অবাধ্য স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গল যেভাবে | husbend wife love story

লেখক এক অবাধ্য স্ত্রীর জীবনের ভুল শোধরানোর গল্প বলেছেন। কিভাবে স্বামীর অবাধ্য স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গলো তা জানতে আসুন আমরা অবাধ্য স্ত্রীর ভুল শোধরানোর গল্পটি পড়ি! 

অবাধ্য স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গল যেভাবে।

অবাধ্য স্ত্রীর ( স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প)এক অবাধ্য স্ত্রী। নাম রাজিয়া। বয়স বাইশ। গোলগাল চেহারা। স্বাস্থ্যও ভালো। তবে দেমাগী। তার গোটা অস্তিত্বে যেন অহংকার খেলা করে।

রাজিয়ার স্বামীর নাম রফীক। বছর পাচেঁক আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। রাজিয়া তার স্বামীকে একদম মানে না। তার কোনো কথা শুনে না। স্বামী যা বলে তার উল্টোটাই করতে অধিক পছন্দ করে সে। আজ পর্যন্ত সে স্বামীর কোনো খেদমত করেনি। তার অভিধানে যেন খেদমত, সেবা এবং এ জাতীয় কোনো শব্দই নেই! সে সর্বদা স্বামীকে কষ্ট দেয়। পিতার অগাধ সম্পত্তির কারণে অহংকার বশতঃ তার পা দুটো যেন মাটিতে পড়তে চায় না। সে সর্বদা দেমাগ দেখিয়ে চলে। কারণে অকারণে নিজের বড়ত্ব জাহির করে। স্বামীকে কথায় কথায় খোঁটা দেয়। স্বামীকে অসম্মান ও অপমান করার জন্য যত পথ ও পন্থা আছে, তার সবই সে ব্যবহার করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো, এসব করেও যেন তার সাধ মিটে না। সে আরো নতুন নতুন পথ ও পন্থায় স্বামীকে আঘাত করতে চায়। আরো আশ্চর্যের কথা হলো, এসবের জন্য একদিনও সে অনুতাপ অনুশোচনা করেনি। কোনোদিন তার ভুল স্বীকার করেনি।

রাজিয়ার রাতের স্বপ্ন ১!

একরাতে রাজিয়া পরপর দু’বার স্বপ্ন দেখে। এবং এ স্বপ্ন দুটোই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! রাজিয়া কী স্বপ্ন দেখেছিল এবং কীভাবে তার জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছিল সেকথা চলুন তার মুখ থেকেই শুনি-

সেদিন আমার মন-মেজাজ একদম ভালো ছিল না। নানারকম দুশ্চিন্তায় অস্থির ছিলাম। গোটা পৃথিবী তখন নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। চারিদিক নীরব-নিস্তব্ধ। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। বারবার এপাশ ওপাশ করছি। কত গভীর রাত পর্যন্ত এভাবে কাটিয়েছি তা ঠিক বলতে পারব না, তবে আমার অনিদ্রার সঙ্গী হওয়ার জন্য তখন যে শুধু নিশাচর প্রাণীরা ছাড়া আর কেউ জেগে ছিল না তা জোরই দিয়ে বলতে পারি। তারপর সেই চিন্তিত মন নিয়ে কখন যে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছি তাও বলতে পারব না।

ঘুমের ঘোরে আমি এক স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতে লাগলাম। আমি দেখলাম, ফুলে ফলে সুশোভিত অসম্ভব সুন্দর এক বাগান। মৃদুমন্দ বায়ূ প্রবাহ গোটা পরিবেশটাকে স্নিগ্ধ –শীতল করে রেখেছে। নানারকম ফুলের মিষ্টি সুবাসে চারিদিক মৌ মৌ করছে। বাগানে আরাম-আয়েশ আর আনন্দ উপভোগের কত যে উপকরণ রয়েছে তা বলে শেষ করতে পারব না। সে এক মনোহর দৃশ্য!

চারিদিকে চপলা-চঞ্চলা নারীরা ঘুরে ঘুরে বসন্তের স্বাদ আস্বাদন করছে। হাসি-খুশি আর প্রাণোচ্ছলতায় চারিদিক মাতিয়ে তুলছে। হঠাৎ একটি বিশাল আকৃতির গেইটের উপর নজর পড়ল। সবাই সেই গেইট দিয়ে বাগানে ভিতরে প্রবেশ করছে। আমিও বাগানে প্রবেশের জন্য গেইতের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম, সেখানে উন্মুক্ত তরবারী হাতে বলিষ্ঠ এক দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন বাগানে প্রবেশ করতে চাইলাম, তখনই ঐ দারোয়ান আমার নিকট টিকেট চাইল।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে প্রবেশ করার জন্য কি টিকেটের প্রয়োজন হয়? দারোয়ান বলল। হ্যাঁ, এখানে বিনা টিকেটে কারো প্রবেশের অনুমতি নেই।  আমার তো টিকেট নেই। আচ্ছা বলুন তো টিকেটের মূল্য কত? এ বলে আমি টাকা বের করার জন্য ব্যস্ত হলাম।

ঠিক তখনই দারোয়ান বলে ওঠল, মুহতারামা! এখানে টাকা দিয়ে টিকেট পাওয়া যায় না। এখানে টিকেটের জন্য প্রয়োজন হয় অন্য কিছুর। সে আবার কি? সব জায়গায় টিকেট কিনতে হয় টাকা দিয়ে। আর এখানে টিকেট কিনতে হয় অন্য কিছু দিয়ে। এটা তো বুঝলাম না।

হ্যাঁ, এখানে অন্যকিছু দিয়েই টিকেট কিনতে হয়। টাকা পয়সার লেনদেন এখানে চলে না। তা সেই ‘অন্য কিছুটা কি তা জানতে পারি? এজন্য আপনাকে একটি সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে। এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে আপনি যে কোনো সময় এই বাগানে প্রবেশ করতে পারবেন।

দারোয়ানের কথা শুনে আমি আগেই বিস্মিত হলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে? দারোয়ান এবার অতীব বিনয়ের সাথে বলল, মুহতারামা! আপনাকে এখানে নতুন মনে হচ্ছে। এখানকার কোনো নিয়ম-কানুন আপনার জানা নেই। শুনুন, যিনি এই বাগান প্রবেশ করতে চান তিনি যদি পুরুষ কিংবা অবিবাহিতা নারী হন তবে তার পিতা-মাতার সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। আর বিবাহিতা নারী হলে তার জন্য প্রয়োজন হয় স্বামীর সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেট দেখানো ব্যতিত কারো পক্ষেই বাগানে প্রবেশ করা সম্ভব হয় না। আমি বিবাহিতা নারী। আমার কাছে তো স্বামীর সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট নেই। তবে পিতা-মাতার সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট আছে। এই সার্টিফিকেট দিয়ে কি আমি প্রবেশ করতে পারব না? প্রশ্ন করে আমি একবুক আশা নিয়ে দারোয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখের তাকিয়ে রইলাম।

কিন্তু দারোয়ান আমাকে নিরাশ করে দিয়ে বলল-না মুহতারাম! বিবাহিতা নারীর জন্য স্বামীর সন্তুষ্টির সার্টিফিকেটই লাগবে। এর কোনো বিকল্প চলবে না। দারোয়ানের কথা শুনে আমি হতাশায় ভেঙ্গে পরলাম। লজ্জায় আমার গোটা দেহ ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে কী আর করা! মনের দুঃখ মনে নিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে বাগানে প্রবেশকারী আনন্দ – উচ্ছল নারী-পুরুষদের দিকে এক দৃষ্টি তাকিয়ে রইলাম। এভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ দেখলাম,আমার বান্ধবীরাও সহাস্য কলকাকলিতে মুখরিত অবস্থায় বাগানে প্রবেশ করছে। এই দৃশ্য আমার গোটা হৃদয়টাকে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। আর বারবার আফসোস করে বলতে লাগলাম! হায় আল্লাহ! এই লজ্জা, এই অপমানই কি আমার কপালে ছিল!! যদি এখন ভূপৃষ্ঠের মাটি ফাঁক হতো তাহলে উহাতে আত্মগোপন করে এই অপমান থেকে নিজেকে রক্ষা করতাম।

আমাকে এভাবে পথের পাশে দুরবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার কয়েক জন বান্ধবীর মনে দয়ার উদ্রেক হলো। তাদের একজন বলল, চলো। ভিতরে চলো। এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখান থেকে তো বাগানের ভেতরের সৌন্দর্য একশ ভাগের একভাগও দেখা যায় না। আমি বললাম, ভিতরে কিভাবে যাব? আমার তো স্বামী – সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট নেই।

আমার কথা শুনে অবাক হলো সে এবং আফসোস করে বলতে লাগল, স্বামী – সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট ছাড়া তো বাগানে প্রবেশের কোনো অনুমতি নেই। এখানে কারো সুপারিশও চলে না। যদি চলতো তাহলে তোমাকে সুপারিশ করে অবশ্যই নিয়ে যেতাম। কিন্তু এখন তো আমাদের কিছুই করার নেই। এ বলে আমাকে আপন স্থানে রেখে তারা ভিতরে চলে গেল।

এবার আমার অনুতাপ-অনুশোচনা আরো বৃদ্ধি পেল। চোখে অশ্রুর জোয়ার এল। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল। বারবার মন বলতে লাগল- হায়, আজ যদি আমার কাছে স্বামী-সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট থাকত তাহলে সবার মতো আমিও ঐ বসন্ত –বাগানে প্রবেশ করে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে পারতাম। যদি আমি স্বামীর খেদমত ও তার সাথে সদাচরণ করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারতাম তাহলে আজকে আমাকে এই অপমানকর পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হতো না।

এসব কথা চিন্তা করতে করতে আমার পেরেশানী ও অস্থিরতা যখন চরমে পৌঁছল ঠিক তখন দূর থেকে একটি আওয়াজ শুনা গেল-রাস্তা ছাড়ো, রাস্তা ছাড়ো, সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও!

আওয়াজ লক্ষ্য করে সেদিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, একটি রাজকীয় বাহন এদিকে আসছে। তাতে উপবিষ্ট আছে অপরূপ সাজে সজ্জিতা এক সৌন্দর্যের  রাণী। বাহনের সামনে থেকে বেশ কয়েকজন প্রহরী হাতের ইশারায় রাস্তা পরিস্কার করে দিচ্ছে।

আর পথের দু’পাশে দন্ডায়মান লোকজন পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে তাকে সালাম করছে। গেইটে আসার পর বাহন থেকে নীচে অবতরণ করে মহিলাটি সোজা বাগানের ভিতরে চলে গেল।

আমি দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম, এই সম্মানিতা মহিলাটি কে?

জবাবে সে বলল, ইনি একজন পতিপরায়ণা নারী। স্বামীর সাথে কোমল আচরণ,নম্র ব্যবহার, সর্বোপরি তার খেদমত করে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রবাদতুল্য। আট বছরের দাম্পত্য জীবনে কোনোদিন তিনি স্বামীকে কষ্ট দেননি। তার মনে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলেন নি। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কখনো বাড়ীর বাইরে যাননি। স্বামী অপছন্দ করেন এমন কোনো কাজ ইচ্ছে  করে করেন নি। স্বামী কী করে খুশী হবেন, খুশী থাকবেন সে চিন্তাই তিনি সর্বদা ব্যস্ত করতেন। তার আদেশ-নিষেধ গুলো অক্ষরে পালন করতেন। মোটকথা স্বামীর আনুগত্য ও ফরমাবরদারী করে তিনি তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছেন। যার ফলে তার স্বামীও তার জন্য সর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণের দোয়া করেন। স্বামীর নজিরবিহীন আনুগত্য এবং তার দোয়ার বদৌলতেই তিনি আজ এত মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন।

দারোয়ানের কথাগুলো আমার হৃদয়ে তীরের ন্যায় আঘাত করল। কারণ দাম্পত্য জীবনে স্বামী কে আমি মোটেও সুখী করতে পারিনি। কথায় কথায় তার সাথে ঝগড়া করেছি। তর্ক করেছি। মুখের উপর কথা বলেছি। তার কোনো আদেশ-নিষেধ পালন করিনি। তার সাথে মেজাজ দেখানো ছিল আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। আর এসব করতে করতে একদিন আমি ক্রোধের মাথায় পিত্রালয়ে চলে এসেছিলাম। আমার কথা ছিল, সে যখন আমাকে কোনো খাতির তোয়াজ করেনি, তাহলে আমি কেন তাকে সম্মান করতে যাব? তার চেয়ে আমি কম কিসে? আমি তো তার দাসী-বাঁদী নই যে, তার খেদমত করতে হবে। আমার ব্য্যভার বহন করার মতো যথেষ্ট স্বচ্ছলতা আমার পিতা-মাতার আছে। তবে কেন আমি তার নিকট ছোট হয়ে থাকব?

কিন্তু আজকে এই মহিলার অভূতপূর্ব সম্মান ও অপূর্ব শান-শওকত দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল, দুঃখে-কষ্টে আমার প্রাণপাখি যেন খাঁচা ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসবে। মহিলাটির প্রতি আমার দারুণ ঈর্ষা হতে পাগল। আর নিজের কৃতকর্মের জন্য হতে লাগল কঠিন অনুশোচনা।

বারবার মনে হতে লাগল, কেন আমি স্বামীর খেদমত করিনি? কেন আমি তার আনুগত্য করিনি?কেন তার কথা শুনিনি। কেন তাকে শান্তি দেইনি? কেন তাকে ভক্তি – শ্রদ্ধা করিনি। যদি করতাম, তবে তো আজ আমাকে এই রাজকীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হতে হতো না।

 এসব কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম এবং ‘আয় আল্লাহ!দয়া করো’বলে চিৎকার করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শিশুদের ন্যায় কাঁদতে লাগলাম।

আমার মা আমার কক্ষেই ছিলেন। চিৎকার শুনে  তিনি জেগে উঠলেন এবং ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, বেটি! শান্ত হও। কালেমা পড়ো। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুণ। তুমি কি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখেছো?

আমি বললাম, হ্যাঁ। তারপর আমি স্বপ্নে যা যা দেখলাম তার সবই খুলে মায়ের নিকট বর্ণনা করলাম।

মা আমাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, বেটি! স্বপ্ন তো স্বপ্নই । খুব কম স্বপ্নই সত্য হয়ে থাকে। অনেক সময় শয়তান মানুষকে আজেবাজে স্বপ্ন দেখায়। তোমার স্বপ্নটি সেরকমই হবে। তাই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। লা হাওলা পড়ে পার্শ্ব পরিবর্তন করে শুয়ে পড়ো।

রাজিয়ার রাতের স্বপ্ন ২!

আমি মায়ের নির্দেশ মত শুয়ে পড়লাম। এ সময় নানাবিধ চিন্তা এসে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।  বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এল। এবং আশ্চর্য! দ্বিতীয় বারের মতো আবার আমি স্বপ্নের জগতে চলে গেলাম। আমি দেখলাম-

আমার স্বামীর বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে। লোকজন বরযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এই বিয়ের বর আমার স্বামীই। খানিক দূরে তাকে বরবেশে অত্যন্ত আনন্দিত অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমি এক দৌড়ে তার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে রাগতকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, এসব কী হচ্ছে?

প্রশ্ন শুনে আমার স্বামী আমার দিকে চরম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।

আমি নিরুপায় হয়ে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পিত্রালয়ে চলে এলাম। বাড়ীর লোকজন এই ঘটনা শুনে প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!! বলে চিৎকার করে উঠলেন। সেই সাথে এর একতা বিহিত করার জন্য কয়েকজন মুরুব্বী আমার স্বামীর বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। আমিও তাদের সঙ্গে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে বরযাত্রী রওয়ানা হয়ে কিছু পথ অতিক্রম করে ফেলেছে।

আমাদের বাড়ির লোকজন সেখানে গিয়ে চেচামেচি করে একটা মহাহুস্থুল বাধিয়ে বিয়ের আয়োজন পন্ড করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু ফলাফল খুব একটা সুবিধার হলো না। লোকদের চিৎকার চেচামেচি শুনে স্বামী পক্ষের কিছুলোকও সেখানে জড়ো হয়েছিল। আলোচনা পর্যালোচনায় পর সমস্ত দোষ আমার ঘাড়েই এসে চাপল। আশেপাশের লোকদের মধ্যে যারা আমাদের স্বামী স্ত্রীর বিষয়টি জানল তারা ছিঃ ছিঃ করতে লাগল। ফলে সীমাহীন লজ্জায় আমি ও আমাদের পক্ষের লোকদের মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার উপক্রম হলো। যারা আমাদের পক্ষালম্বন করে দু;চারটি কথা বলেছিল, চরম অপমানে তাদের মাথাও হেট হয়ে গেল। মুখ তুলে তাকাবার মতো কোনো অবস্থা কারোর রইল না।

অবশেষে আমাদের পক্ষের লোকজন আপসের মাধ্যমে বিষটির সুরাহা করতে চাইলেন। কিন্তু স্বামী পক্ষের লোকজন কোনো প্রকার ছাড় দিতে রাজী হলো না। ফলে আমরা যারপরনাই অপদস্থ হয়ে মাথা নিচু করে বাড়ী ফিরে এলাম।

অতঃপর যা হওয়ার তা-ই হলো। আমার স্বামী নতুন স্ত্রী নিয়ে পরম আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন। আমাদের জনু এই ঘটনা ছিল অসহনীয়। তাই আমার পিতা-মাতা উপায়ান্তর না দেখে আমার ভরণ-পোষণ ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার দাবী তুলে মামলা ঠুকে দিলেন। এই মামলা অনেক দিন পর্যন্ত চলল। অবশেষে আমাদের দোষই প্রমাণিত হলো। আমার স্বামী ঘোষণা  দিয়ে দিলেন- আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাইনা। আমার দ্বিতীয় বিবাহ কেবল নিজের আরাম-আয়েশের জন্য করেছি। ইসলামী বিধান মতে একই সাথে দুই স্ত্রী রাখায় কোনো সমস্যা নেই। তাই ওদের দুজনকেই আমি স্ত্রী হিসেবে রাখতে চাই।

তার বক্তব্য শুনে আদালত এই মর্মে রায় দিল যে, মেয়ে যদি তার স্বামীর সাথে থাকতে চায় তো ভাল। অন্যথায় স্বামী তাকে ভরণ পোষোন বাবদ মাসিক এক হাজার টাকা প্রদান করবেন। যদি এই দুই অবস্থায় কোনটাই গৃহীত না হয় তবে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ অবলম্বন করা যেতে পারে।

রায় শুনে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো। আমরা আশা করেছিলাম, আদালতের রায় আমাদের অনুকূলেই হবে এবং আমার স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রী কে তালাক দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু আমাদের আশা পূরণ হলো না। ফলে আমার হৃদয় জগতে কি যে ঝড় বইতে লাগল, তা বলে বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঠিক এ অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বস্লাম এবং গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে।

কান্নার আওয়াজ শুনে ঘরের সবাই আমার কক্ষে জড়ো হলো। আমি তাদের নিকট স্বপ্নের কথা বিবৃত করলাম। সব শুনে তারা আমাকে তিরস্কার করে বললেন, বেটি! তোমার কি হয়েছে? একটু স্থির হও। তোমার এই বাজে স্বপ্ন তো আমাদের সকলের ঘুম হারাম করে দিল। আজকাল তুমি অন্যরকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ। আল্লাহ না করুণ, তোমার স্বামী তো তোমার উপর এতটা অসন্তুষ্ট হননি যে, তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করবেন। তুমি তাকে না বলে চলে এসেছো, তাতেই তার রাগ। এটা এমন কোনো বড় অপরাধ নয় যে, এর কারণে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। বেটি! অনেক হয়েছে। যাও, এবার গিয়ে একটু আরাম করে ঘুমাও। সকালে তোমার স্বামীর বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ে খবর নিব।

তখন নিশ্চয় তোমার সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। তাছাড়া তুমি বরাবরই একটু সন্দেহ প্রবণ। সারাদিন যা চিন্তা করো, রাতে তো স্বপ্নে তাই দেখবে। স্বপ্নের আর দোষ কি! বেকার চিন্তা করো না। যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।

মা যখন এসব কথা বলছিলেন তখন তো আমি একদম চুপ করে বসে ছিলাম সত্য। কিন্তু পরপর দুটি স্বপ্ন আমার স্থিরতা আর চোখের নিদ্রা সমূলে হরণ করে নিল। এসময় সবার অলক্ষ্যে আমার চিন্তার জগতে এক মহাবিপ্লব ঘটে গেল। আমি আমার ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটালাম। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোনোদিন স্বামীর অমতে কোনো কাজ করব না। কালই আমি স্বামীর বাড়ি চলে যাব এবং তার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব এবং জীবনের বাকী দিঙ্গুলো তার ইচ্ছানুযায়ী পরিচালনা করব।

এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমি দু’রাকাত নামায পড়ে দোয়ার জন্য হাত তুললাম। বললাম, হে আল্লাহ! আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমার কৃতকর্মের জন্য আমি চরমভাবে লজ্জিত। আমি খাঁটি দিলে তওবা করছি। হে আল্লাহ! আমি মহাঅপরাধী । দুদিন আগে আমার এক বান্ধবী আমাকে বলে গেল, স্বামীর মনে কষ্ট দেওয়া কোনো ভাবেই উচিত নয়। কারণ তিনি তোমার মালিক। তোমার মাথার মুকুট। তোমার জীবন সঙ্গী। আল্লাহকে ছাড়া যদি অন্য কাউকে সিজদা করার হুকুম হতো, তবে স্ত্রীদের কে বলা হতো নিজ নিজ স্বামী কে সিজদা করার জন্য। যে নারীর উপর তার স্বামী অসন্তুষ্ট তার উপর আল্লাহ পাকের লানত বর্ষিত হয়।

দোয়া শেষে আবারও আমি অনুতাপ অনুশোচনা করতে লাগলাম। এমনকি দু’গালে দু’টি চপেটাঘাত করে তাওবা তাওবা বলতে লাগলাম এবং এরূপ অনুতাপ-অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়েই রাতের বাকী অংশ অতিবাহিত করলাম।

অতপর ভোরের আলো ফোটার আগে বিছানা ত্যাগ  করলাম এবং ফজরের নামায ও কুরআন তিলাওয়াত সেরে কাগজ কলম নিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলাম-

প্রিয় স্বামী আমার! আসসালআমু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আল্লাহ পাক আপনাকে নিরাপদে ও সুখে শান্তিতে রাখুন। পর কথা হলো, এ পর্যন্ত আমার পক্ষ থেকে যা কিছু আপনাকে সহ্য করতে হয়েছে উহাকে একটি দুঃস্বন মনে করে ভুলে যাওয়ার অনুরোধ করছি। সেই সাথে এই পত্রে যা লিখছি উহাকেই সত্য ও বাস্তব বলে মনে করবেন।

আজ এতদিন পর আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তাই আমি আপনার দয়া ও অনুগ্রহ ভিক্ষা করছি। মেহেরবানী করে এই গুনাহপগার দাসীকে দয়ার ভিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমি আমার ভুলের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। আমার সকল ভুল-ক্রটি মাফ করে দিন। আমাকে আপনার গৃহে আসার অনুমতি দিন। আমি আপনার অনুমতির অপেক্ষা করছি। আমার মনকে এখানে আর বেঁধে রাখতে পারছি না। ডানা থাকলে উড়ে উড়ে এখনই আপনার কাছে চলে আসতাম।

আপনি যদি এই পত্রের উত্তর না দেন তাহলে কসম করে বলছি, আপনি আমার মরামুখ দেখতে পাবেন। আমি আপনাকে ছাড়া আর একটি মুহূর্তও কাটাতে চাই না। আমাকে আপনার নিকট চলে আসার অনুমতি দিয়ে অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্য করার সুযোগ দিন। আমি ওয়াদা করছি, এখন থেকে আপনি যখন যা করতে বলবেন তাই করব। আমার জীবন যৌবন সব আপনার জন্য উৎসর্গ করব। সর্বদা আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করব। এতদিন আমি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে পাআড় পরিমাণ অপরাধ করেছি তাতে বিন্ধুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনার হৃদয়ে যদি আমার জন্য সামান্য ভালোবাসাও থেকে থাকে তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে মাফ করে আপনার যাওয়ার অনুমতি দিন। মনে রাখবেন, আমার জীবন এখন আপনার হাতে। পরিশেষে দোয়ার আবেদন রেখে শেষ করলাম।

                                                                              ইতি-  আপনার গোনাহগার দাসী ।

চিঠি লেখা শেষ হওয়ার পর উহাকে সুন্দর একটি খামে ভরে বাসার কাজের লোকটির মাধ্যমে স্বামীর নিকট পাঠিয়ে দেই। কাজের লোকটি ফিরে এসে বলল, তিনি আপনার চিঠি খুব গুরুত্ব দিয়েও অবাক বিস্ময়ে কয়েকবার পাঠ করেছেন। পত্র পাঠের সময় তার চেহারায় আমি গভীর প্রশান্তির একটি ক্ষীণ রেখা ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। ভাবখানা এমন ছিল যে, তার বুকের উপর চেপে থাকা একটি বিশাল পাথর যেন কে এসে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল। সবশেষে তিনি খাতা কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে আমাকে বললেন, তুমি এখন চলে যাও। একটু পর কারো মাধ্যমে আমি চিঠির জবাব পাঠিয়ে দেব।

ঘন্টা দুয়েক যেতে না যেতেই স্বামীর পবিত্র হস্তে লিখা একখানা চিঠি আমার হস্তগত হলো। এই দু’ঘন্টা সময় আমার কাছে দুই যুগ দীর্ঘ বলে মনে হলো। তাতে লিখা ছিল –

বোকা স্ত্রী আমার! আল্লাহ পাক তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুণ। জীবনে এই প্রথম তোমার হাতের পত্র পেলাম। তোমার পত্র পেয়ে কত যে খুশি হয়েছি তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোমার পত্র পাঠ করে খুব অবাক হয়েছি এজন্য যে, তোমার সঙ্গে এই পত্রের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার চিন্তা-চেতনার এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন সত্যি আমাকে দারুণ বিস্মিত করেছে। তোমার এই অনুভূতি ও বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে আমি আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করছি। কারণ, অনেক দেরীতে হলেও তুমি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে সক্ষম হয়েছে।

তুমি শুধু আমার নিকট অপরাধ করেছ তাই নয়, বরং আল্লাহ পাক ও তার প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর নিকটও তুমি অপরাধী। কেননা স্বামীর অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে তুমি তাদের নির্দেশকে অমান্য করেছ। তোমার অসঙ্গত কথাবার্তা ও অনৈতিক আচরণের ফলে আমার মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল তোমার মধুর আচরণ ও ভালোবাসার প্রলেপ দ্বরাই সেরে ওঠতে পারে। তোমার জন্য আমার হৃদয়ে যে কী গভীর ভালোবাসা রয়েছে তা কেবল মহান আল্লাহ পাকই জানেন। রাজিয়া!

তোমাকে আমি এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমার হৃদয়রাজ্যে তুমি ছাড়া আর কোনো নারীর পদচারণা নেই। আমার হৃদয়ে তোমার জন্য এখনো পর্যন্ত অসম্ভব রকমের ভালোবাসা লালন করছি। যা হোক, তুমি যেহেতু নিজের অপরাধ স্বীকার করেছ এবং ক্ষমা চেয়েছ, এমনকি তুমি তোমার জীবনকে আমার ক্ষমার উপর নির্ভর করে দিয়েছ তাই তোমার সমস্ত অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিলাম। এখন তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। নেই কোনো দুঃখ বা কষ্ট। যদিও আমার অতীত একটি দুঃস্বপ্নই ছিল, কিন্তু তোমার আজকের এই বিনয় ও ভালোবাসা পূর্ণ কথা আমার সমস্ত কষ্ট ধুয়ে  মুছে সাফ করে দিয়েছে। আর হ্যাঁ, আমি আন্তরিকভাবেই চাই যে, অতীত, অতীত হয়েই থাকুক। অতীতকে আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে চাই।

তুমি তোমার চিঠিতে আমার বাড়ীতে আসার ব্যাপারে অনুমতি প্রার্থনা করেছ। পাগলী মেয়ে কোথাকার! আমার বাড়ি তো তোমারই বাড়ি। তদুপরি তুমি এই বাড়ীর গৃহকর্ত্রীও বটে। সুতরাং এখানে আসতে আবার অনুমতির প্রয়োজন হবে কেন? অবশ্য তোমাকে এতটূকু বলব যে, তুমি এখানে এসে এমনভাবে চলবে যাতে অতীতকেয়ামি দুঃস্বপ্নের মতোই ভুলে থাকতে পারি। আল্লাহ হাফেয।

                                                                                         ইতি  তোমারই………………।

চিঠিখানা হাতে পাওয়ার পর আমি চরম অধৈর্যের ন্যায় চোখের সামনে তা মেলে ধরলাম। তারপর একবার দুইবার নয়, পাঁচবার পড়লাম। চিঠি পড়ার পর আনন্দের আতিশয্যে আমার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা আনন্দ অশ্রু নির্গত হয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ল। আমার খুশীর কোনো সীমা রইল না। শূন্য হৃদয় পরম প্রাপ্তির আনন্দে নেচে ওঠল। অবশেষে সিজদার অবনত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালাম।

অতঃপর আমি সময় নষ্ট না করে স্বামীর বাড়ী যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কাজের লোকটিকে দিয়ে রিক্সা ডাকিয়ে আনলাম এবং অল্প সময়ের মধ্যে স্বামীর বাড়ী উপস্থিত হলাম।

আমি রিক্সা থেকে নেমেই আমার স্বামীর পায়ের উপর আছড়ে পড়লাম এবং আঝোর ধারায় ক্রন্দন করে অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলাম। আমার এই ব্যাকুল অবস্থা দেখে আমার স্বামীর চোখেও পানি এসে গেল। এবং তার কয়েক ফোঁটা অশ্রু আমার মুখে নিপতিত হলো। তার পায়ে পড়ে এভাবে ক্ষমা চাইতে তার সমস্ত কষ্ট দূরীভূত হয়ে গেল। তাই তিনি আমার মুখখানা দু;হাত দিয়ে উপরে তুলে বললেন, আমি তো তোমাকে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। যাও, তোমার খুশীর জন্য আবারও তোমার ক্ষমার ঘোষণা দিলাম। তোমার প্রতি আমার কোনো দুঃখ নেই। সামনের দিনগুলোতে তুমি ভালো হয়ে চলবে, তোমার কাছে এ-ই আমার দাবী।

স্বামীর কাছ থেকে মাফ-মুক্তি নিয়ে আমি ঘরের সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম এবং তাদের কাছেও ক্ষমা চাইলাম।

সেদিন থেকে আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করলাম।প্রতিটি দিন যেন ঈদের দিন এবং প্রতিটি রাত যেন শবে বরাত হয়ে আমাকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।

 এখন আমি নতুন এক নিয়মে জীবনযাত্রা শুরু করলাম। ইতিপূর্বে যেখানে সবার পরে ঘুম থেকে জাগ্রত হতাম, এখন সে নিয়ম ও অভ্যাস পাল্টে সবার আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার অভ্যাস করলাম। রাতে ঘুমানোর বেলায়ও পূর্বের নিয়ম পরিবর্তন করে ঘরের সবাইকে খাইয়ে সবকাজ সমাধান করে তারপর ঘুমুতে যাওয়ার অভ্যাস করলাম। স্বামীর খেদমত, তার স্বাস্থ্য ও আরামের প্রতি খুব নযর দিলাম। তার আদেশ-নিষেধ গুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম। ঘরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুন্দর করার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট ফিকির ও প্রচেষ্টা ছিল। আলহামদুলিল্লাহ্‌! এতে আমি সফলও হলাম।

অল্পদিনের মধ্যে দেখা গেল, আমার তত্ত্বাবধানে ঘরের সকল কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে লাগল। আশ্চর্য! যে ঘর একদিন আমার নিকট জাহান্নামের টুকরো বলে মনে হতো আজ সে ঘরই আমাকে জান্নাতের সুখ উপহার দিচ্ছে। ভাসিয়ে নিয়ে চলছে শাতি-সুখের বন্যায়!

আমার সুব্যবস্থাপনায় ঘরের গোটা চিত্রই পরিবর্তন হয়ে যায়। আশেপাশের লোকজন আমাদের বাড়ীর ঝকঝকে তকতকে অবস্থা দেখে দারুণ অবাক হয়। আর আমাকে বাহ বাহ দিতে থাকে। স্বামী বাড়ীতে থাকা অবস্থায় শত কাজের মধ্যেও আমি পরিপাটি হয়ে থাকার চেষ্টা করি। যাতে আমাকে তিনি যতবার দেখেন ততবারই খুশি হন। আমি তার হকগুলো আদায়ের ব্যাপারেও যথেষ্ট মনোযোগী হই। তিনি আমার কাছে যতটা না কামনা করেন, আমি তার চেয়েও একটু বেশি করার চেষ্টা করি। এসব দেখে তিনি আমার উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বাইরের কাজ সেরে ঘরে আসতেই তার হৃদয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়। এখন তাকে তার প্রয়োজনের কথা মুখ ফুটিয়ে বলতে হয় না। কারণ তার প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস চাইবার আগেই আমি তার সামনে উপস্থিত করি।

এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার উপর তার মুহাব্বত ও ভালবাসার মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, তিনি এখন আমার জন্য গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিতে চান। সর্বদা এখন তার মুখে আমার জন্য দোয়ার কালাম উচ্চারিত হতে থাকে। আর আমিও তার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে বিন্দুমাত্র কসুর করি না। একনিষ্ঠ দাসীর মতোই নিরলস ভাবে আমি তার সেবা করে যাচ্ছি।

আল্লাহ পাক আমাকে সবকিছুই দিয়েছিলেন। শুধু একটা জিনিসেরই অভাব ছিল। আর তা হলো – দাম্পত্য সুখ। আল্লাহর ফজলে আজ উহাও পূরণ হয়েছে। এখন আমাদের এই দাম্পত্য সুখ দেখে সবাই দোয়া দেন। বলেন- আল্লাহ পাক তোমাদের এই দাম্পত্য সুখ অটুট রাখুন। তোমাদের এই ভালোবাসা চিরস্থায়ী করুণ। তোমাদের সংসার ফুলে-ফলে আরও সুবাসিত হোক।

ইতিপূর্বে সকলের মুখে কেবল আমার দুর্নাম শুনা যেত। আর এখন সকলে কেবল আমার প্রশংসা করে বেড়ায়; যদিও আমি এসব কাজ প্রশংসা কুড়ানোর জন্য করি না। পাড়া-প্রতিবেশী , মহল্লাবাসী, এমনকি গোটা গ্রামের মহিলারাই এখন আমার পাশে বসে দু’দন্ড কথা বলতে পারাকে নিজেদের জন্য সৌভাগ্য বলে মনে করে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! একথা সত্য যে, নারী যদি বুদ্ধিমতি ও বিচক্ষণ হয়, তার মধ্যে যদি কোমলতা ও সেবার মনোভাব থাকে তাহলে ঘরের তুচ্ছ আয়োজনকেও সে সুখের উপকরণ রূপে ব্যবহার করতে পারে। ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। তার গুণী হাতের সংস্পর্শে তখন সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠে। বস্তুত সৎ, সংসারধর্মী ও পতিপরায়ণা নারী জগতের জন্য আলোকসদৃশ এমন এক মহামূল্যবান সম্পদ যে দুনিয়া আখেরাতের উভয়জগতকে সুখ-সম্পদে ভরে দিতে পারে। দোয়া করি, আল্লাহ পাক আমার সকল মা-বযোনকে এমনই নেক নারী হওয়ার রাওফীক দান করুণ এবং উভয় জাহানে তাদেরকে সুখ ও আনন্দময় জীবন দান করুণ। আমীন।

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২)

এরপর পড়ুনঃ নববধূ

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, অবাধ্য স্ত্রীর ভুল শোধরানোর গল্পটি পড়ে যদি ভালো লাগে তাহলে গল্পটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। আমাদের গল্প মিস করতে না চাইলে নিয়মিত আমার বাংলা পোস্ট.কম এ আসুন।  

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment