গোপনে সোহেলের পারিবারিক অবস্থাসহ সব খবরাখবর নিয়ে রেখেছে। এমনকি একদিন সে বেড়ানোর ছুতোয় সোহেলদের বাড়িঘরও দেখে এসেছে। যাতায়াত ব্যবস্থাও বেশ ভালো। বাড়িতে পর্দা-পুষিদার কোনো কমতি নেই। সোহেলের পিতা ও বাড়ির লোকদের সাথে আলাপ আলোচনা সাকিব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে, সোহেলরা খান্দানী লোক। দীনদারী ও পরহেযগারী ওদের রগে-রেশায় প্রোথিত। সর্বোপরি খালেদার সাথে সোহেলের মানাবেও ভালো।
এবার খালেদা ও সোহেলের বিয়ে নিয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যেই বিয়ের সর্ব প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো এবং এক সময় দিন তারিখ ধার্য করে উলামায়ে কেরাম, মুরব্বীয়ানে কেরামসহ সকলের উপস্থিতিতে সোহেল-খালেদার শুভ পরিণয়ের কাজ সমাধা হলো।
পঁচিশ
সোহেলের খালেদার বিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায় সকলেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। সোহেলের মত গুণধর স্বামী পেয়ে খালেদার আনন্দ আর ধরে না। বিয়ের পর এ পর্যন্ত সে কয়েকবার তাঁর স্বামীর বাড়িতে আসা যাওয়া করেছে। খালেদা শুধু মনের মতো স্বামীই পায় নি। শ্বশুর-শাশুড়ীও পেয়েছে। তারা খালেদাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর-স্নেহ করে। সে ঠিকমত খেল কিনা, ঘুমাল কিনা, কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা ইত্যাদির খোঁজ-খবর সব সময় তারা নিয়ে থাকেন।
খালেদার এতটুকু কষ্ট হউক–এটা সোহেল যেমন চায় না, তেমনি চায় না তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ীও। যাদেরকে নিয়ে খালেদা চলবে, যাদের সান্নিধ্যে তাকে জীবনের বাকি অংশটুকু কাটাতে হবে তাদেরকে মন মতো পেয়ে যাওয়ার খালেদার দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটতে লাগল।
একদিন বিকেল বেলা রিচার্স সেন্টারে বসে কম্পিউটারে কাজ করছিল সাকিব। এমন সময় হাজী বশীর সাহেব সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। হাজী সাহেবের কণ্ঠ শোনা মাত্রই সাকিব তাঁর কাজ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। সেই সাথে সালামের জবাব দিয়ে এক রকম দৌড়ে এসেই হাজী সাহেব বুকে জড়িয়ে ,ওয়ানাকার দোয়া পড়ল–আল্লাহুম্মা যিদ মুহাব্বাতি লিল্লাহি ওয়া রাসূলিহি। তারপর বলল–
আপনার আগমনে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। একথা বলে সাকিব তাকে হাত ধরে একটি সোফায় বসিয়ে দেয়।
হাজী সাহেব বললেন, তোমাকে না জানিয়ে দুটো কথা বলার জন্য এখানে চলে এলাম।
জ্বী। আপনার সব কথা আমি শুনব। তাঁর আগে চা-নাস্তা হয়ে যাক।
নাস্তার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু এক কাপ রং চা হতে পারে।
সাকিব কাজের ছেলে কামালকে ডেকে আপেল, আঙ্গুর ও চা-বিস্কুট আনার নির্দেশ দিল। তারপর হাজী সাহেবের দিকে মনোযোগী হয়ে বলল, জ্বী চাচাজান! এবার বলুন।
হাজী সাহেব বললেন–
তোমার সেমিনার স্মারকের কাজ কতটুকু হলো?
এতক্ষণ স্মারকের কাজই করছিলাম। কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন শেষ বারের মতো ফাইনালে প্রুফ দেখা হচ্ছে। আশা করি আগামী দশ পনের দিনের মধ্যেই ট্রেসিং বের করতে পারব।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ পাক তোমাকে কামিয়াব করুক। আমীন।
আমি আরেকটি কথা বলতে চাচ্চিলাম।
বলুন।
নাঈমা আমাকে বারবার বলছে আর এটা আমারও দীলের একান্ত তামান্না যে, সোহেল ও খালেদাকে আমাদের বাসায় নেওয়া। এই নব দম্পতি আমাদের বাসায় যাবে। কয়েক দিন বেরাবে। সাথে যাবে তুমিও। আশা করি, তুমি এতে অমত করবে না। এত তাড়াহুড়া কিসের! মাত্র ছ মাস হলো। ওরা তো যে কোনো সময় আপনার বাসায় যেতে পারে। মাওলানা! নতুন অবস্থায় বউ নিয়ে বেরানোর মজাই আলাদা। তা অবশ্য তুমি বুঝবে না। তাছাড়া আমার মা নাঈমার বারংবার তাগদা তো আছেই।
তা আপনি কবে নিতে চান?
তাদের সাথ আলোচনা করে তুমি যখন বলবে তখনই আমরা তৈয়ার, প্রস্তুত। তুমি কেবল মোবাইল করে আমাকে তারিখটা জানিয়ে দিও। ঠিক আছে। আমি দু একদিনের মধ্যে জানিয়ে দিব। তবে আমি কিন্তু ওদের সাথে যেতে পারব না। আম্র ব্যস্ততা তো দেখতেই পাচ্ছেন।
তা হয় কী করে। তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে। শুধু গেলেই চলবে না। তাদের সাথে তোমাকেও বেরাতে হবে।
বেড়াতে হবে!
হ্যাঁ, বেড়াতে হবে। মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত একদিনেও কি তুমি আমাদের বাসায় বেড়িয়েছ? তুমি যাও আর আসো। কোনোদিন এক ঘন্টার বেশি অপেক্ষা করো না। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নাও। এখন আর এ হবে না। হতে দেওয়া হবে না।
হাজী সাহেবের কথায় কিসের যেন ইঙ্গিত পায় সাকিব। সে বলে আচ্ছা চেষ্টা কুরে দেখব, ওদের সাথে যাওয়া যায় কি-না।
আম অত কিছু বুঝি না। আমি তোমার উপস্থিতি চাই। তাছাড়া… … ।
হাজী সাহেব থেমে যান। কি যেন বলতে গিয়েও বলতে পারেন নি।
থামলেন কেন? বলুন।
মানে বলতে চাইছিলাম যে, নাঈমার মাও তোমাকে যেতে বলেছে।
ও আচ্ছা তাই! ঠিক আছে চাচীআম্মা যখন যেতে বলেছেন তখন না গিয়ে আর উপায় কি!
নাঈমার মা তো বারবার বলে, সাকিব আমাদের জন্য কত কিছু করল। তাঁর ওসিলায় আমরা দিন পেলাম। সর্বোপরি নাঈমার আশাতীত সুন্দর রেজাল্টের পেছনে তাঁর অবদান ভোলার মতো নয়। কিন্তু সাকিবের কী হলো বুঝলাম না। নাঈমার রেজাল্টের খবর নিয়ে এই যে একবার এসেছিল আর একবারও আসে নি আপনি যান। সোহেল-খালেদাসহ সাকিবকে দাওয়াত করে আসুন। ওরা কমপক্ষে চার পাঁচ দিন আমাদের বাসায় বেড়াবে।
যাওয়ার ইচ্ছা যে একেবারে নেই তাও কিন্তু নয়। সত্যি কথা কি, অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। তবে এবার ওয়াদা দিলাম, যাবোই ইনশাআল্লাহ। উভয়ের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলল। তারপর একসময় সাকিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ বাসায় চলে এলেন হাজী সাহেব।
ছাব্বিশ
সাত দিন পর। সাকিব একটি ট্যাক্সি করে নব দম্পতিকে নিয়ে হাজী সাহেবের বাসায় হাজির হলো। মেহমানদের আগমনকে কেন্দ্র করে হাজী ভবনে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। হাজী সাহেব তখন বাসায় ছিলেন না। তাঁর বড় ছেলে আব্দুস সালাম মেহমানদের অভিবাদন জানালেন।
হাজী সাহেবের বাড়ি। চারিদিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। সৌন্দর্যমণ্ডিত। ভারি চমৎকার। বাড়ির মাঝে ছোট একটি ফুল বাগান। বাগানে নানা জাতের রং-বেরংয়ের ফুলের অপূর্ব সমারোহ। বাগানের মাঝে একটি ফোয়ারা। সাদা ধবধবে মর্মর পাথরে নির্মিত। সেই ফোয়ারার উছলে পড়া পানি দারুণ চমৎকার দেখায়। চারদিক সবুজ গাছপালায় বেষ্টিত ফুল বাগানের মাঝে অবস্থিত ফোয়ারাটি বেহেশতের নাজ-নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সত্যি, ভারি মনোরম ও হৃদয়গ্রাহী সে দৃশ্য!
বাসার ভেতর যাওয়ার পর নাঈমা আম্মা সহাস্য বদনে আনন্দের সাথে খালেদাকে গ্রহণ করলেন। আর নাঈমা তো খালেদাকে পেয়ে খুশিতে আটখানা। খালেদা যখন নাঈমার নিকট এল, তখন নাঈমা তাঁর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁর স্মৃতিময় চেহারার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে রইল। খালেদা নাঈমার মুখোমুখি হতেই কিছুটা লজ্জা পেয়েছিল। তা এই ভেবে যে, নাঈমার সাথে একই ক্লাসে লেখা পড়া করেছে খালেদা। দু’জনের মধ্যে ছিল কত হৃদয়ের টান। আজ সে তাঁর স্বামীকে নিয়ে নাঈমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। অথচ নাঈমার এখনো বিয়েই হয় নি। খালেদাকে নববধূর সাজে সজ্জিতা দেখে এ মুহূর্তে নাঈমার মনেও কত স্বপ্ন উঁকি দিয়েছে কে জানে!
নাঈমাদের এক ভাড়াটিয়ার মেয়ে নাজমা। সে প্রায়ই নাঈমার কাছে আসে। কথাবার্তা বলে। আজ সে সকালে সে নাঈমার কাছে শুনেছিল যে, খালেদা তাঁর স্বামী সোহেল ও বড়ভাই সাকিব সহ তাদের বাসায় বেড়াতে আসবে। সুতরাং বিকালে যখন মেহমানরা আসল, তখন নাজমাও তাদেরকে দেখার জন্য দৌড়ে এল। প্রথমেই সে খালেদাকে দেখে বিস্ময়ে থ খেয়ে রইল। তারপর বলল, আমি নাঈমার কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তাই অনেকদিন যাবত আপনাকে দেখার ও সাক্ষাতের তামান্নাও অন্তরে ছিল। আল্লাহর শুকরিয়া আজ উভয়টি বাস্তাবায়িত হলো।
সামান্য সময়ের ব্যবধানে তিনজনের মধ্যে আলাপ আলোচনা বেশ জমে ওঠল। এক পর্যায়ে নাজমা খালেদাকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি তো সাক্ষাৎ পূর্ণিমার চাঁদ।
খালেদা বলল, আমি কেমন তাতো আপনারা দেখছেন। কিন্তু সুন্দরী বলতে যা বুঝায়, তাতো আপনি এবং বোন নাঈমা।
খালেদার কথায় উভয়ে হেসে ফেলল। নাজমা বলল, আমরা হয়তো সুন্দরী ঠিক। কিন্তু আপনি তো সাক্ষাৎ পরী। শুধু পরী নয়, হুর।
হুর! খালেদার কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ, হুরই বটে। হুরকে তো কেউ কখনো দেখেনি। শুধু কুরআন ও হাদীসে তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তোমাকে দেখে আমরা অনুমান করতে পেরেছি, হুর কেমন হবে। যদিও হুরের সৌন্দর্য-লালিত্য অনুমান করাও অসম্ভব। জানালার পাশে কারো পদধ্বনি শুনতেই পর্দার ফাঁকে দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে নাঈমা। দেখে তাঁর বড় ভাইয়ের সাথে সাকিব এক কামরা থেকে অন্য কামরায় প্রবেশ করছে। তাকে দেখেই নাঈমার চেহারায় একটা রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে। যা খালেদা কিংবা নাজমা কারো দৃষ্টিকেই ফাকি দিতে পারে নি।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সোহেল খালেদাকে একটি সাজানো গোছানো কক্ষে থাকতে দেওয়া হলো। আর সাকিবের জন্য নির্ধারিত হলো আরেকটি কক্ষ। সাকিব নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। সে যে রুমে ঘুমিয়েছিল ওটার সাথে এটাচ বাথরুম ছিল না। সাকিব ঘুম থেকে জেগে কমন বাথরুমে যায়। ওজু-ইস্তেঞ্জা সেরে ফিরে এসে দেখে, কক্ষের সব কিছু এমন নিপুন ভাবে সুন্দর করে সাজানো, যার কোথাও ক্রটির লেশমাত্র নেই। যেন এই মাত্র কোনো দক্ষ হাতে সম্পাদিত হয়েছে এগুলো। সাকিব অভিভূত হয়। চিন্তা করে–এত স্বল্প সময়ে কে এর সুন্দর করে রুমটা সাজিয়ে গুছিয়ে গেল? কে মশারী তুলল? তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য কে জায়নামাজ বিছিয়ে রাখল? তবে কি এটা নাঈমার কাজ! হতেও পারে । এসব কথা চিন্তা করে সাকিব তাঁর মনের মধ্যে একটি আনন্দের শিহরণ অনুভব করে।
সাতাশ
শাকিল এখন প্রায়ই ঢাকা আসে। যখনই তাঁর মনটা ভাল থাকে না তখনই সে দু’একদিনের জন্য সাকিবের কাছে চলে আসে। এতে সাকিব দারুণ খুশি হয়। বন্ধুর জন্য নানবিধ আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। সেদিন দু’ বন্ধুর মধ্যে আলাপ-আলোচনা বেশ জমে ওঠেছিল। কথার ফাঁকে এক সময় শাকিল বলে ওঠে–
সাকিব! তোমার কি একটা কথা মনে আছে?
কোন কথা?
ঐ যে দীর্ঘদিন পর তোমার সাথে যখন কুমিল্লায় দেখা হয়েছিল এবং আমি তোমাকে আমার জীবন কাহিনী শুনিয়েছিলাম, তখন তুমি বলেছিলে যে আমারও এ ধরণের একটি ঘটনা জানা আছে। সময় হলে একদিন তোমাকে বলব।
হ্যাঁ হ্যাঁ স্মরণ আছে। তা এখনই শুনতে চাও নাকি সেই ঘটনা?
হ্যাঁ, এখনই শুনতে চাই। সত্যি কথা কি জানো?
কী?
আমি এবার তোমার কছে এ উদ্দেশ্যেই এসেছি যে, তোমার মুখ থেকে ঘটনটি শুনব। তারপর……….।
বলো। থেমে গেল কেন?
তারপর তোমাকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেব।
সেটা বার কোন কথা?
আচ্ছা সেকথাটা পরে বলছি। আগে কাহিনী শুনাও। আমার আর ধৈর্য কুলাচ্ছে না।
‘ঠিক আছে শোনো তাহলে’ বলে সাকিব তাঁর জানা একটি সত্য ঘটনা বলতে শুরু করল–
সুনামগঞ্জ সদর থানাধীন উলুতুলু একটি গ্রাম। জাহানারা এ গ্রামেরই মেয়ে। দেখতে তেমন একটা সুন্দর না হলেও শারীরিক গঠন বেশ চমৎকার। তাঁর পিতার নাম মজুমদার আলী। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভাল। প্রাইমারী পাহসের পর মজুমদার সাহেব মেয়ে জাহানারাকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি নামকরা হাইস্কুলে ভর্তি করি দেন।
জাহানারা স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঠিক দু’বছরের মাথায় মজুমদার সাহেব ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি বাড়ির সবাই কে ডেকে বলেন–জাহানারাকে বি, এ পাশ করানো আমার জীবনের একটি বিরাট সেপ্ন ছিল। কিন্তু আমি তো আর সময় পেলাম না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো তোমাদের থেকে চিরতরে বিদায় নেব। তবে যাওয়ার বেলায় তোমাদের কাছে আমার একটি মাত্র অনুরোধ থাকবে। তা হলো, আমার কলিজার টুকরা জাহানারাকে তোমরা যেভাবেই হোক বি, এ পর্যন্ত পড়াশুনা করার সু-যোগ করে দি—।
মজুমদার সাহেব আর বলতে পারলেন না। তাঁর মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়ল। যাত্রা শুরু হলো অনন্তের পথে।
জাহানারা তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। লেখাপড়ায় বেশ ভালো। নিয়মিত স্কুলে যায়। পিতার মৃত্যুতে সে একদম ভেঙ্গে পড়ে। কয়েকদিন স্কুলে যেতে পারে নি।
জাহানারার আর কোনো ভাই বোন নেই। সে একা। একাই স্কুলে যায়। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। কাঁচা ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তা হওয়ায় দুই কিলোমিটার। কাঁচা ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তা হওয়ায় সেপথে কোনো যানবাহন চলাচল করে না। সেজন্য জাহানারাকে প্রতিদিন হেঁটেই স্কুলে আসা যাওয়া করতে হয়।
পিতার মৃত্যুর পর জাহানারার মনে কেমন একটু ভয় ঢুকে যায়। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। এজন্য প্রায়ই সে স্কুল কামায় করে। আগের মতো নিয়মিত সে স্কুলে যায়।
মহিবুল্লাহ জাহানারার সাথে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। সেও বেশ ভালো ছাত্র। ক্লাসের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানটি কয়েক বছর যাবত তাদেরই দখলে। পরীক্ষায় জাহানারা ফার্স্ট হলে মুহিবুল্লাহ দ্বিতীয় হয়। আর জাহানারা দ্বিতীয় হলে মুহিব্বুল্লাহ ফার্স্ট হয়।
জাহানারা এখন বড় হয়েছে। পুরুষদের চোখে পড়ার মতো বয়সে উপনীত হয়েছে। এতদিন মুহিব্বুল্লাহর সাথে জাহানারার তেমন একটা কথা হতো না। জাহানারা নিজেও মুহিব্বুল্লাহসহ সকল ছেলেদেরকে এড়িয়ে চলত। প্রয়োজনের বেশি একটা কথাও সে বলত না। তাই সবাই তাকে ভয় পেত। অকারণে কথা বলার বা হাসি তামাশা করার সাহস পেত না।
জাহানারা কোনো ছেলেকে পাত্তা দিত না ঠিকই, কিন্তু তাকে নিয়ে চিন্তা করতে মুহিব্বুল্লাহর বেশ ভালো লাগত। তাঁর কথা মনে হতেই হৃদয়টা আনন্দে নেচে ওঠত। তবে আজও সে ভাল লাগার কথাটি জাহানারাকে বলতে পারে নি। বলার সাহসও হয় নি। সে বরাবরই চাইত, জাহানার আর সে একত্রে স্কুলে আসা যাওয়া করবে। গল্প করতে করতে পথ চলবে, হাসি-মজাক করবে ইত্যাদি। কিন্তু জাহানারার এক রোখা মেজাজের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মুহিব্বুল্লাহ তাঁর সাথে একত্রে আসা যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। জাহানারার অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তঁর সাথে পথ চলতে চেয়েছে। কিন্তু জাহানারা তা বুঝতে পেরে কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেছে। কোনোদিন তাকে সাথে নেয় নি। মুহিব্বুল্লাহ তাঁর পিছনে পিছনে হাঁটলেও পথে তাঁর সাথে একটি কথাও বলে নি।
মুহিব্বুল্লাহ হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে সুযোগের অপেক্ষায় থকে। একদিন সে সুযোগ পেয়েও যায়। সে যখন জানতে পারল, ভয়জনিত কারণে জাহানারা নিয়মিত স্কুলে আসে না, তখন সে জাহানারার কাছে গিয়ে বলল, জাহানারা! আমি শুনেছি তুমি নাকি ভয়ের কারণে প্রতিদিন স্কুলে আসতে পারো না? কথাটি কি ঠিক?
হ্যাঁ তুমি ঠিকই শুনেছ। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে। শত চেষ্টা করেও তা বের করতে পারছি না। আশেপাশে কোনো মেয়েও নেই যে, তাঁর সাথে স্কুলে আসা যাওয়া করব।
মুহিবুল্লাহ এবার সুযোগ পেয়ে যায়। সে বলে, মেয়ের কি দরকার? আমরা তো একই গ্রামের লোক। তুমি ইচ্ছা করলে আমার সাথেই আসা যাওয়া করতে পারো। আমি তোমার সাথে থাকলে এমন কোনো বাপের বেটা নেই যে, তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাবে । তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাযী থাকো, তাহলে আগামীকাল থেকেই শুরু করতে পারো। আমি তোমার অপেক্ষায় রেডি হয়ে বসে থাকব। তুমি এলেই এক সাথে স্কুলে চলে যাব ।
এত দিন জাহানারা মুহিব্বুল্লাহকে উপেক্ষা করলেও আজ আর পারে নি। তাই সে মুহিব্বুল্লাহর প্রস্তাবে রাযী হয়ে যায়। বলে, ঠিক আছে, তাই হবে।
পরদিন থেকেই শুরু হয় দুজনের একত্রে যাতায়াত। প্রথম প্রথম অপ্রয়োজনীয় কোনো কতজাই হতো না দু জনের মাঝে। কিন্তু দিন যতই যায় ততই কথাবার্তার পরিমাণ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, এখন আর প্রয়োজন অপ্রয়োজনের বালাই নেই। যখন যার মনে যা আসছে তাই অবলীলায় বলে চলছে। কেউ কিছু মনে করছে না। এমনকি এক পর্যায়ে তাদের মাঝে হাসি মজাকও শুরু হয়। এতে উভয়ই তৃপ্তিবোধ করে। আনন্দে নেচে ওঠে হৃদয়-মন।
দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে নতুন বছর শুরু হয়। সময়ের তালে তালে তাদের সম্পর্কেও জটিল আকার ধারণ করে। এখন তাঁর তাদের সম্পর্ক কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একে অপরের বাড়িতে যাওয়া, নির্জনে দেখা–সাক্ষাৎ করা, চিঠি–পত্র বিনিময় করা ইত্যাদি সব কিছুই এখন অবলীলায় চলছে।
গ্রামের লোকদের কাছে তাদের আচরগুলো প্রাথমিক অবস্থায় একটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। তারা মনে করত ওরা একই সাথে একই স্কুলে পড়ে। সুতরাং পড়াসংক্রান্ত নানাবিধ প্রয়োজনে একজন আরেকজনের বাড়িতে যেতেই পারে। দেখা সাক্ষাৎ করতেই পারে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তাদ্রে আচরগুলো যখন গ্রামের লোকদের দৃষ্টিতে সহনীয় পর্যায় অতিক্রম করল, তখন এ নিয়ে তাদের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়। এমনকি কয়েকজন সচেতন গ্রামবাসী একরামুল হকের কাছেও কথাটি জানিয়ে দেয়।
মুহিব্বুল্লাহরা মোট দুই ভাই। সে ছোট, একরামুল হক বড়। ওদের পিতার নাম মুদাব্বির হোসেন। বার্ধক্য এসে যাওয়ায় সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গত কয়েক বছর আগে একরামুলের হাতেই অর্পণ করেছেন তিনি। সুতরাং একরামই এখন সংসার চালায়, সবদিক দেখাশুনা করে।
জাহানারার সাথে মুহিব্বুল্লাহর সীমাতিরিক্ত মাখামাখি একরামের চোখে যে পড়ে নি তা নয়। কিন্তু লজ্জার কারণে সে তাঁর ছোট ভাইকে কিছুই বলে নি। বলতে পারে নি। কিন্তু এখন যেহেতু ব্যাপারটি সবার চোখের পড়ে গেছে; হাটে- ঘাটে, বাজারে-বন্দরে এ নিয়ে কথা হচ্ছে, কয়েকজন তাকে সতর্কও করেছে, সর্বত্র বয়ে যাচ্ছে সমালোচনার ঝড়, তখন আর একরাম বসে থাকতে পারে নি। সে ব্যাপারটি নিয়ে দারুণ চিন্তিত হয়। মনে হয়, তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। এমতাবস্থায় কী করবে সে কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না।
একরাম বড় হলেও এখনো সে বিয়ে করে নি। ভাবে সে, আমি যদি এখন বিয়ে করতে যাই, তাতে সময় অনেক ফুরিয়ে যাবে এবং এরই মধ্যে হয়তো কোনো অঘটন ঘটে যাবে। তাই সে নিজের বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মুহিব্বুল্লাহর বিয়ের জন্য ওঠে পড়ে লেগে যায়।
একরামকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় নি। মাস খানেকের মধ্যেই সে মুহিব্বুল্লাহর জন্য ভাল একজন পাত্রি খুঁজে পায়। শুধু তাই নয়, উভয় পক্ষের আলোচনা শেষে বিয়ের দিন তারিখও নির্ধারিত হয়ে যায়। শুক্রবার। ১৭ নভেম্বর ২০০৬। আজই মুহিব্বুল্লাহর বিয়ে। আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই এসে গেছে। কনের বাড়িতে গিয়ে জুমুআ পড়ার কথা। বরযাত্রীরা প্রস্তুত হচ্ছে। গাড়িও উপস্থিত। রং-বে রংয়ের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বরের গাড়িটি।
মুহুব্বুল্লাহ ও বিয়েতে রাযী ছিল না। কিন্তু মুরব্বীদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত সে রাযী হয়। এখন সে দুলহার সাজে সজ্জিত। সবাইকেবাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য একরাম বারবার তাগাদা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ বেরও হয়ে গেছে। খানিক বাদেই কনের বাড়ির উদ্দেশে সবাই একত্রে বরযাত্রা শুরু করবে।
এরই মধ্যে ঘটে যায় একটু বিস্ময়কর ঘটনা। জাহানারা দৌড়ে এসে একরামের সামনে উপস্থিত হয়। এ মুহূর্তে জাহানারাকে দেখে একরাম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে সে। তাকে কী বলবে, কী বলা উচিত৫ কিছুই সে ঠিক করতে পারছে না। তাছাড়া তাকে কোনো কথা বলার সুযোগেও দেয় নি জাহানারা। সে তাঁর সামনে মৃত্যুদূতের মতো ঝড়ের বেগে হাজির হয়েই চরম ক্ষোভ নিয়ে বলতে থাকে–
“মুহিবুল কোথায়? আজ নাকি ওর বিয়ে! আমি কিছুতেই এ বিয়ে হতে দিব না। আজ তিন বছর যাবত সে আমাকে বয়ে করবে বলে কথা দিয়ে আসছে, সে আমাকে বারবার বলেছে, আমাকে ছাড়া আর কাউকে সে বিবাহ করবে না। আমাকে আশ্বাস দিয়ে, আমার সবকিছু শেষ করে সে আজ অন্যত্র বিবাহ করতে রওয়ানা দিচ্ছে? কোথায় সে? আমি একবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই”। কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে শেষ করে জাহানারা।
শাকিলকে ঘটনাটা এতটুকু শুনানোর পর খালেদার স্বামী সোহেল এসে সেখানে উপস্থিত হয়। তাকে দেখেই সাকিব একটু এগিয়ে এসে হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে। ঘরে ঢুকে শাকিলের উপর চোখ পড়তেই তাকে জড়িয়ে ধরে সোহেল বলতে থাকে–আরে! আপনি এখানে? ভাইয়ার রিচার্স সেন্টারে সেই যে একবার আপনার সাথে দেখা হলো, আর দেখা হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। ভেবেছিলাম, আপনি খালেদার বিয়েতে আসবেন। কিন্তু সাকিব ভাইয়ার কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আপনি নাকি অসুস্থ। তাই আসতে পারবেন না। যা হোক অনেক দিন পর আপনাকে পেয় খুব খুশি লাগছে।
শাকিল বলল, আমিও আপনাকে পেয়ে বেশ আনন্দিত হয়েছি। আপনারা বোধ হয় কোনো জরুরী কথা আলোচনা করছিলেন। আমি তাহলে বাইরে একটু ঘুরে আসি। সোহেল বলল। না, না, জরুরী কনো কথা নয়। দীর্ঘদিন পূর্বে সাকিব ভাই আমাকে একটি ঘটনা শুনাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। আজ তাকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম।
তাহলে সেই ঘটনাই এখন হচ্ছিল?
হ্যাঁ।
আমি কি শুনতে পারব সেই ঘটনা?
অবশ্যই শুনতে পারবেন। তবে ঘটনার যে অংশটুকু বলা হয়ে গেছে তাঁর কী হবে?
সেটুকু আমি আপনার কাছে থেকে পরে শুনে নেব। এখন সামনে চলা যাক। এতক্ষণ সাকিব সোহেল ও শাকিলের কথোপকথন শুনছিল। তাদের কথা শেষ হলে সে আবার বলতে লাগল–
জাহানারার কথায় একরাম কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সে কঠিন কণ্ঠে বলল, এমন পাগলামী শুরু করেচ কেন? এখন বরযাত্রী রওয়ানা দিচ্ছে। কিছু বলার থাকলে পরে এসে বলো।
পাগলামী করছি মানে? আমি আর আপনার সাথে একটি কথাও বলতে চাই না। যা বলার মহিব্বুল্লাহর কাছেই বলব। আমি তাকে শুধু একটি কথাই জিজ্ঞেস করব যে, অন্যত্র বিবাহ করার ইচ্ছাই যদি তাঁর থাকে তাহলে সে আমার সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল কেন? কেন সে আমার জীবনটাকে নষ্ট করল? কী অপরাধ করেছি আমি?
এতক্ষণে আত্মীয়-স্বজন সবাই জড়ো হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। কেউ কল্পনাও করতে পারে নি যে, আজকের এই শুভ দিনে তাদেরেকে এরূপ একটা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
জাহানারাকে অনেক বুঝাল। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। কারো কথাই সে কানে নেয় নি। সে পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, আমার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই আপনারা যা করার করবেন। তাতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।
জাহানারাকে ফিরিয়ে দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত একরাম একথা বলতে বাধ্য হলো যে, আচ্ছা ঠিক আছে। জুমুআর পর এলাকার মুরব্বীদের নিয়ে আলোচনা করে এর একটা সমাধানে যাব।
যাওয়ার পথে এই যে বাধা পড়ল, সেই বাধা আর দূর হলো না। যাওয়া হলো না কনের বাড়িতে। আনন্দের দিনে এক ঝাপটা কালো মেঘ এসে সবার সুখ-স্বপ্নকে ধূলির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেল। আলোকোজ্জ্বল চেহারাগুলো হয়ে গেল বিবর্ণ–ফ্যাকাশে।
এদিকে কনের বাড়ির লোকজন যখন এ সংবাদ শুনল তখন তারাও বেঁকে বসল। তারা বলল, এমন ছেলের কাছে আমরা আমদের মেয়ে দেব না। তবে ইজ্জত রক্ষার্থে ঐদিনই তারা অন্যত্র বিবাহ ঠিক করে মেয়েকে নতুন বরের হাতে উঠিয়ে দিল।
জুমআর পর গোটা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের জায়গাও বাকি নেই। জাহানারা প্রখর রৌদ্রে বসে আছে। ঘরে গিয়ে বসার জন্য তাকে বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু সে কারো কথা শুনে নি। সে বলছে, আমার ব্যাপারটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ব না। মুহিব্বুল্লাহকে পাওয়ার আশায় কোনো কষ্টই যেন অনুভব হচ্ছে না তাঁর।
গ্রামের মুরব্বীগণ ইতোমধ্যেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেছেন। তারা জাহানারাকে তাঁর বক্তব্য পেশ করা জন্য বললে সে সব কিছু সবিস্তারে খুলে বলল।
এবার মুহিব্বুল্লাহ পালা। মুরব্বীরা তাঁর দিকে মনোযোগী হলেন। জাহানারার দেওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাঁর কোনো কথা আছে কিন জানতে চাইলেন।
মুহুব্বুল্লাহ চাপের মুখে সবকিছু অস্বীকার করে বসল। শুধু এতটুকু বলল, গ্রামের মেয়ে হিসেবে এবং আমরা একসাথে পড়াশুনা করি বিধায় তাকে যতটুকু চিনা দরকার ততটুকু চিনি। এর বাইরে তাঁর সাথে আমার কোনো ধরনের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনও নেই।
মুরব্বীগণ পুনরায় জাহানারার দিকে মনোনিবেশ করলেন। তারা বললেন, তোমার বক্তব্যের স্বপক্ষে তোমার হাতে কোনো প্রমাণ আছে কী?
জাহানারা বলল, হ্যাঁ আছে। আমি যে খাটে ঘুমাই, ঐ খাটেই আমার একমাত্র প্রমাণ।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ এই তিন বছরে সে আমার কাছে যতগুলো চিঠি দিয়েছে সবগুলো ঐ খাটের বিছানার নীচে আজও সংরক্ষিত আছে।
সঙ্গে সঙ্গে জাহানারাদের বাড়িতে দুজন লোক পাঠানো হলো। কিছুক্ষণ পর লোক দুজন সত্যি সত্যি অসংখ্য চিঠি নিয়ে ফিরে এল। চিঠিগুলো যে মুহিব্বুল্লাহর হাতে লেখা তাতে কোনো সন্দেহ রইল না। কারণ প্রতিটি চিঠির নীচেই তাঁর নাম লিখা আছে। তাছাড়া তাঁর হাতের লেখাও অনেকেই চিনে।
কয়েকটি চিঠি মজলিশে পাঠ করা হলো। এতে বিচারের আসনে সমাসীন বিজ্ঞ মুরব্বীগণ পরিস্কার বুঝতে পারলেন যে, ওদের দুজনের মধ্যে আসলেই গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তারা ফায়সালা দিলেন যে, মুহিব্বুল্লাহ যেহেতু জাহানারার জীবন নষ্ট করেছে, বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে, সুতরাং মুহিব্বুল্লাহ এখন জাহানারাকেই বিয়ে করবে। তাকেই গ্রহণ করবে জীবনসঙ্গীনি হিসেবে।
মুহিব্বুল্লাহর পরিবার এ ফায়সালা মেনে নিল না। কিন্তু মেনে না নিলে কি হবে? গোটা গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে কি একা অবস্থান নিয়ে টিকে থাকা যায়? সুতরাং শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ফয়সালা মেনে নিতে হলো। তবে একরাম বলল, আমাদের কে দু’দিনের সময় দিন। এর মধ্যে আমরা জাহানারার সাথে মুহিব্বুল্লাহর বিবাহের কাজ সমাধা করব।
বৈঠক শেষ হওয়ার পরও জাহানারা তাঁর নিজ বাড়িতে যায় নি। মুহিবুলদের বাড়িতেই অবস্থান করছে। উভয়ের জন্য শক্ত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে কেউই কোনো অঘটন ঘটাতে না পারে।
আজ দুদিন শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এখনো বিয়ের কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। আগামী কালই বিচারকদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। একরাম আজ দারুণ চিন্তিত। যদি আজ বিয়ে না হয়, তাহলে আগামীকাল কী জবাব দিবে সে! এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একরাম তাঁর মায়ের কাছে যায়। অবশেষে সবদিক চিন্তা করে আজ রাতেই বিয়ের কাজ সমাধা করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
মুহিব্বুল্লাহ রাত ন’টার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন রাত দশটা। বাড়ির সবাই নিশ্চিন্ত যে, মুহিব্বুল্কলাহ তাঁর বিছানায় শুয়ে আছে। একরাম বিয়ে পড়ানো জন্য কাজী সাহেবকে নিয়ে আসে। তাপর মুহিব্বুল্লাহকে ডেকে আনার উদ্দেশ্যে তাঁর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। একরাম মুহিব্বুল্লাহর ঘরে গিয়ে দরজা খোলা পেল। বিছানা খালি। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজল সে। ছোট ভাইয়ের নাম নিয়ে বারবার দাকল। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এ ঘটনায় গোটা বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেল।
চাঁদনী রাত। জোৎস্নার আলোতে চারিদিক ফক ফক করছে। একরাম তাঁর আত্মীয়-স্বজন সহ সবাইকে নিয়ে মুহিব্বুল্লাহকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। সম্ভাব্য সব জায়গায় তাকে খোঁজা হলো। কিন্মতি কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
এখন রাত প্রায় আড়াইটা। সবাই উদ্বিগ্ন। ভীষণ রকমের চিন্তিত। এমন সময় একজন ‘পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি’ বলে চিৎকার করে ওঠল। সেই সাথে বলল, এই তো মুহিবুল কে গাছের ডালে ঝুলন্ত দেখা যাচ্ছে। তাঁর কথা শুনে সবাই দৌড়ে গেল নদীর ধারের সেই বৃক্ষটির দিকে।
এতক্ষণ জাহানারা কড়া প্রহরায় বেষ্টিত ছিল। কিন্তু মুহিবুলের দুঃসংবাদ শুনে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। হন্তদন্ত হয়ে ছূটে গেল মুহিবুলকে দেখার জন্য। ফলে একমাত্র একজন বৃদ্ধা ছাড়া জাহানারার কাছে তখন আর কেউ রইল না।
মুহিব্বুল্লাহর আত্মহত্যা করার সসংবাদ শুনতে পেয়ে জাহানারা মনে মনে ভাবল, যার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিলাম, ইজ্জত সম্মান নষ্ট করলাম, সে-ই যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তখন আমার আর এ জীবন রেখে লাভ নেই। বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। মুহিবুল ছাড়া অন্য কারো শয্যাশায়িনী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সে তো আমার সবকিছু.. .. ..।
জাহানারা আর ভাবতে পারে না। সে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বৃদ্ধা তাকে আটকে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেন নি। তাই অন্যরা এসে কী বলবে এই ভয়ে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর কয়েকজন মহিলা ফিরে এল। তারা বৃদ্ধা মহিলাকে জাদতে দেখে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করল। বৃদ্ধা জবাবে বললেন, তোমরা চলে যাওয়ার একটু পরেই জাহানারা চলে গেছে। আমি তাকে বহু চেষ্টা করেও রুখতে পারি নি। ঘর থেকে বের হয়ে কোন দিকে গেল তাও আন্দাজ করতে পারি নি।
এবার শুরু হলো আরেক হৈ চৈ। একরাম পাগলের মতো হয়ে গেল। তাঁর পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। একদিকে সে ভাইকে হারাল। আবার এদিকে এ কালনাগিনোও চলে গেল। তবে বেশিক্ষণ ভাবার সময় নেই তাঁর। সে সবাইকে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল জাহানারার সন্ধানে।
একরাম প্রথমে জাহানারাদের বাড়িতে গেল। সে বাড়ির ভিতর ঢুকতে চাইলে জাহানারার মা তাকে বাধা দিল। বলল, তোমরা আমার মেয়েকে হত্যা করে তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এখানে তাকে খুঁজতে এসেছ?
একরাম বাধা উপেক্ষা করে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। সমস্ত বাড়ি খুঁজে দেখল। জাহানারাকে কোথাও খুঁজে পেল না।
এবার একরামের সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল। চিন্তার অথৈই সাগরে হারিয়ে গেল সে । সবাইকে বলল, তোমরা গোটা গ্রামের প্রতিটি বৃক্ষ তন্ন তন্ন কুরে খুঁজে দেখ।
সবাই খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না । এভাবে অনেকক্ষণ খোঁজার পর একজন একরামের কানের কাছে এসে বলল, একরাম ভাই! ওই যে ওখানের ভাঙ্গা কবরটার উপর মানুষের মত কি যেন একটা দেখা যায়। চলুন না সেখানে গিয়ে দেখি আসলে ব্যাপারটা কি।
একরাম সেদিকে পা চালাল। উপস্থিত সবাই তাঁর অনুসরণ করল। সেখানে গিয়ে তারা দেখল, জাহানারা তাঁর গলায় উড়না পেঁচিয়ে কবরের পাশে একটি ছোট গাছের ডালে ঝুলে আছে।
জাহানারা যেখানে আত্মহত্যা করেছিল তাঁর অদূরেই ছিল মুহিব্বুল্লাহর আত্মহত্যার স্থানটি। যদি রাতের অন্ধকার না থাকত তাহলে একে অপরকে স্পষ্ট দেখতে পেত। ভাবখানা এমন, মুহিব্বুল্লাহ যেন জাহানারার দিকে চেয়ে আছে, আর জাহানারা যেন চেয়ে আছে মুহিব্বুল্লাহর দিকে।
শাকিল! এভাবেই এক রাত ঝরে দু টি তরতাজা প্রাণ। যাওয়ার বেলায় তারা যেন সবাইকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেল–হে জগতের যুবক-যুবতীরা! আমাদের মতো অবৈধ প্রেমে মত্ত হয়ে তোমরা তোমাদের মূল্যবান জীবন নষ্ট করো না।
সাকিবের বলা কাহিনী শুনে শাকিল ও সোহেল উভয়ে নির্বাক, বিমুঢ় ও বিহ্বল। আঁখিগুলো অশ্রু ছল ছল করছে। কান্নার একটা ঝড় তাদের মরুতে তাণ্ডব তুলে বারবার ঠোঁটগুলোকে কাঁপিয়ে তুলছে।
আটাশ
খালেদার বিয়ে হওয়ার কয়েকদিন পরই আল ফালাহ রিচার্স সেন্টার থেকে একটি সেমিনার স্মারক বের হলো। এই স্মারক-গ্রন্থের যাবতীয় ব্যয়ভার হাজী বশীর সাহেব একাই বহন করলেন। শুধু তাই নয়, সাকিবদের রিচার্স সেন্টারের কার্যক্রম দেখে হাজী সাহেব এতই খুশি হলেন যে, ইতোমধ্যে তিনি সেন্টারের জন্য দশটি কম্পিউটার এবং প্রায় তিন লক্ষ টাকার কিতাব-পত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনে দিলেন। এতে সেন্টারের কার্যক্রম আরো ত্বড়িত গতিতে এগিয়ে চলল। প্রথম এডিশনে ৫০০০ কপি স্মারক গ্রন্থ ছাপা হয়েছিল। এসব কপি খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ায় হাজী সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী আরো ১০,০০০ কপি ছাপা হয়। আনন্দের বিষয় এই যে, এই গ্রন্থ যারাই পড়েছে তারাই মুগ্ধ হয়েছে, বিস্মিত হয়েছে। বলতে বাধ্য হয়েছে, বর্তমান যুগে এমন বই অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই গ্রন্থের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল, সেমিনারের প্রদত্ত মাওলানা সাকিবুল হাসানের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি। সর্বশ্রেণীর মানুষের উপর এই বক্তব্য এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করেছে যে, অসংখ্য পাঠক মোবাইল এবং চিঠির মাধ্যমে মাওলানাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অনেক উচ্চশিক্ষিত লোক তো ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি এও বলেছেন যে, স্মারক থেকে আপনার বক্তব্যটি পাঠ করে সর্বাধিক উপকৃত হয়েছি। আপনি নারীদের মর্যাদা, অবস্থান, পর্দা, স্বাধীনতার ইত্যাদি বিষয়ে সে সারগর্ভ ও যুক্তিযুক্ত আলোচনা করেছেন তাতে আমাদের হৃদয়ের বদ্ধ কপাট খুলে গিয়েছে। আমাদের চিন্তা ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। আল্লাহ পাক আপনাকে দীর্ঘজীবি করুক এবং আপনার জবান ও কলমকে করুন আরো শানিত। মোটকথা এই স্মারক গ্রন্থ অতি অল্প সময়ের মধ্যে গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলে।
স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় মাস খানেক পর রিচার্স সেন্টার থেকে আরেকটি বই বের হয়। বইটির নাম দেওয়া হয়, ভুলের মাশুল। অত্র বইয়ে অবৈধ প্রেমের করুণ পরিণতি সম্পর্কিত দশটি সত্য কাহিনীও অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই গ্রন্থে ছন্দনামে আরো স্থান পায় শাকিল ও লাবণীর হৃদয়স্পর্শী কাহিনীও। এ বইটিও অতি অল্প সময়ে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো, এ বই পাঠ করার পর অনেক যুবক-যুবতী তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং এ ভয়ঙ্কর পথ পরিহার করে সঠিক পথে ফিরে আসে। সেই সাথে তারা মুসলিম যুবক-যুবতীদেরকে আলোর পথের দিশা দেওয়ার নিমিত্তে এ ধরনের আরো বই বের করার জোর আবেদন জানায়।
সাকিবকে কেন্দ্র করে হাজী বশীর সাহেব, মুফতি শফীউল্লাহ এ মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদের মধ্যে একটি গভীর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। দেখলে মনে হয়, এ সম্পর্কে যেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের চাইতেও বেশি মজবুত, বেশি শক্ত, বেশি অটুট, যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়। একথা অবশ্য পাঠকবৃন্দ আগেই জেনে ফেলেছেন।
একদিন মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব মুফতি সাহেবের কাছে গেলেন। তারপর দু’জনে মিলে সাকিবের বিয়ে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ বললেন-মুফতি সাহেব! সাকিবের তো বিয়ের বয়স হয়েছে।
হ্যাঁ, আমিও এ ব্যাপারে চিন্তা করছি।
তাঁর জন্য কোনো মেয়ে দেখেছেন কি?
মেয়ে আর দেখব! মেয়ে তো দেখাই আছে।
আপনি কোন মেয়ের কথা বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
অনুমান করতে পারছেন তো?
হ্যাঁ, অনুমান করতে পারছি।
বলুন তো কে সে?
আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তবে সে হাজী সাহেবের মেয়ে নাঈমা ছাড়া আর কেউ নয়।
আপনি ঠিক ধরতে পেরেছেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
তা কাজ কুতটুকু এগুলেন?
তেমন একটা এগুতে পারি নি।
কারণ?
কারণ তেমন কিছু নয়। সাকিবের বোন খালেদা বিয়ের উপযুক্ত ছিল না সেজন্য সাকিবের ব্যাপারটাকে আমি তেমন প্রাধান্য দেই নি। এখন তো সে বাধা দূর হয়েছে। খালেদার বিয়ে হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, এখন আর কোনো বাধা নেই। আমি ভেবেছিলাম দু’একদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে আপনার সাথে পরামর্শ করব এবং পরামর্শ মোতাবেক দু’জন মিলে যা করার করব। এখন আল্লাহর মেহেরবানীতে আপনি যখন এসে গেছেন, এবার বলুন আমরা কিভাবে সামনে অগ্রসর হতে পারি।
আমার তো মনে হয় আমরা সাকিবের আব্বা জনাব আতাউর রহমান সাহেবকে ঢাকায় এনে তাঁর কাছে নাঈমার ব্যাপারটি খুলে বলি। আমাদের কথা শুনে তাঁর পছন্দ হলে আমরা দু’জন একদিন হাজী সাহেবের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাব। আমার বিশ্বাস দু জনের কেউই আমাদের কথা প্রত্যাখ্যান করবেন না।
না, না প্রত্যাখ্যান করার তো প্রশ্নই আসে না। সেদিন তো আতাউর রহমান সাহেব আমাকে সাকিবের একটি মেয়ে দেখতে বলেও গেছেন। সেই সাথে এও বলেছেন যে, আপনারা সাকিবকে মানুষ করেছেন, নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন, সুতরাং তাঁর ব্যাপারে আপনারা যা বলবেন, যা করবেন, সবই আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিব। আপনাদের পছন্দের উপর আমাদের কোনো পছন্দ নেই। আপনি কি তখন সাকিবের আব্বাকে নাঈমার ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, সামান্য একটু আভাস দিয়েরছিলাম। তবে বিস্তারিত কিছুই বলি নি। এরপর দুজনের মধ্যে সাকিবের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে আরো অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তারা-প্রথমে সাকিবদের বাড়িতে গিয়েই তাঁর আব্বার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেশ করবেন।
ঊনত্রিশ
আজকাল সাকিবকে নিয়ে বশীর সাহেবের বাসায় প্রায়ই কথাবার্তা হয়। একদিন একখিলি পান স্বামীর মুখে তুলে দিতে দিতে বশীর সাহেবের স্ত্রী স্বামীকে উদ্দেশ করে বললেন–
সাকিব তো খুব ভদ্র, দয়ালু ও মার্জিত ছেলে। তাই না?
হ্যাঁ, একথা তো সবাইকে স্বীকার করতে হবে।
তাছাড়া ছেলেটির যোগ্যতাও তো কম নয়।
তাও ঠিক। তো হঠাৎ করে এসব কথা বলছ যে!
আমার মনে একটি কথা বারবার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছি না।
নির্ভয়ে বলো।
কথাটি হলো, সাকিব যদি নাঈমাকে পছন্দ করে….।
যা বলতে চাও, বলে যাও। ভয়ের কোনো কারণ নেই।
মানে বলছিলাম কি, সাকিবদের বাড়ি থেকে যদি নাঈমার জন্য কোনো প্রস্তাব আসে!
সাকিব আমাদের উপর অপরিসীম ইহসান করেছে। তাঁর ইহসানের বদলা দেওয়া কস্মিনকালেও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং তুমি যা বলতে চাচ্ছ, তা যদি বাস্তব হয়, তাহলে হৃষ্টচিত্তে আমি তা মেনে নেব।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নাঈমা সবকিছু শুনে ফেলে। সে তাঁর পিতা-মাতার উপর এজন্য খুশি যে, তাঁর পছন্দের সাথে তাদের পছন্দ মিলে গেছে। তারাও সাকিবকে পছন্দ করেছে। তাই তাঁর মনে তামান্না, সাকিবদের পক্ষ থেকে যেনো দ্রুত পয়গাম আসে। তারপর সে…..। আনন্দের আতিশয্যে নাঈমা এর চেয়ে বেশি ভাবতে পারে না। আনন্দে তাঁর হৃদয়-মন বারবার নেচে ওঠে। হৃদয়ের অনন্ত সুর, শব্দের আকৃতিতে কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে।
নাঈমা এখন আগের চে’ বেশি অপরূপা, অধিক সুন্দরী। মায়াময় তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য। কারণ, হৃদয়ের আনন্দের জোয়ার তাঁর শিরায় শিরায় রক্তের বান নিয়ে এসেছে। রক্তের লালিমায় তাঁর চেহারা গোলাপী আকার ধারণ করে বড় চিত্তাকর্ষী ও মায়াময়ী করে তুলেছে।
পিতা-মাতার সম্মতির কথা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে আকাশসম খুশি নিয়ে বাগানে এসে দাঁড়ায় নাঈমা। এই আনন্দঘন মুহূর্তে হঠাৎ নাজমা এসে হাজির হলো। কিন্তু নাঈমা তা আঁচ করতে পারল না। বিড়ালের মতো অতি সন্তর্পণে নাজমা এগিয়ে গেল। তারপর আচানক পশ্চাৎ দিক দিয়ে তাঁর ডাগর চোখ দুটি চেপে ধরল। বলল, কী খবর? এত আনন্দিত মনে হচ্ছে যে!
না, তেমন কিছু না। শীতল স্নিগ্ধ বাতাসটা মনটাকে বেশ প্রফুল্ল করে তুলেছে কিনা তাই খুব ভালো লাগছে। নাজমা চোখ ছেড়ে দিয়ে নাঈমার লজ্জাভরা চোখে চোখ রেখে বলল, বুঝেছি, আসল কথা আমার থেকে লুকানো হচ্ছে! আমি কি তোমার আনন্দিত হওয়ার আসল কারণটি বলে দিব?
বলো দেখি।
সাকিব তোমাদের সাথে যে অভাবনীয় আচরণ করেছে, অর্থাৎ যার ওসিলায় তোমরা যে দীন পেয়েছ, সে কারণে তোমার পিতা-মাতা তোমাকে তাঁর গলার মালায় গেঁথে দিতে প্রস্তুত হয়েছেন। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে এ বিষটাই তোমাকে এত আনন্দিত করেছে।
তুমি কি ভাবে তা জানলে?
আমি জানব না মানে! সকালে খালাম্মা ও ব্যাপারে আমার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন। তাদের কথা থেকেই ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আর এখন তোমাকে এতটা উৎফুল্ল দেখে তোমার ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াচ্ছে তা ভালো করেই টের পেলাম।নাজমার কথা শুনে নাঈমা যারপর নাই বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ত্রিশ
একদিন তারিখ করে মুফতি সাহেব ও ইমাম সাহেব দু’জনে একত্রে মিলে সাকিবদের দেশের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। সাকিবের আব্বা আতাউর রহমান সাহেব তাদেরকে পেয়ে সীমাহীন খুশি হলেন। বললেন, আপনাদের মতো মহান ব্যক্তিগণ আমাদের বাড়িতে আসবেন, তা আমি ভাবতেও পারি নি। সত্যিই আপনাদের পদধূলিতে আমাদের বাড়ি আজ ধন্য।
‘আমরা কোনো মহান ব্যক্তি নয়। আমি সাকিবের মুখে আপনাদের অনেক ত্যাগ এ কুরবানীর কথা শুনেছি। আল্লাহ পাক আপনাদের কবুল করুন।’ বললেন, সাকিবের পিতা জনাব আতাউর রহমান সাহেব।
বিকাল চারটা। মুফতি সাহেব চেয়েছিলেন, তাদের আসল কথাটি সাকিবের আব্বাকে বলে সেদিনই তারা ফিরে চলে আসবেন। তাই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর তিনি সাকিবের আব্বাকে ডেকে বলেছিলেন, বসুন। আপনার সাথে আমাদের জরুরী কিছু কথা আছে।
জবাবে সাকিবের আব্বা বললেন, আপনাদের সব কথাই আমি শুনব। তবে এখন নয়।পরে শুনব। এখন আপনারা একটু আরাম করুণ। আমাদের চলে যেতে হবে। বললেন ইমাম সাহেব। অসম্ভব। কমপক্ষ দু’দিন আমাদের গরীবালয়ে বেড়াবেন। তারপর যাবেন। বিশ্রাম সেরে সবাই একত্রে মসজিদে গিয়ে আছরের নামাজ আদায় করলেন।
অতপর ফিরে এসে বৈকালিক চা-নাস্তার পর সাকিবের আব্বাকে সাকিবের বয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত অবহিত করা হয়। সবকিছু শুনে আতাউর রহমান সাহেব বললেন, এ ব্যাপারে আমার কোনো মতামত নেই। আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই আমার মত। আমি তো আগেই এ কথা মুফতি সাহেবকে বলে দিয়েছি।
হ্যাঁ, একথা মুফতি সাহেবও আমাকে বলেছেন। তবে আপনি হলেন ছেলের পিতা। সবকিছু আপনার জানার প্রয়োজন আছে। ইমাম সাহেব বললেন। এরপর আরো কতক্ষণ আলাপ চলল। পরামর্শ করে সামনের করণীয় ঠিক করা হলো। সেই সাথে এও সিদ্ধান্ত হলো যে, বশীর সাহেবের কাছে ওনারা দুজনই প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। যদি তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে প্রস্তাব কবুল করেন, তবে দেরী না করে মাস খানেকের মধ্যে বিবাহের কাজ সমাধা করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
মুফতি সাহেবরা ঐ দিন রাতেই ঢাকা ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আতাউর রহমান সাহেব কিছুতেই তাদেরকে ছাড়লেন না। পরদিন দুপুরের খানা খেয়ে তাদেরকে বিদায় নিতে হলো। সত্যি বলতে কি, সাকিবের পিতা তাদেরকে এত বেশি আদর আপ্যায়ন করলেন, যা কখনো ভোলার মতো নয়।
একত্রিশ
এবার বশীর সাহেবের সাথে আলোচনার পালা। একদিন সকালে উভয়ে হাজির হলেন বশীর সাহেবের বাসায়। তারা যে হাজী সাহেবের বাসায় যাবেন এ সংবাদ অবশ্য আগেই তাকে জানানো হয়েছিল। এ প্রোগ্রাম সম্পর্কে সাকিবও অনবহিত নয়।
সাকিব আগের দিন রাতে তাঁর এক বন্ধুর মুখ থেকে কথাটি জানতে পারে। স্নগবাদ জানার পর গোটা রাত তাঁর দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটে। যখন তাঁর মনে হতো, হাজী সাহেব প্রস্তাব কবুল করবেন, তখন তাঁর অন্তরে এক আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মন তাঁর বারবার নেচে ওঠে। আর যখন এ চিন্তা আসত–যদি তিনি তা মঞ্জুর না করেন, এক সময়কার হোটেল বয়ের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী না হন, তখনই তাঁর চেহারায় এক বিমর্ষ ভাব ফুটে ওঠে। তখন দুনিয়ার সব কিছু তাঁর কাছে বিস্বাদ মনে হয়।
সাকিব সারারাত দোয়া করে কাটায়। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে খুব কান্নাকাটি করে। মহাপ্রভুর দরবারে হাত তুলে বলে–হে রাহমানুর রাহীম! এ নালায়েক বান্দার উপর তোমার করুণার শেষ নেই। তোমার অসীম দয়ায় আমি আজ বর্তমান অবস্থায় উপনীত। ওগো মাবুদ! আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তুমিই ভালো জানো। তুমি এও জানো যে, আমি কতবার নাঈমাদের বাসায় গিয়েছি, কিন্তু পর্দার বয়সে উপনীট হওয়ার পর আমি কোনোদিন তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলি নি। একমাত্র তোমার ভয়ে আমি আমার চোখকে কড়া শাসনে রেখেছি। কোনোদিন তাকে ইচ্ছা করে দেখার চেষ্টা করি নি। হে আল্লাহ! যদি তাঁর সাথে আমার বন্ধন তুমি রেখেই থাকো, তাহলে অতি সহজে যাবতীয় কাজ তুমি সমাধা করে দাও।
ওগো দয়াময় প্রভু! তুমি ভালো করে জানো যে, মাদরাসায় পড়াশুনাকালে আমি নাঈমার কত খোঁজ খবর নিয়েছি। এ কাজটি সর্বদাই আমি খালেদার মাধ্যমে করেছি। আমি ইচ্ছা করলে তাঁর সাথে কথা বলে তৃপ্ত হতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করি নি। কখনোই করি নি। কি জন্য করি নি, তা তুমি ভালো করেই জানো। হে আল্লাহ! আমি একজন সতীসাধ্বী দীনদার স্ত্রী চাই, যে আমার চক্ষুকে শীতল করবে, আমার দীনের কাজে সহায়তা করবে, আমার সুখ-দুঃখের সাথী হবে। যদি সে মানুষটি নাঈমা হয়, তবে অতি তাড়াতাড়ি … …।
বাক্যের অবশিষ্ট অংশটুকু মুখ দিয়ে উচ্চারণ না করেই ‘বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহীমীন’ বলে সাকিব তাঁর মোনাজাত শেষ করে।
বত্রিশ
সাকিবের দোয়া যেমন কবুল হয় তেমনি আশা পূরণ হয় নাঈমারও। মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে উভয়ে উভয়কে একান্ত কাছে পাওয়ার সুযোগ পায়। মুফতি সাহেব ও ইমাম সাহেবের পরামর্শে অত্যন্ত সাদামাটা ভাবেই সাকিব–নাঈমার বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এ ছিল এমন এক বরকতময় বিয়ে যেখানে সুন্নতের খেলাফ একটি কাজও হয়নি, যা ছিল যৌতুকের অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আসলে সাকিব–নাঈমা মনে মনে এমনটিই চেয়েছিল। এরূপ চাওয়ার কারণ হলো, তাদের জানা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ হাদীস, যে হাদীসে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হলো ঐ বিয়ে যাতে খরচ কম হয়।
বাসর রাতে নাঈমাকে অপূর্ব সাজে সজ্জিত করা হলো। তাঁর দিকে এখন তাকানোই মুশকিল। দৃষ্টিশক্তি খেই হারিয়ে ফেলে। চোখ ঝলসে যায়। যেনো ধূলির ধরায় জান্নাতের হুর! দীর্ঘদিনের সহপাঠিনী মোসাম্মত নাঈমা আখতারকে ভাবী হিসেবে পেয়ে খালেদার আনন্দ যেন আর ধরে না। এ বিয়ের জন্য সেও কম খাটা খাটনি করে নি। নাঈমার রূপ-গুণের কথা সে-ই তাঁর পিতা আতাউর রহমান সাহবের কাছে বারবার বলেছে।
একরাতে খালেদা তাঁর ভাবীকে একটি বিস্ময়কর হার উপহার দেয়। শুধু উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, নাঈমার গলায় হারটি পরিয়ে দিয়ে মিটিমিটি হেসে ‘আমার পেয়ারা ভাবী’! বলে একটানে ঘোমটা খুলে ফেলে। মনে হলো, যেনো অন্ধকার মেঘমালার ফাঁক গলিয়ে পূর্ণিমার উজ্জ্বল ঝলমলে চাঁদ বেরিয়ে এল। খালেদার ঠোঁট ইষ্যৎ হাসি। বলে–ভাবী! বলুন তো, কে আপনাকে দেখে স্থির থাকতে পারবে!
খালেদার কথায় শুনে নাঈমাও মুচকি হাসে। বলে–আর বলো না, পাছে আবার কার চোখ লাগে!
ইস! চোখ আবার লাগবে কে? যে এ কাজ করবে তাঁর চোখ দুটো ফুটো করে দিব না?
যদি এ চোখ তোমার……..।
ভাইয়ার হয়? এটাই তো বলতে চেয়েছিলেন?
মনে করো তাই।
মনে আবার করব কি? আপনি তো ভাইয়ার নাম শুনলেই হুঁশ হারিয়ে ফেলেন।
এমন সময় বাইরে হাজী সাহেবের গলার আওয়াজ শোনা গেলে সবাই খামোশ হয়ে যায়।
তেত্রিশ
সাবিক ও নাঈমার দাম্পত্য জীবন সুখের সাগরে ভেসে হেলে দুলে চলতে লাগল। বিয়ের ঠিক তিন বছরের মাথায় নাঈমার কোল আলোকিত করে একটি ফুটফুটে মেয়ে জম্ম নিল। তাদের দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি ষোল কলায় পূর্ণ হলো। তবের দুঃখের কথা এই যে, সাকিবের ছোট মা রাশেদা খানম এখনো তাঁর হিংসাত্মক স্বভাব পরিত্যাগ করতে পারেন নি।
সাকিব নাঈমাকে নিয়ে এ কারনেই খুব একটা দেশের বাড়িতে যায় না। সে নাঈমাকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে ঢাকায় থাকে। বছরে দু’তিনবার বাড়িতে যায়।আট দশ অবস্থান করে আবার ঢাকায় চলে আসেন।সাকিবরা যে কয়দিন বাড়িতে থাকে সে কয়দিন রাশেদা খানম অস্থির হয়ে থাকেন। এদেরকে দু’চোখে তিনি দেখতে পারেন না। ভাবখানা এমন, এরা চলে গেলেই যেন তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। হিংসুটে মানুষ গুলো কি এমনই হয়!
সাকিবদের দাম্পত্য জীবনের বয়স এখন পাঁচ বছর। এর মধ্যে সাকিবের শ্বশুড় হাজী বশীর সাহেব রাশেদা খানমকে তাঁর বাসায় নেওয়ার জন্য কত যে চেষ্টা করেছেন তাঁর কোনো ইয়ত্তা নেই। নাঈমার আম্মাও তাকে নিতে এসেছেন। সাকিবের আব্বাও তাকে যেতে বলেছেন। কিন্তু তার এক কথা। আমি কোথাও যাই না, যাবো না।
আসলে রাশেদা খানম সাকিবকে যেমন বরদাশত করতে পারেনি, তাঁর উন্নতি অগ্রগতিকে যেমন সুনজরে দেখেন নি, ঠিক তদ্রুপ সাকিবের বউ এত সুন্দর ও গুণবতী হউক এটাও তিনি কোনোদিন কামনা করেন নি। অথচ তিনি যা চান নি, যা কামনা করেন নি, তাই বাস্তবে হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মনে এত জ্বালা, এত যন্ত্রণা, এত দুঃখ।
চৌত্রিশ
কালের পরিক্রমায় সাকিবের সৎ ভাই সেন্টু বড় হয়। রাশেদা খানমের আদর্শে(?) গড়া এই সন্তানও স্বভাব-চরিত্রে মায়ের মতোই হয়। সে কোনোদিন মসজিদে যায় নি। নামাজ পড়ে নি। এমন কি জুমুআর নামাজও। রমজান মাসে দিনের বেলায় সে পেটপুরে খানা খায়। দিনের অধিকাংশ সময় টিভি দেখেই শেষ হয়। গভীর রাত পর্যন্ত সে বিভিন্ন চ্যানেল দেখে তারপর বিছানায় যায়। কোনোদিন আটটার আগে ঘুম থেকে জাগে না বা জাগতে পারে না। সাকিব ও তাঁর পিতা উভয়ে তাকে সঠিক পথে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাশেদা খানমের কারণে তাদের কোনো চেষ্টাই সফলতার মুখ দেখতে পারে নি।
সেন্টু বড় হলে রাশেদা খানমই মেয়ে দেখে পছন্দ করে। এতে সেন্টুর পিতা কিংবা বড় ভাইয়ের মতামতকে তিনি গুরুত্ব দেন নি। গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও তিনি মনে করেন নি। তাঁর কথা হলো, আমার পুত্রবধূ হবে আমার মনমতো। মোল্লা কিংবা মোল্লা টাইপের কোনো লোক দিয়ে আমার ছেলের বউ নির্বাচন করলে চলবে না। কারণ ওদেরকে বউ নির্বাচনের দায়িত্ব দিলে ওরা মোল্লা মার্কা বউই নিয়ে আসবে। আর মোল্লা মার্কা বউ আমার একদম অপছন্দ!
সেন্টুর স্ত্রীর নাম রোজিনা। সে সুন্দরী হলেও বদদ্বীন। আধুনিকা। ঠিক সেন্টু ও তাঁর মায়ের মতো। পর্দা পুশিদা কি জিনিষ কোনোদিন তা বুঝ নি। আলহামদু সূরা তো দূরের কথা কালিমাটা পর্যন্ত শুদ্ধ করে বলতে পারে না। নামাজ-রোজার ধারে কাছেও নেই। এসব কথা শুনলেই সে নাক সিটকায়। অথচ রাশেদা খানমের ভাষায় এই মেয়েই হলো ‘ফাস্ট ক্লাস বউ’!
যে রাশেদা খানমকে শতবার বলেও সাকিবের শ্বশুড় বাড়িতে নেওয়া যায় নি, সেই তিনিই আজ সেন্টুর শ্বসশুড় বাড়িতে যাওয়ার জন্য নতুন শাড়ি ও গহনা পড়ে রেডি হয়েছেন।
একটি ঝকঝকে নতুন মাইক্রো ভাড়া করে আগেই প্রস্তত রাখা হয়েছে। খানিক পর রাশেদা খানম, সেন্টু, রোজিনা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে চলতে শুরু করল গাড়িখানা। কিন্তু তাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! গাড়িখানা তাঁর গন্তব্যে পৌঁছতে পারে নি। নতুন বেয়াইর বাড়িতে বেড়ানোর স্বাদ পূর্ণ হলো না রাশেদা খানমের। পথে তারা মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলেন। সেন্টু ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাল আর বাকীরা সবাই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো।
আহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন রাশেদা খানম। তাঁর অবস্থা আশংকাজনক। তাঁর দু’হাত একটি পা ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেছে। মাথায়ও প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। সবাই তাঁর জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু হায়াত আছে বিধায় বেঁচে রইলেন। তবে এমন বাঁচা যে, যে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম ছিল।
রাশেদা খানম আজ দশ বছর যাবত পঙ্গু হয়ে কালাতিপাত করছন। তবে তাঁর সৌভাগ্য যে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন।
তিনি সাকিবকে ডেকে এনে চোখের পানি ফেলে দিয়ে বলেছেন, বাবা সাকিব! আসলেই আমি তোমার উপর অনেক জুলুম করেছি। অত্যাচার করেছি। আমি কখনোই তোমার কল্যাণ কামনা করি নি। আমি চেয়েছিলাম, তোমাকে বাদ দিয়ে তোমার পিতার অগাধ সম্পত্তি আমরা একাই ভোগ করব। কিন্তু চাইলেই যে সবকিছু পাওয়া যায় না, আল্লাহর পাকড়াও যে অত্যন্ত কঠিন–এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজে। আর সেন্টুর মৃত্যুতে হৃদয়ে যে ব্যাথা পেয়েছি সে ব্যাথা হয়তো কোনোদিন ঘুচবে না। তাই ব্যথিত হৃদয় নিয়েই হয়তো আমি তোমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিবো বাবা। বিদায় বেলায় সত্য কথাটা স্বীকার করে গেলাম। যাতে আমার আত্মটা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দি–ও বা—-বা !
রাশেদা খানমের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। তিনি আর বলতে পারলেন না। একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
সমাপ্ত।
প্রিয় পাঠিক পাঠিকা, আশা করি লেখকের ইসলামিক উপন্যাস ব্যথিত হৃদয় পড়ে আপনার ভালো লেগেছে। এটি শেয়ার করতে ভুলবেন না।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.