চলুন আজকে আমরা হাইডাটিড সিস্ট রোগের ভয়ঙ্কর খেলার সম্পর্কে জানি যে আমাদের দেহের ভিতরে নিরবে সর্বনাশ করে চলে। আপনার কিংবা আপনার সন্তানের পেটের ব্যথা হচ্ছে কিংবা ফোলাফোলা বা খাবারের অস্বস্তি হচ্ছে, কাশি, বুক ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট, কিংবা প্রচন্ড মাথাব্যথা ও চোখ ফোলে যাওয়া কিংবা বমি, এসব উপসর্গের কারণ হতে একটি অদৃশ্য পরজীবি যার নাম Echinococcus Granulosus এবং এই রোগের হাইডাটিড সিস্ট। আজকে আমরা আমার বাংলা পোস্ট.কম এ এই অদৃশ্য পরজীবির ভয়ানক খেলা, এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের কথা জানবো।
কেইস স্টাডি : এক অদৃশ্য পরজীবির ভয়ানক খেলা।
ঘটনা ১ : মাঝ বয়সী এক কৃষক, আব্দুল হান্নান, কয়েক মাস ধরে তাঁর ডান পাশের পেটে হালকা ব্যথা অনুভব করছিলেন। প্রথমে তিনি ভাবলেন এটি হয়তো গ্যাসের সমস্যা বা লিভার ইনফেকশনের কারণে এমনটি হচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর পেট ফোলতে শুরু করে এবং খাওয়ার পর অস্বস্তি বাড়তে থাকে, এমনকি মাঝে মাঝে জন্ডিসের মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে আলট্রাসাউন্ড করলে তাঁর লিভারে একটি বড় সিস্ট ধরা পড়ে। এবং পরবর্তী পরীক্ষায় এটি প্রতীয়মান হয় যে_এটি হাইডাটিড সিস্ট, যার কারণ Echinococcus granulosus নামের এক ক্ষুদ্র ফিতা-কৃমি।
ঘটনা ২: ডাক্তার আবদুর রহমানের চেম্বারে এক চৌদ্দ বছরের ছেলেকে আনা হয়েছিল, ছেলেটির প্রায় একমাস ধরে তাঁর অসহ্য মাথাব্যথা, বমি আর চোখ ফুলে যাওয়ার কারণে।
প্রথমে ভাবা হয়েছিলো যে, হয়তো স্ট্রেস, চোখের সমস্যা বা মাইগ্রেন সমস্যা কারণে মাথাব্যথা, বমি আর চোখ ফুলে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা ছিলো খুবই ভয়ংকর। চোখের পরীক্ষা করে papilledema পাওয়া গেছে, মানে মাথার ভেতরে চাপ বেড়ে গেছে। তখনই জরুরিভাবে ছেলেটির MRI করা হলে মস্তিঙ্কের ভেতর ৬ সেন্টিমিটার লম্বা এক জলভরা সিস্ট ধরা পড়ে যার ভিতরে আবার ছোট ছোট ফোঁড়া, এই রিপোর্ট দেখে পুরো টিম হতবাক হয়ে যায়। তবে এটা কোনো ক্যান্সার না, এটা এক পরজীবী (Parasite), যার নাম Echinococcus granulosus.

এটি মানুষের শরীরে কিভাবে প্রবেশ করে?
মূলত এই জীবাণুটি পাওয়া যায় কুকুর ও গবাদিপশুর মলে। এটি মানবদেহে প্রবেশ করে যখন কেউ পশুর সংস্পর্শে আসে ও হাত না ধুয়ে খাবার গ্রহণ করে। এটি ধীরে ধীরে শরীরে সিস্ট তৈরি করে লিভার, ফুসফুস এমনকি মস্তিঙ্কেও।
কেনো এটি ভয়ঙ্কর?
ডাক্তার আব্দুর রহমান উল্লেখ করেছেন যে, এই চৌদ্দ বছরের ছেলেটির ক্ষেত্রে সেটা তাঁর মস্তিঙ্কে হয়েছিল যা খুবই বিরল ও বিপজ্জনক। অপারেশনের সতর্কতার সঙ্গে সিস্টকে বের করা হয়, যেনো এটি ফেটে না যায়। কারণ এটি ফেটে ভেতরের তরল ছড়িয়ে গেলে তা মারাত্মক এলার্জিক শক দিতে পারে যা প্রাণঘাতী। অপারেশনের পর তাকে দেওয়া হয় Albendazole নামের ওষুধ।
Echinococcus granulosus: এক ক্ষুদ্র কৃমির ভয়ানক রোগ!
চলুন হাইডাটিড সিস্ট রোগ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানি। Echinococcus granulosus হলো একটি ক্ষুদ্র ফিতা-কৃমি (Tapeworm), কিন্তু এর প্রভাব হতে পারে খুবই ভয়ানক। এটি মানবদেহে হাইডাটিড সিস্ট (hydatid cyst) তৈরি করে, যার ফলে সিস্টিক ইকাইনোকক্কোসিস (cystic echinococcosis) নামের একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ বাসা বাধে। এটি একটি জুনোটিক রোগ, অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
জীববৈজ্ঞানিক পরিচয়
- এটির বৈজ্ঞানিক নাম: Echinococcus granulosus
- এটি Taeniidae পরিবারে অন্তর্ভুক্ত।
- শ্রেণি: Cestoda
- প্রকার: পরজীবী ফিতা-কৃমি
প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৩–৬ মি.মি, তবে এর সৃষ্টি করা হাইডাটিড সিস্টের আকার কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
Echinococcus granulosus এর জীবনচক্র!
Echinococcus granulosus কিভাবে মানুষকে সংক্রমিত করে চলুন এর জীবনচক্র থেকে জেনে নিই:
Echinococcus granulosus এর জীবনচক্রে দুটি মূল স্বাগতিক থাকে:
- চুড়ান্ত স্বাগতিক: সাধারণত কুকুর বা নেকড়ে অন্ত্রে পূর্ণবয়স্ক কৃমি বাস করে এবং এর ডিম মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে।
- মধ্যবর্তী স্বাগতিক: গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। তারা দূষিত খাবার বা পানি থেকে ডিম গ্রহণ করলে লার্ভা তাদের দেহে হাইডাটিড সিস্ট তৈরি করে।
- মানুষ (দুর্ঘটনাজনিত): দুর্ঘটনাজনিতভাবে মানুষ সংক্রমিত হয়, যখন কুকুরের মল দ্বারা দূষিত খাবার বা পানি গ্রহণ করে। মানুষের শরীরে কৃমি পূর্ণবয়স্ক হয় না, তবে হাইডাটিড সিস্ট তৈরি হয়, যা লিভার, ফুসফুস বা অন্য অঙ্গে বৃদ্ধি পায়। যেমন আমরা উপরের কেইস স্টাডি থেকে মানুষের ব্রেইন সংক্রমিত হতে দেখেছি।
হাইডাটিড সিস্ট রোগের উপসর্গ!
এই রোগের উপসর্গ নির্ভর করে এর সিস্ট কোথায় তৈরি হয়েছে তাঁর ওপর। নিচে এর উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরা হলো।
- লিভার: পেটের ব্যথা, ফোলাভাব, জন্ডিস।
- ফুসফুসে: কাশি, বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট।
- ব্রেইনে: মাথাব্যথা, চোখফোলা, বমি ইত্যাদি।
অনেক সময় রোগটি ধীরে ধীরে বাড়ে এবং প্রথমদিকে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এমনকি রোগটি অনেক সময় ‘নীরব আতঙ্ক’ হিসেবে বছরের পর বছর শরীরে লুকিয়ে থাকে, যতক্ষন না এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ না করে। এই রোগের আরও একটি ভয়ানক দিক হচ্ছে, সিস্ট ফেটে গেলে অ্যানাফাইল্যাকটিক শক হতে পারে, যা প্রাণঘাতী।
হাইডাটিড সিস্ট : রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি!
হাইডাটিড সিস্ট রোগটি প্রথমে লিভার বা ফুসফুসের রোগ হিসেবে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে পারে। তাই রোগটি সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারগণ নিচের টেস্ট পদ্ধতি গুলি অনুসরণ করে থাকে:
- ইমেজিং টেস্ট: আলট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করার মাধ্যমে সিস্টের অবস্থান ও আকার সবচেয়ে কার্যকরীভাবে নির্ধারণ করা যায়।
- সেরোলজিক টেস্ট: ELISA, Indirect Hemagglutination (IHA), বা Western Blot—পরজীবির অ্যান্টিবডি সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।
- হিস্টোপ্যাথলজিক পরীক্ষা: সিস্ট অপসারণের পর মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ।
চিকিৎসা পদ্ধতি
হাইডাটিড সিস্ট-এর চিকিৎসা নির্ভর করে সিস্টের অবস্থান, আকার ও জটিলতার উপর।
১. ঔষধ:
- Albendazole বা Mebendazole, এটি কৃমির লার্ভাকে ধ্বংস করে বা সিস্টের বৃদ্ধি রোধ করে।
২. PAIR পদ্ধতি (ছিদ্র–নিষ্কাশন–ইনজেকশন–পুনঃনিষ্কাশন):
- ইংরেজিতে এই পদ্ধতিকে বলা হয় Puncture–Aspiration–Injection–Reaspiration.
- ইনজেকশন: এই পদ্ধতিতে এতে সূচ ঢুকিয়ে সিস্টের তরল বের করা হয় (নিঙ্কাশন), তারপর জীবাণুনাশক দ্রবণ যেমন ৯৫% ইথানল বা হাইপারটনিক স্যালাইন ইনজেকশন করা হয়।
- পুনঃনিঙ্কাশন: কিছু সময় পর সেই দ্রবণ আবার টেনে বের করা হয়।
- এই পদ্ধতিটি সার্জারির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত যেখানে সিস্টটি ছোট এবং জটিল অবস্থানে নেই।
৩. সার্জারি:
- বড় বা জটিল সিস্টের ক্ষেত্রে অপারেশন করে অপসারণই একমাত্র কার্যকরি উপায়।
- এলার্জি (অ্যানাফাইল্যাকটিক) শক প্রতিরোধে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হয় যা আমরা উপরের বর্ণিত কেইস স্টাডি থেকে জানতে পেরেছি।
হাইডাটিড সিস্ট প্রতিরোধ ও জনসচেনতা
Echinococcus granulosus এটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ__ এর জন্য জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন।
- কুকুরকে নিয়মিত deworming: ৩-৬ মাস অন্তর antiparasitic ওষুধ প্রয়োগ করা।
- কাঁচা পশুর মাংস না খাওয়ানো: বিশেষ করে ভেড়া বা গরুর লিভার ও ফুসফুস।
- স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা: খাবার-পানীয় ঢেকে রাখা, সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া, পশু জবাইয়ের পর পশু জবাইয়ের পর ভালোভাবে পরিঙ্কার করা।
- গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় পশুপালক, কসাই ও সাধারণ জনগণের মধ্যে রোগের সংক্রমণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচার করা জরুরী।
উপসংহার: হতে পারে Echinococcus granulosus একটি ক্ষুদ্র পরজীবী, কিন্তু এর ক্ষতি মারাত্মক, এটি আমাদের অবহেলা ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের সুযোগ নেয়। তাই নিয়মিত সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হাইডাটিড সিস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
📚 তথ্যসূত্র (References)
1. World Health Organization (WHO). Echinococcosis – Key Facts.
2. Centers for Disease Control and Prevention (CDC). Parasites – Echinococcosis (Echinococcus granulosus).
আরও পড়তে পারেন: হেপাটাইটিস প্রতিরোধে করণীয় কী? সহজ পদক্ষেপে সুস্থ জীবন