উম্মুল মু’মিনীন সাওদা বিনতে যাম‘আ (রা)

উম্মুল মু’মিনীন সাওদা বিনতে যাম‘আ (রা) (রাসূল সাঃ এর দ্বিতীয় স্ত্রী)

তুমি সত্যই এ স্বপ্ন দেখে থাকলে আল্লাহর শপথ, আমি মারা যাবো এবং নবীজী তোমাকে বিয়ে করবেন।’

সাওদা (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) এর দ্বিতীয় স্ত্রী, উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের নেতৃস্থানীয়া। খাদীজার ইন্তেকালের পর তিনিই সর্বপ্রথম রাসূল (সাঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সংসারের হাল ধরেন। রাসূল (সাঃ)-এর দুঃখময় জীবনকে সুখময় করে তোলেন ।

সাওদা বিনতে যাম‘আ (রা)

নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম সাওদা। পিতার নাম যাম আ। তাঁর বংশ তালিকা এরূপ- সাওদা বিনতে যাম’আ বিন কায়েস বিন আবদে শামস বিন আবদ বিন নাসর বিন মালেক বিন হাসল বিন আমের ইবনে লুয়াই । তাঁর মাতার নাম ছিল শামুস বিনতে কায়েস বিন যায়েদ বিন আমর বিন লবিদ বিন আমের বিন গণম বিন আদী বিন আন নাজ্জার। মাতা শামুস ছিলেন মদীনার নাজ্জার বংশের মেয়ে।

জন্ম : সাওদা ৫৬৫/৫৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশের একটি প্রসিদ্ধ শাখা লুওয়াই বিন আমের গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।

প্রথম বিবাহ : সাওদা (রা)-এর প্রথম বিয়ে হয় তাঁর পিতার চাচাত ভাই সাকরান বিন আমরের সাথে। যিনি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণ ও হিজরত : ইসলামের সূচনা লগ্নেই তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আত্মীয়-স্বজনের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসলাম কবুল করেন। শুধু তাই নয়, তাদের নিকটাত্মীয়দের জুলুম-অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁরা রাসূল (সাঃ) এর পরামর্শ অনুযায়ী আবিসিনিয়া হিজরত করেন। এ আবিসিনিয়াতেই তাদের একমাত্র সন্তান আবদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে আবদুর রহমান হালুলার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

প্রথম স্বামীর ইন্তেকাল : সাকরান দম্পতি আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফেরার কিছুদিন পরই সাকরান ইন্তেকাল করেন। মক্কায় তাকে সমাহিত করা হয় ৷

রাসূল (সাঃ) এর সাথে বিবাহের স্বপ্ন : সাকরানের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে সাওদা (রা) স্বপ্নে দেখেন, নবী (সাঃ) আগমন করে তাঁর কাঁধে কদম (পা) মুবারক স্থাপন করেছেন।’ তিনি স্বামী সাকরান (রা)-কে স্বপ্ন খুলে বললে তিনি বলেন, ‘তুমি সত্যই এ স্বপ্ন দেখে থাকলে আল্লাহর শপথ, আমি মারা যাবো এবং নবীজী তোমাকে বিয়ে করবেন।’ সাওদা (রা) পুনরায় স্বপ্ন দেখেন যে, ‘তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন, আকাশের চাঁদ ছুটে এসে তাঁর মাথায় পড়ছে।’ এ স্বপ্ন সম্পর্কেও সাকরানকে জানালে তিনি বলেন, ‘আমি খুব সহসা মৃত্যুবরণ করব এবং আমার পরে তুমি বিয়ে করবে।’ সাকরান (রা) সে দিনই অসুস্থ হন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ইন্তেকাল করেন।

স্বামী সাকরানের মৃত্যুর পর শিশুপুত্র আবদুর রহমানকে নিয়ে সাওদা (রা) অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করতে থাকেন। মুসলমান হওয়ার কারণে আত্মীয়-স্বজনরাও তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এ সময়ে একান্ত অনন্যোপায় হয়ে তিনি শিশুপুত্রসহ রাসূল (সাঃ) এর এক দূর সম্পর্কীয় খালা খাওলার বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওলার অবস্থাও অস্বচ্ছল ছিল। তবুও ধৈর্য, সংযম ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক সাওদা অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়েই আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের চেষ্টা করে যেতে লাগলেন।

চিন্তিত রাসূল (সাঃ): পৃষ্ঠপোষক চাচা আবূ তালিবের মৃত্যু সর্বোপরি খাদীজার মৃত্যুতে রাসূল খুবই মনকষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছিলেন। মা হারা মাসুম বাচ্চা উম্মু কুলছুম ও ফাতিমাকে নিয়েই বেশি চিন্তার মধ্যে ছিলেন তিনি I এমন কি ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম রাসূল (সাঃ)-কে নিজ হাতেই সম্পাদন করতে হচ্ছিল। যা একজন পুরুষ মানুষের জন্য ছিল সত্যিই কষ্টসাধ্য। প্রকৃতপক্ষে সংসারে এ অব্যবস্থাপূর্ণ শোচনীয় পরিস্থিতিতে সন্তানদের লালন-পালনের জন্য রাসূল (সাঃ) এর একজন জীবন সাথীর জরুরি প্রয়োজন ছিল। মূলত খাদীজাবিহীন নবীর সংসার জীবন অনেকটা মাঝিবিহীন নৌকার মত বেশামাল অবস্থায় পৌঁছেছিল।

সাওদার বিবাহের ব্যবস্থাপনা : রাসূল (সাঃ) এর সংসারের এ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে একদিন তাঁর খালা উসমান বিন মাযউন-এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম নবীগৃহে এসে দেখেন যে- রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে থালা-বাসন পরিষ্কার করছেন। তখন তিনি রাসূল (সাঃ) কে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেগুলো পরিষ্কার করেন এবং বিনীতভাবে রাসূল (সাঃ) কে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! খাদীজার ইনতিকালে তোমাকে অত্যন্ত বিষণ্ন দেখছি।’ বললেন, ‘ঠিক! ব্যাপার তো তাই।’ তখন খাওলা বললেন, “হে মুহাম্মদ! বর্তমানে তোমার সংসারে একজন পরিচর্যাকারিণীর প্রয়োজন।

সুতরাং তুমি যদি অনুমতি প্রদান কর তাহলে সাওদা বিনতে যাম আর সাথে তোমার বিয়ে দিতে পারি। সাওদা খুবই নিরীহ, অসহায় ও খুবই ভালো। তাঁর স্বভাব-চরিত্র ও সহিষ্ণুতার যে পরিচয় আমি পেয়েছি, এতে তাঁর মতো একজন রমণী তোমার গৃহে আসলে তোমার কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে। সাওদা তোমার সংসারকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।’ নবী করীম (সাঃ) এ প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং ঐ দিনই খাওলা সাওদাকে সুসংবাদ শুনান। সাওদা তা কবুল করলে খাওলা সাওদার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। সাওদার মা খ্রিস্টান ছিলেন তবুও তিনি বললেন, “কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে আমার মেয়ে বিয়ে দিতে আমি রাজি আছি।’

রাসূল (সাঃ) এর সাথে সাওদার বিয়ে : সাওদা ও তাঁর পিতা বিয়েতে রাজি হওয়ায় রাসূল (সাঃ) নিজে সাওদার পিতার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। চারশত দিরহাম মোহরানা ধার্য করে সাওদার পিতা নিজে খুতবা প্রদান করে বিয়ে পড়ান। কিন্তু সাওদার ভাই আবদুল্লাহ এ বিয়ের খবর জানার পর প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, এমন কি নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে মাথা ও কপালে ধূলাবালি মাখিয়ে বলেছিলেন, ‘হায় কি সর্বনাশ হলোরে? পরে যখন তিনি ইসলাম কবুল করেন তখন তার এ জঘন্য উক্তির জন্য সব সময় আফসোস করতেন।

যে বিয়ের পর পরই সাওদা রাসূল (সাঃ) এর সংসারে চলে আসেন এবং বাচ্চাদের লালন-পালনসহ গৃহের সব দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। ফলে রাসূল (সাঃ) যে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তা থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন এবং ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। 

রাসূল (সাঃ) ও সাওদার যখন বিয়ে হয় তখন রাসূল (সাঃ) এর বয়স ৫০ বছর আর সাওদা (রা)-এর বয়স ৫০/৫৫ বছর। হিযরতের প্রায় তিন বছর পূর্বে সাওদা মহানবী (সাঃ) এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। নবুওয়্যাতের দশম বছর রমযান মাস হতে শুরু করে একাদশ হিজরীর রবিউল আওয়াল পর্যন্ত আনুমানিক সাড়ে বারো বছর পর্যন্ত তিনি নবী করীম (সাঃ) এর পবিত্র সাহচর্য লাভ করেন। জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে নবুওয়্যাতের দশম বছরের রমযান হতে ১ম হিজরীর শাওয়াল পর্যন্ত তিনি এককভাবে নবী পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।

অত:পর ক্রমান্বয়ে মহানবী (সাঃ) এর অপরাপর জীবন-সঙ্গিনীগণ আগমন করতে থাকেন এবং সাওদা (রা)-এর দায়িত্বও হ্রাস পেতে থাকে। হিজরতের ১ম/২য় বছর রাসূল (সাঃ) আয়েশা (রা)-কে বিয়ে করেন। এ সময় আয়েশা (রা)-এর বয়স ছিল ৬/৭/৮/৯ বছর। আয়েশা (রা) বিয়ের ৩ অথবা ৪ বছর পর রাসূল (সাঃ) এর সংসারে আসেন। অর্থাৎ রাসূল (সাঃ) এর সাথে তার বাসর হয়েছিল ৯/১০/১১/১২/১৩ বছরের সময়। এ অসম বয়সের বিয়ের ব্যাপারে অর্থাৎ বৃদ্ধা ও শিশুকে বিয়ে করার ব্যাপারে ইসলাম বিরোধী ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ সমালোচনামুখর হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু রাসূল (সাঃ) ছিলেন মানবতার বন্ধু। ইচ্ছে করলে তিনি খাদীজার মৃত্যুর পরও আরবের সেরা সুন্দরী যুবতীদের যে কাউকে বিয়ে করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি সম্পূর্ণ বৃদ্ধা, বিধবা ও মোটা একজন মহিলাকে বিয়ে করলেন। কারণ সাওদা ছিলেন একজন অসহায় বিধবা। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁর আত্মীয়-স্বজন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) এ সহায়হীন মুসলিম মহিলার কল্যাণের চিন্তা করেই তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। অপরদিকে তাঁর শিশু কন্যা উম্মু কুলছুম ও ফাতিমা’র কথা চিন্তা করেও তিনি বৃদ্ধা সাওদাকে ঘরে তুলে নেন।

আরও জানুন: নবীজির ছেলেদের নাম ও মেয়েদের নাম

কিশোরী আয়েশাকে রাসূল (সাঃ) এর বিয়ে করার ব্যাপারে কথা হচ্ছে- জাহেলী যুগে আরবে প্রচলিত ছিল আরবরা কথিত ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে কোনো বিয়ের সম্পর্ক করত না। রাসূল (সাঃ) ও আয়েশা (রা) এর বিয়ে সে কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত হানলো । তাছাড়া এ বিয়েটা হয়েছিল মূলত আল্লাহরই নির্দেশে।

আকৃতি : সাওদা (রা) ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী ও সুন্দরী। তাঁর দৈহিক গঠন ছিল চমৎকার। তবে তিনি একটু মোটা ধরনের ছিলেন, যে কারণে দ্রুত চলাফেরা করতে কষ্ট হতো । তিনি ছিলেন বৃদ্ধিমতি ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্না।

পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়া : তিনি বিদায় হজ্জের সময় মুজদালিফা থেকে রওয়ানা হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রওয়ানা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু মহানবী (সাঃ) তা অনুমোদন করেননি। শেষ পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) এর সাথেই তাঁকে রওয়ানা হতে হয়। একদিন প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য ভোররাতে খোলা মাঠের দিকে (তখনো পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি) সাওদা গমন করেন। ফেরার পথে ওমর (রাঃ) তাকে চিনে ফেলেন । ওমর (রা) তাঁকে তখন বলেন, ‘আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি।’ বিষয়টি সাওদা (রা) ও ওমর (রা) কেউই পছন্দ করেননি। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করেন। এর পর পরই পর্দার আয়াত নাযিল হয়। 

وَقَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاہِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی وَاَقِمۡنَ الصَّلٰوۃَ وَاٰتِیۡنَ الزَّکٰوۃَ وَاَطِعۡنَ اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ ؕ  اِنَّمَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیُذۡہِبَ عَنۡکُمُ الرِّجۡسَ اَہۡلَ الۡبَیۡتِ وَیُطَہِّرَکُمۡ تَطۡہِیۡرًا ۚ

অর্থ: আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে। হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চাহেন তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে । [সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩৩]

রাসূলের নির্দেশ পালন : রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্জের পর তার পবিত্র স্ত্রীদেরকে বলেন, ‘অতঃপর আর ঘরের বাইরে যাবে না।’ আবূ হুরাইরা (রা) থেকে জানা যায় নবী (সাঃ) এর ওফাতের পরও অন্যান্য স্ত্রীরা হজ্জ করেন। কিন্তু সাওদা বিনতে যাম’আ ও যয়নব বিনতে জাহাশ এ নির্দেশটি এমন কঠোরভাবে মেনে চলেন যে আর ঘরের বাইরে যাননি। তিনি বলতেন, ‘আমি হজ্জ করেছি, ওমরাহ করেছি। এখন আল্লাহর নির্দেশ মতো ঘরে বসে কাটাবো।’

রাসূলকে খাদীজার মতো আশ্রয় দান : সাওদা (রা) যখন রাসূল (সাঃ)  এর ঘরণী হয়ে আসেন তখন তাঁর ওপর শত্রুদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন নেমে এসেছিল। সাওদা স্বামীর এ দুঃখ-কষ্ট ও মর্মযাতনার বিষয় উপলব্ধি করে সর্বদা তাঁর কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতেন। খাদীজার মতই সাওদা তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে স্বামীর সংকটকালের মোকাবিলা করেছেন। নিঃসন্দেহে সাওদা (রা) এসব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠস্থানীয়া ছিলেন।

সৎ সন্তানকে মায়ের মতো সোহাগদান : সাওদা (রা) নবী নন্দিনী উম্মু কুলছুম ও ফাতিমাকে এমনভাবে লালন-পালন করেন যে, তাঁরা কোন দিনই তাদের মায়ের অভাব অনুভব করেননি। তিনি কুলছুম ও ফাতেমাকে খুবই আদর করতেন ।

জীবনচরিত : স্বল্প ভাষিণী, মধুর আচরণকারিণী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্না পবিত্ৰ প্ৰাণা নারী ছিলেন সাওদা (রা)। অতিথিপরায়ণতা ও দানশীলতার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

একবার ওমর (রা) উপহারস্বরূপ একটি থলে ভর্তি দিরহাম সাওদা (রা) এর নিকট পাঠালেন। সাওদা (রা) থলে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর ভিতরে কি আছে? বলা হল, ‘দিরহাম।’ এ কথা শুনে সাওদা (রা) বললেন, ‘খেজুরের থলেতে কি দিরহাম শোভা পায়?’ এ বলে তিনি সমস্ত দিরহাম গরীব মিসকীনের মধ্যে বিলি করে দিলেন।

সাওদা (রা) ছিলেন বেশ রসিক মহিলা। মাঝে মাঝে তিনি এমন এমন রসিকতাপূর্ণ কথা বলতেন যে, রাসূল (সাঃ)ও হেসে ফেলতেন। একবার তিনি রাসূল (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কাল রাতে আমি আপনার সাথে সালাত পড়ছিলাম। আপনি রুকুতে এত দেরী করছিলেন যে, আমার সন্দেহ হয়েছিল নাক ফেটে রক্ত ঝরবে। এ কারণে আমি আমার নাক অনেকক্ষণ টিপে ধরেছিলাম।’ রাসূল সা এ কথা শুনে মুচকি হাসলেন।

সাওদা (রা) সে উদার মহিলা যিনি সপত্নী আয়েশার জন্য ছাড় দিতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) এর খেদমতে বলেছিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) আমার জন্য যে রাত আপনার সান্নিধ্যে থাকা বরাদ্দ আছে, সে রাতটুকু আমি আয়েশাকে দান করলাম। সে কুমারী, আল্লাহ আপনার সান্নিধ্য ও সাহচর্য দ্বারা তাকে অধিক উপকৃত করুন, এটাই আমার কামনা।’ রাসূল (সাঃ)ও শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, ‘সাওদা! প্রকৃতই তুমি অনন্যা। প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুৰ্থ হিজরী সনে আয়েশা (রা) স্বামী গৃহে আসলে সাওদা (রা) তাঁকে অত্যন্ত আপন করে নেন। গার্হস্থ জীবনের অধিকাংশ বিষয়ে সাওদা (রা) ছিলেন আয়েশা (রা)-এর বান্ধবী।

তিনি আয়েশা (রা)-কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। রাসূল (সাঃ) এর ঘরে আসার পর সাওদা (রা) নিজেই আয়েশার সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেন। এ জন্যই আয়েশা (রা) তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আমি কেবল একজন মহিলার কথাই জানি, যার অন্তরে হিংসার ছোঁয়া মোটেই পড়েনি। তিনি হলেন সাওদা । কতইনা ভালো হতো যদি আমার অন্তর তার দেহে স্থান লাভ করত।’

কতখানি উদার ও মহৎ হৃদয়ের মানুষ হলে এটা সম্ভব? সম্ভবত সাওদা (রা) বলেই তা সম্ভব হয়েছিল।

عَنْ عَائِشَةَ أَنْ سَوْدَةَ بِنْتَ زَمْعَةَ (رضى) وَهَبَتْ يَوْمَهَا لِعَائِشَةَ وَكَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقْسِمُ لِعَائِشَةَ بِيَوْمِهَا وَيَوْمِ سَوْدَةَ .

আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। সাওদা বিনতে যাম’আ (রা) তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর রাত যাপনের পালা আয়েশা (রা)-কে দিয়ে দেন। সুতরাং রাসূল (সাঃ) আয়েশা (রা)-এর জন্য (দু’দিন বরাদ্দ করেন), একদিন তার নিজের অন্যদিন সাওদার (রা)। (বুখারী)

রাসূল (সাঃ) এর ঔরসে সাওদা (রা)-এর গর্ভে কোন সন্তান জন্ম লাভ করেনি ৷ প্রথম স্বামী সাকরাণের ঔরসে আবদুর রহমান নামে একজন পুত্র সন্তান ছিলেন। যাঁর কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

হাদীসশাস্ত্র শিক্ষা ও সম্প্রসারণে তাঁর অবদান!

হাদীস শিক্ষা ও সম্প্রসারণে সাওদা (রা) অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি সর্বমোট ৫টি হাদীস বর্ণনা করেন। এর মধ্যে বুখারী শরীফে একটি হাদীস উল্লেখ আছে। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস, ইয়াহইয়া বিন আবদুর রহমান বিন আস, আদ বিন জাররার মত বিখ্যাত সাহাবীরা তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বুখারী শরীফে বর্ণিত তাঁর হাদীসটি হল-

عنْ ابْنِ عَبَّاس (رضى) عَنْ سَودَةَ (رضى) زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ : مَانَتْ لَنَا شَاءً فَدَبَغْنَا مَسْكَهَا ثُمَّ مَازَلْنَا نَنْبَدُ فِيهِ حَتَّى صَارَ شَنَّا .

ইবনে আব্বাস (রা) উম্মুল মু’মিনীন সাওদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : আমাদের একটি বকরী মারা গেলে আমরা এর চামড়া পরিশোধন (দাবাগাত) করলাম। এরপর আমরা তাতে পানি ঢেলে খেজুর রাখতে লাগলাম। এমনকি তা একটি বিশেষ চর্ম থলেতে পরিণত হলো।

এ ছাড়া তাঁর থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসের মধ্যে রয়েছে-তিনি বলেন : জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, আমার পিতা অতি বৃদ্ধ, হজ্জ করার শক্তি তাঁর নেই। নবী করীম (সাঃ) বললেন : তোমার পিতার ওপর যদি ঋণ থাকে, আর তা যদি তুমি আদায় করে দাও, তবে কি তা তোমার থেকে গ্রহণ করা হবে? সে বলল : হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : আল্লাহ অধিক দয়ালু, তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ কর। 

সাওদা বিনত যাম’আ (রা) বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে বললাম, আবু যাম’আ তাঁর এক দাসীর সন্তান (উম্মু ওয়ালাদ) রেখে মারা গিয়েছে। ভূমিষ্ঠ সন্তান আমাদের ধারণাকৃত লোকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) তাকে বললেন : তুমি তার থেকে পর্দা কর। সে তোমার ভাই এর থেকে নয়। আর তার উত্তরাধিকার থাকবে। 

ওফাত : রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের পর প্রায় এগার বছর জীবিত ছিলেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আপন ভূমিকা পালন করেন। ৭৫ বছর বয়সে সাওদা (রা) ইন্তেকাল করেন। মদীনার জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যু সন নিয়ে মতভেদ আছে। ওয়াকিদীর মতে আমির মু’আবিয়ার শাসনামলে ৫৪ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। আর ইবনে হাজারের মতে ৫৫ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইমাম বুখারী (র) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ওমর (রা)-এর খেলাফতের সময় ২২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

উৎস: কুরআন হাদীসের আলোকে রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীগণ যেমন ছিলেন  বই থেকে। 

সৌজন্য: পিস পাবলিকেশন -ঢাকা। 

Leave a Comment