“এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, এক ফিরিশতা কারুকার্য খচিত একটি রুমাল জড়িয়ে অতি মনোরম এক বস্তু তাঁকে উপহার দিচ্ছেন। রাসূল (সাঃ) তা হাতে নিয়ে ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি কি জিনিস? উত্তরে ফেরেশতা তা খুলে দেখার জন্য বললেন। রাসূল (সাঃ) খুলে দেখলেন তার মধ্যে আয়েশার ছবি অঙ্কিত রয়েছে।”

আয়েশা (রা) কে রাসূলুল্লাহ (সা:) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
١. عَنْ عَائِشَةَ (رض) أَنْ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُونِي زوجتى فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ قُلْتُ بَلَى قَالَ فَأَنْتِ زَوْجَتِي فِي الدُّنْيَا
১. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, হে আয়েশা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার স্ত্রী হবে? আয়েশা বলল, কেন নয়? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার স্ত্রী। (হাকিম : সিলসিলা আহাদিস সহীহা লি আলবানী, হাদীস নং-১১৪২)
নাম ও বংশ : নাম আয়েশা । আয়েশা শব্দের অর্থ সৎচরিত্রা। ডাক নাম উম্মে আবদুল্লাহ। উপাধি সিদ্দিকা ও হুমায়রা। তিনি খুব ফর্সা ছিলেন এ জন্য তাকে হুমায়রা বলা হতো। পরবর্তীকালে নবী (সা:)-এর স্ত্রী হওয়ার কারণে উন্মুল মু’মিনীন বা মু’মিনদের মা খেতাব প্রাপ্তা হন ।
পিতা-মাতা ও বংশ পরিচয় : পিতার নাম আবূ বকর সিদ্দিক (রা)। যিনি রাসূল (সাঃ)-এর সার্বক্ষণিক সহচর ও বন্ধু ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদার প্রথম খলিফা ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল যয়নব এবং ডাক নাম ছিল উম্মে রুম্মান।
পিতার দিক থেকে তাঁর বংশ তালিকা হল, আয়েশা বিনতে আবূ বকর ইবনে কুহাফা ইবনে ওসমান ইবনে আমের ইবনে ওমর ইবনে কা’ব ইবনে সা’দ ইবনে তাইম। মাতার দিক থেকে আয়েশা বিনতে উম্মে রুম্মান বিনতে আমের পিতৃকূলের দিক থেকে আয়েশা (রা) তাইম গোত্রের এবং মাতৃকূলে দিক থেকে কেনানা গোত্রের ছিলেন।
কুনিয়াত বা উপনাম : আয়েশা (রা) নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন তিনি রাসূল (সাঃ) কে বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) আপনার অন্যান্য স্ত্রীগণ তাদের পূর্বোক্ত স্বামীর সন্তানদের নামানুসারে গুণবাচক নাম গ্রহণ করে থাকেন। আমি কি ডাক নাম গ্রহণ করার ব্যাপারে কারো নামের সাথে নিজের নামকে সংযুক্ত করবো? রাসূলুল্লাহ মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘আয়েশা! তুমি তোমার বোনের ছেলে আবদুল্লাহর নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে ডাকনাম (কুনিয়াত) গ্রহণ কর।’ এর পর থেকে তিনি উম্মে আবদুল্লাহ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। অবশ্য তাঁর পিতা আবূ বকর (রা)-এর আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ, আর ডাক নাম ছিল আবূ বকর। এ জন্য আয়েশা (রা)-কে উম্মে আবদুল্লাহ অর্থাৎ আবদুল্লাহর মা বলার কারণ ইবনুল আসীর এভাবে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে রাসূল (সাঃ) তাঁকে ‘সত্যবাদীর কন্যা সত্যবাদীণী’ বলে ডাকতেন।
জন্ম : আয়েশা (রা)-এর জন্ম ও বিয়ের সন তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবুও মতগুলো নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, নবুওয়্যাতের ২/৩ সনে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং নবুওয়্যাতের ১০ম সনের শাওয়াল মাসে বিয়ে হয়েছিল। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৬/৭ বছর। হিজরী দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসে রাসূল (সাঃ) ও আয়েশা (রা)-এর বাসর অনুষ্ঠিত হয়। এ সময়ে আয়েশার বয়স হয়েছিল ৯/১০/১১ বছর, আর নবী নন্দিনী ফাতিমার বয়স হয়েছিল ১৭/১৮ বছর। আয়েশা (রা) ফাতিমা (রা) থেকে ৫ বছরের ছোট ছিলেন ।
রাসূলের সাথে আয়েশার বিয়ের প্রস্তাব : রাসূল (সাঃ) এর খালা খাওলা বিনতে হাকিম ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও আরবের জাহেলী যুগের কুসংস্কার দূর করার জন্য আয়েশা (রা)-কে বিয়ে করার ব্যাপারে তাঁকে বললেন, তৎক্ষণাৎ রাসূল (সাঃ) এ বিষয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। তিনি আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর তিনি এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, ‘এক ফেরেশতা কারুকার্য খঁচিত একটি রুমাল জড়িয়ে অতি মনোরম এক বস্তু তাঁকে উপহার দিচ্ছেন। রাসূল (সাঃ) তা হাতে নিয়ে ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি কি জিনিস? উত্তরে ফেরেশতা তা খুলে দেখার জন্য বললেন। রাসূল (সাঃ) খুলে দেখলেন তার মধ্যে আয়েশার ছবি অঙ্কিত রয়েছে।’
এরপর রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে খাওলা আয়েশা (রা)-এর পিতা-মাতার নিকট প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাব শুনে আবূ বকর জানান যে, এ বিয়েতে তাঁর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘এ বিয়ে কীভাবে বৈধ হবে? আয়েশা তো রাসূলুল্লাহর ভাইঝি।’ এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তিনি তো কেবলমাত্র আমার দ্বীনি ভাই।’ খাওলা আবূ বকর (রা)-কে বোঝান যে, রাসূল (সাঃ) তো আপনার রক্ত সম্পর্কের ভাই নন। রক্ত সম্পর্কে না থাকলে একই খান্দানে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের মেয়েকে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে।
আয়েশা (রা)-এর মা এ বিষয়ে বললেন, ‘আয়েশার সাথে রসূলুল্লাহ সালাম-এর বিয়ে খুবই আনন্দের কথা। আমার বিশ্বাস এ বিয়ের ফলে আরবের অনেক জঘন্য কু-প্রথা দূর হবে।’
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে আবূ বকর (রা) তাঁর পিতা আবূ কুহাফাকে বিষয়টি বললেন। তিনি তাঁর মতামতে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহর সাথে আমার নাতনীর বিয়ে হলে তা বড়ই গৌরবের কথা হবে। আমার আদরের নাতনী মাহবুব রাব্বুল মাশরিকাইন ও মাগরিবাইন এর মাহবুবা হবে। তবে আমি আমার নাতনীর বিয়ে যুবায়ের ইবনে মাতয়াম এর ছেলের সাথে দেবার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি। এ কথা আমি কারো নিকট এতদিন প্রকাশ করিনি। আমি যুবায়েরের মতামত নিয়ে তোমাকে আমার অভিমত জানাবো।
যুবায়ের ও তার পরিবার তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। সে কারণে তারা নওমুসলিম আবূ বকরের কন্যার সাথে তাদের সন্তানের বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে রাসূল (সাঃ) এর সাথে আয়েশা (রা)-এর বিয়ের বাধা দূরীভূত হয়।
বিয়ে সম্পন্ন : উভয়পক্ষ বিয়েতে সম্মত হয়ে ৫০০ দিরহাম মহরানা ধার্য করা হয় । এরপর আবূ বকর (রা) নিজে রাসূল (সাঃ) এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে নিজ বাড়িতে আনলেন। রাসূল (সাঃ) আবূ বকরের বাড়িতে আসার সাথে সাথে উপস্থিত মেহমানবৃন্দ ‘মারহাবান মারহাবান, আহলান ওয়া সাহলান’ অর্থাৎ শুভেচ্ছা স্বাগতম বলে তাঁকে খোশ আমদেদ (স্বাগতম) জানালেন। বিয়ের মজলিসে সকলকে উদ্দেশ্য করে আবূ বকর সিদ্দিক (রা) একটি বক্তৃতা দিলেন, তিনি বললেন-
‘আপনারা জানেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের পয়গম্বর। তিনি আমাদেরকে আঁধার থেকে আলোকে নিয়ে এসেছেন। এ আলোকের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবার এবং চিরদিনের জন্য আমাদের এ অকৃত্রিম বন্ধুত্ব বজায় রাখবার পথ অনেকদিন ধরে খুঁজছি। তাই আজ আপনাদের খেদমতে আমার ছোট মেয়েটিকে এনেছি। এ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে কতশত কুসংস্কার আমরা গড়ে তুলেছি । বিনা অজুহাতে আমরা শিশু কন্যাকে মাটিতে পুঁতে ফেলি, হাত পা বেঁধে দেব-দেবীর পায়ে বলি দেই; যাদেরকে বাঁচিয়ে রাখি তাদেরকে জীবন্ত-মরা করে ফেলি, দোস্তের মেয়েকে আমাদের কেউই বিয়ে করতে পারে না। আপনারা যদি আমার এ আয়েশাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতে সোপর্দ করে দেন তবে চিরতরে আরব দেশ থেকে এ সকল কুসংস্কার মুছে ফেলতে পারবেন। এতে আপনারা আমার বন্ধুত্বকে বজায় রাখতে পারবেন এবং আমার প্রিয় কন্যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে থেকে ভবিষ্যতে তাঁর আদর্শ ও বাণী জগতে প্রচার করতে পারবে।
উপস্থিত সুধীবৃন্দ এ বক্তৃতা শোনার পর সমবেত কণ্ঠে আবার বলে উঠলেন, ‘মারহাবান, মারহাবান, (স্বাগতম) আয়েশার বিয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই কল্যাণ নেমে আসুক ।
এরপর আবূ বকর (রা) নিজে খুতবা পাঠ করে রাসূল (সাঃ) ও আয়েশার (রা) বিয়ে পড়িয়ে দেন। আয়েশা (রা)-এর জন্ম ও বিয়ে ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা মত থাকলেও একটি বিষয়ে সকল ঐতিহাসিকই একমত, তা হল- তিনি শাওয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন, শাওয়াল মাসেই তাঁর বিয়ে হয় এবং শাওয়াল মাসেই তিনি স্বামীগৃহে প্রথম পদার্পণ করেন ।
আয়েশা (রা)-এর জ্ঞান-গরিমা : বাল্যকাল থেকেই আয়েশা (রা) নানা ক্ষেত্রে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাধর একজন বালিকা। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। যে কোনো বিষয় তিনি দু’একবার পড়লেই মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন। আয়েশা (রা) তাঁর পিতার সাথে থেকে ৩/৪ হাজার কবিতা ও কাসিদা কণ্ঠস্থ করেছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই পিতা আবূ বকর (রা)-এর ন্যায় একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষের পূত-পবিত্র সাহচর্য থেকে আদব-কায়দা, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, দান-খয়রাত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অতিথি আপ্যায়ন এবং সত্যবাদিতার ক্ষেত্রে তাঁকেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন । তিনি তাঁর পিতা-মাতার নিকট থেকে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, রাসূল (সাঃ) এর সাহচর্যে এসে তা শতধারায় বিকশিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে পরবর্তী জীবনে তিনি মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন ।
কাফেরদের অন্তর্জালা : ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই মক্কা ও মদীনাতে মুনাফিকরা তৎপর ছিল এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার দেখে তাদের অন্তর্জালা ক্রমেই বাড়ছিল। তারা সুযোগ খুঁজছিল বড় ধরনের কোনো গোলযোগ সৃষ্টির জন্য। বিশেষ করে রাসূল (সাঃ) ও আবূ বকর (রা)-এর মধ্যে যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল এটাকে তারা ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে লাগলো । তাদের ধারণা ছিল আবূ বকর (রা) যেহেতু সমাজের প্রভাবশালী মানুষ, তাছাড়া রাসূল (সাঃ) এর সব কিছুকে বিনা বাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করে। অতএব তাদের বন্ধুত্বে ভাঙন ধরানো একান্ত জরুরি ।
কাফেরদের ষড়যন্ত্র : কাফেরদের অন্তর্জালা ও গোপন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য মুনাফিকদের সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই পুণ্যবতী, সতীসাধ্বী আয়েশা (রা)-এর চরিত্রের ভয়ানক এক অপবাদ রটনা করে। ইসলামের ইতিহাসে যা ইফকের ঘটনা নামে খ্যাত ।
আয়েশা (রা)-এর জীবনের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী!
আয়েশা (রা)-এর জীবনে চারটি ঘটনা অত্যন্ত আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ । এ ঘটনা চারটি হলো : ১. ইফক, ২. ঈলা, ৩. তাহ্রীম ও ৪. তাখাইয়ির ।
১. ইফক বা মিথ্যা অপবাদ আরোপের ঘটনা!
৫ম মতান্তরে ৬ষ্ঠ হিজরীর শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু মুসতালিক বা আল মুরায়সী যুদ্ধে যাত্রা করেন। এ যুদ্ধে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)ও শরীক ছিলেন ।
অনেক মুনাফিক বা কপট মুসলমান এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এ যুদ্ধাভিযানেই মুনাফিকরা আয়েশা (রা)-এর চারিত্রিক নিষ্কলুষতাকে কেন্দ্র করে এক ষড়যন্ত্র পাকায় । তারা আয়েশা (রা)-এর পূত পবিত্র চরিত্রের ওপর নেহায়েত আপত্তিকর মিথ্যা দোষারোপ করে বসে। মূল ঘটনাটি আয়েশা (রা)-এর ভাষ্যে বিভিন্ন হাদীস ও সীরাত গ্রন্থ অবলম্বনে সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে উদ্ধৃত হলো :
আয়েশা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অভ্যাস ছিল দূরে কোথাও সফরে গেলে কুরআ বা লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিতা তাঁর কোন এক পত্নীকে সফর সঙ্গী করতেন। বনূ মুসতালিক যুদ্ধে আমি সফর সঙ্গী নির্বাচিতা হই। এটা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরের ঘটনা। পর্দা রক্ষার জন্য আমাকে হাওদাসহ উটের পিঠে উঠানো-নামানো হতো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাতে মদীনার নিকটস্থ কোন এক স্থানে তাঁবু গেড়ে অবস্থান করেন।
রাতের শেষাংশে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ আসে। আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য বাইরে যাই । প্রয়োজন সেরে সাওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখি, আমার গলার হার হারিয়ে গিয়েছে। আবার ফিরে গিয়ে তা খুঁজতে শুরু করি। এতে বেশ দেরী হয়ে যায়। আমি হাওদার (অর্থাৎ পালকির মতো) মধ্যে আছি ভেবে লোকেরা সাওয়ারীর পিঠে হাওদা উঠিয়ে দেয়। তারা মনে করেছিল আমি হাওদার মধ্যে আছি, যেহেতু আমি চিকন ও হালকা ছিলাম সেহেতু তারা তা বুঝতে পারেনি। ঐ সময়ে খাদ্যাভাবের কারণে আমরা মেয়েরা ছিলাম খুবই হালকা-পাতলা ।
সৈন্যবাহিনী রওয়ানা হওয়ার পর আমি হার খুঁজে পেলাম এবং ফিরে এসে দেখি সেখানে কেউ নেই। মনে করলাম তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার সন্ধানে ফিরে আসবে। কাজেই যে স্থানে আমি ছিলাম সেখানে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে পড়লাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম। বনু সালাম গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল পিছনে ছিলেন। প্রত্যুষে তিনি আমার অবস্থান স্থলের নিকট পৌঁছে নিদ্রাবস্থায় দেখে আমায় চিনে ফেলেন এবং ইন্নালিল্লাহ পড়লেন । তাঁর আওয়াজ শুনে আমি জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর শপথ। আমাদের মধ্যে কোন কথাবার্তাই হয়নি।
তিনি সাওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং সাওয়ারীকে বসিয়ে তার পা কষে বাঁধলে আমি তাতে আরোহণ করলাম। তিনি লাগাম ধরে হেটে চললেন। প্রায় দুপুরের সময় আমরা কাফেলাকে ধরলাম। তখন তাঁরা বিশ্রামের জন্য একটি স্থানে কেবলমাত্র থেমেছেন। আমি যে পিছনে রয়ে গেছি এ কথা তাঁদের কারো এখনো জানা হয়নি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার ওপর মিথ্যা অপবাদ রটানো হলো। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল এ অপপ্রচারের অগ্রনায়ক। এছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে হাসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ, ইবনে উসামাহ এবং হামনা বিনত জাহাশও এতে জড়িয়ে পড়েন ।
আয়েশা (রা) বলেন : মদীনায় পৌঁছে আমি এক মাস যাবৎ অসুস্থ ছিলাম । এদিকে অপবাদের বিষয় নিয়ে লোকজনের মধ্যে কানা-ঘুষা হতে লাগল। কিন্তু এসবের আমি কিছুই জানতাম না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা দৃঢ় হচ্ছিল এ কারণে যে, আমার অসুস্থতার সময় পূর্বে রাসূল (সাঃ) যেভাবে আমার দেখাশুনা করতেন এবার তা করছেন না। বরং এবার “আমি কেমন আছি”? জিজ্ঞেস করেই চলে যেতেন। এতে আমার মনে বড় সংশয় সৃষ্টি হলো । ভাবতাম হয়তো কিছু একটা ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) থেকে অনুমতি সাপেক্ষে মায়ের নিকট চলে গেলাম। যাতে তিনি আমার সেবা-শুশ্রূষা ভালোভাবে করতে পারেন।
একদা রাতের বেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলাম। তখন আমরা সাধারণ আরববাসীদের অভ্যাসমত পায়খানার জন্য এলাকার বাইরে মাঠে বা ঝোপ-ঝাড়ে চলে যেতাম। ‘উম্মু মিসতাহ্’ ঐ রাতে আমার সাথে গিয়েছিল। কাজ সেরে ফেরার পথে উম্মু মিসতাহ্ পায়ে কাপড় জড়িয়ে পড়ে গিয়ে বলে উঠলেন, মিসতাহ্ ধ্বংস হোক। আমি বললাম, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নিজ পুত্রের ব্যাপারে একি বলছ? সে বলল মিসতাহ তোমার সম্পর্কে কী বলে বেড়াচ্ছে, তাতো তুমি শোননি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকারীদের কার্যকলাপ ও প্রচারণা সম্পর্কে আমায় অবহিত করলেন। এ ঘটনা শুনে আমার রক্ত যেন শুকিয়ে গেল। সোজা ঘরে ফিরে এসে সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটালাম।
উম্মু মিসতাহ্ হলেন আবূ রুহম ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে আবদ মানাফের কন্যা। তার মা ছিলেন আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর খালা সাখার ইবনে আমরের কন্যা। তার পুত্র মিসতাহর পিতা ছিলেন আসাসা ইবনে আদ ইবনুল মুত্তালিব।
এ দিকে ওহী আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে রাসূলুল্লাহ আল তাঁর পত্নী বিচ্ছেদের ব্যাপারে পরামর্শ চেয়ে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়েদ (রা)-কে ডেকে পাঠালেন। উসামা আয়েশা (রা)-এর পবিত্রতার বিষয়ে দৃঢ় মনোবল হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আপনার স্ত্রী (আয়েশা) সম্পর্কে আমি ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানি না। আপনি তাঁকে নিজের কাছেই রাখুন । আলী (রাঃ) বললেন, হে নবী! আল্লাহ তো আপনার সংকীর্ণতা রাখেননি। তিনি ছাড়া তো আরো বহু মেয়ে সমাজে আছে। তবে আপনি দাসী বারীরাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। সে আপনাকে সত্য কথাই বলবে।
নবী মা বারীরাকে ডেকে বললেন, তুমি কি আয়েশার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু দেখেছ? বারীরা বলল, সে সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, আমি তাঁর মাঝে খারাপ বা আপত্তিকর কিছু লক্ষ্য করিনি। তবে তিনি অল্প বয়স্ক কিশোরী হওয়ার কারণে শুধু এতটুকু দোষ দেখেছি যে, রুটি তৈরি করার জন্য আটা খামীর করে রেখে তিনি মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন, আর বকরী এসে তা খেয়ে ফেলতো ।
সে দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে সাহাবীগণ! তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে আমার স্ত্রীর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমায় যে কষ্ট দিয়েছে তার আক্রমণ থেকে আমায় রক্ষা করতে পারে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রীদের মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাইনি। একথা শুনে উসাইদ ইবনে হুদাইর মতান্তরে সা’দ ইবনে মু’আয (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অভিযোগকারী যদি আমাদের বংশের লোক হয়ে থাকে, তবে আমরা তাকে হত্যা করবো আর আমাদের ভ্রাতা খাযরাজ গোত্রের লোক হলে আপনি যা বলবেন তাই করবো।
এ কথা শুনেই খাযরাজ গোত্র নেতা সা’দ ইবনে উবাদা দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো, কিছুতেই তাকে তুমি মারতে পারবে না। সে খাযরাজ গোত্রভুক্ত বলেই তুমি তাকে হত্যা করার কথা বলছো। সে তোমাদের গোত্রের হলে কখনই তাকে হত্যা করার কথা বলতে না । উত্তরে তাকে বলা হলো, তুমি তো মুনাফিক, এ জন্য মুনাফিকদের সমর্থন দিচ্ছ। এরূপ কথা কাটাকাটির দরুণ মসজিদে নববীতে গোলযোগের সৃষ্টি হলো। আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা মসজিদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নবী (সাঃ) তাদেরকে বুঝিয়ে শাস্ত করেন। একমাস ব্যাপী এ মিথ্যা দোষারোপের কথা সমাজে পর্যালোচনার বস্তুতে পরিণত হলো। রাসূল (সাঃ) মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত হলেন।
আমি অবিরাম কাঁদতে লাগলাম। আমার পিতা-মাতাও খুব উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে কালাতিপাত করছিলেন। শেষে নবী করীম (সাঃ) একদিন আমার পাশে এসে বসলেন। আমার পিতা-মাতা ভাবলেন, আজ হয়ত কোন সিদ্ধান্তমূলক রায় হয়ে যাবে। এ কারণে তাঁরাও কাছে এসে বসলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : হে আয়েশা (রা)! তোমার সম্পর্কে উত্থাপিত অপবাদ-অভিযোগ আমার কানে পৌঁছেছে। তুমি যদি নির্দোষী হয়ে থাক, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রকাশ ও প্রমাণ করে দেবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে আল্লাহর নিকট তাওবা করে ক্ষমা চাও, অপরাধী যখন অপরাধ স্বীকার করে তাওবা করে, আল্লাহ তখন ক্ষমা করে দেন ।
এ কথা শুনে, আমি হত-বিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। বাবা-মাকে বললাম, আপনারা রাসূলের কথার উত্তর দিন। তাঁরা বললেন, কি বলে যে উত্তর দিব তা আমাদের বুঝে আসছে না। তখন আমি বললাম, আপনাদের কানে একটা কথা এসে তা বিশ্বাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এখন যদি আমি নির্দোষ বলে প্রলাপ করি তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি শুধু শুধুই এমন একটি অন্যায় কর্মকে স্বীকার করে নেই, যার সাথে আদৌ আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, আল্লাহ জানেন যে, আমি নির্দোষ তবে আপনারাও তা সত্য বলে মেনে নিবেন। আমি তখন ইয়াকূব (আ)-এর নামটি স্মরণের চেষ্টা করলাম, কিন্তু তা স্মৃতিতে এলো না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, এ পর্যায়ে আমি ঐ কথাই বলব, যা ইউসুফ (আ)-এর পিতা বলেছেন। তা হলো : فَصَبْرٌ جَمِيلٌ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ .
অর্থ: “এখন ধৈর্যধারণ করাই উত্তম পন্থা, আর তোমরা যা কিছু বলেছ, সে ব্যাপারে আল্লাহই একমাত্র সহায়”। [১২-ইউসুফ : ১৮]
এ কথা বলে আমি অপর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহ আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। নিশ্চয়ই তিনি প্রকৃত সত্য উম্মোচন করে দিবেন। ‘আমার বিষয়ে আল্লাহ কোন আয়াত নাযিল করবেন নিজেকে আমি এতখানি যোগ্য মনে করিনি, বরং আমি এতটুকু আশা করেছি যে স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সাঃ) কে আমার পবিত্রতা সম্পর্কে হয়ত জানিয়ে দিবেন। আল্লাহর শপথ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখনও তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠেননি এবং বাড়ির কোন লোকও তখন বাইরে যায়নি, এমন সময় নবী (সাঃ) এর ওপর ওহী নাযিল হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হলো, তীব্র শীতের মধ্যে তাঁর চেহারা হতে টপ টপ করে ঘামের ফোটা পড়তে লাগল। আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি সম্পূর্ণ নিৰ্ভয় ছিলাম, কিন্তু আমার পিতা-মাতা অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ওহী অবতরণের অবস্থা শেষ হয়ে গেল রাসূল (সাঃ) কে অত্যন্ত প্রফুল্ল মনে হলো । তিনি হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় প্রথমেই বললেন, হে আয়েশা! তোমার সুসংবাদ। আল্লাহ তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করে ওহী নাযিল করেছেন। অত:পর তিনি সূরা নূর এর ১১ নং আয়াত থেকে ২১ নং আয়াত পর্যন্ত পাঠ করে শুনালেন ।
১. ইরশাদ হচ্ছে, যারা মিথ্যা অপবাদ রচনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল । এ অপবাদকে তোমরা নিজেদের জন্য অমঙ্গল মনে করো না । বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে কৃত পাপ কর্মের ফল। আর তাদের মাঝে যে এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি ।
২. এ কথা শুনার পর বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেননি? এবং বলেনি যে এটা মিথ্যা অপবাদ ।
৩. তারা কেন চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? এজন্য তারা আল্লাহর বিধান মতো মিথ্যাবাদী।
৪. ইহলোক ও পরলোকে তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে নিমগ্ন ছিলে তজ্জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত ।
৫. যখন তোমরা মুখে মুখে তা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয়ে মুখ খুলছিলে যে সম্পর্কে তোমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না, আর তোমরা একে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলে, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ছিল গুরুতর বিষয় ।
৬. আর তোমরা তা শ্রবণ করলে, তখন কেন বললে না, এ বিষয়ে তোমাদের বলাবলি করা উচিত নয় । আল্লাহ পবিত্র ও মহান। এ এক জঘন্য অপবাদ ।
৭. আল্লাহ তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি বিশ্বাসী হও তবে কখনো এরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করো না ৷
৮. আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও বিজ্ঞানময় ।
৯. যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে ইহলোক ও পরলোকে কঠোর শাস্তি । আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জান না ।
১০. তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউ অব্যাহতি পেত না এবং আল্লাহ্ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।
১১. হে মু’মিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । কেহ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয় । আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউ কখনো পবিত্র হতে পারতে না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করে থাকেন এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (সূরা আন নূর : আয়াত-১১-২১)
আয়েশা (রা) বললেন, মা তখন আমাকে বললেন ওঠো মা, রাসূলুল্লাহ (সা:) এর শুকরিয়া আদায় কর। আমি বললাম, রাসূল (সাঃ)-এর শুকরিয়া আদায় করবো না। আমি তো সেই মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল করেছেন। আপনারা তো এ বানোয়াট অপবাদ ও অভিযোগকে মিথ্যা ঘোষণা করেননি। (বুখারী)
এ ওহী নাযিলের পর মু’মিনদের মনে শান্তি ফিরে এল। রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে অপবাদকারী তিনজন মুনাফিক প্রত্যেককে আশিটি করে দোররা মারা হল । কিন্তু মূল আসামী আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি না দিয়ে রাসূল (সাঃ) তার বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলেন ।
ইফক এর এ ঘটনাকে পুঁজি করে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী একটা মহল আয়েশা (রা) এর বিষয়ে সমালোচনার অপপ্রয়াস চালানোর চেষ্টা করেছে। অথচ আল্লাহ প্রদত্ত আয়েশা (রা)-এর চারিত্রিক সনদ এলে তাদের মিশন প্রাথমিক পর্যায়েই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আল্লাহর কোন কাজ-ই অন্তসার শূন্য নয়, বরং সবকিছুর পশ্চাতেই একটা উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। ইফক এর এ ঘটনা অবতারণের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো বিশ্ব নারী জাতিকে সকল বিপদে দৃঢ়তা অবলম্বন ও ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দেয়া।
এ ঘটনাটি ইফকের বা অপবাদ আরোপের ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে ।
ইফকের ঘটনার মাত্র তিন মাস পর ‘জাতুল জ্বায়েশ’ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) গমন করেন। এবারও আয়েশা রাসূল (সাঃ)-এর সফর সঙ্গী হন এবং তাঁর হারটি হারিয়ে যায়। বিষয়টি তিনি তৎক্ষণাৎ রাসূল (সাঃ) কে জানান। ফলে রাসূল (সাঃ) যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। হার খুঁজতে খুঁজতে ফজরের ওয়াক্ত প্ৰায় যায় যায় অবস্থা। এদিকে কাফেলার সাথে এক ফোঁটাও পানি ছিল না। কীভাবে সালাত আদায় করা হবে এ ব্যাপারে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ।
আবূ বকর (রা) যথারীতি এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনি বুঝলেন আয়েশার জন্য এ অবস্থা । তাই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে রাসূল (সাঃ) এর তাঁবুতে গেলেন । রাগত কণ্ঠে বললেন, “আয়েশা! এ কি তোমার আচরণ? তোমার হারের জন্য সমগ্ৰ কাফেলার লোকজন এক চরম বিপদের সম্মুখীন। অযু গোসলের জন্য এক বিন্দু পানিও নেই। এখন লোকজন কেমন করে ফজরের সালাত আদায় করবে? বারে বারে তুমি আমাদেরকে এ কি সমস্যায় ফেলে চলেছ?
আয়েশা (রা) টু শব্দটি পর্যন্তও করলেন না। কারণ রাসূল (সাঃ) তখন তাঁর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজেছিলেন । তিনি মনে মনে শুধু আল্লাহর সাহায্য চাইলেন । এ সময় রাসূল (সাঃ) এর নিকট ওহী নাযিল হলো-
وَإِنْ كُنْتُمْ مُرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْجَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لمَسْتُمُ النِّسَاء فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمُمُوا صَعِيدًا طَيِّبَا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ، إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوا غَفُورًا .
“আর যদি তোমরা পীড়িত হও কিংবা বিদেশ ভ্রমণে থাক, কিংবা তোমাদের কেউ শৌচাগার হতে ফিরে আসে, কিংবা স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এমতাবস্থায় পানি পাওয়া না গেলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম কর। হস্তদ্বয় ও মুখমণ্ডল মাসেহ কর, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী।” (সূরা নিসা : আয়াত-৪৩)
তায়াম্মুমের হুকুম নাযিল হওয়ায় উপস্থিত সবাই খুব খুশি হয়ে আয়েশা (রা) ও আবূ বকর (রা)-এর প্রশংসা করতে লাগল। রাসূল (সাঃ) ও খুশি মনে সকলকে নিয়ে তায়াম্মুম করে জামা’আতের সাথে ফজর সালাত আদায় করলেন। সালাত শেষে যাত্রা করার উদ্দেশ্যে আয়েশা (রা)-কে বহনকারী উট উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেল তাঁর হার সেখানে পড়ে আছে। হার পাওয়াতে আবূ বকর (রা) নিজ কন্যার কাছে এসে বললেন, মা আয়েশা! আমি জানতাম না তুমি এতই পুণ্যবতী। তোমাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা’আলা উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি যে রহমতের ধারা বর্ষণ করেছেন, তার জন্য হাজারো শোকর। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘায়ু দান করুন ।
২. ঈলার ঘটনা!
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর স্ত্রীদের জন্য খাদ্য ও খেজুরের যে পরিমাণ ছিল, প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল নেহায়েত অপ্রতুল। তাঁরা অভাবের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন । এদিকে ৯ম হিজরী বা আহযাব ও বনু কুরায়জার সমসাময়িককালে আরবের দূর-দূরান্তে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের পর যুদ্ধ বিজয়, বার্ষিক আমদানী বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত গনীমতের মাল সঞ্চয় হতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে অর্থ-সম্পদের আধিক্য দেখে তাঁরা (নবী পত্নীগণ) সমস্বরে তাঁদের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানালো। আবূ বকর সিদ্দীক (রা) ও ওমর (রা) তাঁদের কন্যাদ্বয় যথাক্রমে আয়েশা ও হাফসা (রা)-কে বুঝিয়ে এ দাবী থেকে বিরত রাখেন।
অপরদিকে অন্যান্য স্ত্রীগণ তাঁদের দাবির ওপর অটল থাকলেন। ঘটনাক্রমে এ . সময় মহানবী (সাঃ) ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং পাজরে গাছের একটি মূলের সাথে ধাক্কা লেগে আঘাতপ্রাপ্ত হন। (সুনানে আবু দাউদ) স্ত্রীদের এ দাবীতে তিনি অসন্তুষ্ট হন। আয়েশা (রা)-এর হুজরা সংলগ্ন ‘আল-মাশরাবা’ নামক গৃহে অবস্থান নেন এবং এক মাস পর্যন্ত কোন স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার কসম বা শপথ করেন। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কুচক্রী মুনাফিকরা সমাজে রটিয়ে দেয় যে, রাসূল (সাঃ) তাঁর স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়েছেন। এ কথা শুনে সাহাবীগণ অস্থির হয়ে পড়েন। তাঁরা মসজিদে নববীতে সমবেত হন। রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীগণ অত্যন্ত বিমর্ষ ও চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু কেউই রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত যাওয়ার সাহস করলেন না।
ওমর (রা) মসজিদে নববীতে এসে ব্যথাতুর অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। দু’বার সাড়া না পেয়ে তৃতীয় বারের মাথায় অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন মহানবী (সাঃ) একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন, তাঁর শরীর মুবারকে মোটা কম্বলের দাগ পড়ে গেছে । ওমর (রা) ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন সেখানে কয়েকটি মাটির পাত্র ও শুকনো মশক বৈ কিছুই নেই। এ দৃশ্য দেখে ওমর (রা)-এর চক্ষু অশ্রু সিক্ত হয়ে পড়ল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) আপনি কি আপনার স্ত্রীদেরকে তালাক দিবেন? নবী (সাঃ) বলেলন, না। ওমর (রা) এ সুসংবাদ লোকদের কে শুনিয়ে দিলেন । ফলে সকল মুসলমান এবং নবী পত্নীগণ চিন্তামুক্ত হন।
আয়েশা (রা) বলেন, আমি এক এক করে দিন গুণতে ছিলাম। ২৯ দিন পূর্ণ হলে নবী (সাঃ) সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সর্বপ্রথম আমার গৃহে আগমন করেন। আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো এক মাসের শপথ করেছিলেন, আজতো ঊনত্রিশ দিন হয়েছে। নবী (সাঃ) বলেলেন : মাস ঊনত্রিশ দিনেও হয়। (মুসলিম)
৩. তাখাইয়্যিরের ঘটনা!
ঈলার ঘটনার পর তাখাইয়্যিরের ঘটনা ঘটে। তাখঈর অর্থ ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা দান করা। পার্থিব ভোগ-বিলাসিতা দ্বারা নিজেকে কুলষিত করতে একদিকে যেমন নবী নারাজ ছিলেন অন্যদিকে তাঁর স্ত্রীগণ জীবন যাপনের মান বৃদ্ধির জন্য দাবি জানিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন : এ ঘটনা থেকে মুসলিম নারী সমাজ দাম্পত্য জীবনে ধৈর্যধারণ ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার শিক্ষা পান ৷
وَ اِنۡ كُنۡـتُنَّ تُرِدۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ فَاِنَّ اللّٰهَ اَعَدَّ لِلۡمُحۡسِنٰتِ مِنۡكُنَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا
“হে নবী! আপনি স্ত্রীদেরকে বলুন, তোমরা যদি দুনিয়া ও তার চাকচিক্য পেতে চাও তবে এসো, আমি তোমাদেরকে কিছু দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখিরাতের গৃহ ভালো মনে কর, তবে তোমাদের মধ্যে যে নেককার তাঁর জন্য আল্লাহ বিরাট পুরস্কার ঠিক করে রেখেছেন”। (সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-২৯)
অর্থাৎ আয়াতটির মূল বক্তব্য হলো : নবী পত্নীদের মধ্যে যার ইচ্ছা দরিদ্র ও অভাব-অনটন মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূলের সাথে সংসার ধর্ম পালন করতে পারেন। আর যার ইচ্ছা তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন।
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম আয়েশা (রা)-এর কাছে এসে বললেন, আজ তোমাকে একটি কথা বলছি, খুব তাড়াতাড়ি করে উত্তর না দিয়ে তোমার পিতা-মাতার সাথে জেনে স্থিরভাবে উত্তর দেবে। অতঃপর নবী (সাঃ) উপরিউল্লিখিত আয়াতটি তাঁকে পাঠ করে শুনালেন এবং বললেন, আল্লাহর নিকট থেকে এ হুকুম এসেছে। তৎক্ষণাৎ আয়েশা (রা) বললেন : এ বিষয়ে আমার বাবা-মার নিকট কি জিজ্ঞেস করবো? আমি তো আল্লাহ, তদীয় রাসূল এবং পরকালের সাফল্যই প্রত্যাশী।
আয়েশা (রা)-এর এ উত্তর শুনে নবী (সাঃ) অত্যন্ত খুশী হলেন। তিনি বললেন, বিষয়টি তোমার নিকট যেভাবে উপস্থাপন করেছি, ঠিক সেভাবে অন্য স্ত্রীদের নিকটেও করবো। আয়েশা (রা) তাঁর সিদ্ধান্তের কথা কাউকে না জানাতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু নবী তা রাখেন নি। তিনি বরং তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের নিকট আয়েশা (রা)-এর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। (বুখারী) তাঁদের প্রত্যেকেই আয়েশা (রা)-এর মত একই উত্তর দেন। আলোচ্য আয়াত নাযিলের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ৪ জন (সাওদা, আয়েশা, হাফসা ও উম্মু সালামা) মতান্তরে ৯ জন (বাকি ৬ জন উন্মু হাবিবা, সাফিয়া, মায়মুনা, জুআইরিয়া, যয়নব বিনতে জাহাশ) স্ত্রী ছিলেন ।
৪. তাহরীমের ঘটনা (হারাম করা ) আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) মধু খুব পছন্দ করতেন। এ জন্য যয়নাব (রা) তাঁকে প্রায়ই মধুর শরবত তৈরি করে দিতেন। কিন্তু একদিন আছরের পর রাসূল (সাঃ) যয়নব ঘর থেকে মধু খেয়ে বের হয়ে আয়েশা (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করলে আয়েশা ও হাফসা বললেন, হে রাসূল! আপনার মুখে “মাগাফীর” নামক এক প্রকার দূর্গন্ধ ফলের গন্ধ আসছে। বিষয়টি আয়েশা (রা) সহ অন্যান্য নবী পত্নীদের পছন্দনীয় ছিল না। রাসূল (সা:) যখন ব্যাপারটি আঁচ করলেন, তখন তিনি আর মধু খাবেন না বলে কসম করলেন।
মহান রাব্বুল আলামীন কিন্তু তাঁর হাবীবের এ কাজটি পছন্দ করলেন না । সাথে সাথে ওহী নাযিল হল, হে প্ৰিয় নবী-
“আল্লাহ যা কিছু আপনার জন্য বৈধ করেছেন, স্বীয় স্ত্রীদের প্ররোচনায় তাদের মনস্তুষ্টির জন্য হালাল বিষয়কে আপনি অবৈধ বা হারাম বলে অভিহিত কেন করলেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আর আল্লাহ আপনার কসম ভঙ্গ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা হবে আইনসঙ্গত। আল্লাহ আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত।” (সূরা তাহরীম : আয়াত-১-২)
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) তিনি আবার মধু পান করা শুরু করলেন । (তারপর রাসূল (সাঃ) কসমের কাফফারা আদায় করেন) আয়েশা ও হাফসাসহ অন্যান্য নবীপত্নীগণ এ বিষয়ে রাসূল -এর নিকট ক্ষমা চাইলেন। তিনি সকলকে ক্ষমা করে দিলেন। এ ঘটনা ‘তাহরীম‘ এর ঘটনা হিসেবে পরিচিত। যেহেতু এ ঘটনা বহুলাংশে হাফসা (রা)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই তাঁর সম্পর্কে আলোচনার স্থানে এ বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে। আয়েশা (রা)-এর জীবনে সংঘটিত উপরিউক্ত প্রতিটি ঘটনাই প্রকারান্তে তাঁর ইযযত ও সম্মান বৃদ্ধি করেছে। যা গোটা মানব জাতিকে বহুবিদ কল্যাণের পথ দেখিয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা) ছিলেন বিশ্ব নারী জাতির জন্য গর্ব, আদর্শ ও আলোকবর্তিকা স্বরূপ।
সচেতন আয়েশা : আয়েশা (রা) অন্ধ অনুকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি সবকিছু যাচাই- বাছাই করে তারপর গ্রহণ করতেন। রাসূল (সাঃ) এর সময়ে মেয়েরা মসজিদে গিয়ে পুরুষদের পেছনে সালাত আদায়ের অনুমতি ছিল। কিন্তু রাসূল সালাম-এর ইন্তেকালের পর তৎকালীন সময়ের মেয়েদের চলাফেরা দেখে আয়েশা (রা) বেশ রাগের সাথে বলেছিলেন, ‘রাসূল (সাঃ) যদি জানতেন, নারীদের কি দশা হবে, তা হলে তিনি বনী ইসরাঈলের মতো নারীদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন।’
কা’বা শরীফের চাবিধারী ওসমান (রা) একবার এসে আয়েশা (রা)-কে বললেন, ‘কা’বা শরীফের গেলাফ নামানোর পর তা দাফন করা হয়েছে। যেন মানুষের নাপাক হাত তা স্পর্শ করতে না পারে।’ আয়েশা (রা) বললেন, ‘এটাতো কোন যুক্তিযুক্ত কথা হলো না। গেলাফ খুলে ফেলার পর যার ইচ্ছে তা ব্যবহার করতে পারে। তুমি তা বিক্রি করে গরীব-দুঃখীদের মধ্যে তার মূল্য বিতরণ করে দাও না কেন?’
আয়েশার প্রতি রাসূল(সাঃ) এর ভালোবাসা : আয়েশা (রাঃ) সে সৌভাগ্যবান উন্মাহাতুল মু’মিনীন যার কোলে মাথা রেখে রাসূল (সাঃ)ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব থেকে অসুস্থাবস্থায় নবী করীম (সাঃ) আয়েশার গৃহেই ছিলেন, এমন কি তাঁর গৃহেই রাসূল (সাঃ) কে দাফন করা হয়। পরবর্তীকালে আবূ বকর (রা.) ও ওমর (রা)-কেও রাসূল (সা:) এর পাশে অর্থাৎ আয়েশার গৃহে দাফন করা হয় ।
আসলে রাসূল (সাঃ) অন্যান্যদের তুলনায় আয়েশা (রা)-কে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! যা কিছু আমার আয়ত্তাধীন, (অর্থাৎ স্ত্রীদের মধ্যে সাম্য বজায় রাখা) সে ক্ষেত্রে ইনসাফ থেকে যেন আমি বিরত না থাকি, আর যা আমার আয়ত্তের বাইরে (অর্থাৎ আয়েশার মর্যাদা ও ভালোবাসা) তা ক্ষমা করে দাও। (আবূ দাউদ)।
আমর ইবনুল আস (রা) নবীজীকে জিজ্ঞেস করেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) দুনিয়ায় আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? রাসূল (সাঃ) বললেন, আয়েশা । তিনি বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি পুরুষদের মধ্যে কে সবচেয়ে প্রিয়। জবাব দিলেন, আয়েশার পিতা অর্থাৎ আবূ বকর (রা)।’
আয়েশা (রা)ও প্রাণ দিয়ে রাসূল (সা:)-কে ভালোবাসতেন। নবীজী ইন্তেকালের সময় যে পোশাক পরিহিত ছিলেন পরবর্তীকালে আয়েশা তা যত্ন সহকারে হেফাযত করেন। একদিন তিনি জনৈক সাহাবাকে নবীজীর কম্বল ও তহবন্দ (লুঙ্গি জাতীয়) দেখিয়ে বলেন, ‘খোদার কসম, এ কাপড় পরিধান করে রাসূল (সাঃ) ইন্তেকাল করেছেন।’ জীবনের শুরুতেই আয়েশা (রা) বিধবা হন, এরপর তিনি ৪৮ বছর জীবিত ছিলেন। এ ৪৮ বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে রাসূলের রেখে যাওয়া কাজের তদারকি করেছেন।
রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর আবূ বকর (রা)-এর খেলাফাতকে স্বীকার করে বাই‘আতকালে নবী পত্নীগণ উসমানের মাধ্যমে মীরাছি দাবি করার উদ্যোগ নিলে আয়েশা (রা) সকলকে স্মরণ করে দিয়ে বলেন, ‘রাসূল বলে গেছেন, কেউ আমার ওয়ারিশ হবে না। আমার রেখে যাওয়া জিনিস হবে ছদকা। ‘
আয়েশা (রা) পোশাক পরিচ্ছদ পরার ব্যাপারে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতেন। একবার তাঁর ভাইঝি হাফছা বিনতে আবদুর রহমান পাতলা ওড়না পরে তাঁর সামনে আসলে তিনি ওড়নাটি ছুড়ে ফেলে বলেন, ‘সূরা নূর-এ আল্লাহ তা’আলা কি বলছেন, তুমি কি পড়নি?’ এরপর একটা মোটা কাপড়ের ওড়না তাকে দেন ৷ আয়েশা (রা) কোনো এক বাড়িতে একবার বেড়াতে যান। সেখানে বাড়ির মালিকের দু’জন মেয়েকে চাদর ছাড়াই সালাত পড়তে দেখে বলেন, ‘আগামীতে বিনা চাদরে কখনো সালাত পড়বে না।’
পরামর্শক আয়েশা (রা): আবূ বকর (রা)-এর আমল থেকে আয়েশা (রা) বিভিন্ন জটিল বিষয়ে সাহাবাদেরকে পরামর্শ দিতেন। এ সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর হাদীস বর্ণনা করতে থাকেন এবং ফতোয়া দেয়া শুরু করেন।
ওমর (রা)-এর শাসনামলে যখন তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনাপতির পদ থেকে পদচ্যুত করেন, তখন এ সংবাদ পাওয়ার পর আয়েশা (রা) খলিফাকে পরামর্শ দেন খালিদকে সাধারণ সৈনিক হিসেবে রাখার জন্য। তা না হলে বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে বলে তিনি আংশকা করছিলেন। ওমর (রা) মা আয়েশার কথা অনুযায়ী কাজ করেন।
মিসর অভিযানে আমর ইবনুল আস যখন সুবিধা করতে পারছিলেন না, তখন আয়েশা (রা) ওমর (রা)-কে তাড়াতাড়ি জোবায়েরের নেতৃত্বে নতুন সৈন্য বাহিনী মিসরে পাঠানোর পরামর্শ দেন। খলিফা সে অনুযায়ী কাজ করলেন। ফলে অল্পদিনেই মিসর মুসলমানদের পদানত হয় ।
ইরাক বিজয়ের পর গণীমতের মালের মধ্যে এক কৌটা মণি-মুক্তা পাওয়া যায় । রাসূল (সাঃ)- এর প্রিয় স্ত্রী হিসেবে আয়েশা (রা) বলেন, ‘রাসূল (সাঃ)-এর পর খাত্তাবের পুত্র ওমর আমার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করছেন। হে আল্লাহ! তাঁর দানের জন্য আগামীতে আমাকে বাঁচিয়ে রেখো না।
ওমর (রা)-এর খিলাফতকালে উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের সকলকে বার্ষিক দশ হাজার দিরহাম বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু আয়েশা (রা)-এর জন্য বার হাজার দিরহাম ধার্য করা হয়। এর কারণ উল্লেখ করে ওমর (রা) বলেন, “ আয়েশা (রা) ছিলেন নবীজীর অতি প্ৰিয়।
মৃত্যুর আগে ওমর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহকে আয়েশা (রা)-এর নিকট পাঠান তাঁর লাশ রাসূল (সাঃ)-এর পাশে দাফন করার অনুমতির জন্য। আবেদন পেশ করলে আয়েশা (রা) বলেন, ‘স্থানটি আমার নিজের জন্য রাখলেও ওমরের জন্য তা আনন্দের সাথে ত্যাগ করছি।’
আয়েশা (রা)-এর অনুমতি পাওয়ার পরও ওমর (রা) ওছিয়াত করে যান, ‘আমার মৃতদেহ আস্তানার সামনে রাখবে। অনুমতি পাওয়া গেলে ভেতরে দাফন করবে, অন্যথায় সাধারণ মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করবে।’ সে অনুযায়ী কাজ করা হয়। আয়েশা (রা)-এর অনুমতি পাওয়ার পর হুজরার ভেতর ওমর (রা)-এর লাশ দাফন করা হয়।
ওসমান (রা)-এর খিলাফতকালে বিভিন্ন বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর নিকট থেকে যুক্তি পরামর্শ গ্রহণ করা হতো এবং সে অনুযায়ী কাজ করা হতো। তাঁর সময়ের প্রথম দিকে রাজ্যে হট্টগোল দেখা দিলে মুহাম্মদ বিন আবূ বকরসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ খলিফার পদত্যাগের দাবি নিয়ে আয়েশার কাছে আসেন। আয়েশা (রা) বলেন, “না, তা হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, যদি ওসমানের হাতে খেলাফতের দায়িত্ব আসে তাহলে সে যেন তা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ না করে।’
ওসমান (রা)-এর খেলাফাতের শেষ দিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে দুঃশাসনের অভিযোগ উঠলে আয়েশা (রা)-এর পরামর্শ অনুযায়ী তাদেরকে রাজধানীতে তলব করা হয় এবং গভর্নরদের পেশকৃত দলিল-দস্তাবেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে। এ তদন্ত কমিটিও আয়েশা (রা)-এর পরামর্শে গঠিত হয়।
ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই মুনাফিকরা আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছিল। ওসমান (রা)-এর সময়ে এসে তারা খুবই সুকৌশলে কাজ শুরু করে এবং ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ফলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে । আলী (রা) এমনি এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের খলীফা হন। খিলাফাত প্রাপ্তির পর পরই তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় ওসমান হত্যার বিচার করার জন্য ।
কিন্তু ঘটনা এমন ছিল যে, হত্যাকারী কে বা কারা তা সঠিক করে কেউ জানতো না। ওসমান (রা)-এর স্ত্রী নাইলা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কাউকে চিনতে পারেননি। ফলে কাউকে সাজা দেয়া যাচ্ছিল না। চক্রান্তকারীরা এ সুযোগটিই গ্রহণ করল। তাদের প্ররোচনায় কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবাও ওসমান হত্যার বিচার দাবি করলেন। এদের মধ্যে আয়েশা, তালহা ও যুবাইর (রা)-এর মতো লোকও ছিলেন। তাঁরা আয়েশার নেতৃত্বে মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন, সেখানে ওসমান হত্যার বিচার দাবিকারীদের সংখ্যা ছিল বেশি। এহেন সংবাদে আলী (রা) সেনাদলসহ সেখানে পৌছান এবং দু’বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। যেহেতু উভয়পক্ষ সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, ফলে আলাপ আলোচনার পর বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় ।
কিন্তু চক্রান্তকারীরা এ ধরনের পরিস্থিতির পক্ষে ছিল না। তাই তারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাতের আধারে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ চালায়, আর প্রচার করতে থাকে যে অপর পক্ষ সন্ধির সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে। এতে যুদ্ধ বেধে যায় এবং আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। উভয়পক্ষে প্রচুর শহীদ হন। শেষ পর্যন্ত আলী জয়লাভ করেন এবং আয়েশা (রা)-কে সসম্মানে মদীনা পাঠিয়ে দেন।
এ যুদ্ধে আয়েশা (রা) উটে আরোহণ করে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন বলে ইতিহাসে এটা জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত ।
আয়েশা (রা)-এর বদান্যতা : আমীর মু’আবিয়ার শাসনামলে আয়েশা (রা)-এর খেদমতে তিনি এক লক্ষ দিরহাম উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। আয়েশা (রা) ঐদিন সন্ধ্যার আগেই পুরো এক লক্ষ দিরহাম গরীব মিসকীনদের মধ্যে দান করে দিলেন। ঐদিন তিনি রোযা ছিলেন। কিন্তু তিনি ইফতার করার জন্যেও কিছু রাখেন নি। তাই তার দাসী আরজ করলো, ‘ইফতারের জন্য তো কিছু রাখা প্রয়োজন ছিল।’ উত্তরে আয়েশা (রা) বললেন, ‘মা! তোমার এ বিষয়ে পূর্বে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত ছিল।’
আয়েশা (রা)-এর বৈশিষ্ট্য : আয়েশা (রা) অনেক ক্ষেত্রে অনেকের চেয়ে বিশিষ্ট ছিলেন। উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের মধ্যে তাঁর ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি নিজেই বলেন, ‘এটি আমার অহংকার নয়, বরঞ্চ প্রকৃত ঘটনা এই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনেকগুলো কারণে দুনিয়ার সকলের চেয়ে আমাকে বিশেষভাবে সম্মানিতা করেছেন। তারই কথা—
১. আমার বিবাহের পূর্বে আমার ছবি ফেরেশ্তাগণ রাসূলুল্লাহর সামনে রেখেছিলেন ।
২. যখন আমার ৬/৭ বছর বয়স তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)আমায় বিয়ে করেছিলেন।
৩. ৯/১০/১১ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়িতে পদার্পণ করেছি ।
৪. আমি ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কোন স্ত্রী কুমারী ছিল না।
৫. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আমার নিকট একই বিছানায় থাকতেন তখন প্রায়ই তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো ।
৬. আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলাম ।
৭. আমাকে লক্ষ্য করে সূরা নূরের এবং তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়েছে ।
৮. আমি চর্মচক্ষে দু’বার জিবরাঈল (আ)-কে দেখেছি ।
৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমারই কোলে পবিত্র মাথা রেখে ইন্তেকাল করেছেন।
১০. আমি রাসূল (সাঃ)-এর খলিফার কন্যা এবং সিদ্দিকা। আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে যাদেরকে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকার ওয়াদা দিয়েছেন, আমি তাদেরও অন্যতম ।
আয়েশা (রা) ছিলেন একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষ। কবি হাসসান বিন সাবিত ইফকের জঘন্য অপবাদকারীদের মধ্যে শামিল ছিলেন। তবুও কবি সাবিত যখন আয়েশা (রা)-এর মজলিসে আসতেন তিনি সাদরে তাকে বরণ করে নিতেন। অন্যরা সাবিতের কৃতকর্মের জন্য সমালোচনা ও নিন্দা করলে তিনি বলতেন, ‘তাকে মন্দ বলো না । সে বিধর্মী ও পৌত্তলিক কবিদের কবিতার উত্তর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে প্রদান করতো।’
আয়েশা (রা)-এর ছিল প্রচণ্ড সাহস ও আত্মিক মনোবল। যে কারণে তিনি ওহুদ যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা করতে পেরেছিলেন। তিনি সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে মশক (কলস জাতীয় চামড়ার তৈরি এক প্রকার পানির পাত্র) কাঁধে নিয়ে তৃষ্ণার্তদের পানি পান করিয়েছিলেন। তিনি উষ্ট্রের যুদ্ধের এক পক্ষের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এমনিতেও তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণের প্রবল ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন। রাতের বেলা তিনি একাকী কবরস্থানে গমন করতেন। রাসূল (সাঃ) জীবিত থাকতে তিনি তাঁর সাথে রাতের বেলা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। অধিকাংশ দিন তিনি রোযা রাখতেন ।
ইশরাকের সালাত সম্বন্ধে আয়েশা (রা) নিজে বলেছেন, ‘আমি নবীজীকে কখনো ইশরাকের সালাত পড়তে না দেখলেও আমি নিজে তা পড়ি। তিনি অনেক কিছু পছন্দ করতেন, উম্মতের ওপর ফরয হয়ে যাবে এ আশংকায় তদনুযায়ী আমল করতেন না।’
আয়েশা (রা)-এর পাণ্ডিত্য : আয়েশা (রা)-এর পাণ্ডিত্যের বিবরণ শুনলে অবাক হতে হয়। তিনি কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূল, ইজমা, কিয়াস, সাহিত্য, ইতিহাস, রসায়ন, চিকিৎসা বিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সুপণ্ডিত ছিলেন ৷ তিনি শিক্ষকতা ও বক্তৃতায় পারদর্শী ছিলেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় তাঁর ছাত্র সংখ্যা ছিল কমপক্ষে বার হাজার । এ জন্যই আয়েশা (রা) সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘শরীয়তের অর্ধেক বিদ্যাই তোমরা ঐ রক্তাভ গৌরবর্ণা মহিয়সীর নিকট থেকে শিখতে পারবে । ‘
আবূ মূসা আশ’আরী (রা) বলেন, ‘সাহাবী হিসেবে আমাদের সামনে এমন কোনো কঠিন বিষয় উপস্থিত হয়নি, যা আয়েশাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর কাছে কিছু জানতে পারিনি।’ বিশিষ্ট সাহাবী আবূ সালমা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওফ বলেন, ‘আয়েশার চেয়ে সুন্নাতে নববীর বড় আলেম, দ্বীনের সূক্ষ্মতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ, কালামে মজীদের আয়াতের শানে নুযূল এবং ফারায়েয সম্পর্কে বেশি জ্ঞানের অধিকারী আর কাউকে দেখিনি।’
আতা ইবনে আবূ রেবাহ তাঁর সম্বন্ধে বলেন, ‘আয়েশা ছিলেন সবচেয়ে বড় ফকীহ, সবচেয়ে উত্তম মানুষ এবং লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুস্থ মতের অধিকারিণী।
ইমাম যুহরী বলেন, ‘সকল পুরুষ এবং উম্মুল মু’মিনীনদের সকলের ইলম একত্র করা হলেও আয়েশার ইলম হবে তাদের সবার চেয়ে বেশি।”
হাদীস শাস্ত্রে আয়েশা (রা)-এর অবদান : আয়েশা (রা) মোট ২২১০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ১৭৪টি হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। ইমাম বুখারী (র) তাঁর কাছ থেকে এককভাবে ৫৪টি হাদীস এবং ইমাম মুসলিম (র) ৬৮টি হাদীস বর্ণনা করেছেন । সাহাবী ও তাবেয়ী মিলে মোট দুই শতাধিক রাবী আয়েশা (রা)-এর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাসরুক, আসওয়াদ, ইবনুল মুসাইয়িব, উরওয়াহ, কাসেম প্রমুখ সাহাবিগণ। কারো মতে তিনি শরীয়তের এক-চতুর্থাংশ নির্দেশাবলী বর্ণনা করেছেন। নিচে তাঁর থেকে বর্ণিত কিছু হাদীস উল্লেখ করা হল ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর ব্যক্তিসত্তা বিষয়ক!
১. শুরাইহ বলেন : আমি আয়েশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সাঃ) ঘরে এসে কোন কাজটি প্রথম করতেন। তিনি বললেন : মিসওয়াক । (মুসলিম : হাদীস নং-৫৯০)
২. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মাথার চুল কানের লতির উপরে এবং অল্প নিচ পর্যন্ত থাকতো। (আবু দাউদ : হাদীস নং-৪১৮৭)
৩. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল (সাঃ) মৃত অবধি ক্রমাগত দু’দিন পেট ভরে রুটি খেতে পারেননি (তিরমিযী)
8. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল (সাঃ) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। (তিরমিযী : হাদীস নং-৮০৩)
৫. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সারা তাঁর চাকর এবং কোন স্ত্রীকে মারেননি। এমন কি তিনি স্বীয় হস্তে কোন বস্তুকে প্রহার করেন নি।
পারিবারিক প্রসঙ্গে!
৬. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) তাকে বলেছেন, বিয়ের পূর্বে স্বপ্নের মাঝে দু’বার তোমাকে আমায় দেখানো হয়েছে। আমি স্বপ্নে দেখি যে, তুমি একখণ্ড রেশমী বস্ত্রে আচ্ছাদিতা। আমাকে বলা হলো, ইনি আপনার স্ত্রী । তারপর আমি তার মুখাবরণ উন্মোচন করে দেখি যে, সে তুমিই। তখন আমি মনে মনে বললাম, এ স্বপ্ন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তবে তা তিনি কার্যকর করবেনই। (বুখারী: হাদীস নং ৬২৮৩; আবু দাউদ)
৬. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি ঘুমিয়ে থাকতাম । আমার পা দু’টি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে থাকত। তিনি রাতের সালাত পড়তেন । যখন সিজদা করতে চাইতেন আমার পায়ে খোচা দিতেন। আমি পা সংকোচিত করে নিতাম । অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিজদা করতেন । (আবু দাউদ)
৭. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রমযান মাসের শেষ দশক আসলেই নবী (সাঃ) রাত্রি জেগে ইবাদত করতেন, তাঁর কোমর শক্তভাবে বেঁধে নিতেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে (ইবাদতের জন্য) জাগাতেন। (আবু দাউদ)
৮. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকট উত্তম। (তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮)
৯. আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা:) মেযবানকে মেহমানের খাওয়া শেষ হওয়ার পূর্বে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃ. ১৩৭।)
১০. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী (সাঃ) একদা ঘরে প্রবেশ করে উল্টো করে ফেলে রাখা একটি খাবারের পাত্র দেখে তা হাতে উঠিয়ে নিলেন এবং তা মুছে খেয়ে ফেললেন আর বললেন : হে আয়েশা (রা)! খাবারকে সম্মান কর, কেননা তা যে সম্প্রদায় হতে বিরাগ ভাজন হয়ে বেরিয়ে গেছে কোন দিন তাদের কাছে তা আর ফিরে আসে না । (তিরমিযী)
১১. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য তিনটি পাত্র ঢেকে রাখতাম। একটি অজুর জন্য, একটি মিসওয়াকের জন্য আর একটি পান করার জন্য। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ৩০)
১২. আয়েশা (রা) নবী মোর থেকে বর্ণনা করেন : “প্রত্যেক নেশাকর পানীয়ই হারাম। (আল-বুখারী : ১ম খণ্ড, পৃ: ৩৮; তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ: ২৮)
১৩. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : কোন মুসলমানের ওপর আপতিত বিপদ তার পাপরাশি ক্ষমার কাফফারা হয়ে থাকে। এমনকি একটা কাঁটা ফুটলেও। (সহীহ আল-বুখারী : ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৪৩।
১৪. আয়েশা (রা) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : জিব্রাঈল (আ) সদা-সর্বদা আমার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অসীয়ত করেন। আমার ধারণা হচ্ছে যে, অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন। (বুখারী)
১৫. আবূ সালামা ও তাঁর জাতির সাথে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ ছিল। আবূ সালামা (রা) আয়েশা (রা)-এর কাছে এসে তাঁকে এ বিষয়টি জানালে তিনি বললেন : হে আবূ সালামা! ঐ জমি হতে বিরত থাক। কেননা নবী (সাঃ) বলেছেন : যে ব্যক্তি এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে দখল করবে, কিয়ামতের দিন এর সাত স্তবক জমিন তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩।)
১৬. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সালাতে দোয়া করতেন এ বলে-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْمَاثَمِ وَالْمَغْرَمِ
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পাপ ও ঋণগ্রস্ততা হতে আশ্রয় চাই ৷
জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে রাসূল (সাঃ) আপনি ঋণগ্রস্ততা থেকে বেশি পরিমাণে আশ্রয় চান কেন? নবী (সাঃ) বললেন : কেউ ঋণগ্রস্ত হলে কথা বলার সময় মিথ্যা বলে, ওয়াদা খিলাফ করে। (নাসাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৭ )
১৭. আয়েশা (রা) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : যখন কোন স্ত্রী তার স্বামীর ঘর থেকে সৎপথে খাদ্য ব্যয় করে সে তাঁর এ দানের পুণ্য লাভ করবে। তাঁর স্বামীও উপার্জনকারী হিসেবে এর পুরস্কার পাবে। আর তা রক্ষণাবেক্ষণকারীও অনুরূপ পুণ্য লাভ করবে। কারো পুরস্কার কম করে দেয়া হবে না । (আল-বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯২)
১৮. উরওয়া ইবনে যুবাইর (র) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আয়েশা (রা.) তাঁকে সংবাদ দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা) আবূ বকর (রা)-এর কাছে গিয়ে বললেন, আল্লাহর দেয়া সম্পদ হতে রাসূলুল্লাহ (সা:) যা রেখে গিয়েছেন তা বণ্টন করে আমার উত্তরাধিকারের অংশ বুঝিয়ে দিন। আবূ বকর (রা) তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : আমরা যা রেখে গেলাম তাঁর কোন উত্তরাধিকার হবে না, বরং তা সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
১৯. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি কিছু মিসকীন কিংবা কিছু সাদকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করলেন । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বললেন : দান করে দাও, গুণে গুণে দিবে না, তাহলে তোমাকেও সাওয়াব গুণে গুণে দেয়া হবে। (আবূ দাউদ : ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৮)
২০. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন : মৃত প্রাণীর চামড়া দাবাগত তথা পরিশোধন করে তা থেকে উপকৃত হবার অনুমতি রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রদান করেছেন। (আবু দাউদ : ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৯)
২১. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি বিশ দীনার বা এর বেশি হলে অর্ধ দীনার এবং প্রতি চল্লিশ দীনারে এক দীনার যাকাত হিসেবে গ্রহণ করতেন। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ১২৮)
রাজনীতি বিষয়ক!
রাজনৈতিক বলতে এখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠাকল্পে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন যুদ্ধাভিযান ও খিলাফত সংক্রান্ত বর্ণনাকে বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আয়েশা (রা) হাদীস বর্ণনা করেছেন । নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো-
২২. আয়েশা (রা) বলেন : নবী (সা:) যখন খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যুদ্ধাস্ত্র খুলে গোসল করলেন, তখন জিব্রাঈল (আ) এসে বললেন, আপনি যুদ্ধের অস্ত্র খুলে ফেলেছেন । অথচ আল্লাহর শপথ আমরা তা খুলিনি। আপনি তাদের দিকে বের হন। নবী (সাঃ) বললেন, কোন দিকে বের হবো? জিব্রাঈল (আ) বনু কুরায়জার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন : ঐদিকে । অতঃপর নবী (সাঃ) তাদের দিকে বের হয়ে পড়লেন। (বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৯০)
২৩. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল (সাঃ) বলেছেন : আল্লাহ যখন কোন নেতার কল্যাণ কামনা করেন তখন তাকে একজন সত্যবাদী মন্ত্রী (উযীর) দান করেন। যিনি তাঁকে কিছু ভুলে গেলে স্মরণ করিয়ে দেন। আর কিছু স্মরণ করতে তাকে সহায়তা করেন । অপর পক্ষে আল্লাহ যে নেতার অমঙ্গল চান, তাকে একজন খারাপ উযীর দান করেন যে তাকে ভুলে গেলেও স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর কিছু স্মরণ করলেও তাকে সহায়তা করে না । (আবূ দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. 809 )
২৪. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর যুদ্ধে যাবার পথে হাররাতুল ওয়াবার নামক স্থানে যখন পৌঁছালেন, তখন একজন মুশরিক ব্যক্তি তাঁর সাথে সাক্ষাত করে নিজের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিল। অতঃপর মহানবী (সাঃ) বললেন, তুমি কী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখ? সে বলল, জী না। মহানবী (সাঃ) বললেন : আমি কোন মুশরিকের নিকট সাহায্য-সহযোগিতা চাইব না । (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৪)
২৫. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উসমান (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন : হে উসমান! আল্লাহ যদি কোন দিন তোমাকে নেতৃত্ব দান করেন, তবে মুনাফিকরা আল্লাহর দেয়া নেতৃত্বের ঐ জামা তোমার থেকে খুলে নিতে চাইলে তুমি তা খুলে দিবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কথাটি তিনবার বললেন। হাদীসের বর্ণনাকারী নু’মান বলেন, আমি আয়েশা (রা)-কে বললাম, জনগণকে এ সংবাদটি জানতে দিতে আপনাকে কোন জিনিস বারণ করল? তিনি বললেন, আমাকে (তখন তা) ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ১১)
২৬. আসওয়াদ (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আয়েশা (রা)-এর নিকটে আলী (রা)-এর (কথিত) খিলাফতের ওসিয়ত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো । তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কখন খিলাফতের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ওসিয়ত করলেন? আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে) আমার কোলে বা বুকে ঠেস লাগিয়ে রেখেছিলাম। তখন তিনি একটি গামলা আনতে বললেন। আমার কোলের মধ্যেই গামলাটি কাত করলেন। পরে তিনি মারা যান। অথচ আমি বুঝতেও পারিনি। এমতাবস্থায় কখন তিনি ওসিয়ত করলেন? (ইবনে মাজাহ, পৃ. ১১৭ )
২৭. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : সুদ সংক্রান্ত সূরা বাকারা-এর আয়াত যখন নাযিল হলো, তখন নবী (সাঃ) মসজিদে গিয়ে লোকদেরকে তা শিক্ষা দিলেন। (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ, ৬৫)
২৮. আয়েশা (রা) মহানবী (সা:) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : যে ব্যক্তি আল কুরআন পড়ে এবং মুখস্থ করে সে মহান লিপিকারদের অন্তর্ভুক্ত হবে । আর যে ব্যক্তি পড়ে এভাবে যে, সে তা বুঝার চেষ্টা করে এবং এ ক্ষেত্রে যে বড়ই যত্নবান তার জন্য আছে দ্বিগুণ পুণ্য। (বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩৫)
২৯. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর এ বাণী প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলো- “সে মহান সত্তা যিনি আপনার ওপর কুরআন নাযিল করেছেন যার কিছু আয়াত সুস্পষ্ট অর্থবোধক যেগুলো কিতাবের মূল বিষয়। অপর কিছু আয়াত অস্পষ্ট। যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে তারা ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে অস্পষ্ট আয়াতগুলো অন্বেষণ করে।” রাসূলুল্লাহ বলেন : যখন তোমরা ঐ সমস্ত লোকদেরকে দেখবে যারা অস্পষ্ট আয়াতগুলো অনুসরণ করে, জানবে তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তাদের থেকে সাবধান হয়ে চলো। (তিরমিযী, ২য় খণ্ড পৃ. ১২৮)
৩০. আয়েশা (রা) বলেন : প্রতি রাতে বিছানায় শয়ন করার সময় নবী (সাঃ) দু’হাতের তালু একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে মাথা ও মুখমণ্ডল হতে সারা শরীর তিন বার মাসেহ করতেন। (তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৭৭)
৩১. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সাঃ) যে অসুখে মৃত্যুবরণ করলেন তাতে আশ্রয় প্রার্থনার দু’আ দ্বারা নিজের ওপর ঝাড়-ফুঁক করছিলেন। অত:পর তিনি যখন ভারী (শক্তিহীন বিহ্বল) হয়ে গেলেন তখন আমি ঐ গুলোর দ্বারা ঝাড়-ফুঁক দিচ্ছিলাম এবং তিনি ঐসবের বরকত হাসিলের জন্য নিজের হাত বুলাচ্ছিলেন। একজন বর্ণনাকারী বলেন যে, আমি ইবন হিশাবকে জিজ্ঞেস করলাম : তাঁর ঝাড়-ফুঁক কেমন ছিল? তিনি উত্তর দিলেন যে, তিনি তাঁর দু’হাতে ফুঁক দিতেন। তারপর এর দ্বারা মুখমন্ডল মুছতেন।
৩২. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : জ্বর জাহান্নামের উত্তাপ থেকে হয়ে থাকে । সুতরাং পানি দিয়ে তোমরা তা ঠাণ্ডা করো । (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২৬ ও তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭)
৩৩. আয়েশা (রা) বলেন, আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট প্রেরণ করার জন্য মোটা তাজা করার চেষ্টা করছিলেন। এ জন্য অনেক কিছু ভক্ষণ করলেও তাঁর উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছিল না। অবশেষে পাকা খেজুরের সাথে কাকুড় মিশিয়ে খেয়ে বেশ মোটাতাজা হলাম। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ২৩৮)
৩৪. খালিদ ইবনে সাদ (রা) বলেন, আমরা সফরে বের হলাম। গালিব ইবনে জাবের আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম। ইবনে আবু আতীক তাঁকে দেখতে এসে বললেন, তোমাদের উচিত কালো জিরা দিয়ে তার চিকিৎসা করা। পাঁচ বা সাতটি কালো জিরার দানা নিয়ে তা পিষে তেলের সাথে মিশিয়ে নাকের দু’পাশে ফোঁটা ফোঁটা করে দিবে। কেননা, আয়েশা (রাঃ) তাঁদেরকে বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন, নবী (সাঃ) বলেছেন : এ কালো জিরা মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের প্রতিষেধক ।
৩৫. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি ঋতুবতী থাকাকালে রাসূলুল্লাহ (সা:) আমার কোলে মাথা রেখে কুরআন পাঠ করতেন। (আল-বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১২৫)
৩৬. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমাদের (নবীপত্নী) কারো মাসিক স্রাব শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে আদেশ করতেন চাদর দিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখতে । অত:পর তিনি তার সাথে মিলিত হতেন। (সহীহ মুসলিম : ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪১)
৩৭. আয়েশা (রা)-এর গোলাম যাকওয়ান (র) বলেন, আমি আয়েশা (রা)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন : আমি রাসূল (সাঃ) -কে জিজ্ঞেস করেছি যে, কোন মেয়েকে তার অভিভাবক বিবাহ দেয়ার সময় মেয়ের অনুমতি নিতে হবে কি? নবী (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ, নিতে হবে। আমি বললাম : সে মেয়ে তো লজ্জাবোধ করবে। নবী (সা:) বললেন, নীরবতা পালন করাই তার সম্মতির লক্ষণ । (মুসলিম : ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫৫)
৩৮. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আসমা বিনত আবূ বকর (রা) একদা পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় মহানবীর (সাঃ)-এর নিকট আসলে তিনি বললেন, হে আসমা! মহিলাদের যে দিন থেকে মাসিক হওয়া শুরু করে সে দিন থেকে তাদের এই এই অঙ্গ ছাড়া কিছুই দেখানো ঠিক নয়। এই বলে তিনি তাঁর মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জিদ্বয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন । (আবূ দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৭)
পবিত্রতা বিষয়ক!
৩৯. আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সাঃ) অপবত্রি (জুনুবী) অবস্থায় নিদ্রা যেতে ইচ্ছা করলে তিনি তার যৌনাঙ্গ ধুয়ে নিতেন এবং সালাতের অযূর ন্যায় অযূ করতেন।
৪০. খুল্লাস আল-হাজরী (র) বলেন, আমি আয়েশা (রা)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন : ঋতুস্রাব অবস্থায় আমি ও নবী (সাঃ) একই চাদরের নিচে ঘুমিয়েছি। নবী (সাঃ)-এর শরীরে বা কাপড়ে রক্ত লাগলে তিনি তা ধুয়ে সালাত পড়তেন” । (আবূ দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৪)
৪১. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, নবী (সাঃ) গোসলের পর আর অযূ করতেন না। (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯ ও নাসাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯)
৪২. আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, মিসওয়াক মুখ পবিত্র করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি আনয়ন করে। (সুনানে আন-নাসাঈ)
৪৩. উরওয়া ইবনুয যুবাইর আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর কোন স্ত্রীকে চুমু দিতেন। তারপর নতুন অযূ ছাড়াই সালাতে যেতেন। উরওয়া (রা) বলেন, তিনি আর কেউ নন আপনি ছাড়া। এ কথা শুনে তিনি হাসলেন। (ইবনে মাজাহ, পৃ. ৩৮)
৪৪. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন দুই লজ্জাস্থান মিলিত হয় তখন গোসল ফরয হয়ে যায় । আমার এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এমনটি হতো। অতঃপর আমরা গোসল করে নিতাম। (বুখারী)
ইবাদতমূলক!
৪৫. আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ফজরের সালাত অন্ধকার থাকতে পড়তেন। মু’মিন মহিলাগণ সালাত শেষে ফিরে আসতেন, অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেতো না বা তাঁরা একে অপরকে চিনতে পারতো না । (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২০ )
৪৬. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)সালাতের اللهم أنتَ السّلامُ وَمِنْكَ السّلام تباركتيَا ذَا الْجَلالِ وَالْإِكْرَامِ পাঠ করা পরিমাণ সময় বসতেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড, পৃঃ ২১৮)
৪৭. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের এক রাক’আত এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের এক রাক’আত পেল, সে যেন পূর্ণ ফজর ও আসরের সালাতই পেল। (মুসলিম ১ম খণ্ড, পৃঃ ২২১)
৪৮. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন: আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হলো যা সর্বদা করা হয়, যদিও তা কম হয়। আয়েশা (রা) যখন কোন আমল করতেন তখন তা স্থায়ীভাবে করতেন। (মুসলিম)
৪৯. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী সা (সাঃ) নিন্মের বাক্যগুলো দ্বারা দু’আ করতেন : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে জাহান্নামের ফিতনা ও আযাব থেকে এবং ধনাঢ্য ও দারিদ্র্যতার অপকারিতা থেকে আশ্রয় চাই । (আবূ দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৫)
৫০. মু’আযা থেকে বর্ণিত যে, একটি মহিলা আয়েশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করল, মহিলারা হায়েজ থেকে পবিত্র হলে তাদের জন্য কী সালাতের কাজা আদায় করে দেয়া আবশ্যক? আয়েশা (রা) বললেন, তুমি কী খারেজী মহিলা? আমরাতো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে জীবন কাটিয়েছি, আমাদেরও ঋতুস্রাব হত অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে সালাত কাজা করার জন্য কখনো বলেননি তাই আমরা কোন দিন কাজা আদায় করতাম না। (বুখারী)
৫১. আয়েশা সিদ্দীকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে রাত্রের সালাত বসে পড়তে দেখিনি। তবে যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তখন কেরাত পাঠ করার সময় বসে বসে পড়তেন। আর ত্রিশ চল্লিশ আয়াত বাকি থাকতেই দাঁড়িয়ে যেতেন এবং তা পড়ে রুকু করতেন। (মুসলিম)
৫২. আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা) থেকে রাসূল করীম (সাঃ)-এর নফল সালাত প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম । আয়েশা (রা) বললেন, রাসূল করীম (সাঃ) জোহরের পূর্বে চার রাকা’আত আমার ঘরে পড়তেন, তারপর মসজিদে গিয়ে ফরজ আদায় করতেন । অতঃপর ঘরে চলে আসতেন এবং জোহরের পর দুই রাকাত পড়তেন। মাগরিবের সালাত শেষ করেও ঘরে চলে আসতেন এবং দুই রাকা’আত পড়তেন। এশার সালাতের পরও ঘরে চলে আসতেন এবং দুই রাকা’আত পড়তেন। রাসূলুল্লাহ তাহাজ্জুদের সালাত বেতরসহ নয় রাকা’আত আদায় করতেন। তাহাজ্জুদের সালাত কখনো দাঁড়িয়ে আর কখনো বসে বসে আদায় করতেন । দাঁড়িয়ে কেরাত পাঠ করলে রুকু সেজদাও দাঁড়িয়ে করতেন। আর বসে কেরাত পড়লে রুকু সেজদাও বসে আদায় করতেন। ফজর হয়ে গেলে দুই রাকা’আত আদায় করতেন।
ব্যাখ্যা : পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকা’আতের মোট সংখ্যা নিম্নরূপ :
সলাত | ফরজ | ফরজের পূর্বে সুন্নাত | ফরজের পরে সুন্নাত |
ফজর | ২ | ২ | – |
জোহর | ৪ | ২ বা ৪ | ২ |
আছর | ৪ | – | – |
মাগরিব | ৩ | – | ২ |
এশা | ৪ | – | ২ |
মোট | ১৭ | ৪/৬ | ৬ |
৫৩. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল আপনারা বলেন : যখন তোমাদের কেউ খাবার শুরু করে সে যেন প্রথমে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। প্রথমে তা ভুলে গেলে পরে বলবে بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وَ آخِرَه (বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৯, তিরযিমী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭)
পরকাল বিষয়ক!
৫৪. আয়েশা (রা) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : হে আমার উম্মতগণ! আল্লাহর শপথ আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে, তবে তোমরা কম করে হাসতে, বেশি করে কাঁদতে। (বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৮১)
৫৫. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে আল্লাহও তাঁর সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে আল্লাহর সাক্ষাৎ অপছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন। (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৪৩)
৫৬. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছি! তিনি বলেছেন : কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষকে উলঙ্গ অবস্থায় এবং খাতনা বিহীন একত্রিত করা হবে। আয়েশা (রা) বলেন, আমি বললাম : হে রাসূল (সাঃ) পুরুষ ও নারী সকলকেই কি এভাবে একত্রিত করা হবে?
৫৭. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি একদা জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করত: কাঁদছিলেন। মহানবী (সাঃ) বললেন : তোমাকে কাঁদাল কে? তিনি বললেন, আমি জাহান্নামের আগুন স্মরণ করছিলাম, তাই কাঁদছি। আচ্ছা আপনি কি কিয়ামতের দিনে আপনার পরিবার-পরিজনদের কথা মনে রাখবেন? মহানবী (সাঃ) বললেন : এমন তিনটি স্থান রয়েছে যেখানে কেউ কাউকে মনে রাখবে না।
১. আমল ওজন করার সময়, যতক্ষণ না সে নিশ্চিত হবে যে, তার ওজন ভারী হলো না হালকা হলো।
২. যখন আমলনামা দেয়া হবে এই বলে যে, এসো তোমার আমলনামা পড়ে দেখ। যতক্ষণ না সে নিশ্চিত হবে তার আমলনামা ডান হাতে পাচ্ছে, না বাম হাতে, নাকি পৃষ্ঠদেশে।
৩. জাহান্নামের উপরে রাখা কঠিন (পুলসিরাত) পার হবার সময়। (আবূ দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৪৫-৪৫)
৫৮. আয়েশা (রা) বলেন, যখন আল্লাহর এ বাণী নাযিল হলো “তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করে দাও।” তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন : হে আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা সাফিয়া! হে মুহাম্মদ তনয়া ফাতিমা! হে বনূ আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর বিষয়ে তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না, তোমরা আমার মাল থেকে যা খুশি চেয়ে নিতে পার। (তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬)
৫৯. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ (সা:) বলেছেন : জন্মগত সম্বন্ধের কারণে যা হারাম হয়, দুধ পানগত সম্বন্ধের কারণেও তা হারাম হয়। (মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৬)
৬০. আয়েশা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা:) বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন : এক-চতুর্থাংশ দীনার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মূল্যের সম্পদ চুরি করলে চোরের হাত কেটে দিতে হবে। (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩)
৬১. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : তোমাদের কারো সালাতে অযূ ছুটে গেলে (হদস) সে যেন তাঁর নাক ধরে পিছনে চলে আসে । (আবূ দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৯)
৬২. আতা ইবন আবী রাবাহ (র) থেকে বর্ণিত। তিনি আয়েশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মহিলাদের সাওয়ারীর উপর সালাত আদায় করার অনুমতি আছে কি? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে কোন অনুমতি নেই। স্বাভাবিক অবস্থাতেও নয় এবং অস্বাভাবিক অবস্থাতেও নয়। (মুসলিম, পৃ. ১৭৩)
৬৩. আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : কেউ যদি রোযা কাযা থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তবে তার অভিভাবকদের কেউ তা আদায় করে দেবে। (আবূ দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৬)
৬৪. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ করতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিষেধ করেছিলেন জনগণের অভাব-অনটনের কারণে। এ অবস্থা উত্তরণের পর তিনি তা পুনরায় সংরক্ষণের অনুমতি দান করেন । (ইবনে মাজাহ, পৃ. ২২৮)
অন্যান্য বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর অবদান!
আয়েশা (রা) ইসলামী সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে এক বিস্ময়কর নাম। হাদীস ছাড়াও তাফসীর, ফিক্হ, সাহিত্য, কাব্য ও চিকিৎসা প্রভৃতি শারঈ ও পার্থিব বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলো ।
তাফসীর বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর অবদান : পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকে পরিভাষায় তাফসীর বলে। এ ক্ষেত্রেও আয়েশা (রা)-এর অবদান ছিল অসামান্য। দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পবিত্র সাহচর্য থেকে তিনি কুরআন অবতরণ, নাযিলের প্রেক্ষাপট এবং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। উপরন্তু তাঁর ঘরেই অধিকাংশ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট কুরআনের আয়াত নাযিল হতো। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে কুরআন (ভাব ও তাৎপর্যসহ) শিক্ষা লাভ করতেন। আবূ ইউনূস নামে তাঁর এক দাসকে দিয়ে তিনি কুরআন লিখিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনায় আল-কুরআনের অনেক আয়াতের সঠিক তত্ত্ব ও তাৎপর্য প্রতিভাত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হলো-
১. আল্লাহ তা’আলার বাণী-
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَفَلا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يُطَّوفَ بِهِمَا
“নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম । সুতরাং যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ বা উমরা করবে তাদের জন্য এ দু’টির তাওয়াক (সাঈ) করাতে কোন দোষ নেই”।
এ আয়াত সম্পর্কে একদা তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র ও ভাগ্নে উরওয়া (র) বললেন : খালা আম্মা! অত্র আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, সাফা, মারওয়ার তাওয়াফ না করলেও কোন ক্ষতি নেই। আয়েশা (রা) বললেন : “তোমার ব্যাখ্যা সঠিক নয়, যদি আয়াতটির অর্থ তাই হতো, তবে আল্লাহ এভাবে বলতেন : لَا جُنَاحَ أَنْ لا অর্থাৎ ঐ দু’টির তাওয়াফ না করাতে কোন দোষ নেই। মূলত এ আয়াতটি আনসারদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা ইসলামে দীক্ষিত হবার পূর্বে মানাত দেবীর অর্চনা করত। এ মূর্তি ছিল কুদায়দ সংলগ্ন মুশাব্বাল পর্বতে। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অত্র আয়াত নাযিল হয়। অতঃপর আয়েশা (রা) বলেন : “নবী (সাঃ) সাফা ও মারওয়ায় সাঈ করেছেন। সুতরাং এখন তা পরিত্যাগ করার অধিকার কারো নেই।”
২. আল্লাহ তা’আল্লার বাণী-
حافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاة الوسطى
“তোমরা সকল সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের”। এখানে মধ্যবর্তী সালাত নিয়ে সাহাবীদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। যায়িদ ইবন সাবিত এবং উসামা (রা)-এর মতে, এর দ্বারা যুহরের সালাত, আবার কোন কোন সাহাবীর মধ্যে ফজরের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু আয়েশা (রা) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেছেন : তা হলো আসরের সালাত । তিনি এ তাফসীরের ওপর এত দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে, স্বীয় মাসহাফের পাদটীকায় (আরবি) কথাটি লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। তাঁর মাসহাফ লেখক আবূ ইউনুস বলেন : তিনি আমাকে তাঁর নিজের জন্য কুরআন লিখার নির্দেশ দিয়ে বললেন : যখন এ আয়াত পর্যন্ত আসবে তখন আমাকে জানাবে। আমি তাঁকে সে সম্পর্কে জানালে তিনি বললেন : ” (আরবি) এর পরে (আরবি) দাও। অতঃপর তিনি বলেন, আমি মহানবী (সাঃ) এর থেকে এর ব্যাখ্যা এমনই শুনেছি।
৩. আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : “তোমাদের হৃদয়ে যা কিছু আছে তা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তোমাদের কাছে তার হিসাব নিবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করবেন” । এ আয়াত সম্বন্ধে ইবন আব্বাস ও আলী (রা) বলেন : “অত্র আয়াতের বিধান মতে, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে” । আল্লাহ তা’আলার এই বাণীর দ্বারা রহিত হয়ে গিয়েছে। ইবন উমর (রা)-এর অভিমতও অনুরূপ। জনৈক ব্যক্তি আয়েশা (রা)-এর নিকট উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলে তিনি “যে খারাপ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পাবে” আয়াতটি উল্লেখ করেন ।
প্রশ্নকারীর বক্তব্য ছিল এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ বান্দা কি করে লাভ করবে? আয়েশা (রা) বললেন : নবী (সা:)-এর নিকট আমি এ আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন সর্বপ্রথম তুমিই এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছ। আল্লাহর কালাম সত্য। তবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ছোট ছোট অপরাধসমূহ বিভিন্ন মুসিবত-বিপদের মাধ্যমে ক্ষমা করে দেন। কোন মু’মিন যখন রোগাক্রান্ত হয় বা তার উপর বিপদ নেমে আসে, এমনকি পকেটে কোন জিনিস রেখে ভুলে যায়, আর তা অন্বেষণ করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ে, এ সবই তাঁর ক্ষমা ও অনুকম্পা লাভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর অবস্থা এমন হয় যে, সোনা আগুনে জ্বালালে যেমন নিখাদ হয়ে যায়, তেমনি মু’মিন ব্যক্তিও গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় ।
৪. আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি নবী (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা’আলা যার কাছে থেকে হিসাব চেয়ে বসবেন সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বললাম : হে রাসূল (সাঃ) অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : (আরবি) “অচিরেই তাদের থেকে সহজ হিসাব গ্রহণ করা হবে”। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : এর অর্থ হল আমলনামা উপস্থাপনা ।
ফিকহ বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর অবদান : কুরআন ও হাদীসের উপর ভিত্তি করে শরঈ বিষয়ে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তাকেই ফিকহ বলে। এই ফিকহ শাস্ত্রে আয়েশা (রা)-এর অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মহানবী (সাঃ) ছিলেন সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত ও ফতওয়া দানের কেন্দ্রস্থল। তাঁর ইন্তিকালের পর ইসলামী শরী’আত ও হুকুম-আহকামে পারদর্শী সাহাবীদের উপর এ দায়িত্ব বর্তায়। বিশেষ কোন সমস্যা আসলে তাঁরা প্রথমে কুরআন ও সুন্নায় তার সমাধান তালাশ করতেন। কিন্তু তাতে স্পষ্ট সমাধান না পেলে কুরআন ও হাদীসের অন্য হুকুমের উপর কিয়াস বা অনুমান করে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন। খুলাফায়ে রাশিদার যুগের শেষ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন কারণে বড় বড় সাহাবীদের অনেকেই মক্কা, তায়িফ, দামিস্ক, বসরা, কৃষ্ণা প্রভৃতি নগরীতে ছড়িয়ে পড়েন । পক্ষান্তরে ইবনে আব্বাস, ইবনে ওমর, আবূ হুরায়রা ও আয়েশা (রা)-এ চার মহান ব্যক্তিত্ব মদীনায় ফিকহ ও ফতওয়ার কাজ আঞ্জাম দেন ।
এ ক্ষেত্রে ইবনে ওমর ও আবূ হুরায়রা (রা)-এর পদ্ধতি ছিল উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের কোন বিধান কিংবা পূর্ববর্তী খলীফাদের কোন আমলে থাকলে তাঁরা তা বলে দিতেন। অন্যথায় নীরবতা অবলম্বন করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) এ ক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্ববর্তী খলীফাদের আমলে সমাধানকৃত মাসআলার ওপর অনুমান করে নিজের জ্ঞান ও বৃদ্ধি অনুযায়ী সমাধান দিতেন। এ ক্ষেত্রে আয়েশা (রা)-এর মূলনীতি ছিল প্রথমে কুরআন ও পরে সুন্নাতের মাঝে সমাধান অনুসন্ধান করা। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে সমাধান না পেলে স্বীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান করা । নিম্নে তাঁর গৃহীত ফিকহী মাসআলার কিছু উদাহরণ পেশ করা হলো-
* আল্লাহ তা’আলার বাণী-
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَريصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلاثَةَ قُرُوءٍ .
“তালাক প্রাপ্তা নারী তিন ‘কুরূ’ পর্যন্ত নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে। অর্থাৎ এ সময় পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।” (সূরা আল বাকারা : আয়াত-২২৮)
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)-এর এক ভাতিজী স্বামী কর্তৃক তালাক প্রাপ্তা হন। তাঁর ইদ্দতের তিন তুহুর অর্থাৎ পবিত্রতার তিনটি মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে নতুন মাসের প্রারম্ভনায় আয়েশা (রা) তাকে স্বামী গৃহ ছেড়ে চলে আসতে বলেন। কিছু লোক এটাকে কুরআনী হুকুমের পরিপন্থী বলে প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা দলীল হিসেবে উল্লেখিত আয়াতটি পেশ করলে আয়েশা (রা) বলেন : আল্লাহর বাণী সত্য। ‘কুরূ’ এর অর্থ কি তা কি তোমরা জান? ‘কুরূ’ অর্থ : পবিত্রতা (তুহুর)। মদীনার ফিকহবিদগণ এ বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর অনুসরণ করেছেন। তবে ইরাকের ফকীহগণ ‘কুর’ বলতে হায়েজ (ঋতুস্রাব)-কে বুঝে থাকেন।
* স্বামী স্ত্রীকে তালাক দানের ক্ষমতা অর্পণ করলে এবং স্ত্রী সে ক্ষমতা স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়ে তাকে সর্বোতভাবে মেনে নিলেও কি সে স্ত্রীর ওপর কোন তালাক পতিত হবে? এ ক্ষেত্রে আলী (রা) ও যায়েদের (রা) অভিমত হলো স্ত্রীর ওপর এক তালাক প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আয়েশা (রা)-এর মতে কোন তালাকই হবে না। তিনি তাঁর মতের স্বপক্ষে ‘তাখঈর’ এর ঘটনা উল্লেখ করে বলেন : রাসূল (সাঃ) তাঁর স্ত্রীদেরকে এ ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁকে ছেড়ে পার্থিব সুখ-সাচ্ছ্যন্দ গ্রহণ করতে পারেন, অথবা তাঁর সাথে থেকে এ দারিদ্র্যময় জীবন বেছে নিতে পারেন। উম্মুল মু’মিনীনগণ (রা) শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন । অথচ এতে তাঁদের ওপর কোনরূপ তালাক পতিত হয়নি ৷ এরূপ আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে, যাতে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আয়েশা (রা)-এর ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গী বা ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও সূক্ষ্মতার প্রমাণ মিলে ।
আরবী সাহিত্যে আয়েশা (রা)-এর অবদান : আরবী ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। এ ভাষা অত্যন্ত অলংকার সমৃদ্ধ, ছন্দময় ও প্রাঞ্জল। আয়েশা (রা) তাঁর এ মাতৃভাষার ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এর পশ্চাতে অলংকার সমৃদ্ধ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) এর হাদীস চর্চা ও অধ্যয়ন সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল বলে অনুমিত হয়। আয়েশা (রা) অত্যন্ত সুমিষ্ট, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর ছাত্র মূসা ইবন তালহা এ সম্পর্কে যথার্থ বলেন : (আরবি) “আমি আয়েশা (রা) অপেক্ষা অধিকতর অলংকারময় ও প্রাঞ্জলভাষী কাউকে দেখিনি”। আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীসের মধ্যে অনেক হাদীস তিনি নিজের প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে শৈল্পিকরূপ ও সৌন্দর্য । তাতে বিভিন্ন রূপক ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সার্থক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওপর ওহী অবতীর্ণের বর্ণনা উল্লেখ করা যায়। আয়েশা (রা) বলেন :
أولُ مَا بُدِئَ بِهِ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْوَحْيِ الرُّؤْيَا الصَّالِحِةَ فِي النَّوْمِ، فَكَانَ لا يَرَى رُؤْيَا إِلَّا جَاءَتْ مِثْلَ فَلَقِ الصُّبْحِ
“প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর ওহী নাযিল হয় সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে ! তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের স্বচ্ছ ঊষার ন্যায় তাঁর কাছে দীপ্যমান হতো” ।
সাহিত্যিকরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সত্য স্বপ্নসমূহকে সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ ভঙ্গীমায় “প্রত্যুষের কিরণের” সাথে তুলনা করেছেন।
অনুরূপ তাঁর ওপর ইফক বা মিথ্যা অপবাদ আরোপের ঘটনার সময়কার এক রাতের করুণ চিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন
দারিদ্র্যময় জীবন বেছে নিতে পারেন। উম্মুল মু’মিনীনগণ (রা) শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন । অথচ এতে তাঁদের ওপর কোনরূপ তালাক পতিত হয়নি ৷ এরূপ আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে, যাতে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আয়েশা (রা)-এর ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গী বা ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও সূক্ষ্মতার প্রমাণ মিলে ।
আরবী সাহিত্যে আয়েশা (রা)-এর অবদান : আরবী ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। এ ভাষা অত্যন্ত অলংকার সমৃদ্ধ, ছন্দময় ও প্রাঞ্জল। আয়েশা (রা) তাঁর এ মাতৃভাষার ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এর পশ্চাতে অলংকার সমৃদ্ধ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) এর হাদীস চর্চা ও অধ্যয়ন সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল বলে অনুমিত হয়। আয়েশা (রা) অত্যন্ত সুমিষ্ট, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর ছাত্র মূসা ইবন তালহা এ সম্পর্কে যথার্থ বলেন : (আরবি) “আমি আয়েশা (রা) অপেক্ষা অধিকতর অলংকারময় ও প্রাঞ্জলভাষী কাউকে দেখিনি”। আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীসের মধ্যে অনেক হাদীস তিনি নিজের প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে শৈল্পিকরূপ ও সৌন্দর্য । তাতে বিভিন্ন রূপক ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সার্থক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওপর ওহী অবতীর্ণের বর্ণনা উল্লেখ করা যায়। আয়েশা (রা) বলেন :
أولُ مَا بُدِئَ بِهِ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْوَحْيِ الرُّؤْيَا الصَّالِحِةَ فِي النَّوْمِ، فَكَانَ لا يَرَى رُؤْيَا إِلَّا جَاءَتْ مِثْلَ فَلَقِ الصُّبْحِ
“প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর ওহী নাযিল হয় সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে ! তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের স্বচ্ছ ঊষার ন্যায় তাঁর কাছে দীপ্যমান হতো” ।
সাহিত্যিকরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সত্য স্বপ্নসমূহকে সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ ভঙ্গীমায় “প্রত্যুষের কিরণের” সাথে তুলনা করেছেন।
অনুরূপ তাঁর ওপর ইফক বা মিথ্যা অপবাদ আরোপের ঘটনার সময়কার এক রাতের করুণ চিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন-
আরবী..
“ঐ রাতটি ক্রন্দন করে কাটালাম ।
সকাল পর্যন্ত আমার অশ্রুও শুকায়নি
এবং আমি চোখে ঘুমের সুরমাও লাগাইনি” ।
অর্থাৎ তিনি ঐ রাতটি জেগে কেঁদে কেঁদে অতিবাহিত করেছেন, এ কথাটি তিনি সরল বাক্যে না বলে অলংকার সমৃদ্ধ অভিব্যক্তির মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। ভাষার ওপর তাঁর যে যথেষ্ট দখল রয়েছে এতে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় ।
আয়েশা (রা) ছিলেন অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতী ও সূক্ষ্মদর্শিনী মহিলা। প্রাচীন আরবের লোক সাহিত্যের ওপর তাঁর বিচরণ ছিল। আরবের এগার সহোদরের একটি লম্বা কিচ্ছা তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সা:) কে শুনিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) একাগ্রচিত্তে তাঁর বর্ণনা শুনতেন। এসব কাহিনী বর্ণনাতে তার ভাষার লালিত্য, অনন্য বাচনভঙ্গি, অসাধারণ গাঁথুনী ও আরবী সাহিত্যে তাঁর অগাধ নৈপুণ্যের সাক্ষ্য বহন করে ।
পত্র সাহিত্যে আয়েশা (রা): যে কোন ভাষায়ই পত্র সাহিত্যের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামী সাহিত্য কিংবা আরবী সাহিত্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন অসংখ্য পণ্ডিতের নাম পাওয়া যাবে যাদের পত্রাবলী ইসলামী সাহিত্যকে সমধিক সমৃদ্ধ করেছে। তন্মধ্যে আয়েশা (রা)-এর নাম শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করতে পারি। আয়েশা (রা) ছিলেন তৎকালীন সময়ের শরয়ী বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিদল বা জ্ঞানপিপাসুগণ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রয়োজনের তাগিদে অনেক সময় আয়েশা (রা) কেও বিভিন্ন শহর বা অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের সাথে পত্র যোগাযোগ করতে হয়েছে। লিখনী বিদ্যার সাথে তাঁর তেমন পরিচয় না থাকলেও অন্যের মাধ্যমে তিনি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো লিখে নিতেন ।
কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তাঁর পত্রের ভাব ও ভাষা ছিল একান্তই নিজস্ব। তাঁর পত্রাবলিতেও সাহিত্যের প্রবীণ সাহিত্যিকগণ সাহিত্যমূল্য বিবেচনা করে নিজেদের রচনাবলীতে স্থান দিতে আগ্রহী হয়েছেন। ইবন আবদি রাব্বিহি রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-ইক্দুল ফরীদ এর ৪র্থ খণ্ডে আয়েশা (রা)-এর অনেক পত্র সঙ্কলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নিম্নে একটি পত্রের উল্লেখ করা হলো-
আয়েশা (রা:) বসরায় পৌঁছে তথাকার এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব যায়েদ ইবন সূহানকে পত্র লিখেছেন এভাবে-
مِنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ إِلَى ابْنِهِ الْخَالِص زَيْدِ بْنِ صَوْحَانَ، سَلامٌ عَلَيْكَ أَمَّا بَعْدُ : فَإِنْ آبَاكَ كَانَ رَأْسًا فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَسَيّدًا فِى الإِسْلامِ وَإِنَّكَ مِنْ أبِيكَ بِمَنْزِلَةِ الْمُصَلِّي مِنَ السَّابِقِ يُقَالُ : كَانَ أو لحقٍ وَقَدْ بَلَغَكَ الَّذِي كَانَ فِي الْإِسْلَامِ مِنْ مَصَابِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانٍ وَنَحْنُ قَادِمُونَ عَلَيْكَ وَالْعَيَانِ أشفى لَكَ مِنَ الْخَيْرِ فَإِذَا أَتَاكَ كِتَابِي هَذَا فَتَبْطِ النَّاسَ عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبِ وَالسّلام .
“মুমিনদের জননী আয়েশা (রা)-এর পক্ষ থেকে তাঁর একনিষ্ঠ সন্তান যায়েদ ইবন সুহানের প্রতি লিখিত। তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর কথা এই যে, তোমার পিতা জাহিলী যুগে সর্দার ছিলেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরও তিনি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন। তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে মাসবুক মুসল্লীর অবস্থানে আছ, যাকে বলা যায় প্রায় কিংবা সুনিশ্চিতভাবে লাহিক হয়েছ। নিশ্চয়ই তুমি অবগত আছ যে, খলিফা ওসমান ইবনে আফফান (রা) হত্যার মাধ্যমে ইসলামে কি বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এসেছি তোমার কাছে, প্রত্যক্ষ দেখা সংবাদের চেয়ে তোমায় অধিক স্বস্তি দেবে। তোমার কাছে আমার এ পত্র পৌঁছানোর পর মানুষকে আলী ইবন আবু তালিব (রা)-এর পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত রাখবে। তুমি স্বগৃহে অবস্থান করতে থাকো, যতক্ষণ না আমার পরবর্তী নির্দেশ তুমি পাও। ওয়াস সালাম।”
কাব্য সাহিত্যে আয়েশা (রা)-এর অবদান: আরব জাতি কাব্য কবিতার সাথে অধিক পরিচিত ছিল। স্বভাবতই তারা ছিল কাব্য প্রিয়। কাব্য ও নারী ছিল তাদের সকল কাজের জীবনী শক্তি। জাহেলী যুগ থেকেই আরবরা কাব্য চর্চায় অভ্যস্ত ছিল। ওকায মেলায় প্রতিবছর উন্মুক্ত কাব্য প্রতিযোগিতা হতো । কারো সম্মান মর্যাদা বর্ণনা বা কারো কুৎসা বা নিন্দা রটনার প্রধান হাতিয়ার ছিল কবিতা । জাহেলী যুগে আরবের কোন কবির স্থান বা মর্যাদার উল্লেখ করতে যেয়ে ইবন রাশীক আল-কায়রোয়ানী বলেন : “আরবের কোন কবি গোত্রের একজন কবি কাব্য জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে অন্যান্য গোত্র কর্তৃক অভিনন্দিত হতো । বিয়ের অনুষ্ঠানের পর মেয়েরা বাদ্য বাজিয়ে ফূর্তি করত। নানা রকম খাদ্যের আয়োজন করা হতো। আবাল, বৃদ্ধা, বণিতা সবাই মিলে উল্লাস করত । কারণ তাদের মতে, একজন কবি হলো মান মর্যাদার রক্ষক, বংশের প্রতিরোধক এবং সুনাম-সুখ্যাতির প্রসারক” ।
ইসলাম আগমনের পরও আরবদের মাঝে কাব্যচর্চার এ শাণিতধারা ব্যাপকভাবে অব্যাহত থাকে। তাদের অনেকেই কাব্যচর্চায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। ইবন কুতায়বা-এর ভাষায় – الشَّعَرَاء الْمَعْرُفُونَ بِالشَّعْرِ عِنْدَ عَشَائِرِ هِمْ وَقَبَائِلِهِمْ فِي
الجَاهِلِيَّةِ وَالْإِسْلامِ أَكْثَرُ مِنْ أَنْ تُحِيْطَ بِهِمْ مُحِيطٌ .
অর্থাৎ, জাহিলী ও ইসলামী যুগে যারা কবিতার জন্য তাদের সমাজ ও গোত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের সংখ্যা এক অধিক যে, কেউ তা গণনা করতে পারবে না ।”
আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন আমাদের নিকট (মদীনায়) আসেন, আনসারদের প্রতিটি গৃহে তখন কাব্য চর্চা হতো। পুরুষদের পাশাপাশি আরবের মেয়েরাও কাব্য চর্চা করতো ।
উম্মুল মু’মিনূন আয়েশা (রা) তাঁর প্রথম স্মৃতিশক্তিকে কুরআন ও হাদীস চর্চার পাশাপাশি কাব্য চর্চা ও তা সংরক্ষণের কাজে লাগিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারেও কাব্য চর্চা হতো। আবূ বকর (রা) নিজেও একজন কবি ছিলেন। আয়েশা (রা)-এর বর্ণনা থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন মদীনায় আগমন করলেন, আবূ বকর (রা) ও বিলাল (রা) মদীনায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমি তাঁদের উভয়ের নিকট গিয়ে বললাম, আব্বাজান! আপনার কেমন লাগছে? হে বিলাল (রা)! আপনার কেমন অনুভূত হচ্ছে? আয়েশা (রা) বলেন : আবু বকর (রা) জ্বরে আক্রান্ত হলে নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করতেন – كُلُّ امْرِي مُصْبِحٍ فِى أَهْلِهِ * وَالْمَوْتُ أَدْنَى مِنْ شِرَاكِ نَعْلِهِ .
“প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিজনের মাঝে দিনাতিপাত করছে, অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী”।
পিতার কাছ থেকেই তিনি কাব্য বিষয়ের বিভিন্ন জ্ঞান তথা এর আঙ্গিক চিত্রকল্প, ছন্দ, লালিত্য, ভাব-ভাষা প্রভৃতি শিখে নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জনেও সক্ষম হয়েছিলেন। মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদের নিম্নের উক্তি তার সাক্ষ্য বহন করে । তিনি বলেন : مَا كُنتُ أَعْلَمُ أَحَدًا فِي أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ وَلَا فَرِيضَةً مِّنْ
“রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবীদের মধ্যে কবিতা ও ফারাইয বিষয়ে আয়েশা (রা)-এর থেকে অধিক জ্ঞানী আর কাউকে জানি না”। তাঁর ভাগিনে উরওয়া ইবন যুবাইরও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ইসলাম পূর্ব ও পরবর্তী যুগে কবিদের অনেক কবিতা আয়েশা (রা)-এর মুখস্থ ছিল । তিনি সে সকল কবিতার অংশ বিশেষ বিভিন্ন সময় উদ্ধৃতি আকারে পেশ করতেন। হাদীসের গ্রন্থাবলিতে তাঁর বর্ণিত কিছু কবিতা বা পংক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।
আয়েশা (রা) এর মাঝে কাব্য রস আস্বাদনের প্রবল আগ্রহ ছিল। অনেক কবি তাদের স্বরচিত কবিতা তাঁকে শুনাতেন। হাসসান ইবন সাবিত (রা) ছিলেন আনসারদের সেরা কবি। ইফকের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁর প্রতি আয়েশা (রা) এর মনোভাব তিক্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আয়েশা (রা)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে কবিতা শুনাতেন । হাসসান ইবন সাবিত (রা) ছিলেন আনসারদের সেরা কবি। হাসসান (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সভা কবি। আয়েশা (রা) বলেন, আমি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছেন : হাসসান! যতক্ষণ তুমি আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে কাব্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করতে থাকবে, জিব্রাইল আমীন (আ)-এর সাহায্য তুমি লাভ করবে। তিনি আরো বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সা:) কে এ কথাও বলতে শুনেছি যে, হাসসান তাদের যথাযথ প্রত্যুত্তর দিয়ে দুশ্চিন্তা ও কষ্ট থেকে মুক্ত করেছেন। এসব কথা বর্ণনার পর আয়েশা (রা) হাসসান ইবন সাবিত (রা) এর নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃতি করেন-
আরবি..
১. “তুমি মুহাম্মদ (সা:) এর কুৎসা রটনা করেছ, আমি তার জবাব দিয়েছি। আমার এ কাজের পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর সমীপে ।
২. তুমি মুহাম্মদের নিন্দা করেছ। অথচ তিনি নেককার, ধার্মিক ও আল্লাহর রাসূল । প্রতিশ্রুতি পালন যার চারিত্রিক ভূষণ।
৩. আমার পিতা-পিতাসহ, আমার মান-সম্মান সবই তোমাদের আক্রমণের হাত হতে মুহাম্মদের মান-সম্মান রক্ষার জন্য ঢালস্বরূপ।
৪. তোমাদের মধ্য থেকে কেউ মুহাম্মদের কুৎসা, প্রশংসা বা সহায়তা করুক না কেন, সবই তার জন্য সমান ।
৫. আল্লাহর বার্তাবাহক ও পবিত্র আত্মা জিব্রাঈল আমাদের মধ্যে আছেন, যার সমকক্ষ কেউ নেই ।
তৃতীয় খলীফা উসমান (রা)-এর শাহাদাত বরণকে কেন্দ্র করে মদীনায় গোলযোগ সৃষ্টি হলে আয়েশা (রা) তা অবহিত হয়ে নিম্নের কাব্য চরণটি আবৃত্তি করেন- আরবি: “যদি আমার সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ আমার কথা মানতো তবে আমি তাদের এ ফাঁদ ও ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারতাম।”
আয়েশা (রা) নিজে যেমন কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন, তেমনি অন্যদের গঠনমূলক কবিতা চর্চা ও অনুশীলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলেন- আরবি: “কিছু কবিতা ভালো আছে, আবার কিছু খারাপও আছে, তোমরা খারাপটি ছেড়ে দিয়ে ভালোটি গ্রহণ কর”।
আয়েশা (রা) আরো বলেন : “তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে কবিতা শিখাও। তা হলে তাদের ভাষা সুমধুর ও লাবণ্যময় হবে”।
এছাড়াও চিকিৎসা, ইতিহাস, কালাম শাস্ত্র, বিবাদমান সমস্যা ও প্রভৃতি বিষয়েও আয়েশা (রা)-এর কম-বেশি দখল ছিল।
মোটকথা উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা) ছিলেন উম্মতে মুহাম্মদিয়ার কাছে একটি নাম, একটি ইতিহাস ও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। হাদীস বিষয়ে তাঁর অনবদ্য অবদান মুসলিম উম্মাহ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। মহিলাবিষয়ক অনেক শারঈ বিধান মুসলিম নারী সমাজ আয়েশা (রা)-এর মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, প্রখর মেধা ও মনন এবং অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা হাদীস সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে । হাদীস ও অন্যান্য বিষয়ে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল অবদান সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন কল্পে বিস্তৃতভাবে ও স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ৷
ওফাত : আমীর মু’আবিয়ার শাসনামলে ৫৮ হিজরীতে ১৭ রমযান ৬৮ বছর বয়সে আয়েশা (রা) ইন্তেকাল করেন। তাঁর ওছিয়ত মোতাবেক রাতের বেলা তাকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। মদীনার তৎকালীন গভর্নর আবূ হুরায়রা (রা) তাঁর সালাতে জানাযা পড়ান। আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের ও ওরওয়াহ বিন জুবায়ের দুই সহোদর জানাযার পর তাঁর লাশ কবরে নামান।
আয়েশা (রা)-এর মৃত্যু সংবাদে ঐ রাতের বেলায়ও পুরুষ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে মহিলার সমাগম ঘটে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ সকলকে এত ব্যথাভুর করেছিল যে, মাসরুক বলেন, ‘নিষিদ্ধ না হলে আমি উম্মুল মু’মিনীনের জন্য মাতমের আয়োজন করতাম ।’ আর আবূ আইউব আনসারী বলেন, ‘আমরা আজ মাতৃহারা শিশুর মতো এতিম হলাম ।’
উৎস: কুরআন হাদীসের আলোকে রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীগণ যেমন ছিলেন বই থেকে। সৌজন্য: পিস পাবলিকেশন -ঢাকা।
আরও পড়তে পারেন:
01. উম্মুল মু’মিনীন সাওদা বিনতে যাম‘আ (রা)
02. উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা)