কবরের আহবান হল মুমিনদের জন্য একটি শিক্ষণীয় গল্প। রাসূল (সাঃ) মুমিনদেরকে সতর্ক করার জন্য মুমিনদের জন্য কবরের জীবন কেমন হবে এবং কাফেরদের জন্য কবরের জীবন কেমন হবে তা উপস্থিত সাহাবীদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বর্ণনা করেছিলেন। কবরের আহবান গল্পের সম্মানিত লেখক পাঠক পাঠিকাদের জন্য রাসূলের এই উপদেশগুলি তুলে ধরেছেন এবং কিছু নসীহত পেশ করেছেন। তাহলে চলুন এটি পড়ি…
কবরের আহবান! (কবরের জীবনের গল্প)
হযরত সাহাবায়ে কেরামের প্রাণপ্রিয় ইবাদতগাহ মসজিদে নববী। সেখানে আল্লাহভক্ত মুমিন মুসলমানগণ আসেন, নামাজ পড়েন, প্রভু প্রেমের অকুল দরিয়ায় ডুব দিয়ে নানাবিধ বন্দিগীতে মশগুল হন। কখনাে জিকির করেন, কখনাে তিলাওয়াত করেন, আবার কখনাে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণী শ্রবণ করে জান্নাতে পৌছার সহজ সরল রাস্তা চিনে নেন, জেনে নেন।
মসজিদে নববীতে তখন কোন আলাের ঝলকানি ছিল না, ছিল না। আকাশচুম্বী মিনার ও চোখ ধাঁধানাে সুদর্শন গম্বুজ। মেঝেতে পাথরখন্ড। বিছানাে, খেজুর পাতার ছাউনি আচ্ছাদিত অনাড়ম্বর ও জাঁকজমকহীন এ মসজিদের ইমাম হচ্ছেন দোজাহানের সর্দার সায়্যিদুল মুরসালিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
একটু পূর্বে হযরত বিলাল (রা.) এর কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এসেছে সুমধুর আযানের ধ্বনি। জামাতের সময় অত্যাসন্ন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন সাহাবায়ে কেরাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ঘর থেকে বের হয়েছেন মসজিদে যাবার উদ্দেশ্যে। শান্ত-মন্থর গতিতে এগিয়ে চলছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেল তার চলার গতি। থমকে দাঁড়ালেন তিনি। ইতােমধ্যে তিনি পৌছে গেছেন মসজিদে নববীর প্রধান ফটকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন কয়েকজন লােক খিলখিল করে হাসছেন। যার ফলে তাদের দাঁত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন ভারী হয়ে উঠলাে। তিনি দারুন বিচলিত হলেন। ব্যথায় মুষড়ে পড়লেন। তাঁর অন্তর কেঁদে উঠল। দুচোখ ছাপিয়ে পানি এল। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললেন, উহ! এদের মাঝে যে উদাসীনতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তবে কি তাদের মাঝে পরকালের ভাবনার কমতি রয়েছে? তারা কি ভুলে গেছে কবরের কথা, কবরের নির্মম শাস্তির কথা? না, এমন হলে তাে চলবে । এর একটা সংশােধন এখনই প্রয়ােজন।
সাহাবাগণ! তােমরা বেশী করে মৃত্যুর কথা স্মরণ কর।
বিশ্ব মানবতার একান্ত হিতৈষী চিরকল্যাণের আধার, অতি দরদী মানব ও আদর্শ শিক্ষক নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইলেন তাদের এ অবস্থার সংশােধন করতে। তাই তিনি সমবেত সাহাবীগণকে সম্বােধন করে বললেন, হে আমার প্রাণের সাহাবাগণ! তােমরা বেশী করে মৃত্যুর কথা স্মরণ কর। মনে রেখাে, যদি তােমরা বেশী পরিমাণে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে হবে। তােমাদেরকে আজকে যে অবস্থায় পেয়েছি সে অবস্থায় কখনােই পেতাম না। এমন একদিনও যায় না যেদিন কবর এ বলে ফরিয়াদ না করে, আমি অপরিচিত ঘর, নির্জন ঘর, মাটির ঘর, পােকা মাকড়ের ঘর, কীট পতঙ্গের ঘর। (সুতরাং এখানে আসার সময় হিসেব করে পরিপূর্ণ ঈমান ও উপযুক্ত পাথেয় অর্থাৎ নেক আমল নিয়ে আসিও। অন্যথায় তােমাদের অবস্থা কিন্তু বড়ই করুণ ও ভয়াবহ হবে।)
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি আরাে পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য বলেন, দেখাে, যখন কোন মুমিন ও নেককার বান্দাকে কবরে রাখা হয়, তখন কবর তাকে নবাগত অতিথির ন্যায় সম্মান করে। সে প্রফুল্ল চিত্তে আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে বলতে থাকে, তােমাক অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি এখানে আসায় বেশ ভালই হয়েছে। শােন, যত লােক জমিনের উপর চলাফেরা করত, তাদের মাঝে তুমিই ছিলে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোৎকৃষ্ট। আজ তুমি আমার নিকট আগমন করেছ; তােমাকে অর্পণ করা হয়েছে আমার হাতে। অতএব অতি শীঘ্রই তুমি দেখতে পাবে তােমার সুখ শান্তি ও আরামের জন্য আমি কত উত্তমও আনন্দদায়ক ব্যবস্থা করেছি। অতঃপর মৃত ব্যক্তির দৃষ্টি পর্যন্ত কবর প্রশস্ত হয়ে যায় এবং জান্নাতের দিক থেকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। যে দরজা দিয়ে বেহেশতের সুগন্ধি হাওয়া আসতে থাকে।
পক্ষান্তরে কোন পাপীকে যখন কবরে রাখা হয় তখন কবর বলতে থাকে, হে পাপিষ্ঠ! তাের আগমন কতই না অশুভ! আমার উপর দিয়ে যত মানুষ চলাফেরা করত তাদের মধ্যে তু-ই ছিলে সর্বাধিক নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। আজ তােকে আমার নিকট সােপর্দ করা হয়েছে। সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যেই তুই আমার ব্যবহার দেখতে পাবি। দেখতে পাবি আমার নিষ্ঠুর ও নির্মম আচরণ।
এতটুকু বলে কবর তাকে দুদিক থেকে এমন প্রচন্ড জোড়ে চাপ দিবে যে, তার এক পাঁজরের হাড়গুলাে অপর পাঁজরে ঢুকে যাবে। তারপর তাকে দংশন করার জন্য এমন সত্তরটি বিষাক্ত সাপ নিযুক্ত করা হবে, যেগুলাের একটি যদি জমিনের উপর একবার নিঃশ্বাস ফেলত, তবে বিষের ক্রিয়ায় কেয়ামত পর্যন্ত কোন গাছ জন্মাত না। সাপগুলাে তাকে কিয়ামত পর্যন্ত দংশন করতে থাকবে। হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবু সাইদ (রা.) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন তা হল, কবর হয়তাে কারাে জন্য) বেহেশতের একটি টুকরা অথবা (কারাে জন্য) দোজখের একটি গর্ত। (তিরমিযি, মিশকাত)
প্রিয় পাঠক, দিন যতই যাচ্ছে ততই আমরা কবরের নিকটবর্তী হচ্ছি। আমরা সবাই একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, আমাদের সবাইকে ইচ্ছায় হােক আর অনিচ্ছায় হােক কবরে যেতেই হবে। কবরে না গিয়ে কারাে কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এতটাই উদাসীন ও বেপরােয়া ভাবে জীবন যাপন করছি যে, কেউ তাকে দেখলে ভাবতে বাধ্য হবে হয়তাে তার কখনােই মৃত্যু হবে না, শুইতে হবে না তাকে নীরব নির্জন কবর গহ্বরে।
সম্মানিত ভাইয়েরা! সত্যিই আমাদের দেখলে মনে হয় না যে, আমরা একদিন মরব। চলে যাব এ দুনিয়া ছেড়ে। কারণ অধিকাংশ মানুষ আজ পরকালের চিন্তা একদম বাদ দিয়ে মাল-দৌলত কামাই করার ফিকিরে সর্বদা মত্ত আছে। কখনাে সঙ্গী সাথীদের সাথে হাসি মউজ করছে, কখনাে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। ঠগবাজি, চোরাকারবারী, দুর্নীতি, বদমাশি আর : * বিলাসিতায় সময় কাটাচ্ছে। সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া সবই সমান তালে চলছে।” কথায় কথায় মিথ্যা বলছে। সুন্দরী, ছলনাময়ী রূপসী যুবতীদের একান্ত করে কাছে পাওয়ার জন্য বৈধ অবৈধ সবই করছে।
গান-বাদ্য নাচ-নৃত্য ছাড়া আমাদের যেন একটি দিনও চলতে চায় না। কেউ নাজায়েজ রং তামাশায় সময় কাটাচ্ছে। আবার বড় গলায় দাবীও করছে আমি মুসলিম। আমাদের পরিবারের সবাই মুসলিম। আমি মসজিদের সভাপতি, সেক্রেটারী ইত্যাদি।
প্রিয় বন্ধুগণ! আমাকে আপনাকে আল্লাহ পাক মেহেরবানি করে মুসলমান বানিয়েছেন এজন্য হাজারাে শুকরিয়া। এটি আল্লাহর এক বহুত বড় নেয়ামত। কেয়ামত পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকলেও এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় হবে না। কিন্তু আমি বলতে চাই, মুসলমান হওয়ার পর আমরা যেসব অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয়েছি তা কি আমাদের জন্য কখনাে শুভ ফল বয়ে আনবে? আমি মুসলমান অথচ আমি নামায রােজার ধারে কাছে যাচ্ছি না, শরীয়তের বিধি বিধান পালন করছি না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করছি না। মুসলমান হওয়ার অর্থ কি এই?
আমি দাবী করি আমি মুসলমান অথচ আমার ঘরে রঙ্গিন টিভি। সিডি, ভিসিডি সমান তালে চলে আমার বাসায়। পরিবারের সবাই একত্রে বসে উপভােগ করছি বিনােদনের নামে নানাবিধ অবৈধ কর্মকান্ড । মেয়ে বড় হয়েছে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার দেহে বৃদ্ধি পাচ্ছে রূপ জৌলুস। আর আপনি পিতা হয়ে তাকে পর্দাহীন অবস্থায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও শপিং সেন্টারে। অথচ আপনি একবারও চিন্তা করে দেখলেন না যে, আপনার মেয়েকে, আপনার স্ত্রীকে, এক কথায় আপনার অধীন সকল মেয়েকে পর্দার রাখা আপনার ধর্মীয় দায়িত্ব ছিল। তবে কি এটাই আপনার মুসলমানিত্বের পরিচয়?
মনে রাখবেন, আজ হয়তাে আপনি ভাবছেন যে, মেয়েদের পর্দা মানে তাদের বন্দী করে রাখা, মেয়েদের পর্দা মানে দেশের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করা, মেয়েদের পর্দা মানে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। কিন্তু ভাইজান, আপনি যাই ভাবুন না কেন, এই বিধান কিন্তু আমি দেইনি, দেয়নি কোন মৌলভী মাওলানা। বরং এই বিধান দিয়েছেন আমার আপনার সৃষ্টিকর্তা যিনি নারী পুরুষ ও দেশের কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে সম্যক অবহিত সেই মহাজ্ঞানী, মহাক্ষমতাধর আল্লাহ রাব্বল আলামিন।
সুতরাং এতাে যুক্তি তর্কের অবতারণা না করে মুসলমান হিসেবে আপনার উচিত হবে খােদায়ী বিধানকে মেনে নেয়া এবং একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর আইন মানার মধ্যেই সমূহ কল্যাণ ও কামিয়াবী নিহিত আছে। নচেৎ স্মরণ রাখবেন, যে পর্দার বিধানকে অহেতুক মনে করে আপনি অবলীলায় তা লংঘন করে চলেছেন তার ফলশ্রুতিতেই আপনার পরিবারে এমন এক কলংকজনক অধ্যায় সূচিত হবে যা আমৃত্যু আপনাকে মাথা নিচু করে রাখতে বাধ্য করবে।
ভাই জান, আপনি আমাকে একটু বল বােরকা পড়া মেয়ে রাতের অন্ধকারে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনের মুখে চুনকালি দিয়েছে? আমার জানামতে একজনও নয়। আপনাদের জানামতে দু’একটি ঘটনা ঘটলেও তা তুলনামূলকভাবে একেবারেই নগণ্য। সুতরাং বুঝা গেল, পর্দাই হলাে মেয়েদের ইজ্জত ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
কথায় কথায় অনেকদূর চলে এলাম। বলছিলাম, আমাদের সবাইকে মরতে হবে। পােকা মাকড়ের ঘরে শুইতে হবে। তাই আসুন, মৃত্যুর আগেই প্রস্তুতি নেই। মৃত্যুর কথা বারবার স্মরণ করি। সুদ-ঘুষ, মিথ্যা-প্রতারণা, জুলুম অত্যাচার সবকিছু পরিত্যাগ করে খাঁটি মুমিন হয়ে যাই। ইসলামী বিধি বিধানগুলাে হক্কানী আলেমদের কাছ থেকে জেনে জেনে আমল করি মনে রাখবেন, আপনি যদি আল্লাহর দিকে এক বিঘত অগ্রসর হন, তবে আল্লাহর রহমত আপনার দিকে এক হাত অগ্রসর হবে। আপনি যদি এক হাত অগ্রসর হন আল্লাহর রহমত আপনার দিকে দুই হাত অগ্রসর হবে। আর আপনি যদি আল্লাহর দিকে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হন তবে আল্লাহর রহমত আপনার দিকে দৌড়িয়ে আসতে থাকবে। এটি হাদীসেরই কথা।
হাদীস শরীফে আছে, একবার এক যুবক সাহাবী মসজিদে দাঁড়িয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুমিনদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে? উত্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হলাে ঐ ব্যক্তি, যে মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে এবং মৃত্যু আসার পূর্বেই এর জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
ওগাে দয়ালু মাওলা! আমাদের সবাইকে তুমি মৃত্যুর জন্য, কবরের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার তাওফীক দাও। আমীন।
সূত্র : তিরমিযি, মিশকাত ২ঃ ৪৫৭, কবর কি পহেলী রাত।
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ হৃদয়স্পর্শী শিক্ষণীয় কাহিনী (হৃদয় গলে সিরিজ ১২)
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.