কিভাবে আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, অফিসের সহকর্মী কিংবা আপনার অধীনস্ত কর্মকর্তাদের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করবেন কিংবা ভারসাম্য আচরণের দ্বারা তাদেরকে বিমোহিত করবেন এবং তারই সাথে আপনার স্বার্থ্য, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ করবেন তা শিখতে সম্মানিত লেখকের “ভারসাম্য রক্ষা করুন” আর্টিকেলটি পড়ুন।
ভারসাম্য রক্ষা করুন! (Lifestyle Tips 33)
আপনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। একজন শিক্ষক সকালে প্রায়শ দেরি করে আসে। আপনি তাকে কিভাবে সতর্ক করবেন? এভাবে বলুন, শিক্ষকতার পেশা বেছে নেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ছাত্রদেরকে বােঝানাের চমৎকার যােগ্যতা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন। ছাত্ররা আপনাকে অত্যন্ত ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। তবে আমি আশা করি, আপনি সকালে সব সময় দেরি করে আসবেন না।’
সন্তানদের পােশাকের ব্যাপারে আপনার স্ত্রী খুব অসচেতন। আপনি তাকে সতর্ক করতে চান। খোচা না দিয়ে এভাবে বলুন: তুমি নিজে দেখতে খুব সুন্দরী। মাশাআল্লাহ! ঘরও বেশ পরিপাটি। সংসার ও সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে গিয়ে তােমাকে অনেক কষ্ট করতে হয় এটা আমি অস্বীকার করি না। তারপরও আমি আশা করি সন্তানদের পােশাকের প্রতি তুমি আরও যত্নবান হবে।
বস্তুতঃ মানুষের সঙ্গে একজন সদাচারী ব্যক্তির কথার স্টাইল এমনই হওয়া উচিত। যে ভুল করে ফেলেছে তার সামনে প্রথমে তার ভাল ও সুন্দর দিকগুলাে উল্লেখ করবেন। এরপর তার ভুল সম্পর্কে সতর্ক করবেন। এটিই ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের দাবি ।
যখনই আপনি কোনাে অপরাধী ব্যক্তির কোনাে দোষ-ত্রুটি দেখবেন, প্রথমে তার ভাল দিকগুলাে স্মরণ করার চেষ্টা করুন। আপনার সামনের ব্যক্তিটির প্রতি আপনার ধারণা ভাল । এটা তাকে বােঝাতে চেষ্টা করুন।
যখন তার কোনাে ভুল সম্পর্কে তাকে সতর্ক করবেন তখন সে যেন না ভাবে যে, আপনার দৃষ্টিতে সে অনেক ছােট ও তুচ্ছ হয়ে গেছে কিংবা আপনি তার ভাল কাজগুলাের কথা ভুলে গেছেন এবং শুধু মন্দ কাজগুলাের কথাই মনে রেখেছেন।
তার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ যেন এমন হয় যে, সে যেন ভাবতে পারে, আপনি তার ভাল গুণগুলােও মনে রাখেন। রাসূল সাহাবীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন। কারণ, তিনি তাদের সঙ্গে উন্নত ও উৎকৃষ্ট আচরণশৈলী প্রয়ােগ করতেন।
একবার তিনি সাহাবীদের মাঝে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি কোনাে কিছু গভীরভাবে ভাবছেন কিংবা কোনাে কিছুর প্রতীক্ষায় আছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘বর্তমান সময়টা হলাে মানুষের কাছ থেকে ইলম ও জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়ার সময়। এর বিরুদ্ধে মানুষ কিছুই করতে পারবে না।
অর্থাৎ মানুষ কুরআন ও তার শিক্ষা হতে বিমুখ হবে। শরীয়তের ইলমের প্রতি উদাসীন হয়ে যাবে। তা শেখার প্রতি কারাে আগ্রহ থাকবে না এবং কেউ তা বুঝতেও সক্ষম হবে না। ফলে তা মানুষের অন্তর থেকে উঠে যাবে।
এ কথা শুনে মহান সাহাবী যিয়াদ বিন লাবীদ আনসারী দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি খুব আগ্রহভরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইলম কীভাবে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে? আমরা তাে বর্তমানে কুরআন তিলাওয়াত করি । ভবিষ্যতেও নিজেরা কুরআন তেলাওয়াত করব এবং আমাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে তা শিক্ষা দেব।’
রাসূল সাঃ তার দিকে তাকালেন। দেখলেন ধর্মীয় চেতনা, উদ্দীপনা ও আত্মমর্যাদাবােধে টইটম্বুর টগবগে এক যুবক। তিনি তার বােধ ও চিন্তাশক্তিকে আরও শানিত করতে চাইলেন।
তিনি বললেন, ‘যিয়াদ! এ কী বলছ তুমি, আমি তাে তােমাকে মদিনার অন্যতম ফকীহ ও প্রাজ্ঞ হিসেবে জানি।’ এ কথা বলে রাসূল তা সকলের সামনে যিয়াদের প্রশংসা করলেন। তাকে মদিনার অন্যতম ফকীহ ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করলেন। এটি হলাে যিয়াদের ভাল এবং উত্তম গুণের আলােচনা। তার আলােকিত দিকের কথা।
এরপর বললেন, “দেখ, তাওরাত ও ইঞ্জীল ইহুদি-খৃস্টানদের কাছে বিদ্যমান আছে। কিন্তু তা তাদের কী কাজে আসে?
অর্থাৎ রাসূল তাকে বােঝাতে চাচ্ছিলেন, কুরআন বিদ্যমান থাকা আসল উদ্দেশ্য নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য হলাে কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি তার অর্থ বােঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।’ সাহাবীদের সঙ্গে আল্লাহর রাসূলের আচরণ এমনই ভারসাম্যপূর্ণ ছিল।
আরেকদিন আল্লাহর রাসূল সাঃ আরবের কয়েকটি গােত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাদের ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেন। প্রজ্ঞাপূর্ণ, চিত্তাকর্ষক কথার মাধ্যমে তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। আহবান জানালেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।
তাদের মধ্যে একটি গােত্রের নাম ছিল ‘বনু আবদুল্লাহ। তিনি তাদেরকেও আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন। তাদের সামনে উত্তম আদর্শ তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, “হে বনু আবদুল্লাহ! আল্লাহ তাআলা তােমাদের পিতৃপুরুষের নামটিকে সুন্দর করেছেন। তােমরা বনু আবদুল উযযা’ নও, ‘বনু আবদুল লাত’ও নও; বরং তােমরা হলে বনু আবদুল্লাহ’ । তােমাদের নামের মধ্যে কোনাে শিরক নেই। অতএব তােমরা ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নাও।
আল্লাহর রাসূল সাঃ এর একটি উত্তম বৈশিষ্ট্য হলাে, তিনি মানুষের কাছে পরােক্ষ বার্তা পাঠাতেন। বার্তায় তিনি তাদের প্রতি তার ভাললাগা, কল্যাণকামিতা ও অনুভূতির কথা বলতেন। চিঠি ও বার্তা যখন প্রাপকের কাছে পৌছত তখন অনেক সময় তা সরাসরি দাওয়াতের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলত।
খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন একজন বীরযােদ্ধা। তিনি সাধারণ কোনাে বীর ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী মহান বীর। যুদ্ধের ময়দানে তার মূল্য ছিল অপরিসীম। সে রণক্ষেত্রে থাকলে প্রতিপক্ষকে অনেক হিসাব কষতে হতাে। আল্লাহর রাসূল একাকার আন্তরিকভাবে তার ইসলাম গ্রহণ কামনা করতেন। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? খালিদ তাে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে অগ্রগামী সৈনিক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনাে যুদ্ধে সে পিছপা হয় নি; বরং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলাে খালিদ বিন ওয়ালিদের কৌশলী ভূমিকা।
একদিন রাসূল তাে তার সম্পর্কে বললেন, ‘সে যদি আমাদের কাছে আসত তাহলে আমরা অবশ্যই তাকে মূল্যায়ন করতাম এবং অন্যদের চেয়ে তাকে প্রাধান্য দিতাম। এ কথার প্রভাব কেমন ছিল?
এটা জানতে আমাদেরকে একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। খালিদ তখন ইসলামের চরম শত্রু। কট্টরপন্থী কাফের এবং কাফের দলের শীর্ষস্থানীয় সেনানায়ক। সুযােগ পেলেই রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতাে এবং রাসূলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওঁৎ পেতে বসে থাকত। এরই মধ্যে একসময় আল্লাহর রাসূল সাঃ মুসলমানদের নিয়ে ওমরা করার জন্য হুদাইবিয়া পর্যন্ত আসলেন।
খালিদ মুশরিকদের একদল অশ্বারােহী নিয়ে রওয়ানা করলাে। এক পর্যায়ে উসফান নামক স্থানে আল্লাহর রাসূল ও সাহাবীদের সঙ্গে মুখখামুখি হলাে। খালিদ কাছেই দাঁড়িয়ে রাসূলের ওপর তীর নিক্ষেপ করার কিংবা তরবারী দিয়ে আঘাত করার সুযােগ খুঁজছিল।
সে ওঁৎ পেতে সুযােগের অপেক্ষা করছিল। ইত্যবসরে আল্লাহর রাসূল এই সাহাবীদের নিয়ে জামাতের সাথে জোহরের নামায আদায় করলেন। তারা এ সুযােগে হামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। আল্লাহর রাসূল শত্রুদের অপতৎপরতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই তিনি আসরের নামায যুদ্ধকালীন পদ্ধতিতে আদায় করলেন। অর্থাৎ সাহাবীদের দু’দলে ভাগ করে একদলকে পাহারায় রেখে অপর দলকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। বিষয়টি খালিদ ও তার সঙ্গীদের মনে প্রভাব ফেলল। সে মনে মনে ভাবল, ‘এ লােক তাে খুব সংরক্ষিত। এখানে নিশ্চয় এমন কোনাে সত্তা আছেন, যিনি তাকে হেফাযত করেন এবং সবধরণের ক্ষতি হতে তাকে নিরাপদ রাখেন।
তারপর আল্লাহর রাসূল সাহাবীদের নিয়ে রওয়ানা হলেন এবং ঝামেলা এড়াতে ডান দিকের পথ ধরে চলতে লাগলেন, যেন খালিদ এবং তার সঙ্গীদের মুখােমুখি না হতে হয়। আল্লাহর রাসূল হুদাইবিয়ায় পৌঁছে। কুরাইশদের সঙ্গে পরবর্তী বছর ওমরা করার জন্য সন্ধিচুক্তি করলেন। তারপর মদিনায় ফিরে এলেন।
খালিদ লক্ষ্য করে দেখলাে, দিনে দিনে আরবে কুরাইশদের মান-মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবতে লাগল, অবশিষ্ট আর কী আছে? আমি কোথায় যাব? কার কাছে যাব?
আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কাছে? না! সে তাে মােহাম্মদের অনুসারী হয়ে গেছে। মােহাম্মদের সঙ্গীরা তার আশ্রয়ে নিরাপদে থাকে।
তবে কি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে যাব? নাহ! তার কাছেও যাওয়া যাবে না।’
নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করব? না ইহুদী ধর্ম? না-কি আরবের বাইরে কোথাও গিয়ে বসবাস করব?’ এভাবে খালিদ চিন্তিত ও দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। এ অবস্থায় এক বছর পার হয়ে গেল। মুসলমানদের ওমরার সময় সমাগত হলাে। তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
রাসূল (সাঃ) মক্কায় প্রবেশ করলেন। যে মুসলমানদেরকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সে তার জানপ্রাণ সব নিয়ােজিত করেছে সে মুসলমানদেরকে এহরাম পরিহিত অবস্থায় মক্কায় প্রবেশের দৃশ্য খালিদ সহ্য করতে পারল । সে মক্কা থেকে বের হয়ে গেল। যে চারদিন রাসূল সাঃ ওমরা আদায়ের জন্য মক্কায় অবস্থান করলেন, সেই চারদিন মক্কার বাইরে অবস্থান করলাে। ওমরা সম্পাদন করে আল্লাহর রাসূল ও মক্কার পথঘাট আর ঘর-বাড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। অতীতের পুরােনাে স্মৃতিগুলাে তার স্মৃতির এ্যালবামে ভেসে উঠছিল। এই সে মক্কা! যেখানে তিনি জন্ম নিয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন, কৈশাের ও যৌবন পেরিয়ে নবুয়ত পেয়েছেন। এই সেই হেরা গুহা! যেখানে তিনি ধ্যানমগ্ন হতেন। এই সেই মক্কা! যেখানে ইসলাম ও শান্তির পথে আহ্বান জানানাের অপরাধে তাকে ও তার অনুসারীদেরকে চরমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। তাঁর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠল এখানকার বাসিন্দাদের অনেকের প্রতিচ্ছবি। ভেসে ওঠল বীর সৈনিক খালিদ বিন ওলিদের প্রতিমূর্তি। খালিদের ভাই ওলিদ বিন ওলিদের দিকে তাকালেন। ওলিদ ছিলেন মুসলমান। তিনি আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে ওমরা করার জন্য এসেছিলেন।
রাসূল (সাঃ) ইসলামের প্রতি আহ্বান সম্বলিত একটি পরােক্ষ বার্তা খালিদের কাছে পাঠাতে চাইলেন। তিনি ওলিদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খালিদ কোথায়? ওয়ালিদ তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসবেন।
রাসূল বললেন, তার মতাে বিচক্ষণ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে না। সে যদি তার শক্তি ও ক্ষিপ্রতা মুসলমানদের পক্ষে ব্যবহার করত তাহলে এটা তার জন্য অনেক মঙ্গলজনক হতাে।
এরপর রাসূল সাঃ বললেন, যদি সে আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তাকে মূল্যায়ন করব এবং অন্যদের চেয়ে তাকে প্রাধান্য দেব।”
এ কথা শুনে ওলিদের খুশির সীমা রইল না। সে মক্কার বিভিন্ন স্থানে খালিদকে তালাশ করতে লাগল । কিন্তু কোথাও তাকে পেল না। তাই সে মদিনায় ফিরে আসার আগে তার ভাইয়ের কাছে একটি চিঠি লিখল। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। পরকথা হলাে, তুমি এখনাে ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে আছ। আমার কাছে এরচেয়ে আশ্চর্যের আর কিছু নেই। তােমার মতাে বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ মানুষ মক্কায় আর কয়জন আছে? বল তাে, ইসলামের মতাে মহান সম্পদ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা কি তােমার সাজে? আল্লাহর রাসূল আমাকে তােমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন, খালিদ কোথায়? আমি বললাম, “আল্লাহ তায়ালা তাকে অচিরেই আমাদের নিকট নিয়ে আসবেন। তিনি বলেছেন, তার মতাে বিচক্ষণ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে না। সে যদি তার শক্তি ও ক্ষিপ্রতা মুসলমানদের পক্ষে ব্যবহার করত তাহলে এটা তার জন্য অনেক মঙ্গলজনক হতাে।
তিনি আরাে বলেছেন, যদি সে আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তাকে মূল্যায়ন করব এবং অন্যদের চেয়ে তাকে প্রাধান্য দেব।
কাজেই ভাই আমার! যেসব সুযােগ হাতছাড়া হয়ে গেছে তার কথা না ভেবে সামনের কথা চিন্তা কর। ক্ষতিপূরণে সচেষ্ট হও। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নাও।
খালিদ (রাঃ) বলেন, “চিঠিটি হাতে পেয়ে আমার ভেতর কুফরির অন্ধকার থেকে বের হয়ে ইসলাম গ্রহণ করার এক আশ্চর্য উদ্যম সৃষ্টি হলাে। বিশেষত রাসূল আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন এ বিষয়টি আমাকে পুলকিত করলাে। এরই মধ্যে একদিন স্বপ্নে দেখলাম, আমি যেন এক সংকীর্ণ-উষর ভূমিতে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে এক প্রশস্ত-সবুজ ভূমিতে গেলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম, এটা নিশ্চয় সত্য স্বপ্ন।
আল্লাহর রাসূলের কাছে যাওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম, এমন কেউ কি আছে যে, আমার এ মােবারক সফরের সঙ্গী হবে? এরই মধ্যে সাফওয়ান বিন উমাইয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে। আমি তাকে বললাম, আবু ওয়াহাব! তুমি কি চিন্তা করেছ আমরা কিসের মধ্যে আছি? ‘
আমাদের অবস্থা তাে মাড়ির দাঁতের ন্যায় যাদের একটি অপরটিকে পেষণ করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আরব-অনারবে সর্বত্র মােহাম্মদ বিজয়ীবেশে আবির্ভূত হচ্ছে। যদি আমরা তার কাছে গিয়ে তার অনুসারী হয়ে যাই তাহলে আমরাও মােহাম্মদের মর্যাদায় অংশীদার হব।’
সাফওয়ান কঠিনভাবে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাে এবং বললাে, ‘আমি ছাড়া আর যদি সবাই তার অনুসারী হয়ে যায় তবুও আমি তার অনুসারী হব না।
আমি তার কাছ থেকে সরে এলাম। মনে মনে ভাবলাম, “সে তাে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্যক্তি। তার পিতা ও ভাই বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছে। সে ইসলামের অনুসারী হবে না।
এরপর ইকরিমা বিন আবু জাহলের সাথে দেখা হলাে। তাকেও অনুরূপ প্রস্তাব দিলাম। সেও আমাকে সফওয়ানের মতাে জবাব দিল। আমি তাকে বললাম, তাহলে মােহাম্মদের কাছে আমার এই গমনের কথা কাউকে বল না।
সে বললাে, “ঠিক আছে আমি কাউকে বলব না। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে এলাম এবং বাহন নিয়ে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে ওসমান বিন তালহার সাথে দেখা হলাে। মনে মনে ভাবলাম, “ইনি আমার বন্ধু । আমি যা আশা করছি, তা তাকে বলে দেখি কী বলে। কিন্তু মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে তার যেসব আত্মীয়-স্বজন নিহত হয়েছে, তাদের কথা স্মরণ হলে আমি তার সঙ্গে আলােচনা না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে ভাবলাম, এ ব্যাপারে কিছু বলা আমার জন্য সমস্যা নয়। কেননা, আমি এখন মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তারপর আমি তাকে কুরাইশদের বর্তমান পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, আমাদের অবস্থা এখন গর্তে আটকে পড়া সেই শিয়ালের ন্যায়, গর্তে পানি ঢালা হলে যে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে। আমি তাকে সে কথাগুলােও বললাম, যা ইতােপূর্বে সাফওয়ান ও ইকরিমাকে বলেছিলাম। সে দ্রুত আমার আহ্বানে সাড়া দিল এবং আমার সঙ্গে মদিনায় যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানাল।
আমি বললাম, আমি তাে আজই বের হব। আমি মদিনায় যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। পথের পাথেয় ও বাহন সব প্রস্তুত করে ফেলেছি।
খালিদ (রাঃ) বলেন, “আমরা পরস্পর ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে, ‘ইয়াজাজ নামক স্থানে আমরা একত্র হব। সে আগে পৌছলে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর আমি আগে পৌছলে সেখানে অবস্থান করে তার জন্য অপেক্ষা করব।’
কুরাইশরা জেনে ফেলবে এ আশঙ্কায় আমি রাতের শেষ প্রহরে বাড়ি থেকে বের হলাম। ভােরের আলাে ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমরা উভয়ে ইয়াজাযে মিলিত হলাম। এরপর দ্রুত পথ চলে ‘হাদ্দাহ’ নামক স্থানে পৌঁছতেই আমর ইবনুল আসের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হলাে। সেও উটে চড়ে কোথাও যাচ্ছিল।
আমাদের দেখে সে বললাে, “স্বাগতম হে কাফেলা! কোথায় যাচ্ছ?”
আমরা বললাম, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
সে পাল্টা প্রশ্ন করলাে, ‘আগে বল, তােমরা কোথায় যাচ্ছ?
আমরা বললাম, “ইসলাম গ্রহণ করতে এবং মােহাম্মদের অনুসারী হতে যাচ্ছি।
সে বললাে, ‘এ উদ্দেশ্যই তাে আমি বের হয়েছি!
আমরা তিনজন একত্রে মদিনায় প্রবেশ করলাম এবং হাররার কাছে যাত্রা বিরতি করলাম। আল্লাহর রাসূলকে আমাদের আগমণ সংবাদ দেয়া হলাে । তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। আমি আমার সবচেয়ে ভাল পােশাকটি পরিধান করে আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। খবর পেয়ে আমার ভাই এগিয়ে এলাে। তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলাে। সে বললাে, “জলদি এসাে! আল্লাহর রাসূলকে তােমাদের আগমন সংবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি তােমাদের আগমনে খুশি হয়েছেন। তােমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা দ্রুত রাসূলের দরবারে উপস্থিত হলাম। দূর থেকে আমাকে দেখেই তিনি মুচকি হাসছিলেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ানাে পর্যন্ত তার মুখে হাসির আভা লেগেই ছিল। আমি তাকে সালাম দিলাম । তিনি হাসিমুখে জবাব দিলেন।
আমি বললাম, আশহাদু আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।
তিনি বললেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ! সকল প্রশংসা ঐ মহান সত্তার , যিনি তােমাকে হেদায়েত দান করেছেন। আমি তােমাকে একজন প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী ব্যক্তি হিসেবে জানি। তাই আশা করতাম, তােমার বিবেক তােমাকে কেবল কল্যাণের দিকেই ধাবিত করবে।
আমি বললাম, ‘আল্লাহর রাসূল! আপনার বিরুদ্ধে যে সকল স্থানে উপস্থিত হয়েছি সেগুলােকে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ বলে মনে হয়। অতএব, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ইসলাম পূর্ববর্তী যাবতীয় অপরাধ মােচন করে দেয়।
আমি বললাম, ‘আল্লাহর রাসূল! তবুও আমার জন্য ইসতেগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
রাসূল (সাঃ) দোয়া করলেনঃ
ما أوضع فيه من صد عن سبيلك » الله افزا خالد بن الوليد
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনার পথে বাধাদানসহ খালিদ বিন ওয়ালিদের যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করে দিন।
এরপর খালিদ (রাঃ) পরিণত হলেন ইসলামের অন্যতম মহান ব্যক্তি হিসেবে। তার ইসলাম গ্রহণ ছিল আল্লাহর রাসূলের একটি পরােক্ষ বার্তার মাধ্যমে। কত চমৎকার সহনশীলতা, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা ছিল আল্লাহর রাসূলের! মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে আমাদেরও এ নববী দক্ষতার অনুসরণ করা উচিত।
আপনি কোনাে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সিগারেট বিক্রি হতে দেখলেন। মালিককে সতর্ক করতে চাইলে প্রথমে তার দোকানের ডেকোরেশন ও পরিচ্ছন্নতার প্রশংসা করুন। তার ব্যবসার উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করুন। এরপর হালাল উপার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করুন। এর ফলে সে অনুভব করবে যে, আপনি চশমার কালাে আয়না দিয়ে তাকে দেখেন নি; বরং লাঠিটির মাঝখানেই ধরেছেন! তার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ কথা বলেছেন।
কথাবার্তায় বিচক্ষণ হােন। সামনের মানুষটির কোনাে ভাল গুণ খুঁজে বের করে তা দিয়ে মন্দ আচরণগুলােকে ঢেকে দিন। অন্যের প্রতি সুধারণা পােষণ করুন। তাহলে দেখবেন আপনার ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের কারণে অন্যরা আপনাকে ভালবাসতে শুরু করবে।
একপলক ..
কোনাে মানুষ যখন দেখবে আমরা তার মন্দ গুণগুলাের পাশাপাশি উত্তম গুণগুলােও দেখছি তখন সে আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ♦♦♦
উৎস: জীবনকে উপভোগ করুন (Enjoy your life in bangla) বই থেকে।
আরও পড়তে পারেন..
০১. সাফল্য কি? সাফল্যের ইতিকথাঃ বাস্তবতা ও বর্তমান
০২. ডিপ্রেশন টু সুইসাইড : আত্মহত্যাই সমাধান নয়!
০৩. স্ত্রী কি স্বামীর জন্য রান্না বান্না করতে বাধ্য?
০৪. স্মার্ট হওয়ার উপায়- স্মার্ট হবার A-Z গাইডলাইন
০৫. ইসলামে যিনা ব্যভিচারের শাস্তি!
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি সম্মানিত লেখকের “ভারসাম্য রক্ষা করুন” আর্টিকেলটি পড়ে আপনাদের ভালো লেগেছে। আপনাদের বন্ধুদের সাথে এটি শেয়ার করতে ভুলবেন না।
Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.