সম্পদ নয় জ্ঞানই উত্তম (শিক্ষণীয় গল্প)

সম্পদ নয় জ্ঞানই উত্তম, এটি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনামলের একটি ছোট্ট ঘটনার গল্প। একদল লোক খলিফার নিকট জানতে চেয়েছিলেন কোনটি সর্বোত্তম ধন সম্পদ নাকি জ্ঞান। হযরত আলী রাঃ তাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের চমকপদ উত্তর দিয়েছিলেন। এখানে সেই মূল ঘটনাটি উল্লেখ আছে। চলুন পড়ি! 

সম্পদ নয়, জ্ঞানই উত্তম
সম্পদ নয়, জ্ঞানই উত্তম

সম্পদ নয়, জ্ঞানই উত্তম – শিক্ষণীয় ইসলামিক গল্প!

মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা:)। হযরত সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী স্পষ্টভাষী ও উচ্চাঙ্গের ভাষা সাহিত্যিক। একজন সুবক্তা হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল সর্বত্র। জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বীরত্ব-বাহাদুরী ও বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন,

আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা।

তাঁর খ্যাতি ছিল দেশ-বিদেশে। যে একবার তাঁর কথা শুনত সেই মুগ্ধ হয়ে যেত । ভাবত, এত বিশাল জ্ঞান ভান্ডার কিভাবে তিনি অর্জন করলেন? এত জ্ঞানের কথা কে শেখাল তাকে?

কিন্তু সব মানুষ তো আর সমান নয়। যাদের হৃদয়টা হিংসার কালিমায় আচ্ছাদিত, যারা অপরের ভাল দেখতে পারে না, তারা আলী (রা:) এর এই সুনাম সহ্য করতে পারত না। তারা কৌতুক করে বলত, আলী আবার পন্ডিত হল কবে থেকে? সে তো গোটা জীবন মুহাম্মদের পিছনে ঘুরে বেরিয়েছে। মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করেছে। বড় জোড় সে একজন নামকরা যোদ্ধা হতে পারে। কিন্তু পন্ডিত হবে কি করে?

একদিন কয়েকজন হিংসুটে একত্রিত হল । পরামর্শ করল তারা । সিদ্ধান্ত নিল, আলীর পান্ডিত্যের পরীক্ষা আজই নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? আলোচনার মাধ্যমে তাও ঠিক হল –

তারা সবাই একত্রে আলী (রা.) এর দরবারে উপস্থিত হবে । নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী তাকে প্রশ্ন করবে। যদি তিনি প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেন তবে তো ভালই। আর যদি না পারেন, তাহলে বুঝা যাবে, তার জ্ঞানী হবার কথা সঠিক নয়। মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও গুজব মাত্র ।

যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ । শীর্ষস্থানীয় দশ পন্ডিত হযরত আলী (রা:) এর দরবারে উপস্থিত। দলনেতা সকলের সামনে। বাকীরা পিছনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে। কক্ষে বিরাজ করছে এক অসীম নিরবতা।

এক সময় দলনেতাই নিরবতা ভাঙ্গল । বলল…

: আমীরুল মুমেনীন! শুনেছি, আপনি একজন মহাপন্ডিত। অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তাই বহু পথ অতিক্রম করে অনেক কষ্ট স্বীকার করে আমরা আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। আশা করি আপনার প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্যে আমাদের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবৃত্ত হবে ।

: আমি মহাপন্ডিত নই। তবে আপনাদের বক্তব্য খুলে বলুন । শান্ত কন্ঠে আলী (রা.) বললেন।

: অনুমতি পেলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই ।

: এ সামান্য ব্যাপারে অনুমতি কি প্রয়োজন। বলুন, কি প্রশ্ন আপনাদের।

: আমাদের প্রশ্ন হল, সম্পদ এবং জ্ঞান এ দুটির মধ্যে কোনটি উত্তম এবং কেন ?

: ও সে কথা । শুনুন তাহলে ……. |

হযরত আলী (রা.) কথা শেষ করতে পারলেন না। দলনেতা বাধা দিয়ে বলল, জনাব এ প্রশ্নের কেবল একটি জবাব দিলে চলবে না। আমরা মানুষ দশজন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক জবাব দিয়ে জবাবের সংখ্যা অবশ্যই দশে পৌঁছাতে হবে।

দলনেতার কথা শুনে হযরত আলী (রা.) কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। ভাবলেন, একটি প্রশ্নের দশটি উত্তর দিতে হবে কেন? তবে কি তারা বিশেষ কোন উদ্দেশ্য বা দুরভিসন্ধি নিয়ে এখানে এসেছে? নাকি আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছে? সে যাই হোক, প্রশ্ন যেহেতু করেছে সেহেতু তার জবাব দেয়াই উত্তম । তিনি বললেন, আমি দশজনের জন্য দশটি জবাবই দিচ্ছি। আপনারা মনযোগের সাথে শুনুন।

উপস্থিত সকলেই এক দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে আছে হযরত আলী (রা.) এর মুখপানে। জবাব শুনার জন্য সকলেই উদগ্রীব। কারো মুখে কোন কথা নেই । গোটা কক্ষ তখন নিরব ।

খানিক পর। হযরত আলী (রা.) একটু নড়েচড়ে বসলেন। শুরু হল তার জবাবের পালা। সকলের বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি তারই প্রতি নিবদ্ধ । তিনি বললেন-

অনেক কারণেই জ্ঞান ধনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবে আপনারা দশ জনের জন্য আমি দশটি কারণই বলছি ।

এক: জগতের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হল নবী রাসূলগণ । আর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও মহামনীষীদের বিবেচনায় যা শ্রেষ্ঠ তা বাস্তবিকই শ্রেষ্ঠ হতে বাধ্য। নবী-রাসূলগণ জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দিয়েছেন, সম্পদ অর্জনের উপর নয়। পক্ষান্তরে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে সর্বাধিক উৎসাহিত করেছে ফেরাউন ও নমরুদের ন্যায় অভিশপ্ত লোকেরা । তারাই সম্পদের জয়গান গেয়েছে মৃত্যু পর্যন্ত। সে কারণেই সম্পদ অপেক্ষা বিদ্যা শ্রেষ্ঠ ।

দুই: সম্পদ পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু জ্ঞান পাহারা দিয়ে রাখতে হয় না। এমনকি আল্লাহ চাহেতো উহা মানুষকে নানাবিধ বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে পারে । তাই জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ ।

তিন: সম্পদ মানুষের মাঝে হিংসার জন্ম দেয়। শত্রুতা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে জ্ঞান মানুষের মাঝে তৈরী করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। পরিণত করে পরস্পরকে অকৃত্রিম বন্ধুত্বে । সুতরাং সম্পদ নয় জ্ঞানই উত্তম ।

চার: জ্ঞান বিতরণে কখনও তা হ্রাস পায় না। বরং যতই বন্টন করা যায় ততই তা বৃদ্ধি পায়, প্রসারিত হয়। কিন্তু সম্পদ এর ঠিক উল্টো । অতএব সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ ।

পাঁচ: জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের মনে কোন কৃপণতা থাকে না। জ্ঞানী ব্যক্তিদের মন থাকে আকাশের মত উদার । কিন্তু সম্পদ মানুষকে কৃপণ হিসেবে গড়ে তোলে । সম্পদের প্রতি এক দুর্লভ মোহ সর্বদাই তাদের অন্তরে বিরাজ করে । সুতরাং সম্পদ অপেক্ষা জ্ঞানই উত্তম ।

ছয়: সম্পদ চুরি হয়, ডাকাতি হয়। কিন্তু জ্ঞান চুরি করা অসম্ভব। জোর করে কেউ তা কেড়েও নিতে পারে না। উহা লুণ্ঠিত হওয়ার কোন ভয় নেই । সকলের জন্যই উহা নিরাপদ সম্পদ। তাই ধন- সম্পদের তুলনায় জ্ঞানই উত্তম ।

সাত: জ্ঞানের ক্ষয় নেই, লয় নেই। কোন দিন ধ্বংস হওয়ার ভয় নেই । একবার অর্জন করলে কোন দিন তা আর নষ্ট হয় না। কিন্তু সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। আজ আছে, কাল নেই । তাই সম্পদের তুলনায় জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

আট: জ্ঞান অসীম; অনন্ত। এর কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কোন কিছু দিয়ে একে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু সম্পদ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সহজেই এর আকার আয়তন ঠিক করা যায়। পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। তাই সম্পদ অপেক্ষা জ্ঞানই উত্তম।

নয়: জ্ঞান মানবাত্মাকে উজ্জ্বল করে। আলোকিত করে। কিন্তু সম্পদ অন্তরকে করে কলুষিত। সুতরাং সম্পদ নয়, জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

দশ: জ্ঞানের তুলনায় সম্পদ কোন মূল্যই রাখে না। কারণ জ্ঞানই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল সততা, সত্যবাদিতা, খোদাভীরুতা ও মানবতার ন্যায় মহৎগুণগুলো। তিনি গড়ে উঠেছিলেন মানব দরদী হিসেবে। পক্ষান্তরে বিপুল সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্যের অধিকারী হয়েও ফেরাউন, নমরুদ ও কারুণ মানব দরদী হতে পারেনি। পারেনি সবর-শোকর, দয়া-পরোপকার ও বিশ্বস্ততার ন্যায় মানবীয় গুণগুলো অর্জন করতে। বরং তারা হয়েছে কৃপণ, অহংকারী ও ধনলিপ্সু।

এতক্ষণ সকলেই হযরত আলী (রা.) এর প্রজ্ঞাপূর্ণ জবাব গ্রোগ্রাসে গিলছিল। তন্ময় হয়ে শুনছিল তার কথা। এক প্রশ্নের দশ জবাব শুনে সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হল। বুঝল, হযরত আলী (রাঃ) সত্যিকার অর্থেই একজন পন্ডিত, জ্ঞানের সাধক। তার জ্ঞানের কোন তুলনা নেই ।

আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সম্পদের উপর জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়ার তাওফীক নসীব করুন। আমীন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ ۚ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ

তোমরা কি আখেরাত বাদ দিয়ে দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছ? (মনে রেখ) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নেহায়েতই তুচ্ছ। (সূরা তওবা : ৩৮

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। উৎস: যে গল্প হৃদয় কাড়ে – হৃদয় গলে সিরিজ ৫। 

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading