স্বামী ভক্তির অত্যুজ্জল দৃষ্টান্ত – বিবি রহিমার ঘটনা

এটি হযরত আইয়ূব নবী (আঃ) এর বিবি রহিমার ঘটনা যিনি তাঁর অগাধ স্বামী ভক্তির জন্য দুনিয়া জুড়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আজ আমরা হযরত রহিমা (আঃ) এর স্বামী ভক্তির অত্যুজ্জল দৃষ্টান্তের ঘটনা জানবো। চলুন শুরু করা যাক..

স্বামী ভক্তির অত্যুজ্জল দৃষ্টান্ত
ছবি: এক নারী তাঁর স্বামীর প্রতি ভক্তি জ্ঞাপন করছে!

স্বামী ভক্তির অত্যুজ্জল দৃষ্টান্ত – বিবি রহিমার ঘটনা!

যে সব ভাগ্যবতী নারী স্বামী ভক্তির পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কিয়ামত পর্যন্ত আগত নারীদের জন্য আদর্শ হয়ে আছেন তাদের শীর্ষস্থানীয় হচ্ছেন হযরত রহীমা (আ)। স্বামীর প্রতি তার অকৃত্রিম প্রেম, নযীরবিহীন ভালবাসা ও সীমাহীন মহব্বতের কারণে জগতের মানুষ আজও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। স্বীয় স্বামীর খেদমত করতে গিয়ে তিনি যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে অনুরূপ দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।

হযরত রহীমা ছিলেন হযরত আইয়ূব (আ.) এর প্রিয়তম সহধর্মীনী । বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা মহান আল্লাহ যখন পরীক্ষা স্বরূপ হযরত আইয়ূব (আ.) কে কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত করলেন এবং তার দেহের গোশতগুলো পঁচে-গলে চতুর্দিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো তখন আত্মীয় স্বজন ও একান্ত ঘনিষ্ঠজনরা পর্যন্ত তার নিকট আসা যাওয়া বন্ধ করে দিল । শুধু তাই নয়, জীবনের এই চরম সংকটময় মুহূর্তে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীগণ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে চলে গেল । কিন্তু স্বামীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও নিখাদ ভালবাসার কারণে এমন কঠিন সময়েও হযরত রহীমা (আ.) আপন স্বামীকে ছেড়ে চলে যাননি। বরং হৃদয়ে পুঞ্জিভূত সমস্ত প্রেম- ভালবাসা দিয়ে একনিষ্টভাবে তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বামীর খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

আজ অনেকদিন হল হযরত রহীমা (আ.) পরম আন্তরিকতার সাথে হযরত আইয়ুব (আ.) এর সেবা-যত্ন করে যাচ্ছেন। তার সেবা- যত্নে হযরত আইয়ূব (আ.) অত্যন্ত খুশি। এজন্য প্রাণ খুলে তিনি স্ত্রী রহীমার জন্য খোদার নিকট দোয়া করেন। মনে মনে বলেন, “হে দয়াময় খোদা! এই কঠিন বিপদে আপতিত হয়েও আমি তোমার উপর রাযী আছি। এতে বিন্দু মাত্রও নাখোশ নই আমি। আমার এই মারাত্মক রোগের কারণে সবাই আমাকে ঘৃণা করে চলে গেল। কেউ আমাকে দেখতেও আসে না। এমনকি খোঁজ খবরও নেয় না। অথচ রহীমা দিন রাত পাশে থেকে বিরামহীন ভাবে আমার খেদমত করে যাচ্ছে। হে করুণাময়! তুমি রহীমাকে এর উত্তম বদলা দান কর।’

হযরত রহীমা (আ.) স্বামীর জন্য যে কোন কোরবানী দিতে তৈয়ার। এমনকি প্রিয়তমের জন্য যদি জানটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয় সেজন্যও সব সময় প্রস্তুত’। ‘যে কোন উপায়ে স্বামীর মন খুশী রাখাকেই তিনি জীবনের প্রধান কর্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

হযরত আইয়ুব (আ.) এর দেহ থেকে কখনও রক্ত ঝরে। কখনও পুঁজ গড়িয়ে পড়ে। কখনও বা তিনি রোগের প্রচন্ডতায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন। কিন্তু বিবি রহীমা এজন্য কোন ক্লান্তি বা ঘৃণাবোধ করেন না। তিনি হাত দিয়েই শুধু নয়, মাঝে মধ্যে স্বীয় আঁচল দিয়ে স্বামী দেহের রক্ত-পুঁজগুলো মুছে দেন। পরম ভালবাসায় মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীকে জাগিয়ে তুলেন। বিভিন্ন কথা-বার্তা বলে স্বামীকে সান্তনা দেন। বিবি রহীমার এসব কর্মকান্ড দেখে হযরত আইয়ুব (আ.) আশ্চর্য হন। সীমাহীন বিস্মিত হয়ে তিনি ভাবেন, দেখলেই ঘৃণার উদ্রেক হয় এমন কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরও রহীমা আমাকে কত ভালবাসে! আমার জন্য তার ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেম কত অপরিসীম! কত নিখাদ! হায়, জগতের সকল নারীই যদি আপন স্বামীকে এরূপ ভালবাসত !

হযরত রহীমার (আ.) নযীরবিহীন খেদমতের কারণে তার মর্যাদা দিন দিন খোদার দরবারে বাড়তে লাগল। অসীম মর্যাদায় ভূষিত হতে লাগলেন তিনি । কিন্তু মরদুদ শয়তানের নিকট ব্যাপারটি মোটেই পছন্দ হল না। ক্রমে যেন ইহা তার বরদাশতের বাইরে চলে গেল । তাই সে চিন্তা করল, যে কোন উপায়ে হোক, রহীমাকে স্বামীর খেদমত থেকে বঞ্চিত করতেই হবে।

ইবলিস তাঁর হীন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য নানা প্রকার ফন্দি ও কুটকৌশল অবলম্বনে মগ্ন হল। বেশ কিছুদিন বিরতিহীন চেষ্টার পর সে একটি কৌশল আবিস্কার করতে সক্ষম হল।

এবার ইবলিসের খুশি দেখে কে? মনের মত কৌশল খুঁজে পাওয়ায় তার আনন্দ যেন আর ধরে না। সে এবার কালবিলম্ব না করে তার কৌশল বাস্তবায়নে মনোযোগী হল।

প্রথমে ইবলিস এক ধনাঢ্য গৃহবধূর সাথে দরবেশের বেশে সাক্ষাত করল। সেই গৃহবধূ ছিল পরমা সুন্দরী। তার রূপ যৌবন ছিল অতুলনীয়। কিন্তু চুলগুলো খুবই ছোট ও পাতলা হওয়ার কারণে তার দু:খের অন্ত ছিল না।

বিভিন্ন কথাবার্তার মাধ্যমে ইবলিস গৃহবধূর হিতাকাংখী সাজল। বলল, তোমার কোন ভয় নেই। আমার পরামর্শ মোতাবেক কাজ করলে অল্প দিনের মধ্যেই তোমার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়ে যাবে ৷

ইবলিসের কথা শুনে গৃহবধূ খুব খুশি হল । বলল, হুজুর! বলুন কি পরামর্শ? আমি যে কোন মূল্যে আপনার পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করবো ।

ইবলিস বলল, এজন্য তোমাকে কষ্টকর কিছুই করতে হবে না । আজকে তোমাদের বাড়ীতে রহীমা নামের একটি মহিলা আসতে পারে। তার মাথার কেশরাজি যেমনি লম্বা তেমনি চমৎকার। তার মাথা থেকে যদি এক গোছা চুল কেটে রাখতে পার তাহলে উহা দিয়ে তোমাকে এমন তদবীর বাতলে দিব যাদ্বারা অল্প দিনের মধ্যেই তোমার মাথায় লম্বা, কাল ও ঘন চুল গজাবে। তখন দেখবে সকলেই তোমার চুলের ভূয়সী প্রশংসা করছে।

ইবলিসের কথা গণীমত মনে করে উক্ত গৃহবধূ হযরত রহীমার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগল। স্বামী অসুস্থ থাকায় নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা বিবি রহীমাকেই করতে হত। তাই প্রতিদিন তিনি কিছু সময়ের জন্য মহল্লায় চলে যেতেন এবং কোন বাড়ীতে কাজকর্ম করে সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করতেন।

অন্যান্য দিনের মত আজও তিনি কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু সারাদিন খুঁজে কোন কাজ যোগাতে পারলেন না । শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরার পথে এক গৃহস্থের বাড়ীতে এসে কাজের বিনিময়ে খাবার চাইলেন । গৃহবধু বিবি রহীমার পরিচয় পেয়েই যারপর নাই খুশি। দরবেশের কথা মত লম্বা চুল ওয়ালী রহীমাকে পেয়ে সে আনন্দে আটখানা। ভাবল, বুযুর্গ দরবেশের কথাইতো সত্য হল। সুতরাং তার কথা মত যখন মহিলাকে পেয়েছি তখন ক্রমান্বয়ে আমার মনোবাসনাও নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে।

মহিলা বিবি রহীমাকে বলল, আমি তোমাকে খাবার দিতে রাজী আছি । তবে তা কাজের বিনিময়ে নয়, চুলের বিনিময়ে।

: মানে? বিবি রহীমা বলল।

: মানে বুঝলে না? মানে হল, তোমার মাথা থেকে আমাকে এক গোছা চুল দিবে। তবেই কেবল তুমি খাবার পেতে পার। এছাড়া অন্য যে কোন উপায়ই দেখাও না কেন, কমপক্ষে আমার নিকট থেকে খাবারের আশা,করতে পারে না।

হযরত রহিমা (আ.) খানিক চিন্তা করলেন। ভাবলেন, আজ সারাদিন আমার কলিজার টুকরা স্বামী না খেয়ে আছেন। ক্ষুধার  জ্বালায় না জানি কত কষ্ট করছেন। আবার এই পড়ন্ত বিকেলেও যদি তার নিকট খালি হাতে গিয়ে হাজির হই তাহলে তো তার কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। সীমাহীন কষ্ট হবে তার। সুতরাং তার জন্য আমাকে যে কোন মূল্যে খাবার সংগ্রহ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে খাবার খাইয়ে খুশি করতে না পারবো, ততক্ষণ আমার অশান্ত চিত্ত শান্ত হবে না।

এসব কথা চিন্তা করে বিবি রহীমা আপন চুলের বিনিময়েই খাবার নিতে সম্মত হলেন । বললেন-

: বোন! আমার স্বামী আজ সারাদিন উপোস। তিনি অসুস্থ । হয়ত ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। সুতরাং শুধু চুল কেন আমার জীবনের বিনিময়েও যদি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে স্বামীর মুখে হাসি ফুটাতে পারি তাহলে নিজেকে আমি মহা সৌভাগ্যবতীদেরই একজন বলে মনে করব।

গৃহবধূ বিবি রহীমার স্বামী-প্রীতির কথা শুনে আশ্চর্য হল । ভাবল, স্বামীর জন্য স্ত্রীর এতবড় দরদ! এতবেশী ভালবাসা!! স্বামী তো আমারও আছে। কিন্তু আমি তো কোনদিন তার জন্য এত মহব্বত দেখাইনি । এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আমিও কি পারব বিবির রহীমার মতো এমন ত্যাগ ও কুরবানীর নযীর পেশ করতে? পারব কি প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গৃহবধুর চক্ষুগুলো অশ্রুসজল হয়ে উঠল। মনে মনে বলল, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা, প্রেম, মহব্বত এমনই হওয়া উচিত। একে অপরের জন্য কষ্ট ত্যাগ কেন, জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত না থাকলে এ কেমন স্বামী- স্ত্রী? উভয়ে একে অপরের জন্য এমনই হওয়া চাই। রহীমার কথায় গৃহবধূর হৃদয় গলে গেল। সে তাকে বিনিময় ছাড়াই খাবার দিতে চাইল। কিন্তু পরক্ষণে শয়তানের প্ররোচনায় মন ঘুরে গেল। মনে মনে বলল, সে যাই হোক, আমার তো চুলের প্রয়োজন। তার এই চুলের উসিলাতেই আমার চুল লম্বা হবে, সুন্দর হবে। জীবনের একমাত্র আশা পূর্ণ হবে। অতৃপ্ত মন তৃপ্তিতে ভরে উঠবে। তখন কতই না আকর্ষনীয় দেখাবে আমাকে।

সে বিবি রহীমার নিকট পূর্বের প্রস্তাবই পুনরায় পেশ করল। বিবি রহীমা উপায়ন্তর না দেখে কেবল স্বামীর ভালবাসার খাতিরেই আপন চুলের বিনিময়ে খাবার সংগ্রহ করে বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিল।

এদিকে ইবলিস গৃহবধূর কাছ থেকে চুলের গোছা সংগ্রহ করে অতি দ্রুত হযরত আইয়ুব (আ.) এর নিকট পৌঁছল। বলল বিনীত কন্ঠে-

: জনাব! রোগাক্রান্ত ও অভাবগ্রস্থ হলেও তো আপনি আল্লাহর নবী। সুতরাং হালাল-হারাম বিবেচনা করে খাবার খাওয়া আপনার জন্য উচিত নয় কি?

: তা তো বটে । কিন্তু তুমি কি বলতে চাচ্ছ বুঝতে পারলাম না।

: কি আর বলব । বলতেও লজ্জা লাগে। নবীর স্ত্রীর ব্যাপারে এমন কথা কিভাবে মুখে তুলি।

: কি, কি হয়েছে? খুলে বল। নইলে আমি বুঝব কি করে?

: আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো বলা শোভা পাচ্ছে না। তারপরেও আপনার একজন হিতাকাংখী হিসেবে না বলে পারছি না।

: তুমি নির্ভয়ে মনের কথা খুলে বল।

: কথা হল, আজ ক’দিন যাবত আপনার স্ত্রী রহীমা সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় খাবার সংগ্রহ করছেন। আর আপনার সরলতার সুযোগে এই খাবারই আপনাকে খাওয়াচ্ছেন।

: বল কি তুমি? এটা কখনোই হতে পারে না। তুমি যতই বল, রহীমার ব্যাপারে এমন কথা কোন দিন আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না।

: হযরত! কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। অভাবে পড়লে ভাল মানুষও খারাপ হয়ে যায়। আপনার স্ত্রীর বেলায়ও এমনটি হয়েছে। আপনি বিশ্বাস না করলে আমার নিকট রক্ষিত প্রমাণ পেশ করতেও আমি বাধ্য হব।

: কই তোমার প্রমাণ?

: প্রমাণ অবশ্যই আছে। এ বান্দা প্রমাণ ছাড়া কিছুই বলে না। তবে তার আগে ঘটনাটা একটু শুনে নিন।

: বল, ঘটনা কি?

: ঘটনা হল, বেশ কিছুদিন যাবত বিবি রহীমা চুরি করে আপনার জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনে। আজ এক গৃহস্থের বাড়ী থেকে চুরি করে খাবার আনতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে যান। ফলে শাস্তি স্বরূপ তারা তার মাথার চুল কেটে রেখে দেয়।

একথা বলে ইবলিস একগোছা চুল বের করে হযরত আইয়ূব (আ.) এর সামনে পেশ করল। তিনি চুলগুলো দেখে বিস্মিত হলেন । তিনি খুব ভাল করেই চিনতে পারলেন যে, এ চুল রহীমারই। সুতরাং দরবেশবেশী ইবলিসের কথা অবিশ্বাস করার মত কোন পথ তার নিকট খোলা রইল না। তিনি ক্ষোভে দু:খে ফেটে পড়লেন। সাথে সাথে স্ত্রী রহীমাকে ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়ের কারণে একশত দুর্রা (বেত্রাঘাত) মারার শপথ করে বসলেন।

হযরত আইয়ুব (আ.) এর শপথ বাক্য শ্রবণে ইবলিস মহাখুশি। প্রিয়তম স্ত্রীর প্রতি নবীর ধারণা পাল্টে দিতে পারায় সে আনন্দে আত্মহারা। মনে মনে বলে, এতদিনে উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হল। বাকীটুকু হলেই আমি পরিপূর্ণ সাকসেস হব।

কিছুক্ষণ পর বিবি রহীমা বাড়ী ফিরলেন। অন্য দিনের তুলনায় বেশী খাবার সংগ্রহ করতে পারায় তিনি আজ মহাখুশি। কিন্তু বাড়ীতে ফিরে প্রিয়তম স্বামীর মলিন চেহারা ও বিষন্নতা দর্শনে সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল? তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন-

: প্রেমাস্পদ আমার! আপনার চেহারা মলিন কেন? আপনাকে এত বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন? আমার আসতে দেরী হওয়ায় বেশী কষ্ট হয়েছে বুঝি? কলিজার টুকরা আমার! আর আপনাকে কষ্ট দিব না ৷ আগামীকাল থেকে অতি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসব। আজকে সারাদিন খুঁজে কোন কাজ পাইনি বলে দেরী হয়ে গেল।

এতটুকু বলে বিবি রহীমা অন্যান্য দিনের মত আজও স্বামী দেহের রক্ত পুঁজ পরিস্কার করতে গেলেন। কিন্তু হযরত আইয়ূব (আ.) তাকে আপন শরীর স্পর্শ করতে নিষেধ করলেন। বললেন, তুমি কিছুতেই আমার দেহ ছুইতে পারবে না। আমি পঁচে গলে শেষ হয়ে যাব। তথাপি আর কোন দিন তোমার সেবা গ্রহণ করব না।

যে স্বামীকে এক মুহূর্ত না দেখলে রহীমার ভাল লাগে না। যাকে তিনি এত ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। যার জন্য তিনি এত কষ্ট স্বীকার করেন তার মুখ থেকে এমন কথা শুনে বিবি রহীমা বিস্মিত হলেন। স্বামীর এরূপ উক্তি শ্রবণে তিনি দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কি করবেন তিনি, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। এক সময় স্বামীর পায়ে পড়ে অবুঝ বালিকার ন্যায় অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।

হযরত আইয়ুব (আ.) ইবলিসের নিকট থেকে শ্রবণ কৃত কল্পিত কাহিনী বিবি রহীমার নিকট বিস্তারিত বর্ণনা করলেন। বিবি রহীমা এ মিথ্যা, বানোয়াট ও কল্পিত কাহিনী শ্রবণ করে মুষড়ে পড়লেন। মনে হল, সমস্ত আকাশ যেনো তার উপর ভেঙ্গে পড়েছে। পর্বত পরিমাণ বোঝা যেন তার মাথায় চেপে বসেছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি বসে রইলেন। অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে আলোচ্য ঘটনাকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে প্রকৃত ঘটনা স্বামীর নিকট বর্ণনা করলেন। কিন্তু হযরত আইয়ূব (আ.) সেদিকে খুব একটা কর্ণপাত করলেন না।

এবার কি করা যায় এ নিয়ে বিবি রহীমা দীর্ঘক্ষণ চিন্তা ভাবনা করলেন। শেষ পর্যন্ত দেখলেন, এ আকস্মিক বিপদ থেকে একমাত্র আল্লাহ পাকই তাকে রক্ষা করতে পারেন। তাই খোদার দরবারে তিনি দু’হাত তুলে দোয়া করলেন-

ওগো পরওয়ার দিগার! তুমি তো সবকিছুই জান। এ মহাসংকট থেকে তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। হে দয়াময় খোদা! মেহেরবানী করে তুমি যে কোন উপায়ে আমাকে এ মসীবত থেকে উদ্ধার কর।

আল্লাহ পাক বিবি রহীমার প্রার্থনা কবুল করলেন। তিনি ওহীর মাধ্যমে হযরত আইয়ূব (আ.) কে জানিয়ে দিলেন- রহীমা তার কথায় সত্যবাদী।

এ সংবাদে হযরত আইয়ূব (আ.) খুবই আনন্দিত হলেন এবং প্রিয়তম স্ত্রী রহীমাকে পূর্বের তুলনায় আরো অধিকতর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন।

হযরত আইয়ূব (আ.) এর ব্যাধি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি কঠিন পরীক্ষা। তিনি এ পরীক্ষায় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কৃতকার্য হলেন। আল্লাহ তাআলা খুশি হয়ে তার রোগ ভাল করে দিলেন। কিন্তু যেহেতু ইবলিসের প্ররোচনায় তিনি বিবি রহীমাকে একশ দুররা মারার জন্য আল্লাহর নামে শপথ করে ফেলেছিলেন, তাই সেটা পূর্ণ করাও ছিল তার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সুতরাং আল্লাহ তাআলাই এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিয়ে ঘোষণা করলেন-

শত শলাযুক্ত একটি ঝাড়ু দিয়ে তার গায়ে মাত্র একবার স্পর্শ কর। এতেই তোমার শপথ পূর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আইয়ুব (আ.) তার শপথ পূর্ণ করলেন।

সম্মানিত মা ও বোনেরা! একটু চিন্তা করে দেখুন। স্বামী কঠিন ও ঘৃণ্যতম রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও তার সেবা-শশ্রুষা করে হযরত রহীমা (আ.) যে ধৈর্য, সহনশীলতা, ত্যাগ, সহমর্মিতা ও স্বামী ভক্তির অপূর্ব নযীর স্থাপন করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ ঘটনা বিরল নয় কি?

এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আপনারাও কি স্বামীর সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারেন না? আল্লাহ আপনাদের তৌফিক দিন । আমীন। যদি এ ঘটনা দ্বারা স্বামীর প্রতি আপনাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সেবা- যত্নের মনোভাব আগের চেয়ে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায় তাহলে আমি আমার শ্রমকে স্বার্থক বলে মনে করব।

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। উৎস: যে গল্পে হৃদয় কাড়ে – হৃদয় গলে সিরিজ ৫। 

Leave a Comment