আজকাল চোখের হেফাযত না করার গুনাহ সাংঘাতিক ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদাসীনতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঘরে, বাইরে, বাজারে, বন্দরে, হোটেল, পার্কে, রাস্তায়, যানবাহনে- এক কথায় সর্বত্রই এই গোনাহের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ মাফ করুণ, বিবাহিত, অবিবাহিত, যুবক, বৃদ্ধ এমনকি অনেক নামাজী লোকও উপযুক্ত চেষ্টার অভাবে এই গোনাহ থেকে বাঁচতে পারছেন না বা অনেকে হয়তো বাচার জন্য তেমন কোনো চেষ্টাও করছেন না। আরো ভয়ের কথা হলো, কিছু কিছু লোক বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করাকে কোনো গুনাহই মনে করছেন না। তাদের বক্তব্য হলো, আমরা তো মেয়েদের দিকে কোনো খারাপ দৃষ্টিতে তাকাই না!
তাদের এ কথার প্রেক্ষিতে বলতে হয়, খারাপ দৃষ্টিতে না তাকালে বেগানা মেয়েদের কে দেখা জায়েজ- এমন কোনো কথা তো কুরআন হাদীসের কোথাও নেই। তবে কি আপনারা স্বীয় প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য এই অন্যায় কর্মকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই নিজেদের পক্ষ থেকে এই খোঁড়া যুক্তি উত্থাপন করছেন? অবস্থাদৃষ্টে তো তা-ই মনে হয়!!
মনে রাখবেন, নিজের পক্ষ থেকে যুক্তি খাঁড়া করে ইসলামী শরীয়তের কোনো বিধি-বিধানকে পরিবর্তন করার কোনো অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি।
চোখের হেফাযত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন- হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন আপন দৃষ্টিকে নত ও সংযত রাখে। অর্থাৎ তারা যেন না-মাহরাম মেয়ে ও নারীদের প্রতি দৃষ্টিপান না করে। অনুরূপভাবে দাড়ি- মোচবিহীন ছেলেদের দিকেও না তাকায়। সহজ কথায়-যার দিকে নযর করলে স্বীয় নফসের মধ্যে হারাম মজা অনুভব হয়-চাই সে না-মাহরাম মেয়ে কিংবা নারী হোক অথবা বালক কিংবা তরুন হোক-তাদের দিকে নযর করা হারাম।
also read : ইসলামে যেনা ব্যভিচারের শাস্তি!
চোখের হেফাযতের বিষয়টি এতবেশি গুরুত্ব পূর্ণ যে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদেরকেও একই বাচন ভঙ্গিতে পৃথক ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন-হে নবী! আপনি মুমিন নারীদেরকেও বলে দিন , তারা যেন (না-মাহরাম পুরুষদের থেকে) আপন দৃষ্টিকে নত ও সংযত রাখে। অথচ আল্লাহ পাক নামাজ , রোজা ইত্যাদির হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষদের কে হুকুম করেছেন, মেয়েদেরকে পৃথক ভাবে হুকুম করেননি। বরং পুরুষদের অধীনে মেয়েরাও সেখানে পুরুষদের কে প্রদত্ত নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-চোখের যেনা হলো-কুদৃষ্টি। (বুখারী, ২য় খন্ড,পৃষ্ঠাঃ ৯২৩) মিশকাত শরীফে বর্ণিত অপর এক হাদীসে নবীজি (সাঃ) বলেন-আল্লাহর লা’নত হোক ঐ পুরুষের উপর যে (কোনো বেগানা নারীকে) দেখে এবং লা’নত হোক ঐ নারীর উপর যে নিজেকে দেখানোর জন্য অন্যের সামনে নিজের রূপ পেশ করে।
এই হাদীসে দেখা যাচ্ছে, যে দেখে এবং যে দেখায় উভয়ের উপরই নবীজি (সাঃ) লা’নত করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের রহমত থেকে বঞ্চিত থাকার বদদোয়া করেছেন। নাউযুবিল্লাহ!!
কেউ কেউ বলে , মেয়েদেরকে একটু দেখলে তেমন কী আসে যায়? আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, বিষয়টি যদি এতই তুচ্ছ ও মামুলি হয়, তাহলে আপনারা দেখেন কেন? অতএব বুঝা গেল, নিশ্চয় এখানে কিছু একটা আছে। আর তাহলো চোখ দ্বারা দেখে অন্তরে হারাম মজা উপভোগ করে যার দ্বারা অন্তর ধ্বংস ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় এবং উহার নূর চলে যায়।
বুজুর্গানে দীন বলেছেন-কুদৃষ্টির গুনাহের দ্বারা আল্লাহ পাক থেকে মানুষের এত বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হয় যা অন্য কোনো গুনাহ দ্বারা হয় না। এই গুনাহের ফলে দিলের রোখ বা কিবলাই পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন মনে করুণ, যদি কারো অন্তরের রোখ আল্লাহর দিকে ৯০ ডিগ্রি থাকে, কুদৃষ্টির ফলে এই রোখ আল্লাহর দিক থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে যায়। অর্থাৎ পূর্বে আল্লাহ পাকের দিকে যে পরিমাণ নৈকট্য ছিল কুদৃষ্টি দানের পর আল্লাহ পাক থেকে তার দ্বিগুণ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। যেন আল্লাহ পাকের দিকে পিঠ আর ঐ নারী কিংবা বালকের দিকেই তার রোখ। যেন আল্লাহকে পিছনে ফেলে সুন্দরী ঐ নর- নারীর দিকেই সে পূর্ণরূপে ধাবমান। ফলে সাধারণ কাজ কর্ম তো বটেই, এমনকি নামাজ পড়ার সময়ও ঐ নর-নারী তার সম্মুখে । তেলাওয়াত কিংবা যিকিরের মধ্যেও সে তার সম্মুখে। নির্জনেও তার ধ্যান, তাকে নিয়েই জল্পনা – কল্পনা । যেখানে সর্বদা ঐ সুশ্রী-মুখের ধ্যান ও স্মরণ। মোটকথা অন্তরের এতবড় ক্ষতি ও বিনাশ আর অন্য কোনো গুনাহের দ্বারা হয় না। যেমন, কেউ যদি নামাজ কাযা করে, অথবা কাউকে কষ্ট দেয় কিংবা মিথ্যা কথা বলে-তাতে অন্তরের রোখ মনে করুণ আল্লাহ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সরে গেল।
পরে যখন সে তাওবা করে নিল বা ঐ ব্যক্তির নিকট ক্ষমা চেয়ে নিল, তখন অন্তরের রোখ পুরোপুরি আল্লাহর দিকে হয়ে গেল। কিন্তু দৃষ্টির হেফাযত না করার গুনাহ এতবেশী ক্ষতিকারক যে, এর ফলে বান্দা আল্লাহ পাক থেকে একেবারে গাফেল হয়ে ঐ সুন্দর – সুদর্শন চেহারাটি তার অন্তরে প্রোথিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই মারাত্মক গুনাহের কারণে কোনো কোনো লোককে ঈমানহারা হয়ে পর্যন্ত মারা যেতে দেখা গেছে। নাউযুবিল্লাহ।
হযরত মাওলানা শাহ হাকীম মুহাম্মদ আখতার সাহেব বলেন, চোখের হেফাযত না করার গুনাহ এমনই মারাত্মক গুনাহ যা পরিত্যাগ করা ব্যতীত কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ওলী হবে দূরের কথা, ওলী হওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারে না।
অবশ্য চোখের হেফাযত করার দারুণ পুরস্কারও আছে। যেমন, কানযুল উম্মাল নামক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার হাদীস-হাদীসে কুদসী বর্ণিত আছে। সেই হাদীসটি হলো-আল্লাহ পাক বলেন, কুদৃষ্টি ইবলীসের তীর সমূহ থেকে একটি বিষাক্ত তীর। যে ব্যক্তি আমার ভয়ে তা বর্জন করবে, এর বিনিময়ে আমি তাকে এমন এক (নবতর) ঈমান দান করব, যার সমধুর স্বাদ সে অন্তরের মধ্যে অনুভব করবে।
আল্লামা কাসেম কুশাইরী (রহঃ) তার রিসালায়ে কুশাইরিয়াতে বলেন- আল্লাহ পাক চক্ষু হেফাযতের নির্দেশ দিয়ে দৃষ্টিপাতের মজাকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে বলেছেন। যার বিনিময়ে তিনি অন্তরের মধ্যে চিরস্থায়ী স্বাদ ও মিষ্টতা করবেন।
মিরকাত নামক গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৭৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে আছে-একবার যদি কারো অন্তরে ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা প্রবেশ করে তা আর কখনো অন্তর থেকে বের হয় না। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) এই হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ পাক তাকে ঈমানের সাথে মউত নসীব করবেন। কারন, ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা কখনোই অন্তর থেকে বের না হওয়ার দ্বারা বুঝা, তার মৃত্যু নিশ্চয় ঈমানের সাথে হবে। এতএব , দৃষ্টি হেফাযত করা ঈমানের সাথে মউত লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলও বটে!
আজকাল এই অমূল্য সম্পদ রাস্তা-ঘাট, মার্কেট – ষ্টেশনে, বিমানবন্দর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সর্বত্র বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। যা ইচ্ছে করলে আপনিও সংগ্রহ করতে পারেন! অর্থাৎ যেসব স্থানে নারীরা বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে ঐসব স্থানে চোখের হিফাযত করে ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতার ভান্ডার এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুর গ্যারান্টি হাসিল করতে পারেন। তাই বলা হয়েছে, বর্তমানে সময়ে বেপর্দা ও উলঙ্গপণা যেমন সীমাহীন তেমনি ঈমানের স্বাদ অর্জনের সুযোগও বিপুল।
সুতরাং আসুন আমাদের দৃষ্টিকে স্বীয় স্ত্রী ও মাহরাম মহিলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি এবং অন্যান্য নাজায়েয ক্ষেত্রে দৃষ্টি ফেলা থেকে যে কোনো মূল্যে বিরত থাকি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুণ।
প্রিয় পাঠক! চোখের হেফাযতের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এর আলোচনাটা একটু দীর্ঘ হয়ে গেল। যদি এ লেখাগুলো পাঠ করে আমরা আমাদের নযরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কঠিন প্রতিজ্ঞা গ্রহন করতে পারি তবেই আমার এ শ্রম পুরোপুরি স্বার্থক হবে।
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম।
এরপর পড়ুন :
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.
Nice story