একটি বিস্ময়কর ফায়সালা (ইসলামিক শিক্ষণীয় গল্প)
দুই ব্যক্তি । পাশাপাশি হাটছে। উভয়েই একে অপরের সফর সঙ্গী । দীর্ঘক্ষণ চলতে চলতে সীমাহীন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষিধেও পেয়েছে প্রচুর। সুতরাং আর পথ চলা নয়। এবার খানিক বিশ্রাম ও খাওয়া নাওয়ার পালা ।
দু’জনে খেতে বসেছে। প্লেটে মোট আটখানা রুটি। পাঁচটি একজনের। তিনটি অপরজনের। এখনই তারা খাওয়া শুরু করবে। এমন সময় পাশের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তাদের পরিচিত আরেকজন। সৌজন্যের খাতিরে তাকেও ডেকে খানায় শরীক করল।
তিনজনে মিলে আটটি রুটি খেল। তৃতীয় ব্যক্তি তাদের শুকরিয়া আদায় করল। অতঃপর বিদায়ের প্রাক্কালে পকেট থেকে আটটি টাকা বের করে দুজনের সামনে রেখে বলল, আপনাদের দু’জনের ভাগ থেকে যে রুটি আমি খেয়েছি, তার বিনিময়ে এ টাকা কয়টি দিলাম। আপনারা তা ভাগাভাগি করে নিবেন। এ বলে সে চলে গেল ।
এবার তারা প্রাপ্য টাকা বন্টন করতে বসল। পাঁচ রুটিওয়ালা আগেই ভাগ ঠিক করে বলল, ভাই! ভাগতো অতি সহজ । আমার রুটি ছিল পাঁচটি, তাই আমি পাব পাঁচ টাকা। আর তোমার যেহেতু রুটি ছিল তিনটি, তাই তুমি পাবে তিন টাকা। তিন রুটি ওয়ালা এ বন্টন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করল। সে বলল, না তা হবে না। হতেও পারে না। কারণ যদি এ রুটিগুলো শুধু আমরাই খেতাম, তাহলে সমান সমানই খেতাম। আর সে এ টাকাগুলো দিয়েছে আমাদের দু’জনকে সমান লক্ষ্য করেই। সুতরাং আমার চার টাকা তোমার চার টাকা ।
পাঁচ রুটিওয়ালা এ প্রস্তাব মানতে রাযী হল না । তিন রুটিওয়ালাও তার পূর্বের কথায় অটল। এর বিকল্প কোন প্রস্তাবই সে মানবে না বলে পরিস্কার জানিয়ে দিল। ইতিমধ্যে তাদের উচ্চবাচ্যে বহু লোকজন এসে জড়ো হল। তারা সবাই মিলে একে একে দু’জনকেই মানাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কোন কাজ হল না। উভয়েই আপন সিদ্ধান্তে অনড়।
কেউ মত পরিবর্তন করতে সম্মত হল না। অবশেষে লোকজন বলল, ঠিক আছে, তোমরা যখন আমাদের কথা শুনলে না, সুতরাং এবার আমীরুল মুমেনীনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তোমাদের আর কোন উপায় নেই ৷
হযরত আলী (রা.) এর দরবার। কক্ষে অখন্ড নীরবতা। বিচারের আসন অলংকৃত করে আছেন স্বয়ং খলীফাতুল মুসলেমীন। তার চেহারায় গাম্ভীর্যতার সুষ্পষ্ট ছাপ। রুটিওয়ালারা দুজন দু’দিকে উপবিষ্ট ।
এক পর্যায়ে বিচার প্রার্থীরা নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করল। সবকিছু শুনে হযরত আলী (রা.) খানিক ভাবলেন। তারপর তিন রুটিওয়ালাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার সঙ্গী তোমাকে তিন টাকা দিতে চায়। তুমি তাই নিয়ে নাও। এতেই তোমার জিত। এতেই তোমার মঙ্গল ! কারণ তোমার তুলনায় তার রুটি ছিল বেশী ।
খলীফার কথা শুনে তিন রুটিওয়াল৷ ভীষণ ক্ষেপে উঠল ৷ সে গোস্বা ভরে বলল, হুজুর! তিন টাকা নিলে তো আগেই নিতে পারতাম । আপনার দরবারে এসে আমার লাভটা হল কি? এরকম হলে তো আপনার পর্যন্ত আসার প্রয়োজন ছিল না। যাহোক, আমি আপনার নিকট অন্য কিছু চাই না। চাই শুধু আপনার ইনসাফী ফায়সালা ।
তার কথায় হযরত আলী (রা.) রেগে না গিয়ে নম্রস্বরে বললেন, ভাই! এবার তুমি সুন্দর কথা বলেছ। পূর্বে আমি আপোষের কথা বলেছিলাম। এবার যখন তুমি ইনসাফী বিচার প্রার্থনা করেছ তাহলে শুন-
এ বলে তিনি একটু থেমে আবার শুরু করলেন। বললেন, ইনসাফী বিচার মতে তোমার সাথী পাবে সাত টাকা আর তুমি পাবে মাত্র এক টাকা । সুতরাং এবার তোমাকে এক টাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে ।
নতুন ফায়সালা শুনে তিন রুটিওয়ালা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। মনে মনে বলল, এর নাম কি ইনসাফী বিচার? এর নামই কি সুশাসন প্রতিষ্ঠা? খানিকপর সে রাগ সংবরণ করে বিস্মিত কণ্ঠে খলীফাকে সম্বোধন করে বলল, হযরত! এ কি বলছেন আপনি। সে আমাকে তিন টাকা দিতে চায় আমি নিতে চাইনি। আপনিও অনুরোধ করেছেন তিন টাকা নিতে। তাতেও আমি সম্মত হইনি। আর এখন আপনি বলছেন, আমাকে এক টাকা নিতে। এটা কি করে সম্ভব?
খলীফাতুল মুসলেমীন হযরত আলী (রা.) একটু নড়ে চড়ে বসলেন। বললেন, তিন টাকার কথা ছিল আপোষ-মিমাংসার কথা। কিন্তু তুমি তো আপোষ-মিমাংসায় যেতে রাযী নও। তুমি চাও ইনসাফ। তুমি চাও সুবিচার। আর ইনসাফ ও সুবিচারের দৃষ্টিতে তুমি এক টাকার বেশী কিছুতেই পেতে পার না। যদি বল কিভাবে? তাহলে আমি একবার নয় একশ বার বুঝিয়ে দিতেও রাযী আছি।
আলী (রা.) এর দৃঢ়তায় লোকটি নরম হয়ে এল। এবার সে তার গলার স্বর নীচু করে ভদ্রতার সাথে বলল, হযরত! অনুগ্রহ করে আমাকে বুঝিয়ে দিন, কিভাবে আমি এক টাকা পাওয়ার যোগ্য। যদি বুঝাতে পারেন, তবে আমি এক টাকাই নেব। এর বেশী দাবী করব না।
হযরত আলী (রা.) আপন ফায়সালার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বললেন- সর্বমোট রুটি ছিল আটটি। খেয়েছ তোমরা তিনজন। প্রত্যেকটি রুটি ভাগ করলে তাতে মোট চব্বিশ টুকরো রুটি হয়।
তোমার রুটি ছিল তিনটি। তিন রুটির প্রত্যেকটির তিনভাগ করলে টুকরো হয় মোট নয়টি । আর তোমার সঙ্গীর রুটি ছিল পাঁচটি। পাঁচ রুটির প্রত্যেকটির তিন ভাগ করলে টুকরো হয় মোট পনেরটি ।
কে কম খেয়েছে, কে বেশী খেয়েছে, সম্মিলিত খাওয়ায় এ তারতম্য করা হয় না। সুতরাং ধরা হবে যে, তোমরা প্রত্যেকেই সমান খেয়েছ। অর্থাৎ চব্বিশ টুকরো রুটি থেকে প্রত্যেকেই আট টুকরো করে খেয়েছ।
এবার লক্ষ্য কর। তোমার রুটি ছিল নয় টুকরো। তন্মধ্যে তুমি নিজেই খেয়ে নিয়েছ আট টুকরো। বাকী থাকল এক টুকরো । সুতরাং আগন্তুক তৃতীয় ব্যক্তি তোমার ভাগ থেকে কেবল এক টুকরো রুটিই খেয়েছে।
অপরদিকে তোমার সাথীর ছিল পনের টুকরো। তন্মধ্যে সে নিজে খেয়েছে আট টুকরো । বাকী রইল সাত টুকরো। সুতরাং তৃতীয় ব্যক্তি তার ভাগ থেকে খেয়েছে সাত টুকরো ।
লোকটি আট টুকরোর বিনিময়ে আট টাকা দিয়েছে। সুতরাং একথা খুবই পরিস্কার যে, সাত টুকরোর বিনিময়ে তোমার সাথী পাবে সাত টাকা, আর এক টুকরোর বিনিময়ে তুমি পাবে এক টাকা।
ফায়সালার চমৎকার বিশ্লেষণ শুনে শুধু তিন রুটিওয়ালাই নয়। উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। সকলেই খলীফার প্রখর বুদ্ধিমত্তার ভূয়সী প্রশংসা করল। অবশেষে তিন রুটিওয়ালা বলতে বাধ্য হল- হ্যাঁ, আমি এক টাকাই পাওয়ার উপযুক্ত। এর বেশী নয়। খামাখা না বুঝে এতক্ষণ পাগলের মত প্রলাপ বকলাম। এতটুকু বলে মনে মনে খলীফাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক টাকা নিয়েই দরবার থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রিয় পাঠক, আলোচ্য ঘটনায় হযরত আলী (রা.) এর জ্ঞানের গভীরতা ও বিস্ময়কর বিচার বুদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে হযরত সাহাবায়ে কেরামের পদাংক অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন। (সূত্রঃ তারীখে খুলাফা)