আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ। শিরক কুফর আর কুসংস্কারের নিচ্ছিদ্র অমানিশার নিকষ কালাে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে সারা আরব জাহান। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানব জাতি পৌছে গেছে অসভ্যতা ও বর্বরতার চরম পর্যায়ে । অন্যায়-অবিচার, জুলুম নিপীড়ন সন্ত্রাস-ছিনতাই, যিনা-ব্যভিচার ইত্যাকার নানাবিধ অন্যায়-অপকর্ম নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাইয়ের রক্তে অবগাহন করে ভাই তৃপ্তির হাসি হাসে। এক খুনের বদলে চলে হাজার খুন। দ্বন্দ্ব একবার শুরু হলে তা আর শেষ হয় না। চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে। এমনকি সে লড়াইয়ের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে বংশানুক্রমিকভাবে।
মানবতার এই চরম বিপর্যয়ের সময়গুলােতেও আরব জাহানে খুঁজে পাওয়া যায় অনুপম অতিথি সেবার অনবদ্য আদর্শ। পাওয়া যায় মেহমানদারীর অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এবার পাঠক-পাঠিকাদের খেদমতে সে ধরনের একটি বিস্ময়কর ঘটনাই উপস্থাপন করছি।
এক নওজোয়ান। টগবগে যুবক। সমস্ত হৃদয় জুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশােধের প্রজ্বলিত আগুন। আজ কয়েক বছর যাবত সে অস্থিরবেকারার। কোনাে কিছুতেই শান্তি খুঁজে পায় না সে। প্রতিদিন নাঙ্গা তলােয়ার হাতে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। শহরের অলি গলি আর বিজন প্রান্তরে খুঁজে বেড়ায় ঐ ঘাতককে, যে কয়েক বছর পূর্বে তার পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সে চায় পিতা হত্যার প্রতিশােধ নিতে চায় ঘাতককে হত্যা করে দগ্ধভূত অন্তরকে ঠান্ডা করতে।
দীর্ঘদিন চলে গেল। ঘাতককে সে খুঁজে পায় না। প্রতিশােধের অনল তার অন্তরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। কিন্তু ঘাতকের কোনাে সন্ধান মিলছে না। দেখা মাত্র মুক্ত তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে ঘাতকের মস্তক সে দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে- এ প্রতিজ্ঞা সে বহু পূর্বেই করেছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা পালনের কোনাে সুযােগই সে খুঁজে পাচ্ছে না। এভাবে চলে গেল আরাে কিছু দিন।
একদিন সে ঘাতকের খুজে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। ঠিক এক সময় একজন মুসাফির তার বাড়িতে এসে মেহমান হলাে। সে মেহমানকে উত্তম রূপে মেহমানদারী করার জন্য বাসার লােকদের ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। সারাদিন দূরগামী অশ্ব নিয়ে ঘাতককে খুঁজে বেড়াল। কিন্তু ফলাফল আগের মতাে শূন্যই রয়ে গেল।
আজ কয়েকদিন যাবত আগন্তুক মেহমান শাহী হালতে থাকছে। প্রতিদিন পরিবেশন করা হচ্ছে উন্নত মানের খাবার। থাকার জন্য দেওয়া হচ্ছে সুন্দর শয়ন কক্ষ ও আরামদায়ক বিছানা। গৃহকর্তার নির্দেশ ও আরবদের অনুপম অতিথি সেবার কালজয়ী আদর্শের কারণেই মেহমান দিনের পর দিন এসব সুযােগ-সুবিধা অবলীলায় ভােগ করে যাচ্ছে। কেন, কি জন্য এখানে এসেছে- এধরনের কোনাে প্রশ্ন কেউ তাকে করছে না।
এদিকে ঐ যুবক, যে এ বাড়ির গৃহকর্তাও বটে, সেও মেহমানকে কোনাে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। জিজ্ঞেস করার সময়ও তার হচ্ছে না। কারণ সে তাে ভােরের আলাে উঁকি দেওয়ার পূর্বেই প্রচন্ড প্রতিশােধের স্পৃহা নিয়ে তরবারী হাতে বের হয়ে যায় এবং গভীর রাতে বাসায় ফিরে । সুতরাং মেহমানের সাথে আলাপ করার সুযােগটা তার কোথায়?
একদিন যুবক ভাবল, আজ বেশ কয়েক দিন হল, মেহমানের সাথে কোনাে আলাপ হলাে না। এটা তাে সৌজন্যবােধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী কাজ। সুতরাং আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে মেহমানের সাথে খােলামেলা আলােচনা করব। |
অন্য দিনের তুলনায় অনেক আগেই সে বাড়ি ফিরেছে। মেহমানকে নিয়ে একসাথে খানা খেয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর সে মেহমানকে নিয়ে একটি নির্জন কামরায় প্রবেশ করল। প্রথমেই সে এ কয়দিন যাবত তার সাথে কথা বলতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। তারপর একের পর এক শুরু হলাে বিভিন্ন রকমের আলােচনা।
গভীর রাত পর্যন্ত কথা হলাে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সে খুব ভাল করে বুঝতে পারল- এ মেহমানই তার পিতার হত্যাকারী। সে-ই ঐ ঘাতক যাকে সে কয়েক বৎসর যাবত মাঠে-প্রান্তরে, শহরে-বন্দরে হন্যে হয়ে খুঁজছে। যার মস্তক দিখন্ডিত করার জন্য মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে সে কঠোর শপথ করেছে।
কিন্তু এখন? সে যে মুসাফির! আশ্রিত মেহমান!! যাকে পাওয়ার জন্য এত ব্যাকুলতা, যার রক্তে অবগাহন করার জন্য এত অস্থিরতা, সে এখন তারই সম্মানিত অতিথি। সুতরাং এবার উপায় কি? কি করা যায় এখন? একদিকে পিতৃ হত্যার প্রতিশােধ নেওয়ার পালা, প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের মােক্ষম সুযােগ, অপরদিকে মেহমানের সম্মান!
যুবক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলাে। ভাবল, লােকটি যত বড় অপরাধীই হউক, এখন সে আমার মেহমান। সুতরাং এ অবস্থায় কিছুতেই আমি তার উপর তরবারি উঠাতে পারি না। পারি না এমন কিছুও করতে যা অতিথিপরায়ণতার পরিপন্থী, মেহমানদারীর খেলাফ। অতএব, এ মুহূর্তে মেহমানকে বিদায় করে দেওয়াই হবে তার উপযুক্ত সম্মান।
যুবক ধীরে ধীরে চলে গেল। একটু পরে একটি তরবারি ও আস্তাবল থেকে একটি সুন্দর ঘােড়া এনে মেহমানকে দিয়ে বলল, তিলার্ধ পরিমাণ কালবিলম্ব না করে এক্ষুণি আপনি এ স্থান ত্যাগ করুন। কারণ আপনাকে পাকড়াও করার জন্যেই আমি আজ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে হন্যে হয়ে শহরের অলি-গলি, বিজন অরণ্য, বিশাল প্রান্তর জুড়ে অশ্ব ছুটিয়ে ফিরছি। কিন্তু আজ আপনাকে এমন অবস্থায় আমার হাতের মুঠোয় পেয়েছি যখন আপনি আমার আশ্রিত মেহমান, সম্মানিত অতিথি। যদি অনুরূপ অবস্থা না হতাে, তাহলে এ মুহূর্তে আমি তলােয়ার দিয়ে আপনার মস্তক দ্বিখন্ডিত করে দীর্ঘদিন যাবত অন্তরের প্রজ্বলিত প্রতিশােধের আগুন নিভাতাম। আপনাকে পৌঁছে দিতাম এমন এক জগতে যেখান থেকে কোনােদিন আপনি ফিরতে পারতেন না।
প্রিয় পাঠক বন্ধুগণ! আলােচ্য ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরাও কি পারি না সেবা ও মেহমানদারীর অনুপম নজির স্থাপন করতে? মনে রাখবেন, জগতের বড় বড় মহা মনীষীরা কিন্তু এধরনের মহানুভবতা ও অনুপম আদর্শ স্থাপনের মধ্য দিয়েই মানব হৃদয়ের গহীন কোণে স্থান করে। নিয়েছেন। ফলে মানুষ আজ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাদের কীর্তিময় জীবন নিয়ে গর্ববােধ করে। সুতরাং আমরাও যদি মাঝে মধ্যে অনুরূপ আদর্শের নজির স্থাপন করতে প্রয়াসী হই, দৃঢ় সংকল্প করি, তবে কি জগত আরও সুখ সমৃদ্ধির মুখ দেখবে না? ] গল্পের উৎসঃ হায়াতে শাইখুল হিন্দ, পৃষ্ঠা – ১৬৭।
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম – যদি এমন হতাম বই থেকে।
আরও শিক্ষণীয় গল্প..
০১. হিংসার ভয়াবহ পরিণাম (শিক্ষণীয় গল্প)
০২. সবচেয়ে বড় পাপ (শিক্ষণীয় গল্প)
০৩. গল্প : বংশের প্রভাব (শিক্ষণীয় ঘটনা)
০৪. কে অধিক দানশীল (তিন ব্যক্তির দানশীলতার গল্প)
০৫. কৃতজ্ঞতার উত্তম প্রতিদান (তিন ব্যক্তির ঘটনা)
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.