চুম্বক পাহাড়ের গল্পটি আরব্য রজনীর সেরা গল্পগুলির একটি এবং সোনামণিরা শুনতে খুবই ভালোবাসে। আপনার সোনামণিকে রূপকথার গল্প শুনিয়ে প্রফুল্ল রাখতে তাকে চুম্বক পাহাড়ের গল্প’টি পড়ে শুনাতে পারেন।
চুম্বক পাহাড়ের গল্প ( শিশুদের আরব্য রজনীর সেরা গল্প ৩)
এক ছিল বাদশাহ। নাম তার কালান্দর। তার বাবা ছিলেন বাদশাহ কাসিব। বাদশাহ কাসিব যখন মারা গেলেন তখন সিংহাসনে বসলেন কালান্দর। তার শাসনে দেশের মানুষ ছিল সুখী। কারণ বাদশাহর মনটা ছিল উদার। আর মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালােবাসা।
কালান্দর বাদশাহর দেশটা ছিল সমুদ্রের পাড়ে । ফলে ছোটবেলা থেকে তার রক্তে মিশে গিয়েছিল সমুদ্র ভ্রমণের নেশা। সমুদ্রের গভীরে অনেক দূরে বেশ কিছু দ্বীপ ছিল এই কালান্দর বাদশাহর দখলে। মাঝে মাঝেই যুদ্ধজাহাজ আর সৈন্যসামন্ত নিয়ে কালান্দর বাদশাহ যেতে সেই দ্বীপ পরিদর্শনে ।
একবার এইরকম এক দ্বীপ পরিদর্শনে যাবার সময় সমুদ্রে উঠল ভয়ঙ্কর ঝড়। সারারাত উত্তাল সমুদ্রের বুকে মরণের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে তাদের সময়। রাত্রি শেষে ঝড় থামল। শুরু হল সুন্দর হাসি-ঝলমল রােদে দিন। ঝড়ের তাণ্ডবে কালান্দর বাদশাহর জাহাজগুলো আটকে গিয়েছিল এক ছোট্ট দ্বীপে! একটু বিশ্রামের জন্য সবাই এই দ্বীপে নেমে এল। বিশ্রাম নিতে নিতে কালান্দর বাদশাহ তাকালেন সমুদ্রের দিকে। অবোধ শিশুর মতো শান্ত সমুদ্রকে দেখলে এখন মনেই হয় না যে এই সমুদ্রেই রাতে এমন তাণ্ডব চালিয়েছিল। সমুদ্রের গভীর নীল জলের সৌন্দর্য যেন বাদশাহ কালান্দরের মনে এনে দিল কবিতার গন্ধ।
কয়েকদিন এই ছােট্ট দ্বীপে বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন বাদশাহ। কুড়ি দিন ধরে গভীর সমুদ্রে জাহাজ চালিয়েও হারনাে পথের কোনও নিশানা পাওয়া গেল না। দিশহারা হয়ে অথৈ সমুদ্রে দাঁড় টানছে মাল্লারা। বৃদ্ধ অভিজ্ঞ কাপ্তানের কপালেও ফুটে উঠেছে রেখা। বাদশাহর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
কিছুতেই চেনা সমুদ্রের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাদশাহ কালান্দর এক ডুবুরিকে সমুত্রে নামিয়ে দেয়ার হুকুম দিলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল ডুবুরি । অনেকগুলো বড় মাছ দেখা যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে । আর দূরে দেখা যাচ্ছে একটা পাহাড় । শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন কাপ্তেন।
তার রক্ষা নেই আমাদের। আমরা চুম্বক পাহাড়ের কাছে এসে পড়েছি । পাহাড়ের গায়ে গাথা আছে হাজার চুম্বক লােহার বর্শা । আমাদের জাহাজ যতই তার কাছে যেতে থাকবে সেই চুম্বকের প্রচণ্ড আকর্ষণ ততই টেনে নেবে জাহাজকে। জোরে এগুতে এগুতে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে যাবে জাহাজগুলাে । মত্যু নিশ্চিন্ত আমাদের জাহাপনা। এই পাহাড়ের আকর্ষণ ভীষণ তীব্র। কত যে জাহাজ আর মানুষ এখানে প্রাণ হারিয়েছে তার কোনও লেখাজোখা নেই! আমরাও মরব তাদের মতাে।
কাপ্তেন প্রাণভয়ে কাতর হয়ে কাঁদছিল। কারণ এই চুম্বক পাহাড়ের ভয়াবহতার কথা সে-ই জানে সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রে জাহাজ চালাতে গেলে সব কাপ্তেনই এই এলাকার বাইরে থাকতে চেষ্টা করে : ওস্তাদ কাপ্তেরা এই পাহাড়ের কথা সব সময় স্মরণ করিয়ে দেন তাদের শিষ্যদের । যে মানুষ জানে যে সামনে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যু সে তাে কাঁদবেই। জাহাজের অন্যেরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাদের মনে ভয়ও নেই ।
কাপ্তেন কাঁদতে কাঁদতে জানাল, ‘চুম্বক পাহাড়ের চূড়ায় আছে একটা গম্বুজ। দশটা পিতলের খুঁটির উপর দাঁড় করানাে আছে সেই গম্বুজটা। তার উপরে আছে এক তামার তৈরি ঘোড়সওয়ার । তার এক হাতে আছে ঢাল আর অন্য হাতে তলোয়ার। বুকে বর্ম, মাথায় শিরস্ত্রাণ। যুদ্ধসাজে সজ্জিত যােদ্ধা । সে সীসার ফলকে লেখা এক দৈববাণী আঁটা তার বুকে। লােকে বলে ঐ ঘােড়সওয়ার যােদ্ধাটি যতদিন ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে ততদিন কোনও জাহাজের নিস্তার নেই। এই সমুদ্র-এলাকায় গেলেই চুম্বকের আকর্ষণ টেনে নেবে জাহাজকে । এভাবে কত জাহাজ যে এই পাহাড়ে এসে ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব নেই। যদি কেউ ঐ ঘােড়সওয়ারকে ওখান থেকে ফেলে দিতে পারে তাহলেই শুধু এই চুম্বক পাহাড় থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে ।
কাপ্তনের কথা শুনে সবাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল । তাদের মনে একই ভাবনা, না জানি তাদের কোন মহাপাপের শাস্তি দিচ্ছেন আল্লাহ।
পরের দিন সকালে কাপ্তেন জানাল জাহাজগুলাে চুম্বক পাহাড়ের একেবারে কছে চলে এসেছে! আর কিছুক্ষণের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে সব জাহাজ। সবাই যেন আল্লাহর নাম জপতে থাকে। কাপ্তেনের কথা শেষ হতে-না-হতেই প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কালান্দর বাদশাহর সব জাহাজ। কালান্দর বাদশাহ ঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যে মুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসতে লাগলেন। ভাবলেন মৃত্যু তাে নিশ্চিত! তারপর আর কিছু মনে নেই তার। জ্ঞান ফিরলে দেখলেন শুয়ে আছেন সেই পাহাড়টার নিচে এক বালির চুড়ায় । জলোচ্ছাসের প্রচণ্ড আঘাতে তার মৃত্যু হয়নি। এ নিশ্চয়ই তার পরম সৌভাগ্য । নইলে এতক্ষণে হাঙর-কুমিরের পেটে চলে যাবার কথা। এই রকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালেন কালান্দার বাদশাহ । দেখলেন একটা পথ সােজা উঠে গেছে পাহাড়ের চুড়ার দিকে। পথ ধরে এগিয়ে চললেন তিনি । আল্লাহর কি অপার মহিমা! এতক্ষণ বিপরীত দিক থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছিল । এই তীব্র বাতাসের বাধা পেরিয়ে সোজা খাড়া পাহাড়ের উপর ওঠা একেবারেই অসম্ভব। হঠাৎ করে উল্টে গেল বাতাসের গতি। যেন বাতাসই কালান্দার বাদশাহকে ঠেলে উপরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । একসময় কালান্দর বাদশাহ আবিষ্কার করলেন কাপ্তন চুম্বক পাহাড়ের চূড়ার যে গম্বুজের কথা বলেছিলেন সেই গম্বুজের নিচে এসে পড়েছেন তিনি। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় ভেঙে এল শরীর । ওখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন বাদশাহ ।
ঘুমের মধ্যে বাদশাহ কালান্দর শুনতে পেলেন এক দৈববাণী : ‘শুনো কাসিবের পুত্র, ঘুম থেকে জাগাে । তােমার পায়ের ঠিক তলায় গর্ত খুঁড়ে দেখ । একখান তীর আর ধনুক পাবে । এই ধনুকটাতে আছে দৈবের শক্তি । তার ঐ ধনুকে তীর গেঁথে ঘোড়সওয়ারকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেবে ! তাহলে দেখবে তামার ঘােড়সওয়ার সমুদ্রে ডুবে যাবে । সঙ্গে সঙ্গে তােমার হাত থেকেও পড়ে যাবে ধনুকটা। যে গর্ত খুঁড়ে তুলবে ধনুকটা, সেই গর্তে রেখেই ধনুকটাকে আবার মাটিচাপা দিয়ে রাখবে। তাকাবে তারপর সামনের দিকে । দেখবে সমুদ্রের পানি তােমার পায়ের তলার পাহাড়-চুড়ার সমান হয়ে যাবে । দেখতে পারে একটা ডিঙি নৌকা বেয়ে এক লােক এগিয়ে আসছে তােমার দিকে । ভিঙির লােকটা দেখতে একেবারে তামার সেই ঘােড়সওয়ারের মতাে মনে হবে । কিন্তু আসলে সে তা নয়। নৌকায় বােঝাই করা থাকবে মড়ার খুলি । সে আসবে তােমাকে পার করে দিতে। কিন্তু সাবধান! ভুলেও নৌকায় উঠে আল্লাহর নাম উচ্চারণ কোরাে না । একটানা দশদিন ধরে সেই নৌকায় থাকবে। তারপর দেখবে তুমি তােমার চেনা সমুদ্রে এসে পড়েছ । সেখানে দেখতে পাবে সওদাগরের নৌকা। তারা তােমাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেবে তােমার দেশে কিন্তু আবার সাবধান করে দিচ্ছি তােমাকে, ভুলেও কখনও আল্লাহর নাম উচ্চারণ কোরাে না।
দৈববাণী শুনতে শুনতে বাদশাহর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ । দৈববাণীর কথামতাে সব কাজ করলেন বাদশাহ । সব ঘটন’ মিলে যেতে লাগল দৈববাণীর সঙ্গে । বাদশাহ যখন নিজের চেনাজানা সমুদ্রে এসে পড়লেন তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এল তাঁর । আল্লাহ তুমি সর্বশক্তিমান । তােমার দোয়াতেই আমি আবার দেশে ফিরে আসতে পেরেছি । তুমিই একমাত্র প্রভু..।’
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল । পিতলের মারিটা একহাতে বাদশাহকে তুলে ফেলে দিল সমুদ্রে। তারপর নৌকা নিয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল । বাদশাহ ছিলেন ভালো সাঁতারু । সমুদ্রের ঢেউয়ে গা এলিয়ে ভেসে রইলেন কোনওমতে : প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়! প্রতি মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলেন তিনি। কারণ অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষ বেশি করে আল্লাহকে ডাকে। মসজিদের বড় বড় গম্বুজের চূড়ার মতাে ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে চলল কালান্দর বাদশাহকে। একসময় তিনি দেখলেন একটা বিরাট ঢেউ এসে তাঁকে উপকুলের দিকে ছুড়ে দিয়ে চলে গেল । তীরে এসে গায়ের জামাকাপড় শুকাতে দিয়ে ক্লান্ত বাদশাহ ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই সেই দিন আর রাত্রি পার করে দিলেন তিনি। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই শুকনাে কাপড়গুলাে পরিধান নিলেন । সামনে দেখলেন সুন্দর সবুজ শস্যক্ষেত্র । আনন্দে নেচে উঠল মন। চারদিকে সমুদ্রঘেরা এই ছােট সবুজ শস্যভরা দ্বীপটিকে খুব ভালাে লাগল বাদশাহর। কিন্তু পরক্ষণেই দুঃখ জড়িয়ে ধরল তাঁকে। নিজেকে ভীষণ হতভাগ্য মনে হতে লাগল। একটা ভুলের জন্য আজ তাঁর আর নিজের দেশে ফেরা হল না। কে জানে আর কোনওদিন ফেরা হবে কি-না । কী আর করা! যে করেই হােক বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে । বিপদে পড়ে ভয় পেলে চলবে না। সাহস নিয়ে বিপদের মােকাবেলা করতে হবে। কোনও দুর্বল মানুষকে আল্লাহ সহযােগিতা করেন না ।
হঠাৎ কালান্দর বাদশাহ দেখলেন একটা জাহাজ যেন এই দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন একটা ঝােপের আড়ালে ‘ একটা উঁচু গাছের ডালে উঠে লুকিয়ে পড়লেন বাদশাহ । ওরা তার শত্রু না মিত্র কে জানে! দেখতে দেখতে এই দ্বীপেই এসে নােঙর করল জাহাজটা । জনাদশেক লােক নামল । সবার হাতে মাটিকাটার কোদাল । এরা নিশ্চয়ই কারও ভাড়া করা শ্রমিক । মনে হল বাদশাহ কালান্দরের। ওরা একটা জায়গা খুঁজে বের করল। তারপর গর্ত করতে লাগল। গাছের ডালে বসে সবই দেখতে লাগলেন বাদশাহ । লােকগুলাে গর্ত খুঁড়তেই একটা গুপ্তঘরের দরজা পেয়ে গেল। তারপর আবার ফিরে এল জাহাজে । জাহাজ থেকে নানা রকম খাবার নিয়ে সেই গুগুঘরের ভিতরে রেখে আসতে লাগল । আরেক দফায় আনল কাপড় আর সাজপােশাক। আরও অনেক দামি জিনিশপত্র এনে রাখল ওই গুপ্তঘরে । মােটকথা একটা সন্তু পরিবারের যে-সব দামি দামি জিনিশপত্র সবসময় প্রয়ােজন সে-সব এনে রাখা হল সেখানে । তারপর জাহাজ থেকে নেমে এল এক থুত্থুড়ে বুড়ো । দেখে মনে হল তিনি কোনও দেশের রাজা। তাঁর হাত ধরে নামল একটি সুন্দর কিশাের। পরনে তার মণিমুক্তো খচিত জামাকাপড়। এ নিশ্চয়ই তাহলে শাহজাদা? সবাই চলে গেলো গুপ্তঘরের ভেতর। বেশ কিছুক্ষণ পর ঐ শাহজাদা ছাড়া আর সবাই বেরিয়ে এল । তারপর ঐ জাহাজে চড়ে সবাই চলে গেল দূরে কোথাও।
চোখের আড়ালে চলে গেল জাহাজটা। কালান্দার বাদশাহ নেমে এলেন গাছ থেকে। গুগুঘরের উপরের মাটি সরিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন তিনি। তারপর পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নিচে । সুন্দর করে বানানাে এই গুপ্ত বাড়িটা । চারপাশের দেয়ালে সুন্দর কারুকাজ। একটু এগােতেই দেখা গেল মখমলের পর্দা ঝোলানো একটা দরজা : পর্দা সরিয়ে ভেতরে যেতে একটু ভয় হল । মেঝেতে এত সুন্দর ঝকঝকে তকতকে গালিচা পাতা আছে যে পা রাখতে ইচ্ছে করে না। সুন্দর সুন্দর বসার আসন । মাথার ওপর হিরের কারুকাজ করা ঝাড়বাতি ঝুলছে । আলমারিতে রাখা আছে অনেক বই। টেবিলের উপরে একটা ফলের রেকাবি । মাঝখানে সুন্দর ফুলদানি । ঘরের এক কোণায় রাখা আছে একটা সােনার পালঙ্ক। পালঙ্কে শুয়ে আছে সেই কিশাের শাহজাদা । বাদশাহ কালারকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠল শাহজাদা । বাদশাহ তাকে অভয় দিলেন ।
‘আমি তােমার শত্রু নই, বন্ধু । তােমার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি বন্ধু । তােমাকে উদ্ধার করতেই এসেছি : দেখলাম ওরা তােমাকে এই পাতালপুরীতে বন্দি করে রেখে গেছে। ভয় দূর হল ছেলেটির মন থেকে । হাসি ফুটল মুখে; আর যেন মণিমুক্তো ঝরে পড়ল। বলল,
‘ওরা আমাকে বন্দি করে রেখে যায়নি। আমাকে বাঁচানাের জন্যই এই ব্যবস্থা। যে বৃদ্ধ লােকটিকে দেখেছেন তিনি আমার বাবা । আপনি হয়তো তাঁর নামও শুনে থাকবেন । জগদ্বিখ্যাত জহুরি তিনি। তার মতাে ধনী লােক পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পৃথিবীর প্রায় সব রাজা-বাদশাহর কাছে তিনি হিরে-জহরত বিক্রি করেছেন । তাঁর বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান আমি..। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল ছেলেটি । বলে চলল আবার—
এক গণক আমার জন্মের সময় বলেছিলেন, এই শিশু তার পিতামাতার জীবদ্দশাতেই মারা যাবে। এর বয়স যখন পনের বছর হবে তখন বাদশাহ কাসিবের পুত্রের হাতে তার মৃত্যু ঘটবে । সেই গণক আরও অনেক বিস্তারিত আলামত বলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাদশাহ কাসবের পুত্র জাহাজডুবি হয়ে এক কষ্টিপাথরের পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে পিতলের ঘোরসওয়ারকে পানিতে ফেলে দিয়ে হাজার হাজার নাবিকের প্রাণ বঁচাবে । আমার বাবা খুব সাবধানে এই পনের বছর আমাকে চোখে চোখে রেখেছেন । কিছুদিন হল খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে কাসিবের পুত্র সেই পিতলের ঘোড়সওয়ারকে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিয়েছে । এই খবর শােনার পর থেকে আমার বাবা-মায়ের চোখে ঘুম নেই । গণকের ভবিষ্যদ্বাণী শােনার পর থেকেই আমাকে রক্ষা করার জন্য বাবা এই গুপ্ত প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছিলেন। গণক বলেছিলেন, “পিতলের ঘােড়সওয়ারকে ফেলে দেয়ার চল্লিশ দিনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটবে। চল্লিশ দিনের জন্য তাই বাবা, আমাকে এখানে রেখে গেছেন। ছেলেটার কথা শুনে রাগ হল বাদশাহ কালান্দরের । এইসব গণকেরা যে কী ভণ্ড হয় তা তার জানা আছে । নিরহ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে এরা টাকা উপার্জন করে । তিনি ছেলেটাকে বললেন,
‘কোনও ভয় নেই। আমি বেঁচে থাকতে কেউ তােমার একচুলও ক্ষতি করতে পারবে না । তােমার মতাে এমন ভালাে নিস্পাপ একটা ছেলেকে আমি হত্যা করব একি হতে পারে? সব মিথ্যে কথা ‘ সব বানানো গল্প ‘।
এরপর থেকে বাদশাহ কালান্দর ছেলেকে যত্ন করতে লাগলেন। খাবার সময় হলে আদর করে খাইয়ে দেন। মজার মজার গল্প শুনিয়ে আনন্দে মাতােয়ারা করে রাখেন তাকে : ছেলেটাও নির্ভয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই এটা-সেটার জন্য আবদার করে । যদি আবদার না মেটানো হয় তাহলে অভিমান করে বসে। তাই বাদশাহ কালান্দার চেষ্টা করেন তার মনটাকে প্রফুল্ল রাখতে। ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গেছে তাঁর।
একদিন দুদিন করে পিতলের ঘােড়সওয়ারকে ফেলে দেবার উনচল্লিশ দিন পার হয়ে এল । এই দিনটা পার হলেই চল্লিশ দিন শেষ হবে। হিসেবমতাে সেদিনই তার বাবার এসে নিয়ে যাবার কথা। তাই যত্ন করে বাদশা তাকে গােসল করিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলেন । আতরের খুশবু মেখে দিলেন গায়ে। তারপর ছেলেটি খেতে বসবে । সামনে সুন্দর সুন্দর সব খাবার সাজানাে আছে কিন্তু সে তরমুজ খাবার বায়না ধরল । বাদশাহ তার জন্য বড় দেখে একটা তরমুজ নিয়ে এলেন । পালঙ্কের ওপাশের দেয়ালে টাঙানো ছিল একটা ছুরি। তরমুজ কাটার জন্য ছুরিটা নামাতে হবে । ছুরি নামানাের জন্য পালঙ্কের উপর উঠে দাড়ালেন । ছুরিটা হাতে নিতেই হঠাৎ ছেলেটার মাথায় কী যেন হল, দুষ্টুমি করে কাতুকুতু দিয়ে বসল বাদশাহকে। বাদশাহ তখন ছুরিটা খােলার জন্য চেষ্টা করছেন। হয়তাে ছুরি খােলার এই চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হওয়ায় মজা পাচ্ছিল ছেলেটি। হঠাৎ এভাবে কাতুকুতু দিয়ে বসবে তাঁকে, ভাবতেও পারেননি বাদশাহ । চমকে উঠে পা-টা সরিয়ে নিতেই ভারসাম্য রক্ষা করতে না-পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। আর পড়বি তাে পড়, পড়লেন ছেলেটার বুকের উপরে। তার হাতে তখন খােলা ছুরি । সােজা গিয়ে বিধে গেল ছেলেটার বুকে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হল ছেলেটার । বুক ফেটে যেতে চাইল কালান্দ বাদশাহর । একেই বলে নিয়তি । না হলে যে ছেলেটার জন্য তার এত মায়া-মমতা জন্মাল, যাকে আদর করে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল; নির্জন দ্বীপে একা থাকার কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিল যে ছেলের কারণে, সেই ছেলেটি কি-না গণকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে দিয়ে তাঁরই হাতে মরল!
সারাজীবন কালান্দার বাদশাহকে এই দুঃখ বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। যখনই বৃদ্ধ জহুরির কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে ছেলেটার কথা তখন নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ে কালান্দার বাদশাহর চোখ থেকে।
গল্পের উৎস : ছোটদের আরব্য রজনীর সেরা গল্প।
লেখক : আহমাদ মাযহার!
আরও পড়ুন : সোনালী শাহজাদা (শিশুদের রূপকথার গল্প ১)
ছোট সোনামণিদের জন্য আরও কিছু শিক্ষণীয় গল্প!
০১. মানবতা (কিশোর কিশোরীদের গল্প ১২)
০২. দুই কিশোর (বদর যুদ্ধের গল্প)
০৩. ত্যাগের শিক্ষা (কিশোর কিশোরীদের গল্প ১৪)
০৪. হিংসার ভয়াবহ পরিণাম (শিক্ষণীয় গল্প)
০৫. অহঙ্কার থেকে সাবধান! (কিশোরীদের গল্প)
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি চুম্বক পাহাড়ের গল্প টি পড়ে আপনাদের ভালো লেগেছে এবং আপনার সোনামণিকে এই চুম্বক পাহাড়ের রূপকথার কাহিনী শুনিয়ে তাকে আনন্দিত করতে পারবেন।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.