অঙ্গীকার পালনের বিরল দৃষ্টান্ত (শিক্ষণীয় গল্প)

কারোর সাথে অঙ্গীকার করলে সেই অঙ্গীকার কিভাবে রক্ষা করতে হয় তাঁর একটি উপমা হবে এই গল্পটি। গল্পের লেখক খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলের অঙ্গীকার পালনের একটি বিরল দৃষ্টান্ত গল্পাকারে তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন গল্পটি পড়া শুরু করি! 

অঙ্গীকার পালনের বিরল দৃষ্টান্ত (শিক্ষণীয় ইসলামিক গল্প)

অঙ্গীকার পালনের বিরল দৃষ্টান্ত

প্রসিদ্ধ বাগদাদ নগরী। অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত এই বাগদাদ নগরীর এক কালের খলীফা ছিলেন বাদশাহ হারুন অর রশীদ। ঐশৰ্য্য, বৈভব, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য্য এবং সুষমামন্ডিত বাগদাদ নগরী তারই আমলে একটি স্বপ্নপুরীতে পরিণত হয়েছিল । আব্দুল্লাহ ছিলেন তারই ঔরসজাত সন্তান ।

যিনি পরবর্তীতে মামুনুর রশীদ নামে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন । বাদশাহ হারুন অর রশীদের পরেই যিনি আমীরুল মুমিনীনের আসন অলংকৃত করেছিলেন।

মামুনুর রশীদ ছিলেন খলীফা হারুন অর রশীদের যোগ্য উত্তরসূরী। ন্যায়নিষ্ঠা, মহানুভবতা ও উদারতার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন । তিনি প্রতি রমজান মাসে পবিত্র কুরআন শরীফ ৩৩ বার খতম করতেন। ধৰ্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। ঐতিহাসিকগণ তার শাসনকালকে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ (Golden Age of Islamic civilization) বলে আখ্যায়িত করে থাকেন ।

৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে যখন খলীফা মামুনুর রশীদ শাসনভার গ্রহণ করলেন । তখন তারই চাচা ইব্রাহীম ইবনে মাহদী তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাগদাদে বিদ্রোহ শুরু করেন। তার বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রগাঢ় প্রজ্ঞা, দৃঢ় সংকল্প, অপূর্ব বুদ্ধিমত্তা ও নির্ভীক চরিত্রের অধিকারী খলীফা মামুনুর রশীদ কালবিলম্ব না করে একটি শক্তিশালী বাহিনী প্রস্তুত করেন। এবং সমগ্র ইরাকে ঘোষণা করে দেন যে, যে ব্যক্তি আমার চাচা ইব্রাহীম ইবনে মাহদীকে গ্রেফতার করে দিতে পারবে তাকে একলক্ষ দিরহাম পুরস্কার দেয়া হবে।

এ সংবাদ শ্রবনে ইব্রাহীম ইবনে মাহদী অত্যন্ত ভয় পেলেন এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্য আত্মগোপন করে অন্যত্র পালিয়ে গেলেন । কিন্তু সেখানেও তিনি বাঁচতে পারলেন না। বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর এক সময় তিনি সিপাহীদের হাতে বন্দী হয়ে খলীফার দরবারে অপরাধী হিসেবে উপস্থিত হলেন।

আত্মগোপনের সে দিনগুলো ইব্রাহীম ইবনে মাহদীর কিভাবে কাটলো, কিভাবে তিনি বন্দী হলেন, কিরূপ আচরণ করা হলো তার সাথে এবং এর পরবর্তী ঘটনাই বা কি ছিল এ নিয়েই এবারের চমকপ্রদ কাহিনী । চলুন, শিক্ষামূলক ও মর্মস্পশী সে কাহিনীটি তার নিজের মুখ থেকেই শুনি।

তিনি বলেন, যখন খলীফা মামুনুর রশীদ আমাকে বন্দী করার জন্য লক্ষ দিরহাম পুরস্কার ঘোষণা করলেন তখন আমি ভাবলাম, এ পরিস্থিতিতে বাগদাদে অবস্থান করা আমার জন্য মোটেও নিরাপদ নয় ৷

তাই আমি নিরুপায় হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন ছিল গরমের মৌসুম। দুপুরের খৈফোটা প্রচন্ড রৌদ্রের মধ্যে আমি উদ্ ভ্রান্তের মত হেঁটে চলছিলাম। বিরামহীন এই চলার কোন গন্তব্য আমার ছিল না। উদ্দেশ্যহীনভাবেই আমি একদিকে হাঁটছিলাম। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমি একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

গলির সরু পথ ধরে কিছুক্ষণ চললাম। হঠাৎ দেখি পথটি সামনের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ । সামনে এগুবার কোন রাস্তা নেই। পিছনে ফিরে যাওয়াও ভাল মনে করলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভাবনার সমুদ্রে হারিয়ে গেলাম আমি। মৃত্যুভয় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরল আমাকে। মনে হল, এই বুঝি আমি ধরা পড়ে গেলাম।

আমি চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ এক কৃষ্ণকায় যুবকের মায়াময় চেহারা আমার চিন্তায় ছেদ ফেললো। সে তার ঘরের দরজায় দাড়িয়ে । তাকে দেখে কেন যেন হৃদয়ে এক আশার সঞ্চার হল। আমি ধীর পদে যুবকের নিকট এগিয়ে গেলাম। বললাম, অত্যন্ত বিনয়ের সাথে-

ভাই! কিছু সময়ের জন্য আমাকে তোমার ঘরে আশ্রয় দিবে?

যুবক বললো, অবশ্যই দিব। আসুন, ভিতরে আসুন। একথা বলে সে আমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে তার ঘরে নিয়ে গেলো এবং আমাকে একটি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি কক্ষে বসাল।

আমাকে বসতে দিয়ে সে বলল, জনাব! আপনি একটু বসুন। আমি আসছি। বেশী দেরী হবে না ইনশাআল্লাহ। এ বলে সে চলে গেল ।

যুবক চলে যাওয়ার পর আমার মনে সন্দেহ জাগলো । ভাবলাম, যুবক আবার আমাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশে খবর দিতে গেল না তো? একবার সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাব। কিন্তু তা আর হল না। ইতিমধ্যেই যুবক বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবার নিয়ে উপস্থিত হয়ে বলল,

মুহতারাম! আমি একজন নাপিত। আমার ঘরের সাধারণ খাবার আপনাকে খাওয়ানো উচিত মনে করিনি। তাই আপনার জন্য বাজার থেকে সাধ্যমত ভাল খাবার নিয়ে এসেছি। অনুগ্রহ পূর্বক আমার মেহমানদারী কবুল করুন।

যুবকের ভদ্রতা ও উদারতা দেখে আমি সীমাহীন বিস্মিত হলাম। আমার প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধও আমাকে যারপর নাই আশ্চর্যান্বিত করল। শেষ পর্যন্ত তার উপস্থিত করা খাবার থেকে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলাম ।

খানা শেষ করার পরও অস্থিরতা ও পেরেশানীর ছাপ আমার চোখে- মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই অস্থির ভাব যুবকের সুতীক্ষ্ণ নজরকেও এড়াতে পারল না। আমার অস্থিরতায় যেন সেও অস্থির হয়ে উঠল । এ সময় কিছুক্ষণ চিন্তা করে হঠাৎ সে বলে উঠল, হুজুর! বেয়াদবী মাফ করবেন। আপনার সুললিত কন্ঠে কিছু কবিতা আবৃত্তি শুনতে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম ।

যুবকের কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, বাবা! আমি কবিতা জানি এ কথা কে তোমাকে বলল? কিভাবে তুমি এ কথা জানতে পারলে?

যুবক বলল, হযরত! আপনাকে চিনে না এমন দুর্ভাগা কে আছে? জীবনের একটি দীর্ঘ সময়তো আপনার স্নেহের ছায়াতেই কাটিয়েছি। আপনার ইব্রাহীম নামটি বাগদাদে কোন অপরিচিত নাম নয় । খলীফা মামুনুর রশীদ তো আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যই এক লক্ষ দিরহামের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন ।

যুবকের কথায় আমি আবারও বিস্মিত হলাম। অবশেষে জীবনের এই কঠিন মুহুর্তেও তার মন রক্ষার্থে কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শুনালাম । সেও খুব আবেগ ও উচ্ছাসের সঙ্গে আমার কবিতা আবৃত্তি শ্রবণ করল । অতঃপর আমি বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিলাম এবং তাকে কিছু উপহার দিতে চাইলাম । কিন্তু যুবক যথেষ্ট বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং এ সংকটময় মুহূর্তে বাইরে না বেরিয়ে তার ঘরে আরো কিছুদিন থাকার অনুরোধ করল। আমিও তার কথা যুক্তিসংগত ভেবে আরও কয়েকদিন সেখানেই অবস্থান করলাম। যতদিন আমি তার ওখানে থাকলাম, ততদিন সে পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারেই আমার মেহমানদারী ও আদর যত্ন করল। যতবারই আমি চলে যাওয়ার কথা বললাম ততবারই সে আমাকে একথা বলে যেতে বারণ করল যে, বাইরের পরিবেশ আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। সুতরাং আপনি এখানেই অবস্থান করুন ।

বারবার একই কথা বলে যুবক তার উদারতা ও প্রশস্ত হৃদয়ের পরিচয় প্রদান করলেও একজন গরীব ছেলে আমার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করবে তা আমার বরদাশত হচ্ছিল না। তাই একদিন তাকে কিছু না বলেই গোপনে সেখান থেকে অন্যত্র রওয়ানা হয়ে গেলাম ।

নিজকে আড়াল করার জন্য এ সময় আমি মহিলাদের পোষাক পরে নিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে দেখলাম, একজন ঘোড় সওয়ার দাঁড়িয়ে আছে এবং সে তার সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে বারবার আমাকেই পর্যবেক্ষণ করছে। এক সময় সে যখন নিশ্চিত রূপে বুঝতে পারল যে, আমিই ইব্রাহীম ইবনে মাহদী তখন সে হঠাৎ ঘোড়ার পিঠ থেকে এক লাফে নেমে এসে আমাকে জাপটে ধরল। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, ইব্রাহীম ইবনে মাহদী! ইব্রাহীম ইবনে মাহদী !! খলীফা যাকে গ্রেফতার করার জন্য লক্ষ দেরহাম পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তোমরা কে কোথায় আছ জলদী এসো।

আমি দেখলাম অবস্থা বেগতিক। অত্যন্ত শোচনীয়। তার কাছ থেকে ছুটতে না পারলে জীবন বাঁচাবার আর কোন উপায় নেই । তাই দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে তাকে এত জোরে একটি ধাক্কা লাগালাম যে, তা সামলাতে না পেরে সে ছিটকে গিয়ে একটি গভীর খাদের মধ্যে পড়ে গেল ৷

ঘোড়সওয়ার ছিল খলীফা মামুনুর রশীদের একজন শক্তিশালী সৈনিক। আমি তার সাথে এরূপ আচরণ করব এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিতে সক্ষম হব এমনটি হয়তো সে ভাবতেও পারেনি। খাদে পড়ে গিয়ে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। সেখানে পতিত হওয়ার পর সে আমাকে পাল্টা আক্রমণ করবে তো দূরের কথা, নিজেকে সেখান থেকে সাথে সাথে তুলে আনাও তার পক্ষে সম্ভব হল না। এ সুযোগে কালক্ষেপণ না করে আমি যে দিকে পারলাম উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে লাগলাম এবং দ্রুত একটি সংকীর্ণ অন্ধকার গলির ভিতর ঢুকে পড়লাম ।

গলিপথ দিয়ে বেশকিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ দেখলাম, একজন মহিলা তার ঘরের দরজার সামনে বসে আছে। আমি খুব বিনয়ের সাথে তাকে অনুরোধ করে বললাম, বোন! আমার জীবন হুমকীর সম্মুখীন। দুশমনরা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দয়া করে আমাকে একটু আশ্রয় দিন ।

সৎ স্বভাবের সে মহিলা আমার কথা শুনে সাথে সাথে আমাকে ঘরের ভিতর প্রবেশ করার আহবান জানাল এবং আমার প্রতি অনুগ্রহশীল হয়ে পর্দার আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ করে বলল, জনাব! আসুন! ভিতরে আসুন!! আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি। আমি আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম ।

ঘরে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। মহিলার আহবানে আমি একটি কক্ষে প্রবেশ করার পর আমাকে সেখানে বিশ্রাম করার কথা বলে সে বাইরে দিয়ে কক্ষটি তালাবদ্ধ করে দিল। যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, এতে কোন লোক আছে। আমি মনে মনে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম এবং একথা ভেবে স্বস্তি অনুভব করলাম যে, আর যাই হোক, খলীফা মামুনের সিপাহীর হাত থেকে তো বাঁচা গেল ।

কিন্তু পরক্ষণেই আমি যা শুনলাম ও দেখলাম, তাতে বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও দপ করে নিভে গেল। কেননা কিছুক্ষণ পূর্বে যে সিপাহীকে খাদে ফেলে দিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিলাম সে-ই এখন আমার দরজার সামনে উপস্থিত। খাদে পড়ে গিয়ে সে মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। যে মহিলা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল তার সাথে সে কথা বলছে। তার কাঁধে হাত দিয়েই সে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করছে। তাদের কথা-বার্তা ও আচার-আচরণ দেখে আমার বুঝতে বাকী রইল না যে, উক্ত মহিলা সিপাহীর স্ত্রী ।

পায়ে আঘাত পাওয়ার কারণে সিপাহী খুঁড়ে খুঁড়ে মাটিতে পা হেঁচড়িয়ে চলছিল । মাথা ও দেহের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে রক্ত ঝরতে দেখা গেল । মাঝে মধ্যে সে ব্যথায় ককিয়ে উঠছিল। ব্যাপারটা এখন এই দাঁড়াল যে, সিপাহীকে মারাত্মকভাবে আহত করে আমি তারই বাড়ীতে তারই প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর আশ্রয় গ্রহণ করেছি। এ বিস্ময়কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আমি হাসব না কাঁদব তা বুঝতে পারছিলাম না। এ সময় মনের ধুক ধুকানী আরও বেড়ে গেল। চারিদিক থেকে হীম-শীতল মৃত্যু আতংক আমাকে ঘিরে ধরল। এক সময় নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বললাম, ইব্রাহীম! এবার তোমার বাঁচার আর কোন পথ নেই। তোমার মউতই তোমাকে এখানে ডেকে এনেছে।

আমার রুমের একটু দূরে বসে সিপাহী তার স্ত্রীর নিকট সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে শুনাল। আমার আকার আকৃতিও তার সামনে উপস্থাপন করল । আমার বয়স আনুমানিক কত হবে তাও সে বলতে ভুল করল না।

ফলে প্রিয়তম স্বামীর গোটা দেহকে রক্তাক্তকারী অপরাধী যে আমিই, একথা বুঝতে মহিলার মোটেও অসুবিধা হল না। এমতাবস্থায় মহিলা কি কঠিন সিদ্ধান্ত নিবেন তা বলাই বাহুল্য ।

কিন্তু ঘটনা দাঁড়াল সম্পূর্ণ উল্টো। পবিত্র মনের সে মহিলা শান্ত ভাবেই সবকিছু শুনে গেল। কিন্তু আমার কথা ঘুণাক্ষরেও সে স্বামীর সাথে উচ্চারণ করল না । এমন কোন আচরণও সে করল না যদ্বারা স্বামী বুঝতে পারে যে, আমি তারই ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় বিশ্রাম করছি। আমি এখন তারই হাতের মুঠোয় ।

মহিলাটি একদিকে স্বামীর বর্ণিত কাহিনী মনযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছে আর অন্যদিকে অত্যন্ত যত্নসহকারে আন্তরিকভাবে স্বামীর আহত স্থানগুলো পরিস্কার করে তাতে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কথা-বার্তা বলে স্বামীকে সান্তনা দিচ্ছে ।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ যাবত আন্তরিক সেবা-যত্ন, ভালবাসা, মহব্বত ও ভক্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনায় স্বামীর শরীরে একটু আরামবোধ হলো এবং এক সময় সে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হল।

এরপর যা ঘটলো তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত। যা প্রত্যক্ষ করে আমি কেবল খুশিই হইনি রীতিমত বিস্মিতও হয়েছি। একজন মহিলা আপন কলিজার টুকরো স্বামীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেও কেবলই অঙ্গীকার পালনের জন্য অপরাধীকে এভাবে ক্ষমা করে দিতে পারে, তার সাথে এমন সৌজন্যমূলক ভদ্র ব্যবহার করতে পারে, উপরন্ত একলক্ষ দিরহামের পুরস্কারকে কোরবানী দিতে পারে তা আমার ধারণায় ছিল না। বিষয়টি আমার নিকট কেবল অসম্ভব নয় অবাস্তবও মনে হয়েছিল। কিন্তু মহিয়সী এ নারীর বেলায় তাই ঘটল। সে মহাপ্রলয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানব জাতিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল মুসলমান ওয়াদা খেলাফ করতে পারে না। অঙ্গীকার রক্ষার জন্য যে কোন ধরণের কোরবানী দিতে সে প্রস্তুত থাকবে। নিজের সহায়-সম্পত্তি আর প্রিযতম স্বামী কেন, প্রয়োজনে স্বীয় জীবনকে বিপদের সম্মুখীন করে হলেও সে তার ওয়াদা রক্ষা করতে সচেষ্ট হবে। কেননা ওয়াদা পালন তো ঈমানেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদা খেলাফ সম্পর্কে কত কঠিন কথাই না উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন ঐ ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ নয়, যার ওয়াদা ঠিক নেই। তাই পরিপূর্ণ মুমিন হতে হলে অবশ্যই ওয়াদা পালনের প্রতি যত্নবান হতে হবে ।

যাহোক, স্বামীকে ঘুম পাড়িয়ে এ বিদূষী মহিলা হালকা পায়ে আমার দরজায় এসে দাঁড়ালো। তাকে আসতে দেখে আমি ভেবেছিলাম, এবার আর আমার রক্ষা নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম ভিন্ন কিছু। সে আমার কাছে এসে অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষায় অনুচ্চ স্বরে বলল, ভাই! এই সিপাহী যাকে আপনি মারাত্মভাবে জখম করেছেন তিনি আমার স্বামী । আর একজন দ্বীনদার স্ত্রী তার স্বামীকে কতটুকু শ্রদ্ধা করে, কি পরিমাণ মহব্বত করে তা হয়ত আপনার অজানা নয়। একে তো আপনি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে চরম অপরাধী আবার আমার কলিজার টুকরা স্বামীকে আহত করে সে অপরাধের মাত্রাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছেন। উপরন্ত আপনাকে এখন বন্দী করে খলীফার হাতে তুলে দিলে আমরা একলক্ষ দিরহাম পুরস্কার পেতে পারি এবং সেখানে আপনাকে অপমানিত হতে দেখে নিজেদের প্রতিশোধ স্পৃহাও চরিতার্থ করতে পারি । কিন্তু এতটুকু বলার পর তার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে । মুখ থেকে কোন কথা সরে না। ছলছলিয়ে উঠে আখিযুগল। প্রিয়জনের এ কাহিনীর প্রতিক্রিয়ায় বড় দুফোটা তপ্ত অশ্রু মুক্তধারার ন্যায় নীচে গড়িয়ে পড়ে। স্বামীর রক্তাক্ত দেহের দিকে একবার তাকিয়ে সে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেঁকে মাটিতে বসে পড়ে। ছোট্ট শিশুটির মতো মুখ গুজে কিছুক্ষণ কাঁদে। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে সে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আঁচলে চোখ মুছে সে আবার বলতে থাকে-

কিন্তু ভাইজান! আমি একজন মুসলিম নারী। আপনাকে আমি আশ্রয় দিয়েছি। নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার করেছি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে আশ্বস্ত হয়েই আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। সুতরাং কিছুতেই আমি আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আমি আমার অঙ্গীকার পালনের জন্য যে কোন ধরণের কোরবানী দিতে প্রস্তুত আছি। আমার মানবতা ও ভদ্রতা কখনো এমনটি মেনে নিবে না যে, আমার আশ্রয়ে থাকাকালীন আপনার কোন কষ্ট হোক।

মহিলার কথা শুনে আমি লজ্জায় ও ভয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলাম। আমার মুখ থেকে একটি শব্দও বেরোল না। মনে মনে বললাম, আল্লাহ! একি কোন মহিলা না ফিরিশতা? এমন অনুপম চরিত্র ও সুন্দর আদর্শের নারীও কি তাহলে পৃথিবীতে আছে? যারা কেবলই ওয়াদা রক্ষার খাতিরে এতবড় উদারতার পরিচয় দিতে পারে? লক্ষ্য দিরহামের মায়াকে অবলীলায় ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিতে পারে? পারে আদরের স্বামীর প্রাণঘাতী শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়ে এরূপ সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা বলতে?

আমি কথাবার্তা না বলে, হতভম্বের মতো বসে রইলাম। মহিলার বলে যাওয়া কথাগুলো চিন্তা করতে লাগলাম। এভাবে চিন্তার অথৈ সাগরে হারিয়ে গেলাম । হঠাৎ মহিলাটি আবার কথা শুরু করলে আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে তার কথার দিকে মনোনিবেশ করলাম।

সে বলল, ভাই! আমার স্বামী এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরেই হয়তো ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। তাই দেরী না করে আপনি এখনই এখান থেকে অন্যত্র সরে যান। আমার স্বামী যদি জেগে উঠেন, তবে তা আপনার ও আমার উভয়ের জন্যই বিপদের কারণ হবে। সুতরাং আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে আপনি চুপচাপ বেরিয়ে পড়ুন।

মহিলার কথা শেষ হওয়ার পর তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কম্পমান পদে ধীরে ধীরে সেখান থেকে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবারও বেরিয়ে পড়লাম । সেখান থেকে বের হওয়ার পর গোটা দুনিয়া আমার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এল। মৃত্যু ভয়ে আমার আপাদমস্তক কাঁপতে শুরু করল। এ সংকটময় মুহূর্তেও আমি মহিলার মহানুভবতা ও তার অঙ্গীকার পালনের অনুপম দৃষ্টান্তের কথা বারবার স্মরণ করে সামনে অগ্রসর হতে থাকলাম ।

এভাবে কিছুদুর চলার পর হঠাৎ আমার এক প্রিয় বাদীর কথা মনে পড়ল । মনে মনে বললাম, আরে! এ বিপদ মুহূর্তে তো আমি তার কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারি। এ কথা চিন্তা করে সাথে সাথে তার বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম। যখন আমি তার ঘরের দরজায় পৌছলাম তখন আমাকে দেখতে পেয়ে সে সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে এল এবং খুব ব্যাকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তার এ কান্না যে মায়াকান্না ছিল, তা আমি বুঝতে পারিনি। অতঃপর সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল এবং আমার সাথে শান্তনামূলক অনেক কথাই বলল। আমার এ বিপদের কথা আলোচনা করে বার বার সে আঁচলে চোখ মুছল। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আমি আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করলাম। ভাবলাম, জীবনের এই কঠিন মুহূর্তে কয়েকটা দিন হলেও তার নিকট নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।

এরপরের ঘটনা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। একজন বাদী আপন মুনীবের সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি । সে আমাকে ঘরে বসিয়ে কিছু সময়ের জন্য বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই সে আমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে গেছে। এ সময় আমার পেটেও ছিল প্রচন্ড ক্ষুধা। তাই এ কথা ভেবে খুশি হলাম যে, এখন কিছু খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ আরাম করা যাবে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার আশায় বালি পড়ল । আমি বাস্তবে যা দেখলাম, তা আমার কল্পনাকেও হার মানাল !

বাদী এবার ফিরে এল ৷ তবে একা নয়, কয়েকজন নওজোয়ান সিপাহীকে সঙ্গে নিয়ে। তার চোখে-মুখে প্রাণোচ্ছলতার ছাপ । সে এক গাল দুষ্টমীভরা হাসি দিয়ে বলল, এ দৃশ্য দেখে আপনি হয়তো আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাবছেন। কিন্তু তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। যদি আপনার মত শিকার ধরে দিতে পেরে লক্ষ দেরহাম পুরস্কার পাওয়া যায়, তাহলে একেই আমি জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করব। সুতরাং বন্দী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন।

বাদীর কথা শুনে ও এ অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আমি সীমাহীন আশ্চর্য হলাম। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বাদীকে লক্ষ্য করে শুধু এতটুকুই বললাম যে, উপকারীর উপকার বুঝি মানুষ এভাবেই করে। তুমি আমার প্রতি কেবল টাকার লোভে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারবে তা আমি কোনদিন কল্পনা ও করতে পারিনি । একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ।

যা হোক এ অবস্থায়ই আমি বন্দী হলাম । সিপাহীরা আমাকে গ্রেফতার করে খলীফা মামুনের দরবারে উপস্থিত করল ।

খলীফার দরবারে পৌঁছে আমি রাজকীয় নিয়মানুসারে খলীফাকে সালাম করলাম । খলীফা আমার সালামের জবাব দিলেন বটে, কিন্তু রাগে- গোস্বায় তখন তিনি কটমট করছিলেন। গোটা দরবারে তখন একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কেউ কোন কথা বলছে না। রাষ্ট্রদ্রোহী, বিদ্রোহীর শাস্তি কত কঠিন ও নির্মম এবং তার শেষ পরিণতি কি হবে এখানকার সকলেই তা জানে। আর একথা আমারও অজানা ছিল না। বিভীষিকাময় মৃত্যু তখন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল । আমি জানতাম, ন্যায়-পরায়ন এ খলীফার দরবারে স্বজনপ্রিয়তার কোন স্থান নেই। অপরাধী হিসেবে যে যতটুকু শাস্তির যোগ্য তা তাকে ভোগ করতেই হবে। তথাপি আমি জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে একটু সাহস সঞ্চয় করে বললাম-

আমীরুল মুমেনীন! দয়া করে আমার ব্যাপারে তাড়াগুড়া করবেন না । একথা নিঃসন্দেহে শতভাগ সত্য যে, একজন বিদ্রোহী হিসেবে আমি কঠোর শাস্তির যোগ্য। কিন্তু আপনার উদারচিত্ত ও দয়াভরা অন্তরের কাছ থেকে ক্ষমা লাভের ব্যাপারেও আমি নিরাশ নই ।

আমি জানি আমার অপরাধ অন্য সব অপরাধের চেয়ে বড়। কিন্তু আপনার বেনযীর উদারতা এবং হৃদয়ের প্রশস্ততা আমার অপরাধের চাইতেও বিশাল । আজ যদি আপনি আমাকে শাস্তি দিতে চান, তবে অবশ্যই আমি তার উপযুক্ত। আর আপনার সে অভিপ্রায়ে বাধা দানের ক্ষমতাও কারো নাই । কিন্তু আপনি যদি তা না করে আমাকে ক্ষমা করে দেন তবে তা আপনার মহানুভবতারই পরিচায়ক হবে এবং বিশ্বের ইতিহাসে আপনার নাম সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। আমার কার্যাবলী যদিও ভদ্রতা পরিপন্থী ছিল, কিন্তু তাই বলে আমীরুল মুমিনীনের কাজও ভদ্রতা পরিপন্থী হবে এমন কল্পনা করাও আরেকটি অন্যায় বৈ কিছুই নয় ।

আমার কথাগুলো খলীফা গোগ্রাসে গিলছিল । মনে হল, প্রতিটি কথাই যেন তার হৃদয়ের গহীন কোণে মৃদু আঘাত করল। আর তারই প্রভাবে তার চেহারার রং পাল্টে গেল । বিরক্তি, বিষণ্নতা ও নিষ্ঠুরতার পরিবর্তে সে চেহারায় একটি মায়ার স্পষ্ট আবরণ ছেয়ে গেল। দারুন প্রভাবিত হয়ে পড়লেন তিনি ৷

এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি উপস্থিত সভাসদদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন,উপস্থিত পরিষদবর্গ! এ আসামীর ব্যাপারে আপনাদের অভিমত কি?

খলীফার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই তারা এক বাক্যে বলে উঠল, নির্মম মৃত্যুদন্ডই এ আসামীর উপযুক্ত শাস্তি। রাষ্ট্রদ্রোহীতার স্বাদ কত তিক্ত, নিষ্ঠুর মৃত্যুই তাকে উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিবে।

কিন্তু দরবারে উপস্থিত উযীরে আজম আহমদ ইবনে খালেদ শুধু ভিন্ন মতামত পেশ করলেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। তিনি বললেন, আমীরুল মুমেনীন! বিদ্রোহী আসামীকে নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়ে হত্যা করা একটি সচরাচর ব্যাপার। ইতিহাসে এটা কোন দুর্লভ বিষয় নয়। তবে আপনি যদি আপনার প্রশস্ত মন, অপরিসীম উদারতা ও বিশাল মহানুভবতার কথা স্মরণ করে তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন তাহলে ইতিহাসের সোনালী পাতায় আপনার নাম চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। অনাগত ভবিষ্যতের পরবর্তী প্রজন্ম আপনার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

খলীফা মামুন অত্যন্ত গুরুত্ব ও মনোযোগ সহকারে উযীরে আজমের কথাগুলো শ্রবণ করলেন। তারপর আমার প্রতি একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, আজ যদি বিদ্রোহী হওয়ার কারণে আমি আমার চাচার গায়ে তীর চালাই, তবে সেটা কার গায়ে লাগবে? সেটা তো প্রকারান্তরে আমার গায়েই লাগবে ।

আমীরুল মুমেনীনের কথা শুনে আমার শুষ্ক ঠোঁটে খেলে গেল এক টুকরো হাসি । খুশিতে ঝলকিত হয়ে উঠল আমার গোটা চেহারা। চোখের কোণে দেখা দিল বাধভাঙ্গা অশ্রু। তবে এ অশ্রু দুঃখের নয় আনন্দের। বেদনার নয় । খুশীর । মনে হল, এটিই যেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন। সবচেয়ে বড় খুশির দিন। তাই সীমাহীন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম আমি। অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলে খোদার শোকর আদায় করলাম ।

এ সময় খলীফা মামুন আল্লাহ পাকের দরবারে সিজদাবনত হলেন এবং কিছুক্ষণ পর মাথা উত্তোলন করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাচাজান! আপনি কি জানেন আমার সিজদার কারণ কি? আমি বললাম, আমীরুল মুমেনীন! এর কারণ হয়ত এটাই হবে যে, আল্লাহ পাক দয়া করে আমাকে আমীরের বাধ্যগত হওয়ার তাওফীক দান করেছেন।

খলীফা বললেন, না চাচাজান, আমি সিজদায়ে শোকর এজন্য আদায় করলাম যে, আল্লাহ পাক আমার ক্রোধের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে আপনার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করার তৌফিক দিয়েছেন। একথা শুনে আমি আবারও খোদার দরবারে কালিমাতুস শুকর আদায় করলাম।

অতঃপর খলীফা মামুনুর রশীদ আসন থেকে নেমে আমার কাছে এসে বললেন, আত্মগোপনের দিনগুলো আপনার কিভাবে কোথায় কেটেছে তার কিছু বিবরণ আমাদেরকে শুনান। আমি সবাইকে পুরা বিবরণ শুনালাম । আমার বক্তব্য সকলেই মনোযোগ সহকারে শুনল এবং যারপর নাই আশ্চর্য হল। সবশেষে আমি বললাম, আজ আমার সকল অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। আমার মনে আর কোন দুঃখ নেই। খলীফার আনুগত্য স্বীকার না করে সত্যিই আমি মহা ভুল করেছিলাম। আল্লাহ আমাকে সত্যের পথে ফিরে আসার তাওফীক দিয়েছেন। এখন আমি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। দিনের আলো-বাতাস উপভোগ করতে পারছি। এবার রাতের অন্ধকার দূর হয়ে আমার জীবনে এসেছে নব প্ৰভাত৷

আমার কথা শেষ হলে পর খলীফা ঐ যুবককে ডাকলেন, যে শ্রদ্ধাভরে সযত্নে আমার মেহমানদারী করেছিল। তারপর অঙ্গীকার পালনকারী ঐ মহিয়সী মহিলাকেও ডাকলেন যে নিজের অঙ্গীকার রক্ষার খাতিরে প্রেমাস্পদ স্বামীর প্রাণঘাতী শত্রুকেও নিঃসংকোচে ক্ষমা করে দিয়েছিল। অতঃপর ঐ ধোকাবাজ লোভী বাদীকে উপস্থিত করলেন, যে কয়েকটি দিরহামের লোভে আপন মুনীবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে হত্যার জন্য খলীফার দরবারে পেশ করেছিল।

যে যুবক আমার মেহমানদারী করেছিল, খলীফা তার জন্য মাসিক একহাজার স্বর্ণমুদ্রা ধার্য করে দিলেন। আর ঐ নেককার দ্বীনদার মহিয়সী নারীকেও বিভিন্ন প্রকার পুরস্কার দিয়ে পরিতৃপ্ত করলেন ।

সবশেষে লোভী বাদীকে ডাকলে সে পুরস্কারের আশায় দৌড়ে এল। কিন্তু খলীফা তাকে পুরস্কারের পরিবর্তে মুনীবের সাথে বেঈমানীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেন।

আলোচ্য ঘটনায় একদিকে যেমন খলীফা মামুনের মহানুভবতার দিকটি স্পষ্টরূপে ফুটে উঠল ঠিক তেমনি অন্যদিকে একজন মুসলিম রমনীর ওয়াদা পালনের অভাবনীয় দৃষ্টান্তটিও আমাদের জন্য সবক হয়ে রইল। প্রকৃত প্রস্তাবে, মুসলমানদের চরিত্র তো এমনই হওয়া উচিত। আল্লাহপাক লেখক, পাঠক-পাঠিকা তথা বিশ্বের সকল মুসলমানকে এরূপ চরিত্র মাধুর্য দান করুন। আমীন। (সূত্র : বেহেশতী হুর)

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের যে গল্পে অশ্রু ঝরে – হৃদয় গলে সিরিজ ৮ বই থেকে।

Leave a Comment