ভূমিকা: এটি মহিলা সাহাবিয়া উম্মে সুলাইম (রাঃ) জীবনের একটি ঘটনা যেখানে রয়েছে মুসলিম নারীদের জন্য অনুপম আদর্শ এবং দাম্পত্য জীবনের পাথেয়। গল্পটি পড়ুন।
নারী জাতির এক অনুপম আদর্শ (নারী সাহাবীয়ার গল্প)
হিজাজের বালু ও কঙ্করময় পর্বত মালার মধ্যখানে অবস্থিত এক ছোট্ট বস্তি ইয়াছরিব। চারদিকে খেজুর বৃক্ষের বেষ্টনী। দিন মনির নিস্তেজ আলোতে ইয়াছরিবের খর্জুর বিথিকাগুলো লম্বা লম্বা ছায়া ফেলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই বুঝি দিনমনি পর্বতমালার আড়ালে পালিয়ে যাবে। অদূরে খেজুর বাগানের এক প্রান্তে দুজন নরনারীকে আলাপরত দেখা গেলো ।
উভয়ে কথা বলছিলো নিচু আওয়াজে, অনুচ্চ কণ্ঠে। মহিলাটির আসল নাম মাহলা। উপনাম উম্মে সুলাইম। মানুষের মাঝে উপনামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। পুরুষটি মহিলাকে লক্ষ্য করে বলছে-
: আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই ।
: তুমি মুশরিক। আমি মুসলমান। তোমার সাথে আমার বিয়ে হতে পারে না। হ্যাঁ, যদি তুমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনো, তাঁকে সত্য নবী বলে স্বীকার করো, তাঁর আনীত ধর্মের অনুসরণ করো, তাহলে আমি তোমাকে বিবাহ করে নিবো। তদুপরি তোমার নিকট আমি কোন মহরও দাবি করবো না। তোমার ইসলাম গ্রহণই হবে আমার জন্য মহর ৷
এ বলে উম্মে সুলাইম ক্ষণিকের জন্য থামলেন । তারপর আবার বলতে লাগলেন-
: তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো আবু তালহা! তোমরা যে সকল মাবুদের ইবাদত কর সেগুলো বৃক্ষের একখণ্ড কাঠ মাত্র। আর বৃক্ষ সম্পর্কে সকলেই জানে যে, উহা মাটি থেকে উৎপন্ন হয়। কাঠের এ টুকরাগুলো তোমাদেরকে না কোনো উপকার পৌঁছাতে পারে, না ক্ষতি সাধন করতে পারে । বলো তো আবু তালহা! অমুক মিস্ত্রি কি একে করাত দিয়ে চিড়েনি?
: হ্যাঁ। জবাব দিল আবু তালহা ।
: তাহলে একটি কাষ্ঠ খণ্ডের সামনে সিজদায় পড়ে থাকতে তোমাদের কি বিবেকে বাধে না!? লজ্জা হয় না তোমাদের!?
: ঠিক আছে, তুমি আমাকে একটু ভাবার সুযোগ দাও ।
এ বলে সে গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটি নিশ্চল পাথরের মূর্তি জমিনের উপর দিয়ে এগেিয় চলছে। মন- মস্তিষ্কে বয়ে চলছে একটি প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডব লীলা ।
বাড়িতে ফিরার পর সময় যতই যাচ্ছে ততই আবু তালহার চিন্তার স্রোত তীব্রতর হচ্ছে । তার কর্ণকুহরে বারবার ধ্বনিত হচ্ছে উম্মে সুলাইমের সেই কথাগুলো-
“তোমার কি খবর নেই তোমাদের মাবুদ একটি কাষ্ঠখণ্ড মাত্র। অমুক মিস্ত্রি কি একে করাত দিয়ে চিড়ে নি? তোমরা এর সামনে অবনত মস্তকে দাড়িয়ে থাক……. লজ্জা হয় না তোমাদের?”
এভাবে চিন্তা করতে করতে আবু তালহার কেটে গেল কয়েকটি রাত। তাদের আকীদা বিশ্বাসগুলোকে উম্মে সুলাইমের নিকট তুলে ধরার জন্য অনেক যুক্তি প্রমাণ খুঁজলো সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশা ছাড়া কিছুই পেল না। বরং তার নিকট তাদের বিশ্বাসগুলোকে অন্তসারশূন্যই মনে হলো । তাই অবশেষে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলো সে ।
পরদিন প্রত্যুষে নবীয়ে রহমতের দরবারে হাজির হয়ে কালিমায়ে শাহাদত পাঠ করে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন আবু তালহা (রা.)। অতঃপর স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) এর সাথে তার বিবাহ পড়িয়ে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ছিলো এমনই একটি ব্যতিক্রম বিবাহ যার মহর ধরা হয়েছিলো ইসলাম গ্রহণকে ।
হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) ছিলেন ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার উজ্জ্বল প্রতীক । ছিলেন একান্ত পতিপরায়না। তার আচার-ব্যবহার কিংবা কথাবার্তায় প্রাণপ্রিয় স্বামীর সামান্যতম কষ্ট হউক তা তিনি কখনোই চাইতেন না। নিম্নোক্ত ঘটনাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ ।
আবু তালহা (রা.) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর উম্মে সুলাইম (রা.) এর ঘরে জন্ম নেয় একটি ছেলে সন্তান। ছেলেটির নাম রাখা হয় আবু উমাইর। পিতা-মাতা উভয়ই তাকে ভীষণ ভালোবাসতো । আদর করতেন । স্নেহ দিতেন ।
অপরিসীম স্নেহ মমতায় বেড়ে উঠে আবু উমাইর। এভাবে বড় হতে হতে সে যখন হাঁটাহাঁটির বয়সে উপনীত হলো তখন একদিন সে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। ঘটনাক্রমে সেদিন আবু তালহা (রা.) বাড়িতে ছিলেন না। তিনি বাড়িতে ফিরার পূর্বেই আল্লাহ পাক আবু উমাইরকে দুনিয়া থেকে নিয়ে নেন। চলে যায় আবু উমাইর চিরদিনের জন্য ৷
ছেলের মৃত্যুতে উম্মে সুলাইম (রা.) এর মাতৃহৃদয় ডুকরে কেঁদে উঠে। কিন্তু তিনি তা বাইরে প্রকাশ করলেন না। উপরন্তু বাড়ির লোকদের বলে দিলেন, তোমরা ছেলে সম্পর্কে আবু তালহাকে কিছুই বলো না। যা বলার আমিই বলবো ।
রাতে আবু তালহা (রা.) বাড়ি এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আবু উমাইর কেমন আছে? জবাবে তিনি বললেন পূর্বের চেয়ে ভালো আছে । অতঃপর রাতের আহার শেষে হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) স্বামীর জন্য পুর্বের তুলনায় আরো অধিক সুন্দর করে সাজগোজ করলেন। তারপর স্বামীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন শেষে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে বিনম্র স্বরে বললেন-
: প্রেমাস্পদ আমার! বলুন তো কোনো কওম যদি কোনো গৃহবাসীকে একটা জিনিস নিছক ধার হিসেবে প্রদান করে তারপর সেই জিনিসটি ফেরত চায় তবে কি সেই গৃহবাসী তাদের ধার ফেরত না দেওয়ার অধিকার রাখে?
: না, অবশ্যই সেটা ফেরত দিতে হবে। জবাবে বললেন আবু তালহা (রা.)।
: তাহলে আবু উমাইরের ব্যাপারে আপনাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ দিয়ে আবার তিনিই তা ফেরত নিয়েছেন। অত্যন্ত প্রসন্ন মনে স্থিরতার সহিত কথাগুলো বললেন হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) ।
পূর্বেই কেন এ কথাটি আবু তালহা (রা.) কে অবহিত করা হলো না এজন্য তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। বললেন, তুমি আগে কিছু বললে না, এমনকি (মৃত ছেলেকে ঘরে রেখে) তোমার সাথে দৈহিক সম্পর্কও স্থাপন করে ফেললাম ।
পরদিন সকালে আবু তালহা (রা.) রাসূলে আকরাম (রা.) এর দরবারে উপস্থিত হলেন এবং পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে শুনালেন। রাসূল (সা.) বললেন, হে আবু তালহা! গত রাতে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর বিশেষ বরকত নাজিল করেছেন।
এর কিছুদিন পর আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে আবু উমাইরের পরিবর্তে একটি পুত্র সন্তান দান করেন যার নাম রাখা হয় আব্দুল্লাহ। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ও তাঁর বংশধরদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞ আলেম হয়েছিলেন ।
প্রিয় পাঠক! হযরত উম্মে সুলাইম (রা.) আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে এ পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন সত্য কিন্তু রেখে গেছেন যুগ যুগান্তরের মুসলিম রমণীদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে গোটা নারী জাতিকে এ কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, স্বামী ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোনো বিপদের খবর শোনানো যাবে না । শুনাতে হবে কিছুক্ষণ পরে, সময় মতো, মন ও মেজাজ বুঝে ।
স্মরণীয় বাণী
যে তোমাকে দান করে না, তুমি তাকে দান কর। যে তোমাকে দূরে ঠেলে দেয়, তাকে তুমি টেনে রাখ। যে তোমার অপকার করে, তার তুমি উপকার কর।-হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)
ঘটনার সূত্র : বুখারী শরীফ #তারাশে #হায়াতুস সাহাবা ।
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বই: নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী থেকে।