বড় মেয়ে (বাস্তব গল্প)

আব্বা স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ার পর চাকরীটা চলে যায়। এখন আর দাঁড়াতেও পারেনা।
আমার তিনটা টিউশনি আর কাকুদের থেকে হাত পেতে আর কয়দিন??
নিজের সহ দুবোনের পড়ালেখা,বাসা ভাড়া সংসার খরচ,বাবার ঔষধপত্র…
বড় মেয়ে হিসেবে সব চিন্তা তখন আমার। যখন সাহায্যের হাত গুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছিল তখন আমার মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা। রুহু তড়পাতে থাকে সহস্র যন্ত্রনায়। খাওয়ার কষ্ট হতে লাগলো। তিনবেলার যায়গায় দুবেলা…
বাসায় এতো এতো ঝামেলা। ছোট বোনরা জ্বালাতে থাকে। এটা চাই,ওটা চাই…রাগে যখন ওদের গাঁয়ে হাত তুলি আম্মা এসে আমায় পেটায়। ব্যাথা ভর্তি শরীর আর মনের ব্যাথা কভু এক হয়না….
আম্মা আমায় মারতো ঠিকই পরে বুকে টেনে আদর করে বলতো,মারে আমার সবচেয়ে প্রিয় মেয়ে তুই….
রাগের মাথায় বোনদের মারলেও ওরা ছিল আমার জান।
খুব ভাগ্যবতী মনে হয় নিজেকে। অভাব আছে। কিন্তু অগাধ ভালোবাসাও আছে….
সেই ভালোবাসা আমায় সবাইকে নিয়ে বাঁচার সাহস জোগায়।
বোনদের পড়া চালিয়ে নেবার জন্য মাঝপথে নিজের পড়াটা বন্ধ করে দিলাম। ভাবলাম অনার্স শেষ না করি,এই পর্যন্ত আসতে তো পেরেছি। কিন্তু বোনরা তো অনেক ছোট।
আরও অনেক টিউশনি খুঁজতে থাকি। আমি জানি একজন মেয়ে হিসেবে এইটুকু পড়াশোনায় আমার সৎ পথে উপর্জনের উৎস এই টিউশনি। এটা ছাড়া বিকল্প নাই। আমার তেমন মামা,চাচা নাই যারা আমায় চাকরী দিতে পারে।
এই অবস্থায় বিয়ের জন্য কোনোভাবেই আমি প্রস্তুত নই।
তাছাড়া সোহেল যখন ওর পরিবারে আমার কথা জানায় তারা আমাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে অস্বিকৃতিই জানায়। বিশেষ করে ওর বাবা। কারণ আমার বাবা গরীব। ওদের বাড়ির বউ হওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই।
আমি সোহেলকে বলি সে যেনো তার পরিবারের কথা মতো কাউকে বিয়ে করে সুখি হয়।
সোহেল আমাকে ছাড়েনা। চাকরী পেয়ে আমার জন্য নিজের বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় ওঠে।
আমি বলি,
–আমার জন্য মা,বাবাকে কষ্ট দিতে হবেনা। তারা যা বলে শোনা উচিৎ।
সে বলে,
–তারা যদি আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায় তবে সেটা কি হতে দেয়া উচিৎ!?
আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। তাই বলে আমার মনের বিরুদ্ধে তাদের অন্যায় চাওয়াকে মেনে নিই কি করে?? একটা মেয়ের পরিবার আমাদের চেয়ে কম সামর্থ্যবান। এটা তো তার দোষ হতে পারেনা।
জীবন আমার। ছেলে হিসেবে জীবনসঙ্গী আমার ইচ্ছাতেই হওয়া উচিৎ নয়কি???
তাছাড়া তুমি একা পারছোনা তোমার পরিবারের বোঝা বইতে। সেই বোঝা বইতে আমিও না হয় শরিক হলাম??
সুযোগ দিবেনা!??
তোমার মাঝে সত্যিকার নারীর গুন দেখেছি বলেই তোমাকে চাই। কোনো ধনী বা খুব রুপবতী নারী আমার নেশা নয়।
বড় মেয়ে হয়ে তোমার পরিবারের জন্য তোমার ত্যাগ আমায় তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিয়েছে বুঝিয়েছে। সবাই এমনটা পারেনা। আমার পরিবার আজ ভুল। কাল ঠিক ভুল বুঝতে পারবেন।
–আমি আর কিছু বলিনা।

আমাকে বিয়ে করতেও বাধ্য করে। আমাদের বিয়ে হয়। ও ওর পরিবারে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যদি আমায় মেনে নেয় তবেই সে বাড়ি ফিরবে।
সোহেল ওর বেতন থেকে কিছু টাকা প্রতি মাসে আমার হাতে দেয় আমার পরিবারের জন্য। চাচা শ্বশুরের হাত ধরে আমিও একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরী পেয়ে যাই। বাবাকে চিকিৎসা করিয়ে অনেকটা সুস্থ করেছি। হাটতে পারে। চাকরীও খুঁজছে। আমি বলি,বাবা তোমার চাকরী করতে হবেনা। আমি আছিনা?? সোহেলও তাই বলে…..
আমার আর সোহেলের নতুন অতিথি যখন আমার মাঝে বেড়ে উঠতে থাকে তখন আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমায় দেখতে আসেন….
কিন্তু মন থেকে তখনও মেনে নেন নি।
যেদিন হসপিটালে আমার নাড়ী ছেড়া নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখে সেদিন চোখ মেলে শ্বশুর বাড়ির সবাইকে চোখে সামনে দেখতে পাই…..
তারা সবাই আমার ছেলেকে নিয়ে আনন্দে মাতামাতি করছে….
আমার শ্বশুর,শাশুড়ি আমার পাশে বসে ছোট্ট কিন্তু আমার জন্য অনেক দামী একটা কথা বলেন।
“সরি বউমা”
আর আমার বাবা,মা বলেন,
আমার বড় মেয়ে!
আমার সোনা মা!
আমার চোখ আনন্দে ভিজে উঠছে….
সব খুশি আজ একইসাথে।
আলহামদুলিল্লাহ! সকল প্রশংসা আল্লাহর। দুঃখের পর তিনি সুখ দেন…
‘বউ মা’ হয়েছি!
‘মা’ হয়েছি!
হয়েছি আদরের “বড় মেয়ে”…… <3
(فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا * إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا)
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে”…
“অতঃপর নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ রয়েছে।” [সূরা আল ইনশিরাহ,আয়াত ৫-৬]

গল্প-“বড় মেয়ে” (বাস্তবতার আলোকে) লেখিকা : শারমিন রহমান

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading