এটি একজন নারীর জীবনের গল্প যিনি পূর্বের ন্যায় স্বামীর ভালোবাসা ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো কিছু উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে এক দরবেশের শরানাপন্ন হয়েছিলেন। অতঃপর দরবেশের পরামর্শে এই যুবতি নারী স্বামীর ভালোবাসা পূর্বের ন্যায় ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু কি ভাবে? জানতে চলুন মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলামের কলমে এই নারীর জীবনের গল্পটি পড়া যাক।
দুনিয়ার বেহেশত লাভ হবে যেভাবে (নারীর জীবনের শিক্ষনীয় গল্প)
ভোরের স্নিগ্ধ হওয়া বইছে। পূর্ব আকাশ রাঙ্গা করে উঁকি দিয়েছে অরুণ আলো। গোটা পৃথিবী নতুন জীবন লাভ করলো যেন। প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের হাতছানি, গাছে গাছে পাখির মিষ্টি কলতান যে কোনো মানুষের ভালো লাগারই কথা । কিন্তু খালেদার আজ কিছুই ভালো লাগছে না ।
খালেদা বিশ বাইশ বছরের যুবতী। দেখতে শুনতেও খুব একটা খারাপ নয়। মুখখানা ততটা আকর্ষণীয় না হলেও দেহের অপূর্ব গঠন যে কোনো দর্শককে মুগ্ধ করে ।
ছয় বছর আগে এক সুশ্রী যুবকের সাথে খালেদার বিয়ে হয়। কয়েক বছর স্বামী স্ত্রীর মাঝে খুব মহব্বত ছিল। একজন অপরজনকে ছাড়া কিছুই কল্পনা করতে পারতো না। দু’বছরের মাথায় খালেদার কোল আলোকিত করে একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। ছেলেটি খুবই সুন্দর ও ফুটফুটে। খালেদা তার প্রিয়তম স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ছেলেটির নাম রাখে সাইফুল ইসলাম শিহাব
খালেদার স্বামীর নাম মনজুরুল ইসলাম শিবলী। সবাই তাকে শিবলী বলেই ডাকতো। শিহাবের বয়স দু’বছর হওয়া পর্যন্ত খালেদা-শিবলীর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুময় ছিল। শিবলী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বাড়ির পার্শ্ববর্তী মার্কেটেই তার বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়িক কাজে সে সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও এরই মাঝে প্রত্যহ দুই তিন বার খালেদাকে না দেখে সে থাকতে পারে না। শিবলী যখন কর্মচারীদের উদ্দেশ্য করে বলতো, তোমরা একটু ভালো করে খেয়াল রেখো, আমি বাসা থেকে আসছি, তখন তারা একথাই বুঝতো যে, খালেদা ভাবীর টানেই তিনি বাসার দিকে চলছেন। মোটকথা, তাদের এই সুসম্পর্কের বিষয়টি ইতোমধ্যেই অনেকে জেনে ফেলেছিল।
কিন্তু আজ দু’বছর যাবত ক্রমেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। দিন যতই যাচ্ছে সম্পর্কে ততই ফাটল ধরছে। অবনতি ঘটছে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার। আর এজন্যেই খালেদার মন ভালো নেই। স্বামী-স্ত্রীর এই সুখময় সম্পর্কের মাঝে কিভাবে, কি কারণে চির ধরলো, কেনই বা স্বামী তাকে আগের মতো ভালবাসে না; হৃদয়ের গভীর থেকে প্রেম বিনিময় করে না, এসব চিন্তায়ই সর্বদা ডুবে থাকে খালেদা ।
সুন্দর বনের অদূরবর্তী একটি গ্রামে শিবলী-খালেদা বসবাস করে। একদিন খালেদা শুনতে পেলো সুন্দরবন এলাকায় একটি ছোট পাহাড়ের পাদদেশে একজন দরবেশ থাকেন। এই দরবেশ নাকি খুবই কামেল লোক ৷ দুনিয়ার ধন সম্পদ ও টাকা পয়সার প্রতি মোটেই কোনো আগ্রহ নেই । আল্লাহর ইবাদত ও সৃষ্টির সেবা এ দুয়ের মাঝেই অতিবাহিত হয় তার গোটা সময়। সৃষ্টির সেবা করে তিনি হৃদয়ে অনুভব করেন এক পরম শান্তি । এই দরবেশের প্রশংসা এক এক করে অনেকের মুখেই শুনতে পায় খালেদা ।
লোকজনের মুখে দরবেশের প্রশংসা শুনে তার প্রতি খালেদার সৃষ্টি হয় এক অগাধ ভক্তি। মনে মনে ভাবে- দরবেশ তো মানুষের উপকারের মাঝেই শান্তি খুঁজে পান। বর্তমানে শিহাবের পিতার সাথে আমার যে টানপড়েন অবস্থা, সম্পর্কের যে ক্রম অবনতি – এমতাবস্থায় দরবেশের কাছ থেকে একটি তাবিজ আনলে তো মন্দ হয় না। তিনি বুযুর্গ মানুষ। তাঁর দেওয়া তাবিজ ব্যবহার করলে আমাদের দাম্পত্য জীবনে আবারো ফিরে আসবে শান্তি-সুখ ও সমৃদ্ধি । ফিরে আসবে মধুময় জীবন ।
কথাটি চিন্তা করতেই খালেদার মন খুশিতে ভরে উঠে। চেহারায় ফুটে উঠে আনন্দ উচ্ছ্বাস। তাই কালক্ষেপণ না করে ঠিকানা নিয়ে সে দ্রুত হাজির হয় দরবেশের খানকায়। দরবেশ তখন একটি কাজে মশগুল ছিলেন। একটি মেয়েকে খানকায় প্রবেশ করতে দেখে তিনি তাকে হাতের ইশারায় পর্দার আড়ালে যেতে বললেন। তারপর অত্যন্ত দরদ মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন-
: মা! এখানে কেন, কি উদ্দেশ্যে এসেছো? সঙ্গে কোনো মাহরাম আছে?
: না, কোনো মাহরাম নেই। আমি একাই একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি।
: এখন তুমি চলে যাও । পরবর্তীতে কোন মাহরাম পুরুষকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো । তখন তোমার সব কথাই আমি শুনবো ।
: হুজুর! আমি একটি অসহায় মেয়ে। আমাকে আপনি তাড়িয়ে দিবেন না। মাহরাম পুরুষদের মধ্যে আমার আব্বা ও ভাই আছেন । তারা দেশের বাড়িতে থাকেন। আমাদের বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলায়। এতদূর থেকে আব্বা কিংবা ভাইকে নিয়ে আসা সম্ভব নয় ।
: তোমার কি স্বামী নেই?
: হ্যাঁ, আছে ৷
ঃ তার সঙ্গে এসো ।
ঃ সেটাও সম্ভব নয় ।
ঃ কেন?
: আমি আপনার নিকট যা বলতে চাই, তা আমার স্বামী সম্পর্কেই । সুতরাং তার ব্যাপারে তার সামনেই কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি?
: ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি। এবার তাহলে যা বলার সংক্ষেপে বলে ফেলো ৷
ঃ হযরত! আমার বিয়ে হয়েছে আজ ছয় বছর। আমার চার বছরের একটি ছেলে আছে। স্বামীর নাম মনজুরুল ইসলাম শিবলী । তিনি একজন নামকরা ব্যবসায়ী। অঢেল টাকা পয়সার মালিক। বিয়ের পর প্রায় চার বছর পর্যন্ত আমাদের দাম্পত্য জীবন খুব সুখেই কাটছিলো। তখন কারো মাঝেই আন্তরিকতা ও মহব্বতের কোনো কমতি ছিলো না । তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমিও তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালো- বাসতাম ও পছন্দ করতাম । কিন্তু প্রায় দু’বছর আগে হঠাৎ করেই আমাদের ভালোবাসায় ফাটল ধরে। তিনি এখন বাইরে থেকে এসে আগের মতো আমাকে ভালোবাসা দিতে চান না। প্রেম বিনিময় করেন না। প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেন না। খানা পেশ করলে খুশির সাথে গ্রহণ করেন না । সর্বদা আমাকে এড়িয়ে চলতে চান। আমি দূরে থাকি, তার কাছে না আসি, এই যেন তার পছন্দ। অথচ আগে আমাকে কয়েক ঘন্টা না দেখে থাকতে পারতেন না । আমাকে নিয়ে একত্রে এক প্লেটে খানা খেতেন ।
হুজুর! আমার স্বামীর মেজাজ এখন খিটখিটে হয়ে গেছে। আগে দোকান থেকে বাসায় এসেই খালেদা, খালেদা করে ডেকে সারা বাড়ি মাতিয়ে তুলতেন; আর এখন এসে একা একা শুয়ে কি যেন চিন্তা করেন ৷ জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর দেন না । এমতাবস্থায় আমার হৃদয়ে কেবল এ ধারণাই বদ্ধমূল হচ্ছে যে, তিনি অন্য কোনো মেয়ের প্রেমে আবদ্ধ হয়েছেন। তাই সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকে । হুজুর! আমি আপনার নিকট এ উদ্দেশ্যেই এসেছি যে, আপনি দয়া করে আমাকে একটি তাবিজ দিবেন যার অসিলায় আমার স্বামী আগের মতো আমাকে ভালোবাসবে, তার হৃদয় জগতে খালেদা নামের মেয়েটিই কেবল সর্বদা বিচরণ করবে ।
দরবেশ সাহেব অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে মেয়েটির কথা শুনলেন। তারপর ক্ষণকাল চুপ থেকে বললেন-
তোমার স্বামী একজন যুবক ছেলে। আর কোনো যুবক যখন মানসিকভাবে পেরেশান থাকে তখনই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমার মনে হয়, তোমার স্বামী যখন দোকানের বিভিন্ন ঝামেলা সহ্য করে একটু সুখের আশায় তোমার নিকট আসে তখন হয়ত তোমার কাছ থেকে তা পায় না । যা হোক, তোমার কাজটা খুবই কঠিন যা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি এখন যেতে পারো ।
দরবেশের কথায় খালেদা আর্তনাদ করে উঠলো ৷ সে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, হুজুর! আমি একজন মেয়ে মানুষ হয়ে এতদূর থেকে এতো কষ্ট করে আপনার নিকট চলে এলাম আর আপনি আমাকে হতাশ করে ফিরিয়ে দিবেন? হুজুর! আমার প্রতি একটু দয়া করুন। মেহেরবানী করে আমাকে এমন একটি উপায় বাতলে দিন যদ্বারা আমাদের জীবনে আবারো বইতে থাকবে শান্তি সুখের ফল্গুধারা ।
দরবেশ বললেন, বললাম তো, ব্যাপারটি অত্যন্ত কঠিন। আমার পক্ষে তা সম্ভব হবে না ৷
খালেদা কাকুতি মিনতি করে পূর্বের কথাগুলো পুনরায় উত্থাপন করলো। সে বারবার দরবেশকে বুঝাতে চাইলো, যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বামীর পূর্ববৎ ভালোবাসা সে চায়-ই ।
এবার দরবেশ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে । তুমি তিনদিন পরে এসো। তিন দিনের মধ্যে আমি তোমার জন্য একটি ব্যবস্থা করে রাখবো ।
দরবেশের কথায় খালেদার আনন্দ যেন আর ধরে না। সে উৎফুল্ল হৃদয়ে বাড়ি চলে গেলো। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো তিন দিন শেষ হওয়ার ।
কথায় বলে, অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়েও শ্রেয়। অপেক্ষার সময় অনেক দীর্ঘ মনে হয় । খালেদার বেলায়ও তা-ই হলো। তার কাছে তিনদিন যেন তিন বছর মনে হলো। তার মন বলছিলো, বৈজ্ঞানিক কোনো উপায় অবলম্বন করে তিনদিনকে যদি কমিয়ে একদিনে আনা যেতো, তবে যে কোনো মূল্যে সে তা-ই করতো। যা হোক অবশেষে তিনদিন পর খালেদা পুনরায় দরবেশের দরবারে উপস্থিত হলো ।
এবার দরবেশকে কিছুটা পেরেশান ও হতাশাগ্রস্থ মনে হলো। তিনি খালেদাকে পূর্বের ন্যায় পর্দার আড়ালে যেতে বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: তোমাকে একটি তাবিজ দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তোমার তাবিজখানা এ কয়দিনে নিশ্চিত তৈরি হয়ে যেতো, তবে……. ।
তবে বলে দরবেশ সাহেব ইচ্ছে করেই মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন । বুঝতে চাইলেন মেয়েটির আগ্রহ উদ্দীপনার অবস্থা ।
ঃ তবে কি? খালেদা ব্যস্ত কন্ঠে জানতে চাইলো ।
: এই তাবিজ তৈরি করতে যেসব জিনিসের প্রয়োজন তার সবগুলোই আমি সংগ্রহ করেছি। কিন্তু একটি জিনিস সংগ্রহ করতে পারিনি। আর পারবো বলেও মনে হয় না। দরবেশ স্থির অথচ দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললেন ।
ঃ যে কোনো উপায়ে আমি এ জিনিস আপনাকে সংগ্রহ করে দিবো। আপনি শুধু বলুন সে জিনিসটি কী?
ঃ একটি গোঁফ মাত্র। তবে তা মানুষের গোঁফ নয়, সিংহের গোঁফ । তাও আবার মৃত সিংহের নয়, জীবিত সিংহের। যদি তুমি জীবিত সিংহের একটি গোঁফ আমাকে এনে দিতে পারো, তাহলে তোমার কাজ হয়ে যাবে ।
ঃ সিংহের গোঁফ! তাও আবার জীবিত!! আমার পক্ষে তা কি করে সম্ভব? খালেদা চরম বিস্ময় নিয়ে বলল ।
: সম্ভব না হলে তাবিজও পাবে না। তোমার তাজিব এ ছাড়া হবেই না। তোমার যদি তাবিজ এত বেশি দরকার হয় তাহলে জীবিত সিংহের গোঁফ লাগবেই । আর যদি মনে করো, তাবিজের প্রয়োজন নেই, তবে কষ্ট করে গোঁফ সংগ্রহ করারও কোনো দরকার নেই। এ বলে দরবেশ অন্যমনস্ক হয়ে আপন কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ।
দরবেশেরে এ শক্ত কথায় খালেদার সব আশা যেন মুহূর্তে মাটি হয়ে গেলো। চেহারায় ফুটে উঠল চরম বিষণ্নতা। এ মুহূর্তে সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। অবশেষে খানিক পরে বাসায় ফিরার প্রাক্কালে দরবেশকে আবারো সে বললো-
: তবে কি সিংহের গোঁফ ছাড়া তাবিজ হবেই না ?
: না, হবে না । আমার একটাই কথা । তাবিজ চাইলে গোঁফ লাগবেই ।
খালেদা আর কথা বাড়ালো না। সে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে উদাস মনে বাসায় ফিরে এলো। তারপর দিনরাত কেবল একই চিন্তায় মগ্ন থাকলো- কিভাবে, কি উপায়ে জীবিত সিংহের গোঁফ আনা যায় ।
বেশ কিছুদিন চিন্তা-ভাবনা করার পর তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো । সে ভাবলো, এমনি তো সিংহের সামনে গেলে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার এক ভাগও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আদর যত্ন করে, তার রুচি মতো খাবার খাওয়ারে মন জয় করার পরে তো এক সময় তার সামনে যাওয়া যেতে পারে। আর কোনো রকম একবার কিছুক্ষণের জন্য যেতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে।
এই চিন্তা মাথায় আসার পর থেকেই খালেদা রাতের অপেক্ষায় থাকলো। যখন রাত গভীর হলো এবং স্বামীও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো তখন সে থালার মধ্যে কিছু কাঁচা গোশত নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঘর থেকে একটু দূরেই সুন্দরবন। সে ধীরে ধীরে বনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো । তাবিজ প্রাপ্তির অদম্য আগ্রহ তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিলো। ভুলিয়ে দিলো একথাও যে, সে একজন নারী; তার পক্ষে গভীর রাতে একাকী পথ চলা নিরাপদ নয় ।
খালেদা এখন নির্ভীক । তথাপি কিছুটা ভয় যে তার লাগেনি তা নয় । যেতে যেতে সে এমন এক জায়গায় গেলো যেখানে সিংহ থাকে। সেখানে গিয়ে গোশতগুলো রেখে সুউচ্চ কন্ঠে আওয়াজ দিয়ে বললো-
হে বনের রাজা! তোমার জন্য খানা নিয়ে এসেছি, খেয়ে যাও ।
খালেদার এ আহবানে কোনো সিংহ সাড়া দিলো না। একই আহবান সে আরো কয়েকবার জানালো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাসায় ফিরে এলো।
পরদিন রাতে আবারো সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলো। এভাবে একাধারে বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর সিংহও আস্তে আস্তে গুহা থেকে বের হয়ে মজা করে গোশত খেতে লাগলো ।
খালেদা এখন খুশি। সে ভাবলো, সিংহকে যখন গোশতের লোভ দেখিয়ে প্রতি রাতেই গুহা থেকে বের করে আনতে পেরেছি, তখন একদিন না একদিন তার কাছেও পৌঁছতে পারবো। তাই সে প্রত্যহ এক পা দু পা করে ভয়ে ভয়ে সিংহের নিকটবর্তী হতে লাগলো। সিংহকে দেখে যদিও তার বুক দুরু দুরু করতো, এমনকি কোনো কোনো সময় অধিক ভয় পেয়ে দ্রুত বাসায় চলে আসতো, তবুও সে সিংহের নিকটে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলো। এভাবে সময় যেতে যেতে একদিন অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তার মন থেকে সিংহের ভয় একদম দূরীভূত হয়ে গেলো ।
এক রাতের ঘটনা। খালেদা গোশত নিয়ে সিংহের গুহার সামনে উপস্থিত। তার আগমন টের পেয়ে সিংহ তার গুহা থেকে বের হতে না হতেই খালেদা গোশতের পাত্রটি সিংহের সম্মুখে রেখে দিলো। তখন সিংহ মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে অনুগত পশুর মতোই মাথা নিচু করে খেতে শুরু করলো । এবার খালেদা দেহের সমস্ত সাহস একত্রে সঞ্চয় করে সিংহের একেবারে কাছে গেলো । তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো। কিন্তু সিংহ কোনো সাড়া শব্দ করলো না। এতে খালেদার মনে আরো সাহস সঞ্চয় হলো। বললো, হে জঙ্গলের বাদশাহ! আমার শুধু তোমার একটি গোঁফ দরকার । একথা বলে সিংহের একটি গোঁফ ধরে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টান মেরে তা ছিড়ে ফেললো। কিন্তু এবারও সিংহ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। সুবোধ বালকের মতোই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো । এতদিন যাবত খালেদার আদর-যত্ন ও খাবার খেয়ে বনের সিংহটি যেন একেবারেই বশীভূত হয়ে গেল। সে যে একটি হিংস্র প্রাণী-বনের রাজা একথাও যেন বেমালুম ভুলে গেলো ৷
খালেদার আনন্দ আর ধরে না। সে সিংহের গোঁফ সংগ্রহ করে অতি দ্রুত বাসায় ফিরে এলো। তারপর ভোরের অপেক্ষায় অবশিষ্ট রাতটি ছটফট করে কাটালো ।
সকালে সে দৌড়ে গিয়ে দরবেশের কাছে উপস্থিত হলো। আনন্দের আতিশয্যে দূর থেকেই চিৎকার করে বলতে লাগলো- পেয়ে গেছি । সিংহের গোঁফ পেয়ে গেছি। এখন আপনার কথামতো আমাকে তাবিজ বানিয়ে দিন। যাতে করে আমার স্বামী আগের মতো আমাকে ভালবাসে। প্রেম-প্রীতি ও স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে ।
দরবেশ বললেন, কই সিংহের গোঁফ? দাও তো দেখি ।
খালেদা সিংহের গোঁফটি দরবেশের হাতে দেয়। দরবেশ উহাকে পরীক্ষা করে। নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। যখন তার বিশ্বাস হলো, সত্যিই উহা জীবিত সিংহের গোঁফ, তখনই গোঁফখানা তিনি পার্শ্বের একখানা জ্বলন্ত চুলোয় নিক্ষেপ করে পুড়ে ছাই করে ফেললেন ।
অবস্থা দৃষ্টে খালেদা হতবাক । বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জ্বলন্ত চুলোর দিকে। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে সুউচ্চ কন্ঠে বললো- আরে দরবেশ সাহেব! এ কি করলেন আপনি? আমার এতদিনের সাধনার ফসলকে মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই করে দিলেন? এ একখানা চুলের জন্য কত ঘুম আমার নষ্ট হয়েছে, কত টাকা আমার খরচ হয়েছে, কত আরাম আমার হারাম হয়েছে। আর আপনি কিনা এ চুলটিকে আগুনে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এ বলে খালেদা দরবেশের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো, যেনো দরবেশের সুস্থ চিন্তা ও বুদ্ধি নিয়ে তার সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে ।
কিন্তু দরবেশ সাহেব এসবের কোনো পাত্তা না দিয়ে সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-
: আচ্ছা মা! বল তো দেখি এ অসম্ভব কাজটি কেমন করে তুমি সম্ভব করলে?
: শুনবেন? শুনতে চান সেই কাহিনী? খালেদা রাগে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বললো ।
: হ্যাঁ, শুনবো । বলো তোমার চেষ্টা-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কাহিনী ।
খালেদা বলতে লাগলো, প্রতি রাতে আমার স্বামী ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি নিঃশব্দে উঠে জীবন বাজি রেখে নিকটবর্তী জঙ্গলে চলে যেতাম। সাথে নিতাম সিংহের জন্য খাবার। এভাবে একদিন দুদিন নয়, দীর্ঘ ছয় মাস সিংহকে খাবার খাওয়ালাম । প্রতি রাতেই এক পা দু’পা করে সিংহের দিকে এগুতাম । এরূপ এগুতে এগুতে একদিন আমি সিংহের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাহস পেলাম তার মাথায় হাত বুলানোর। সেই সঙ্গে তুলে নিলাম একখানা গোঁফ। এভাবেই আমি আমার সাধনায় জয়ী হলাম । দরবেশ সাহেব! এত কষ্ট স্বীকার করে যে গোঁফখানা আমি সংগ্রহ করলাম, ক্ষণিকের মধ্যে আপনি সে গোঁফখানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিলেন? জনাব! আপনি যদি জানতেন এটি সংগ্রহের পিছনে আমার কত শ্রম-সাধনা ব্যয় হয়েছে তবে কখনোই আপনি এমনটি করতে পারতেন না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন আমার তাবিজ তৈরি কিভাবে হবে?
দরবেশ মেয়েটির বলে যাওয়া কথাগুলো কান পেতে শুনলেন । তারপর অত্যন্ত মমতা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন-
: সত্যি তুমি অনেক মেহনত করেছো মা ।
: মেহনত তো করেছি। কিন্তু আপনি তো আমার সকল মেহনতকে মাটি করে দিলেন ।
: না, আমি তোমার মেহনতকে নষ্ট করিনি। আমি যা করেছি বিলকুল ঠিক করেছি।
: তবে কি আপনি আমার সাথে উপহাস করছেন?
ঃ না, তাও নয় । এ গোঁফের কোনো প্রয়োজন নেই ।
ঃ তবে আমার তাবিজ?
: তোমার তাবিজ তো তৈরি হয়ে গেছে।
: কি বললেন তাবিজ তৈরি হয়ে গেছে?
ঃ হ্যাঁ, তৈরি হয়ে গেছে। অর্থ্যাৎ তাবিজ তৈরির দ্বারা আমার যে উদ্দেশ্য ছিল তা হাসিল হয়ে গেছে ৷
: আপনার কথাগুলো রহস্যময় মনে হচ্ছে ।
: না, এখানে রহস্যের কিছুই নেই। আমি যা বলতে চাই তা খুবই পরিস্কার কথা ।
: আপনি কি বলতে চান বা কি বুঝাতে চান তা একটু খুলে বলুন তো । এতক্ষণে খালেদার কণ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
: আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই ।
ঃ করুন ।
: আচ্ছা বলতো, বনের হিংস্র প্রাণী সিংহ বেশি ভয়ঙ্কর, না তোমার স্বামী শিবলী বেশি ভয়ঙ্কর?
: আমার স্বামী তো মানুষ। সিংহের হিংস্রতার সাথে মানুষের কোনো তুলনা হয় নাকি?
: তাহলে তুমি স্বীকার করছো যে, তোমার স্বামী কোনো অবস্থাতেই হিংস্র জানোয়ারের ন্যায় ভয়ঙ্কর, বর্বর ও পাষণ্ড নয় ৷
ঃ হ্যাঁ।
: তবে তুমিই বলো, একটি ভয়ঙ্কর বন্য প্রাণীকে যদি আদর-যত্ন করে মায়া-মমতা দিয়ে বশে আনা যায়, তবে তোমার স্বামী যিনি এক সময় তোমাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসতেন, আন্তরিকভাবে মহব্বত করতেন সাময়িকভাবে কোনো কারণে যদি তার সেই ভালোবাসার মাত্রা কিছুটা হ্রাস পায়, তবে কি তাকে প্রেম ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ করে, মনমতো চলে, সেবা-যত্ন করে পূর্বের ন্যায় বশে আনা যায় না? এটা কি বনের পশুকে বাগে আনার চাইতেও কঠিন কাজ? যাও, এক্ষুণি বাসায় গিয়ে স্বামীর সাথে ভালো ব্যবহার করো। তার মেজাজ বুঝে চলো। স্বামী বাইরে থেকে এলে হাসিমুখে সালাম দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাও। শরিয়তের গণ্ডির ভিতর থেকে সাজগোজ করে পরিপাটি হয়ে থাকো । হৃদয়ের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে তার খেদমত করো ৷ সম্মানজনক আচরণ করো। অযথা তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে নিজের ক্ষতি করো না। মনে রেখো, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা এবং অমনোযোগীতাই স্বামীকে অনেক সময় বিপদগামী করে । সুতরাং তার প্রতি যত্নশীলা হও। সে বৈধ যা চায় তাই তাকে দিতে চেষ্টা করো। হঠকারিতা আর আত্মঅভিমান করে তার থেকে বিমুখ হয়ে থেকো না। এতে বরং তোমারই ক্ষতি হবে। আরো মনে রেখো, স্বামীর মন বুঝে যদি চলতে পারো, তবে তোমার ঘর খানা দুনিয়াতেই বেহেশতের টুকরোয় পরিণত হবে ।
দরবেশের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর খালেদা বললো, হুজুর! আপনি আমার অন্তর চক্ষু খুলে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, ছেলেটি জন্ম গ্রহণ করার পর আমি স্বামীর প্রতি একেবারেই উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম । তার মনোতুষ্টির পরোয়া করতাম না। নিজের মনমতো চলতাম । আর এ কারণেই বোধ হয় তিনি আমার থেকে ধীরে ধীরে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। দোয়া করবেন হুজুর, আমি যেন আপনার কথা মেনে চলতে পারি, আবার যেনো ফিরে আসে আগের সেই সোনালী দাম্পত্য জীবন।
: হ্যাঁ মা, আমি অবশ্যই দোয়া করবো । আল্লাহ তোমার সহায় হোন ৷ হেফাজত করুন সকল অনিষ্ট থেকে ।
সেদিন থেকে খালেদা স্বামীর সেবায় বিশেষভাবে মনোযোগী হলো । তার কথা মতো চলতে লাগলো। স্বামী অসন্তুষ্ট হবেন এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত রইলো। অহেতুক সন্দেহ মন থেকে বাদ দিলো ৷ দিনের বেলায় সাধারণ সাজসজ্জা ছাড়াও রাত্রিকালে বিছানায় যাওয়ার পূর্বে খুব ভাল করে পরিপাটি হয়ে নববধূর বেশ ধারণ করে স্বামীর সঙ্গ দিতে লাগলো। এতে মাস খানেকের মধ্যেই ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, স্বামী এখন তাকে পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণে ভালোবাসতে লাগলো । সৃষ্টি হলো আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা ।
সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! আলোচ্য ঘটনার কিছু কিছু অংশের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ প্রশ্ন কেবল আপনাদের পক্ষ থেকেই নয়, আমার পক্ষ থেকেও। অর্থাৎ একজন নারীর পক্ষে এরূপ দুঃসাহসিক কাজ প্রায় অসম্ভব । তাই এর সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক । কিন্তু এ ঘটনার অবশিষ্ট অংশ কিন্তু অবিশ্বাস্য কিংবা অসম্ভব কোনটাই নয়। কারণ একজন স্ত্রী যদি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে স্বামীর সেবা ও সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয় তবে স্বামী সুপথে ফিরে আসবেই। একদিন না একদিন তার ভুল ভাঙ্গবেই। তাই মা-বোনদের বলছি, আসুন- শাসন করে নয় প্রেম-ভালোবাসা ও সেবার মাধ্যমে স্বামীর মন খুশি করে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, মজবুত করি প্রেম-প্রীতি ও মহব্বতের বন্ধন । ওগো খোদা! তুমি আমাদের তাওফীক দাও। আমীন ।
স্মরণীয় বাণী
- আমি উসমান (রা.) থেকে এ উপদেশ লাভ করেছি যে, নিজের জীবন দিয়ে হলেও ইসলামের গৌরব রক্ষা করতে হবে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে এ উপদেশ লাভ করেছি যে, মিথ্যা দোষারোপের পরওয়া না করে নিজের চরিত্রকে পবিত্র রাখতে হবে। আর হযরত আলী (রা.) থেকে আমি এ উপদেশ লাভ করেছি যে, মতবিরোধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু মতবিরোধ বা যুদ্ধের কারণে যার যে মর্যাদা আছে তা ক্ষুন্ন করা যাবে না। – হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.)
- গরীব-মিছকিন কে তুচ্ছ জ্ঞান করো না। এদের সেবা করে গর্ববোধ করা উচিত। – হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)
সহায়তায় : মাসিক আল আশরাফ, অক্টোবর ২০০০ সংখ্যা ।
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি এই নারীর জীবনের গল্পটি পড়ে আপনাদের ভালো লেগেছে এবং গল্পটি থেকে ভালো কিছু শিখতে পেরেছেন। ভালো লাগলে এটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ।