স্নিগ্ধ কোমল হাসি! (এক এতিম শিশুর গল্প)

সিগ্ধ কোমল হাসি, লেখক এক এতিম শিশুর জীবনের করুন গল্প তাঁর আদর্শ কিশোর কিশোরী ৩ বইতে তুলে ধরেছেন। আমার বাংলা পোস্ট.কমের পাঠক পাঠিকাদের জন্য এই এতিম শিশুর কোমল হাসির গল্পটি হুবুহু তুলে ধরা হলো। 

আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর।….. আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম। মুআজিনের আযান কানে যেতেই চোখ খুলে গেল মাহমুদ সাহেবের। ফজরের নামাজ আদায় করার পর দক্ষিণের বাগান সংলগ্ন রুমটিতে বসে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা তার নিয়মিত অভ্যাস।

কোমল হাসি

সকালে কচি রোদ আর ঈষৎ ঠাণ্ডা বাতাস চারদিকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সকালের এই শান্ত নিস্তরঙ্গ পরিবেশে কুরআন তিলাওয়াতের মৃদু ধ্বনি একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। হঠাৎ সদর দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে মাহমুদ সাহেব কুরআন শরীফ বন্ধ করে দরজা খুললেন। দেখলেন, একজন কিশোর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শীতের এই সকালে তার গায়ে শুধু একটি হাফশার্ট। অনাহার-অনাদরের ছাপ তার সারা শরীরে পরিস্ফুট হয়ে আছে। মাহমুদ সাহেবের কেন যেন মনে হলো, ছেলেটি কোনো ভদ্র ঘরের সন্তান হবে।

ছেলেটি করুণ স্বরে বলল, আমার নাম ফরহাদ। নদীভাঙ্গনে আমাদের ঘরবাড়ি নদীবক্ষে বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষুধার্ত ছোট বোনটার মুখে কিছু তুলে দেওয়ার জন্য যে কয়েকটি টাকা যোগাড় করেছিলাম, তাও কেড়ে নিয়ে গেছে মোড়ে দাঁড়ানো কয়েকটা লোক। ওরা নাকি ওই টাকা দিয়ে সিগারেট কিনবে। আর কিছুই বলতে পারল না ছেলেটি। চোখের কোণ থেকে বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোটা অশ্রু!

আরও পড়ুনঃ অভিভূত জার্জিস কন্যা! ইসলামিক যুদ্ধের গল্প

ছেলেটিকে কাঁদতে দেখে মাহমুদ সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। এরপর সমবেদনা জানানোর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

বাবা! তোমার পিতা-মাতা কোথায়? তাঁরা কি করেন?

উত্তরে ছেলেটি যা বলল, তার সারমর্ম বুঝে নিতে মাহমুদ সাহেবের কষ্ট হলো না। ছেলেটির বাবা আগেই মারা গেছেন। দুই সন্তানকে বুকে চেপে মা এসেছিলেন কাজের খুঁজে শহরে। একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চলনসই একটি কাজও যুগিয়েছিলেন। গার্মেন্টস শ্রমিকের যৎসামান্য বেতন দিয়ে কষ্টে ক্লেশে কোনোরকমে তাদের দিন চলছিল। কিন্তু মালিকদের আগুন খেলায় দু’টি মাসুম সন্তানকে ফেলে তিনিও চলে গেছেন স্বামীর পথ ধরে।

মাহমুদ সাহেব ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের বাগান বাড়ির সদর দরজায় আজ যেন মাহমুদ সাহেব তাঁরই পীড়িত কৈশোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন। 

আরও পড়ুনঃ অহঙ্কার থেকে সাবধান! (কিশোরীদের গল্প)

স্বামী ছেলে নিয়ে ছোট্ট সংসার রাবেয়ার। তাতে আভিজাত্য ছিল না, তবে পরিপাট্য ছিল, প্রাচুর্য্য ছিল না, সুখ ছিল। স্বামীর প্রীতি ভালোবাসায় রাবেয়া ভুলে গিয়েছিলেন সংসার জীবনের সব কষ্ট। কিন্তু তার এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কঠিন শোকর গোজারির পরীক্ষা শেষে এবার বুঝি শুরু হলো ধৈর্য ও সবরের পরীক্ষা।

আজ মাসের প্রথম দিন। অফিসের বড় সাহেবের ছেলের জন্মদিন হওয়ায় এমাসের বেতনটা অফেলা তারিখেই পেয়ে গেছে সবাই। বেতনের টাকায় ছেলের পোশাক আনবেন বলে বের হয়ে গেছেন স্বামী। রাবেয়ার মনে আজ বড় আনন্দ। ছেলেকে মাদরাসায় পাঠাবেন। সেখানে সে তার উস্তাদের হাতে কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করবে। মানুষের মত মানুষ হবে—এই তার প্রত্যাশা। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল ভিন্ন। স্বামী ফিরলেন। কিন্তু জীবিত নয়, মৃত; স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে নয়; বরং তাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিতে। জনগণের শান্তি বিধানের জন্য যারা রাজপথকে উত্তপ্ত করে তাঁরা কি পারবে সদ্য বিধবা রাবেয়ার হারিয়ে যাওয়া শান্তিটুকু ফিরিয়ে দিতে?

ছোট্ট ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শহরের পথে পা বাড়ালেন রাবেয়া। দু’মুঠো অন্ন আর আদরের পুত্রের একটুখানি শিক্ষার জন্য কতই না কষ্ট করেছেন তিনি। একমাত্র সন্তানের শান্তিময় ভবিষ্যতের জন্য সামান্য হাতছানি যেখানে পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে চলেছেন। আর এভাবে ছুটতে ছুটতেই একদিন তিনি হারিয়ে গেলেন সন্তানকে ছেড়ে। তার ছোট্ট ছেলে। নাম মাহমুদ। সে এবার মা-হারা হলো। রাজপথের একটি ঘাতক ট্রাক তার মাকে চিরদিনের জন্য দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিল। শুরু হলো কিশোর মাহমুদের একাকী পথ চলা। জননীর কোমল আশ্রয়ে থেকে পৃথিবীর যে নির্মম রূপ কখনো সে কল্পনাও করেনি তা-ই সে এখন দেখতে পেল তার চারদিকে। কিন্তু এত সব ভীতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে মাহমুদ মাঝে মাঝে দেখতে পেত এক পরম আশ্রয়দাতার স্নিগ্ধ কোমল মুচকি হাসি!

আরও পড়ুনঃ আসমানী সাহায্য!-কিশোর গল্প

পৃথিবী এখনো মানবতাশূন্য হয়নি। আজো কিছু কিছু মহানুভব মানুষের দেখা মেলে এ জগতে। তাদেরই একজন এগিয়েএলেন এবং কিশোর মাহমুদকে আপন করে নিলেন। অন্তরের মমত্ব আর হৃদয়ের মহত্ব দিয়ে তাকে লালন পালন করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মাহমুদ  মা বাবা হারানোর শোক ভুলে গেল। তারপর শিক্ষার আলো তার বুকে নতুন শক্তি দান করল।

তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। সে দিনের কিশোর মাহমুদ আজ যৌবনের মধ্যগগণে উপস্থিত। বর্তমানে সে  বহু টাকা-পয়সা ও সহায়-সম্পত্তির মালিক। আজ যে ছেলেটি তার দরজায় দাঁড়ানো, তার মাঝেই তিনি তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। এটি কি তাহলে মহান প্রভুর ইঙ্গিতময় ইচ্ছা! বনী ইসরাইলের সেই তিন ব্যক্তির কাছে পরীক্ষার ফেরেস্তা পাঠানোর মত এখানেও কি  রয়েছে তার কোনো গোপন অভিপ্রায়? মাহমুদ সাহেব একদৃষ্টে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমার ছোট বোনটির জন্য একটু সাহায্য করুন। ছেলেটির কান্নাজড়ানো কণ্ঠস্বরে মাহমুদ সাহেব সচকিত হলেন। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় জেগে উঠল তার মনে। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই। নেই কোনো চিন্তা। তোমার বোনকে নিয়ে আমার এখানে চলে এসো। আমার বাড়িতেই তোমরা থাকবে।

ছেলেটির অশ্রুসিক্ত নয়নে খুশির রেখা ফুটে উঠল। কৃতজ্ঞতার কোমল হাসি উপহার দিয়ে বলল, আল্লাহ আপনার ভালো করুন।

ছেলেটি চলে যেতে লাগল। মাহমুদ সাহেব তাকিয়ে রইলেন তার গমন পথের দিকে।

প্রিয় বন্ধুরা! মাহমুদ সাহেবের মতো তোমরাও কি নিজ নিজ সাধ্য অনুসারে অসহায় ছেলে-মেয়েদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না? আমার বিশ্বাস, তোমরা পারবে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের তাওফীক দিন। আমীন। [সূত্রঃ মাসিক আল কাউসার, ডিসেম্বর-২০০৬]

এরপর পড়ুন>> সৎ মায়ের আদর

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি লেখকের এতিম শিশুর সিগ্ধ কোমল হাসি গল্পটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে এবং তারই সাথে গরবী অসহায় ও এতিম শিশুদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করার উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগাবে। লেখাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।  

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading