মানুষের সাথে কিংবা কেমন লোকেদের সাথে আপনি কি ধরনের কথা বলবেন তা শিখতে সম্মানিত লেখকের স্থান-কাল- পাত্রভেদে কথা বলুন শীর্ষক আর্টিকেলটি পড়ুন। সম্মানিত লেখক রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের আলোকে পাত্রভেদে কথা বলার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আপনার জীবনকে উপভোগ করতে পাত্রভেদে কথা বলুন আর্টিকেলটি পড়ুন।
স্থান কাল ও পাত্রভেদে কথা বলুন (লাইফ হ্যাকিং টিপস ১৮)
আগের আলোচনায় পরই যে প্রসঙ্গটি আসে তা হলো—মানুষের সঙ্গে কথা বলার পদ্ধতি ও ব্যক্তি হিসেবে আলোচ্য বিষয়ের ভিন্নতা। আপনি যখন কারো সঙ্গে কথা বলবেন তখন তাঁর মনন ও রুচি উপযোগী প্রসঙ্গ টানুন। এটা মানুষের সহজাত প্রকৃতির দাবিও বটে।
যুবকের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা আর বৃদ্ধের সঙ্গে আলোচনা কখনো এক রকম হবে না। অনুরূপভাবে একজন অজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে সেভাবে কথা বলবেন না, যেভাবে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে বলবেন। স্ত্রী ও বোনের সঙ্গে আলাপচারিতার ধরনও অবশ্যই ভিন্ন হবে।
আমি এ কথা বলতে চাচ্চি না যে, আলোচনাই সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে। বোনকে যে ঘটনা বলা যাবে তা স্ত্রীকে বলা যাবে না। যুবকের সঙ্গে যে আলোচনা করেছেন তা কোনো বৃদ্ধ শুনতে পারবে না!
না, আমি এরূপ বোঝাতে চাচ্ছি না; বরং ভিন্নতা বলতে আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো, ঘটনাটি উপস্থাপনের ধরন ও আঙ্গিকে একটু পার্থক্য করা। তবে ক্ষেত্রবিশেষ পুরো কাঠামোটাকেই পাল্টে দিতে হয়। একটি উদাহরণ দিলে আশা করি বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। মনে করুন, আপনার দাদা অথবা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আপনাদের বাসায় আশির উর্ধ্বে বয়স এমন কয়েকজন মেহমান এলেন। আপনি যদি তাদের সঙ্গে হাসতে হাসতে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়ার গল্প বলতে শুরু করেন তাহলে কেমন হবে? অথবা ফুটবল খেলার গল্প শুরু করে বললেন, অমুক টুর্নামেন্টে খেলোয়ার কীভাবে গোল দিল। কে মাথায় বল রেখে পরে হাঁটু দিয়ে কিক করলো। তাহলে এটা ব্যক্তি ও পরিবেশের উপযোগি আলোচনা হবে না।
অনুরূপভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করার সময় যদি দাম্পত্য জীবনের বিষয় কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন তাহলে কেমন হবে?
আমার মনে হয় এ বিষয়গুলো যে স্থান-কাল-পাত্রের প্রতিকূল তাতে আমরা সবাই একমত হব।
মানুষকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যম হলো, যে ব্যক্তি যে প্রসঙ্গ ভালবাসে, তাঁর সঙ্গে যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা। কোনো ভদ্রলোকের যদি স্বনামধন্য কোনো পুত্র থাকে তাহলে তাঁর কাছে তাঁর পুত্রের ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে চাইবেন। কারণ ভদ্রলোক অবশ্যই তাঁর ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে গর্ববোধ করেন। আর এ কারণেই তিনি তাঁর ব্যাপারে আলোচনা করতে পছন্দ করবেন।
মনে করুন আপনার পরিচিতি কোনো দোকানদার দোকান খোলার পর কিছু বেচাকেনা করেছেন। বেশ লাভও হয়েছে। এ মুহূর্তে আপনি তাঁর কাছে গেলেন। তখন আপনি বেচাকেনা কেমন হচ্ছে, দোকানে ক্রেতাদের উপস্থিতি কেমন? এসব বিষয় জানতে চাইবেন। কেননা, এ জাতীয় আলোচনা তখন তাঁর ভাল লাগবে। আর এর ফলে সে আপনাকে দেখলে খুশী হবে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভাল লাগবে।
আমাদের রাসূল (সাঃ)ও এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতেন। তাই যুবক-বৃদ্ধ, নারী ও শিশুর সাথে তাঁর কথা বলার ধরন হতো ভিন্ন ভিন্ন।
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) আল্লাহর রাসূলের এক যুবক সাহাবী। মা বেঁচে নেই। নয় বোন রেখে ওহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতাও শহীদ হয়েছেন। তাই সহোদর নয় বোনের দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়েছে।
এদিকে বাবা বিশাল ঋণের বোঝা রেখে গেছেন। যা তাকেই পরিশোধ করতে হবে। যৌবনের শুরুতে এমন বহুমুখী চাপে জাবের (রাঃ) ছিলেন উদ্বিগ্ন। তাঁর মাথায় সবসময় শুধু দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেত। ঋণ পরিশোধের চিন্তা, বোনদের ভরণ-পোষণ ও বিবাহের চিন্তা। সকাল-বিকাল পাওনাদারদের আনাগোনা ও ঋণ পরিশোধের দাবি এমন এক যুবকের সাথে রাসূলের আচরণ দেখুন।
যাতুরা রিকা অভিযান শেষে রাসূল (সাঃ) মদিনার ফিরে আসছেন। সঙ্গে জাবের (রাঃ) ছিলেন। তাঁর বাহন ছিল জীর্ণ-শীর্ণ একটি উট। নিজেরই যার চলতে কষ্ট হয়। যাত্রী বহন করা তো আরো কষ্টসাধ্য। উৎকৃষ্টমানের উট কেনার মতো অর্থ জাবেরের ছিল না। উটের ধীর গতির কারণে তিনি কাফেলার একেবারে পেছনে পড়ে গেলেন। রাসূল (সাঃ) ও বাহিনীর পেছনে পেছনে চলছিলেন। তিনি জাবেরকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে তাঁর জীর্ণ-শীর্ণ উটটিও তাঁর নজর এড়াল না।
রাসূল (সাঃ) তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘জাবের! তুমি এতো পেছনে পড়ে গেলে কেন? জাবের বললেন, ‘এই উটটির কারণে আমি পেছনে পড়ে গেছি।’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘উটটিকে বসাও।’
জাবের উটকে বসাল। রাসূল (সাঃ) ও নিজের উটকে বসিয়ে জাবেরকে বললেন, ‘তোমার লাঠিটি আমাকে দাও অথবা আমার জন্য গাছ থেকে একটি ডাল কেটে আন।’
জাবের রাসূল (সাঃ)-এর দিকে নিজের লাঠি এগিয়ে দিলেন। জাবেরের উটটি মাটিতে দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে বসে ছিল। রাসূল (সাঃ) উটটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি উটটিকে লাঠি দিয়ে একটু আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উটটি দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে চলতে লাগল। জাবের দৌঁড়ে উটটির পিঠে চেপে বসলেন।
রাসূল (সাঃ) ও জাবের (রাঃ) একসঙ্গে চলছেন। এখন জাবেরের মন খুব ভাল। তাঁর উটটি নতুন শক্তি ও উদ্যম ফিরে পেয়েছে। রাসূল জাবেরের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে চাইলেন।
এখানে লক্ষণীয় হলো, জাবেরের সঙ্গে রাসূল কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন? জাবের তখন সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়েছে। যৌবনের মৌবনে সে এক নতুন ভ্রমর। এ বয়সে সাধারণত যবকদের মাথায় বিয়ে-শাদী ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তাই বেশি ঘুরপাক খায়। তাই রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘জাবের! তুমি বিয়ে করেছ?’
জাবের উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’।
রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুমারী না বিধবা?’
‘বিধবা’। জাবের বললেন।
অবিবাহিত এক তাগড়া যুবক তাঁর জীবনের প্রথম বিয়ে একজন বিধবাকে করেছে শুনে রাসূল (সাঃ) খুব অবাক হলেন। তিনি জাবেরকে স্নেহের স্বরে বললেন, ‘কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তো সেও তোমার সাথে মজা করত আর তুমিও তাঁর সাথে মজা করতে।’
জাবের রাযি বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আমার বাবা আমার নয় বোন রেখে ওহুদের যুদ্ধে ইন্তেকাল করেছেন। আমি ছাড়া তাদের দেখা-শোনা করার মত আর কেউ নেই। তাই আমি তাদের বয়সী কোনো যুবতীকে বিয়ে করা সমীচীন মনে করিনি। কারণ এর ফলে তাঁর সঙ্গে তাদের বনি বনা না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমি তাদের চেয়ে বয়স্ক এক নারীকে বিয়ে করেছি, যাতে সে তাদেরকে মায়ের মতো মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রাখতে পারে।’
রাসূল (সাঃ)-এর সামনে তখন ছিল এমন এক আত্মত্যাগী যুবক যে নিজের বোনদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে যৌবনের ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়েছে। তাই তিনি তাকে যুবকদের রুচি ও প্রকৃতির অনুকূল কিছু কথা বলে তাকে আনন্দ দিতে চাইলেন।
রাসূল তাকে বললেন, ‘আমরা মদিনার কাছা-কাছি পৌঁছে সিরারে[1] যাত্রাবিরতি করব। আমাদের আগমন সংবাদ যখন তোমার স্ত্রী শুনবে, তখন সে তোমার জন্য খাট সাজিয়ে রাখবে।’
যদিও তুমি বিধবা বিয়ে করেছ, কিন্তু সে তো তোমার জন্য নববধূ। তাই সে তোমার আগমনে আনন্দিত হবে এবং তোমার আরামের জন্য বিছানা প্রস্তুত করে রাখবে।
রাসূলের মুখে খাটের কথা শুনে জাবেরের নিজের দরিদ্রতার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের ঘরে তো কোনো খাট নেই।’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ! তোমাদের ঘরে অতিসত্বর খাট আসবে।’
উভয়ে আবার পথ চলতে লাগলেন। রাসূল (সাঃ) জাবেরকে কিছু অর্থ-কড়ি দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘জাবের!’
সঙ্গে সঙ্গে জাবের (রাঃ) উত্তর দিলেন, ‘আমি উপস্থিত, ইয়া রাসূলাল্লাহ!’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তুমি কি তোমার উটটি আমার কাছে বিক্রি করবে?’
জাবের (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর এ প্রস্তাবে একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই উটটিই তাঁর একমাত্র সম্বল। দুর্বল হলেও সেটি এখন তেজি ও সবল হয়ে গেছে। কিন্তু প্রস্তাব দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল (সাঃ)। জাবের বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আপনিই বলুন, এর দাম কত দেবেন?’
‘এক দেরহাম।’ রাসূল (সাঃ) বললেন।
আমার ঠক হয়ে যাবে।’ জাবের বললেন,
‘তাহলে দুই দেরহাম।’ রাসূল বললেন।
‘তাহলেও ঠক হবে।’ জাবের বললেন।
এভাবে দাম বাড়াতে বাড়াতে চল্লিশ দিরহাম পর্যন্ত পৌছল। আরবের তৎকালীন পরিমাপ হিসেবে ৪০ দেরহামে এক উকিয়া সমপরিমাণ স্বর্ণ হয়ে থাকে। জাবের বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি রাজি। তবে আমার একটি শর্ত আছে। আমি এই মুহূর্তে উটটি হস্তান্তর করতে পারব না। এর ওপর চড়ে আমি মদিনা পর্যন্ত যাব। এরপর তা হস্তান্তর করব।’
রাসূল বললেন, ‘ঠিক আছে।’
সবাই যথাসময়ে মদিনায় পৌঁছলেন। জাবের নিজের বাড়িতে গিয়ে উটের পিঠ থেকে মালপত্র নামালেন। এরপর রাসূলের সঙ্গে নামায পড়ার জন্য মসজিদে এলেন। মসজিদের কাছেই উটটিকে বেঁধে রাখলেন।
নামায শেষে রাসূল (সাঃ) যখন বের হলেন, জাবের বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! এই যে নিন আপনার উট।’ রাসূল (সাঃ) উটটি বুঝে নিলেন। এরপর বেলালকে বললেন, ‘বেলাল! জাবেরকে এক উকিয়া দিয়ে দাও। কিছু বাড়িয়ে দিও।’ বেলাল (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর আদেশ অনুযায়ী মেপে এক উকিয়ার চেয়ে কিছু বেশি জাবেরকে দিয়ে দিলেন। জাবের দিরহামগুলো হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে করতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, দেরহামগুলো দিয়ে কী করবেন? একটা উট কিনবেন? নাকি বাড়ির জন্য কিছু আসবাবপত্র কিনবেন? নাকি…? তাঁর ভাবনায় ছেদ পড়লো। বেলাল তাকে ডাকছে।
এদিকে রাসূল (সাঃ) বেলালকে বললেন, ‘বেলাল! উটটি নিয়ে তুমি জাবেরকে আমার পক্ষ থেকে হাদিয়াস্বরূপ দিয়ে দাও।’ বেলাল সঙ্গে সঙ্গে উট নিয়ে জাবের (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জাবের (রাঃ) বেলাল (রাঃ) কে উট নিয়ে আসতে দেখে অবাক হলেন। মনে মনে আশঙ্কা করলেন, রাসূল (সাঃ) কি তাহলে বিক্রয়চুক্তি বাতিল করে দিলেন? বেলাল (রাঃ) জাবের (রাঃ)-এর পাশে বললেন, ‘জাবের! তোমার উট তুমি নিয়ে নাও। জাবের (রাঃ) বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘কেন? ব্যাপার কি?’
বেলাল (রাঃ) বললেন, ‘রাসূল (সাঃ) আমাকে বলেছেন, আমি যেন উটটা তোমাকে দিয়ে দিই। আর দেরহামগুলোও ফিরিয়ে না নিই।’
বেলালের কথা শুনে জাবের রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি উট নেবেন না?’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তুমি কি মনে কর আমি এত অল্প দামে উটটি নেয়ার জন্য তোমার সঙ্গে দর কষা-কষি করেছি? বরং আমি অনুমান করতে চেয়েছিলাম, এ মুহূর্তে কী পরিমাণ অর্থে তোমার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে।’
আহ! কত উত্তম চরিত্র!
রাসূল যুবকদের সঙ্গে তাদের মানসিকতা বুঝে কথা বলতেন। আর যখন তাদেরকে কোনো কিছু দান করতে চাইতেন তখন তা স্নেহ ও ভালবাসার আবরণে আবৃত করে দিতেন।
রাসূলের পাশে একদিন এক সাহাবী বসা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল জুলাইবীব। তিনি ছিলেন একজন উত্তম ও নওজোয়ান সাহাবী। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃস্ব, অসহায় ও দেখতে কিছুটা কদাকার। সেদিন রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলছিলেন। আসুন একটু দেখি একজন অবিবাহিত যুবক সাহাবীর সঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল?
রাসূল তাঁর সঙ্গে আরবের কুলজি বা কুষ্ঠিনামা নিয়ে আলোচনা করছিলেন? কোনোটি সম্ভ্রান্ত বংশ, আর কোনোটি সাধারণ বংশ? না কি তাঁর সঙ্গে বাজার ও ক্রয়—বিক্রয়ের নানা বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা করছিলেন? না, এ জাতীয় কোনো বিষয় নিয়ে রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন নি।
রাসূল তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য এক ভিন্ন প্রসঙ্গ নির্বাচন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গটিই তাঁর জন্য অন্য যে কোনো প্রসঙ্গ থেকে বেশি উপযোগী। রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পৃথিবীতে এমন কোনো যুবক নেই, যার কাছে এ প্রসঙ্গটি ভাল লাগে না।
যাই হোক, রাসূল (সাঃ) তাকে বিয়ে করার কথা বললেন। জুলাইবীব (রাঃ) বললেন, ‘সমাজে তো আমি অচল, এ সমাজের চোখে আমার কোনো মূল্য নেই।’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘কিন্তু আল্লাহর কাছে তো তুমি অচল নও।’
এরপর থেকে রাসূল (সাঃ) জুলাইবীবকে একটি ভাল পাত্রী দেখে বিয়ে দেয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। একদিন জৈনিক আনসারী সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর কাছে তাঁর বিধবা মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। তাঁর অভিপ্রায় ছিল, রাসূল (সাঃ) যেন তাকে বিয়ে করেন।
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘আমি তোমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি।’ সাহাবী বললেন, ‘অবশ্যই, অবশ্যই।’
রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তবে আমার নিজের জন্য নয়।’
সাহাবী জানতে চাইলেন, ‘তাহলে কার জন্য?’
রাসূল (সাঃ) বললেন, জুলাইবীবের জন্য।
আনসারী সাহাবী একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘জুলাইবীব? তাহলে মেয়ের মায়ের সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে হবে।’
এ কথা বলে তিনি ফিরে গেলেন। বাড়িতে এসে স্ত্রীকে বললেন, ‘রাসূল (সাঃ) তোমার মেয়ের ব্যাপারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।’
স্ত্রী বললো, ‘এ তো মহা আনন্দের সংবাদ। তুমি রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও।’
‘রাসূল নিজের জন্য প্রস্তাব পাঠান নি।’ আনসারী সাহাবী বললো।
‘তবে কার জন্য?’
‘রাসূল (সাঃ) তাকে জুলাইবীবের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান।’
তখন তাঁর স্ত্রী বললো, ‘এমন নিঃস্ব ফকিরের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব! দেখতেও তো সে সুন্দর নয়। জুলাইবীবের সঙ্গে আমি মেয়ের বিয়ে দেব না। তাছাড়া আমরা এরচেয়ে ভাল প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি।
মেয়ের বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। রাসূলকে গিয়ে কি বলবেন? যাই হোক সাত পাঁচ ভেবে তিনি যখন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে আসার জন্য অগ্রসর হলেন তখন ঘরের ভেতর থেকে মেয়ে জানতে চাইল, ‘আপনাদের কাছে কে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।’
তারা বললেন, ‘রাসূল (সাঃ)।’
মেয়েটি বললো, ‘আপনারা রাসূল (সাঃ)-এর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে চাইছেন? আমাকে রাসূল (সাঃ)-এর সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিন। তিনি কখনোই আমার জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।’
মেয়ের কথায় বাবা খুব খুশি হলেন। মাও তা মেনে নিলেন। বাবার দুশ্চিন্তা দূর হলো। মেয়ের বাবা নিশ্চিন্তে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়ের দায়িত্ব আপনার ওপর অপর্ণ করলাম। আপনি চাইলে তাকে জুলাইবীবের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারেন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ রাসূল (সাঃ) তাকে জুলাইবীবের সঙ্গে বিয়ে দিলেন এবং তাদের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! তাদের ওপর তুমি অজস্র কল্যাণ বর্ষণ কর এবং তাদের জীবনকে তুমি দুঃখময় কর না।’
কিছুদিন পর রাসূল (সাঃ) এক গযওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। জুলাইবীবও রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন। যুদ্ধ শেষে সবাই সঙ্গীদের তালাশ করতে লাগলেন। কারো কারো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি কাউকে খুঁজে পাচ্ছ না?’ সাহাবীরা বললেন, ‘আমরা অমুক অমুককে খুঁজে পাচ্ছি না।’
রাসূল (সাঃ) কিছু সময় চুপ থেকে আবার বললেন, ‘তোমরা কার সন্ধান পাচ্ছো না?’ তারা বললো, ‘আমরা অমুক অমুকের সন্ধান পাচ্ছি না।।’
রাসূল (সাঃ) আবারও চুপ থেকে বললেন, ‘আমি তো জুলাইবীবকে দেখছি না।’
এবার সবাই তাঁর সন্ধানে নেমে পড়ল। যুদ্ধের ময়দানে নিহতদের মধ্যে তাকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল একটু দূরে। তাঁর আশে-পাশে পড়েছিল সাতজন মুশরিকের লাশ। তাদেরকে হত্যা তিনি শাহাদাতের শরাব পান করেছেন।
রাসূল (সাঃ) তাঁর লাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘সে সাতজনকে হত্যা করার পর শহীদ[2] হয়েছে। সে সাতজনকে হত্যা করার পর শহীদ হয়েছে। সে আমার, আমি তাঁর। ’
রাসূল (সাঃ) তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে কবর খননের আদেশ দিলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা কবর খুঁড়ছিলাম। আর জুলাইবীবের লাশ কাঁধে নিয়ে রাসূল (সাঃ) দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূলের কাঁধই ছিল তাঁর খাট! কবর খোঁড়া শেষ হলে রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে তাকে কবরে শুইয়ে দিলেন।’
আনাস (রাঃ) বলেন, জুলাইবীবের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য আনসারী সাহাবীদে মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল।’
এভাবেই রাসূল (সাঃ) প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর রুচি ও প্রকৃতির অনুকূল বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ কারণে রাসূলের কাছে বসে তাঁর কথা শুনতে কেউ বিরক্ত হতো না।
রাসূল (সাঃ) একদিন আয়েশা (রাঃ)-এর পাশে বসলেন। তিনি তাঁর সঙ্গে কিছু সময় গল্প করবেন। তাকে আনন্দ দেবেন।
বলুন তো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো বিষয়ের আলোচনা সবচেয়ে অনুকূল? তাঁর সঙ্গে কি রাসূল (সাঃ) রোমের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন? নাকি অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছিলেন?
এ ধরনের বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাসূল (সাঃ) আদৌ আলোচনা করেন নি। কারণ আয়েশা তো আর আবূ বকর নন যে তাঁর সাথে রাজনীতি বা যুদ্ধনীতি নিয়ে আলোচনা করবেন।
রাসূল কি তাঁর সঙ্গে মুসলমানদের অভাব অনটন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন? না, এ বিষয়েও রাসূল (সাঃ) আলোচনা করেন নি। কারণ তিনি তো আর ওসমান নন।
তিনি আয়েশার সঙ্গে দাম্পত্যসুলভ ভালবাসার কথা বলেছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যখন আমার ওপর সন্তুষ্ট থাক তখন আমি তা বুঝতে পারি। আবার আমার ওপর রাগ করলেও তা অনুভব করতে পারি।’
আয়েশা রাযি বললেন, ‘কিভাবে?’
রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি যখন সন্তুষ্ট থাক তখন কসম খেতে চাইলে বল, ‘মুহাম্মদের রবের কসম!’ আর যখন আমার ওপর রেগে থাক তখন বল, ‘ইবরাহীমের রবের কসম!’
আয়েশা (রাঃ) বললেন, ‘আপনি ঠিক বুঝতে পেরেছেন। তবে আল্লাহর কসম! রাগের মুহূর্তে আমি আপনার নামটিই কেবল উচ্চারণ করি না।
আমরা কি আজ এ সুন্নাতটির অনুসরণ করতে পারি না?
দৃষ্টিভঙ্গি…
আপনি যা বলে আনন্দ পান তা নয়, বরং মানুষ যা শুনতে পছন্দ করে, সে প্রসঙ্গে কথা বলুন।
[1] মদিনা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম।
[2] শহিদ’ (আরবি: شهيد šahīd, বহুবচনে: شُهَدَاء শুহাদাʾ ; স্ত্রীবাচক: শাহিদা) শব্দটি হলো পবিত্র কুরআনের তথা আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো সাক্ষী। এছাড়াও এর অন্য অর্থ হলো আত্ম-উৎসর্গ করা। উৎসঃ উইকিপিডিয়া
এরপর পড়ুন :
উৎস : জীবনকে উপভোগ করুন বই থেকে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি সম্মানিত লেখকের “স্থান-কাল-পাত্রভেদে কথা বলুন” আর্টিকেলটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে। এটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.