শিশুদের নৈতিক শিক্ষার গল্পের এই পর্বে আমরা তুলে এনেছি এমন দশটি ছোট বাচ্ছাদের ইসলামিক শিক্ষার গল্প, যা শুধু আনন্দ দেয় না, বরং শিশুদের হৃদয়ে বুনে দেয় আদব, সততা, ধৈর্য, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি। প্রতিটি গল্পে আছে জীবনের বাস্তবতা, চরিত্র গঠনের উপাদান, এবং এমন বার্তা যা শিশুরা বড় হয়ে মনে রাখবে। এ পর্ব যেন একটি নরম আলো—যা শিশুদের অন্তরে নৈতিকতার দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়।
৬১. 🍚 অন্ধের পায়েস খাওয়া
পাড়ার ছেলেরা মিলে বন ভোজনে যাবার ইচ্ছা করল। পরামর্শ করে স্থির করল, আজ তারা সেখানে পায়েস রান্না করে খাবে। তাদের মধ্যে একজন অন্ধ ছিল। সে ইতিপূর্বে পায়েস খায়নি, পায়েস নামটাও শুনেনি। সে একজন বন্ধুকে পাশে ডেকে নিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা! পায়েস জিনিসটা কেমন?’
বন্ধু বলল, ‘সাদা’
অন্ধ বলল, ‘সাদা আবার কেমন?’ বন্ধু বলল, ‘বকের মতো।’
অন্ধ বলল, ‘বক আবার কেমন?’
বন্ধু ভাবল, কথার উদাহরণে অদেখা জিনিস সে বুঝতে পারছে না। তাই সে তার হাতটা টেনে নিয়ে কল্কিটা বাঁকা করে বলল, এই দ্যাখো, বক এই
রকম।
অন্ধ বলল, বাব্বা! এমন টেরা-বাঁকা। এ তো গলায় আটকে যাবে! আমি ভাই তোমাদের সাথে বন ভোজনে গেলেও পায়েস কিন্তু খাব না।’
অনেকে পরের ব্যাখ্যা ও বিশেষণে ভুল ধারণা নিয়ে সহজটাকে কঠিন ধারণা করে বহু কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। তারাও কিন্তু আসলে জ্ঞানান্ধ ।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: না জেনে অনুমান করা বা অন্যের ভুল ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করা মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জ্ঞান ছাড়া মত দেওয়া আত্মবঞ্চনার নামান্তর।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- অন্ধ ব্যক্তি পায়েস সম্পর্কে কী জানতে চেয়েছিল?
- তার বন্ধু কীভাবে পায়েসের রূপ বোঝাতে চেষ্টা করেছিল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় ভুল ব্যাখ্যা ও অন্ধবিশ্বাস সম্পর্কে?
না বুঝে মত দেওয়া নয়, জ্ঞানই হোক সত্যের পথচিহ্ন।
কিওয়ার্ড: অন্ধের গল্প, ভুল ধারণা, জ্ঞানান্ধতা, ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প
৬২. 🎭 পরের অনুকরণ
কোন বিহারীর অভিজ্ঞতায় কোন বাঙ্গালী খারাপ হলে সে সকল বাঙ্গালীকেই খারাপ ধারণা করে। আবার কোন বাঙ্গালীর অভিজ্ঞতায় কোন বিহারী খারাপ হলে সে সকল বিহারীকেই খারাপ মনে করে। অনুরুপ তার কাছ থেকে শুনে অন্যেরাও অনেকে ঐ ধারণা করে থাকে। অথচ এমন ধারণা সঠিক নয়। অনেকে না জেনে অনেক বিষয় সম্বন্ধে অনুচিৎ মন্তব্য করে। অনেকে আন্দাজ ও অনুমানে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো জ্ঞান করে। অনেকে পরের মুখে ঝাল খায়।
এক ইংরেজ দম্পতি জঙ্গল-মহলে বেড়াতে এসে মধুর উপকারিতার কথা শুনে তা পাওয়ার আশায় জঙ্গলে বের হল। এক গাছে মৌচাকের সন্ধান পেল। মধু কীভাবে গালতে হয়, মৌমাছির বিঁধুনি আছে—এসব কিছুই জানে না তারা। স্ত্রীকে কাঁধে চাপিয়ে মধু পাড়তে বললে, চাকে হাত দিতেই বিধতে লাগল মৌমাছিতে। কষ্টে ও ভয়ে ম্যাডামের পেশাব কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে গেল। পা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল স্বামীর মুখে। স্বামী ভাবল ওটাই হয়তো মধু! লাগল মুখ নেড়ে খেতে!
অতঃপর সে ভেদ না জানলে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, “মধুর স্বাদ কেমন?”—তাহলে নিশ্চয় সে বলবে, “নোনতা!” যার যেমন অভিজ্ঞতা, সেই মতো কয় কথা।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: অন্যের অভিজ্ঞতা বা মুখের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক। নিজে যাচাই না করে মত দেওয়া অন্ধ অনুকরণের নামান্তর।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- ইংরেজ দম্পতি কী শুনে জঙ্গলে গিয়েছিল?
- তারা কীভাবে ভুল ধারণা তৈরি করেছিল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় অনুকরণ ও যাচাই সম্পর্কে?
যা সত্য, তা যাচাই করেই গ্রহণ করো, অন্যের মুখে ঝাল খাওয়া নয়।
কিওয়ার্ড: অন্ধ অনুকরণ, ভুল ধারণা, যাচাই, শিশুদের ইসলামিক গল্প
৬৩. 💰 তিন লোভী ডাকাত
একবার একদল লোক বিপুল স্বর্ণ মুদ্রা ও অর্থ-সম্পদ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে তিনজন ডাকাতের খপ্পরে পড়ে নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে তারা রিক্ত হস্তে বাড়ী ফিরে। ডাকাত তিনজন বিপুল স্বর্ণ-মুদ্রা ও টাকা-কড়ি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। চলতে থাকে নানা পরিকল্পনা। সম্পদ বন্টনের নীল নকশা।
এমন সময় ডাকাত সর্দার বলল, আমরা ক্ষুধার্ত। আগে ক্ষুধা নিবারণ করি। তারপর সম্পদ বন্টন হবে। অতএব সর্বাগ্রে বাজার থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসা হৌক। ডাকাতের একজন তখন খাদ্যক্রয়ের অনুমতি চাইলে সরদার তাকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে সে বাজারে রওনা হ’ল। পথে যেতে যেতে সে ঐ ছিনতাইকৃত স্বর্ণমুদ্রা ও অর্থ-কড়ি কি করে একাই ভোগ করা যায় সে পরিকল্পনা আঁটতে লাগল। অনেক চিন্তা- ভাবনার পর স্থির করল যে, খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে দুই বন্ধুকে হত্যা করব। তখন সব সম্পদই আমার হয়ে যাবে। বাকী জীবন এই সম্পদ দিয়ে সানন্দে কেটে যাবে। মুছে যাবে দুঃখ-দুর্দশা। বউ-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে পরে ভালভাবেই দিন যাপন করতে পারব। সম্পদের এই মোহে পড়ে সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে বাজার থেকে ফিরে আসছে।
অপরদিকে ঔ দুইজন চিন্তা করল যে, এতগুলো সম্পদ দুই বন্ধুর মধ্যে বন্টন করতে পারলে পরিমানে বেশী হবে। তারা স্থির করল যে, খাদ্য নিয়ে আসা মাত্রই তাকে হত্যা করব। তখন সমস্ত সম্পদ দুই বন্ধু ভাগ করে নিব। কথামতো অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকল তারা। খাদ্য নিয়ে সে ফিরা মাত্রই অপেক্ষমাণ দুই বন্ধু অস্ত্রাঘাত করে তাকে শেষ করে ফেলল ।
এবারে অবশিষ্ট দুই ডাকাতের মধ্যে যে অধিক শক্তিশালী ছিল সে চিন্তা করল, যদি আমি একাই এই বিশাল ধন ভাণ্ডারের মালিক হই তবে আমার চেয়ে আর কে ধনবান হতে পারে? আমার জীবন ধন্য হবে। সমস্যা দূরীভূত হবে। দারিদ্র বিমোচিত হবে। জীবনে আর কোন সমস্যা থাকবেনা। এই দুরভিসন্ধি অনুযায়ী অপর সাথীকে সে হত্যা করে ফেলল। পর পর দুই সাথীকে হত্যা করে সে আনন্দে উদ্বেলিত। তার লোলুপ দু’চোখ অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে ছিনতাইকৃত সম্পদের দিকে। একাই এত সম্পদের মালিক, এই আনন্দে সে পাগলপারা। সাথীদ্বয়কে হত্যা করে স্বভাবতই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল সে। সামনে খাবার মওজুদ। ভাবল, আগে ক্ষুধা মিটিয়ে নেই, তারপর সম্পদ নিয়ে বাড়ী ফিরব অতঃপর প্রত্যাশার পরিসমাপ্তি ঘটল, যখন সে বিষ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাল।
শিক্ষা: অত্যধিক সম্পদের লোভ মানুষকে ধ্বংস করে।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: অতিরিক্ত লোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। সম্পদের মোহে নৈতিকতা হারিয়ে গেলে শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- তিন ডাকাত কীভাবে একে অপরকে ধোঁকা দিল?
- তাদের পরিকল্পনার মধ্যে কী ভুল ছিল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে?
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু— নৈতিকতা ছাড়া সম্পদ শুধু ধ্বংস ডেকে আনে।
কিওয়ার্ড: লোভ, ডাকাতের গল্প, শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা
৬৪. 🧠 বড় কে?
দুই ভাই পিঠের পিঠ। সদা-সর্বদা তর্ক-বিতর্ক ও কথায় কথায় ঝগড়া। একদিন তর্ক শুরু হল—চরিত্র ও গুণে বড় কে?
: রাজু বলল, “আমি বড়।”
: কাজু বলল, “আমি।”
: রাজু বলল, “আমি বাড়ির কাজ বেশি করি।”
: কাজু বলল, “তুমি নও, আমি।”
: রাজু বলল, “মা-বাবার কথা আমি বেশি শুনি।”
: কাজু বলল, “তুমি নও, আমি।”
: রাজু বলল, “তোমার থেকে আমার বুদ্ধি বেশি।”
: কাজু বলল, “বরং আমার বুদ্ধিই বেশি।”
: রাজু বলল, “আমি বেশি ভালো পড়াশোনা করি।”
: কাজু বলল, “আমিই পড়াশোনায় তোমার থেকে ভালো।”
পরিশেষে আব্বা বললেন,
“আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়,
লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার,
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।”
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: বড়ত্ব জন্ম বা বয়সে নয়—গুণ, আচরণ ও নৈতিকতায়। সত্যিকারের বড় সেই, যাকে সবাই শ্রদ্ধা করে তার চরিত্রের জন্য।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- রাজু ও কাজুর মধ্যে কী নিয়ে তর্ক হচ্ছিল?
- তাদের বাবা কীভাবে বড়ত্বের ব্যাখ্যা দিলেন?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় “বড়” হওয়া সম্পর্কে?
বয়সে নয়, গুণে বড় হও, আচরণেই প্রকাশ পায় সত্যিকারের শ্রেষ্ঠতা।
কিওয়ার্ড: বড়ত্ব, ভাইয়ের গল্প, নৈতিক শিক্ষা, শিশুদের ইসলামিক গল্প
৬৫. 🐦 গাছের পাখিটি কী বলে?
এক রৌদ্রতপ্ত দুপুরে শহর ও বহু গ্রামের মাঝে এক বটগাছের ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল জন কয়েক লোক। পরিচয়ের পর আপোসে গল্প করছিল। এমন সময় গাছের ডালে একটি পাখি ডাক দিতে লাগল। ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘আচ্ছা! আপনারা কি বলতে পারেন, পাখিটা কী বলছে?’
প্রথম ব্যক্তি চট করে বলে উঠল, আমি জানি, পাখিটা কী বলছে। ও বলছে, ‘পিঁয়াজ-রসুন-আদরক।’
দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রতিবাদ করে বলল, ‘আরে ধুৎ! পাখিটা বলছে, সি-বা- জল ট্যাবলেট।’
তৃতীয় ব্যক্তি বলল, ‘না-না, আসলে পাখিটা বলছে, সুবহা-ন তে-রী কুদরত।’
চতুর্থ ব্যক্তি বলল, ‘অসম্ভব! পাখিটা বলছে, ইযাস সামা-উন ফাতারাত।’
আসলে প্রথম ব্যক্তিটি ছিল একজন সবজি-ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছিল চিকিৎসক। তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিল ভিক্ষুক। আর চতুর্থ ব্যক্তিটি ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। সকলে নিজ নিজ নিত্য ব্যবহৃত শব্দ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে পাখির বুলিকে কল্পনা করল। সাধারণতঃ এমনটাই হয়ে থাকে, যে যেমন মানুষ, তার তেমন ধারণা।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: মানুষ তার অভিজ্ঞতা, পেশা ও মানসিকতা অনুযায়ী জগতকে দেখে। সত্যকে বুঝতে হলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- পাখির ডাক নিয়ে লোকেরা কীভাবে ভিন্ন মত প্রকাশ করল?
- তাদের পেশা কীভাবে তাদের ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় দৃষ্টিভঙ্গি ও সত্য উপলব্ধি সম্পর্কে?
যে যেমন, সে তেমনই ভাবে— সত্যকে বুঝতে চাইলে চাই নিরপেক্ষতা।
কিওয়ার্ড: দৃষ্টিভঙ্গি, পাখির গল্প, শিশুদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও সত্য
৬৬. 🕌 আদর্শ পিতা-মাতার যোগ্য সন্তান
এক সৈনিক একবার তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে গেল । তখন তার স্ত্রী গর্ভবতী। যাবার সময় সে স্ত্রীর কাছে ত্রিশ হাযার স্বর্ণমুদ্রা রেখে গেল। এরপর বহু বছর কেটে যায়। যোদ্ধার ফেরার নাম নেই। অবশেষে দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর পর সে বাড়ী ফিরে আসে। ঘোড়া থেকে নেমে সৈনিক বর্শা নিয়ে ঘরের দরজায় আঘাত করলে এক টগবগে যুবক বেরিয়ে আসে। যুবক আগন্তুকের হাতে বর্শা দেখে বলল, হে আল্লাহর দুশমন! তুমি আমার বাড়িতে হামলা করতে এসেছ? লোকটি একথা শুনে তাজ্জব বনে গেল । বলে কি এই যুবক! আমার বাড়ী এটা, অথচ সে কিনা আমাকেই ডাকাত বলে অভিহিত করছে? বীর সৈনিক গর্জে উঠে বলল, কে তুমি? তোমার সাহস তো কম নয়? আমার বাড়ীর অন্দরে ঢুকে আমাকেই ডাকাত বলছ? একথা শুনে যুবকের চোখ ছানাবড়া হওয়ার জো। এই অচেনা-অজানা বুড়ো দেখি উড়ে এসে জুড়ে বসার মত কথা বলছে। এভাবে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেঁধে গেল তুমুল লড়াই। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। তাদের লড়াই ও হুংকারে পাড়ার সব লোক এসে জড়ো হ’ল এবং কোনমতে তাদের থামাতে সক্ষম হ’ল। এবার সবাই যুবকের পক্ষ নিল। যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, একে কাযীর দরবারে সোপর্দ না করে কিছুতেই ছাড়ছি না। লোকটিও হুংকার ছেড়ে বলল, এই দুশ্চরিত্র ছেলেকে আমি বিচারালয়ে নিয়ে যাব। সেখানে যা হবার তাই হবে।
প্রতিবেশীরা লোকটির দৃঢ়তা দেখে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারা বলল, ভাই আপনি বোধ হয় বাড়ী চিনতে ভুল করেছেন। এই বাড়ী ওদেরই। ওরা বহুদিন ধরে এখানে আছে। লোকটি বলল, হ’তেই পারে না। আমি ঠিক চিনেছি, এ বাড়ী আমার। আমি তো অমুক গোত্রের সর্দার। তখন বাড়ী থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এসে বলল, রাবী’আহ চুপ কর। উনি তোর বাবা, আমার স্বামী। মুহূর্তেই উত্তপ্ত পরিবেশ পাল্টে গেল। সন্তান পিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল, আব্বা আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। লোকটিও ছেলেকে না চিনে নানা কথা বলায় লজ্জা পেল।
ছেলে বলল, ঘরে চল বাবা, কিছু মনে কর না। ঘরে ঢুকে লোকটি স্ত্রীকে বলল, আমার ছেলে এত বড় হয়েছে? স্ত্রী বলল, হবে না। সেই কবে আপনি যুদ্ধে গিয়েছেন, ফিরলেন এতদিন পরে। লোকটি বলল, আমার সেই ত্রিশ হাযার স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রেখেছ? এবার লোকটি একটি থলে এগিয়ে দিয়ে বলল, এখানে আরো চল্লিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা আছে, একসাথে রাখ। স্ত্রী বলল, সেগুলো আমি পুঁতে রেখেছি। কিছুদিন পর বের করব। যুবক মসজিদে গেলে স্ত্রী স্বামীকে সালাত আদায় করতে মসজিদে পাঠিয়ে দিল। সালাত শেষে লোকটি দেখল, মসজিদ চত্বরে বহু লোকের সমাগম। পাঠচক্র চলছে। কাছে গিয়ে দেখল, এক অল্প বয়সী যুবক জড়সড় হয়ে অধোমুখে দারস দিচ্ছে। আর বহু গন্যমান্য আলেম-ওলামা একান্ত মনোযোগের সাথে তার দারস শুনছেন।
লোকটি আশ্চর্য হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল, কে এই সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি? লোকটি বলল, তিনি হলেন মদীনা নগরীর সবচেয়ে বড় ফক্বীহ ইমাম রাবী’আতুর রায়। বাবা ছেলের পরিচয় পেয়ে বেজাই খুশি হ’লেন। হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। তিনি প্রাণভরে ছেলের জন্য দু’আ করলেন ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে বললেন, আজ আমি তোমার ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখেছি, যে অবস্থায় কেউ তার ছেলেকে দেখেনি। সত্যিই সৌভাগ্যবান। স্ত্রী তখন হেসে বলল, আপনি এই ত্রিশ হাযার মুদ্রা চান, না এই ছেলেকে চান? আপনার রেখে যাওয়া ত্রিশ হাযার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে আমি এই সোনার ছেলে গড়েছি। আপনি খুশী হয়েছেন? তিনি বললেন, আজ আমার খুশির সীমা নেই। তোমার মত মহীয়সী মা যার আছে, তার এমনটি হওয়াইতো স্বাভাবিক। আমার কষ্টে অর্জিত অর্থ তুমি হকের পথেই ব্যয় করেছ। আল্লাহ তোমাকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: আদর্শ সন্তান গড়তে চাইলে প্রয়োজন আদর্শ মা ও পিতা। সন্তানকে সোনার মানুষ বানাতে হলে ত্যাগ, ধৈর্য ও সঠিক শিক্ষার প্রয়োজন।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- সৈনিক কত বছর পর বাড়ি ফিরে আসে?
- সে কীভাবে ছেলেকে প্রথমে চিনতে পারেনি?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় সন্তান গঠন ও পিতামাতার দায়িত্ব সম্পর্কে?
ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নয়, একটি আদর্শ সন্তানই প্রকৃত সম্পদ।
কিওয়ার্ড: আদর্শ সন্তান, ইমাম রাবী’আ, ইসলামিক শিক্ষা, মা-বাবার দায়িত্ব
৬৭. 🛶 শিক্ষার মান যখন তখন
এক শিক্ষিত ভদ্রলোক নদীপথে এক মাঝির নৌকায় চড়ে যাত্রা করছিলেন। কথায় কথায় তিনি মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন:
: “তুমি কি অঙ্ক জানো?”
: মাঝি বলল, “আজ্ঞে না।”
: ভদ্রলোক বললেন, “তাহলে তোমার জীবনের চার আনাই মিছে।”
: “তুমি কি ভূগোল জানো?”
: মাঝি বলল, “আজ্ঞে না।”
: “তাহলে তোমার জীবনের আট আনাই মিছে।”
: “তুমি কি জ্যামিতি জানো?”
: মাঝি বলল, “আজ্ঞে না।”
: “তাহলে তোমার জীবনের বারো আনাই মিছে।”
এমন সময় আকাশে মেঘ জমে, শুরু হয় ঝড়। নৌকা ডুবুডুবু অবস্থায় পৌঁছায়।
: ভদ্রলোক বললেন, “মাঝি, এবার কী হবে?”
: মাঝি বলল, “নৌকা হয়তো ডুবে যাবে। আপনি সাঁতার জানেন তো?”
: ভদ্রলোক বললেন, “না তো!”
: মাঝি বলল, “তাহলে আজ্ঞে, আপনার জীবনের ষোল আনাই মিছে!”
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: বইয়ের জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তব জীবনের দক্ষতা কখনো কখনো জীবন বাঁচায়। অহংকার নয়, প্রয়োজন বুঝে শেখা উচিত।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- ভদ্রলোক মাঝিকে কী কী প্রশ্ন করেছিলেন?
- ঝড়ের সময় মাঝি কীভাবে বাস্তব শিক্ষা দেখাল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় জ্ঞান ও বাস্তবতা সম্পর্কে?
জ্ঞান শুধু বইয়ে নয়, জীবনের পরীক্ষায়ই তার সত্যতা প্রমাণ হয়।
কিওয়ার্ড: বাস্তব শিক্ষা, মাঝির গল্প, অহংকার, শিশুদের নৈতিক শিক্ষা
৬৮. 🌍 দুনিয়ার মূল্য
সালামাহ আল-আহমার বলেন, একদা বাদশা হারুনুর রশীদের নিকট গমন করলাম। তাঁর বিভিন্ন বালাখানা ও রাজমহল দেখে আমি তাঁকে বললাম, “আপনার মহলখানা বেশ প্রশস্ত। আপনার মৃত্যুর পর যদি আপনার কবরটাও প্রশস্ত হয়, তবেই উত্তম।’
এ কথা শুনে বাদশা কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে সালামাহ ! আপনি আমাকে সংক্ষেপে আরো কিছু উপদেশ দিন।
আমি বললাম, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কোন মরুভূমিতে থেকে যদি পিপাসিত হন, তাহলে আপনার পিপাসা মিটাবার জন্য কী পরিমাণ অর্থ দিয়ে এক ঢোক পানি কিনবেন?
তিনি বললেন, ‘আমার অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে।
আমি বললাম, ‘অতঃপর তা পান করে তা যদি পেট থেকে বের হতে না চায়, তাহলে তা বের করার জন্য কী ব্যয় করবেন?’
তিনি বললেন, ‘বাকী অর্ধেক রাজত্ব ব্যয় করে দেব।
আমি বললাম, ‘অতএব সে দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ, যে দুনিয়ার মূল্য হল এক ঢোক পানি ও এক সোড় পেশাব!’
এ কথায় বাদশা হারুন আরো জোরে কেঁদে উঠলেন।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: দুনিয়ার মোহে নয়, আখিরাতের প্রস্তুতিতে মনোযোগী হও। দুনিয়ার মূল্য এক ঢোক পানি, অথচ মানুষ তার জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- সালামাহ বাদশাহকে কীভাবে দুনিয়ার মূল্য বোঝালেন?
- বাদশাহ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিলেন?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় দুনিয়া ও আখিরাত সম্পর্কে?
যে দুনিয়ার মূল্য এক ঢোক পানি,
তার জন্য নয়, আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হও।
কিওয়ার্ড: দুনিয়ার মূল্য, হারুনুর রশীদ, ইসলামিক শিক্ষা, শিশুদের নৈতিক গল্প
৬৯. 🍆 মোসাহেবি ও চাটুকতা
বাদশা আকবর খেতে খেতে একটি তরকারি বড় পছন্দ করলেন। পাচক বীরমলকে তরকারিটির নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, এটি বেগুন, হুজুর! এর বহু গুণ আছে। এ হল শতরোগের মহৌষধ।
এ খেলে ব্রেন তাজা হয়, রাজনীতিতে মন বসে, শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, পরকালে বেহেশেত। বেহেশতীদের মাঝে এই তরকারী প্রথম পরিবেশন করা হবে।’
বেগুনের এত সব গুণ শুনে বাদশা খুব খেলেন। পরদিন সকালে বললেন, ‘বীরমল! তোমার ঐ শতগুণের বেগুন খেয়ে আমার পেটে সারা রাত ব্যথা।’
পাচক বলল। ‘হুজুর! ওটা তো বেগুন, ওর কোন গুণ নেই। খেলে নানা রোগ হয়, শরীরের ক্ষমতা কমে যায়, পেটে ব্যথা হয়, দুশ্চিন্তা বাড়ে, পরকালে দোযখে দোযখীদের মাঝে সর্বপ্রথম ঐ তরকারি পরিবেশন করা হবে!’
বাদশা বললেন, ‘কাল তুমি এর এত প্রশংসা করলে, আর আজ এর এত নিন্দা কেন?’
পাচক বলল, ‘কাল হুজুরকে ভালো লেগেছিল, তাই প্রশংসা করেছিলাম। আজ হুজুরকে খারাপ লেগেছে, তাই নিন্দা করছি। আমি তো হুজুরের চাকরি করি, বেগুনের নয়।’
বলা বাহুল্য, এমন ব্যক্তিপূজারী বহু মানুষ আছে, যারা স্বার্থের তরে রায় ও দল বদলে নেয়।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: সত্যবাদিতা ও নৈতিকতা ছাড়া প্রশংসা শুধু চাটুকারিতা। যারা স্বার্থের জন্য মত বদলায়, তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- পাচক বীরমল কীভাবে বাদশাহের মন রক্ষা করতে চেয়েছিল?
- তার মত পরিবর্তনের পেছনে কী কারণ ছিল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় সত্যবাদিতা ও চাটুকতা সম্পর্কে?
যে সত্য বলে, সে সম্মান পায়— চাটুকার শুধু হাস্যকর হয়।
কিওয়ার্ড: চাটুকারিতা, বাদশাহ আকবর, নৈতিক শিক্ষা, শিশুদের ইসলামিক গল্প
৭০. 🍽️ পেট বড় বালাই
একদা এক কুকুর পশুরাজ সিংহকে বলল, ‘হে পশুরাজ! আমার নামটা বড় খারাপ ও অসুন্দর। আমার নাম পাল্টে দিন।’ সিংহ বলল, ‘তুমি তো বড় লোভী, এ নাম তোমার জন্য যথার্থ ও উপযুক্ত।’
কুকুর বলল, ‘তাহলে আমাকে পরীক্ষা করে দেখে নিন, ভাল নামের কাজ করতে পারি কি না?’ সিংহ কুকুরকে এক টুকরা মাংস দিয়ে বলল, ‘এটি কাল পর্যন্ত তোমার কাছে আমানত রাখো। আগামী কাল তোমার কাছ থেকে এটি ফিরে নিব এবং তোমার সুন্দর দেখে একটি নাম রেখে দিব।’
কুকুর মাংস নিয়ে ফিরে গেল। অতঃপর যখন সে ক্ষুধা অনুভব করল, তখন মাংস খণ্ডটির দিকে তাকিয়ে জিভে লাল ফেলতে লাগল। খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও নাম পাল্টাবার কথা স্মরণ করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু এক পর্যায়ে যখনই তার প্রকৃতিতে লালসার উদ্রেক হল, তখনই তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল ও মনে মনে বলল, ‘ভাল নাম নিয়েই বা আর কী হবে? কুকুরও তো ভাল নাম!”
এই পরই সে মাংস খণ্ডটি খেয়ে ফেলল। যারা স্বার্থের খাতিরে নিজেদের হীন চরিত্র বদলাতে পারে না, এমন অসচ্চরিত্র, লোভী ও নীচমনাদের উদাহরণ এটাই।”
চরিত্র বদল না হলে নাম বদলে কিছু আসে যায় না। সম্মান পেতে হলে আগে নিজেকে বদলাও।
🌟 শিক্ষণীয় বার্তা: নাম বা পরিচয় বদলাতে হলে আগে নিজের চরিত্র বদলাতে হয়। যারা লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারা কখনোই সম্মানিত পরিচয়ের যোগ্য হয় না।
❓ প্রশ্নোত্তর:
- কুকুর পশুরাজ সিংহের কাছে কী অনুরোধ করেছিল?
- সিংহ কুকুরকে কীভাবে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল?
- কুকুর কেন মাংস খণ্ডটি খেয়ে ফেলেছিল?
- এই গল্পটি আমাদের কী শিক্ষা দেয় চরিত্র ও আত্মসংযম সম্পর্কে?
যা প্রয়োজন, তা-ই গ্রহণ করো— অতিরিক্তে আছে অপমান ও ক্ষতি।
কিওয়ার্ড: সংযম, অতিভোজন, শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, পেট বড় বালাই
📚 শিশুদের নৈতিক শিক্ষার গল্পের অন্যান্য পর্বসমূহ
🗣️ আপনার শিশুর মতামত কী?
এই গল্পটি আপনার শিশুকে কী শিক্ষা দিল?
নিচে মন্তব্য করে জানাতে পারেন, অথবা পরবর্তী গল্পে এগিয়ে যান!
🌙 পর্বের শেষ কথা
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এই দশটি ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প যেন একটি নৈতিক আলো—যা শিশুদের হৃদয়ে সত্য, সততা, ধৈর্য ও চিন্তার বীজ বুনে দেয়। প্রতিটি গল্পে আছে জীবনের বাস্তবতা, চরিত্র গঠনের উপাদান, এবং এমন বার্তা যা শিশুরা বড় হয়ে মনে রাখবে। আমরা চাই, এই গল্পগুলো শুধু পড়া না হোক—বরং শিশুদের সঙ্গে আলোচনা হোক, তাদের ভাবনায় জায়গা পাক, এবং তাদের আচরণে প্রতিফলিত হোক। আল্লাহ যেন আমাদের সন্তানদের সত্য, সুন্দর ও সৎ পথে পরিচালিত করেন—এই কামনায় পর্বটি আমার বাংলা পোস্ট.কম এ তুলে ধরলাম।