কে অধিক দানশীল (তিন ব্যক্তির দানশীলতার গল্প)

কে অধিক দানশীল – মক্কার তিন দানশীল ব্যক্তির সত্য কাহিনী!

তিন বন্ধু। মক্কা মুকাররমায় থাকেন। প্রত্যহ কোন এক সময় একত্রে মিলিত হন। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। কখনো কোথাও বেড়াতে যান। নামাজের সময় হলে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেন। অবশেষে যার যার বাসায় ফিরে আসেন।

একদিন তিন বন্ধুর মধ্যে বিতর্ক শুরু হল। বিতর্কের বিষয় হল, বর্তমান সময়ে মক্কা শহরে সবচেয়ে বড় দানশীল কে? প্রত্যেকেই যার যার অভিমত পেশ করল। কিন্তু একজনের মত অন্যজনের সঙ্গে মিলল না।

প্রথম ব্যক্তি বলল, বর্তমানে এ শহরে সবচেয়ে বড় দানবীর হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাঃ)।

দ্বিতীয় জন বলল, আমি তোমার সাথে একমত নই। আমার মতে এ শহরের সবচেয়ে বড় দানশীল হলেন কায়েস বিন সাআদ (রা:) ।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল, আমি তোমাদের কারো কথা সমর্থন করতে পারলাম না। আমি মনে করি বর্তমান কালে শায়েখ আরাবাহ (র.)-এর চেয়ে বড় কোন দাতা এ শহরে নেই।

 

অধিক দানশীল কে? তিন ব্যক্তির দানশীলতার গল্প

এবার প্রত্যেকেই যার যার মতের স্বপক্ষে দলিল ও যুক্তি পেশ করল। উল্লেখ করল বিভিন্ন উদাহরণ। কিন্তু কোন সুরাহায় পৌছা সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, যে যার নাম বলেছে সে তাঁর কাছে যাবে এবং আজই নগদ ও বাস্তব প্রমাণ নিয়ে ফিরবে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রথম ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (র.) এর নিকট গেল। সে তাঁর নিকট একজন সওয়াল্কারীর বেশে উপস্থিত হল। এ সময় আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (র.) দীর্ঘ সফরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি উটের উপর উঠে বসছিলেন। সে তাঁর নিকট গিয়ে বলল, হে দানবীর! আমি এক বিপদগ্রস্থ মুসাফির। বাড়িতে ফেরার মত প্রয়োজনীয় অর্থ বা বাহন কোনটি আমার নিকট নেই। মেহেরবানী করে আমাকে কিছু সাহায্য করুণ। লোকটির অভাবের কথা শুনে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (র.) সমবেদনা প্রকাশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজে সফরের ইরাদা পরিত্যাগ করে বললেন, হে মুসাফির! এখন আমার নিকট একখানা উট, পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ও কয়েক থান রেশমী কাপড় আছে। তুমি এগুলো নিয়ে যাও এবং আপন প্রয়োজন পূর্ণ কর।

এদিকে দ্বিতীয় ব্যক্তি কায়েস ইবনে সাআদ (র.) এর নিকট উপস্থিত হল। কায়েস (র.) তখন ঘুমাচ্ছিলেন। গোলাম বলল, আমার মনিব এখন ঘুমিয়ে আছেন। তাকে জাগাতে চাই না। আপনি কেন এসেছেন আমার নিকট বলুন। সম্ভব হলে আমিই এর ব্যবস্থা করব।

লোকটি গোলামের নিকট স্বীয় অভাবের কথা বলে সাহায্যের আবেদন জানাল। গোলাম দেরী করল না। সাথে সাথে ঘরের ভিতরে গিয়ে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ফিরে এল। বলল, এগুলো নিন, এ মুহূর্তে ঘরে এ পরিমাণ অর্থই ছিল। তারপর সে লোকটির হাতে একটি চিরকুট দিয়ে বলল, অমুক স্থানে গিয়ে চিরকুটটি দেখালে একটি ঘোড়া ও একটি উট পেয়ে যাবেন। লোকটি চিরকুট ও স্বর্ণ্মুদ্রা নিয়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর হযরত কায়েস (র.) ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন। তারপর গোলামের মুখ থেকে সবকিছু অবগত হয়ে এতটাই খুশি হলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে গোলামকে আযাদ করে দিলেন। সেই সাথে এ কথাও বললেন যে, হায়! তুমি যদি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে তাহলে আমি এই কৃপণতা করতাম না।

তৃতীয় ব্যক্তি শায়েখ আরাবার নিকট পৌঁছে অভাব অনটনের কথা জানাল এবং সাহায্যের পার্থনা করল। শায়েখ তখন নেহায়েত দুর্বলতার কারণে দু’জন গোলামের কাঁধে ভর করে কোথাও যাচ্ছিলেন। লোকটির প্রার্থনা শুনে তাঁর দু’চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি অতি কষ্টে গোলামদের থেকে পৃথক হলেন এবং সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর আফসোস করে বললেন, হায়! তোমাকে দেওয়ার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ ধন-সম্পদ যদি আমার নিকট থাকত। যাহোক, এখন আমার এ দুটি গোলাম উপস্থিত আছে, তুমি এদের গ্রহণ করো।

সওয়ালকারী শায়েখের দান গ্রহণ করল না। কারণ সে তো মূলতঃ সাহায্যের জন্য আসেনি। পরীক্ষার উদ্দেশ্যে এসেছে। যখন সে দেখল, বৃদ্ধ শায়েখ দুটি গোলামের সাহায্য নিয়েই চলাফেরা করে তখন তাঁর কষ্টের কথা ভেবে সে এ দান গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাল। এবার শায়েখ আরাবাহ (র.) বললেন, যদি তুমি আমার এ দুটি গোলাম গ্রহণ না কর তাহলে আমি এদেরকে এক্ষুণি আযাদ করে দিচ্ছি। এ বলে তিনি গোলাম দুটি আযাদ করে দিলেন এবং অনেক কষ্টে চলাফেরা করতে লাগলেন।

ঐদিন রাতে তিন বন্ধু আবার একত্রিত হল। একে একে নিজ নিজ নতুন অভিজ্ঞতা সবাই বর্ণনা করল। কিন্তু এবারও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল না যে, এই তিন মহান ব্যক্তির মাঝে কে অধিক দানশীল।

প্রিয় পাঠক! বর্ণিত ঘটনাটি কোন কল্পকাহিনী নয়। এটি একটি বাস্তব সত্য ঘটনা। আপনারা একটু চিন্তা করে দেখুন, বর্ণিত ঘটনায় যাদের নাম আলোচনা এসেছে তাদের মন কত বড়? কত বিশাল ও উদার হৃদয়ের অধিকারী তারা? একজন অভাবীর প্রয়োজন পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সফর বাতিল করে তদুপরি বাহন সহ সফরের সমস্ত সামানাদি দান করে ফেলা-এ কি কোন সাধারণ কথা? অথচ আল্লাহ মাফ করুক, আমাদের কারো কারো অবস্থা তো এই যে, কোথাও বের হওয়ার প্রাক্কালে কোন ভিক্ষুক যদি দু’পয়সা চেয়ে বসে তবে বিরক্তির সীমা থাকে না। এমন কি তখন দু’চার কথা শুনিয়ে ধমকি দিয়ে তাকে বিদায় করে দিতেও দ্বিধাবোধ করি না।

আরেকটু খেয়াল করে দেখুন, হযরত কায়েস (র.)-এর গোলাম তার মনিবের দানের ব্যাপারে কত বেশি আস্থাবান ছিলেন যে, তাকে না জানিয়ে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা অভাবী লোকটির দিয়ে দেওয়ার মত হিম্মত হল। আর ঐ মনিবের প্রতি কেনই বা আস্থা সৃষ্টি হবে না, যিনি গোলামের দানের কথা শুনে খুশি হয়ে তাকে মুক্তিই দিয়ে দিলেন। তদুপরি এ কথা বলে  দুঃখ প্রকাশ করলেন যে, আমাকে জাগিয়ে দিলে আমি এই কৃপণতা করতাম না। লক্ষ্য করে দেখুন, দশ হাজার দিনার, একটি ঘোড়া ও একটি উটকে তিনি কৃপণতার দান বলে আখ্যায়িত করছেন। সুবহানাল্লাহ!

অপর দিকে শায়েখ আরাবাহ (র.) এর ব্যাপারটিও চিন্তা করে দেখুন যে, তিনি অভাবীর অভাব পূরণের জন্য কত বড় কুরবানি পেশ করেছেন। নিজে বৃদ্ধ। একাকী চলতে পারেন না। দুটি গোলামের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করেন। কিন্তু অভাবের কথা শুনে তাঁর কোমল হৃদয় এতটাই কোমল হল যে, এই গোলাম দুটিকে তিনি দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন।

প্রিয় পাঠক! উল্লেখিত ঘটনা পাঠ করে গরিব দুঃখী অনাথ এতিম ও অভাবীদের প্রতি আমাদের মনেও যদি পূর্বের তুলনায় আরও অধিক পরিমানে সহানুভূতি ভাব সৃষ্টি হয় তবেই আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। হে করুণাময় আধার! তুমি আমাদের তাওফীক দাও। আমীন।

[সহায়তায়ঃ এমন মানুষ মিলবে না আর, মাওলানা শাববীর আহমাদ শিবলী।]  

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বই সাড়া জাগানোর সত্য কাহিনী থেকে। 

হৃদয় গলে সিরিজের আরও শিক্ষণীয় গল্প!

০১. মায়ের অবাধ্য হয়ে হজে যাওয়ার পরিণতি

০২. সবচেয়ে বড় পাপ (শিক্ষণীয় গল্প)

০৩. এরই নাম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন (লোকমান আ. এর গল্প)

০৪. ভয়ংকর সাপ (কবরের আজাবের গল্প ১)

০৫. ত্যাগের শিক্ষা (কিশোর কিশোরীদের গল্প ১৪)

০৬. এক নির্যাতিতা স্ত্রীর ফরিয়াদ : একটি ঘটনা।

০৭. কৃপণ : কৃপণের ঘরে দানশীল বউ

০৮. আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ (শিক্ষণীয় গল্পের বই)

০৯. বাংলার এক মহিয়সী নারী (পতিপ্রাণা স্ত্রীর গল্প)

১০. দুই রমনীর হৃদয়স্পর্শী কাহিনী (ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া ঘটনা)

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি হৃদয় গলে সিরিজের “কে অধিক দানশীল” গল্পটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে এবং এটি আপনার বন্ধুদেরকে পড়াতে শেয়ার করতে ভুলবেন না। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment