বুদ্ধিমানরা ব্যয় করে পরকালের জন্যই

হযরত মালেক ইবনে দিনার ও এক বিশ্বাসী যুবকের গল্প!

হযরত মালেক ইবনে দিনার রহঃ। একদিন তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখলেন, এক যুবক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। কী যেন ভাবছে সে।

ব্যয়যুবক ভাবছিল—আমার হাতে টাকা আছে। অনেক টাকা। যা দিয়ে অতি অনায়েসে একটি বিল্ডিং নির্মাণ করা যায়। আমি কি তাহলে বিল্ডিং নির্মাণের কাজে ব্যয় করব এ টাকাগুলো? হ্যাঁ বিল্ডিং নির্মাণের পিছনেই টাকাগুলো ব্যয় করা উচিত। কারণ এতে আমি দুনিয়ার জীবনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারব। তাছাড়া আমি যদি একটি বিল্ডিংয়ের মালিক হতে পারি, তবে সবাই আমাকে সমীহ করবে, শ্রদ্ধা করবে। আমার সাথে কথা বলতেও হিসেব করে কথা বলবে। সমাজের লোকদের কাছে আমি পাব এক অন্যরকম মর্যাদা।

হযরত মালেক ইবনে দিনার রহঃ কাশফের মাধ্যমে যুবকের ভাবনার বিষয়টি জেনে গেলেন। তাই তিনি যুবকটি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে যুবক! কী ভাবছ তুমি?

যুবক বলল, আমি একটি বিল্ডিং তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা করছি। বিল্ডিং তৈরির চিন্তা-ভাবনা?

হ্যাঁ।

তোমার বিল্ডিং নিশ্চয়ই ইট-সুরকি ও বালি দ্বারা নির্মিত হবে। হ্যাঁ, বিল্ডিং তো এসব জিনিস দ্বারাই তৈরি করতে হয়।

তা তো বটে! তবে আমি তোমার খেদমতে একটি কল্যাণকর প্রস্তাব রাখতে চাই। তুমি কি গ্রহণ করবে আমার প্রস্তাবটি? মেনে নিবে আমার কথা?

বলেই দেখুন না। ভালো প্রস্তাব হলে অবশ্যই গ্রহণ করব।

মালেক ইবনে দিনার রহঃ বললেন—তোমার পরিকল্পিত বিল্ডিংটি মাটির ইট দ্বারা তৈরি করতে যে পরিমান টাকা ব্যয় হবে, তুমি যদি আমাকে সেই পরিমান টাকা দিয়ে দাও, তাহলে আমি তোমার  জন্য এমন একটি বিল্ডিং তৈরি করে দেব যার একটি ইট হবে সোনার ও আরেকটি ইট হবে রুপার। আর আস্তর হবে মেশক ও জা’ফরানের।

কী বলো? তুমি কি এই প্রস্তাবে রাযী আছো?

যুবক বলল, খুব সুন্দর প্রস্তাব! তবে আমাকে একটু ভাবতে দিন।

ঠিক আছে। তুমি ভাবতে থাকো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানিও। এ বলে তিনি চলে গেলেন।

যুবক সারারাত চিন্তা করল। সিদ্ধান্ত নিল, স্বর্ণ-রৌপ্যের বিল্ডিং-ই সে বানাবে। কারণ ইট-সুরকি দ্বারা নির্মিত অস্থায়ী বিল্ডিংয়ের চেয়ে সোনা-রুপার তৈরি স্থায়ী বিল্ডিং অনেক শ্রেয়।

পরদিন সকালে হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ যুবকের বাড়িতে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানতে চাইলেন।

যুবক বলল, আমি স্বর্ণ-রুপার বিল্ডিংই চাই। ইটের তৈরি বিল্ডিং চাই না। আমি এখনই আপনার হাতে একটি বিল্ডিং তৈরির সম্পূর্ণ টাকা তুলে দিচ্ছি। তবে আপনার কাছে আমার আবেদন, আপনি আমাকে একটি কাগজে এ কথা লিখে দিন যে—

“যুবক তাঁর মৃত্যুর পর এই টাকার বিনিময়ে সোনা-রূপার তৈরি একটি বিল্ডিং পাবে।”

মালেক বিন দিনার রহঃ কাগজ কলম হাতে নিলেন। তারপর যুবক যা লিখার আবদার করেছিল, তা সুন্দর করে স্পষ্টক্ষরে লিখে দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে এসে যুবকের অজান্তে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া সবগুলো টাকা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে দিলেন।

মালেক বিন দিনার রহঃ এর বাড়ি ও ঘর!

কয়েকদিন পরের কথা। একদিন ঐ যুবক হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ এর বাড়িতে গেল। দেখল, তাঁর বাড়িতে একটি কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। তাও আবার ভাঙ্গা।

যুবক জিজ্ঞেস করল, আপনি এই ঘর মেরামত করেন না কেন?

উত্তরে মালেক ইবনে দিনার রহঃ বললেন, আমার দুইটি বাড়ি আছে। একটি হলো যা তুমি দেখতে পাচ্ছ। অর্থাৎ এই কুঁড়েঘর। আর অপরটি হলো পরকালের ঘর। এখানে মাত্র অল্প কিছুদিন থাকতে  হবে। কাজেই এই অল্প দিনের জীবনের জন্য এতকিছু করে কোনো লাভ নেই। পক্ষান্তরে আখেরাত আমাকে চিরকাল থাকতে হবে। কাজেই আমি যা খরচ করি কিংবা জমা করি তা ঐ আখেরাতের ঘরের জন্য করি। দুনিয়ার এই অস্থায়ী বাড়ির জন্য কিছুই খরচ করি না। মনে রেখো, বুদ্ধিমান লোকেরা কিন্তু পরকালের বাড়ি নির্মাণের চিন্তাই সর্বদা করে থাকেন।

যুবকের দুনিয়া থেকে বিদায়কালের ঘটনা!

কিছুদিন পর যুবকটি মারা গেল। হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ পুনরায় সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে যুবকের খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন, গত কয়েকদিন আগে যুবকটি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।

হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ যুবকের আত্মীয়-স্বজনদের জিজ্ঞেস করলেন, এই যুবক মৃত্যুর আগে আপনাদের কিছু বলে গেছে কি?

একজন বলল, হ্যাঁ বলে গেছে। মারা যাওয়ার পূর্বে সে আমার হাতে একখন্ড কাগজ তুলে দিয়ে বলেছে, আমি যেন ঐ কাগজটি তাঁর কাফনের সাথে কবরে দিয়ে দেই। আমি তাঁর অসিয়ত পূর্ণ করেছি।

এ কথা শুনে হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ মসজিদে প্রবেশ করলেন। হঠাৎ তাঁর নযর পড়ল মিম্বরের উপর ভাঁজ করে রাখা একটা কাগজের প্রতি। মনে হলো, এ কাগজটি যেন কোথাও তিনি দেখেছেন।

হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ কাগজের টুকরোটি হাতে নিলেন। ভাঁজ খুললেন। দেখলেন, এটি ঐ কাগজ যা ইতোপূর্বে তিনি যুবকের হাতে দিয়েছিলেন। তিনি কাগজটি উল্টোলেন। দেখলেন, সেখানেও কিছু লিখা আছে। তিনি পড়লেন। সেখানে আছে—“হযরত মালেক বিন দিনার রহঃ আমাকে যে বিল্ডিং দেওয়ার  ওয়াদা করেছিলেন তা আমি পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।”

প্রিয় পাঠক! যারা পরকালের জন্য খরচ করে তাদের সেই টাকা বৃথা যায় না। আলোচ্য ঘটনাটি এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই আসুন, শুধু দুনিয়ার ঘর নয়, পরকালের ঘর তৈরির ব্যাপারেও সচেষ্ট হই। সেখানে কীভাবে আরামে থাকা যাবে, কীভাবে অফুরন্ত নেয়ামতের অধিকারী হওয়া যাবে, সেই চিন্তা করি, সেই ফিকির করি। পবিত্র কুরআনের আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—তোমাদের কাছে যা আছে, তা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে তা অবশিষ্ট থাকবে। অর্থাৎ দুনিয়াতে আমরা বাড়ি-গাড়ী, ধন-দৌলত যা-ই অর্জন করি না কেন, একদিন তা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবেই। চাইলেও ছাতছাড়া হবে, না চাইলেও ছাতছাড়া হবে। কিন্তু যা আমরা আল্লাহর ব্যাংকে জমা করব, তা কোনোদিন হাতছাড়া হবে না। মৃত্যুর পর এর বিনিময় পুরোপুরিই আমরা পেয়ে যাব। যা আমরা ভোগ করতে পারব অনন্ত অসীম কাল। আর আল্লাহর ব্যাংকে জমা রাখার উপায় হলো—দীনের কাজে, ধর্মের কাজে টাকা-পয়সা খরচ করা। গরীব মিসকিন, ইয়াতিম-অসহায়কে দান করা। নিরন্ন, বুভুক্ষু মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজে অর্থ ব্যয় করা ইত্যাদি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সবাইকে তোমার ব্যাংকে বেশি বেশি সঞ্চয় করার তাওফীক দাও। হিম্মত দাও। সাহস দাও। শক্তি দাও। আমিন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।

লেখকঃ মাওলানা মুফীজুল ইসলাম

বইঃ আদর্শ যুবক যুবতি ১ (হৃদয় গলে সিরিজ) 

লেখকের আরও গল্প…

০১.সৎ মায়ের আদর (শিক্ষামূলক গল্প)

০২. ধন্য এ জীবন-হযরত হাসান বসরীর গল্প

০৩. স্নিগ্ধ কোমল হাসি! (এক এতিম শিশুর গল্প)

০৪. যে ফুল ঝরে গেল অবেলায় (কিশোর গল্প)

০৫. অভিভূত জার্জিস কন্যা! ইসলামিক যুদ্ধের গল্প

০৬. জীবন পরিবর্তনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা (মালেক ইবনে দিনার রহঃ তওবার ঘটনা)

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment