কাজী হাসান বিন মারওয়ান ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক। তিনি তার আদালতী জীবনে এমন সুবিচারের নমুনা রেখে গেছেন, যা মুসলিম কাজী ও বিচারকদের জন্য যুগ যুগ ধরে উত্তম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এবার পাঠক সমীপে তার জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।
উত্তর আফ্রিকার প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর কাইরাে ওয়ানের একটি ছােট্ট মহল্লা। সেখানকার জনৈক অধিবাসী লােকদের যাতায়াতের পথে আপন দেয়ালের পাশে একটি বৈঠকখানা বানানাের সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য হলাে, সে যেন এখানে বসে নিজের পশুপাল ও সাওয়ারীর দেখাশুনা করতে পারে।
সিদ্ধান্ত মােতাবেক একদিন সে সত্যি সত্যিই বৈঠকখানা নির্মাণের কাজ শুরু করে দিল। মহল্লাবাসী এতে আপত্তি জানাল এবং বৈঠকখানা বানাতে নিষেধ করল। তারা বলল, এ জায়গা যেহেতু আপনার সেহেতু এখানে সবকিছু করার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু কালক্রমে এ জায়গাটি সর্বসাধারণের হাটা-চলার রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এখন যদি আপনি বৈঠকখানা বানিয়ে এ রাস্তাটি বন্ধ করে দেন, তাহলে তাে জনগণের ভীষণ কষ্ট হবে। সামান্য পথের জন্য তাদেরকে বহু পথ ঘুরে আসতে হবে। লােকটি বলল, আমি কিছুতেই তােমাদের কথা শুনব না। এ জায়গার মালিক আমি । সুতরাং আমার জায়গায় যা ইচ্ছে তাই করব আমি। এতে তােমাদের বলার কি আছে?
তারা বলল, একথা তাে আমরা আগেই বলেছি। আমরা তাে কেবল জনগণের অসুবিধার বিষয়টি আপনাকে বুঝাতে চাচ্ছি। এরূপ জায়গা তাে আপনার আরাে আছে। সুতরাং প্রয়ােজনে আপনি সেখানে বৈঠকখানা বানিয়ে নিন।
সে বলল- না, আমি অন্য কোথাও বৈঠকখানা বানাব না। এখানেই বানাব। কার সুবিধা হলাে, কার অসুবিধা হলাে, তা আমার দেখার বিষয় নয়।
উভয় পক্ষ ক্রমেই উত্তেজিত হতে লাগল। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তর্ক-বিতর্ক চলল। কেউ কারাে মানবার পাত্র নয়। সকলেই নিজ নিজ বক্তব্যে অটল । শেষ পর্যন্ত তারা কাজী হাম্মাসের নিকট উদ্ভূত পরিস্থিতির ফায়সালা তলবের ব্যাপারে একমত হলাে।
দু’জন রওয়ানা দিল কাজী হাম্মাসের দরবারে। একজন জায়গার মালিক, অপরজন সর্বসাধারণের পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিনিধি। অনেকবার তারা কাজী হাম্মাসের নাম শুনেছে। তার সুবিচারের কথাও তাদের অজানা নয়। কিন্তু দুজনের কেউই কাজী হাম্মাসকে পূর্বে দেখেনি বিধায়, লােকদের জিজ্ঞেস করতে করতে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে লাগল ।
এক পর্যায়ে এক ব্যক্তিকে কাজী হাম্মাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, অদূরে নদীর কিনারে এক শান্ত-শিষ্ট ও বুযুর্গ ধরনের লােককে সে ইশারায় দেখিয়ে দিল।। | কাজী হাম্মাস তখন একটি মশক ভর্তি পানি নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন । তারা ধারণাও করতে পারেনি যে, তিনিই সেই ব্যক্তি যাকে পাওয়ার জন্য তারা দীর্ঘ পথ সফর করে এসেছে। কারণ একজন বিচারক মশক ভর্তি করে নদী থেকে পানি আনতে যাবেন কেন? তার তাে কত খাদেম-খুদ্দাম থাকবে। তারাই তাে তার যাবতীয় কর্ম আঞ্জাম দিবে ।
যা হােক, লােক দুজন আরাে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বুযুর্গ ব্যক্তির সামনে গিয়ে বলল, জনাব! আমরা কাজী হাম্মাসের দরবারে যেতে চাচ্ছিলাম। তাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে? মেহেরবানী করে একটু বলে দিবেন কি?
বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, কেন, কি ব্যাপার?
তারা বলল, একটি বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে মতবিরােধ দেখা দিয়েছে। আমরা তার কাছে এর সঠিক ফায়সালা নিতে এসেছি।
বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, আপনাদের সমস্যা কি খুলে বলুন। কাজী হাম্মাস এখন আপনাদের সামনেই দন্ডায়মান।
পথেই কাজী সাহেবের দেখা পেয়ে তারা মনে মনে খুব খুশি হলাে। জায়গার মালিক বলল, আপনি পানির মশকটি মাটিতে রাখুন। তারপর আমরা আমাদের সমস্যার কথা খুলে বলছি।
কাজী সাহেব বললেন, মশক মাটিতে রাখার প্রয়ােজন নেই। আপনারা কথা শুরু করুন।
এবার জনগণের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে আসা লােকটি বলল, হযরত! পানি ভর্তি মশকটি অনেক ভারী। আমাদের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে বেশ সময়ও লাগতে পারে। এতে আপনার সীমাহীন কষ্ট হবে। সুতরাং অনুগ্রহ পূর্বক মশকটি মাটিতে রাখুন।
কাজী হাম্মাস জবাবে বললেন, এ জমিন পথচলা মানুষের হকের অন্তর্ভূক্ত। আমি এখানে মশক রাখলে তাদের পথ চলায় সাময়িক অসুবিধার সষ্টি হবে। সুতরাং সামান্য সময়ের জন্যে হলেও আমি তাদেরকে কষ্টের মধ্যে ফেলতে চাই না। অতএব দেরী না করে আপনাদের মূল বক্তব্য আরম্ভ করুন।
জমির মালিক বলল, আমাদের আর কোনাে বক্তব্য নেই। যে বিষয় নিয়ে আমরা আপনার দরবারে এসেছিলাম, তার সুষ্ঠু ও সুন্দর মীমাংসা আপনি মূল বক্তব্য শুরুর আগেই দিয়ে ফেলেছেন। সুতরাং এখন আর আমাদের বলার কিছুই নেই।
কাজী সাহেব বললেন, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সে বলল, আমি আমার জায়গায় লােকদের চলাচলের পথে একটি বৈঠকখানা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। সেখানকার জনগণ তাতে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমরা আপনার নিকট এর ফায়সালার জন্য এসেছি। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, আপনি লােকদের অসুবিধার কথা ভেবে, সামান্য সময়ের জন্যেও একটি পানির মশক মাটিতে রাখতে রাজি হচ্ছেন না, তখন আমার ধারণা হলাে, লােক চলাচলের পথে ঘর নির্মাণের জন্য কিছুতেই আপনি অনুমতি দেবেন না। উপরন্তু আপনি আমার অন্তর চক্ষু খুলে দিয়েছেন। “মানুষ যে মানুষের জন্য” এই কথাটি আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। সুতরাং আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে কোনাে দিন মানুষের অসুবিধা হয়, অকল্যাণ হয় এমন কিছুই করব না।
এতটুকু বলে সে সালাম দিয়ে ফিরে চলল এবং প্রতিবেশীদের নিকট , এসে স্বীয় অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করল ।
প্রিয় বন্ধুগণ! আলােচ্য ঘটনায় ইনসাফের মূর্ত প্রতীক কাজী হাম্মাসের খােদাভীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কেননা তিনি একমাত্র আল্লাহর ভয়ে প্রতিবেশীর হক তথা শরিয়তের বিধান পালনের জন্য এত কষ্ট স্বীকার করতে তৈরি হয়ে গেছেন। তিনি জনগণ ও প্রতিবেশীর হককে কতটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। স্বল্প সময়ের জন্য একটি পানির মশক রাস্তায় রাখলে মানুষের এমন কি কষ্ট হতাে! হ্যা, এতটুকু কষ্ট হতাে যে, মশকটি রাস্তায় থাকার কারণে তাদের হয়তাে একটু সামান্য পথ ঘুরে যেতে হতাে অথবা কষ্টের কারণ এও হতে পারে যে, মশক থেকে পানি পড়ে রাস্তা কাঁদা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কাজী হাম্মাস প্রতিবেশীকে এতটুকু কষ্ট দিতেও রাজি হননি। তিনি ভেবেছেন, যদি আমি যে কোনাে ভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেই আর তারা কিয়ামতের কঠিন দিবসে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করে, তাহলে খােদার দরবারে কী জবাব দিব?
প্রিয় পাঠক! খুবই চিন্তার বিষয়। আজকাল অনেকেই প্রতিবেশীর হক তাে আদায় করেই না বরং উল্টো তাদের উপর জুলুম-অত্যাচার করে থাকে। প্রতিবেশীর সুখে সুখি হওয়া, দুঃখে দুঃখী হওয়া, বিপদে পড়লে বিপদ মুক্তির চেষ্টা করা যে কত বড় পুণ্যের কাজ এবং প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া যে কত বড় গুনাহের কাজ নিম্নোক্ত হাদীস গুলােই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, আল্লাহর কসম, এমন ব্যক্তি কখনাে (কামিল) মুমিন হবে না, আল্লাহর কসম, এমন ব্যক্তি কখনাে (কামিল) মুমিন হবে না, আল্লাহর কসম, এমন ব্যক্তি কখনাে (কামিল) মুমিন হবে না। এমন সময় উপস্থিত সাহাবাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে ব্যক্তি কে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট হতে রক্ষা পায় না । -(মিশকাত)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় চাই তা কথার দ্বারা হােক কিংবা কাজের দ্বারা হােক, সে কখনাে পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারে না। | একদা এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় যে, সে অধিক (নফল) নামাজ পড়ে, রােজা রাখে এবং বেশি বেশি দান সদকাও করে। তবে সে মুখের দ্বারা তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (এমন ব্যক্তির পরিণতি সম্পর্কে) বললেন, সে জাহান্নামী হবে। – আহমদ, বায়হাকী ।
সাহাবী পুনরায় বললেন, আর অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় যে, সে নফল নামাজ, রােজা এবং দান-সদকা তেমন বেশি করে না, তবে কথা ও কাজে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (এমন ব্যক্তির শুভ পরিণতি সম্পর্কে) বললেন, সে জান্নাতী হবে। | অপর এক হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমন ব্যক্তি কখনাে মুমিন নয়, যে ব্যক্তি উদর পূর্ণ করে খায়, অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী না খেয়ে নিশি যাপন করে। – বায়হাকী।
আলােচ্য ঘটনা ও উল্লেখিত হাদীসগুলাে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা সবাই প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হই। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের তাওফীক দাও। ইনসাফী আদালত।
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম! যদি এমন হতাম গল্পের বই থেকে।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.