তরুণ তরুণীদের জন্য সোনালী উপদেশ মালা

সোনালী উপদেশ মালালেখক মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম তাঁর হৃদয় গলে সিরিজের ২৫তম বই আদর্শ যুবক যুবতী ১ বইতে এই প্রজম্মের তরুণ-তরুণীদের জন্য কিছু সোনালী উপদেশমালা লিখেছেন। আমার বাংলা পোস্ট.কম ব্লগের পাঠক/পাঠিকাদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো। 

তরুণ তরুণীদের জন্য ১৮টি সোনালী উপদেশ মালা

০১. সংযমী হোনঃ যৌবনের প্রারম্ভের সময়টা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় কঠোর সতর্কতা অবলম্বন না করলে যে কোনো মুহূর্তে বিপদগামী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ সময় যৌবন সম্পর্কের ছেলেমেয়েদের অভিজ্ঞতা থাকে না। লজ্জার কারণে বড়রাও এ ব্যাপারে তাদেরকে কোনো উপদেশ দেন না বা দিতে পারেন না। একই কারণে তারাও বড়দের কাছে কিছু জানার সাহস পায় না। অথচ এ সময়টা এতই আশঙ্কাজনক ও গুরুত্বপূর্ণ যে, কেউ যদি এ সময়ে নিজেকে সুসংযত ও সুনিয়ন্ত্রিন করতে না পারে, যদি লিপ্ত হয়ে পড়ে নিন্দনীয় ও নোংরা অভ্যাসে, তবে তাঁর জীবনটা সবদিক থেকেই পঙ্গু ও অকেজো হয়ে যায়। ভবিষ্যতে সে জীবন-মরণের দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয়। পাপের বোঝা মাথায় চাপে। স্বভাব নষ্ট হয়। স্বাস্থ্যের হানি ঘটে। সম্পদও বিনষ্ট হয়।

যৌবন হলো পাগলামির অংশ বিশেষ।-(হাদিস)

হাদীস শরীফে আছে—“যৌবন হলো পাগলামির অংশ বিশেষ।” অতএব এ পাগলামী ও উন্মত্ততার ঢেউকে সংযত রাখার জন্য অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। ছেলে-মেয়েদের যৌবন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চাহিদা ও হরেক রকমের কামনা-বাসনা উথলে উঠে। এ সময় দেহে এক নব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মনে জাগে নতুন নতুন চাহিদা। মনে চায়, সুন্দর বালক-বালিকা দেখতে। ওদেরকে কাছে রাখতে। ওদের কথা শুনতে। এছাড়া আরো কত কি! স্মরণ রাখতে হবে-মনের এই চাহিদা মেটানো—বড় পাপ—কঠিন গোনাহ—মারাত্মক ক্ষতি—এমন ক্ষতি ও গোনাহ যে, ইহ জনমে তাঁর আর তদারক হতে পারে না। অর্থাৎ এসব পাপের দ্বারা ভবিষ্যত জীবন এমনভাবে নষ্ট হয় যে, জীবনে আর তাঁর প্রতিকার হতে পারে না। অতএব মনের এ ধরনের চাহিদার সময় দেহ ও মন উভয়কে চেপে, জোর জবরদস্তি করে সংযত রাখতেই হবে। একেই বলা হয় সংযম অভ্যাস। যতবার মনের মধ্যে এরূপ চাহিদা জন্ম নিবে, ততবারই সংযম অভ্যাসের দ্বারা মন ও দেহকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এসব পাপ কাজে জড়ানো যাবে না। যে কোনো মূল্যে দেহ ও মনকে রক্ষা করতেই হবে। উল্লেখ্য যে, সংযমী হওয়া বা সংযমের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য যুবক-যুবতীদেরকে নিম্নে দু’টি কাজ অবশ্যই করতে হবে। অন্যথায় এ অভ্যাস গড়ে তোলার ইচ্ছা—ইচ্ছাই থেকে যাবে। বাস্তবায়িত হবে না কখনো।

(ক) অসৎসঙ্গ বর্জন করুনঃ দেহ ও মনকে পবিত্র রাখার মানসে সংযম অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো, অসৎসঙ্গ বর্জন। সাপের সংসর্গ গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু তবু কুসৎসর্গ গ্রহণ করা যাবে না। কারণ সাপের দ্বারা হয়তো মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন ধ্বংস হয়। কুসংসর্গ অবলম্বন মানব জীবনের বিরাট এক ভুল-যার মাশুল তাকে আজীবন দিতে হয়। শুধু তাই নয়, পরিণামে পরকালেও তাকে ভোগ করতে হয় কঠিন থেকে কঠিনতর সাজা। তাই আপনি যার সাথে চলাফেরা করবেন কিংবা যাকে বন্ধু বানাবেন বলে মনস্থ করেছেন—তার সাথে চলাফেরা বা তাকে বন্ধু বানানোর আগে অবশ্যই যাচাই করে নিবেন। যদি দেখেন যে—তার চরিত্র ভাল নয়, নামাজ পড়ে না কিংবা পড়ে অলসতা করে, মিথ্যা কথা বলে, পিতা-মাতার অবাধ্য; তাদের কথা শুনে না, পড়াশুনায় ফাঁকি দেয়, সময় নষ্ট করে, গল্প-গুজব ও আড্ডার ব্যাপারে বেশ মনোযোগী, সিনেমা-টিভির দারুণ ভক্ত, গালিগালাজ করে, বেহুদা কথা বলে ইত্যাদি—তাহলে এরূপ ব্যক্তির সাথে চলয়াফেরা বা বন্ধুত্ব করবেন তো দূরের কথা, বরং তাঁর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থান করবেন। বন্ধুত্ব করার উদ্দেশ্যে এরূপ লোকের ছায়াও কোনোদিন মাড়াবেন না।

(খ) সংসঙ্গ অবলম্বন করুনঃ সংযম অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় যে কাজটি আপনাকে করতে হবে তা হলো, সৎসঙ্গ অবলম্বন। কথায় বলে—সৎসঙ্গে স্বর্গে বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তাই আপনি যে লোকটির সাথে উঠাবসা করবেন, যাকে আপনি বন্ধুত্বের আসনে সমাসীন করবেন, তাকে অবশ্যই পরখ করে নিবেন যে, সে সৎ কিনা। সংযমী কিনা। তাঁর চরিত্র ভালো কিনা। দীনদার কিনা। ইসলামী বিধি-বিধান পালনে আগ্রহী কিনা। মনে রাখবেন, সে যদি আপনার চাইতে বেশি দীনদার হয়, চরিত্রগত দিক থেকে আপনার চাইতে অগ্রগামী হয়, মুত্তাকী-পরহেযগার হয়—তবেই তাকে বন্ধু বানাবেন। তাঁর সাথে চলাফেরা করবেন। এতে তাঁর উত্তম স্বভাব ও আচরণগুলো আপনার মধ্যে ধীরে ধীরে চলে আসবে। তখন আপনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন যে, আপনিও তাঁর মতো সংযমী হয়ে গেছেন। হয়ে গেছেন—দীনদার, পরহেযগার ও আল্লাহওয়ালা। আর এটাই তো আপনার পরম পাওয়া! প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষ তাঁর বন্ধুর মত ও পথের অনুসারী হয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে দেখে যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে”।

০২. সিনেমা-টিভি থেকে দূরে থাকুনঃ প্রতিটি যুবক-যুবতিকে অসৎ সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধব থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের পাশাপাশি সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশন, নাচ, গান ও অশ্লীল চিত্রসহ বিভিন্ন ধরনের চরিত্র বিনাশী উপকরণ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। কারণ এসব জিনিস মানুষের মূল্যবান ঈমান ও আমল নষ্ট করার জন্য এতই সুক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে কাজ করে যে, অনেকে তা টেরও পায় না। কারো কারো মন-মানসিকতার বিকৃতি ঘটে। কোনো কোনো সময় এই বিকৃতির মাত্রাটা এতই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তা সংশোধন করা নিতান্তই কঠিন বরং এতই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তা সংশোধন করা নিতান্তই কঠিন বরং অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে তাঁর ইজ্জত সম্মান বিনষ্ট হয়। ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ে—সকল সুখের মূল-স্বাস্থ্য। তখন সে না দুনিয়ার কোনো কাজ করে আরাম পায়; না আখেরাতের কাজ করে আনন্দ অনুভব করে। জীবন তখন তাঁর কাছে দুর্বিসহ ও নিরানন্দ হয়ে উঠে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে যুবকরা তাদের বিবাহ করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মতোই তাঁর যৌবন শক্তির অকাল মৃত্যু ঘটে। কখনো বা আক্রান্ত হয় গনোরিয়া, সিফিলিস না এইডস জাতীয় ধ্বংসাত্মক ব্যাধিতে। তাই ক্ষণিকেই আনন্দের জন্য এসবের পিছনে না পড়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

০৩. লেখক যাচাই করে বই পড়ুনঃ বই নিঃসন্দেহে আমাদের উত্তম বন্ধু। শিক্ষা সাহিত্য আর বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বই। বিশুদ্ধ বোধ-বিশ্বাস, সুস্থ-চিন্তা-চেতনা আর মানবিক আবেদনকে অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি চমৎকার বাহন বই। কিন্তু বাস্তবতার বিচারে কোনো কোনো বই আমাদের বন্ধু তো নয়—ই, বরং শত্রু—চিরশত্রু। যা পড়ে নানা অনৈতিক ও অসুন্দর চিন্তা আমাদের মাথায় আসে। ফলে আমরা হারিয়ে ফেলি সত্য-সুন্দরের আলোকিত পথটি। বই সম্পর্কে এ কথাগুলো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জানা সত্ত্বেও অনেকেই আমরা বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা সচেতন হচ্ছি না। হাতের কাছে যা-ই পাচ্ছি, বাছ-বিচার না করে তা—ই পড়ে ফেলছি। এমনকি আজকাল ইসলামী মূল্যবোধে সমৃদ্ধ অনেক পরিবারেও যাচাই-বাছাই না করে বই পড়ার এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বই পড়ার সময় অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকা খেয়াল করেন না যে, বইটি কে লিখেছেন, কী লিখেছেন। যা লিখেছেন তা আমাদের জন্য কতটা কল্যাণকর; অন্তত নির্মুল আনন্দদানের  জন্য বইটি কতটুকু সক্ষম—এসব বিবেচনায় নিচ্ছি না মোটেও। আজকাল যুবক-যুবতীরা চরিত্রহীন নায়ক-নায়িকা ও তাদের নীতিহীন সংলাপে ভরা নাটকের বই গোগ্রাসে গিলছে। বামপন্থী লেখকদের প্রেম-কাহিনী সম্বলিত গল্প-উপন্যাস পড়ে কলুষিত করছে মন ও মগজ। এসব বাজে বই পড়ে প্রেম কীভাবে করতে হয়, কীভাবে প্রেমখেলা খেলতে হয়—তা তো শিখছেই, সেই সাথে প্রেম না করলে, প্রেম খেলা খেলতে না পারলে, জীবনটাই যেন বৃথা—এ ধরনের একটা মন-মানসিকতাও সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে তাদের অজ্ঞাতসারে। অথচ বিবাহপূর্বে প্রেম-ভালোবাসা সম্পূর্ণ হারাম—নাজায়েয—অবৈধ। ইসলামী শরীয়তে কোনো অবস্থাতেই তা বৈধ নয়। তাই সকল মুসলমানকে বিশেষ করে যুবক-যুবতী ভাইবোনদের অনুরোধ করে বলছি—আপনারা যাচাই বাছাই করে বই পড়বেন। বামপন্থী লেখক, ইসলাম বিদ্বেষী লেখক এবং ঐসব লেখক যাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়, যারা কেবল টাকা উপার্জন ও বাহবা কুঁড়ানোর জন্য বই লিখে তাদের বইগুলো স্বর্ণের হরফে লেখা হলেও তা সযত্নে পরিহার করে চলবেন। এসব বই কিনে পড়বেন না। এমনকি বিনামূল্যে পেলে কিংবা কেউ উপহার দিলেও পড়বেন না। এ নিয়তেও পড়বেন না যে, আচ্ছা দেখি না—তাতে কী আছে। কারণ, লেখক তাঁর সুক্ষ্মবুদ্ধির ম্যারপ্যাঁচ কখন যে আপনাকে বিভ্রান্ত করে ফেলবেন, কীভাবে যে আপনার যেহেন ও মস্তিঙ্ককে ধোলাই করে নিবেন, তা হয়তো আপনি ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাবেন না। অনেক সময় টের পেলেও আপনি তখন সন্দেহের মধ্যে নিপতিত হবেন। যা আপনাকে পেরেশান করবে। তাই সহজ কথা হলো, আপনারা এসব লেখকদের বই পড়বেন না এবং এতসব ঝামেলায় পতিত হওয়ার ঝুঁকিও নিবেন না। হ্যাঁ, যদি ভালো লেখক চিনতে কার প্সুবিধা হয়—তাহলে কোনো ভালো আলেমকে বইটি দেখিয়ে তাঁর অনুমতি নিয়ে তারপর পড়বেন। [যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে মনে চাইলে আমার কাছে ফোন করতে পারেন। আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি।]

০৪. পৃথক বিছানায় শয়ন করুনঃ যৌবনকাল শুরু হওয়ার কয়েক বছর পূর্ব থেকেই অর্থাৎ সাত-আট বছর বয়স থেকেই ভিন্ন বিছানায় শয়ন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এমনকি আপন ভাইবোনদের সাথেও বিছানায় শয়ন করা যাবে না। (উল্লেখ্য যে, এ বয়সে যেহেতু ছেলে-মেয়েরা কোথায় রাত্রি যাপন করবে, তা পিতা-মাতা ও অভিভাবকরাই নির্ধারণ করে থাকেন, তাই এ বিষয়টির প্রতি তাদেরকেই সযত্নে ও কড়া দৃষতি রাখতে হবে। অনুরূপভাবে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে এমন নির্জন কক্ষে পৃথক বিছানায়ও শুইতে দেওয়া উচিত নয়, যে কক্ষে অন্য আর কেউ থাকে না। কারণ এর ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অস্থিরতা ও কুচিন্তা সৃষতি হতে পারে। যা ডেকে আনতে পারে নানাবিধ ক্ষতি ও অমঙ্গল। হ্যাঁ, প্রয়োজনে সকলের সাথে একই কক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বিছানায় শুইতে দেওয়ার অসুবিধা নেই।)

০৫. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্থ হোনঃ যৌবনের সূচনাতে দেহের পরিচ্ছন্তার প্রতি বিশেষ করে বিশেষ অঙ্গের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় ময়লা জমা হয়ে সেখানে খুঁজলি-পাঁচড়া হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন রকম চর্মরোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর চর্মরোগ হয়ে গেলে সেখানে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চুলকাতে হয়। যার ফলে খাহেশাত সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন রকম ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা দেখে দেয়। এ ক্ষেত্রে নাভীর নীচের পশম পরিস্কার রাখার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

০৬. যে কোনো ভালো কাজে নিমগ্ন থাকুনঃ প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি লোককে যে কোনো একটি ভালো কাজে লিপ্ত থাকা চাই। কেননা বেকারত্ব মানুষকে বিশেষ করে যুবক-যুবতীকে নষ্ট করতে দারুণ ভূমিকা পালন করে। কথায় বলে, “অলস মস্তিঙ্ক শয়তানের আড্ডাস্থাল”। কোনো এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন—“বেকার থাকা একটি নিকৃষ্টতম কাজ”। তাই দিনের চব্বিশটি ঘন্টা কোনো না কোনো কাজে লেগে থাকতে হবে। হয়তো নামাজ পড়ুন, নয়তৈ তিলাওয়াত করুন। অথবা জিকিরে মশগুল থাকুন। কিংবা অন্য কোনো কাজ যেমন, পড়াশুনা, নিজ নিজ পেশাদারীর কাজ, গৃহস্থালীর কাজ, পিতা-মাতাকে তাদের কাজে সহায়তা করা, ব্যায়াম, হাঁটাহাটি, কোনো মুসলমানকে সাহায্য করা, ঘুমানো, দীনি দাওয়াত, বয়ান, তালীম, দরস ইত্যাদি কর্মে নিজকে মশগুল রাখুন। যেন খারাপ কাজ কিংবা খারাপ চিন্তা করার কোনো সুযোগই না পাওয়া যায়। এতে একদিকে যেমন আপনার সময়ের হেফাযত হলো, তেমনি অন্যদিকে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রভূত কল্যাণও লাভ হলো। হাদীস শরীফে আছে—কিয়ামতের দিন সাত প্রকার লোক আল্লাহ পাকের আরশের নীচে ছায়া পাবে। তন্মেধ্যে এক প্রকার লোক হলো ঐসব যুবক যারা যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদত করে। অন্য হাদীসে আছে, হাশরের ময়দানে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত আপন স্থান থেকে বিন্দু পরিমান সরতে পারবে না। সেই পাঁচটি প্রশ্নের একটি হলো, তোমার যৌবনকাল কি কাজে ব্যয় করেছ? যেহেতু আল্লাহ পাকের কাছে যৌবনকালের মূল্য অনেক বেশি তাই আমরা এ কালটাকে অবহেলা বা অন্যায়কর্মে ব্যয় না করে ভালো কাজে ব্যয় করি।

০৭. অপচয় থেকে বিরত থাকুনঃ হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—“অহঙ্কার ও অপচয় না করে তোমরা খাও, পান করো, পরিধান করো এবং দান করো। কেননা আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার উপর তাঁর নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন”। [আহমাদ]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি, বলেন, “তুমি যা খেতে চাও খাও, যা পরিধান করতে চাও পরো; যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি বিষয় তোমাকে পেয়ে না বসে। ১ অপচয়, ২ অহঙ্কার”। [তাফসীরে ইবেন কাসীর ২/২৩৫]

এ ধরনের আরো বহু বর্ণনা রয়েছে যদ্বারা একথা পরিস্কার বুঝে আসে যে, আল্লাহ তাআলার নেয়ামতকে যথাযথভাবে উপভোগ করা নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা আল্লাহ পাকের দেওয়া নেয়ামত সমূহকে যথা নিয়মে ভোগ না করে যে দুটি বিষয় ও উপায়কে নিষেধ করা হয়েছে সে দুটিকেই আমরা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছি।

আজকাল লোকদের মাঝে বিশেষ করে যুবক-যুবতীদের মাঝে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যে, প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপর থাকা সত্ত্বেও মার্কেটে কোনো নতুন পোশাকের আমদানী ঘটলেই তা কেনার জন্য তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ তারা জানে না যে, এটা অপচয়ের একটি স্পষ্ট ক্ষেত্র। এ অপচয় থেকে অবশ্যই বাঁচতে হবে। সেই সাথে মনে রাখতে হবে, শুধু অধিক দামের বিবেচনায় কোনো পোষাক ক্রয় করা যেমনি অপচয় তেমনি অহঙ্কারের বহিঃপ্রকাশও বটে।

০৮. আজই স্বর্ণালঙ্কার খুলে ফেলুনঃ স্বর্ণালঙ্কার মহিলাদের পোষাকতুল্য। কিন্তু বর্তমানে অনেক যুবক ভাইদেরকে দেখা যায়—স্বর্ণের চেইন, স্বর্ণের আংটি, রূপার বালা ইত্যাদি পরিধান করে থাকেন। আবার অনেকে এগুলো পরিহিত অবস্থায় নামাজও আদায় করেন। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে না জানার কারণেই তারা এমনটি করে থাকেন। যদি জানতেন তাহলে কখনোই এরূপ করতেন না।

স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো, স্বর্ণ বা রূপার চেইন, আংটি বা অন্য যে কোনো অলংকার পরিধান করা পুরুষদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গুনাহ। এসব নিয়ে নামাজ পড়া আরো মারাত্মক অপরাধ। এগুলো নিয়ে নামাজ আদায় করলে যদিও তা দায় হবে, কিন্তু উক্ত কবীরা গুনাহে লিপ্ত থেকে নামাজ আদায়ের দরুণ তা মাকরুহে তাহরীমি হবে। তাই পুরুষগণ নামাজের ভিতরে কিংবা বাইরে—কোনো সময়ই এসব অলঙ্কার পরিধান করবেন না। [তিরমিযি শরীফ ১-৩০২, ফাতাওয়ায়ে শামী ১-৪০৪, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১-৩০৪, আহসানুল ফাতাওয়া ৩-৪১৩, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম ৪-১৩৪]

৯. বিবাহ অনুষ্ঠানে গেইট নির্মাণ করবেন নাঃ আজকাল আমাদের দেশে রেওয়াজ হয়ে গেছে যে, কনেপক্ষের কিছু যুবক মিলে কোথাও কোথাও কনের অভিভাবকরাই বিয়ের দিন বাড়ির প্রবেশ দ্বারে সুসজ্জিত গেইট নির্মাণ করে। অতঃপর গেইট দিয়ে প্রবেশকালে বরপক্ষের লোকদের থেকে টাকা আদায় করে। মনে রাখবেন, এভাবে গেইট নির্মাণ করায় অপচয় হওয়ার কারণে এবং বিজাতীয় প্রথা অনুকরণের দরুণ তা নিষিদ্ধ। তাছাড়া কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে টাকা উসুল করাও হারাম। তাই এসব থেকে বিরত থাকা জরুরি। যদি টাকা উসুল না কর হয় তবু প্রথা হিসেবে বিয়ে উপলক্ষে গেইট নির্মাণ করা যাবে না। আল্লাহ পাক আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। [তারগীব ও তারহীব ৩-১৯, আসসুনানুল কুবরা ৬-১০০, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ১২-৩৯৪, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১-১৭৯]

১০. অতিরিক্ত চুল সংযোজন থেকে বিরত থাকুনঃ অনেক মেয়েকে দেখা যায়, তাদের মাথার চুল কম থাকার কারণে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম চুল কিনে মাথায় সংযোজন করে। মনে রাখবেন, সংযোজনকৃত চুল যদি কোনো মানুষের হয় তবে তা ব্যবহার করা জায়েয নয়। বরং হারাম ও কবীরা গোনাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের লোকদের প্রতি লানত করেছেন। অবশ্য সংযোজনকৃত চুল যদি কোনো মানুষের না হয়ে প্ল্যাস্টিক জাতীয় হয় বা অন্য কোনো প্রাণীর হয়, তাহলে  তা ব্যবহার করা জায়েয হবে। [সাওসানুল ফাতাওয়া, দ্বিতীয় খণ্ডঃ ৭৭ পৃষ্ঠা]

১১. পর্দায় থাকুনঃ অনেক মেয়েরা পর্দা করে না বা পর্দা করতে চায় না। বিশেষ করে যুবতী মেয়েরা। আসলে পর্দা করা যে কতটুকু প্রয়োজন, অন্তত নিজের কল্যাণের জন্য, তা যদি তারা বুঝত, তাহলে কোনোদিন তারা বেপর্দায় থাকত না, বেপর্দা হয়ে ঘোরাফেরা করত না। মহান আল্লাহ পাক নারী-পুরুষ উভয়ের অসীম মঙ্গলের কথা বিবেচনা করেই পর্দার এই বিধানকে ফরজ করে দিয়েছেন। প্রিয় বোনেরা! আপনারা একটু লক্ষ্য করে দেখুন, একটি জাহাজ চলার জন্য পানি ও আগুন উভয়ের প্রয়োজন হয়। তবে উভয়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে। এবার কেউ যদি অতি দ্রুত জাহাজ চালানোর জন্য আগুন ও পানিকে একত্রিত করে ফেলে, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতে পারে তা আপনারাই একটু চিন্তা করে দেখুন।  তখন কি জাহাজ পানির উপর দিয়ে চলবে? নাকি সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে? অনু্রূপভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ে যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আপন আপন দায়িত্ব পালন করে তাহলে পরিবার, সমাজ, দেশ—এক কথায় গোটা পৃথিবী সুখী ও সমৃদ্ধশালী হবে। কিন্তু এই নারী পুরুষ যদি একত্রিত হয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যায়, তাহলে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র কস্মিনকালেও সুখ-সমৃদ্ধির পথে এগুতে পারবে না । বরং যেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ-ছিনতাই, ফেতনা-ফাসাদ, বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে গোটা দেশ ও সমাজ ধবংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে বাধ্য হবে। প্রিয় বোনেরা! আপনারা যদি আরেকটু চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন যে, যে সব বস্তু মৌলিকভাবে দুর্বল; যা খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে, সেসব বস্তুকে সর্বদাই বিশেষভাবে হিফাযত করতে হয়। আর সেসব বস্তু মৌলিকভাবে মজবুত ও দৃঢ় সেগুলোকে তেমন একটা হেফাযতের প্রয়োজন হয় না। যেমন, ইট ও সিমেন্ট। ইট যেহেতু মৌলিকভাবেই মজবুত ও শক্ত; আলো, বাতাস, পানি ইত্যাদি কোনো কিছুই উহাকে বিনষ্ট করতে পারে ,আ তাই তাকে ঘরে না এনে বাইরেই রাখা হয়। উহাকে সংরক্ষণের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। পক্ষান্তরে সিমেন্ট হলো, কোমল ও স্পর্শকাতর বস্তু যা পানি লাগলে গলে যায়, বাতাস লাগলে জমাট বেঁধে যায়। এটা মৌলিকভাবেই দুর্বল। এ কারণেই তাঁর হেফাযতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ মজবুত প্যাকেটের ভিতর রেখে পানি ও বাতাস থেকে দূরে রাখা হয়। যাতে তা গলে যেতে কিংবা জমাট বাধতে না পারে। অনুরূপভাবে নারী ও পুরুষ। ওদের মধ্যে পুরুষ হলো মজবুত ও শক্তিশালী আর নারী হলো কোমল ও দুর্বল প্রকৃতির; তারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে, সহজেই গলে যায়। তাই কোমল বস্তু সিমেন্টকে হেফাযত করার জন্য যেমন মজবুত প্যাকেটের প্রয়োজন, তেমনি নারীকে রক্ষার জন্যও পর্দার প্রয়োজন। তাই মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা নারী জাতির প্রতি দয়া পরবশ হয়েই তাদের জন্য পর্দার বিধানকে অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। যাতে এই দুর্বল জাতি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয়, জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় না হয়—তাদের কামনার তপ্ত অনলে।

অনেকেই পর্দাকে অবরোধ মনে করে। আসলে যারা পর্দাকে অবরোধ মনে করে তারা আসলে অবরোধ কাকে বলে তা-ই জানে না। যদি জানত, তাহলে কখনোই তারা পর্দাকে অবরোধ কিংবা বন্দীত্ব বলত না। অবরোধ বলা হয়, মানুষকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আবদ্ধ করে রাখা। যেখানে থাকা না চলার অধিকার, বলার অধিকার; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার অধিকার। এ হিসেবে পর্দাকে তো কোনোভাবেই অবরোধ বলা যায় না। কেননা পর্দার বিধান নারীদেরকে এসব অধিকার থেকে কখনোই বঞ্চিত করে না। নারী তাঁর প্রয়োজনে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে। যা খুশি তা খেতে পারে, পরতে পারে। হ্যাঁ, ইসলাম শুধু এতটুকু বলে যে, হে নারী! তুমি তোমার প্রয়োজনে বাইরে যাও তবে পর্দা করে, শরীরটা ভালো করে ঢেকে তারপর যাও। তুমি তোমার মাহরামদের ছাড়া অন্যান্য পুরুষদের সাথে খোলামেলা দেখা করো না। বরং পর্দার সাথে দেখা করো। ওদের সাথে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কথাও বলো না। এতে তুমি হিফাযত থাকবে। হিফাযতে থাকবে তোমার ইজ্জত-সম্ভ্রম। এক হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—নারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্দাবৃত থাকা উচিত। যখন কোনো নারী বেপর্দা হয়ে বাইরে বের হয়, তখন শয়তান তাঁর পিছু নেয়। [তিরমিযি শরীফ]

তাই মা-বোনদেরকে অনুরোধ করে বলছি, আপনারা আজ এবং এখন থেকেই পর্দার বিধান পালন করতে শুরু করুন। বিশেষ কারণে বাইরে যেতে হলে, বোরকা পরে চেহারা ঢেকে তারপর যান। নিজ বাড়িতে অবস্থানকালেও কঠোরভাবে পর্দার প্রতি খেয়াল রাখুন। সব সময় সতর্ক থাকুন—কোনো বেগানা পুরুষ যেন আপনাকে কিছুতেই দেখতে না পারে। আল্লাহ পাক আপনাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

১২. বাংলা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকুনঃ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল আমাদের অনেক ভাই-বোন মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও আরবী পড়তে জানেন না। তাই তারা বাজার থেকে বাংলা উচ্চারণ সমৃদ্ধ কুরআন শরীফ কিনে আনেন এবং তা তিলাওয়াত করতে থাকেন। অথচ হক্কানী উলামায়ে কেরামের ফাতাওয়া হলো—বাংলায় উচ্চারণকৃত কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করলে কোনো সাওয়াব হবে না। এমনকি বাংলায় উচ্চারণ করে কুরআন শরীফ লিখাও জায়েয নয়। কারণ বাংলাতে সহীহভাবে আরবী হরফের উচ্চারণ সম্ভব নয়। কেননা আরবী কয়েকটি হরফের বাংলা উচ্চারণ একরকম। সেক্ষেত্রে বাংলায় আরবী হরফগুলো পার্থক্য করা এবং এবং সহীহ মাখরাজ থেকে উচ্চারণ করা কঠিন। তাছাড়া এটা এক প্রকার কুরআন বিকৃতির মধ্যেও শামিল। তাই বাংলায় কুরআন শরীফ পড়া ও লিখার অনুমতি নেই। কাজেই যারা সহীহভাবে কুরআন পড়তে জানেন না, তাদের উচিত কোনো সহীহ পড়নেওয়ালা ক্বারী সাহেবের কাছ থেকে সরাসরি শিখে নেওয়া। দুনিয়ার কাজের জন্য আমরা কত সময়ই তো ব্যয় করি। আর আল্লাহর কালাম, কিয়ামতের দিন যার সুপারিশ কবুল করে নেওয়া হবে, যার প্রতিটি হরফ পাঠে দশটি করে নেকী হয়; তদুপরি যা শুদ্ধ না হলে গুরুত্বপূর্ন ইবাদত নামাজই শুদ্ধ হয় না—তা শেখার জন্য কিছু সময় বের করা, কিছু কষ্ট বরদাশত করা আমাদের জন্য জরুরি নয় কি? অবশ্যই। অবশ্যই। অবশ্যই। তবে খুশির কথা হলো, আজকাল নূরাণী ও  নাদিয়া পদ্ধতিতে অল্প সময়ে (মাত্র ২০/২৫ দিনে) সহজে কুরআন শরীফ শিক্ষা করা সম্ভব। তাছাড়া তাবলীগ জামাতে কিছু সময় লাগানোর দ্বারাও কুরআন পড়া সহীহ করার ব্যবস্থা হতে পারে। তাই আসুন, আমরা আল্লাহর কালামের মহব্বতে সহীহ তরীকায় তা শিক্ষা করার ফিকির করি। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। [ইমদাদুল ফাতওয়া ৪:৪৫-৪৭ , জাওয়াহিরুল ফিকহ ১:৭৭, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১:২৯২]

১৩. ‘মানি ইজ দ্যা সেকেন্ড গড’ বলবেন নাঃ সেদিক এক লোকের সাথে হাঁটতে  হাঁটতে কথা বলছিলাম। কথাবার্তার এক পর্যায়ে টাকা প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে গিয়ে তিনি বললেন, আরে ভাই! আপনি কি জানেন না, মানি ইজ দ্যা সেকেন্ড গড। অর্থাৎ টাকা হলো দ্বিতীয় খোদা। নাউযুবিল্লাহ। প্রিয় পাঠক! এ কথাটি অনেকের মুখেই শুনা যায়। অথচ এটি কুফুরী কথার অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ পাক এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনই তিনি পুরা করেন। তিনিই বান্দাকে রিযিক দেন। সুতরাং টাকা-পয়সাকে দ্বিতীয় খোদা বলার কোনো অবকাশ নেই। তাই ইতোপূর্বে যারা না বুঝে এ বাক্যটি বলেছেন, সতর্কতা হিসেবে তাদের জন্য উচিত হবে—আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তিগফার করা, ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন করে কালিমা পড়ে স্ত্রী থাকলে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়া। [খাইরুল ফাতাওয়া ১ : ২০২, বাহরুর রায়িক ২ : ৫২০, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১ : ৮৪]

১৪. আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিলে শরীক হবেন নাঃ আমাদের এ উপমহাদেশে কারবালা মর্মান্তিক ঘটনাকে উপলক্ষ করে যে তাজিয়া মিছিলের মাতম করা হয়, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও মারাত্মক গোনাহের কাজ। অনুরূপভাবে হায় হুসাইন! হায় হুসাইন!! বলে বুক চাপড়ানো, তাজিয়া স্থাপন, মর্সিয়া-ক্রন্দন প্রভৃতি নাজায়েজ। এসব কাজ মূলত শীয়া ও রাফেজীদের ধর্মীয় রীতিনীতি যা অতি সংগোপনে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। হযরত ইবনে হাজার মক্কী রহঃ বলেন, খবরদার! তোমরা আশুরার দিনে শীয়াদের সৃষ্ট বিদআতে লিপ্ত হয়ো না।  হায় হুসাইন! হায় হুসাইন ইত্যাদি বলে কান্নাকাটি করো না। কারণ এসব কার্যকলাপ মুসলমানদের শোভা পায় না।

অনেকেই মনে করেন, ১০ই মহরম বা আশুরা দিবসের ফজীলত হয়েছে হযরত হুসাইন রাযিঃ-এর শাহাদাত তথা কারবালার ঘটনার কারণে। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ এই ঘটনার বহু পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হওয়ার কারণে পূর্বেকার উম্মত থেকেই এ দিনের ফজীলত চলে আসছে। হ্যাঁ, সাইয়েদুনা হযরত হুসাইন রাযিঃ এর শাহাদাতের জন্য আল্লাহ তাআলা আশুরার এই মুবারক ও মহান দিবসকেই নির্বাচন করেছেন। ফলে তাঁর শাহাদতের ফজিলত ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও ফজিলতপূর্ণ হয়েছে।

আশুরার দিনে পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তাঁর কয়েকটি হলো—এই দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল হয়। এই দিনে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের জাহাজ মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি পেয়ে জুদি পাহাড়ে এসে স্থির হয়। এই দিনে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে চিরমুক্তি হন এবং নীলনদে ফেরআউন ও তাঁর অনুচরবর্গের সলিল সমাধি ঘটে। এই দিনে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর অসীম কুদরতে বাপের ঔরস ব্যতীত মাতৃগর্ভ হতে জন্ম লাভ করেন এবং এই দিনেই তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই দিনে হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে মুক্ত হন এবং এই দিনেই তাঁর কওমের দোয়া কবুল হয়। এই দিনে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কুয়া থেকে বের করা হয় এবং এই দিনেই হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম জটিল রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন। এই দিনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্ম হয় এবং এই দিনেই হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামকে বাদশাহী দেওয়া হয়। [উমদাতুল ক্বারী ১১ : ১১৭-১১৮]

তাই মহান এই দিবসে শোক পালন নয়, মর্সিয়া-ক্রন্দন নয়, বরং হযরত হুসাইন রাযিঃ-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিরোধ ও সত্য প্রতিষ্ঠায় প্রাণ উৎসর্গের জিহাদী চেতনায় জান-মাল কুরবানী করার দীপ্ত শপথ গ্রহণ করুন। সেই সাথে এই দিনের ফজীলত হাসিলের জন্য সুন্নত হিসেবে রোযা রাখুন এবং ইহুদিদের সামঞ্জস্যতা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরো একটি রোযা মিলিয়ে নিন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি আশুরার দিনের রোযা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার কাছে আশা পোষণ করি যে, তিনি উহাকে পূর্ববর্তী বৎসরের গোনাহের কাফফারায় পরিণত করবেন। (মুসলিম শরীফ)

অন্য এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আশুরার দিন যে ব্যক্তি নিজের পরিবারবর্গকে তৃপ্তিসহকারে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সারা বৎসর তৃপ্তিসহকারে খাওয়ার ও পরিধান করার সুব্যবস্থা করে দিবেন। (বাইহাকী শরীফ) তাই এই দিনে রো্যা রাখার পাশাপাশি পরিবারবর্গের জন্য খোরপোষ ইত্যাদিতে সামর্থানুযায়ী বেশি ব্যয় করুন। এই দিনে এটিও একটি সুন্নত কাজ। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। [বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন—আল বিদায়া ৮ : ৪০, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়া ২ : ২৭৩, আসসানুল ফাতাওয়া ১ : ৩৯০]

১৫. কবর পাকা বা তাঁর উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবেন নাঃ কোনো কোনো স্থানে দেখা যায় কোনো পীর সাহেব বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর সম্মানার্থে তাঁর কবরটিকে পাকা করা হয়, টাইলস বা শ্বেত পাথর বসানো হয়। কখনোবা সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। মনে রাখবেন—কবর পাকা করা, কবরের উপর বিল্ডিং বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হারাম। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাই এসব কাজ হারাম হওয়ার কারণে অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকতে হবে। [ফাতাওয়ায়ে শামী ১ : ৬৬২, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১ : ৯৮]

১৬. নবীজিকে আলেমুল গায়েব ও হাজির নাযির মনে করবেন নাঃ আলেম, গায়েব, হাজির, নাজির এই চারটি শব্দের সবক’টিই আরবী শব্দ। এখানে লামে মানে জাননেওয়ালা, অবগত, যিনি জানেন ইত্যাদি।

আর গায়েব মানে অদৃশ্য, অনুপস্থিত, গোপন প্রভৃতি। সুতরাং আলেমুল গায়েব মানে—যিনি পূর্ব অবগতি বা কারো জানানো ব্যতীত নিজে নিজেই প্রকাশ্য গোপনীয়—সবকিছুর খবর জানেন।

অনুরূপভাবে হাজির অর্থ উপস্থিত, বিদ্যমান ইত্যাদি। আর নাজির অর্থ দ্রষ্টা, দর্ষনকারী, দেখনেওয়ালা। সুতরাং হাজির-নাজির শব্দ দুটোর মিলিত অর্থ দাঁড়ায়—ঐ সত্তা যার উপস্থিতি বিশেষ কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একই সময়ে গোটা বিশ্বের সবখানে বিরাজমান এবং একই সাথে বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তুকে সমানভাবে দেখেন। সহজ কথায়, যিনি সর্বদা সব জায়গায় থাকেন ও সবকিছু দেখেন তিনিই হলেন হাজির নাজির।

আলেমুল গায়েব ও হাজির নাজির হওয়ার গুণ একমাত্র আল্লাহ পাকেরই রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কেউ এ গুনে গুণান্বিত নয়। পবিত্র কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা একথা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। হ্যাঁ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতীত ও ভবিষ্যতের শুধু ঐ সকল বিষয়ই অবগত ছিলেন, যেগুলো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবগত করিয়েছিলেন।

আমাদের দেশে একটি ভ্রান্তদল এ ধারণা পোষণ করে যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলেমুল গায়েব ও হাজির নাজির। তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ এসব গুণ আল্লাহ তাআলার সিফত বা বৈশিষ্ট্য। আর আল্লাহ তাআলার কোনো সিফতের সাথে অন্যকে মিলানো পরিস্কার কুফর বা শিরকী কাজ। যেহেতু আলেমুল হায়েব ও হাজির নাজির হওয়া কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট, তাই কোনো নবী বা অলী আলেমুল গায়েব বা হাজির নাজির হতে পারেন না। এটাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা।

প্রিয় পাঠক! আলেমুল গায়েব ও হাজির নাজির প্রসঙ্গটি আমাদের দেশের একটি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ। এ ব্যাপারে আমাদের আক্বীদা বিশ্বাস কেমন হতে হবে তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। আমি ম্নে করি, আক্বিদা দুরস্ত করে নেওয়ার জন্য এ ব্যাপারে উপরের বক্তব্যই যথেষ্ট। তারপরেও অন্তরের প্রশান্তি ও বিশ্বাসের আরো দৃঢ়তা আনয়নের জন্য নিম্নে কয়েকটি দলীল উল্লেখ করলাম।

প্রথম দলীলঃ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা আরাফের ১৮৮ নং আয়াতে বলেন, (হে নবী) আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ-অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম। ফলে কোনো অমঙ্গলই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো শুধু ভীতিপ্রদর্শক ও ঈমানদারদের জন্য সুসংবাদদাতা।

দ্বিতীয় দলীলঃ (হে নবী) আপনি বলে দিন, আসমান জমীনে যত মাখলুক আছে, তাদের কেউ গায়েবের খবর জানে না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। [সূরা নামলঃ ৬৫]

তৃতীয় দলীলঃ তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত কখন ঘটবে? আপনি তাদেরকে বলে দিন, এ বিষয়ের জ্ঞান আমার প্রতিপালকের কাছেই আছে। শুধু তিনি যথাসময়ে তা প্রকাশ করবেন। [সূরা আরাফঃ ১৮৭]

উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলেমুল গায়েব ছিলেন না।

চতুর্থ দলীলঃ আপনি কি অনুধাবন করেন না যে, আসমান ও জমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থজন হিসেবে উপস্থিত না থাকেন। এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে এমন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এর চেয়ে কম হোক বা বেশি হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছে। [সূরাঃ মুজাদালাঃ ৭]

উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির নাজির নন। কেননা তিনি যদি হাজির নাজির হতেন, তাহলে উক্ত আয়াতে তিন ব্যক্তির মধ্যে গোপন পরামর্শে আল্লাহর সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাও বলতেন। আর তখন মোট সংখ্যা দাঁড়াত পাঁচজন। সুতরাং আল্লাহ পাক যেহেতু মোট সংখ্যা পাঁচজন না বলে চারজনের কথা বলেছেন, তাই এ কথা পরিস্কার যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজির নাজির নন।

 পঞ্চম দলীলঃ আমরা সবাই জানি যে, মুনাফিকরা আম্মাজান হযরত আয়েশা রাযিঃ-এর উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। সেই সাথে আমরা এও জানি যে, এক ইহুদি মহিলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশ মিশ্রিত খাবার খাইয়েছিল। প্রিয় পাঠক! আপনারাই বলুন, যদি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের খবর জানতেন এবং হাজির নাজির হতেন তবে কেন তিনি বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়েছিলেন? আর কেনই বা তিনি আয়েশা রাযিঃ-এর পবিত্রতার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহের দোলায় দুলেছিলেন? এমনকি তাঁকে তাওবা করতেও বলেছিলেন? তিনি আলিমুল গায়েব হলে এসব পেরেশানীর কোনোই অর্থ হয় না।

ষষ্ঠ দলীলঃ এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার উপর দরূদ শরীফ পাঠ করলে ফিরিশতাদের মাধ্যমে তোমাদের নাম ও গোত্রসহ তা আমার নিকট পৌঁছানো হয়। [নাসায়ী শরীফ, ১:১৪৩] এ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজির নাজির নন। কেননা উপস্থিত ব্যক্তির কাছে কোনো কিছু পৌঁছানোর প্রয়োজন পড়ে না। কোনো কিছু পৌঁছাতে হয় ঐ ব্যক্তির কাছে যিনি অনুপস্থিত।

সপ্তম দলীলঃ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি সত্যিই আলিমুল গায়েব হতেন, তাহলে দীর্ঘ তেইশ বৎসর যাবৎ যে সকল ওহী আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর নাযিল করেছিলেন, তাঁর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কেননা তিনি যদি আলিমুল গায়েব হতেন তাহলে আগে থেকেই তা অবগত থাকতেন। আর জানা বিষয়কে পুনরায় জানানোর কোনো মানে হয় না। এটা একটি অনর্থক ও বেহুদা কাজ। সুতরাং আজকে যা নাযিল হয়েছে, গতকাল তিনি তা জানতেন না বলেই নাযিল হয়েছে।

উপরের আলোচনা দ্বারা পরিস্কার বুঝা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন আলেমুল গায়েব যেমন নন, তেমনি হাজির নাজিরও নন। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক আক্বিদা-বিশ্বাস নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

[বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ আহসানুল ফাতাওয়া, ১ : ২০১, ফাতাওয়ায়ে শামী, ৬ : ৩৯৬, কিফায়াতুল মুফতি ১ : ১৫০, জাওয়াহিরুল ফিকহ ১ : ১২৭]

১৭. নবীজি মানুষ ছিলেন-এ আক্বীদা পোষণ করুনঃ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি মানুষ ছিলেন, নূরের তৈরি নয়। তবে উৎকৃষ্ট গুণাবলীর কারণে তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব; নবীজির সৃষ্টির ব্যাপারে এটিই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা। সমস্ত হকপন্থী উলামায়ে কেরাম এ আক্বীদা-বিশ্বাসই পোষণ করেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ ছিলেন—একথা প্রমাণের জন্য তো সূরা কাহাফের ১১১ নং আয়াতটিই যথেষ্ট। কেননা এ আয়াতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরিস্কার মানুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে—

“হে নবী! আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। (তবে ব্যতিক্রম শুধু এতটুকু যে,) আমার কাছে এ মরমে ওহী আসে—তোমাদের মাবুদই একমাত্র মাবুদ”।

এবার রইল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি মানুষ ছিলেন কিনা? চলুন এ ব্যাপারটিও আমরা একটু খতিয়ে দেখি। গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করি। তারপর ধীরে-সুস্থে সিদ্ধান্ত নিই—তিনি আসলে কিসের তৈরি ছিলেন? মাটির? নাকি নূরের?

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আমরা যদি একটু চিন্তা করি, তাহলে একজন মানুষের মধ্যে আমরা বেশকিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। যেমন—

মাতৃগর্ভে জন্ম লাভ করা, মাতৃদুগ্ধ পান করা, ধীরে ধীরে ছোট থেকে বড় হওয়া, পানাহার করা, ক্ষিধে লাগা, নিদ্রা যাওয়া, প্রস্রাব-পায়খানা করা, জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, সন্তান-সন্ততির জন্ম দেওয়া, আনন্দ ও সুখের সময় হাসা, দুঃখ ও বিপদের সময় কাঁদা। অনুরূপভাবে একজন মানুষের মধ্যে আমরা আরো দেখতে পাই যে, রোগ-শোক যেমন তাকে কাতর করে, তেমনি যাদু ও বিষের ক্রিয়াও তাকে কষ্ট দেয়। এমনকি কোনো কোনো সময় তাকে পৌঁছে দেয় মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত। আর এ সমস্ত মানবীয় গুণাবলী কেবল মাটির তৈরি মানুষের বেলায়ই প্রযোজ্য। এখন এমন কেউ কি আছেন, যিনি একথা প্রমাণ করতে পারবেন যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব মানবীয় গুণাবলীর কোনো একটি থেকেও মুক্ত ছিলেন। না, কেউ পারবেন না। তাহলে বুঝা গেল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি মানুষই ছিলেন।

এবার আমরা আরেকটু অগ্রসর হই। পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়েও আমরা নবীজির মাটির তৈরি মানুষ হওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণ করি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। [সূরা মুমিনুনঃ ১২]

পাঠকবৃন্দ! প্রথমে বর্ণিত সূরা কাহাফের আয়াতের কারণে নবীজীকে মানুষ না বলে কোনো উপায় নেই। অন্যথায় আয়াত অস্বীকার করার কারণে কাফের হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে। আর যখন নবীজীকে মানুষ বলা হলো, তখন সূরা মুমিনের আয়াতের কারণে তাকে মাটির তৈরি মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করা অপরিহার্য হয়ে পড়ল। কেননা উক্ত আয়াতে সব মানুষকে মাটি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু মানুষ, তাই তিনিও মাটির তৈরি হওয়া অপরিহার্য। অন্যথায় আয়াত অস্বীকার করার কারণে কাফির হওয়া অপরিহার্য হবে।

আরো কিছু দলীলঃ এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ। [বুখারী শরীফঃ প্রথম খন্ড, ৩৩২ পৃষ্ঠা]

আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযিঃ-বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মানুষ ছিলেন। [মিশকাত শরীফ, দ্বিতীয় খন্ডঃ ২৫০ পৃষ্ঠা]

আর একথা পরিস্কার যে, মানুষ মাটিরই হয়, নূরের হয় না। উপরন্ত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারক নূরের তৈরি ছিল—এ ব্যাপারে কোনো আয়াত বা সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না।

উল্লেখিত আলোচনার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্নটি হলো, বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “নূর” (আলো) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এখানে নূরের অর্থ কি?

এর জবাব হলো, বিভিন্ন আহাত ও হাদীসে  বর্ণিত নূর দ্বারা হেদায়েতের নূর তথা পথ প্রদর্শনের জ্যোতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানব জাতির জন্য এমন এক আলো স্বরূপ যার আগমনে কুফুর ও শিরকের অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে। ফলে মানব জাতি সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে। অতএব যারা তাঁর নূরকে আল্লাহ পাকের জাতি নূরের অংশ মনে করে, তারা শিরকী আক্বীদায় লিপ্ত এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে বহির্ভূত। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাযত করুন। [খাইরুল ফাতাওয়া ১ : ১৩৭, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১ : ৪৮-৫০]

১৮. মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবেন নাঃ বর্তমান যুগের একটি বহুল প্রচলিত প্রথা হলো—কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর মৃতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ফকীর-মিসকীন ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়। লোকজন মনে করে এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পায়। আসলে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদের প্রকৃত জ্ঞান না থাকার কারণেই তারা এমনটি করে থাকে। মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী শরীয়তে মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোনো ভিত্তি নেই। হযরত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনদের যুগে এর কোনো প্রচলন ছিল না। সুতরাং মৃত্যুবার্ষিকী পালনের এ প্রথাটি  নিছক মনগড়া ও বিজাতীয় একটি কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গরীব-মিসকীনকে খাওয়ানো বা অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা শরীয়ত পরিপন্থি কাজ।

তবে হ্যাঁ, মৃতের আত্মার শান্তি ও মাগফিরাতের জন্য দিন-তারিখ নির্দিষ্ট না করে বৎসরের যে কোনো সময় অবস্থা, সুযোগ ও সামর্থ অনুযায়ী দান, সদকা ও নফল ইবাদত ইত্যাদির মাধ্যমে সাওয়াব রেসানী করা যায়। সাওয়াব রেসানী বলা হয়, কোনো নেক কাজ করে একথা বলা যে, আয় আল্লাহ! আমার এ আমলের সাওয়াবটি তুমি অমুকের রুহে পৌঁছে দাও। স্মরণ রাখবেন—হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তি সর্বদাই এ অপেক্ষায় থাকে যে, তাঁর জন্য তাঁর সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন কোনো সাওয়াব পাঠায় কিনা? তাই যখনই সুযোগ হয়, তখনই যথাসম্ভব কোনো নেক আমলের মাধ্যমে ইসালে সাওয়াব বা সাওয়াব রেসানী করা উচিত। আল্লাহ পাক আমাদের মৃত বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনকে ভুলনে না গিয়ে তাদের জন্য কিছু করার তাওফীক দান করুন। আমীন। [ফাতাওয়ায়ে রশীদিয়াঃ ১৬৬ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল মুফতীয়্যিন ১ : ১৫৮, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ১ : ৯৯-১০০]

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মফীজুল ইসলাম। বইঃ আদর্শ যুবক যুবতি ১। (হৃদয় গলে সিরিজ ২৫)                     

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment