জ্ঞান পিপাসা-পুরাতন ও আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ইবনে সীনা (রহঃ)-র গল্প।
বোখারার বাদশাহ। নূহ বিন মানসূর। গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসা চলছে অবিরত। প্রথমে চিকিৎসা করলেন রাজদরবারের চিকিৎসকগণ। তারপর গোটা পৃথিবীর নামকরা ডাক্তারগন। চিকিৎসা দিলেন বিখ্যাত হাকিম-কবিরাজরাও। কিন্তু বাদশাহের সুস্থতার কোনো নামগন্ধ নেই। নেই ভালো হওয়ার ক্ষীণতম লক্ষণ।
বাদশাহের শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। চিকিৎসকগণ তাঁর সুস্থতার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছেন। আশা ছেড়ে দিয়েছেন দরবারের অন্যান্য লোকজনও। গোটা দেশে ঘোষণা করা হয়েছে, সবাই যেন বাদশাহের জন্য খাছভাবে দোয়া করে।
ঘোষণা শুনে জনগণের মনে একটি ব্যথা চিনচিন করে ওঠে। বলাবলি করে, আহা! আমাদের বাদশাহ কত ভালো মানুষ। দেশবাসীর কল্যাণে কত কিছুই করেছেন তিনি। আমাদের যা প্রয়োজন, নির্দ্বিধায় চেয়েছি তাঁর কাছে। পেয়েও গেছি সময়মতো। তাঁর গোটা জীবনটাই ছিল মানুষের জন্য নিবেদিত। তিনি চলে গেলে এমন বাদশাহ পাবো কি আর?
প্রত্যেক নামাজের পর বাদশাহের জন্য কায়মনবাক্যে দোয়া করে দেশের লোকজন। দোয়া করে অন্য সময়ও। কামনা করে বাদশাহের আশু রোগমুক্তির। বলে—ওগো দয়াময় প্রভু! তুমি আমাদের প্রাণপ্রিয় বাদশাহকে সুস্থ করে দাও। দূর করে দাও তাঁর যাবতীয় রোগ-শোক। আবারো তাঁকে তাওফীক দাও দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার।
জনগণের এই হৃদয় নিংড়ানো দোয়া ব্যর্থ হয় কী করে! আল্লাহ পাক তাদের দোয়া কবুল করলেন। বাদশাহের রোগ-মুক্তির ওসিলা হিসেবে রাজ দরবারে পাঠিয়ে দিলেন এক সুন্দর সুদর্শন তাগড়া যুবককে।
যুবক এখন রাজদরবারে। বিখ্যাত চিকিৎসকগণও সেখানে উপস্থিত। যুবক তাদের কাছে মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। বলছে—আপনারা অনুমতি দিলে আমি একটু চিকিৎসা করে দেখতে পারি। যুবকের কথা শুনে সকলে অবাক। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তাঁর চেহারার দিকে। যেন হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে তারা। কয়েক মুহূর্তে অতিবাহিত হওয়ার পর রাজকীয় চিকিৎসকদের একজন যুবককে লক্ষ্য করে বললেন—সমগ্র পৃথিবীর ডাক্তার—কবিরাজ যেখানে ব্যর্থ, হাকীমরা যেখানে পুরোপুরি নিরাশ, এমতাবস্থায় কোন সাহসে তুমি চিকিৎসার কথা বলছ? কী করে তুমি বাদশাহের এ কঠিন রোগ নিরাময় করবে?
যুবক শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়। বলে—আমি চেষ্টা চালিয়ে দেখি। সুস্থ করার মালিক তো মহান রাব্বুল আলামিন। তিনি ইচ্ছা করলে আমার চিকিৎসার ওসিলায়ও বাদশাহকে আরোগ্য করে দিতে পারেন।
যাহোক অনেক চরাই-উৎরাই পার হয়ে চিকিৎসা করার অনুমতি পেল যুবক। এবার সে আল্লাহর নাম নিয়ে এবং তাঁর সাহায্য কামনা করে চিকিৎসা শুরু করল।
আল্লাহর কী অপূর্ব মহিমা! যুবক যেদিন চিকিৎসা শুরু করল, সেদিন থেকেই বাদশাহ একটু একটু করে সুস্থতাবোধ করতে লাগলেন। এমনকি কয়েকদিনের মধ্যে তিনি সম্পূর্ন সুস্থও হয়ে গেলেন।
অল্প সময়ের মধ্যে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল এ খবর। ফলে সবাই যুবকের প্রশংসা করতে লাগল।
পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ একদিন দরবারে এলেন। দরবার কক্ষে তখন উপবিষ্ট ছিলেন, সভাসদ ও উচ্চ পর্যায়ের রাজ-কর্মচারীসহ প্রশাসনের অসংখ্য লোক। তাছাড়া রাজদরবারে তখন দাওয়াতী মেহমানেরও কোনো কমতি ছিল না। লোকে লোকারণ্য এই দরবারে বাদশাহ যুবককে ডাকলেন। বড়ই মমতার সুরে বললেন—হে যুবক! আমি তো প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম জীবনের ব্যাপারে। কিন্তু তোমার ওসিলায় আল্লাহ পাক আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন। এবার তুমি খোলামনে নিঃসঙ্কোচে বলো, আমি তোমাকে পুরস্কার স্বরূপ কী দিতে পারি? আজ তুমি আমার কাছে যা-ই চাইবে, আমার সাধ্যে কুলালে অবশ্যই তা তোমাকে দান করব।
উপস্থিত সবাই নির্বিকার। কারো মুখে কথা নেই। সকলেই অপলক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে যুবকের মুখপানে। যুবক কী বলে তা শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। পূর্ণিমার চাঁদও যেন যুবকের হাতের নাগালে এখন। কারণ যা চাইবে তাই পাবে সে। এমতাবস্থায় কেউ কেউ ইর্ষান্বিত হয়ে মনে মনে ভাবছেন—না জানি যুবক এখন কত কি চেয়ে বসে! আহা, এমন সুযোগ যদি আমার হতো!
যুবক ধীরে ধীরে মাথা তুলল। বলল, জাহাপনা! আমি আপনার রাজ্যের একজন নগন্য খাদেম। সে হিসেবে আপনার খেদমত করা, সঠিক চিকিৎসা দিয়ে আপনাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আপনার খেদমত করে, চিকিৎসা সেবা দিয়ে আমি মূলত আমার সেই দায়িত্বই পালন করেছি। অতএব আমি আপনার নিকট কোনো পুরস্কার চাই না।
একি বলছো তুমি!
হ্যাঁ, আমি যা বলেছি মন থেকেই বলছি।
না, তোমাকে আজ চাইতেই হবে। তোমাকে কিছু না দিতে পারলে আমি শান্তি পাব না।
তাই যদি হয়, তবে পুরস্কার নয়, আমি বিনয়ের সাথে আপনার খেদমতে একটি আবদার করতে চাই।
বলো তোমার কী আবদার।
আমার আবদার হলো, আপনি আমাকে রাষ্ট্রীয় লাইব্রেরীর সকল বই পাঠ করার অনুমতি দিবেন। যাতে আমি যখন যা মনে চায়, তাই পাঠ করতে পারি এবং অগাধ জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আমি বহু চিন্তাভাবনা করে দেখেছি, জ্ঞানের চেয়ে বেশি মূল্যবান কোনো জিনিস এ পৃথিবীতে নেই।
যুবকের কথা শুনে সবাই নিশ্চুপ। নির্বাক। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। খানিক বাদে বাদশাহ বললেন—হে যুবক! তোমার জ্ঞান পিপাসা দেখে সত্যিই আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। যাও, আজ থেকে তোমার জন্য দেশের জাতীয় গ্রন্থাগারকে উন্মুক্ত করে দিলাম। তুমি যখন ইচ্ছা, যে কোনো বই অধ্যয়ন করবে। কেউ তোমাকে বাধা দিবে না।
বাদশাহের অনুমতি পেয়ে যুবক জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশ করল এবং দিনের পর দিন বই পাঠে মগ্ন রইল। জ্ঞান সাগরে ডুব দিয়ে উপভোগ করতে লাগল স্বর্গীয় তৃপ্তি।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আপনারা কি জানেন, কে সেই যুবক? কী তাঁর নাম? হ্যাঁ, এ যুবকের নাম হলো আবু আলী ইবনে সীনা রহঃ। যাকে আধুনিক ও পুরাতন চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলে অভিহিত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর লিখিত বহু গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পাঠদান করা হয়।
ইসলামী বিশ্বের এ মহান ব্যক্তিত্ব ১০৩৮ খৃস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত ইবনে সীনা রহঃ আজ নেই। কিন্তু যতদিন এ পৃথিবী থাকবে ততদিন তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে হযরত ইবনে সীনা রহঃ এর মতো জ্ঞান পিপাসা দান করুন। আমীন। [সহায়তায়ঃ মাসিক রহমত]
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ আদর্শ যুবক যুবতী ১।
লেখকের অন্যান্য গল্প পড়ুন….
মদখোর প্রতিবেশি (বদলে যাওয়ার গল্প)
যুবতীর কবলে যুবক (প্রেমের গল্প)
স্নিগ্ধ কোমল হাসি! (এক এতিম শিশুর গল্প)
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.