এরই নাম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন (লোকমান আ. এর গল্প)

কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, হৃদয় গলে সিরিজের শিক্ষণীয় গল্প। গল্পটি হযরত লোকমান আ. এর জীবনের ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে নেওয়া যাতে আছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের দারুন এক উপদেশ বানী। 

হযরত লোকমান (আঃ) এর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের গল্প!

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে হযরত লোকমান (আঃ)-এর আলোচনা এসেছে। তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যক্তি। কেউ কেউ তাঁকে নবীও বলেছেন। নিম্নে তারই জীবন থেকে নেওয়া ছোট্ট একটি শিক্ষণীয় ঘটনা মুসলিম ভাই-বোনদের উপহার দিচ্ছি।

একটি ফলের বাগান। অনেক বড়। কয়েক একর জমিন নিয়ে এর বিস্তৃতি। বাগানের মালিক বেশ পয়সাওয়ালা। বাগানে আসার তেমন একটা সুযোগ হয় না তাঁর। মালিকের কিছু কর্মচারী আছে, মালী আছে। তারাই বাগান দেখাশুনা করে। পানি দেয়। পরিচর্যা করে। আগাছা কেটে পরিস্কার রাখে। ফল গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে হরেক রকমের শাক সবজি

বাগানের মালীদের মধ্যে হযরত লোকমান (আঃ) ছিলেন অন্যতম। অন্যান্য মালীরা তাঁকে মানত, শ্রদ্ধা করত। প্রয়োজনে পরামর্শ নিত। বাগানের ক্ষতি হয় এ ধরণের কাজ থেকে সবাই বিরত থাকত।

বহুদিন যাবত মালিক বাগানে আসেন না। আসার প্রয়োজনও বোধ করেন না। কারণ মালীদের উপর তাঁর প্রচন্ড আস্থা ছিল। ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি মনে করতেন, কখনো তারা বাগানের অনিষ্ট সাধন করবে না। উপরন্তু আমাকে ঠকানোর মতো জঘন্য মনোবৃত্তিও তাদের নেই। তারা সর্বান্তকরণে আমার ও বাগানের কল্যাণই কামনা করে।

একদিন হঠাৎ মালিকের মনে চাইল বাগানটি ঘুরে দেখার। তিনি বাগানে আসলেন। দেখলেন, মালিদের সর্দার লোকমান (আ.) বাগানেই আছেন। ফলের ভারে গাছের শাখাগুল নুয়ে আছে। বাগানের সর্বত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা নেই। মালীদের নিপুণ হস্তের ছোঁয়ায় গোটা বাগান একটি দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ অভাবনীয় চমৎকার দৃশ্য মালিককে খুবই মুগ্ধ করে।

কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটা হাঁটির পর মালিক একখানা গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। তাঁর মাথার উপর তখন তাজা ফল ঝুলছে। আর খানিক দূরে রয়েছে কাকড়ী নামক মজাদার সবজি। বড়ই অপরূপ সে দৃশ্য!

মালিক কতক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তারপর হযরত লোকমান (আ.) কে ডেকে বললেন, হাঁটতে হাঁটতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাকে একটি কাকড়ি খাওয়াও। (কাকড়ি হল এক প্রকার সুস্বাদু সবজি যা দেখতে অনেকটা শসার মতোই তবে একটু চিকন ও বেশ লম্বা) হযরত লোকমান (আ.) দ্রুত নির্দেশ পালন করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একখানা কাকড়ি এনে মালিকের হাতে দিলেন।

আজ মালিকের মনে নিজের বাগানের কাকড়ি নিজেই কেটে খাওয়ার সাধ জাগল। তাই মালীদের কাউকে তা কাটতে দিলেন না। নিজেই কেটে টুকরো টুকরো করে সর্বপ্রথম এক টুকরো কাকড়ি লোকমান (আ.) কে খেতে দিলেন।

হযরত লোকমান (আ.) কাকড়ির টুকরোটি সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং মুখে দিয়ে সশব্দে মজা করে খেতে লাগলেন। মালিক তাঁর খাওয়া দেখে ভাবলেন, হয়তো এ কাকড়িটি বেশ মিষ্টি ও মজাদার হবে। তাই তিনিও  দেরি না করে এক টুকরো মুখে দিলেন।

কাকড়ির টুকরো মুখে দেওয়ার সাথে সাথে মালিকের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তাঁর সুন্দর দীপ্ত মুখমন্ডল ছেয়ে গেল কালো অন্ধকারে। কারণ এ কাকড়িটি ছিল বড়ই তিক্ত ও স্বাদহীন।

মালিক অবাক হলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, লোকমানের খাওয়া দেখে বুঝা গেল, কাকড়িটি বেশ মজাদার হবে। কিন্তু আমার নিকট তো খুবই তিক্ত লাগল।

লোকমান (আ.) মালিকের মনোভাব বুঝতে পারলেন।  বললেন, হুজুর! কি হয়েছে? কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

: অসুবিধা হচ্ছে না মানে? আমার তো পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বের হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

: কেন? কি হয়েছে আপনার?

: লোকমান! জীবনে আমি অনেক সবজি খেয়েছি। কিন্তু এমন তিক্ত ও বিস্বাদ সবজি কখনোই বোধ হয় খাই নি। অথচ তোমাকে দেখেছি, সেই সবজিরই এক অংশ বেশ মজা করে খেয়েছ। ঘটনা কি বুঝলাম না। তবে কি একই জিনিসে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ! নাহ! তাও তো হতে পারে না। আসল ব্যাপারটা খুলে বল তো।

: হুজুর! ব্যাপার মূলতঃ কিছুই নয়। একই সবজিতে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ কেন আসবে? আসলে আপনার টুকরোটি যেমন তিক্ত ছিল আমার টুকরোটি তাই ছিল।

: তবে কেন তুমি বললে না যে, এটা ভীষণ তেতো।

: জনাব! আমি বলতাম। বলার জন্য তৈরিও হয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, যে খোদার পক্ষ থেকে জীবনে হাজারো মিষ্টি ও সুস্বাদু জিনিস লাভ করেছি, সেই খোদার পক্ষ থেকে যদি গোটা জীবনে দু’একবার তিক্ত বস্তু পাই তবে সে ব্যাপারে অভিযোগ করা কি শোভনীয় হবে?

সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! হযরত লোকমান (আ.) এর এই জ্ঞানগর্ভ জবাবে আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। শুধু এই একটি কথার উপর যদি মানুষ আমল করতে পারত, তবে গোটা দুনিয়ার অশান্তির তীব্রতা অনেকটাই কমে যেত। পরিবার, দেশ তথা সমগ্র বিশ্ব জুড়ে প্রবাহিত হত শান্তির ফল্পুধারা।

যেমন, দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী যদি মনে করে যে আমার ভরণ পোষণের জন্য স্বামী কত কষ্ট স্বীকার করেন, আমার কত মান অভিমান সহ্য করেন তিনি। সুতরাং মাঝে মধ্যে একটু আধটু কঠোর ব্যবহার করলে তেমন কি আসে যায়? তেমনি যদি স্বামীও ভাবে যে, স্ত্রী আমার কত সেবা করে, আমার জন্য রান্না করে, আমার কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়, বিপদে আপদে সান্ত্বনা প্রদান করেন করে, সুতরাং দু’একবার যদি সে আমার মন বিরোধী কোন কথা বলেও ফেলে, তাতে এমন কি আসে যায়?

অনুরূপভাবে কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা যদি মালিকের পক্ষ থেকে দুচারটি শক্ত কথার সম্মুখীন হয়, আর তারা মনে করে যে, মালিক তো সব সময় আমাদের আদর করেন, খোঁজ খবর নেন, বিপদে-মুসিবতে সাহায্য সহযোগিতা করেন, তবেই তো মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে না। এমনিভাবে মালিকও যদি মনে করে যে, এসব কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই তো আমি আজ বড়লোক, আমার আজ গাড়ি-বাড়ি হয়েছে, জায়গা জমিন হয়েছে। সুতরাং মাঝে মধ্যে দু একজন কর্মচারী যদি একটু উল্টাপাল্টা করে ফেলে কিংবা কোন জিনিস অসতর্কতার দরুন নষ্ট করে ফেলে তবে এমন কি আসে যায়? তারা আমার বড় মুহসেন-বড় উপকারী। সুতরাং তাদের সামান্য অসদাচরণ যদি বরদাশ করতে না পারি, তবে আমি কিসের কৃতজ্ঞ হলাম!

মুহতারাম পাঠক! আসুন, হযরত লোকমান (আ.) এর এ ছোট্ট মূল্যবান কথাটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি এবং তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি। হে আল্লাহ! তুমি তাওফীক দাও। আমীন। গল্পের সূত্র : পছন্দীদাহ ওয়াকিয়াত।

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। হৃদয়স্পর্শী শিক্ষণীয় কাহিনী (হৃদয় গলে সিরিজ ১২) বই থেকে।

এরপর পড়ুন : ভয়ংকর সাপ (কবরের আজাবের গল্প ১)

হৃদয় গলে সিরিজের আরও গল্প!

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আপনি যদি হৃদয় গলে সিরিজের গল্প পড়তে ভালোবাসেন তাহলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন গল্পটি পাশাপাশি হৃদয় গলে সিরিজের অন্যান্য শিক্ষণীয় গল্প সমূহ পড়তে পারেন। গল্পগুলি নিচে তুলে ধরা হলো:

01. সবচেয়ে বড় পাপ (শিক্ষণীয় গল্প)

02. ব্যথিত হৃদয় (ইসলামিক উপন্যাস ১)

03. এক বর পাগল নারীর শিক্ষণীয় গল্প | bangla life story

04. কল্যাণকামী স্বামী (একজন ভালো স্বামীর গল্প)

05. অবাধ্য স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গল যেভাবে | husbend wife love story

06. স্ত্রীকে ক্ষমা করার পুরস্কার

07. এক নির্যাতিতা স্ত্রীর ফরিয়াদ : একটি ঘটনা।

08. ভাগ্য ভালো কার? ( এক বদমেজাজী স্ত্রীর গল্প)

09. বাংলার এক মহিয়সী নারী (পতিপ্রাণা স্ত্রীর গল্প)

10. দুই রমনীর হৃদয়স্পর্শী কাহিনী (ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া ঘটনা)

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা লেখকের এরই নাম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন শিক্ষণীয় গল্পটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে। এটি শেয়ার করতে ভুল করবেন না। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment