নিষ্ঠুর নির্মম পরিণতি (সাহাবিয়ার গল্প ৩)

গল্পটি ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া (রাঃ)। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে এই সাহাবিয়ার জীবনে কি নিষ্ঠুর নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল সেই নিষ্ঠুরতার নির্মম পরিণতির ঘটনা লেখক গল্পাকারে তাঁর নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী বইতে উল্লেখ করেছেন। আমার বাংলা পোস্ট.কমের সম্মানিত পাঠক পাঠিকাদের জন্য ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া (রাঃ) শহীদ হবার ঘটনাটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো। গল্পটি পড়ে আপনার চোখে পানিও আসতে পারে। 

নিষ্ঠুর নির্মম

নিষ্ঠুরতার নির্মম দৃষ্টান্ত (সাহাবিয়া সুমাইয়া (রাঃ) এর শহীদ হবার ঘটনা)

[ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া (রা.)। ইসলাম গ্রহণ করার অপরাধে তাঁর উপর নেমে এসেছিলো আবু জাহেল বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা। তাঁর বৃদ্ধ স্বামী ইয়াসির (রা.) এবং যুবক পুত্র আম্মার (রা.) ও রক্ষা পাননি তাদের বর্বর নিপীড়ন থেকে। এ বইয়ের নামের সাথে মিল রাখার জন্য বক্ষমান আলোচনায় শুধুমাত্র হযরত সুমাইয়া (রা.)-এর নির্যাতন ভোগ প্রসঙ্গে লেখার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু বক্তব্যের পূর্ণতা এবং একই পরিবারভুক্ত হওয়ায় ইয়াসির (রা.) ও আম্মার (রা.) এর নির্যাতন ভোগের কাহিনী এবং আনুসঙ্গিক কিছু কথাও এসে যাবে প্রসঙ্গক্রমে। লেখক ]

পূর্বগগণ ফর্সা হয়ে আসছে। ভোরের সূর্য রাঙ্গা হয়ে উঠছে। মক্কার উপকন্ঠে পাহাড়ের চূঁড়ায় ঝলমল করছে রবি রশ্মি। কিন্তু ইয়াসির (রা.)-এর ঘুম তখনো ভাঙ্গে নি। সুমাইয়া (রা.) এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ঘরের অনেক কাজই সমাধা করে নিয়েছেন। কিন্তু পরে তিনি ভাবলেন, আজ অভ্যাসের বিপরীত এতো দীর্ঘ নিদ্রার নিশ্চয় একটা কারণ আছে । তাই তিনি স্বামীর বিছানার কাছে গিয়ে তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলেন। বললেন-
: কি ব্যাপার! আপনার শরীরে কি কোনো রোগ দেখা দিয়েছে? : না, কোনো অসুখ আমার নেই। বিলকুল সুস্থ আছি আমি। ঘুম জড়ানো চোখে উত্তর দিলেন ইয়াসির (রা.)।
: তাহলে আজ এখনো বিছানা ছাড়ছেন না যে?
: সুমাইয়া! আজকের এ বিলম্ব সুস্থতা কিংবা অসুস্থতার জন্য নয়। বরং আমি আজ রাতে এমন এক বীভৎস স্বপ্ন দেখেছি যার কারণে চোখ বুঝে বিছানায় পড়ে আছি। ভুলে গেছি তোমাদের সাথে কথাবার্তা, হাসি ঠাট্টা সব কিছুই ।

: আপনি তো প্রায়ই স্বপ্ন দেখেন। তা আজকের স্বপ্নটা কি দেখেছেন বলুন তো দেখি। সুমাইয়া (রা.) অনেকটা হাস্যোচ্ছলেই কথাটা বললেন ।

: সুমাইয়া! দুষ্টুমী করো না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস । আজ রাতে আমি যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি তা কোনো সাধারণ স্বপ্ন হতে পারে না। প্রতিদিন হাজারো স্বপ্ন দেখি কিন্তু জেগে উঠতেই তা ভুলে যাই। আর আজকের দেখা স্বপ্নের সবকিছু আমার চোখের সামনে। আমি সেই বীভৎস দৃশ্য যেনো এখনো অবলোকন করছি।

: এবার তাহলে দেরি না করে স্বপ্নটা শুনিয়ে দিন। এতে আপনার মনের ভয় কিছুটা হয়তো দূর হবে ।

ইয়াসির (রা.) একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন-

সেটা ছিলো একটা মধ্যম আকারের মাঠ। তার দুদিকে এমন উঁচু দুটো পাহাড়, যার মাথা আকাশে ঠেকেছে। আমি মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম, সেই পাহাড় দুটো স্থানে স্থানে ফেটে গিয়ে কিছু অংশ জমিনে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে সকল পড়ে যাওয়া টুকরো হতে এমন মারাত্মক ধরনের আগুন জ্বলে উঠলো, যে আগুনের তুলনা দুনিয়ার আগুনের সাথে হতে পারে না। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আগুন মাঠের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো ।

এদিকে মাঠের একদিকে ছিলো ছোট ছোট নহর বিশিষ্ট একটি সুন্দর চারণভুমি। সেইসব নহরের পানি ছিলো শীতল ও সুমিষ্ঠ। সেই ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ড এ চারণ ভূমি পর্যন্ত আসতেই পারলো না। বরং তার নিকটে এসেই থেমে গেলো। তোমায় আমি সেই সুন্দর চারণভূমিতে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেছি। আরো দেখেছি, তুমি আমাকে হাত ও চোখের ইশারায় সেখানে যাওয়ার জন্য ডাকছো ।

চারণ ভূমিটি আমার অবস্থান থেকে খুব বেশি দূরে ছিলো না। তবে চারণভূমি ও আমার মাঝে ছিলো সেই প্রজ্জ্বলিত ভয়ঙ্কর আগুন। একদিকে তুমি আমাকে ডাকছো আর অপর দিকে আম্মার আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বলছে- আব্বাজান! ভয় করবেন না। আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এ তো সামান্য আগুন। আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। বেশির চেয়ে বেশি, দুএকটা ফোসকা পড়বে মাত্র। দেখুন না, আগুনের ওপাশে কত সুন্দর সুন্দর মাঠ, ঝর্ণধারা, ফুল ও ফলের বাগান। দেখুন, আম্মাজান সে বাগানে ঢুকে কী সুন্দর কমনীয় স্বর্গীয় রূপ লাভ করেছেন। চলুন, আপনিও সেখানে চলুন। আপনি লাভ করবেন সেই হৃদয়গ্রাহী রূপ ।

সুমাইয়া! প্রজ্বলিত আগুনে ঢুকে পড়ার জন্য একদিকে আম্মারের অনুরোধ ও আহবান আর অপর দিকে তোমার ইশারা ও ডাক শুনে আমি যেই সামনে পা বাড়িয়েছি, তখনই সেই ভীষণ আগুনের প্রখর উত্তাপ আমার গায়ে লেগে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

এ পর্যন্ত বলেই বৃদ্ধ ইয়াসির (রা.) দেয়ালের সাথে মাথা আঘাত করে চিৎকার করে বলে উঠলো, আয় মাবুদ! আয় মাবুদ!! সেই বীভৎস আগুনের উত্তাপ এখনো আমার কলিজা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।

স্বামীর মুখ থেকে স্বপ্নের বর্ণনা শুনে সুমাইয়া (রা.) এর বুক থরথর করে কেঁপে উঠে। শিউরে উঠে তার শরীর, বিবর্ণ হয়ে উঠে মুখমন্ডল । অবশেষে ভয় কম্পিত কণ্ঠে বলেন, আল্লাহ আপনাকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে মুক্তি দিন ।

গত রাতের স্বপ্ন বৃত্তান্ত স্ত্রীকে শোনানোর পর ইয়াসির (রা.) কুরাইশদের সবচেয়ে বড় মজলিশ বনু মাখযুমের সভায় গিয়ে বসে পড়লেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো তার আগমনে কেউ সন্তুষ্টি প্ৰকাশ করলো না। বরং উল্টো একে অপরকে টিপ্পনী কাটতে লাগলো । ইয়াসির (রা.) তাদের এ আচরণে সীমাহীন দুঃখিত হলেন । ঘৃণায় তার সারা শরীর রি রি করতে লাগলো। এমনকি আবু হুযাইফার সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হলে আজই বনু মাখযুমের সভা ত্যাগ করে কুরাইশদের অন্য কোনো সভায় গিয়ে বসতেন। কিন্তু মরে গেলেও আবু হুযাইফার সাথে কৃত ওয়াদার বরখেলাফ তিনি করতে পারবেন না। কারণ আবু হুযাইফা হলো সেই ব্যক্তি যে তাকে সর্বহারাদের কাতার থেকে হাত ধরে টেনে তুলেছিলো। আশ্রয় দিয়েছিলো আপন ঘরে। ক্ষুধার সময় অন্ন আর দুঃখের সময় দিয়েছিলো সান্ত্বনা। বিশেষতঃ তাঁর জীবনের একমাত্র চাওয়ার ধন সুমাইয়াকে বিয়ে দিয়েছিলো তাঁর সাথে। তা না হলে ইয়াসির (রা.) প্রতিশোধ হাড়ে হাড়ে গ্রহণ করে ছাড়তেন ।

ইয়াসির (রা.) ছিলেন ইয়ামেন প্রদেশের তেহমা নামক গ্রামের অধিবাসী । তারা তিন ভাই মক্কায় এসেছিলেন তাদেরই এক হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খোঁজ করতে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত খোঁজ করার পরও ভাইকে না পেয়ে একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে দুই ভাই হারিস ও মালিক ফিরে চলে গেলেও ইয়াসির (রা.) আবু হুযাইফার আতিথ্য গ্রহণ করে তারই সাহায্যকারী হিসেবে মক্কায় থেকে গিয়েছিলেন।

ভাইয়েরা চলে যাওয়ার পর আবু হুযাইফা বলেছিলো, ইয়াসির! আমার আশ্রয়ে যতোদিন থাকবে ততোদিন জীবিকা অর্জনের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার খাওয়া পরার সকল জিম্মাদারী আমিই গ্রহণ করলাম ।

জবাবে ইয়াসির (রা.) বললেন-

হে কোমল প্রাণ সাধক প্রবর! তোমার এ দয়ার প্রতিদান দিতে পারবো না আমি। সত্যিই তুমি কুরাইশ কুলের অমূল্য রত্ন আর পবিত্র কা’বার ইজ্জত রক্ষাকারী। তোমার মতো অতিথিপরায়ণ পরোপকারী, দানবীর আমার চোখে আর কখনো পড়েনি। তুমি আশ্রয়হীনদের আশ্রয়স্থল, অসহায়দের সহায় আর বিপন্নের একমাত্র সাহায্যকারী তোমার এ দানের প্রেরণা সত্যিই চিত্তাকর্ষক। আর তোমার এ মহান আদর্শ সকলের জন্যই গ্রহণীয় ।

: হয়েছে ভাই হয়েছে। তুমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে তো এক বিরাট প্রশংসার সেতু নির্মাণ করে ফেলেছো। তবে একটা কথা হলো, তোমার মতো বিভিন্নমূখী ব্যক্তিকে কাছে পেয়ে আজ আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। এ মক্কার উপকণ্ঠে যতোদিন তুমি থাকতে ইচ্ছা করো, এমনিভাবে আমার মেহমান হয়েই তোমাকে থাকতে হবে ।

: ভাই! তোমার এ সহানুভূতির জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। তোমার এসব অবারিত আর অকৃপণ দানের শুকরিয়া মনে প্রাণে আমি আদায় করি। তোমার এ মহানুভবতার বদলে তোমায় একটি জিনিস গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করবো। আর সেটা হলো তুমি আমায় তোমার সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো। আজ হতে যে তোমার সাথে মোকাবেলা করবে, আমিও তার সাথে মোকাবেলা করবো। যে তোমার দুশমনি করবে আমিও তার দুশমন হয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবো। তুমি যার সাথে সন্ধি করবে, আমিও তার সাথে সন্ধি করবো। এক কথায়, আজ থেকে আমি তোমার বন্ধুদের বন্ধু আর দুশমনদের দুশমন হিসেবে নিজেকে পেশ করলাম। তুমি এবং তোমার বংশের জন্য আমার দেহের সমস্ত রক্ত আজ হতে উৎসর্গ করে দিলাম ।

: তাহলে তো এটা আমাদের পারস্পরিক সাহায্যকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মতোই হলো ।

: হ্যাঁ, যদি তুমি তাতে রাজি হও, তবেই আমি সবচেয়ে সুখী হবো ।

: আমি রাজি । বিলকুল রাজি ।

এরপর তারা দু’জন এ অঙ্গীকারের ব্যাপারে পরস্পর শপথ করে এবং এর কিছুদিন পর আবু হুযাইফা তার অতি সুন্দরী দাসী সুমাইয়াকে আযাদ করে দিয়ে ইয়াসির (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন ।

আজ দীর্ঘদিন পর আবু হুযাইফার সাথে সেই কৃত ওয়াদার কথাই ইয়াসির (রা.)-এর মনে পড়ছে। মনে পড়ছে যৌবন জোয়ারে কানায় কানায় ভরপুর, অপূর্ব সুন্দরী নারী সুমাইয়া (রা.) এর সাথে তার বিবাহ দেওয়ার কথা ।

ইয়াসির (রা.) তখনো মুসলমান হননি। তবে যে রাতে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন তার আগের দিনেই পুত্র আম্মার ও স্ত্রী সুমাইয়া (রা.) ইসলাম গ্রহণে ধন্য হয়েছিলেন । অবশ্য এ খবর ইয়াসির মোটেও জানতেন না ।

যা হোক সেদিন কুরাইশদের দুর্ব্যবহারে মনের আগুন মনেই চেপে রেখে বাড়ির পানে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন ইয়াসির (রা.)। এমন সময় দরবারের মাঝখান থেকে আবু জেহেলের আওয়াজ শুনা গেলো-

: ইয়াসির! ব্যাপারটা কি শুনি । আজ এতো বিলম্বের কারণ?

: বিলম্বের কারণ একটা আছে নিশ্চয়ই । বিদ্রূপাত্মক কন্ঠে জবাব দিলো ইয়াসির (রা.)

: ইয়াসির (রা.)-এর তাচ্ছিল্য মাখা উত্তর শুনে আবু জেহেল বলল-

: বহুদিন থেকে তোমার ব্যাপারে আমার অন্তরে একটা খটকা লেগে আছে । আজ কিন্তু তোমাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করে ছাড়ছিনে ।

: খটকা! কিসের খটকা বলুন ।

: আমি এ যাবত তোমাকে কোনো সময় আমাদের দেবতাদের নিকট যেতে দেখিনি। তাদেরকে সম্মানজনক উপায়ে সম্বোধনও করতে শুনি নি। বেশ ক্ষোভের সাথে বললো আবু জেহেল ।

: তাহলে কি কোনোদিন তাদেরকে কোনো খারাপ কথা বলতে শুনেছো? কোনো প্রকার গালি দিতে দেখেছো? দেখেছো তোমাদের মাবুদকে খারাপ নামে ডাকতে?

: তোমার কথায় তো বুঝা যাচ্ছে, তারা আমাদের মাবুদ, তোমার মাবুদ নয় । তাই না ইয়াসির?

: তাহলে এখন কী করতে চাও তুমি?

এবার আবু জেহেলের সন্দেহ মজবুত হলো। সে দাঁতে দাঁত পিষে দৃঢ় কণ্ঠে বললো-

: হ্যাঁ, এখন দেখে নেবো কে আমাদের পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে । আজ সময় এসেছে। মক্কার সমস্ত লোককেই আপন মনের গোপন কথা বলে দিতে হবে। এ যাবত আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের সদ্ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু এবার প্রকাশ পাবে কার ভীত্ কত মজবুত? বেয়াদব কোথাকার!

: আবুল হাকাম! মুখ সামলে কথা বলো। যেদিন তোমার পিতৃক আবু হোযাইফার সাথে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছি, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কেউ কোনোদিন আমার মুখ থেকে অশালীন একটা কথাও শুনে নি । কিন্তু আজ! আজ তুমি আমার সাথে যে অশ্লীল ও অশোভনীয় ব্যবহার করেছো তা এ যাবত কেউ করে নি ।

: ইয়াসির! আবু হুযাইফার সাথে কৃত ওয়াদার কথা যদি তোমার মনে থেকে থাকে, তবে তো আজ হতে তুমি তোমার পুত্র আম্মারের ঘোর দুশমন! একথা বলে আবু জেহেল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ।

: যা কিছু বলতে চাও পরিস্কার করে বলো। তোমার একটা কথাও আজ বুঝতে পারছি নে আমি। আবু জেহেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো ইয়াসির (রা.)।

: তুমি কি আজ কচি খোকা হয়ে গেছো নাকি যে, আমাদের কথা বুঝো না! আবু জেহেলের পক্ষ হয়ে বিস্ময় মাখা কণ্ঠে পাশ থেকে বলে উঠলো উমর ইবনে হিশাম ।

: না, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

: ইয়াসির! বললো উমর ইবনে হিশাম, শোনো! ধোকাবাজির স্থান এটা নয়। তোমার কি জানা নেই যে, গতকাল তোমার ছেলে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করে বেদ্বীন হয়ে গেছে?

এতক্ষণে ইয়াসির (রা.) আসল কথাটি বুঝতে পারলেন। তাই উমর ইবনে হিশামের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিনি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন। তার মুখ তখন মরার মুখের মতো বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ইয়াসির (রা.) এ অবস্থা দেখে একে অপরের দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ।

উমর ইবনে হিশাম আরো কিছু বলার জন্য তৈরি নিল। কিন্তু চাচা ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার চিৎকারে তা আর বলা হলো না। ওয়ালিদ কঠিন কন্ঠে বললো-

খবরদার আর একটি কথাও বুড়োকে বলো না? তার পুত্র যেহেতু আর ছোট নয়, সবকিছু বুঝার তার বয়স হয়েছে, সুতরাং এখন সে আর ছেলের জিম্মাদার নয় । অতএব ছেলের কোনো অপরাধের জন্য তাকে আমরা কিছু বলতে পারি নে।

কুরাইশদের অন্যান্য লোকেরাও ওয়ালিদের কথায় সায় দিলো।

খানিক পর। ইয়াসির (রা.) এর জ্ঞান ফিরে এলো। সবাইকে তার সমর্থক দেখে আবু জেহেল ও উমর ইবনে হিশামকে সম্বোধন করে বললেন, বড়ই লজ্জার বিষয় আবু জেহেল, উমর। তোমরা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছো অথচ আমি তোমাদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ। খোদার কসম! কাল বা আজ আমি আম্মারকে দেখিনি। তার অবস্থা আমার মোটেও জানা নেই। অথচ অন্যায়ভাবে তোমরা আমার সাথে দুর্ব্যবহার আরম্ভ করেছো । এ বলে তিনি টলতে টলতে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন ।

ইয়াসির (রা.) ঘরে এসে দেখলেন, ঘরের সবকিছুই যেনো বদলে গেছে। ঘরের লোকদের চলা-ফেরা, উঠাবসা সবকিছুই যেনো এক নতুন রূপ লাভ করেছে। স্ত্রী সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, যেনো রূপ কথার কোনো পরী তার ঘরে নেমে এসেছে। সুমাইয়া (রা.)-এর এমন মন ভোলানো কমনীয় রূপ-লাবণ্য দেখে ইয়াসির (রা.) নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারলেন না। তার কেবলই মনে হলো, একি সত্যিই তার সুমাইয়া না কোনো স্বর্গীয় অস্পরী?

স্বামীকে আসতে দেখে সুমাইয়া (রা.) হাসতে হাসতে তার অতি নিকটে এসেই আবার দূরে সরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজ আমাদের কলিজার টুকরা আম্মার আমাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের শান্তি নিয়ে এসেছে।

স্ত্রীর কথায় ইয়াসির (রা.) এর চোখে এক রাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে । নির্বাক দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সুমাইয়া (রা.)-এর চেহারা

পানে । তারপর বলেন-

: পরকাল! কিসের পরকাল!! কি বলছো তুমি? আজ যে আমি একেবারেই এক ঘরে হয়ে গেছি। রাত হলে নানা প্রকার স্বপ্ন করে তোলে অস্থির, আর দিনের বেলা মানুষের অসদাচরণ করে তোলে দিশেহারা। আমি তোমাদের কারো কোনো কথাই বুঝতে পারি না ।

: আব্বাজান, শুকরিয়া আদায় করুন। আজ আমি আপনার জন্য সৌভাগ্যের পরশমনি নিয়ে এসেছি। যার ছোঁয়ায় সবকিছুই মূল্যবান সোনায় পরিণত হয়। বললো আম্মার (রা.) ।

: কি বলতে চাস্ পরিষ্কার করে বলে ফেল্ । বল তোর আসল উদ্দেশ্যটা কি? লোকে বলে তুই নাকি বেদ্বীন হয়ে গিয়েছিস্? সত্যি কি তাই? কমবখত্ কোথাকার! পিতা-মাতার উপর কি সাংঘাতিক মুসিবত নিয়ে এসেছিস তা কি একটু ভেবে দেখেছিস?

: হ্যাঁ, আব্বাজান, আমি যা করেছি সব কিছু বুঝে শুনেই করেছি। আমি আপনার জন্য মুসিবত আনি নি। বরং এনেছি ইহকাল ও পরকালের মুক্তির সনদ। আপনার কাছে কেউ হয়তো বলেছে, আমি বেদ্বীন হয়ে গেছি। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তার সম্পূর্ণ উল্টো। কেননা প্রকৃত অর্থে আমি আজ অধর্ম থেকে ধর্মে ফিরে এসেছি। আমি তো সেই খোদার উপর ঈমান এনেছি যিনি আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন রহমত, বরকত ও পথ প্রদর্শক হিসেবে। যিনি আজ আমাদেরকে সরল পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। জীবন যাপনের প্রকৃতপন্থা আর মানবতার মুক্তির মূল ভিত্তিগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। তিনি নামাজের জন্য, সত্য কথা বলার জন্য এবং মিথ্যা ও পাপাচার থেকে দূরে থাকার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। তিনি আরও বলছেন, তার ধর্মে কালো সুন্দর, দাস প্রভূ, ধনী-গরিব ও আরব অনারবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই । সবাই আল্লাহর বান্দা, একে অপরের ভাই ।

আব্বাজান! তিনি বলেছেন, দেবদেবী মিথ্যে, মিথ্যে এসব হাতে গড়া মাটির পুতুল আর পাথরের মূর্তি। তার দাবি হলো, মৃত্যুর পর মানুষকে মহান আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে যাবতীয় কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে। যারা সৎকর্মশীল, তারা পাবে মনিমুক্তার তৈরি সুরম্য বালাখানা পাবে চির শান্তির স্থান জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত । পক্ষান্তরে যারা অবাধ্য নাফরমান তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে চির দুঃখের স্থান জাহান্নামে ।

ইয়াসির (রা.) পুত্রের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শুনলেন । প্রতিটি কথা তার হৃদয়ের মনিকোঠায় রেখাপাত করলো । চোখে মুখে ফুটে উঠলো খুশির আলো । আনন্দে উদ্ভাসিত হলো গোটা মুখ-মণ্ডল ।

কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। মনে হলো চতুর্দশী শশীকে মেঘমালা ঢেকে দিয়েছে। তিনি অস্থির হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন ।

ঘটনার আকস্মিকতায় স্ত্রী-পুত্র উভয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ইয়াসির (রা.)-এর দিকে। তারপর উভয়ে মিলে তাকে বিছানায় শোয়ায়ে সেবা শুশ্রূষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তার সম্বিত ফিরে এলো। অস্থিরতা কমে গেলো । তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বললেন হ্যাঁ, এই তো সেই জিনিস

: আব্বা! একি বলছেন আপনি? আমরা যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না ৷

ইয়াসির (রা.) কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। তার গলা শুকিয়ে বাকশক্তি যেনো রহিত হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টার পর তার মুখ থেকে কথা বের হলো। চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়লো কয়েক ফোটা তপ্ত অশ্ৰু ।

তিনি বললেন, এটাই তো আমার সেই চির বঞ্চিত জীবন জিজ্ঞাসার জবাব। বৎস আমার! আজ তুমি আমায় বহু পুরানো কথা গুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছো। মানিক আমার! বিশ বৎসর বয়সে যখন আমি মক্কায় আসি, তখন আবু হুযাইফার সাথে আমার এসব কথা হয়েছিলো ।

: কি কথা আব্বাজান! একটু শোনান না আমাদেরকে। : হ্যাঁ, বলছি শোনো ।

: বলুন। স্ত্রী সুমাইয়া (রা.) বললেন ।

: আবু হুযাইফার সাথে অঙ্গীকার সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর সে আমাকে বলেছিলো- চলো কা’বা ঘরে যাই, দেবতাদের সাক্ষী বানাবো। তাদের সামনে গিয়ে উভয়ে শপথ নিবো। তখন আমি অস্বীকার করে বলেছিলাম, আমার মাবুদ এগুলো নয়। আমার মাবুদ এখনো খুঁজে পাচ্ছি না। আমি অন্য কাউকে মাবুদ বানালে সূর্য অথবা তারকারাজি কিংবা সমুদ্রকেই বানাতাম। কিন্তু ভেবে চিন্তে দেখলাম এরাও তো অপরের আদেশে চলে । এদের ক্ষমতা অসীম নয়, বরং সসীম, সীমিত ও সীমাবদ্ধ। আমার মাবুদের ক্ষমতা যে অসীম না হয়ে পারে না ৷

প্রিয় বৎস! আজ মুহাম্মদ (সা.) তোমায় যে বলেছেন, এগুলোরও একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই এদের সবাইকে পরিচালিত করেন; আমার নিশ্চিত বিশ্বাস সেই তিনিই আমার হারানো ধন, তাকেই আমি যুগ যুগ ধরে খুঁজে ফিরছি।

এ টুকু বলে ইয়াসির (রা.) মাথানত করলেন । তার গণ্ডদেশ সিক্ত করে তখনো অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছে অবিরতভাবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও তিনি বললেন, পেয়েছি, হ্যাঁ পেয়েছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জিনিস এবার লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। আম্মার! এক্ষুণিই আমাকে মুহাম্মদ (সা. ) এর দরবারে নিয়ে চলো। আমরা মুসলমান হয়ে ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিবো ।

পিতার কথায় আনন্দের আতিশয্যে জোড়ে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন হযরত আম্মার (রা.)। তার মুখে স্মিত হাসি ৷ চেহারায় ফুটে উঠেছে পুলক স্পন্দন। তিনি কালবিলম্ব না করে তখনই পিতাকে সঙ্গে নিয়ে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মুসলমান বানালেন এবং কিছু কথা বলে বিদায় দিলেন ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। এরই মধ্যে গোটা মক্কায় ছড়িয়ে পড়লো ইয়াসির পরিবারের ইসলাম গ্রহণের খবর। শুনলো কুরাইশ নেতৃবৃন্দও। এ সংবাদ শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তারা। আবু জেহেল কতিপয় লোক নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলো হযরত ইয়াসির (রা.) এর বাড়িতে। তারা হযরত আম্মার (রা.) এবং তার বুড়ো পিতা-মাতার পায়ে শিকল পড়িয়ে টেনে হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করলো এবং একটি ছোট কামরায় নিয়ে আবদ্ধ করে রাখলো। সেই সঙ্গে তাদের বসবাস গৃহটি আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিলো। হযরত ইয়াসির (রা.) তখন তার স্ত্রীকে সম্বোধন করে বললেন দেখো, সুমাইয়া দেখো! আমার স্বপ্ন যে আজ আমার সামনেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে। (অর্থাৎ স্বপ্নে তিনি গোটা মাঠ জুড়ে যে লেলিহান আগুনের শিখা দেখেছিলেন সেই আগুনের বাস্তব রূপ হলো কাফেরদের নিষ্ঠুর নিপীড়ন, নির্মম অত্যাচার ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর স্ত্রীপুত্র যেহেতু আগেই ইসলাম কবুল করেছিলেন তাই তাদেরকে দেখানো হয়েছে সবুজ শ্যামল মনোমুগ্ধকর চারণভূমিতে।

: ও কিছুই নয় আব্বা। এরপরেই তো আমাদের জন্য রয়েছে স্বৰ্গীয় বালাখানা আর মহান আল্লাহর দিদারের সৌভাগ্য। পিতার কথার জবাবে বললেন হযরত আম্মার (রা.)।

ইয়াসির পরিবারের উপর সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল অমানুসিক নির্যাতন। যে নির্যাতনের কথা শুনলে শরীরের লোমকূপে আগুন ধরে যায় । স্তব্দ হয়ে যায় মানুষের বিবেক ।

পরদিন সকালে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এক জায়গায় জমায়েত হলো। আজ কোনো ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শ নেই। কোনো গঠনমূলক কাজেরও কোনো প্রোগ্রাম নেই । আজ সকলের মুখেই এক কথা, এ আগুন আর বাড়তে দেওয়া যায় না। অঙ্কুরেই একে বিনাশ করতে হবে। বেদ্বীন মুসলমানদের সমুচিত শাস্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগের শাস্তি কত কঠিন, কত মারাত্মক । সেদিন এ কথার উপর সভার সমাপ্তি ঘোষিত হলো ।

সভা শেষ হওয়ার পর আবু জেহেল তার দলবল নিয়ে সোজা সেই কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো যেখানে হযরত সুমাইয়া (রা.) তাঁর স্বামী ও পুত্র নিয়ে বন্দী অবস্থায় ছিলেন ।

আবু জেহেলের নির্দেশে প্রথমে লোকেরা বন্দীদেরকে টেনে হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে আনলো। বন্দীরা ছিলো তখনো লোহার ভারী শিকল পরিহিত অবস্থায়। বাইরে আনার পর নিষ্ঠুর আবু জেহেল স্বয়ং তাদেরকে পিছন থেকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে সামনের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো। এ অবস্থায় কয়েদীরা হাঁটতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আবু জেহেলের লোকজন তাদের দেহে তীর, তলোয়ার ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র দিয়ে খোঁচা মেরে সারা শরীর রক্তাক্ত করে দিলো। সেই সঙ্গে তাদের দেহে একের পর এক পড়তে লাগলো কোড়ার প্রচণ্ড আঘাত। শুধু তাই নয়, এ নিষ্ঠুর পাষণ্ডরা তাদের দাড়ি ও চুল ধরে টেনে টেনে বাঁশি বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে এগুতে লাগলো সামনের দিকে। যে পথ দিয়ে তারা বন্দীদের নিয়ে অগ্রসর হতো, সে পথেই এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য লোকজন ভিড় জমাতো ।

তবে আশ্চর্যের কথা হলো, এত নির্মম অত্যাচারের মধ্যেও জনতা লক্ষ্য করলো, বন্দীদের মুখে উহ শব্দটি পর্যন্ত নেই। তিন জনের মুখ হতেই স্বর্গীয় দীপ্তির মতো মুচকি হাসি চমকে উঠতে লাগলো। তাদের মধ্যে সামান্যতম অস্থিরতা নেই । নেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠার লেশ মাত্রও।

মজলুমের কাফেলা জালেমদের সাথে সামনে এগিয়ে চললো । চলতে চলতে মক্কার বাইরে এক বালুকাময় ময়দানে এসে সকলেই থেমে গেলো ৷ এমন সময় আবু জেহেল হঠাৎ হযরত ইয়াসির (রা.) এর সামনে এসে বিদ্রূপের সুরে বললো-

: কি হে বুড়ো! আজো কি তুমি বনি মাখযুমের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ?

: তুমিই তো আমাদের উপর অন্যায়ভাবে অকথ্য নির্যাতন করে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে ফেলেছো । সুতরাং আমার উপর আর সেই সন্ধি চুক্তির এতটুকুন জিম্মাদারীও নেই ।

: তবে কি তুমি আমাদের সন্ধি চুক্তি থেকে আযাদ হয়ে গেলে?

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, আযাদ। পুরোপুরি আযাদ। তোমাদের মূর্তি পূজা, তোমাদের দাসত্ব তোমাদের অধীন সবকিছু হতে আমরা বিলকুল আযাদ । সম্পূর্ণ স্বাধীন।

আবু জেহেলের চেহারায় উন্মুক্তভাব ফুটে উঠে। চোখ দুটো জ্বলে উঠে ক্রুদ্ধ সিংহের মতো। প্রতিহিংসার এক তীব্র জ্বালা তার অন্তরে দাহ সৃষ্টি করে চলে। সঙ্গে সঙ্গে লোহার ডাণ্ডা নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে হযরত ইয়াসির (রা.) -এর উপর। আঘাতের প্রচণ্ডতায় মরদে মুজাহিদের তপ্ত লহুতে লাল হয়ে যায় মরুর বালুকণা ।

আবু জেহেলের দেখাদেখি তার সাথীদের মধ্যেও জেগে উঠে হিংস্র ভাব । তারাও দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপর দুই অসহায় বন্দীর উপর একের পর এক আঘাত হেনে লালে লাল করে দেয় তাদের পবিত্র দেহ ।

খানিক পর শুরু হয় নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। আবু জেহেল বন্দীদের মাটির উপর চিৎ করে শোয়ায় । এ সময় তার সঙ্গীরা তরবারী বর্শা ইত্যাদি আগুনে পোড়ায়ে লাল করে তাদের পিঠে, বুকে মুখে দাগ দেওয়া শুরু করে। সেই সঙ্গে ভারী ভারী পাথর এনে চাপা দেয় বুকের উপর। মুখের উপর রেখে দেয় পানি ভর্তি বড় বড় পানির মশক ।

এ কঠোর সাজার ব্যবস্থা করে আবু জেহেল হাঃ হাঃ হাঃ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। সে হাসির প্রতিধ্বনি নিস্তব্দ মরুভূমি প্রকম্পিত করে তোলে । গাছের পাতাগুলো যেনো থরথর করে কেঁপে উঠে। পাখিগুলো উড়ে উঠে আকাশে ।

হাসির রোল শেষ হলে পাষণ্ড আবু জেহেল বন্দীদের কান্না এবং উহ আহ শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করতে তাকে । কিন্তু মরদে মুমিনদের মুখে একটু বিরক্তি বা কষ্টের ভাবটুকুন পর্যন্ত দেখা গেলো না। নেয়ামতের আশায় আজ যেনো তাদের শরীরের প্রতি কোনো খেয়াল নেই । নেই এ জগতের কোনো কিছুর উপর আগ্রহ কিংবা আকর্ষণ ।

এক সময় মক্কা নগরীর পরিবশেটা ছিল শান্তিপূর্ণ। সারাদেশ পাপাচারে ডুবে থাকলেও পবিত্র কা’বার সম্মানার্থে এখানে তারা মানবতা বিরোধী কোনো কার্যকলাপ করতো না । কিন্তু সেই পবিত্র নগরী আজ আর তেমন নেই। হত্যা, জিঘাংসা, অত্যাচার, উৎপীড়ন আজ সেখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সুমাইয়া, ইয়াসির, আম্মার, বিলাল, খাব্বাব ও সোহায়েল (রা.) সহ আরোও কতিপয় নও মুসলিমের উপর এমন বর্বর ও অমানবিক আচরণ শুরু হলো, যার নজির দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। কুরাইশ গোত্রের কতিপয় লোক মুসলমানদের উপর এ উৎপীড়নকে তাদের খেলার সামগ্রী হিসেবেই গ্রহণ করেছিলো। তারা অত্যাচারিতদের করুণ আর্তনাদ দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। যন্ত্রণায় হা হুতাশ আর ছটফট করতে দেখলে তাদের মন খুশিতে ভরে উঠতো।

জুলুম নির্যাতনের ক্ষেত্রে আবু জেহেলের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তার নির্মম ও নিষ্ঠুর নিপীড়ন দেখে কুরাইশ যুবকেরা পঞ্চমুখে তার প্রশংসা করে বেড়াতো। এতে আবু জেহেল উন্মুক্ত হয়ে অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতো ।

একদিন হারিস ইবনে হিশাম তার বন্ধু ইকরামা ইবনে আবু জেহেলকে বললো, তোমরা তো ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়ার অবস্থা দেখ নি। সে এক মজার ব্যাপার। তার উপর যখন শপাং শপাং বেত্রাঘাত পড়ছিলো, তখন সে কেচোর মতো গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তার মসৃন তেল তেলে শরীরটা চকমক করছিলো। কিন্তু মুখ থেকে তার টু শব্দটি পর্যন্ত বেরুলো না । চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো না এক ফোঁটা অশ্রুও। তোমরা তো দেখ নি, আমরা যখন তাকে ডান দিক থেকে লাথি মারতাম, তখন সে ধড়াস করে বাম দিকে পড়ে যেতো। আবার দাঁড়াবার জন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা মাত্রই কলের পুতুলের মতো সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতো। আবার বেত্রাঘাত পড়তো শপাং শপাং। এভাবে গোটাদিন চেষ্টা করেও তার চোখে পানি বা মুখ হতে একটি কথা বের করতে পারি নি । অথচ আমার ধারণা, বেত্রাঘাতের সাথে ওর দেহের সমস্ত রক্তই বের হয়ে গেছে ।

ইকরামা বললো, আমার নিকট সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হলো, তার বুড়ো স্বামী ইয়াসিরের ব্যপারটা। আব্বুর কোড়ার আঘাতে তার শরীরের সমস্ত মাংস ছিড়ে বের করে আনা হলো । জ্বলন্ত অংগারে ফেলা হলো। পানিতে ডোবানো হলো । তবুও তার দ্বারা আমাদের দেবদেবীর পক্ষে একটি কথাও বের করা সম্ভব হলো না ৷

তার পুত্র আম্মার কিন্তু সমস্ত অত্যাচার অটল অবিচল আর অনড়ভাবে সহ্য করলো। একটু শব্দ করলো না। একটু নড়াচড়াও করলো না। যেন একটা পাথরখণ্ড মাটিতে পড়েছিলো আর কি? কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করলো, তা হলো তার মুচকি হাসি। যত অত্যাচার, যত নির্মমতাই আর প্রতি প্রদর্শন করা হলো, জবাবে সে শুধু এক টুকরো মুচকি হাসিই উপহার দিলো। তার হাসির দৃশ্য বোধ হয় জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এমন অত্যাচারিত হয়ে মানুষ কিরূপে হাসতে পারে তা আমার বুঝেই আসে না। বললো হারিস ইবনে হিশাম ।

একদিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উসমান (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ইয়াসির পরিবারের লোকজনের দূরবস্থা দেখতে পেলেন । এ সময় তাদের হাতে পায়ে লোহার শিকল লাগিয়ে তপ্ত বালুকাময় মরুভূমিতে চিৎ করে শোয়ায়ে বুকের উপর বড় বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো। সেই সঙ্গে একটু পর পর নিষ্ঠুর কাফেরগণ তাদের আগুনে পোড়ানো বর্শা আর তলোয়ারের অগ্রভাগ দিয়ে খোচা মেরে তাদের মুখ দিয়ে দেব দেবীর প্রশংসা বাক্য বের করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু এত চেষ্টা করেও তাদের মুখ থেকে একটা কথা পর্যন্ত বের করতে পারলো না। শাস্তির ভয়, আগুনের দহন, অস্ত্রের আঘাত কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। আল্লাহর ভয় যেনো তাদের অন্তর থেকে সকল ভয় দূর করে দিয়েছে।

এ নির্মম অত্যাচার চলাকালে হঠাৎ হযরত ইয়াসির (রা.) এর দৃষ্টি পড়লো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর । তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পরকালের অবস্থা কি এমনই হবে?

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না হে ইয়াসির পরিবার! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো । বেহেশত তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শেষ হওয়ার পর হযরত সুমাইয়া (রা.) এই প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, হে মহামানব! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল । আমি এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ পাকের ওয়াদা সম্পূর্ণ সত্য ৷

আম্মার (রা.) এর মুখ থেকেও সেদিন প্রথমবারের মতো তারা শুনলো, ওহে আল্লাহর দুশমনরা! যেভাবে ইচ্ছে হয় শাস্তি দাও। আমাদের কোনো পরওয়া নেই । বেহেশত যে আমাদেরই অপেক্ষায় ৷

মুমিনদের এ দৃঢ়তাপূর্ণ উক্তিতে কাফেরদের রাগ আরো চরমে পৌঁছলো । আর সাথে সাথে তাদের উপর নতুন করে এমন নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করলো, যা কলমের দ্বারা ব্যক্ত করা কলমের পক্ষেও দুষ্কর।

কয়েকদিন পর। এক দুপুরে কুরাইশদের সভা বসেছে। বিশেষ জরুরি সভা। আবু জেহেল স্বয়ং এ সভা আহবান করেছে । শুরুতেই আবু জেহেল বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সগর্বে মিথ্যে ভাষণ দিল । বললো, উপস্থিত জনতা! আবু জেহেলের জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। সে আজ সার্থকভাবে নিজেকে দরবারে দাঁড় করাতে পেরেছে। আজ ইয়াসির পরিবারের লোকদের মুখ দিয়ে দেবদেবীর স্বপক্ষে কথা বের করতে পেরেছে। সক্ষম হয়েছে মুহাম্মদকে গাল দেওয়াতে ।

জয়….. লাত ওজ্জার জয় । জয়…… হোবল দেবতার জয় ।

এ সময় উতবা ইবনে রবিয়া দাঁড়িয়ে বললো, না, আবুল হাকাম না । তোমার এ কথা ভিত্তিহীন। উপস্থিত কেউ এমন কথা শুনে নি । ইয়াসির বড় সাংঘাতিক লোক। মরে গেলেও সে এমন কথা বলবে না। এ আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ।

: আমি যদি এর প্রমাণ দিতে পারি? পারি যদি তোমাদের সামনেই তাদের মুখ থেকে দেবদেবীর প্রশংসা বাণী আদায় করতে?

: বাদ দাও আবুল হাকাম, বাদ দাও। ইয়াসির পরিবারের মুখ থেকে ইচ্ছে মতো কথা বের করা, এ কি কোনো চাট্টিখানি কথা? হয়তো নিষ্ঠুরতার নির্মম সাক্ষী হয়ে এরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে । বললো উতবা ইবনে রাবিয়া ।

: আবারও বলছি, যদি পারি?

: তবে আমার পক্ষ থেকে পাবে বিশটি উট পুরস্কার ।

: আমার পক্ষ থেকেও বিশটি । বলল শাইবা ইবনে রবিয়া ।

ঃ কথা ঠিক থাকবে তো?

: অবশ্যই ।

সেদিন আবু জেহেল সঙ্গে সঙ্গে সভা শেষ করে বাজি জিতার লক্ষ্যে ইয়াসির পরিবারের কাছে উপস্থিত হলো। সেদিনকার মতো নির্মম অত্যাচার দুনিয়ার ইতিহাসে এর আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি । সে ছিলো অত্যাচারের এমন এক নির্মম কাহিনী যে কাহিনী লিখতে কলম কেঁপে উঠে। শরীরের লোমকুপে শিহরণ জাগে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়- মানুষ কেন, কোনো পশুর উপরও এ ধরনের হিংস্র আচরণ দেখে কেউ কোনোদিন অশ্রু সংবরণ করতে পারবে না।

আবু জেহেল সেই পঙ্কিল ভূমিতে এসে দেখলো, এক স্থানে গভীর গর্ত খনন করে তা পানি দিয়ে ভরে রাখা হচ্ছে। এক পাশে আগুনের লেলিহান শিখা দাও দাও করে জ্বলছে। লৌহাস্ত্রগুলো লালে লাল করা হচ্ছে আগুনে পুড়ে। আর অপর পাশে হাত পা বাধা অবস্থায় সেই তিন মর্দে মুমিন কর্তিত গাছের মতোই রাস্তার পাশে পড়ে আছে ।

সেখানে এসে হুকুম করা মাত্রই সুমাইয়া, ইয়াসির ও আম্মার (রা.) কে আবু জেহেলের পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলা হলো। সে অসহায় বন্দীদের মুখে তখনো বিরামহীনভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে আবু জেহেল হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাদের শরীরে এলোপাতাড়ি কোড়া মারতে লাগলো। তারপর উত্তপ্ত লোহাস্ত্র দিয়ে সাড়া শরীরে দাগ দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে ধরলো। এতে বন্দীদের শ্বাস বন্ধ হয়ে রক্ত বমি শুরু হলো । অতঃপর পানি থেকে উঠিয়ে কিছুক্ষণ রাখতেই তাদের মুখ থেকে বের হলো- ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ।

আবু জেহেল এবার আরও উম্মাদ হয়ে গেলো। সে সুমাইয়া (রা.) এর নিকট এসে বললো, এভাবেই তোকে মরতে হবে যদি না আমাদের দেব দেবীর প্রশংসা ও মুহাম্মদের কুৎসা তোর মুখ থেকে বের হয় । মনে রাখিস, মুহাম্মদ ও তার ধর্ম না ছাড়লে তোর ভাগ্যে আজ বিকালের দেখাও না জুটতে পারে ।

উত্তরে হযরত সুমাইয়া (রা.) দৃঢ় অথচ কোমল কন্ঠে বললেন, তোর ভণ্ড খোদারা জাহান্নামে যাবে। মৃত্যুই তো আমার সবচেয়ে প্রিয়। মরে গেলে তো কমপক্ষে তোর এ কুৎসিত চেহারা দেখা হতে মুক্তি পাবো ।

সুমাইয়া (রা.) এর কথায় উতবা ও শাইবা হো হা করে হেসে উঠলো। আবু জেহেল পাগল প্রায় হয়ে সুমাইয়া (রা.) এর পেটে সজোরে লাথি মারলো । তিনি লাথির প্রচণ্ড আঘাতে একদিকে ছিটকে পড়লেন । লোকজন আবার তাকে উঠিয়ে এনে আবু জাহেলের পায়ের কাছে রাখলো। পাষণ্ড আবু জেহেল আবারো লাথি চালালো। এভাবে বেশ কয়েকবার চললো। হযরত সুমাইয়া (রা.) ধৈর্যের পাহাড় হয়ে সব অত্যাচার সহ্য করলেন। মুখে বললেন, আল্লাহর দুশমন! তোর মাবুদ জাহান্নামে যাবে ।

উম্মাদ আবু জেহেল আরো উম্মাদ হলো। সে এবার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো এবং এক পর্যায়ে একটি ধারালো বর্শা হাতে নিয়ে হযরত সুমাইয়া (রা.) এর শরমগাহে সজোরে নিক্ষেপ করলো। একটা করুণ আর্তনাদ দুনিয়ার বায়ুমন্ডলে প্রতিধ্বনিত হলো, আল্লাহ! তুমি সাক্ষী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু………। তারপর কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে নীরব হয়ে গেলো হযরত সুমাইয়া (রা.) এর পবিত্র দেহ। ইসলামের ইতিহাসে সোনালী কাহিনী প্রথম লিখিত হলো বীরঙ্গনা সুমাইয়ার (রা.) রক্তে । ইসলামের খাতিরে তিনিই হলেন সর্বপ্রথম শাহাদত বরণকারিণী ।

মায়ের মৃত্যুতে আম্মার (রা.) শোকাহত হয়ে চিৎকার দিয়ে বললেন, রে আবু জেহেল! তুই আমার মাকে জানে মেরে ফেললি? তোর উপর আল্লাহর গজব! তোর মাবুদ জাহান্নামে যাক। আমাদের রাসূল তোর জন্য জাহান্নাম আর আমার শহীদ মায়ের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন ।

ইয়াসির (রা.) বললেন, হে আল্লাহর দুশমন! তুই জাহান্নামের ইন্ধন । নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য………।

আবু জেহেল আর বলবার সুযোগ দিলো না । তার পেটের উপর প্রচন্ড বেগে লাথি চালালো। ফলে ইয়াসির (রা.) এর মুখ দিয়েও বের হলো একটা করুণ চিৎকার- আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসূল………….।

শেষ। তারপর সব শেষ। ইসলামের ইতিহাসে শহীদি রক্তে গোসল করে চির বিদায় গ্রহণ করলেন এক দম্পত্তি ।

প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা! ইসলামের খাতিরে যে সব মহাপ্রাণ পুরুষ ও নারী অপরিসীম দুঃখ যাতনা ভোগ করেছেন হযরত সুমাইয়া বিনতে খাইরাত (রা.) তাদের মধ্যে অন্যতম। স্বামী ইয়াসির ও পুত্র আম্মার (রা.) ও ঐ একই পথের পথিক ছিলেন। তাদের মজবুত ঈমান ও অপরিসীম ধৈর্য সত্যি এক ঈর্ষান্বিত বিষয়। আল্লাহপাক আমাদেরকেও অনুরূপ ঈমান নসীব করুন এবং দীনের জন্য যে কোনো প্রকার কষ্টকে অম্লান বদনে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন । আমীন । সূত্র : আল ওয়াদুল হক ।

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী থেকে সংগ্রহিত।

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment