ভুলের সমাধান করুন সহজভাবে

ছােট বড় অনেক ধরনের অনেক ভুলই মানুষ করে থাকে। ভুল যত বড় হােক তার সমাধান সম্ভব। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, কখনও কখনও শতভাগ সমাধান করা যায় না। তবে বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ভুল শােধরানাের চেষ্টাই করে না। তারা মনে করে ভুল যা হওয়ার হয়ে গেছে, এটা আর ঠিক হবে না।

কখনও কখনও অপরাধীর সঙ্গে আমরা এমন আচরণ করি যে, সেটাও অপরাধের রূপ পরিগ্রহ করে। আমার ছেলে কোনাে অপরাধ করে ফেললে তাকে এমনভাবে তিরস্কার করি এবং তার সামান্য ভুলটাকে এত বড় করে তুলে ধরি যে, তার কাছে মনে হয়, সে এমন কুয়ােয় পড়ে গেছে যা থেকে বাঁচার কোনাে পথ নেই। ফলে সে সমাধানের আশা ছেড়ে দিয়ে ভুলের মধ্যেই ডুবে থাকে।

স্ত্রী কোনাে ভুল করে ফেললে কিংবা বন্ধু কোনাে অন্যায়ে জড়িয়ে পড়লে যদি আমি তাকে বােঝাতে পারি যে, ভুল করলেও তার সমাধানের পথ খােলা আছে তাহলে ভুলের প্রতিবিধান সহজ হয়ে যায়। বস্তুত ভুলের মধ্যে ডুবে থাকার চেয়ে সঠিক পথে ফিরে আসাই তাে কাম্য।

জনৈক ব্যক্তি হিজরতের বায়াত হতে মহানবী (সাঃ)-এর কাছে এসে বললাে, “আমি হিজরতের বায়াত হতে এসেছি। কিন্তু আমি চলে আসার কারণে বাড়িতে আমার বাবা-মা কান্নাকাটি করছেন। নবী (সাঃ) তাকে তিরস্কার করলেন না, তার মনােভাবকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও করলেন। কারণ, লােকটি তাে ভালাে উদ্দেশ্যেই এসেছে এবং তার কাজকে সে সঠিক মনে করেছে।

রাসূল তাকে বােঝালেন, তার সমস্যার সমাধান কঠিন নয়, সহজ। তিনি তাকে সুন্দর করে বললেন, ঠিক আছে, তােমার বাবা-মার কাছে ফিরে যাও। তাদেরকে যেহেতু তুমি কাঁদিয়ে এসেছ এখন গিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাও।

রাসূল (সাঃ) বৈচিত্র্যময় আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের মাঝে কল্যাণকর আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করতেন। তিনি তাদেরকে ভালাে কাজে অগ্রগামী হওয়ার শিক্ষা দিতেন। এমনকি তারা যদি মারাত্মক কোনাে অন্যায়ও করে ফেলতাে তবুও তাদেরকে বােঝাতেন, তারা ভালাে ও কল্যাণ থেকে দূরে সরে যায় নি।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনার শেষ অংশটুকু আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলেও পুরাে ঘটনাটি অত্যন্ত উপকারী হওয়ায় এখানে তা শুরু থেকেই উল্লেখ করছি।

রাসূল (সাঃ) কোথাও সফরে যেতে চাইলে স্ত্রীদের নামের লটারী দিতেন। লটারীতে যার নাম উঠত সফরে তাকেই সঙ্গে নিতেন।

বনু মুসতালিক’ এর যুদ্ধে যাওয়ার সময় লটারী দিলে আয়েশা সিদ্দীকা (সাঃ) এর নাম ওঠে। তিনি রাসূলুল্লাহ -এর সাথে যাত্রা করলেন। এর আগেই পর্দার বিধান নাযিল হয়েছে। তিনি উটের পিঠের হাওদাতে আরােহণ করতেন। কাফেলার লােকজন কোথাও যাত্রা বিরতি করলে তিনি তার হাওদা থেকে নেমে প্রয়ােজন পূরণ করতেন। পুনরায় যাত্রা শুরুর আগে তিনিও তাতে চড়ে বসতেন।

যুদ্ধ শেষে রাসূল (সাঃ) মদিনায় ফিরে আসার উদ্দেশ্যে কাফেলা নিয়ে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। কাফেলা চলতে চলতে মদিনার উপকণ্ঠে এসে যাত্রাবিরতি করলাে। তখন ছিল রাত। তারা রাতের কিছু সময় সেখানে অবস্থান করলাে। আয়েশা (রাঃ) কোনাে প্রয়ােজনে হাওদা থেকে নামলেন। তার গলায় একটি মূল্যবান ‘হার ছিল। প্রাকৃতিক প্রয়ােজন পূরণ করার সময় তার অজান্তে গলার হারটি ছিড়ে কোথাও পড়ে গিয়েছিল। রাতের শেষ প্রহরে রাসূল ও পুনরায় যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ আসবাবপত্র গুছিয়ে নিতে লাগলেন।

এদিকে তিনি উটের হাওদাতে প্রবেশ করতে গিয়ে গলায় হাত দিয়ে অনুভব করলেন যে, হারটি নেই। তিনি দ্রুত সে স্থানের দিকে গেলেন, যেখানে তিনি প্রয়ােজন পূরণ করেছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার হারটি পেয়ে হাওদার কাছে ফিরে এলেন। কিন্তু হায়! হাওদা তাে সেখানে নেই। লােকজন তাঁর হাওদা উটের পিঠে রেখে উট নিয়ে চলে গেলেন। তাঁরা ভেবেছিল, তিনি হাওদাতেই আছেন। কাফেলাও চলতে লাগল।

ঘটনার পরবর্তী অংশ স্বয়ং আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর ভাষাতেই শুনুন।

আমি দ্রুত কাফেলার অবস্থানস্থলে ফিরে এসে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই সবাই চলে গেছে। আমি সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, পরবর্তী মঞ্জিলে লােকেরা আমাকে না পেয়ে শীঘ্রই এখানে। ফিরে আসবে। বড় চাদর দিয়ে আমি আমার শরীর ভালােভাবে ঢেকে বসে থাকলাম।

একসময় ঘুমের প্রবল চাপে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আল্লাহর শপথ! ঠিক সে সময় সাফওয়ান বিন মুআত্তাল (রাঃ) আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। জরুরি কোনাে কাজে তিনি পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। তিনি রাতে কাফেলার সাথে ছিলেন না।

দূর থেকে ঘুমন্ত মানুষের আবছায়া দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। কাছে আসতেই তিনি আমাকে চিনে ফেললেন। কারণ, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, “ইন্নালিল্লাহ!… আল্লাহর রাসূলের স্ত্রী!?

আমি তার শব্দ শুনে জেগে উঠলাম। তাকে দেখে আমি চাদর দিয়ে চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর শপথ! তিনি আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। আমিও তার “ইন্নালিল্লাহ…’ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনি নি।

এরপর তিনি তার বাহন জম্ভকে বসিয়ে দিলেন। আমি তাতে আরােহণ করলে তিনি উটের রশি ধরে লােকদের খোজে দ্রুতপদে চলতে লাগলেন।

আল্লাহর কসম! ভাের হওয়া পর্যন্ত আমরা কারও দেখা পেলাম না। কাফেলার কেউ আমার অনুপস্থিতির বিষয়টি অনুভব করতে পারল না। আমরা কাফেলাকে একস্থানে বিশ্রামরত অবস্থায় পেলাম। হঠাৎ লােকটি এসে উটের রশি ধরে টানতে লাগল।

এরপর অপবাদ আরােপকারীরা বিভিন্ন কথা রটাল। বাহিনীর লােকজন এটা শুনে চমকে উঠলেন। অথচ আল্লাহর শপথ! আমি এর কিছুই জানি না।

আমরা মদিনায় পৌছলাম। মদিনায় এসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। লােকদের এসব রটনার কিছুই তখন আমার কানে পৌছে নি। ..

অবশ্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও আমার বাবা-মার কানে সে সব কথা পৌঁছেছিল। তারা যদিও কিছুই আমাকে জানাননি কিন্তু আমার প্রতি আল্লাহর রাসূলের স্বাভাবিক ভালােবাসায় কিছুটা ঘাটতি অনুভব করতে লাগলাম।

এর আগে যখনই আমি কোনাে কষ্ট বা অসুস্থতায় ভুগতাম তখন তিনি আমাকে যে ধরনের মায়া-মমতা দেখাতেন সে মুহূর্তে তিনি এমন কিছুই করলেন না। এ সময় যখনই তিনি আমার কাছে আসতেন তখন তিনি কেবল এতটুকু জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছ? এর বেশি আর কিছুই বলতেন না। আমি রাসূলের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।

এ কারণে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি অনুমতি দিলে আমি মায়ের কাছে চলে যেতাম, তিনি আমার শুশ্রষা করতেন।

রাসূল সাঃ বললেন, “ঠিক আছে, কোনাে অসুবিধা নেই।’

আমি মায়ের কাছে চলে গেলাম। তখনও আমি সেসব অপবাদ সম্পর্কে কিছুই জানি না। অসুস্থ অবস্থায় এভাবে প্রায় বিশ দিনেরও বেশি কেটে গেল। এ দীর্ঘ সময়ের পরে একদিন আমার ব্যথা কিছুটা লাঘব হলাে। সে সময়ে একরাতে কোনাে প্রয়ােজনে আমি বাইরে বের হলাম। সঙ্গে ছিলেন আমার পিতার খালাত বােন ‘উম্মে মিসতাহ’। তিনি আমার সঙ্গে পথ চলছিলেন। হঠাৎ দ্রুত চলতে গিয়ে নিজের গায়ের চাদরের সাথে লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেন বা পড়ে গেলেন । এরপর তিনি বলে উঠলেন, ‘মিসতাহর সর্বনাশ হােক!

আমি বললাম, “আল্লাহর শপথ! আপনি একি বলছেন? আপনি একজন বদরি সাহাবিকে গালি দিচ্ছেন?

তিনি বললেন, ‘হায় আফসােস! বেটি! সে কী বলেছে তুমি কি কিছুই শুনো নি? ‘হে আবু বকরের কন্যা! তােমার কাছে কি কোনাে খবরই পৌছে নি!? আমি বললাম, “কিসের খবর? 

তখন তিনি আমাকে অপবাদ আরােপকারীদের রটানাে মিথ্যাচার সম্পর্কে সব জানালেন।

আমি বললাম, “আসলে কি এমন রটানাে হয়েছে!?

তিনি বললেন, হ্যা, বেটি! আল্লাহর কসম! এমনই রটেছে!

আল্লাহর কসম! এ কথা শােনার পর আমি আর প্রাকৃতিক প্রয়ােজন সারতে পারলাম না। অস্থির হয়ে ফিরে এলাম। আমার অসুস্থতা আরও বেড়ে গেল। আমি কান্না আর থামাতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল, এ কান্না আমাকে নিঃশেষ করে দেবে। মাকে বললাম, “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! লােকদের অপবাদ সম্পর্কে জেনেও আপনি আমাকে কেন জানালেন না?

তিনি বললেন, বেটি! এটা তাে মামুলি একটা বিষয়! স্বামী যদি তার সুন্দরী স্ত্রীকে ভালােবাসে। আর তার যদি অনেক সতীন থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তাে অনেক কিছুই রটবে!’

আমি বললাম, ‘সুবহানাল্লাহ! মানুষ এসব কথা বলাবলি করছে?

সে রাতে অশ্রুর নােনা জলে অবগাহন করে আমার প্রভাত হলাে। রাতভর অশ্রুধারা অবিরত প্রবাহিত হয়েছে। ক্ষণিকের জন্যও চোখে ঘুম আসে নি।

এ হলাে আয়েশা (রাঃ) এর অবস্থা। তার ওপর অপবাদ আরােপ করা হয়েছে। অথচ তার বয়স তখনও পনেরাের কোঠা পার হয় নি। অথচ তিনি একজন পূতঃপবিত্র, সচ্চরিত্র ও সংযমি নারী। সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে পবিত্র সত্তার জীবনসঙ্গীনী। তিনি ছিলেন পর্দাবৃতা নারী। নিজ চরিত্রে কখনাে সামান্য আঁচড় লাগতে দেন নি। অথচ আজ তিনি পিত্রালয়ে অপবাদের বােঝা মাথায় নিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন ।

আর আল্লাহর রাসূলের সে সময়ের অবস্থা হলাে, তিনি আয়েশা (রাঃ) এর চিন্তা-কষ্টকে লাঘব করার কোনাে ব্যবস্থা নেন নি। তাকে এ ব্যাপারে কোনাে জিজ্ঞাসাবাদও করেন নি। জিবরাঈল (আ.) কোনাে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন নি, কুরআনের কোনাে আয়াতও অবতীর্ণ হয় নি। রাসূল এ বিষয়টি নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কানাঘুষা ও অপবাদ তাঁর ওপর ভারী বােঝার মতাে চেপে বসেছিল। 

এ অবস্থা যখন দীর্ঘ হলাে তখন একদিন রাসূল (সাঃ) খােতবা দিলেন। খােতবায় তিনি বললেন, “হে লােকজন! তাদের কথা আর কী বলব যারা আমার পরিবারকে নিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অসত্য কথা বলে বেড়াচ্ছে। অথচ আল্লাহর কসম! আমি তাদেরকে সৎ ও নিরপরাধ বলেই জানি। তারা এমন লােককে নিয়ে অপবাদ দিচ্ছে আল্লাহর কসম! যার সম্পর্কে আমার ধারণা ভালাে। সে কোনােদিন আমার অনুপস্থিতিতে আমার ঘরে প্রবেশ করে নি।

এ কথাগুলাে শুনে আওস গােত্রপ্রধান সা’দ বিন মুআয দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা যদি আওস সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে তাদের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট। আর যদি আমাদের খাযরাজ সম্প্রদায়ের হয়ে থাকে তাহলে বলুন, আমাদেরকে নির্দেশ দিন, তাদের গর্দান উড়িয়ে দিতে আমাদের বেগ পেতে হবে না।’

খাযরাজ গােত্রপ্রধান সা’দ ইবনে ওবাদা এ কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি একজন সৎ লােক ছিলেন। কিন্তু বংশীয় মর্যাদাবােধে তিনি ফুলে উঠেছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, “আল্লাহর কসম! তুমি অসত্য বলছ, তাদের গর্দান উড়ানাে হবে না। তারা যে খাযরাজ গােত্রের লােক এ কথা তুমি কিভাবে বললে? তারা যদি তােমার গােত্রের হতাে তাহলেও কি তুমি এ কথা বলতে?”

এবার উসায়েদ বিন হুযাইর দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ! আল্লাহর কসম, তাকে আমরা হত্যা করব। তুমি তাে দেখি মুনাফিক হয়ে মুনাফিকদের পক্ষে সাফাই গাইছ!’

তারপর লােকজন উত্তেজিত হয়ে গেল। একপর্যায়ে হাতাহাতির উপক্রম হলাে। রাসূল (সাঃ) তখন মিম্বরে ছিলেন। তিনি তাদেরকে বিরত হতে বললেন। এতে সবাই থামল। রাসূল (সাঃ)ও আর কোনাে কথা না বলে মিম্বর থেকে নেমে ঘরে চলে গেলেন।

রাসূল (সাঃ) যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, সাধারণ লােকদেরকে বলে বিষয়টির সমাধান সম্ভব নয়, তখন তিনি পরিবারস্থ বিশেষ বিশেষ লােকদের নিয়ে বিষয়টি সমাধান করতে চাইলেন। তিনি আলী (রাঃ) ও ওসামা বিন যায়েদ (রাঃ) -কে ডেকে পরামর্শ চাইলেন।

ওসামা (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর খুব প্রশংসা করে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তাে আপনার পরিবারকে সৎ ও ভালাে জানি। এসব ডাহা মিথ্যা ও অপবাদ।

আলী (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মহিলার কি অভাব আছে? আপনি তার পরিবর্তে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে সত্য উদঘাটন করতে চাইলে আপনি কোনাে দাসীকে জিজ্ঞেস করুন। সে তাে অবশ্যই আপনার সঙ্গে সত্য বলবে।

তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বারীরাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, বারীরা! আয়েশার মধ্যে তুমি কি কখনও সন্দেহজনক কিছু পেয়েছ?

বারীরা বললাে, “জ্বী না । যিনি আপনাকে নবী করে পাঠিয়েছেন সেই মহান সত্তার শপথ করে বলছি, আমি তাকে ভালােই জানি। কিছুতেই আমি আয়েশাকে দোষারােপ করতে পারি না। সে অল্প বয়সী একটি মেয়ে। অনেক সময় এমন হতাে যে, আমি আটার মণ্ড তৈরি করে তাকে বলতাম, ‘এগুলাে তােমার দায়িত্বে থাকল, খেয়াল রেখ। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়ত আর বকরি এসে তা খেয়ে ফেলত!

ক্রীতদাসী বারীরা (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি কিভাবে সন্দেহ পােষণ করতে পারেন? আয়েশা তাে সে সতী-সাধ্বী মেয়ে শিশুকাল থেকে যাকে সযত্নে লালন-পালন করেছেন উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম মুমিন সিদ্দীকে আকবার আবু বকর (রাঃ), যাকে বিয়ে করেছেন শ্রেষ্ঠতম মানব রাসূল (সাঃ)।

সংশয় ও সন্দেহ কীভাবে আসতে পারে? তিনি যে আল্লাহর রাসূলের প্রিয়তম স্ত্রী। রাসূল (সাঃ) তাকে হৃদয় দিয়ে ভালােবাসেন। সে নিষ্কলুষ, পূতঃপবিত্র। অবশ্য আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা সমুন্নত করার জন্য এবং তাকে চির অমর করার জন্য পরীক্ষা করছেন।

অসহ্য যন্ত্রণায় আয়েশার দিন কাটছে। দিন দিন দুঃখ-কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। তিনি রােগশয্যায় ছটফট করছেন। পানাহার করতে ভালাে লাগছে না।

আল্লাহর রাসূল সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট সাহাবিদের সামনে খােতবা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে উল্টো মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হলাে। ঘরােয়াভাবে আলী ও ওসামাকে ডেকে সমাধানের চেষ্টা করলেন। তাতেও কোনাে ফল বের হলাে না। পরিস্থিতি যখন এ অবস্থায়, তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিষয়টিকে আয়েশার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি করতে চাইলেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, “আমি সে দিন এতাে কেঁদেছি যে, আমার অশ্রুধারা থামে নি। চোখে ঘুম আসে নি। পরবর্তী রাতও অবিরাম অশ্রুধারা আর নিদ্রাহীন চোখ নিয়ে কাটালাম। আমার বাবা-মা ভাবছিলেন, এ কান্না আমাকে নিঃশেষ করে দেবে।

হুযুর (সাঃ) বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আবু বকরের বাড়িতে গেলেন। অনুমতি নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলেন। আয়েশার বাবা-মা তার শিয়রের পাশেই ছিলেন। জনৈক আনসারী মহিলাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অপবাদ আরােপকারীদের রটানাে মিথ্যাচারের পর এ প্রথম রাসূল সাঃ আবু বকরের বাড়িতে এলেন। প্রায় একমাস যাবৎ তিনি আয়েশাকে দেখেন নি এবং এ দীর্ঘ সময়ে আয়েশার ব্যাপারে কোনাে ওহীও অবতীর্ণ হয় নি।

হুজুর (সাঃ) আয়েশার কাছে গেলেন। তখন তিনি শয্যাশায়ী । অবিরাম কান্না আর মানসিক দুশ্চিন্তার ফলে তিনি কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করছেন।

যখনই তিনি কাঁদেন, উপস্থিত মহিলাটিও তার সঙ্গে কাঁদেন। তারা কেউ কিছু করতে পারছেন না। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এসে বসলেন। আল্লাহর প্রশংসাবাক্য পাঠ করলেন। এরপর বললেন, হামদ ও সালাতের পর হে আয়েশা! তােমার সম্পর্কে আমার কাছে কিছু কথা পৌঁছেছে। এ কথা বলে তিনি অপবাদের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করলেন। এরপর রাসূল (সাঃ) আয়েশাকে বলতে চাইলেন যে, মানুষের কখনও কখনও ভুল হয়ে যায় আর ভুলের সমাধান কঠিন কিছু নয়। তাই তাকে বললেন, ‘কোনো! তুমি যদি দোষমুক্ত হয়ে থাক, তাহলে অতিসত্বর আল্লাহ তােমাকে অপবাদমুক্ত ঘােষণা করবেন। আর আল্লাহ না করুন যদি তুমি কোনাে গােনাহে জড়িত হয়ে থাক তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তাওবা কর । বান্দা যখন অপরাধ স্বীকার করে তওবা করে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। জটিল কোনাে প্রক্রিয়ায় না গিয়ে এভাবেই তিনি তার ভুলের সহজ সমাধান দিলেন।

আয়েশা বলেন, রাসূল (সাঃ) যখন কথা শেষ করলেন, দুঃখের ভারে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। আমার চোখের জল একেবারে শুকিয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করছিলাম যে, আমার পক্ষ থেকে আমার মা-বাবা জবাব দিবেন। কিন্তু তারাও একেবারে নীরব ছিলেন।

আব্বাকে বললাম, “আল্লাহর রাসূলকে আমার পক্ষ থেকে উত্তর দিন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি রাসূলকে কী বলব বুঝতে পারছি না। আম্মাকে বললাম, ‘আল্লাহর রাসূলকে আমার পক্ষ থেকে উত্তর দিন। তিনিও বললেন, আল্লাহর শপথ! কী উত্তর দেব আমি জানি না ।

আল্লাহর শপথ! আবু বকরের পরিবারের ওপর তখন যে বিপদ আপতিত হয়েছিল আমি জানি না অন্য কোনাে পরিবারের ওপর কখনও তা আপতিত হয়েছে কি-না! বাবা-মা উভয়ে যখন নিরুত্তর রইলেন তখন আমি কেবল অশ্রুপাত করতে লাগলাম।

এরপর আমি বললাম, না! আল্লাহর শপথ! এ বিষয়ে আমি কখনও আল্লাহর কাছে তওবা করব না। ‘

আমি জানি, কথাগুলাে শুনতে শুনতে আপনাদের অন্তরে গেঁথে গেছে এবং আপনারা তা বিশ্বাস করে নিয়েছেন। এখন যদি আমি আপনাদের বলি যে, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ (আল্লাহ অবশ্যই জানেন আমি নির্দোষ) তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না! আর যদি আমি বিষয়টা স্বীকার করে নিই (অথচ আল্লাহ জানেন, আমি তা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত) তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। এ মুহূর্তে আমি আমার ও আপনাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে শুধু তাই বলবাে যা ইউসুফ (আ.) এর পিতা বলেছিলেন-

فصبر جيري والله المستعان على ما تقون.
অর্থ : ধৈর্যই আমার একমাত্র অবলম্বন। তােমরা যেসব কথা তৈরি করেছ, সে ব্যাপারে আল্লাহই আমার সাহায্যকারী।’ (সূরা ইউসুফ : আয়াত-১৮)

ধৈর্যই আমার একমাত্র অবলম্বন।

আয়শা বলেন, এরপর আমি পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে রইলাম। আমি জানি, আমি নির্দোষ । আল্লাহ অবশ্যই আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন। তবে এ ধারণা আমি কখনও করি নি যে, আল্লাহ তায়ালা আমার পক্ষে ওহী অবতীর্ণ করবেন। আমার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ওহী অবতীর্ণ করবেন আর তা পঠিত হবে এটা আমি কল্পনাও করি নি। আমি আশা করছিলাম, আল্লাহ তাআলা রাসূল সাঃ)-কে স্বপ্নের মাধ্যমে আমার নিষ্কলুষতা সম্পর্কে অবহিত করবেন।

আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল তখনও মজলিস ত্যাগ করেন নি, উপস্থিত কেউ তখনও ঘর থেকে বের হন নি, এমন সময় রাসূল (সাঃ) এর ওপর সে ভাব সৃষ্টি হলাে, যা ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় হতাে। এরপর তার উপর ওহী নাযিল হলাে।

ওহী অবতীর্ণ হতে দেখে (আল্লাহর কসম আমি শঙ্কিত হলাম না । আমি জানি, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার আল্লাহ আমার উপর জুলুম করবেন না।

ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আয়েশার প্রাণ যখন রাসূল (সাঃ) থেকে ওহী অবতীর্ণ হওয়া কালিন ভাব কেটে গেল তখন আমি খেয়াল করলাম, আমার পিতা-মাতার প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হলাে। তারা আশংকা করলেন, না জানি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের এসব কথাকে বাস্তব হিসেবে প্রত্যয়ন করা হয়।

ওহী অবতীর্ণ হওয়া কালিন ভাব কেটে যাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল হাসতে লাগলেন। এরপর তিনি চেহারা থেকে ঘাম মুছলেন। তারপর সর্বপ্রথম তিনি যে কথাটি বললেন তা হলাে, হে আয়েশা! তােমার জন্য সুসংবাদ । তােমাকে নির্দোষ ঘােষণা করে আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।

আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ!

এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা যে আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেছেন তা হলাে,

غضب؛ نگم لا تخبو شا ته د بل هو إن البنين جا و با خيز ته دل امرئ منهم ما الحب من الاثي و انين تولى كبره من که عاب عظيه كولا إذ سيخته طين المؤمنون و المؤمن باقيهم خيرا وقالوا لهذا إفك مبين. كولا جاءو عليه بأربعة شهداء قا لميثوا بالشهد و قوليك ع الله هم الزبون.

অর্থ : যারা এ অপবাদ রচনা করেছে তারা তাে তােমাদেরই একটি দল; একে তােমরা তােমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে কারাে না; বরং এটা তাে তােমাদের জন্য কল্যাণকর; তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য আছে মহাশাস্তি।

যখন তারা এটা শুনল তখন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীগণ আপন লােকদের সম্পর্কে কেন ভাল ধারণা করলাে না এবং বললাে না, ‘এটা তাে সুস্পষ্ট অপবাদ’। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন স্বাক্ষী উপস্থিত করে নি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করে নি, সে কারণে তারা আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী। (সূরা নূর : আয়াত-১১-১৩)

আর তাদের সম্পর্কে কঠিন হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন

إن الزين يحبون أن تشيع الفاحشة في النيين أموالهم عذاب اليه في الدنيا و الآخرة و الله له وانه لا تغلون.

অর্থ : যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মান্তিক শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তােমরা জান না। (সূরা নূর : আয়াত-১৯)।

এরপর রাসূল প্রজা সবাইকে ডেকে খােতবা দিলেন এবং সদ্য অবতীর্ণ , কুরআনের আয়াতগুলাে তাদেরকে তিলাওয়াত করে শােনালেন। এরপর অপবাদ আরােপকারীদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়ায় শরিয়তের শাস্তি প্রয়ােগ করলেন।

এ ঘটনা থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলাে, একজন অপরাধী একজন রােগীর ন্যায়, অবিলম্বে তার চিকিৎসা প্রয়ােজন। নিন্দা ও ভৎসনা করা এবং বাড়াবাড়ি করা মােটেই সমীচীন নয়। কেননা,, কখনও অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, এর ফলে সে মনে করতে পারে, তার ভুল বা অপরাধের কারণে সবাই খুশি হয়েছে। যে চিকিৎসক রােগীর চেয়েও রােগীর প্রতি অধিক সচেতন তিনিই হিতাকাক্ষী চিকিৎসক। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

يو اتنا مثل و مثل الناس انه سيعرشول او عن أبي هريرة كتير رجل اشتوك تارا فلا أضاءت ما حوله جعل القراش وهيرو يغلبته التواب التي تقع في التار يقعن فيها فجعل يزعه فيقتحم فيها فاناا بجز گم عن الار وهه تيرون فيها.

অর্থ : আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমার ও অন্যদের দৃষ্টান্ত হলাে, জনৈক ব্যক্তি আগুন জ্বালাল। যখন তার চারপাশ আলােকিত হয়ে গেল তখন প্রজাপতি ও বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ তাতে ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। লােকটি সর্বশক্তি দিয়ে সেগুলােকে বিরত রাখতে চাচ্ছেন কিন্তু সেগুলাে তার বাধা অমান্য করে দলেদলে তাতে ঝাপিয়ে পড়ছে! আমিও তােমাদের কোমর ধরে তােমাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু তােমরা তাতে ঝাপিয়ে পড়ছ।’ (বুখারী-৬৪৮৩) |

মতামত..

কখনও অপরাধীর সঙ্গে আমাদের আচরণ এমন হয় যে, তা সে অপরাধের চেয়েও বড় অপরাধে পরিণত হয়।

উৎস: জীবনকে উপভোগ করুন (Enjoy your life in bangla) বই থেকে। 

আরও পড়তে পারেন..

০১. ডিপ্রেশন টু সুইসাইড : আত্মহত্যাই সমাধান নয়!

০২. মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় খাবারের উপকারিতা

০৩. আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১ : দাম্পত্য জীবনের গল্প

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment