প্রেমময় জীবনের মধুয়ম অভিমান
হিজরি ষষ্ঠ সাল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) এর উপর রটানো হলো জঘন্য মিথ্যা অপবাদ। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল এ ঘটনার মূল নায়ক। সে ছিল দুশ্চরিত্র ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চির শত্রু। সতী-সাধ্বী ও পুতঃপবিত্র চরিত্রের উপর ভয়ংকর কলংক রটানো ছিল এই হতভাগারই অপকীর্তি।
সুদীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত মুনাফিক রচিত এ অপবাদের চর্চা হতে লাগল। এতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুবই দুঃখিত হলেন। তীব্রভাবে বেদনাহত হলেন সাধারণ মুসলমানগণও। মদীনার পরিবেশ কেমন যেন নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ। হযরত সাহাবায়ে কেরাম তাদের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথিত-ভারাক্রান্ত চেহারার দিকে চোখ তুলে চাইতে পারছেন না। দুঃখ-বেদনায় তাঁদের কলিজা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
আরো পড়ুন : হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রীদের নাম (বাংলা অর্থসহ)
এদিকে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর অবস্থা আরও করুণ। তিনি এই জঘন্য সংবাদ শুনে সীমাহীন ব্যথিত হন। এমনকি ক্ষোভ, দুঃখ ও বেদনার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে শয্যা গ্রহণ করেন। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সাথে কোনো প্রকার কথাবার্তা না বলে উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের ঐ রোগিনীর কি অবস্থা? এতটুকু বলেই তিনি ঘর থেকে বের হয়ে চলে যান।
ঘরে এসে কিছু জিজ্ঞেস না করে রাসূল (সাঃ)-এর চলে যাওয়ার বিষয়টি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ব্যথাকে আরও তাজা করে তুলে। পরে এ কথাটি যখনই তিনি স্মরণ করতেন, অসীম অভিমানের কারণে তখনই তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠত। এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি পিত্রালয়ে চলে যান।
পিতৃগৃহে চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রাঃ) কে দেখতে যান। তিনি ঘরে প্রবেশ করে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর কাছাকাছি বসেন। ঘটনা আরম্ভ হওয়ার পর হতে এ পর্যন্ত তিনি আর কোনদিন আয়েশা (রাঃ)-এর এত কাছাকাছি বসেননি। এতদিন পর স্বামীকে কাছে পেয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) আনন্দের আতিশয্যে কাঁদতে শুরু করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। অতঃপর করুণা বিগলিত কণ্ঠে বললেন, আয়েশা! তোমাকে এতটা বিচলিত ও চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই। তুমি যদি নিরপরাধ, ক্রটিহীন ও দোষমুক্ত হও, তাহলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তোমার সততার কথা সকলকে জানিয়ে দিবেন। আর যদি তোমার থেকে (খোদা না করুন) কোনো ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর, মাফ চাও। আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিবেন।
উপরোক্ত কথার মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) সম্ভাব্য দুটি দিক তুলে ধরে হযরত আয়েশা (রাঃ) কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন তিনি সম্ভাব্য দুটি দিকের কথা আলোচনা করলেন এটা ছিল পূতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারিণী মা আয়েশা (রাঃ)-এর জন্য সীমাহীন যাতনার বিষয়, চরম কষ্টের কারণ। কারণ এতে বুঝা যায়, রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরেও এ ব্যাপারে সামান্য দুর্বলতা আছে। যদি দুর্বলতা না থাকত, তাহলে তিনি সম্ভাবনার উভয় দিক তুলে ধরতেন না। মোট কথা তিনিও হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে এ ধরনের কিছু ঘটে যাওয়া সম্ভব মনে করেন। রাসূল (সাঃ)-এর মনের এই ভাবনা হযরত আয়েশা (রাঃ) কে দারুণভাবে আহত করে। তিনি বেদনার ভার সইতে না পেরে বিছানায় শুয়ে পড়েন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। সমস্ত হৃদয় তাঁর ক্ষত-বিক্ষত। কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। দুঃখ বেদনায় তাঁর কোমল অন্তর ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে। অস্থিরতার কালো ছায়া তাঁর পবিত্র চেহারাকে মলিন করে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হযরত জিব্রাইল (আঃ) পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হন। যাতে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর পবিত্রতা ও নিঙ্কলুষতার কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে।
এ সময় হযরত আবু বকর (রাঃ)ও ঘরে উপস্থিত ছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিষ্পাপতা ও কুলষমুক্ততার ঘোষণা শুনে রাসূল (সাঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) খুবই আনন্দিত হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) খুবই আনন্দিত হলেন। রাসূল (সাঃ) তখন মুচকি মুচকি হাসছিলেন। অতঃপর স্নিগ্ধ হাসি মুখে রেখেই বললেন—
“আয়েশা! সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তাআলা তোমার পবিত্রতা ও নির্দোষ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমার ধারণা ছিল, আল্লাহ তাআলা আপনাকে স্বপ্ন অথবা অন্য কোনো উপায়ে আমার নির্দোষ হওয়ার কথা জানিয়ে দিবেন। কিন্তু এ ধারণা আমার মোটেও ছিল না যে, আল্লাহ তাআলা আমার ব্যাপারে অকাট্য অহী নাজিল করবেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানগণ তিলাওয়াত করবেন। আমি নিজেকে এত বড় মর্যাদা পাওয়ার অপেক্ষা বহু ছোট মনে করতাম।
এ সময় হযরত আবু বকর (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) কে বললেন, আল্লাহ তা’আলা তো তোমার সততা সম্পর্কে আয়াত নাজিল করেছেন। সুতরাং উঠ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে তাকে সালাম কর। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাঃ) উঠছেন না। তিনি আপন বিছানায় আগের মতোই শুয়ে আছেন। তাঁর সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াতগুলো শুয়া অবস্থায়ই তিনি শ্রবণ করলেন। এরপর নারীসূলভ দাম্পত্য অভিমানের কায়দায় বললেন, এ তো আল্লাহ তা’আলার দয়া ও করুণা। তিনি আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করেছেন। তিনিই আমার পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো শুকরিয়া আদায় করব না। কৃতজ্ঞতা জানাব না অন্য কাউকে। কারণ, আপনারা তো মনে মনে এই ধারণাই পোষণ করে বসেছিলেন যে, আমি হয়ত ভুল করেই বসেছি।–(বুখারী ২য় খণ্ড)
প্রিয় পাঠক, একটু চিন্তা করে দেখুন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) আপন স্বামী রাসূল (সাঃ)-এর সামনে এসে দাঁড়াতে অস্বীকার করছেন, কিন্তু এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু মনে করেননি। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়নি তাঁর হৃদয়পটে। কারণ এ ছিল প্রিয়তম জীবন সঙ্গিনীর মধুময় অভিমান। বস্তুতঃ এ অভিমান প্রেমময় দাম্পত্য জীবনের প্রত্যাশাও বটে। নবী জীবনের এ জীবন্ত ঘটনা থেকে এ কথা স্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হচ্ছে যে, দাম্পত্য জীবন শুধু শাসক শাসিতের জীবনই নয় বরং বন্ধুত্ব ও ভালবাসা ও প্রেমের স্পন্দনও এর অবিভাজ্য অংগ। আর এ বন্ধুত্ব ও ভালবাসার দাবিও এই যে, স্বামীকে স্ত্রীর মনের অভিমান সইতে হবে। হ্যাঁ, একান্তই কোনো ভুল হয়ে গেলে রাসূল (সাঃ) নারাজ হতেন, রাগও করতেন। কিন্তু তাই বলে মান অভিমানের জবাবে শাসকীয় কায়দায় চটে যেতেন না।
স্ত্রীর হক বা পাপ্য অধিকার!
সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! আমি হৃদয় গলে সিরিজের ৫ম অংশে আপনাদের সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আল্লাহ তা’আলা তাওফীক দিলে পরবর্তী সিরিজে স্ত্রীর হকগুলো আলোচনা করব। সেই অঙ্গীকার পালনার্থে এখানে আমি স্ত্রীর হক বা তাদের প্রাপ্য অধিকারগুলো সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। আশা করি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি একে অপরের হকগুলো আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়, তাহলে দুনিয়াতেই তাদের ঘরখানা জান্নাতের বাগিচায় পরিণত হবে।
স্ত্রীর উপর স্বামীর কি কি হক বা অধিকার আছে, তা সকল স্বামীই মোটামুটি ভাবে জানে এবং সেগুলো যথাযথভাবে উসুল করারও চেষ্টা করে। কিন্তু স্বামীর উপর স্ত্রীর কি কি হক, সেটা অনেক স্বামীই জানে না। জানলেও আদায় করতে চেষ্টা করে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক কথা। এতে স্বামীর যে শুধু গুনাহগার হচ্ছে তাই নয়, বরং এর দ্বারা দাম্পত্য জীবনও হয়ে উঠছে অশান্ত, দুর্বিসহ ও যন্ত্রণাময়। সুতরাং আসুন আমরা স্ত্রীর হকগুলো ভালভাবে জানি, সেগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে শত ভাগ পালনের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
১. স্ত্রীর বক্রতাকে মেনে নিনঃ
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে হলে স্বামীকে সর্বপ্রথম খুব ভালভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, নারীকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং নারীর স্বভাবজাত কামনাই হলো বক্রতা। এই বক্রতা দিয়েই আল্লাহ তা’আলা তাকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মনে রাখতে হবে, বক্রতাই নারীর সুস্থতা ও সৌন্দর্য। বক্র রূপেই তাকে মানায়। এটা নারীর দোষ নয়, গুণ। সুতরাং স্বামী যদি তাঁর দ্বারা উপকৃত হতে চায় তাহলে তাঁর বক্রতা বজায় রেখেই উপকৃত হতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। পাঁজরের হাড়কে সোজা করতে গেলে তা যেমন সোজা না হয়ে ভেঙ্গে যায়, অনুরূপভাবে কেউ যদি স্ত্রীর বক্রতাকে মেনে না নিয়ে তাকে সোজা করে ফেলতে চায়, তাহলে সোজা তো হবেই না, বরং উল্টো ভেঙ্গে যাবে অর্থাৎ তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটানো ছাড়া তখন অন্য কোনো উপায় থাকবে না।
মোট কথা, নারী তাঁর স্বভাবগত চাহিদার প্রেক্ষিতেই বাঁকা। তাঁর এ বক্রতা মোটেও কোনো ক্রটি নয়। তাই রাসূল (সাঃ) পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, তোমরা যদি নারীদের মধ্যে তোমাদের স্বভাব বিরোধী কিছু দেখতে পাও, তাহলে এ কারণে তাঁর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না। কারণ এটা তাঁর প্রাকৃতিক চাহিদা। যদি এটা সোজা করতে চাও তাহলে ভেঙ্গে যাবে। বাঁকা রেখেই ওটাকে কাজে লাগাতে হবে।
আমরা অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, স্বামী যদি স্ত্রীর এই সহজাত ব্যাপারটিকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়, তবে দাম্পত্য জীবনের অর্ধেক সুখ এতেই লাভ হবে। বাকি অর্ধেক সুখশান্তি নির্ভর করবে অন্যান্য বিষয়ের উপর। চলুন, এবার আমরা অন্য বিষয়গুলো জেনে নিই।
২. স্ত্রীর মন খুশি রাখুনঃ
স্ত্রী যেমন স্বামীর মন সন্তুষ্ট রাখূতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে, তেমনি স্বামীও স্ত্রীর মন খুশি রাখতে সচেষ্ট হবেন। এজন্য বৈধ যা কিছু করা দরকার সবই স্বামীকে করতে হবে। এরূপ করা সুন্নতও বটে। রাসূল (সাঃ) এর জীবনে শুধু আল্লাহর ধ্যান, জিকির-আযকার ও ইবাদতই ছিল না, তিনি স্ত্রীদের সাথে হাসি-কৌতুক ও রসালাপও করতেন।
বুখারী শরীফের এক হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি হুজুর (সাঃ) এর গৃহে পুতুল নিয়ে খেলা করতাম। আমার কতিপয় সঙ্গিনী ছিল, তারাও আমার সাথে খেলায় অংশ গ্রহণ করত। যখন রাসূল (সাঃ) তাশরীফ আনতেন, আমার সঙ্গিনীরা তখন লজ্জায় লুকিয়ে থাকত এবং আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে যেত। তখন রাসূল (সাঃ) তাদেরকে খুঁজে বের করে আমার নিকট পাঠিয়ে দিতেন। অতএব পুনরায় আমরা খেলা শুরু করতাম।
অন্য এক হাদীসে তিনি বলেন, আমি কোনো এক সফরে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। একদিন (রাতের বেলায়) আমি তাঁর সাথে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করলাম এবং তাঁর উপর জয়ী হলাম। অতঃপর (কয়েক বছর পর) আমি যখন মোটা ও স্বাস্থ্যবান হয়ে গেলাম তখন আবার প্রতিযোগিতা করলাম। কিন্তু এবার আমি তাঁর উপর বিজয়ী হতে পারলাম না। তখন রাসূল (মুচকি হেসে) বললেন, ঐ জয়ের পরিবর্তে এ জয়। -(আবু দাউদ)
এ সব হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূল (সাঃ) আপন বিবিদের সাথে কত খোশ জীবন যাপন করেছেন। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, বেলায়েত বা দরবেশীর পক্ষে তো নয়ই, স্ত্রীর সাথে এরূপ হাসি-মযাক করা নবুওয়তের পক্ষেও ক্ষতিকর বা অশোভনীয় নয়।
প্রিয় পাঠক, একটু চিন্তা করে দেখুন, নবী করীম (সাঃ) ছিলেন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, সকল সৃষ্টির উপরে তাঁর মর্যাদা। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয় ঐশী বাণী। আল্লাহর সাথে সরাসরি আলোচনা ও কথাবার্তা হয় তাঁর। এতবড় উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও জীবন সঙ্গীনীদের সাথে তাঁর আন্তরিকতার কমতি ছিল না। বরং তাদের মন খুশি রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন যথেষ্ট যত্নবান ও সচেতন। কত আনন্দের কথা যে, মন খুশি করার জন্য তিনি আপজন সহধর্মিনী হযরত আয়েশা (রাঃ) কে প্রাচীন আরবের এগার রমণীর গল্প শোনাচ্ছেন—
ইয়ামনে ছিল এগার জন মহিলা। একদা তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিল, সবাই নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনা করবে। বাস্তব অবস্থা খুলে বলবে। মিথ্যা বলবে না কেউ।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলেই আপন আপন স্বামীর প্রকৃত ও বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সাবলীল ও শৈল্পিক ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করল। তাদের কথায়, ভাষায় ছিল সাহিত্যের রস। ছিল বর্ণনায় বিরল সৌকর্য। এভাবে রাসূল (সাঃ) প্রিয়তমা স্ত্রীকে সেই বিশাল কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছেন। আর আয়েশা (রাঃ) তন্ময় হয়ে তা শ্রবণ করছেন। হৃদয় সাগরে বয়ে চলছে তাঁর চরম আনন্দের ফল্গুধারা।
এইতো হলো বন্ধুত্ব। এরই নাম ভালবাসা। একেই বলে প্রাণবন্ত দাম্পত্য জীবন।
নবী জীবনের আরেকটি দৃশ্য দেখুন। রাসূল (সাঃ) আম্মাজান হযরত সাওদা (রাঃ)-এর ঘরে উপস্থিত। এমন সময় হযরত আয়েশা (রাঃ) কিছু মিষ্টান্ন রান্না করে হাজির হলেন হযরত সাও্বদার ঘরে, রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে। সবিনয় আরয করে বললেন, হুজুর! মেহেরবানী করে শুরু করুন। পাশেই উপবিষ্ট ছিলেন হযরত সাওদা (রাঃ)। আয়েশা (রাঃ) তাকেও ডাকলেন। বললেন, আপনিও নিন।
এ আচরণটি হযরত সাওদার নিকট তেমন ভাল ঠেকেনি। কারণ তিনি ভাবলেন, আজকে তো আমার পালা। রাসূল (সাঃ) আমার মেহমান। সুতরাং আজ কেন আয়েশা মিষ্টি পাকিয়ে এখানে নিয়ে আসবে? তাই হযরত সাওদা (রাঃ) নারী সুলভ অভিমান করে সাফ বলে দিলেন, আমি খাব না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হাসিমুখে বললেন, নিন। তাড়াতাড়ি নিন। নইলে কিন্তু মুখে মাখিয়ে দিব।
হযরত সাওদা (রাঃ) এবারও বললেন, না, আমি খাব না। আর তখনই হযরত আয়েশা (রাঃ) একটু মিষ্টান্ন হাতে নিয়ে হযরত সাওদার মুখে মাখিয়ে দিলেন।
এবার হযরত সাওদা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) -এর দরবারে অভিযোগ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেখুন! আয়েশা আমার চেহারায় মিষ্টান্ন মেখে দিয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) পবিত্র কুরআনের একখানা আয়াত পাঠ করলেন। যার অর্থ—
কেউ যদি তোমার সাথে কোনো মন্দ আচরণ করে, (ইচ্ছে হলে) তুমি তাঁর সাথে মন্দ আচরণ করতে পার।
তাই সে যখন তোমার মুখে হালুয়া মাখিয়ে দিয়েছে, তুমিও তার মুখে হালুয়া মেখে দাও।
হুজুরের কথা শুনে হযরত সাওদা (রাঃ) একটু হালুয়া হাতে নিয়ে হযরত আয়েশার মুখে মাখিয়ে দেন।
কী অদ্ভুদ দৃশ্য! রাসূলের দুই জীবন সঙ্গিনী। একে অপরের মুখে দুষ্টমীচ্ছলে হালুয়া মাখামাখি করছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তৃপ্তির সাথে প্রাণভরে তাদের এ নারীসূলভ কাণ্ড উপভোগ করছেন। মুচকি হাসির আলোকময় দীপ্ত ফুটে উঠছে তার সমগ্র চেহারা জুড়ে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ঐ সকল স্বামী একটু শিক্ষা গ্রহণ করবেন কি? যারা মনে করেন আমরা নারীদের শাসক। আমাদের এ পরিমাণ প্রভাব থাকা উচিত যাতে আমাদের নাম শুনেই স্ত্রীরা প্রকম্পিত হয়ে উঠে এবং কথা বলারও সাহস না থাকে।
হযরত থানভী (রঃ) বলেন, আমার এক বন্ধু একবার বড় অহংকারের সাথে আমাকে বলল, যখন আমি কয়েক মাস পর বাড়িতে যাই, তখন আমার স্ত্রী-বাচ্চাদের সাহস হয় না যে, আমার নিকট আসবে এবং আমার সাথে কথা বলবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যখন বাড়িতে যান তখন কি কোনো বাঘ বা সিংহ হয়ে যান? যার কারণে স্ত্রী-বাচ্চারা আপনার নিকট আসতেও ভয় পায়? তিনি বললেন, না, বরং এজন্য যে, আমরা হলাম শাসক। ওরা শাসিত।ওদের উপর আম আমাদের প্রভাব ও দাপট থাকা উচিত।
প্রিয় পাঠক! এ ঘটনা উল্লেখ করে হযরত থানভী (রঃ) বলেছেন, খুব ভাল করে স্মরণ রাখুন, পুরুষ নারীদের শাসক হওয়ার অর্থ এই নয় যে, স্ত্রী-পুত্র তার সামনে এসে মুখ খুলে কথা বলারও সাহস পাবে না। বরং স্বামীকে সর্বদা একথা মনে রাখতে হবে যে, স্বামী শুধু স্ত্রীর শাসকই নয়, সাথে সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুও বটে। তাই স্ত্রীর সাথে প্রশাসনসুলভ আচরণের সাথে সাথে তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণও দেখাতে হবে। কাজ কর্মের শৃংখলা বিধানের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করবে ঠিকই, কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক হবে আন্তরিকতা, বন্ধুত্ব ও ভালবাসা সিক্ত। তাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের মতো ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই। সফরে বের হয়ে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে আমির বানিয়ে নিলে আমীর বন্ধু যেমন প্রভু ও অপর বন্ধু ভৃত্য হয়ে যায় না বরং সফরের কার্যক্রম সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃংখল করার স্বার্থে এ ব্যবস্থা। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বন্ধু। তাদের দাম্পত্য জীবনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বামী আমীর। কাজ-কর্মে সিদ্ধান্ত দিবেন তিনি। তিনিই সিদ্ধান্তের মালিক। তাই বলে স্ত্রীর সাথে তিনি চাকরের আচরণ করতে পারবেন না। বরং বন্ধুত্বের চাহিদা বজায় রেখে, ভালবাসার নিয়ম-নীতি মেনে চলে তাকে সংসারের কাজ কর্মের সিদ্ধান্ত দিতে হবে। বন্ধুত্ব ও ভালবাসার নিবিড় আকর্ষণ অব্যাহত ও অক্ষুন্ন রেখে চালিয়ে যেতে হবে তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব। তাকে ভুলে গেলে চলবে না যে, সে শুধু শাসক নয় বরং প্রেমের স্নিগ্ধতায় উজ্জীবিত জীবনসঙ্গীও বটে।
৩. সামান্য ভুল-ক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখুনঃ
ভুল করা মানুষের স্বভাব। স্ত্রীরাও মানুষ। সুতরাং তাদের থেকে ভুল-ক্রটি প্রকাশ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। উপরন্তু তারা পুরুষের তুলনায় দুর্বল। জ্ঞানও কম। আবার অভিমানও বেশী। এমতাবস্থায় কিছু কিছু ভুল-ক্রটি তাদের হতেই পারে। এতে স্বামীদের চটে গেলে চলবে না। বরং ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে তার ছোট খাটো অপরাধগুলো ক্ষমা করে দিতে হবে।
কোনো কোনো স্বামী কথায় কথায় রাগ হয়ে যায়, স্ত্রীর প্রত্যেকটা কাজের মধ্যে দোষ তালাশ করে। এটা অত্যন্ত খারাপ অভ্যাস। এরূপ করা কখনো সমীচীন নয়। মনে রাখবেন, এই বদভ্যাসের কারণে অনেকের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে দাম্পত্য জীবন। জ্বলে উঠেছে অশান্তির বহ্নি শিখা। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।
৪. পারিবারিক ব্যাপারে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করুনঃ
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এটিও একটি অধিকার যে, স্বামী পারিবারিক ব্যাপারে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করবে। হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা যেহেতু পুরুষদেরকে অভিভাবক ও শাসক বানিয়েছেন, সেহেতু সিদ্ধান্ত তারাই দিবেন। নারীরা কেবল অভিমত ও পরামর্শ পেশ করবে। সুতরাং এক্ষেত্রে যদি কোনো নারী মনে করে, সব বিষয়ে আমার কথাই হবে চূরান্ত, সংসার খেয়াপারে মাঝি হবো আমিই, আমিই হবো গোটা সংসারের মূল পরিচালিকা, তাহলে সংসার ভেঙ্গে যাবে। অশান্তির অনল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। কেননা এরূপ করা প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত রীতির সম্পূর্ন পরিপন্থী। শরিয়ত এ দর্শন স্বীকার করে না। বিবেকবুদ্ধিও মানে না এ ফায়সালা। যুক্তি-তর্ক আর ইনসাফেরও খেলাফ এ সিদ্ধান্ত। সুতরাং এ বিষয়ে মেয়েদের সতর্ক থাকা নেহায়েত প্রয়োজন।
৫. শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে যত্নশীল হউনঃ
স্ত্রীর শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে যত্নশীল থাকা স্বামীর একান্ত কর্তব্য। কোনো কোনো স্বামী এমন আছে যারা নিজে অসুস্থ হলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু স্ত্রী অসুস্থ হলে সেদিকে খেয়ালই করে না। এটা কেবল মমত্ববোধের পরিপন্থীই নয়, চরম দুঃখজনক কাজও বটে।
স্ত্রী নিদ্রা গেলে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া তাকে জাগিয়ে তুল্বেন না। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো কাজ করাও উচিত নয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) রাত্রিকালে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হলে খুবই আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠতেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দরজা খুলে বাইরে যেতেন। আমি এ ব্যাপারে নবী করীম (সাঃ)-কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, আমি আস্তে আস্তে সতর্কতার সাথে এজন্য বের হয়েছি, যাতে তোমার নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটে।
প্রিয় পাঠক! লক্ষ্য করে দেখুন, বিশ্বনবী হওয়া সত্বেও রাসূল (সাঃ) স্ত্রীর সুখ-শান্তির প্রতি কত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন। তার আরামের ব্যাপারে কত বেশি সচেতন তিনি। সুতরাং আমরাও কি পারি না, তার আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে? পারি না স্ত্রীর যেন কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে? আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
৬. সৌন্দর্য লাভের উপকরণ সরবরাহ করুনঃ
স্ত্রীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সাজগোজ ও সৌন্দর্য লাভের সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করা স্বামীর উপর অবশ্য কর্তব্য। যেমন তেল, সাবান, চিরুনী, প্রসাধনী ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী। অনুরূপভাবে শরীর ও বগলের দূর্গন্ধ নাশক খুশবু, মিছওয়াক, দাঁতের মাজন ও সাজ সরঞ্জামও স্বামীকে যোগান দিতে হবে। স্ত্রীকে জেওর-অলংকার দ্বারা সজ্জিত করা স্বামীর উপর ওয়াজিব নয়। বরং এটা তার সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন ও সঙ্গতির ব্যাপার। -(রইসুল মুখতার)
অবশ্য স্ত্রীর শোভা-সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সামর্থানুযায়ী অলংকারাদি তৈরি করে দেয়া স্বামীর জন্য উত্তম। এতে যদি স্বামীর কষ্ট হয় তাহলে অলংকারের মূল্য মোহরের মধ্যে হিসেব করে হলেও অলংকার তৈরি করে দিয়ে স্ত্রীর স্বভাবজাত আকাঙ্খাকে পূর্ণ করা যেতে পারে।
৭. সামর্থানুসারে অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করুনঃ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো তার অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সু-ব্যবস্থা করা। কোনো নারীর বিয়ের পরে তার যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর উপর অর্পিত হয়। এটি স্বামীর নিকট স্ত্রীর অধিকার। স্বামীকে অবশ্যই সামর্থানুসারে স্ত্রীর খাওয়া পরার সম্মানজনক ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো স্বামী আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে স্ত্রীকে তার চাহিদা মোতাবেক অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে মৌখিকভাবে হলেও সন্তোষজনক কথাবার্তা ও প্রেম-প্রীতির মাধ্যমে তাকো খুশি রাখতে হবে। তার প্রতি কোনো রুক্ষ আচরণ প্রদর্শন করা যাবে না। অবশ্য এরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে স্বামীর অবস্থা বিবেচনা করে ধৈর্য ধারণ করা উচিত।
৮. হাত খরচ আলাদা দিনঃ
স্ত্রীর প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করার পর হাত খরচ হিসেবে তার হাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা দেয়া বাঞ্ছনীয়। হযরত থানভী (রঃ) এ বিষয়টির উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, শুধু কাপড়-চোপড়, খাবার আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নামই স্ত্রীর ভরণ-পোষণ নয়। বরং হাত খরচ হিসেবে কিছু অর্থ স্ত্রীর হাতে দেওয়াও ভরণ-পোষণের অংশ বিশেষ। স্ত্রী এ টাকা নিজের ইচ্ছানুযায়ী খরচ করবে। কেননা মানুষের এমন কিছু প্রয়োজনও থাকে, যা সে অন্যের কাছে বলতে লজ্জাবোধ করে।
৯. মোহর আদায় করুনঃ
মোহর স্ত্রীর এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যা আদায় না করলে স্ত্রী স্বামীকে নিজের কাছে আসতে বাধা দিতে পারে। আল্লাহ তালালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
“তোমরা স্ত্রীদেরকে খুশি মনে তাদের মোহর দিয়ে দাও। (সূরা নিসা-৪)।
তাই স্বামীর উচিত গড়িমসি না করে স্ত্রীকে মোহরের টাকা পরিশোধ করে দেয়া। খোদা না করুন, যদি মোহরের টাকা আদায় না করে স্বামী দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, তাহলে ঐ টাকা তার উপরে ঋণ হিসেবে থেকে যাবে। হ্যাঁ, স্বামীর জীবদ্দশায় হোক বা মৃত্যু বরণের পরে হউক, স্ত্রী যদি সম্পূর্ণ মোহর বা এর অংশ বিশেষ মাফ করে দেয়, তাহলে তা মাফ হয়ে যাবে। স্বামী এজন্য খোদার দরবারে পাকড়াও হবেন না।
বর্তমান যুগে অনেকেই এমন আছেন যাদের ধারণা হলো, মোহর আদায়ের প্রশ্ন কেবল তখনই দেখা দেয়, যখন স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হয়। তালাক না দিলে মোহর আদায়ের প্রয়োজন নেই। মোহর তো কেবল এজন্য ধরতে হয় যাতে মোহর নাদায়ের ভয়ে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সাহস না পায়।–(নাউযুবিল্লাহ)
প্রিয় পাঠক, এরূপ মারাত্মক ধারণা পোষণ করা পবিত্র কুরআন ও হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধীতা নয় কি? আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
পড়তে পারেন : দেন মোহর নির্ধারণে রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ | নয়া দিগন্ত
১০. সাধ্যাতীত কাজের নির্দেশ দান থেকে বিরত থাকুনঃ
স্বামীর বৈধ নির্দেশ পালন করা স্ত্রীর উপর ওয়াজিব। স্ত্রী যদি তা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পালন না করে কিংবা গড়িমসি করে তাহলে সে গোনাহগার হবে। কিন্তু তাই বলে স্ত্রীকে এমন কোনো কাজের নির্দেশ দেওয়া অন্যায় ও মানবতা বোধের পরিপন্থী যা পালন করা স্ত্রীর জন্য দুঃসাধ্য কিংবা সীমাহীন কষ্টকর। স্ত্রীর সুখ-শান্তি ও সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাকে কাজের নির্দেশ দেওয়া উচিত। অনেকে স্ত্রীকে একের পর এক ফরমায়েশ করতেই থাকে, যা তার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এমনটি করা কোনো হৃদয়বান স্বামীর পক্ষে কখনও উচিত নয়।
আবার অনেক স্বামী এমনও আছে, যারা ছোট খাটো কাজগুলোও নিজের হাতে করতে প্রস্তুত নয়। সব কিছুতেই স্ত্রীকে হুকুম করে। তারা মনে করে স্ত্রী হুকুমের দাস। স্বামীর হুকুম পালনের জন্যই স্ত্রীদের সৃষ্টি। এক গ্লাস পানির দরকার, পাশেই জগ-গ্লাস রাখা। হাত বাড়ালেই নিযে ঢেলে খেতে পারে। কিন্তু তা সে করে না। এমনটি কখনো কাম্য নয়। অবশ্য স্ত্রী চাইবে, স্বামীর মুখ থেকে কোনো নির্দেশ আসার পূর্বেই তার মনের ভাব বুঝে সে অনুপাতে কাজটি সমাধান করে দেওয়ার। হৃদয়ের মাধুরী মিশিয়ে আন্তরিকভাবে স্বামীর সেবা ও নির্দেশ পালন করাকে সে নিজের জন্য সৌভাগ্য বলে মনে করবে।
১১. স্ত্রীর সাথে সদাচরণঃ
একটি সুখী ও সমৃদ্ধশীল পরিবার গঠনের জন্য স্বামীকে অবশ্যই সহনশীল, সুহৃদ ও দয়ালু হতে হবে। কোনো ভাবেই স্ত্রীকে কটু কথা বলা, গালমন্দ করা, তিরস্কার বা ভর্ৎসনা করা উচিত নয়। বরং সর্বদাই স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করা উচিত। এমনকি স্ত্রী কর্কশভাষী ও বদমেযাযী হলেও এটাকে খোদার পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করে তার সাথে ভাল ব্যবহার করে যাওয়া উচিত। এতে স্বামী বিভিন্ন লাইনে উপকৃতও হবেন, ইনশাআল্লাহ। এ প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা শুনুন—
আল্লাহর এক ওলীর অত্যন্ত বদমেজাযী ও কর্কশভাষী স্ত্রী ছিল। সে তার স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করত। স্বামীকে সে দুচোখে দেখতে পারত না।
একদিনের ঘটনা। বুযুর্গ স্বামী কোনো এক কাজে বাইরে গেছেন। ঠিক এমন সময় দূর থেকে আগত তার এক ভক্ত এসে সালাম দিয়ে দরজার কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করল, হযরত! বাড়িতে আছেন? হযরত! বাড়িতে আছেন?
‘হযরত’ শব্দটি শুনতেই স্ত্রীর মেযায গরম হয়ে গেল। সে অত্যন্ত রুক্ষ ভাষায় জবাব দিল-কোথা হতে এসে হযরত, হযরত করছ? হযরত ঘরে নেই। চলে যাও।
জবাবের ঢং দেখে লোকটি মনে খুব ব্যথা পেল। ভাবল, হুজুরের ঘরে এমন স্ত্রী! আবার তাকে নিয়ে সংসার!! আমি হলে তো একদিনও তাকে রাখতাম না। এসব চিন্তা করে সে ফিরে যেতে ইচ্ছা করল। এমন সময় লোকজন বলল, আপনি কি উক্ত মহিলার কথা শুনেই চলে যাচ্ছেন? সে বলল, কি আর করব, এমন স্ত্রী মানুষ ঘরে রাখে নাকি? তার কথা শুনে তো আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। তাই হযরতের সাথে সাক্ষাতের নিয়ত বাদ দিয়ে বাড়ির পথ ধরেছি।
লোকজন বলল, সেটা আপনার ইচ্ছা। তবে আপনি যদি হুজুরের সাথে দেখা করতে চান, তাহলে সামনের জঙ্গলে চলে যান।
লোকদের কথা মতো আগন্তুক তার মত পরিবর্তন করল। ধীরে ধীরে সে জংগলের দিক রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে সে দেখতে পেল, হযরতজী একটি হিংস্র বাঘের উপর সওয়ার হয়ে বাড়ির দিকে আসছেন।
হযরত কাশফের মাধ্যমে এ ব্যক্তির অবস্থা পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। তাই তাকে দেখেই মুচকী হাসি দিয়ে বললেন, তুমি হয়ত আমাকে বাঘের উপর দেখে আশ্চর্যববোধ করছ। কিন্তু মনে রেখ, এই শক্তি আমি কিভাবে অর্জন করেছি, তা যদি তুমি জানতে পার, তাহলে আরো বেশি আশ্চর্যান্বিত হবে। শোন, আমার স্ত্রীর কটু কথা, অশালীন ব্যবহার আমি ধৈর্য সহকারে সহ্য করি। শুধু তাই নয়, তার সাথে আমি সর্বদা সদ্ব্যবহার করি, ভাল আচরণ করি এবং তার যাবতীয় হক যথাযথভাবে আদায় করি। এর প্রতিদান স্বরূপই আল্লাহ তাআলা এ হিংস্র জানোয়ারটিকে আমার অধীন করে দিয়েছেন। সে আমার কথা মতো চলে। আমি যা বলি তাই করে। সুবহানাল্লাহ!
প্রিয় পাঠক! দেখলেন তাে! স্ত্রীর সাথে সদাচারণের দুনিয়াবী ফল।। আর আখেরাতের উত্তম বদলা তাে আছেই।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
তােমরা তােমাদের স্ত্রীদের সাথে সদাচরণ কর। যদি তাদের কোনাে আচরণ তােমাদের মনঃপুত না হয় (তবে তাতে কি?) আল্লাহ পাক তাে তাদের মাঝে অনেক ভাল দিক রেখে দিয়েছেন। (সূরা নিসা-১৯)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে ভাল আচরণ করে সেই তােমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।-(ইবনে মাজাহ) অপর এক হাদীসে তিনি বলেন, মুমিনদের মাঝে সেই সর্বাপেক্ষা পূর্ণ ঈমানের অধিকারী, যে সর্বাধিক চরিত্রবান এবং আপন স্ত্রীর সাথে অতি নম্র ব্যবহারকারী।-(তিরমিযী)। |
স্ত্রী যদি মারাত্মক কোনাে অপরাধ করে এবং বারবার দরদ ও ভালবাসার সাথে বিনম্র ভাষায় বুঝাবার পরও সে উহা থেকে ফিরে না আসে, তাহলে তার বিছানা পৃথক করে দেওয়া এবং হালকা প্রহারের অনুমতি থাকলেও কঠোরভাবে প্রহার করা উচিত নয়। বরং এমন ভাবে মারতে হবে যেন শরীরে তার প্রতিক্রিয়া বা জখম না হয়। আর চেহারায়। আঘাত করা তাে হারাম। স্মরণ রাখবেন, স্ত্রীকে মারার উদ্দেশ্য কষ্ট দেওয়া নয় বরং সংশােধন করা। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনাে কোনাে নারী, কোনাে চাকর অথবা অন্য কাউকে প্রহার করেননি। অন্য হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তােমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে এমনভাবে প্রহার না করে, যেমনভাবে প্রহার করে তার গােলামকে। (এটা কতই না লজ্জাজনক ব্যাপার যে) দিনের বেলায় সে স্ত্রীকে নির্মমভাবে প্রহার করবে আর রাতের বেলায় তাকেই বাহুতে নিবে। -(বুখারী, মুসলিম)
কোনাে কোনাে স্বামী তরকারীতে লবণের পরিমাণ কম-বেশি হলে, ভাত পাকাতে দেরী হয়ে গেলে ইত্যাদি ছােট-খাট সামান্য কারণে স্ত্রীকে জুতা, লাঠি, বেত ইত্যাদি দ্বারা নির্মমভাবে প্রহার করে। এটা মারাত্মক জুলুম। মনে রাখবেন, এজন্য স্বামীকে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। তাই স্বামীদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং এরূপ করে থাকলে দুনিয়াতেই তার থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া উচিত। কারণ এটা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের মধ্যে শামিল।
১২। একাধিক স্ত্রীর বেলায় ইনসাফ করুনঃ
কারও একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের প্রতি সমতা রক্ষা করে চলা স্বামীর জন্য অত্যাবশ্যক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যদি কারাে দুজন স্ত্রী থাকে এবং সে তাদের মধ্যে সাম্য ও ইনসাফ রক্ষা না করে তবে কিয়ামতের দিন সে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত অবস্থায় উপস্থিত হবে । (তিরমিযী)
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতি ইনসাফের সাথে স্ত্রীদের মধ্যে পালা বন্টন করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ! যে বিষয়ে আমার ক্ষমতা ছিল সে বিষয়ে আমার সাধ্যানুযায়ী আমি স্ত্রীদের মধ্যে পালা বন্টন করেছি, অতএব যে বিষয়ে আমার কোনাে ক্ষমতা নেই কেবল তােমারই ক্ষমতা রয়েছে সে বিষয়ে আমাকে তিরস্কার করাে না। (তিরমিযী)
উল্লেখিত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল কোনাে স্ত্রীর প্রতি মহাব্বত তথা মনের আকর্ষণ অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশিও হয়ে যেতে পারে এবং এটা ক্ষমার যােগ্যও বটে। কিন্তু এটা ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সকল স্ত্রীদের সাথে একই রকমের আচরণ করা একান্ত পরিহার্য। অন্যথায় স্বামীকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
১৩। স্ত্রীর দ্বীনদারীর প্রতি লক্ষ্য রাখুনঃ
স্ত্রীর ভরণ-পােষণ যেমন স্বামীর উপর জরুরি, তেমনি তাকে ধর্মীয় জ্ঞান-শিক্ষা দেওয়া এবং তার দ্বীনদারীর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাও স্বামীর কর্তব্য। অনেকে স্ত্রীর শরীর সুস্থ রাখার জন্য ভাল ভাল খাদ্যের ব্যবস্থা করে, কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান ও দ্বীনদারী থাকার ফলে স্ত্রীর আত্মা যে মুমূর্ষ অবস্থায়, সেদিকে তার কোনাে খেয়াল নেই। একজন মুসলমান স্বামীর এরূপ করা কখনােই কাম্য হতে পারে না। প্রতিটি স্বামীর উচিত স্ত্রীকে নিজে দ্বীনদারী শিক্ষা দেওয়া। এটা সম্ভব না। হলে, অন্য কোনাে উপায়ে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এজন্য বিভিন্ন। পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন..
১। হক্কানী আলেমদের সাথে পরামর্শ করে ভাল ভাল ধর্মীয় বই ক্রয় করে স্ত্রীকে পড়তে দেওয়া। যেমনঃ মাজালিসে আবরার, মাজালিসে সিরাজী, মাওয়ায়েজে সিরাজিয়া, স্পেনের রুপসী কন্যা, আধার রাতের বন্দিনী, মজনু দরবেশ, ইসলামী তাহযীব, মরণজয়ী সাহাবা, জায়েযনাযায়েয, ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়া, যে গল্পে হৃদয় কাড়ে, আদর্শ মা, মুমিন নারীর সুন্দর জীবন, আদর্শ স্ত্রীর পথ ও পাথেয়, ঈমানদীপ্ত কাহিনী, অশ্রুভেজা কাহিনী। যে গল্পে হৃদয় জুড়ে, মুসলমান স্বামী ও মুসলমান স্ত্রী, জীবন পথের পাথেয়, আলাের মিছিল, ইসলাহী খুতুবাত, ফুলের মত জীবন যাদের, বিচিত্র সৃষ্টির মাঝে আমি আল্লাহকে দেখেছি, জীবনের শ্রেষ্ট সম্পদ। আল্লাহ ওয়ালা, কাঙ্খিত সন্তান, স্বামী স্ত্রীর সুখের জীবন। নারী জন্মের আনন্দ ইত্যাদি।
২। আদর্শ নারী, আদর্শ রমণী, মহিলা কণ্ঠ, মদীনা, রাহমানী পয়গাম, রহমত, মঈনুল ইসলাম, দাওয়াতুল হক, আল হক, আল জামিয়া, আত তাওহীদ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত সংগ্রহ করা। সম্ভব হলে বার্ষিক গ্রাহক হয়ে যাওয়া। এতে পরিবারস্থ সকলেরই সীমাহীন উপকার হবে, ইনশাআল্লাহ।
৩। পর্দা রক্ষা করে হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গদের বয়ান শুনানাে।
৪। সম্ভব হলে কোনাে মাহরাম পুরুষের সাথে মাস্তুরাতের জামাতে বের হওয়া।
৫। বাসার আশে পাশে কোথাও মেয়েদের কোনাে এস্তেমা হলে তাতে শরিক হতে দেওয়া। তবে এ এস্তেমা অবশ্যই হক্কানী উলামায়ে কেরাম কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেককে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করার তাওফীক দিন। আমীন। (১. ইসলাহী খুতুবাত)
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ যদি এমন হতো!
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.