ভাল কাজের শুভ ফল এটি একটি ইসলামিক শিক্ষণীয় গল্প। সম্মানিত গল্পের লেখক একজন উপকারী ব্যক্তির জীবনের ঘটনা তুলে ধরেছেন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ নসীহত তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন গল্পটি পড়া শুরু করা যাক..
ভাল কাজের শুভ ফল! (ইসলামিক শিক্ষণীয় গল্প ৩)
একজন সৎ লােক। অত্যন্ত খােদাভীরু। বছরের অধিকাংশ সময় রােজা রাখেন। রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদ পড়েন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলেন। যথাসাধ্য মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেন। বিপদে আপদে সাহায্য করেন। অপরের ব্যথায় ব্যথিত হন। এমনকি কোন জানােয়ারও যদি মসিবতে পতিত হয়, তবে তাও দূর করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। অন্যের উপকার করার প্রশ্নে আপন কর্মের পরিণতির কথাও চিন্তা করার সুযােগ পান না তিনি।
লােকটির নাম আবুল হামীর। শিকারের প্রতি তাঁর ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। এ উদ্দেশ্যে প্রায়ই তিনি জঙ্গলে যান। তারপর স্বীয় অস্ত্রপাতি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে শিকার ধরে বাড়ি নিয়ে আসেন। এমন কখনােই হয় নি যে, তিনি শিকার ধরতে জঙ্গলে গেছেন, অথচ কিছু না নিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন।
অভ্যাস মত একদিন তিনি শিকার ধরার উদ্দেশ্যে জঙ্গলে গেলেন। সেখানে গিয়ে শিকার তালাশ করতে লাগলেন। তাঁর সম্পূর্ণ মনােযােগ তখন শিকার খোঁজার প্রতিই নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটি সাপ সামনে পড়ায় তার মনােযােগে ব্যাঘাত ঘটল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সাপটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের মতােই সুন্দর করে কথা বলতে লাগল।
সাপটি বলল, ওহে আবুল হামীর! আল্লাহর ওয়াস্তে আমার প্রতি একটু দয়া কর। আল্লাহ তােমাকে দয়া করবেন। সাপের মুখে কথা শুনে তিনি বিস্মিত হলেন। মনে মনে বললেন, সাপ আবার কথা শিখল কবে থেকে? তিনি সাপ দেখে ভিতরে ভিতরে আতংকিত হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন কি বিপদে পড়েছ যে, আমার দয়া ও সাহায্য তােমার প্রয়ােজন?
সাপটি বলল, আমার প্রাণঘাতি শত্রু আমাকে তাড়া করে ফিরছে। দেরি হলে এখুনি সে আমাকে ধরে হত্যা করে ফেলবে।
আবুল হামীর বললেন, তুমি কার উম্মত? সাপ উত্তরে বলল, আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত।
সাপের কথায় আবুল হামীরের কোমল হৃদয় আরাে কোমল হল। উহার ব্যথা কাতর কণ্ঠস্বর তার হৃদয়ে শক্তভাবে আঘাত হানল। মনে মনে বললেন, বিপদগ্রস্তের বিপদে সাহায্য করাই তাে আমার কাজ। সুতরাং আল্লাহর এক সৃষ্টির আমার দ্বারা যদি কিছুটা হলেও উপকার হয় তাতে ক্ষতি কি?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে পরিণামের কথা চিন্তা করার সুযােগ পেলেন না তিনি। সাপটিকে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সাথে সাথে তিনি স্বীয় চাদর বিছিয়ে দিয়ে বললেন- এর ভিতর প্রবেশ কর।
সাপটি বলল, শত্রু তাে এর মধ্যে আমাকে দেখে ফেলবে।
: আমি যা বলি তা শােন । তুমি আমার চাদরের ভিতর নির্ভয়ে প্রবেশ কর এবং আমার বুক বরাবর এসে পেঁচিয়ে বসে থাক।
: আমার খুব ভয় হচ্ছে। মনে হয় শত্রু আমাকে এখানেও দেখে ফেলবে।
: তাহলে আমি কি করতে পারি তুমিই বল।
: আপনি যদি আমার মঙ্গলই কামনা করেন তবে দয়া করে আপনার মুখ খানা হা করুন। আমি সেখান দিয়ে প্রবেশ করে আপনার পেটের মধ্যে অল্পক্ষণের জন্য আত্মগােপন করে থাকব।
: এবার তাে তুমি আমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেললে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া যদিও আমি কোন কিছুকে ভয় পাইনা তথাপি তােমার এ প্রস্তাবে আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে। আমার আশংকা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ধ্বংস করে ফেল কি-না।
: আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল, সমস্ত ফিরিশতা এবং আকাশের সমুদয় বাসিন্দাদের সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আপনার কোনই ক্ষতি করব না। শত্ৰু চলে যাওয়ার পরপরই আমি বের হয়ে যাব।
: ঠিক আছে। তবে তাই হােক।
এ বলে আবুল হামীর মুখ খুলে দিলেন। সাপটি ধীরে ধীরে মুখের ভিতর প্রবেশ করে পেটে চলে গেল।
অল্প কিছুক্ষণ পর একজন লােক তরবারি হাতে দৌড়ে এসে আবুল হামীরকে দেখে থমকে দাড়াল। বলল, আপনি কি একটি সাপকে এদিকে যেতে দেখেছেন?
আবুল হামীর বললেন, না, আমি তাে কোন সাপ এখানে দেখিনি। উল্লেখ্য যে, আবুল হামীর যেখানে দাঁড়িয়ে লােকটির সাথে কথা বলছিলেন সেখানে সত্যিই তিনি সাপ দেখেন নি। কেননা, যে স্থানে তার পেটের ভিতর সাপটি প্রবেশ করেছিল সেখান থেকে ইতােমধ্যেই তিনি সরে গিয়ে একটু দূরে অবস্থান করছিলেন। যাতে তার কথাটা মিথ্যে না হয় ।
সাপের খোঁজ না পেয়ে লােকটি চলে গেল। আবুল হামীর আপন স্থানে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিলেন। খানিক পর সাপটি মাথা বের করে বলল, জনাব! একটু দেখুন তাে, আমার শত্রু দৃষ্টিগােচর হয় কিনা? আবুল হামীর বললেন, না, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় এতক্ষণে সে অনেক দূর চলে গেছে।
: সত্যিই সে অনেক দূর চলে গেছে?
: হ্যাঁ, সত্যিই। সে আর আমার দৃষ্টি সীমার মধ্যে নেই। তুমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। সুতরাং দেরি না করে তাড়াতাড়ি বের হয়ে চলে এসাে।
পেট থেকে বের হয়ে আসার প্রস্তাবে সাপটি যে জবাব দিল, তাতে আবুল হামীরের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল । মনে মনে বললেন, উপকারের বদলা কি তবে এই?
সাপটি বলল, হে আবুল হামীর! আমি এবার তােমার নিকট দুটি প্রস্তাব করব। পছন্দ মতাে তুমি যে কোন একটি বেছে নিবে।
: প্রস্তাব দুটি কি? আবুল হামীর জানতে চাইলেন।
: আমি দু’স্থানে ছােবল দেওয়া পছন্দ করি। একটি হল কলিজা আর অপরটি হল হৃদপিন্ড। এখন তুমিই বল কোনটি তােমার পছন্দ।
: এ কি বলছ তুমি!
: হ্যা, আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। তুমি বললে তােমার কলিজাকে টুকরাে টুকরাে করে দিতে পারি, অথবা তােমার হৃদপিন্ডকে ঝলসে দিতে পারি। তবে একথা সত্য যে, উভয় অবস্থায়ই তােমার দেহ প্রাণহীন হয়ে যাবে।
: সুবহানাল্লাহ! এই কি তােমার ওয়াদা? আর এই কি তােমার কসমের ফল? তুমি না একটু পূর্বে লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে? যার ফলে তােমাকে আমি আশ্রয় দিয়েছিলাম। উপকারীর প্রতিদান কি তুমি এভাবেই দিতে চাও? এরূপ কথা মুখ দিয়ে বের করতে তােমার কি একটুও লজ্জা হল না? ..
: আবুল হামীর! আমি তােমার চেয়ে অধিক বােকা কোন লােক এ পৃথিবীতে দেখি নি। তুমি হয়তাে আমাকে চিনতে পার নি। তাই আমাকে অনুগ্রহ করতে এসেছ। আমি হলাম বনী আদমের চিরশত্রু- শয়তান। কেন যে তুমি আমার সাথে ভাল আচরণ করলে তা আমার বােধগম্য নয়।
: ওহ! তুমি তাহলে শয়তান? যাক তােমার নিকট আমি শেষ বারের মতাে জানতে চাই, তুমি কি আমাকে হত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছ?
: হ্যা, এছাড়া আর কোন উপায় নেই।
: আচ্ছা, ঠিক আছে। তােমার যখন এ রকমই ইচ্ছা, তাহলে আমাকে ঐ পাহাড় পর্যন্ত যাওয়ার সুযােগ দাও, যাতে মৃত্যুর পর আমার লাশ গড়িয়ে লােকালয়ে যেয়ে পড়তে পারে।
: ঠিক আছে, চল ঐ পর্যন্ত যাই। কিন্তু, মনে রেখ, তােমার মৃত্যু নিশ্চিত। কোন শক্তিই তােমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।
আবুল হামীর জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে কম্পিত পদে পাহাড়ের দিকে। যেতে লাগলেন। সেখানে যাওয়ার পর কায়মনােবাক্যে তিনি একটি দুআ পাঠ করলেন।
দুআটি বারবার পড়ার পর হঠাৎ একজন সুন্দর সুদর্শন লােক সেখানে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দেহ সুগন্ধিযুক্ত ও পােষাক অত্যন্ত মার্জিত। তিনি আবুল হামীরকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনাকে এতাে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
: এক দুশমন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। এজন্যেই আমি এতাে চিন্তিত।
: আপনার দুশমন এখন কোথায়?
: পেটের ভিতর।
: পেটের ভিতর দুশমন!
: হ্যা, পেটের ভিতর থেকেই সে আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আমি তার উপকার করেছিলাম। আর সেই উপকারের বদলা সে এভাবেই দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
: সে তাে তাহলে বিশ্বাসঘাতক ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ।
: হ্যাঁ, অবশ্যই। এমনটি আমি জীবনেও দেখি নি।
: সে আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যে পাপ করেছে, তার শাস্তি তাকে অবশ্যই পেতে হবে। আপনি এক কাজ করুন। মেহেরবানি করে মুখটি একটু খুলুন।
আবুল হামীর মুখ খুলে দিলেন। সাথে সাথে লােকটি যাইতুন পাতার মতাে একটি পাতা তার মুখে দিয়ে বললেন, ইহা চিবিয়ে গিলে ফেলুন।
আবুল হামীর নির্দেশ পালন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার পেটে পাক খেতে শুরু করল এবং সাপটি খন্ড বিখন্ড হয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে এল। এতে তার অন্তরে যে ভয় ভীতি ছিল তা একেবারে দূরীভূত হয়ে গেল।
এবার আবুল হামীর লােকটিকে সম্বােধন করে বলল- ভাই! আপনার পরিচয় কি? আমার এ বিপদের সময় কোথেকে আপনি আসলেন? আপনার উসিলায় আল্লাহপাক আমাকে খুবই অনুগ্রহ করেছেন। মুক্তি দিয়েছেন সীমাহীন পেরেশানি থেকে তাই দয়া করে বলুন- আপনি কে?
লােকটি মুচকি হেসে বললেন, আপনি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারেন নি?
আবুল হামীর বললেন, না ভাই, খােদার কসম, সত্যিই আপনাকে চিনতে পারি নি।
লােকটি বললেন- আমার নাম মারুফ । আমি চতুর্থ আসমানের ফিরিশতা। আপনি যখন চরম বিপদে নিপতিত হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে কাতর স্বরে প্রার্থনা করছিলেন, তখন সাত আসমানের সকল ফিরিশতা আপনার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্যের ফরিয়াদ করছিল। তখন আল্লাহ পাক বলেছিলেন, আমার বড়ত্ব ও মহত্বের কসম! আমার বান্দার সহিত যে আচরণ করা হয়েছে, তার সবই আমি দেখেছি। আমি অবশ্যই তাকে সাহায্য করব।
অতঃপর আল্লাহ পাক আমাকে আদেশ দিয়ে বললেন, মারুফ! তুমি বেহেশত থেকে তুবা গাছের একটি পাতা নিয়ে আমার বান্দা আবুল, হামীরের কাছে চলে যাও। অতঃপর উহা তাঁকে খাইয়ে দাও।
আমি সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর হুকুম পালন করলাম। এরপর কি হল তা তাে আপনি স্বচক্ষেই দেখলেন।
ফিরিশতার কথা শেষ হলে আবুল হামীর এত বড় অনুগ্রহের জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর ফিরিশতাকে বললেন, আমাকে একটু নসিহত করুন। ফিরিশতা বললেন, সর্বদা লােকদের সাথে সদ্ব্যবহার করবেন। মন্দ আচরণের ধারে কাছেও যাবেন না। মনে রাখবেন নেক কাজ পাপের কারণে আগত বিপদ আপদ থেকে মানুষকে হিফাযত করে। যিনি নেককার, পরহেযগার তার সম্মান ও মূল্যায়ন অনেক সময় লােকেরা না করলেও মহামহিম আল্লাহ ঠিকই করেন।
সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! নেক কাজ ও উত্তম আমল যে বিপদ আপদ ও মসিবত থেকে মানুষকে হেফাযত করে এর হাজারাে নজির রয়েছে। তাই আসুন, আজ থেকে আমরা নেক কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি করি। মানুষের উপকার করি। সর্বদা সবার সাথে উত্তম ব্যবহার করি। হাসি মুখে কথা বলি। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদার পাশাপাশি নফল ইবাদতের প্রতিও যত্নবান হই। নিয়মিত ইশরাক, আউয়াবিন ও তাহাজ্জুদের পাবন্দি করি। প্রত্যহ কুরআন তিলাওয়াত করি। এক কথায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হযরত সাহাবায়ে কেরামের রঙে রঙিন হই । হে আল্লাহ! তুমি আমাদের তাওফিক দাও। আমিন।
(এ ধরণের আরও কয়েকটি ঘটনা জানার জন্য দেখুন- ৪ঃ১৩ ও ৪০ ও ৫০ ও ৯৩) (সূত্র : হুলিয়াতুল আউলিয়া। সহায়তায়: হায়াতুল হাইওয়ান ৩ঃ৯৪)
গল্পের লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মফীজুল ইসলাম! লেখকের : হৃদয়স্পর্শী শিক্ষণীয় কাহিনী (হৃদয় গলে সিরিজ ১২) বই থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বইটির পিডিএফ ফাইল সাইটে উপলব্ধ আছে।