উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা:) জীবন কর্ম

“আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন”।

উম্মুল মু'মিনীন খাদীজা (রা:)

উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা) জীবনী কথা!

١. عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ (رض) قَالَ أَنَّى جِبْرِيلُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَذِهِ خَدِيجَةُ قَدْ آنَتْ مَعَهَا إِنَّا فِيْهِ إِدَامٌ أَوْ طَعَامٌ أَوْ شَرَابٌ فَإِذَا هِيَ أَتَتْكَ فَاقْرًا عَلَيْهَا السَّلَامَ مِنْ رَيْهَا وَمِنى وبَشِّرُهَا بِبَيْتٍ فِى الْجَنَّةِ مِنْ قَصَبِ لَا صَخَبَ فِيْهِ وَلَا نَصَبَ .

১. আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, জিবরাঈল (আ) নবী করীম সালমা নাই-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার ঐ যে খাদীজা (রা) একটি পাত্র হাতে নিয়ে আসছেন। ঐ পাত্রে তরকারী অথবা খাদ্যদ্রব্য অথবা পানীয় ছিল। যখন তিনি পৌঁছে যাবেন তখন তাঁকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকেও সালাম জানাবেন। আর তাঁকে জান্নাতের এমন একটি ভবনের সুসংবাদ দিবেন যার অভ্যন্তর ভাগ ফাঁকা-মোতি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে থাকবে না কোন প্রকার শোরগোল; কোন প্রকার দুঃখ-ক্লেশ । (বুখারী : হাদীস নং-৩৮২০)

খাদীজা (রা)-কে নবী করীম – জান্নাতে একটি গৃহের সুসংবাদ দিয়েছেন ।

. عَنْ عَائِشَةَ (رض) قَالَتْ بَشِّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خَدِيجَةَ رَضِيَ اللهُ
عَنْهَا بِبَيْتٍ فِي الْجَنَّةِ .

২. আয়েশা সিদ্দিকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা:) খাদীজা (রা)-কে জান্নাতে একটি ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন। (মুসলিম : হাদীস নং-৬২৭৬, কিতাবুল ফাযায়েল, বাব মিন ফাযায়েল খাদীজা)

মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা:), রাসূলুল্লাহ (সা:) এর স্ত্রী খাদীজা ও ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া জান্নাতী রমণীদের সরদার হবে।

عَنْ جَابِرٍ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم سَيِّدَاتُ نِسَاء أَهْلِ
الْجَنَّةِ بَعْدَ مَرْيَمَ بِنْتِ عِمْرَانَ فَاطِمَةً وَخَدِيجَةً وَأَسِيَّةٌ امْرَأَةٌ فِرْعَوْنَ .
৩. জাবের (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন : জান্নাতী রমণীদের সরদার মারইয়াম বিনতে ইমরান এর পরে ফাতেমা, খাদীজা ও ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া । (তাবরানী : সিলসিলা আহাদিস সহীহা লি আলবানী; হাদীস নং-১৪৩৪))

নাম ও উপনাম : তাঁর নাম ‘খাদীজা’, ডাক নাম ‘উম্বুল হিন্দ’, তাঁর প্রথম স্বামী আবুল হালার ঔরসে হিনদ নামক তাঁর এক পুত্র ছিল, তার নাম অনুসারে খাদীজা (রা)-এর উপনাম হয় উম্মুল হিনদ।

জন্ম : তিনি নবী করীম (সা:) এর প্রথমা স্ত্রী। প্রথম মুসলমান উম্মুল মু’মিনীনদের প্রধান খাদীজাতুল কুবরা (রা) ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ হস্তী বছরের ১৫ বছর পূর্বে মক্কার সম্মানিত গোত্র আসাদ ইবনে আবদিল উযযায় জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে তিনি বয়সে রাসূল (সা:)-এর ১৫ বছরের বড় ছিলেন ।

মাতা-পিতা ও পূর্বপুরুষ : পিতার নাম খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা ইবনে কুসাই, মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে যায়িদাহ। আর নানা ছিলেন আসাম ইবনে হারাম ইবনে ওয়াহাব ইবনে হাজার ইবনে আবদ ইবনে মাহীছ ইবনে আমের৷ তাঁর নানীর নাম হালাহ বিনতে আবদে মানাফ। উল্লেখ্য যে, কয়েক পুরুষ ওপরে গিয়ে খাদীজা (রা)-এর পিতৃকূল ও মাতৃকূল এক ছিল। অর্থাৎ তাঁর ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ এবং নবী করীম (সা:)-এর ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ একই ব্যক্তি ছিলেন। এ ব্যক্তির নাম ছিল কুসাই। পৈত্রিক বংশের দিক দিয়ে খাদীজা রাসূল (সা:) এর ফুফু হতেন। নবুওয়্যাতের সূচনায় খাদীজা তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল-এর নিকট রাসূল (সা:) সম্পর্কে যে উক্তি করেছিলেন “আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা শুনুন” তা এ সম্পর্কের ভিত্তিতেই। তাহলে বুঝা গেল খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা) ছিলেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ কুরাইশ বংশের পূত পবিত্ৰ সন্তান ।

গোত্র : তাঁর গোত্র আসাদ ইবনে আব্দুল উযযা কুরাইশদের সেই নয়টি বিশিষ্ট গোত্রের অন্যতম ছিল, যাদের মধ্যে দশটি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গৌরবজনক দায়িত্ব ছিল। পরামর্শ এ গোত্রের দায়িত্বে রয়েছে বিধায় ‘দারুণ নাদওয়া’ এর ব্যবস্থাপনা ছিল তাদের অধীনস্থ। পরামর্শ অর্থ হলো কুরাইশদের যখন কোন জাতীয় অথবা রাষ্ট্রীয় সমস্যা দেখা দিত এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কোন কাজ করতে মনস্থ করত তখন সুপরামর্শের জন্য এ গোত্রের নিকট আগমন করত। এ পদে সর্বশেষ অধিষ্ঠিত ব্যক্তি ছিলেন যায়েদ ইবনে যাম’আ ইবনে আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব ইবনে আসাদ। কুরাইশরা তাদের সমস্যাবলী তাঁর নিকট পেশ করত। তিনি যদি তাদের সাথে একমত পোষণ করতেন তাহলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতো নতুবা তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিত। কুরাইশগণ পুনরায় চেষ্টা করে তাকে তাদের মতাবলম্বী করে নিত। এ হতে কুরাইশদের মধ্যে তাঁর প্রভাব কেমন তা উপলব্ধি করা যায়।

উপাধি : উপাধি ‘তাহিরা’ অর্থাৎ পবিত্রা নারী । খাদীজা (রা) তৎকালীন আরবে অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্না ও সম্মানিতা একজন মহিলা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতা ছিলেন। সে জাহেলী যুগেও তাঁর পূত পবিত্র চরিত্রের জন্য তিনি ‘তাহিরা’ উপাধিতে ভূষিতা হন।

তিনিই রাসূল (সা:)-এর প্রথম স্ত্রী, নবী নন্দিনী ফাতিমাতুজ জোহরার মা, ইনিই হাসান ও হোসাইন (রা)-এর নানী এবং তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।

খাদীজা (রা)-এর বাল্যকাল সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে রাসূল (সা:) এর সাথে বিয়ে হবার পূর্বে তাঁর আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। এরও পূর্বে খাদীজা (রা)-এর পিতা খুওয়াইলিদ তাঁকে বিয়ে দেয়ার জন্য সে সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নাওফিলের সাথে সম্বন্ধ ঠিক করেন। ওয়ারাকা খাদীজার চাচাত ভাই ছিলেন। কিন্তু যে কোন কারণে সে বিয়ে করেনি ৷

প্রথম বিবাহ : খাদীজা (রা)-এর প্রথম বিবাহ হয় আবূ হালা হিনদ ইবন যূরারা ইবনে নাব্বাশ ইবনে ‘আদিয়ি আত-তামীমীর সাথে (ইবন হাযম জামহারাতু আনসাবিল-আরাব, পৃ. ২১০)।

তাঁর নাম সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেহ কেহ নামনাশ ইবনে যুরার আবার কেহ কেহ নাব্বাশ ইবনে মুরারা বলে বর্ণনা করেছেন। ইবনে সাদ হিনদ ইবনে নাব্বাশ ইবনে যুরারা বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ হালার দাদা নাব্বাশ তার গোত্রের মধ্যে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি মক্কায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন এবং বনূ আবদি’ ইবনে কুসায়ির সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করেন। কুরাইশদের রীতি ছিল যে, তারা মিত্রদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করত। তাই খাদীজা (রা)-এর সাথে আবূ হালার সম্পর্ক কুরাইশদের সমপর্যায়ের ছিল। তারাও মুদার গোত্রদ্ভূত ছিল । এ জন্য তাদের সাথে আত্মীয়তা করা কোনরূপ অবমাননাকর ছিল না । এ স্বামীর ঔরসে খাদীজা (রা)-এর তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে ২ (দুই) পুত্র হিনদ ও আল হারিছ এবং যয়নব নামক এক কন্যা। খাদীজার প্রথম পুত্র ও প্রথম সন্তান হল হিনদ। যিনি রাসূল (সাঃ) এর নিকট লালিত-পালিত হন। এজন্য তাকে রাবীবু রাসূলিল্লাহ বা রাসূল (সা:) এর পালক পুত্র বলা হতো।

এ হিনদ ইসলাম গ্রহণ করে উহুদ বা বদর যুদ্ধে শরীক হন এবং পরে বসরায় ইন্তেকাল করেন। রাসূল (সাঃ) নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পর খাদীজা (রা)-এর এ পুত্র ‘দু’জনই ইসলাম কবুল করেন এবং সম্মানিত সাহাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু তাদের পিতা আবূ হালা ইবনে যাররাহ সে জাহেলী যুগেই ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় বিবাহ : খাদীজা (রা)-এর স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয় ‘আতীক ইবনে ‘আ’ইয (ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে মাখযুম)-এর সাথে। খাদীজা (রা)-এর গর্ভে তাঁর এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে যিনি উম্মু মুহাম্মদ উপনামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন (জামহারাতু আনসাবিল আরাব, পৃ. ১৪২)।

ইবনে সাদ আইয-এর স্থলে আবিদ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মাখযুম গোত্রের লোক ছিলেন এবং আবূ জাহেল উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা) ও খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা)-এর চাচা ছিলেন। খাদীজা (রা)-এর গোত্রের সাথে এ গোত্রের এ দিক থেকে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যে, উম্মে সালামা (রা)-এর সহোদরা কারীবা বিনতে আবী উমাইয়্যার সাথে যাম’আ ইবনে আসওয়াদ এর বিবাহ হয় এবং যায়েদ ইবনে যাম’আ তাঁদের পুত্র। দ্বিতীয় স্বামী আতিকের মৃত্যু হলে তিনি বিশেষভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতি মনোনিবেশ করেন ।

পিতার ইনতিকাল : খাদীজা (রা)-এর বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বছরের সময় তাঁর পিতা খুওয়াইলিদ ইনতিকাল করেন। ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ফুজ্জার যুদ্ধে ইনতিকাল করেন ।

খাদীজার ব্যবসায়িক অবস্থা : ঐতিহাসিকগণ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, আরবের সে জাহেলী যুগে মক্কার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ব্যবসায়ী ছিলেন খাদীজাতুল কুবরা (রা)। জানা যায়, তাঁর বাণিজ্য বহর নিয়ে যখন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করত তখন দেখা যেতো একা খাদীজার পণ্যসামগ্রী কুরাইশদের সমগ্র পণ্যসামগ্রীর সমান ।

পিতার মৃত্যুর পর খাদীজা (রা)-এর পক্ষে ব্যবসায় পরিচালনা করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তাঁর পিতার ব্যবসায় আরবের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। এজন্য তিনি একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজতে লাগলেন যাতে তাঁর ব্যবসায় দেশের বাইরেও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় ।

বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী রাসূল (সা:) নবী করীম সালমা তখন ২৫ বছরের যুবক। ইতোমধ্যেই তিনি তাঁর চাচা আবূ তালিবের সাথে কয়েকবার বাণিজ্য সফরে গিয়ে প্রভূত সাফল্য বয়ে এনেছিলেন। সাথে সাথে ব্যবসায় সম্পর্কিত পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি নানাবিধ সামাজিক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার কারণে সর্বোপরি ঐ বয়সেই ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ায় সমগ্র আরবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আমানতদারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মাধুর্যতার কথা খাদীজা (রা) এর কানেও পৌঁছতে দেরী হয়নি।

বিশ্বস্ত লোকের খোঁজে খাদীজা : এদিকে খাদীজা (রা) তাঁর ব্যবসায় পরিচালনা করার জন্য বিশ্বস্ত লোক খুঁজছেন জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) এর চাচা আবূ তালিব তাঁকে ডেকে বললেন, ‘ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সংকটজনক । মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোনো ব্যবসায় বা অন্য কোনো উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যাচ্ছে। খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছেন। তুমি যদি তাঁর কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই তিনি নির্বাচিত করতেন। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তাঁর ভালো করেই জানা আছে।’ চাচা আবূ তালিবের প্রস্তাবের জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘সম্ভবত তিনি নিজেই লোক পাঠাবেন ।

দেখা গেল সত্যি সত্যিই খাদীজা (রা) লোক পাঠিয়ে বলে দিলেন যে, ‘মুহাম্মদ (সাঃ) যদি তাঁর ব্যবসায় পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান তাহলে তাঁকে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন।’ রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন এবং একদিন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন ।

পাদ্রীর ভবিষ্যৎ বাণী : রাসূল (সা:) সিরিয়ার পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য বাণিজ্য কাফেলা নামিয়ে বসলেন। সঙ্গে ছিলেন খাদীজা (রা)-এর বিশ্বস্ত দাস মাইসারা। এ সময় গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে এসে মাইসারাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে?’ মাইসারা বললেন, ইনি মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের লোক । এ কথা শুনার পর পাদ্রী বললেন, ইনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা। অবশ্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন ঐ পাদ্রীর নাম ছিল ‘নাসতুরা’।’

রাসূল (সাঃ) এর প্রাথমিক সফলতা : রাসূল (সাঃ) সিরিয়ার বাজারে গিয়ে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যে পণ্য-সামগ্রী বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মালামাল ও জিনিসপত্র কম মূল্যে ক্রয় করলেন। তারপর সঙ্গী মাইসারাকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথ চলতে চলতে মাইসারা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন, ‘নবী করীম (সাঃ) তাঁর উটের পিঠে সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফেরেশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করে আছে।’ এভাবে তাঁরা মক্কায় ফিরলেন। ঘরে ফিরেই মাইসারা তাঁর মালিক খাদীজা (রা)-কে পাদ্রীর মন্তব্য ও পথের সব ঘটনা বিস্তারিতভাবে খুলে বললেন।

মক্কায় ফিরে সিরিয়া থেকে আনা পণ্য-সামগ্রী বিক্রি করে রাসূল (সাঃ) দেখলেন এ যাত্রায় প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা অর্জিত হয়েছে। তিনি সমস্ত হিসাব-নিকাশ খাদীজা (রা)-কে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন।

খাদীজার বিয়ের প্রস্তাব : সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ সর্বোপরি অসম্ভব ভদ্র মহিলা ছিলেন খাদীজা (রা)। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বিধবা। যে কারণে মক্কার অনেক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ যুবক তাঁকে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিলেন। তাদের অনেকে প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন। সে সব প্রস্তাব খাদীজা (রা) বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর অনুগত ও প্রিয় দাস মাইসারার নিকট রাসূল (সা:) এর সম্বন্ধে তাঁর ব্যবসায়িক আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততার বিস্তারিত বিবরণ জানার পর ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজা (রা)-এর বান্ধবী ‘নাফিসা বিনতে মারিয়া’র মাধ্যমে রাসূল (সা:) এর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।  নাফিসা রাসূল -এর নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেন : ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন?

এখানে সকলের অবগতির জন্য একটি তথ্য দিয়ে রাখি, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আরবের সে জাহেলী যুগেও মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামতের স্বাধীনতা ছিল। তারা নিজেদের বিয়ে-শাদী সম্পর্কে নিজেরা সরাসরি কথা বলতে পারতো। প্রাপ্তবয়স্কা ও অপ্রাপ্তবয়স্কা সবাই সমভাবে এ অধিকার ভোগ করতো ।

শুভ বিবাহ সম্পন্ন : রাসূল (সা:) সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন। রাসূল (সা:) খাদীজা (রা)-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার আর তাঁর প্রিয় চাচা আবু তালিব এর পরামর্শে খাদীজা (রা)-কে বিয়ে করার সম্মতি প্রদান করেন। রাসূল (সা:) সম্মতি দেয়ার পর খাদীজা (রা)-এর চাচা আমর বিন আসাদের পরামর্শে পাঁচশ স্বর্ণমুদ্ৰা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহের দিন-তারিখ ঠিক করা হয়।

বিয়ের দিন রাসূল (সা:) এর পক্ষ থেকে খাদীজা (রা)-এর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন আবূ তালিব, হামজা (রা)-সহ তাঁর বংশের আরো কিছু সম্মানিত লোক। খাদীজার পক্ষ থেকেও বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। উভয়পক্ষের বিশিষ্ট মেহমানদের উপস্থিতিতে আবূ তালিব প্রাণপ্রিয় ভাতিজার | বিয়ের খুতবা পাঠ করেন এবং বিয়ে পড়ান। এ সময়ে নবী করীম (সা:) এর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর, আর খাদীজা (রা)-এর বয়স ছিল ৪০ বছর।

নবুওয়াত লাভ : এ বিয়ের ১৫ বছর পর অর্থাৎ রাসূল (সা:) এর বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। হেরা গুহায় প্রথম অহী নাযিলের বিষয়টি সর্বপ্রথম তিনি খাদীজা (রা)-কে জানান। খাদীজা (রা) তো তাঁর বিয়ের পূর্ব থেকেই রাসূল (সা:) এর নবী হওয়া সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। যে কারণে তিনি বিষয়টি সহজে সামলে নিতে পেরেছিলেন। এ সম্পর্কে বুখারী শরীফের ৩নং হাদীসখানা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । 

আরবি…

আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহী আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি ‘হেরা’র গুহায় নির্জনে থাকতেন । আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া- এভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে নিমগ্ন ছিলেন।

তারপর খাদীজা (রা)-এর কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহী এলো । তাঁর কাছে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পড়ুন’। তিনি বললেন : আমি তো পড়তে পারি না। রাসূল (সা:) বললেন, তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন : ‘পড়ুন’। আমি উত্তর দিলাম ‘আমি তো পড়তে পারি না।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ুন, আর আপনার রব মহিমান্বিত।”

তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) ফিরে এলেন। তাঁর অন্তর কাঁপছিল। তিনি খাদীজা বিনত খুওয়াইলিদের কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও’, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।’ তাঁরা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হলো। তখন তিনি খাদীজা (রা)-এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি আমার নিজের ওপর আশঙ্কা বোধ করছি।

খাদীজা (রা) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনো না। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফিল ইন ‘আবদুল আসাদ ইন ‘আবদুল উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ‘খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় লিখতে জানতেন এবং আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

খাদীজা (রা) তাঁকে বললেন, “হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন । ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাতিজা! তুমি কী দেখ ?’ রাসূলুল্লাহ (সা:) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ‘ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ মূসা (আ)-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে।’ রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মতো কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব।’ এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা (রা) ইন্তেকাল করেন। আর ওহী স্থগিত থাকে ৷

খাদীজার ইসলাম গ্রহণ : ওহী সূচনার এ ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় খাদীজা (রা) প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। ইসলাম গ্রহণকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, খাদীজা ইসলাম গ্রহণ করার ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ওপর এক বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাঁর বংশধর এবং শুভানুধ্যায়ী ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন । ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে খাদীজা (রা) পুরোপুরি রাসূলুল্লাহ (সা:) কে অনুসরণ করা শুরু করেন। সালাত ফরজ হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাথে ঘরের ভেতর সালাত আদায় করতেন। এ অবস্থা একদিন বালক আলী দেখে ফেলেন এবং জিজ্ঞেস করেন; “মুহাম্মদ এ কী?’ রাসূল (সা:) এ সময় নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলী (রা)-এর কাছে পেশ করেন এবং বিষয়টি গোপন রাখার জন্য বলেন । এ সময় ইসলামের অবস্থা ছিল আফীক আল কিন্দীর ভাষায়, ‘আমি জাহেলী যুগে মক্কায় এসেছিলাম স্ত্রীর জন্য আতর এবং কাপড়-চোপড় ক্রয় করতে, সেখানে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের নিকট অবস্থান করি ।

ভোরবেলা কা’বা শরীফের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ে। আব্বাসও আমার সাথে ছিলেন। এ সময় একজন যুবক আগমন করেন এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর একজন নারী ও একজন শিশু এসে তার পিছনে দাঁড়ায়। এরা দু’জন যুবকটির পেছনে সালাত আদায় করে চলে যায় । তখন আমি আব্বাসকে বললাম, ‘আব্বাস! আমি লক্ষ্য করছি, এক বিরাট বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে।’ আব্বাস বললেন, ‘তুমি কি জান, এ যুবক এবং মহিলাটি কে?” আমি জবাব দিলাম, ‘না’। তিনি বললেন, ‘যুবকটি হচ্ছে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব। আর শিশুটি হচ্ছে আলী ইবনে আবূ তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। যে নারীকে তুমি সালাত আদায় করতে দেখেছ, তিনি হচ্ছেন আমার ভাতিজা মুহাম্মদ-এর স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ।

আমার ভাতিজার ধারণা, তার ধর্ম খাছ একনিষ্ঠ ধর্ম এবং সে যা কিছু করছে আল্লাহর হুকুমেই করছে। যতদূর আমার জানা আছে, সারা দুনিয়ায় এ তিনজন ছাড়া আর কেউ তাদের দ্বীনের অনুসারী নেই। এ কথা শুনে আমার মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে যে, চতুর্থ ব্যক্তি যদি আমি হতাম।’ (তাবাকাত ৮ম খণ্ড, পৃ-১১)।

খাদীজা (রা) তৎকালীন সময়ে আরবের একজন প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন । ফলে তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই তার পিতৃকূলের লোকদের ওপরও পড়ে। জানা যায় তাঁর পিতৃকূলে বনূ আসাদ ইবনে আবদুল উযযার জীবিত পনের জন বিখ্যাত ব্যক্তির দশজনই ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম কবুল করেন। এর মধ্যে খাদীজার ভাতিজা হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবা হাকীম জাহেলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়া’ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। অপর ভাতিজা আওয়ামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী যুবাইর (রা)। এ যুবাইর (রা)-এর মা ছিলেন রাসূল (সা:) এর আপন ফুফু। খাদীজা (রা)-এর এক বোন হালা ছিলেন রাসূল (সা:) এর মেয়ে যয়নাব (রা)-এর স্বামী আবূল আস ইবনে রাবী’র মা । এ হালাও ইসলাম কবুল করেছিলেন। মোট কথা খাদীজা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের পর তার বংশের ছোট-বড় অনেকে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন আবার অনেকে ইসলাম সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতে থাকেন।

জীবনচরিত : খাদীজা (রা) সে সম্মানিতা মহিলা যিনি নবীজীর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির সুসংবাদ প্রথম শুনেছিলেন। তিনি নির্দ্বিধায় সর্বপ্রথম রাসূল (সা:) এর নবুওয়্যাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং ইসলাম কবুল করেছিলেন । সাথে সাথে তাঁর সমস্ত অর্থ সম্পদ রাসূল (সা:) এর হাতে সোপর্দ করেছিলেন তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করার জন্য। রাসূল (সা:) এর সাথে তাঁর ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি রাসূল (সা:) এর বিপদে আপদে সুখে-দু:খে সর্বোত্তম বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছেন। একজন শান্ত্বনা ধাত্রী হিসেবে সময়ে অসময়ে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন জীবন-মরণ বাজি রেখে।

রাসূল (সা:) নিজেও খাদীজা (রা)-কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যে কারণে নিজের থেকে ১৫ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও খাদীজা (রা) জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।

রাসূল খাদীজা (রা)-কে কেমন ভালোবাসতেন তা আয়েশা (রা)-এর বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায় । তিনি বলেন, ‘খাদীজার প্রতি আমার যতটা ঈর্ষা ছিল রাসূল (সা:) এর অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি ততটা ছিল না।

একদিন রাসূলে করীম (সা:) আমার সামনে তাঁর কথা উল্লেখ করলে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে বলি, ‘সে তো ছিল বৃদ্ধা স্ত্রী, এখন আল্লাহ তা’আলা আপনাকে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট স্ত্রী দান করেছেন; তবুও আপনি তার কথা কেন স্মরণ করছেন?’ আমার কথা শুনে আল্লাহর রাসূল ক্রুদ্ধ হন। রাগে তাঁর পশম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তাঁর চেয়ে উত্তম স্ত্রী আমি পাইনি। যখন সকলে ছিল কাফির, তখন সে ঈমান এনেছিল । যখন সকলে আমাকে অবিশ্বাস করেছিল, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল । যখন সকলে আমাকে ত্যাগ করেছিল, তখন সে অর্থ-সম্পদ দিয়ে আমার সহায়তা করেছিল । আল্লাহ তা’আলা তাঁর গর্ভেই আমাকে সন্তান দান করেছেন।

আয়েশা (রা) বলেন, ‘এরপর আমি অন্তরে অন্তরে বলি-ভবিষ্যতে আমি কখনো খারাপ অর্থে তাঁর নাম মুখে নেবো না।’

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও খাদীজা ছিলেন অতুলনীয়া। যে কারণে রাসূল (সা:) বলেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন সন্তানের মাতা এবং গৃহকর্ত্রী।’

আবূ হুরাইরা (রা) তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত নারীর ওপর চারজন নারীর মর্যাদা রয়েছে— মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ।’ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূল (সা:) মাটির ওপর চারটি রেখা এঁকে বলেন, ‘জান, এটি কি? সাহাবীরা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা:)-ই ভালো জানেন। রাসূল বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ চার জন জান্নাতী নারী-
১. খাদীজা (রা),
২. ফাতিমা (রা),
৩. মারইয়াম (রা) (ঈসা (আ)-এর মা),
৪. আছিয়া (রা) (ফেরাউনের স্ত্রী)।

সত্যি কথা বলতে কি, রাসূল (সা:) খাদীজার যত প্রশংসা করতেন অন্য কোন স্ত্রীর ব্যাপারে ততটা করতেন না ।
সমগ্র আরব যখন রাসূল (সা:) এর দুশমনে পরিণত হয় অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে, তখন একদিন নবীজীকে খুঁজতে খাদীজা (রা) বাইরে বের হন। পথে জিবরাঈল (আ) মানুষের রূপ ধরে তাঁর কাছে আসেন এবং রাসূল (সা:) এর খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু খাদীজা (রা) ভয় পেয়ে যান এ ভেবে যে সম্ভবত তিনি শত্রু, রাসূল (সা:) কে হত্যা করার জন্য খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। সে কারণে তিনি ভয় পেয়ে যান এবং দ্রুত গৃহে ফিরে আসেন। বিষয়টি রাসূল (সা:) কে খুলে বললে তিনি বলেন, ‘ঐ ব্যক্তিটি ছিলেন জিবরাঈল (আ) । তিনি আমাকে বলে গেছেন, তোমাকে তাঁর সালাম পৌঁছাতে এবং জান্নাতে এমন গৃহের সুসংবাদ শুনাতে যে গৃহ তৈরি হয়েছে মণি-মাণিক্য দিয়ে, হৈ চৈ আর কষ্ট ক্লেশ কিছুই থাকবে না সেখানে ।

একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, একবার রাসূলে করীম (সা:) ফাতিমা (রা)-কে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান এবং জিজ্ঞেস করেন, মা তোমার কি অবস্থা? তিনি বললেন, আমি অসুস্থ। তদুপরি ঘরে খাবার কিছু নেই। রাসূল আপনারাই বললেন, কন্যা! তুমি দুনিয়ার নারীদের সরদার। এতে তুমি কি সন্তুষ্ট নও? ফাতিমা (রা) বললেন, “বাবা! তাহলে মারইয়াম বিনতে ইমরান?’ রাসূল (সা:) বললেন, তুমি তোমার যুগের নারীদের সরদার। মারইয়াম ছিল অতীতকালের নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম। আর খাদীজা বর্তমান উম্মতের নারীদের মধ্যে উত্তম।’

রাসূল (সা:) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যুর পরও তাঁকে ভুলতে পারেননি। যে জন্য তাঁর মৃত্যুর পর যতবারই বাড়িতে পশু জবেহ হতো, ততবারই তিনি তালাশ করে করে খাদীজার বান্ধবীদের ঘরে ঘরে হাদিয়া স্বরূপ গোশত পাঠিয়ে দিতেন । একবার রাসূল (সা:) এর কাছে জিবরাঈল (আ) বসে আছেন, এমন সময় সেখানে খাদীজা (রা) উপস্থিত হলেন। খাদীজাকে দেখে জিবরাঈল (আ) রাসূল (সা:) কে বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরি একটি জান্নাতী মহলের সুসংবাদ দিন।’

প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজা (রা) যখন প্রিয় দাস যায়িদ বিন হারিসাকে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন তখন রাসূল (সা:) স্ত্রীকে খুশি করার জন্য যায়িদকে স্বাধীন করে দিলেন। খাদীজার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে আয়েশা (রা) যখন রাসূল (সা:) কে ভালোবাসারচ্ছলে রাগাতে চেষ্টা করতেন তখন তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ আমার অস্তরে তাঁর (খাদীজার) জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’

খাদীজা (রা)-এর সন্তান-সন্তুতি : খাদীজা (রা)-এর গর্ভে রাসূল (সা:)-এর ৬ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। ৪ জন মেয়ে ও ২ জন ছেলে। পর্যায়ক্রমে তারা হলেন-
১. কাসিম (রা)। যে কারণে রাসূল (সা:) এর ডাক নাম ছিল আবুল কাসিম। কাসিম (রা) অল্প বয়সে মক্কায় ইনতিকাল করেন।

২. যয়নব (রা) । যার বিবাহ হয়েছিল খাদীজার ভাগিনেয় আবুল আস (রা)-এর সাথে।৩. রুকাইয়া (রা)।

৪. উম্মু কুলসুম (রা)। রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয়েছিল আবু লাহাবের দুই পুত্রের সাথে। পরবর্তীতে তাদের বিবাহ ভেঙ্গে দেয়া হয় । পরে রুকাইয়াকে ওসমান (রা)-এর সাথে বিবাহ দেয়া হয়। হিজরী দ্বিতীয় সনে রুকাইয়া (রা)-এর মৃত্যু হলে রাসূল (সাঃ) উম্মে কুলসুমকে ওসমানের সাথে বিবাহ দেন’ এ জন্য তাকে যুন নূরাইন দুই জ্যোতির অধিকারী বলা হয়।

৫. খাতুনে জান্নাত ফাতিমা (রা)। তার সাথে আলী (রা)-এর বিবাহ হয় ।

৬. আবদুল্লাহ (রা)। যিনি নবুয়াতপ্রাপ্তির ১ বছর পর জন্মলাভ করেন। আবদুল্লাহ অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার জন্মের কারণে খাদীজা প্রথম সন্তান ও জ্যেষ্ঠ পুত্র কাসিম (রা)-এর শোক ভুলে যান। কিন্তু তিনিও শিশুকালেই ইন্তেকাল করেন। তারই উপাধি ছিল তায়্যিব ও তাহির । কারণ তিনি নবুয়্যাতের যুগে জন্মগ্রহণ করেন ।

নবুওয়্যাতের পঞ্চম বছর রজব মাসে মুসলমানদেরকে হাবশায় হিজরতের নির্দেশ দেয়া হয়। তখন খাদীজা (রা)-কে এক কন্যা হতে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। রুকাইয়া (রা) তাঁর স্বামী ওসমানের সাথে হাবশা হিজরত করেন। দীর্ঘদিন যাবত খাদীজা (রা)-কে এ বিয়োগ ব্যাথা ভোগ করতে হয়। নবুওয়্যাতের নবম ও দশম বছরের মধ্যবর্তী সময়ে তারা হাবশা (আবিসিনিয়া) হতে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ৪ বছর তিনি মাতা হতে বিচ্ছিন্ন থাকেন।

নবুওয়্যাতের অষ্টম বছর রুকাইয়ার বয়স ১৫ বছর হয় এবং তার এক বছর পর নবুওয়্যাতের নবম বছরে রুকাইয়ার গর্ভে আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ।

রাসূল (সা:) এর প্রতি নির্মম অত্যাচার : হাবশায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি কাফিরগণের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। নবুওয়্যাতের সপ্তম বছর মহররম মাস হতে ‘শিব-ই-আবি তালিব’ নামক গৃহ পথে অবরুদ্ধ থাকতে হয়। কুরাইশগণ যখন দেখল যে, সাহাবায়ে কেরাম হাবশায় পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছে এবং নাজ্জাশী তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, ওমর ও হামযা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং সকল গোত্রে ইসলামের চর্চা শুরু হয়ে গেছে, তখন তারা পরামর্শ করে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব সম্পর্কে এ অঙ্গীকারনামা প্রদান করে যার বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ : বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সাঃ) কে হত্যার জন্য তাদের নিকট সোপর্দ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করবে না, ক্রয়-বিক্রয় করবে না, তাদের সাথে মেলামেশা ও কথাবার্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখবে এবং তাদের নিকট কোন খাদ্যসামগ্রী পৌঁছতে দিবে না ।

আবদ দার গোত্রে মনসুর ইবনে ইকরামা এ অঙ্গীকারনামা লিপিবদ্ধ করেন। এর বিষয়বস্তুর প্রতি গুরুত্ব আরোপের লক্ষ্যে একে কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে ঝুলিয়ে দেয়া হয় । উপায়ান্তর না দেখে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব আবু কুবাইস পর্বতের শিব-ই আবু তালিব নামক গিরিপথে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তা ছিল হাশিম গোত্রের মীরাছী (উত্তারাধিকার) সূত্রে প্রাপ্ত গিরিপথ ।

আবু তালিব রাসূলের সঙ্গে ছিলেন। আবু তালিব তার পরিবারবর্গ নিয়ে পৃথক হয়ে যায় এবং কুরাইশদের সাথে যোগ দেয়। রাসূল (সাঃ) এর সাথে খাদীজাও এ গিরিপথে ছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এ গিরিপথে অবস্থান করেন তারা। প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সেখানে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছানো হতো। খাদীজা (রা)-এর তিন ভ্রাতুষ্পুত্র কুরাইশদের সরদার হাকিম ইবনে হিজাম, আবুল বুক্কারী ও জাম’আ ইবনুল আসওয়াত অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য পৌছানোর এ মহান কাজে অংশগ্রহণ করেন। তাদের উষ্ট্র ভিতরে প্রবেশ করত খাদ্যসামগ্রী নিয়ে। পঞ্চাশাধিক বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি অতি দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে সে পার্বত্য গিরিপথে জীবন যাপন করতে থাকেন।

একাধিকক্রমে প্রায় তিন বছর পর দুশমনদের মধ্যেই দয়ার সঞ্চার হল এবং তাদের পক্ষ হতে এ লিখিত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হল। এ নিপীড়নমূলক অঙ্গীকার ভঙ্গের উদ্যোক্তা ছিলেন কুরাইশের পাঁচজন সম্ভ্ৰান্ত ব্যক্তি। তাঁরা হলেন হিশাম ইবনে ‘আমার ‘আমিরী’, যুহাইর ইবনে আবী উমাইয়া মাখযুমী, মুত’ইম ইবনে ‘আদিয়া, আবুল-বুখতারী ইবন হিশাম ও যাম’আ ইবনুল আসওয়াদ । শেষোক্ত দুজন খাদীজা (রা)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিলেন বনু হাশিমের নিকট-আত্মীয়। যুহাইর ছিলেন আবূ জাহলের চাচাতো ভাই এবং উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)-এর ভাই। তা ছিল নবুওয়্যাতের দশম বছরের ঘটনা।

ওফাত : নবুওয়্যাতের দশম বছরে রমযান মাসের ১০ তারিখে মক্কায় খাদীজা (রা) ইন্তেকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর । তখনো জানাযার সালাতের বিধান চালু হয়নি। এ জন্য জানাযা ছাড়াই তাঁকে ‘হাজুন’ নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ‘হাজুন’ মক্কার একটি পাহাড়ের নাম। বর্তমানে এটি জান্নাতুল মাওলা বা জান্নাতুল মু’আল্লা নামে পরিচিত। নবী করীম (সাঃ) নিজেই খাদীজার লাশ কবরে নামান ।

খাদীজা (রা)-এর মৃত্যুর পর ফাতিমা (রা) রাসূল (সাঃ) এর নিকটে তাঁর মায়ের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তোমার মা খাদীজা (রা), সারা (রা) এবং মারইয়ামের মধ্যখানে অবস্থান করছেন।’

রাসূল (সাঃ) এর পৃষ্ঠপোষক চাচা আবূ তালিব খাদীজা (রা)-এর ইন্তেকালের বছরে ইন্তেকাল করেন । অবশ্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, আবূ তালিবের মৃত্যুর তিন দিন পর খাদীজা (রা) ইন্তেকাল করেন। যা হোক সময়টা ছিল রাসূল (সাঃ) একান্ত প্রিয়জন হারানোর দুঃখজনক সময়। এজন্য মুসলিম উম্মাহর নিকট এ বছরটি ‘আ’মুল হুযুন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।

উৎস: কুরআন হাদীসের আলোকে রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীগণ যেমন ছিলেন বই থেকে। সৌজন্য: পিস পাবলিকেশন -ঢাকা। 

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading