মায়ের অভিশাপ : সন্তানের করুণ পরিণতি গল্প

যারা মাকে কষ্ট দেন, মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করেন কিংবা রাগের বশত মায়ের গায়ে হাত তুলেন তারা মায়ের অভিশাপের করুণ পরিণতির সম্পর্কে একটু ভাবুন। কারণ আপনার খারাপ আচরণের কারণে যদি আপনি একবার আপনার মায়ের অভিশাপ পেয়ে যান তাহলে এই অভিশাপের করুণ পরিণতি আপনাকে ভোগ করতে হবে। কারণ, মায়ের দোয়া কিংবা বদদোয়া দু’টিই আল্লাহর দরবারে দ্রুত কবুল হয়ে যায়। দুনিয়াতে মায়ের দোয়ায় সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কিংবা মায়ের অভিশাপে সন্তানের করুণ পরিণতির বহু দৃষ্টান্ত আছে। তেমন এক দৃষ্টান্ত হচ্ছে নিচের এই গল্প টি…

গল্প : মায়ের অভিশাপে সন্তানের করুণ পরিণতি!

মা নাই গৃহে যার, সংসার  অরণ্য তাঁর। দেখিলে মায়ের মুখ, মুছে যায় সব দুঃখ।

উপরি উক্ত চরণ ক’টি কোথায় যেন দেখেছিলাম তা ঠিক মনে পড়ছে না। তবে একথা স্পষ্ট স্মরণ আছে যে, কোন এক বাসায় সুন্দর একটি বাঁধানো ফ্রেমে দেয়ালে তা টানানো অবস্থায় ছিল। প্রকৃত পক্ষে সন্তানের জন্য মা এক পরম সম্পদ এটি চিরন্তন সত্য কথা। তবে একথা বোধ হয় ঐ ব্যক্তিই হাড়ে হাড়ে টের পায় যার মা নেই। কিংবা থাকলেও কোন কারণে তাঁর স্নেহ বঞ্চিত। মা না থাকলে সংসার অরণ্যই বটে। মায়ের স্নেহের ছায়ায় লালিত পালিত সন্তান হঠাৎ করে যদি মা হারা হয় তখনই সে বুঝতে পারে মায়ের স্নেহ-ভালবাসার মূল্য। বুঝতে পারে মায়ের আদরের ডাক তাঁর কত প্রয়োজন। অনুভব করতে পারে মায়ের স্নেহ-মমতা শত কোটি অর্থ লাভের চাইতেও উত্তম।

মুহতারাম পাঠক পাঠিকা! আপনারা জানেন যে, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। অনুরূপভাবে আপনারা হয়তো এ কথাও জানেন যে, পিতা-মাতার দুআ সন্তানের জন্য যেমন সরাসরি কবুল হয় তেমনি তাদের বদদুআও কবুল হতে সময় লাগে না। নিম্মে এ ধরণের একটি মর্মস্পর্শী বাস্তব ঘটনাই উল্লেখ করা হচ্ছে, যা পাকিস্তানের মাওলানা আব্দুশ শুকুর দ্বীনপুরী (রহঃ) এর সূত্রে মাওলানা ক্বারী আমীরউদ্দিন সাহেব বর্ণনা করেছেন।

মাওলানা বলেন, একদিন আমি বাজারে গেলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলাম। বাড়িতে বেশ তাড়া ছিল। তাই দেরি না করে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম।

মায়ের অভিশাপ - মা।আমি দ্রুত হাঁটছিলাম। কতক্ষণে বাসায় ফিরব সে চিন্তায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কোন দিকে খেয়াল ছিল না আমার। কিন্তু হঠাৎ একটি বিকট আওয়াজে আমি থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। দেখলাম, একটি ভিক্ষুক আমাকে উচ্চস্বরে ডাকছে। তাঁর মুখমন্ডল ছিল ফ্যাকাশে বিবর্ণ। বারবার জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুখানা চেটে নিচ্ছে। জীর্ণ শীর্ণ কংকালসার দেহে গোশত নেই বললেই চলে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

বাড়িতে জরুরি কাজ থাকায় আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আবারো চিৎকার করে আমাকে ডাকল। বললো, হুজুর, অনুগ্রহ করে একটু কথা শুনুন। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা চাইবো না। শুধু একটু দুআ প্রার্থনা করব।

ভিক্ষুকের কথায় আশ্চর্য হলাম। হাতে মোটেও সময় নেই। তথাপি তাঁর করুণ আহ্বানে হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হল। মনে মনে বললাম, একজন অসহায় লোক একটি কথা বলার জন্য আমাকে ডাকবে, আর আমি কিনা স্বার্থপরের মতো পাশ চলে যাব এ তো হতে পারে না। এটা তো মুসলমানের আখলাক নয়।

আমি তাঁর কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বাবা! এমন করছ কেন?

সে বলল, হুজুর! জীবনের এক হৃদয়স্পর্শী কাহিনী আপনাকে শুনাতে চাই। সেই সাথে কামনা করি আপনার হৃদয় নিংড়ানো দুআ। আপনার কি একটু সময় হবে?

: বাড়িতে আমার জরুরি কাজ। এখনই যাওয়া দরকার। তারপরেও তোমার জীবন কাহিনী না শুনে যাব না। বল, বল কি বলতে চাও তুমি।

আমার কথায় লোকটি বেশ খুশি হল। একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল তাঁর ঠোঁটের কোণে। সে বলতে লাগল-

হুজুর! আমি এক সময় ছিলাম মহা সম্পদশালী। আল্লাহ তাআলার অফুরন্ত নেয়ামতরাজির প্রাচুর্যে আমি ছিলাম পরিতৃপ্ত। ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা ও বিলাস সামগ্রীসহ সুখ শান্তির কোন উপকরণেরই অভাব ছিল না আমার। কেবল অভাব ছিল একটি জিনিসের। আর তা হল, উত্তম আখলাক। সচ্চরিত্র।

হজুর! আমার আমল ভাল ছিল না। সর্বদা শরাব-কাবাবে মত্ত থাকতাম। যখন যা খুশি তাই করতাম। প্রায়ই নেশার ঘোরে মাতাল হয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতাম। অধিকাংশ রাতে অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরতাম। তখন দেখতাম, আমার একমাত্র মা জননী ছাড়া সবাই গভীর নিদ্রায় অচেতন। রাত যত বেশিই হউক না কেন, আমার স্নেহময়ী মা কখনোই আমি না আসা পর্যন্ত বিছানায় যেতেন না। দরজার কাছে বসে আমার অপেক্ষায় থাকতেন। আমি এলে আমাকে দেখে বলতেন—বাবা! তুমি এত বিলম্ব করে বাড়ি আস কেন? তোমার এ বিলম্ব আমাকে অস্থির করে তুলে। এ অস্থিরতার কষ্ট প্রতিদিনই আমাকে সহ্য করতে হয়। আগামীকাল থেকে সকাল সকাল বাড়ি ফিরে আসো।

মায়ের কথার জবাবে আমি কিছুই বলতাম না। শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়তাম। মা আমাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন। কিন্তু বেশীর ভাগ সময় কিছু খাওয়ার রুচি থাকতো না।

লোকটি এতটুকু বলে একটু জিরিয়ে নিল। তারপর সে বলতে শুরু করল আসল ঘটনা। সে বলতে লাগলো—

এক রাতে আমি বন্ধু-বান্ধবের সাথে নেশায় মত্ত ছিলাম। ঐ রাতে অন্য সময়ের তুলনায় বাসায় ফিরতে বেশ দেরি হল। এতটা দেরি করে কখনোই আমি বাসায় ফিরিনি। এদিকে মায়ের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তিনি আমার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত বিনিদ্র বসে রইলেন। বারবার তিনি দরজা খুলে বাইরে আসেন। পথপানে চেয়ে থাকেন। কিন্তু আমার আসার কোন নাম গন্ধ নেই। এতে ক্রমেই মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তিনি ভীষণ রাগ করলেন। মনে মনে বললেন, আজকে বাড়ি এলে তাকে দু’চার কথা শক্ত করে বলব। প্রয়োজনে গায়ে হাত উঠাব।।

যেই কথা সেই কাজ। আমি বাসায় ফেরার সাথে সাথে আম্মা আমাকে বকাঝকা করলেন। এমনকি এক পর্যায়ে রাগের মাথায় আমার পিঠে একটি থাপ্পর মারলেন। বললেন—

এত রাতে বাসায় ফিরলে তোমার মায়ের যে কষ্ট হয় তা তুমি বুঝ না? কেন তুমি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ?

মায়ের রাগ দেখে আমার মধ্যেও রাগ এসে গেল। তদুপরি আমি ছিলাম মাতাল। তাই মায়ের চপেটাঘাত ও বকাঝকা খেয়ে আমি ঠিক থাকতে পারলাম না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ফলে সাথে সাথে পা থেকে জুতা খুলে মায়ের মাথায় ছুঁড়ে মারলাম। এতটুকু চিন্তা করলাম না যে, আমি কার সাথে কি করছি।

আমার এ অমানবিক আচরণে মায়ের রাগ চরমে উঠল। তিনি লজ্জায় অপমানে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। তারপর ছোট্ট শিশুটির মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে হাত দুখানা উপরে তুলে খোদার দরবারে বদদুআ করলেন। বললেন, হে খোদা! আমার সাথে আমার সন্তান যে দুর্ব্যবহার করছে তা তুমি ভাল করে দেখেছ। ওগো রহমানুর রহীম! তুমি এর বিচার করো। সবশেষে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোর সর্বনাশ হউক, তোকে পোকায় খাক।

এ ঘটনার পর আমার মা বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। এক বুক দুঃখ নিয়ে কবর জগতে পাড়ি জমালেন। আমি ইচ্ছা করলে তা কাছ থেকে ক্ষমা নিচে নিতে পারতাম। পারতাম হাতে পায়ে ধরে তাকে খুশি করতে। মা জননী হয়তো সেটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমি তা করি নি। একটি বারও মায়ের সম্মুখে গিয়ে বলিনি—মা! আমার ভুল হয়েছে। আমার ক্ষমা করে দাও।

মায়ের দুআ অক্ষরে অক্ষরে কবুল হয়েছিল। কিন্তু কখনোই এর পরিণতির কথা চিন্তা করি নি আমি। ভাবতে পারি নি মায়ের বদদুআর ফল এতটাই নির্মম, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক হবে।

মা চলে যাওয়ার পর পরই আমার পায়ে একটি বিশাল আকৃতির ফোড়া দেখা দেয়। এত বড় ফোড়া কেউ কোন দেখে নি। এর প্রচন্ড ব্যথায় সর্বদায় আমি অস্থির থাকতাম। খাওয়া-নাওয়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় কোন কাজ করাও সম্ভব ছিল না। কোন কোন সময় ব্যথার মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেত যে, আমি বেহুঁশ হয়ে যেতাম। কখনো কখনো ষাঁড়ের চিৎকারের মতো চিৎকার দিয়ে উঠতাম।

ইতোমধ্যে বড় বড় ডাক্তার দেখানো হয়েছে। নামকরা স্পেশালিষ্টরা অবিরত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফলাফল একেবারেই শূন্য। কিছুদিন পর ফোড়ার ক্ষতস্থানে  বড় বড় পোকা দেখা গেল। পোকাগুলো আমাকে নির্মমভাবে কামড়াতো। এমন অচেনা অজানা পোকাও আমরা কোন দিন দেখি নি। কত ঔষধ দেওয়া হল, কত ইনজেকশন পুশ করা হল, কিন্তু পোকাগুলো মারা সম্ভব হল না। শুধু তাই নয়, সময়ের তালে তালে পোকার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। কোন কিছু দিয়েই এগুলোকে দমানো গেল না।

আমাকে দেখার জন্য যে কোন লোক আসতো তাকেই আমি বলতাম, ভাই! টাকা যা লাগে নাও। আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য চেষ্টার কোন ক্রটি করে নি। এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ও কবিরাজী চিকিৎসাসহ সব চিকিৎসাই তারা করেছে। খরচ করেছে লক্ষ লক্ষ টাকা। কিন্তু ফল কিছুই হল না। দিন দিন কেবল অবস্থার অবনতি বৈ উন্নতি ঘটল না।

কয়েক মাস চিকিৎসার পর ডাক্তাররা বললেন, আমাদের যতটুকু চেষ্টা করার তা আমরা করেছি। এখন লন্ডনে নেওয়া ছাড়া আপনার আর কোন উপায় দেখছি না।

আমি আমার আত্মীয় স্বজনকে ডেকে বললাম, শুধু লন্ডন কেন, ডাক্তাররা পরামর্শ করে যেখানেই আমাকে নিয়ে যেতে বলেন সেখানে নিয়ে যাও। প্রয়োজনে আমার সহায় সম্পত্তি সব বিক্রি কর। তবু তোমরা আমাকে সুস্থ করে তোল।

আমি লন্ডন গেলাম। পুরোদমে চিকিৎসা চলল। সেখানকার খ্যাতনামা ডাক্তারগণ বহুদিন পর্যন্ত চিকিৎসা করে শেষ পর্যন্ত তারাও ব্যর্থ হলো। পরিশেষে তারা আমাকে জানাল আপনার এ রোগ চিকিৎসার বাইরে। আমরা এর কিছুই করতে পারব না। অবশেষে আমি নিরাশ হয়ে নিজ দেশে ফিরে আসি।

যখন আমি দেশে ফিরি তখন আমার রোগের বয়স পাঁচ বছর। দীর্ঘ এই পাঁচ বছরে চিকিৎসার পিছনে আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। কিছু কিছু সম্পত্তি অন্যেরা নিয়ে গেছে জবরদখল করে। যেদিন আমি নিজ গ্রামে পৌঁছলাম সেদিন আমাকে শোয়ানোর মত নিজস্ব কোন জায়গাও ছিল না। তাই হাঁটাচলা করার মতো সুস্থ হওয়ার পর জীবন বাঁচানোর জন্য ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকল না।

আজ অনেক দিন হল আমি ভিক্ষা করি। এখনো আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। বেশ কিছু পোকা অবিরত আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। যখন সহ্য করতে পারি না তখন রাস্তার কিনারে বসে পড়ি। আর আপনাদের মতো হজুর মাওলানাদের কাছে দুআ প্রার্থনা করি।

হুজুর! আমি একশ ভাগ বিশ্বাস করি, মায়ের বদদুআর ফলেই আজ আমার এ করুণ অবস্থা। জানি না, আমার এ অবস্থা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাই আপনার নিকট আমার বিনীত নিবেদন, আমার জন্য একটু দুআ করবেন। আল্লাহপাক যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন এবং মায়ের বদ দুআ থেকে যেন আমি রক্ষা পাই।

প্রিয় পাঠক! উপরের বিবরণ থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার বুঝা যায় যে, মমতাময়ী মায়ের সাথে বেয়াদবি করে এবং তাঁর মনে ব্যথা দিয়ে তাঁর বদদুআ কুড়ানোর ফলেই আজ তাকে এহেন ভয়াঙ্ক ও দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

তাই আসুন! আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আমরা আর কখনোই পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিব না। তাদের সাথে সদাচরণ করব এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাদের খেদমত করে যাব। হে দয়ার আধার রাহমানুর রাহীম! তুমি তোমার অপরিসীম করুণায় আমাদের প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবায়ন করার তাওফীক দাও। আমীন। গল্পের উৎস  : মাসিক খতমে নবুওয়াত (উর্দু)

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বই : হৃদয়স্পর্শী শিক্ষণীয় কাহিনী (হৃদয় গলে সিরিজ ১২)

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment