মুচকি হাসি ও সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করুন

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আমরা লেখকের আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ বইয়ের ২৬তম আর্টিকেল মুচকি হাসি সহ ২৭,২৮,২৯ ও ৩০ তম আর্টিকেলগুলি একসাথে এখানে তুলে ধরেছি যাতে আপনি খুব সহজেই এগুলি একসাথে পড়তে পারেন। তাহলে আসুন পড়া শুরু করি…

২৬. মুচকি হেসে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করুণ।

 আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, প্রিয় নবী (সাঃ) যখন ঘরে প্রবেশ করতেন তখন তিনি সালাম দিয়ে প্রবেশ করতেন এবং তার গোটা চেহারায় তখন মুচকি হাসির আভা ফুটে থাকত।

তাই মুচকি হেসে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করা সুন্নত। কিন্তু আমরা অনেকেই ঘরে প্রবেশের সময় ঘরের লোকদেরকে সালাম করি না এবং মুচকি হাসিসহ ঘরে আসি না। অথচ নবীজি (সাঃ) উম্মতের জন্য সর্বদা চিন্তাযুক্ত থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন তিনি এই সুন্নত পরিত্যাগ করেননি। তাই চলুন, এই সুন্নতের উপর আমল করার জন্য আজই আমরা প্রতিজ্ঞা করি। সেই সাথে দোয়াও করি। আল্লাহ  পাক আমাদের সবাইকে এই সুন্নতের উপর আমল করার তাওফিক দান করুণ। আমীন।।

২৭. বিয়েতে কম খরচ করুণ, ওলিমাও করুণ খুব সাদাসিধে ভাবে।

আজকাল বিয়ের মধ্যে যতবেশী খরচ হয় ততই উহাকে বরকতমত মনে করা হয়। অথচ নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, বরকতময় ঐ বিবাহ যাতে খরচ কম হয়। তাই বিয়ের মধ্যে যথা সম্ভব কম খরচ করুণ। গান-বাদ্য-বাজানো, ভিডিও করা ইত্যাদি রেওয়াজ রুসুম পরিহার করুণ।

ওলীমার কাজটিও সারুন সাদাসিধে ভাবে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পনের বিশ জন বা কমবেশী লোকদের কে দাওয়াত দিন। এতটুকুই যথেষ্ট। ওলীমা উপলক্ষে দশ – বিশ হাজার লোককে খাওয়ানো ওয়াজিব নয়। ডেকোরেশন কিংবা লাইটিংয়েরও কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করাও। নিজের ঘরের মধ্যেই খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুণ। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে এত পয়সা খরচ করার কী প্রয়োজন? এ পয়সা গুলো নষ্ট না করে নিজের মেয়েকে কিংবা জামাতাকে দিয়ে দিন। অন্যথায় অপচয় করার কারণে পরকালে বিচারের  সম্মুখীন হতে হবে। তখন কিন্তু হাশরের ময়দানের কোটি কোটি মানুষের সামনে আপনার সম্মান, সুনাম সবই ভুলুন্ঠিত হবে। আপনি সেদিন লাঞ্চিত হবেন, বঞ্চিত হবেন, অপমানিত হবেন। অতএব আগে থেকেই সর্তক  হউন, সাবধান হউন। আমার কথা আমি বলে গেলাম। মানা না মানা আপনার ইচ্ছা। তবে আমার বিশ্বাস , আপনি অনন্ত কল্যাণের প্রত্যশায় আমার কথাগুলো অবশ্যই মানার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিন। আমীন।  

২৮. স্ত্রীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা পরিহার করুণ।

আজকাল মানুষের মধ্যে স্ত্রীকে দাবিয়ে রাখার একটি প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা এটাকে নিজেদের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বলে মনে করে। তারা ভাবে, স্ত্রীকে যদি ভয়-ভীতি ও হুমকী-ধমকী দিয়ে প্রভাবিত করে রাখতে না পারি, তাহলে কিসের স্বামী হলাম? আমাদের বাহাদুরী তো এখানেই যে, আমাদের ভয়ে আমাদের স্ত্রীরা তটস্থ থাকবে। ভয়ে আমাদের দিকে ভালো করে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পাবে  না। আল্লাহ মাফ করুণ, সেদিন এক কিতাবে দেখলাম, কোনো কোনো এলাকায় নাকি এমনও রেওয়াজ আছে যে, প্রথম রাত্রে স্ত্রীকে মারধর করা হয়। যাতে করে সে প্রথম থেকেই স্বামীকে ভয় পায়। কী ঘোর মূর্খতা। কী জঘন্য অত্যাচার! আল্লাহপাক আমাদের কে এ মূর্খতা থেকে হেফাযত করুণ। অথচ নবীজি (সাঃ) আমাদের জন্য কত সুন্দর ও উত্তম নমুনা রেখে গেছেন-  একবার আমাদের আম্মাজান নবীজির সাথে বার্ষিক খরচপাতি নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের আওয়াজের মধ্যে কিছুটা তেজ ভাবও ছিল। ইতোমধ্যে হযরত ওমর (রাঃ) তাশরীফ আনলেন। তাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। ওমর (রাঃ) বললেন, হে নবীপত্নীগণ! তোমাদের কি হলো যে, তোমরা ওমরের ভয়ে নিশ্চয় হয়ে গেলে? অথচ তোমরা স্বয়ং আল্লাহর নবীর সঙ্গে গরম ভাষায় কথা বলছিলে? জবাবে আম্মাজানগণ বললেন, হে ওমর! তুমি তো কঠোর প্রকৃতির মানুষ। আর আমরা তো জীবন যাপন করি দয়ার সাগর প্রিয় নবী (সাঃ) এর সঙ্গে। [বুখারী শরীফ, খন্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৫২০]

এ হাদিস থেকে বুঝা গেল, নবী করীম (সাঃ) আমাদের আম্মাজান্দের কে ভয়-ভীতি দেখিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন না।  যদি তা-ই হতো, তাহলে তারা কোনো নবীজির সাথে গরম ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তাই আসুন, আমরাও নবীজিকে অনুসরন করি। নিজ নিজ স্ত্রীকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা পরিহার করি।

কোনো কোনো স্বামী এমন আছেন যাদের মনের মধ্যে সর্বদা একটা হিরো হিরো ভাব বিরাজ করে। যার কারণে স্ত্রীকে মনে করে জিরো! তাই তিনি সবসময় নিজের ইচ্ছা ও মতামতকে সঠিক এবং স্ত্রীর ইচ্ছা ও মতামতকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করে থাকেন। স্ত্রীকে মোটেই তিনি পাত্তা দেন না। তার মতামতকে কোনো মূল্যায়ন করেন না। তিনি সবসময় নিজেকে প্রধান্য দেন। বস্তুতঃ এরূপ মানসিকতার পোষণ করা অর্থহীন ও অনভিপ্রেত।

কেননা একজন আদর্শ স্বামী কখনো এমন করতে পারেন না। তিনি বরং মাঝে মধ্যে স্ত্রীকেও প্রাধান্য দিবেন। প্রাধান্য দিবেন ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কামনা-বাসনা, অভিমত-মতামত ও পছন্দ –অপছন্দকে। অন্যথায় স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধভাব জাগ্রত হবে। সে তখন স্বামীর সাথে মন খুলে কথা বলার সাহস পাবে না। ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আবেগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা ইত্যাদি প্রকাশ করবে না। আর এর বিষময় ফল হিসেবে এক সময় হয়তো সে বেপরোয়া হয়ে স্বামীর হিরো হিরো ভাবকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না।

অবশ্য এর উল্টো চিত্রও মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে স্বামী নয়, বরং স্ত্রীই নিজের মতামত ও ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। স্বামী কিংবা স্বামীর ইচ্ছা – অনিচ্ছাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। এ অবস্থাটি প্রথম অবস্থার চাইতে আরো বেশি মারাত্মক। কারন এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে টানপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং পরস্পরের প্রতি মায়া-মমতা ও প্রেম-ভালোবাসায় আশঙ্কাজনকভাবে ভাটা পড়তে থাকে। তাই স্বামী –স্ত্রী উভয়ের উচিৎ- একে অপরকে গুরুত্ব দেওয়া। তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। আমিই বেশি বুঝি, আমার মতামতটাই সঠিক – এরূপ মনোভাব না রাখা । আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।

২৯. বয়স বিবেচনায়ও স্ত্রীর প্রতি সহানুভুতিশীল হউন।

সাধারণতঃ দেখা যায় স্বামী – স্ত্রীর বয়সের মাঝে ৮/১০ বছরের ব্যবধান থাকে। এই ৮/১০ বছরের ব্যবধান কিন্তু কম নয়, অনেক। ধরুণ, স্বামীর বয়স যদি স্ত্রীর চাইতে ১০ বছর বেশী হয় তবে তার অভিজ্ঞতা স্ত্রীর অভিজ্ঞতার চেয়ে ১০ বছর বেশি। তদুপরি স্বামীর চলাফেরা, মেলামেশা ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে স্ত্রীর তুলনায় অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । ফলে সঙ্গত কারণেই স্বামীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার স্ত্রীর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারের চাইতে অনেক বড়। এ কারণে প্রায় সকল ক্ষেত্রে স্ত্রীর তুলনায় স্বামীর পরিপক্কতা থাকে বেশি। সুতরাং অভিজ্ঞতা ও পরিপক্কতার পার্থক্যের কারণে কোনো বিষয়ে স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল ও চিন্তার ভিন্নতা থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই এ ক্ষেত্রে স্বামীকে চটে গেলে চলবে না। বরং স্ত্রীর বয়সের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তার প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, আমি যে বিষয়টি বর্তমানে উপলব্ধি করছি, তা সময়ের কাছ থেকে শিখতে হলে স্ত্রীকে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। অতএব যে বিষয়টি সে ১০ বছর পর শিখবে, সেটি নিয়ে এখনই তার সাথে ঝগড়া কিংবা রাগারাগি করা  মোটেও সঙ্গত নয়।

৩০. স্ত্রীকে ভালোবাসুন, সেই সঙ্গে শাসনও করুণ।

আপনি স্বামী। স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে তো অবশ্যই ভালোবাসবেন। তবে লক্ষ্য রাখবেন, আপনার এই সীমাহীন ভালোবাসা যেন, স্ত্রীকে শাসন করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।  কেননা ইসলামী শরীয়তে স্ত্রীকে ভালোবাসার সাথে সাথে তার আমল আখলাক সংশোধনের জন্য শাসন করতেও বলা হয়েছে। তাই স্ত্রীকে শাসন করাও আপনার দায়িত্ব। যাতে স্ত্রী লাইনচ্যুত না হয়ে যায়। বে-আদব না হয়ে যায়। তবে স্ত্রীকে নিজের মনমত শাসন করা যাবে না। বরং তাকে শাসন করতে হবে শরীয়ত কর্তৃত্ব নির্ধারিত গন্ডির মধ্যে থেকেই। স্ত্রীকে কীভাবে শাসন করতে হবে তার সুন্দর ও উত্তম পদ্ধিত পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে- তোমরা যখন নারীদের অবাধ্য হওয়ার এবং মাথায় চড়ে বসার আশঙ্কা করো, তখন তোমরা তাদেরকে শাসন করো।

অতঃপর এ আয়াতে শাসন করার তিনটি পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমটি হলো, তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বুঝাও। এর দ্বারা বুঝা গেল, একটু অন্যায় করলেই সাথে সাথে মারপিট শুরু করা যাবে না। বরং প্রথমে তাকে ভালো কথা বলে, উপদেশ দিয়ে, নসীহত করে ভালো বানানোর চেষ্টা করতে হবে।

দ্বিতীয়টি হলো, উপদেশ-নসীহতে কাজ না হলে তার বিছানা পৃথক করে দাও। অর্থাৎ তার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দাও এবং এক বিছানায় থাকলে অন্যদিকে পিঠ ফিরিয়ে, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকো। তাহলে তার আত্মমর্যাদা বোধ থাকলে তাতে আঘাত লাগবে। যার ফলে সংশোধন হয়ে তোমার কাছে আসবে।

যদি এই শাসনের দ্বারা কাজ হয়ে যায় তবে তো হলোই। আর যদি দেখা যায় যে, এভাবেও তার সংশোধন হচ্ছে না, তাহলে তৃতীয় নম্বরে বলা হয়েছে তাকে কিছুটা মারধর করে সংশোধন করো।

মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, এই আয়াতে স্ত্রীকে সংশোধনের যে ধারাবাহিকতা বলা হয়েছে, সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই স্ত্রীকে সংশোধন করতে হবে। তবে মারধর করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন তা পরিমাণে বেশী না হয়ে যায় এবং কোনো ভাবেই শরীরের কোথাও দাগ না পড়ে। আমি যদি আল্লাহর এই বান্দীর উপর জুলুম করি, জিদ মেটানোর জন্য বেশি শাস্তি দেই, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ পাকও আমার থেকে প্রতিশোধ  নিবেন। আর আমি যদি তার উপর রহম করি, তাহলে আল্লাহ পাকও আমার উপর রহম করবেন। মোটকথা, স্ত্রীকে মার দিতে হলে চড়-থাপ্পর বা হালকা কিছু দিয়ে সামান্য আঘাত করলেই যথেষ্ট। কারন, স্ত্রীকে মারার উদ্দেশ্য হলো, তার আত্মমর্যাদা বোধ জাগিয়ে তোলা, তাকে কষ্ট দেওয়া নয়। যাতে তার মনে এই অনুশোচনা তো আসবেই না, বরং উল্টো জিদ পয়দা হবে। ফলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশি হয়ে যাবে। আসলে শরীয়তের প্রত্যেকটা আমল যেভাবে করতে বলা হয়েছে সেভাবে করলেই ফায়েদা হয়, অন্যথায় ফায়েদা না হয়ে ক্ষতি হয়ে যায়। আল্লাহ পাক আমাদের সকলেই সহীহ বুঝ দান করুণ। আমীন!!

আরও পড়তে পারেনবউ পেটানোর মজা!

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ বই থেকে নেওয়া। 

এরপর পড়ুন : আপনার স্ত্রী কি আপনার প্রতি উদাসীন?

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি লেখকের আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ বইয়ের মুচকি হাসি সহ অন্যান্য আর্টিকেলগুলি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে এবং আপনাদের দাম্পত্য জীবনে সহায়ক হবে। লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment