বিরোধীদের সাথে আপনার আচরণের কলাকৌশল

আপনার বিরোধীদের সাথে কিভাবে আচরণ করবেন?  কিরূপ আচরণের মাধ্যমে আপনার বিরোধীদের সাথে বিরোধ মিটিয়ে তাদেরকে আপনার আয়ত্বে আনবেন তা জানতে ও শিখতে লেখের এই আর্টিকেলটি পড়ুন। লেখক নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-মের জীবনের ঘটনাগুলির আলোকে বিরোধীদের সাথে বিরোধ মিটানোর উপায়গুলো বর্ণনা করেছেন।

কেমন আচরণ করবেন বিরোধীদের সাথে? (Life hacking tips 13)

বিরোধীদের সাথে আচরণরাসুল সাঃ কাফেরদের সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। ইসলামের দিকে দাওয়াত ও মানবতার পরিশুদ্ধি করতে গিয়ে তাদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা গালিগালাজ ও নিপীড়ন হাসিমুখে সহ্য করতেন। তাদের এসব তরুণের অসদাচরণ তিনি এড়িয়ে যেতেন। 

এমন হবে না কেন? আল্লাহ তাআলা তো তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে জগৎসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’। 

তাই তিনি শুধু মুমিনদের জন্যই রহমত নন; বরং সমস্ত জগতের জন্য ও জগতবাসীর জন্য রহমত। ইহুদিদের অবস্থা চিন্তা করে দেখু।  তারা আল্লাহর রাসূলের নিন্দা করেছ,  তার সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করেছে। কিন্তু তবুও তিনি তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণ করেছেন। 

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন ইহুদীরা একদিন আল্লাহর রাসূলের ঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন তখন তারা বলল ‘আসসা-মু আলাইকুম।’  (অর্থাৎ আপনার মৃত্যু হোক!) 

আল্লাহর রাসূল তখন এর জবাবে বলেন, ‌’ওয়া আলাইকুম’ অর্থাৎ আমার নয়, তোমাদের। কিন্তু আয়েশা রাদিয়ালাহু আনহা তাদের কথা শুনে রাগ হজম করতে পারলেন না তিনি বললেন, আসসা-মু আলাইকুম (তোমাদের মৃত্যু হোক), আল্লাহ তোমাদের অভিশপ্ত করুন এবং তোমাদের উপর গজব আপতিত করুন।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বললেন, আয়েশা একটু থামো। সবার সঙ্গে নরম ও কোমল আচরণ করবে। কঠোরতা ও অশ্লীল আচরণ থেকে বিরত থাকবে।

 আয়েশা বললেন, তারা কি বলছে তা আপনি কি শুনেন নি?

সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বললেন, “তাদের কথার উত্তর আমি কি বলেছি তা কি তুমি শোনো নি? আমি তাদের কথা তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। (অর্থাৎ তোমাদের জন্যে সে দোয়াই কবুল হোক, যা তোমরা আমার জন্য করেছ।) আমার দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন, আর তাদের দোয়া কবুল হবে না। গালির জবাবে গালি দেওয়ার কি দরকার? আল্লাহ কি বলেন নি, “আপনি মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলুন’? 

একদিনের ঘটনা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ সহ কোনো এক জিহাদে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তারা গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকায়  অবতরণ করলেন। সাহাবীগণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লেন।  রাসুল (সা) ও একটি গাছের ডালের সঙ্গে নিজের তরবারী বেঁধে গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। 

এদিকে জৈনিক মুশরিক মুসলিম বাহিনী কে দূর থেকে গোপনে অনুসরণ করছিলে।  রাসূল (সাঃ)কে একাকী ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঘুমোতে দেখে সে পদক্ষেপে এগিয়ে এলো। গাছের ডাল থেকে তরবারিটি হাতে নিল। এরপর সে চিৎকার করে বললো আজ তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?

আল্লাহর রাসূল ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। শিয়রে উন্মুক্ত তরবারী হাতে শত্রু দন্ডায়মান। তরবারীর ফলা থেকে মৃত্যুর ঝলক ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহর রাসূল একাকী। পরনে কেবল একটি লুঙি।  সঙ্গী সাথীরা সবাই দূরে, বিক্ষিপ্ত ও ঘুমে অচেতন।  

মুশরিক লোকটি তার আরাধ্য জয়ের উল্লাসে ও শক্তির উন্মাদনায় বারবার বলছিল, ‘আজ তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে? 

কিন্তু এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রাসূল শান্ত ও অবিচল কন্ঠে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন ”আল্লাহ।

আল্লাহর রাসূলের এ উচ্চারণে কি অসীম শক্তি নিহিত ছিল তা কে জানে? এ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মুশরিক লোকটির সর্বাঙ্গে কম্পন সৃষ্টি হলো। তার হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল।  

রাসূল (সাঃ) উঠে দাঁড়ালেন এবং তরবারিটি হাতে তুলে নিলেন। পাল্টে গেল দৃশ্যপট।রাসুলের হাতে তরবারি। মুশরিক লোকটি এখন নিরস্ত্র।  

রাসুল অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললে,  এখন তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে?

এ কথা শুনে লোকটির চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।  সে থর থর করে কাঁপতে লাগল।  মৃত্যুর শীতল বাতাস যেন তার ঘাড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতে লাগল। উপায়ন্তর না দেখে রাসূলের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো। 

কাতর স্বরে বলতে লাগল, আপনার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর মতন কেউ নেই। আমার প্রতি দয়া করুন। আমার মত অধম নয়; বরং উত্তম আচরণ করুন। 

রাসূল বললেন, তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করবে? 

সে বললো, না। তবে যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আমি তাদের সঙ্গী হব না। 

আল্লাহর রাসূল তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করলেন। তাকে মুক্তি দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানালেন। 

লোকটি ছিল নিজ গোত্রের প্রধান। গোত্রে ফিরে গিয়ে আলোচ্য ঘটনাটি সবাইকে শোনাল। এরপর গোত্রের সবাইকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাল। তার আহ্বান উত্তরের সবাই মুসলমান হয়ে গেল। 

এভাবে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে আপনিও পারেন মানুষের হৃদয় জয় করতে।  চরম শত্রুকেও পারেন বন্ধুতে তে রুপান্তর করতে। ভেঙে দিতে পারেন দুশমনির মজবুত দেয়াল।  

রাসুল (সাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী।  এ আখলাকের মাধ্যমেই তিনি মানুষের হৃদয় মন জয় করেছেন। হেদায়েতের পথ দেখিয়েছেন।  দূর করেছেন হৃদয় থেকে কুফরির অমানিশা। 

রাসুল (সাঃ) যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন কুরাইশের লোকেরা তার মোকাবেলা সব ধরনের উপায় ও পন্থা অবলম্বন করলো।  রাসুল (সাঃ) এর দাওয়াতি মিশনও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ইসলামের গতি কীভাবে রোধ করা যায় তা নিয়ে তাদের বয়োঃজ্যে ও প্রবীণরা পরামর্শ সভা ডাকল।

সবার মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণ তিনি বললেন, মোহাম্মদের এ মিশনের পেছনে কী লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তার আসল উদ্দেশ্য কী তা আমাদের জানতে হবে। এজন্য যাদুবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা ও কাব্যশাস্ত্রে অভিজ্ঞ এমন একজন লোক খুঁজে বের করে তাকে মোহাম্মদের কাছে পাঠাও। সে তার কাছ থেকে তার আসল উদ্দেশ্য বের করে নিয়ে আসবে। এরপর আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করব। একে রোধ করতে না পারলে আমাদের সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।  আমাদের নেতৃত্ব, আমাদের পরিবার ও আমাদের সমাজ সব ধ্বংস হয়ে যাবে। 

সবাই সমস্বরে বললো, ‘এটা সবচেয়ে সুন্দর প্রস্তাব।  এর বিকল্প নেই।  এক্ষেত্রে ওতবা বিন রবিয়ার চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই।’

তখন সবাই মিলে ওতবাকে বললো, ‘ওতবা! তুমিই এ কাজের যোগ্য। তুমিই যাও। দেখ, সে কি বলে। ওতবা ছিল ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ ও নেতৃস্থানীয় লোক। সে বললো, ‘তোমরা আসলে কী চাও? তোমরা কি চাও যে, আমি বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দিয়ে তাকে নিবৃত করতে চেষ্টা করব?’

তারা বললো, হ্যাঁ,  আবুল ওলিদ আমরা এমনটাই চাচ্ছি।’

ওতবা রাসুল (সাঃ) এর কাছে গেল। রাসুল (সাঃ) তখন শান্তভাবে বসে ছিলেন। ওতবা রাসুলের কাছে গিয়ে বসল। এরপর প্রথমেই বললো,  ‘মুহাম্মদ! তুমি উত্তম না তোমার পিতা আবদুল্লাহ উত্তম? ‘

আল্লাহর রাসূল কোনো জবাব দিলেন না৷ বাবার সম্মানার্থে চুপ থাকলেন। ওতবা এরপর বললো, ‘মুহাম্মদ!  তুমি উত্তম না আবদুল মুত্তালিব উত্তম? ‘ রাসূল এবারও চুপ থাকলেন। আবদুল মুত্তালিবের সম্মান রক্ষার্থে কোনো কথা বললেন না।

এরপর ওতবা বললো, ‘তুমি যদি মনে কর এরা তোমার চেয়ে উত্তম তাহলে তো তোমারও তাদের অনুসরণ করা উচিত। তারা তো মূর্তিরই উপাসনা করতো।  অথচ তুমি মূর্তির নিন্দাবাদ করছো। আর যদি মনে কর তুমি তাদের চেয়ে উত্তম তাহলে স্পষ্ট করে বল।

রাসুল (সাঃ) কোনো জবাব দেয়ার আগেই ওতবা খুব উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল ‘আল্লাহর কসম! আমি কোনো জাতির সন্তানকে তোমার চেয়ে দুর্ভাগা ও অপয়া  দেখি নি। তুমি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করেছ। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছ। আমাদের ধর্মকে কলুষিত করেছ। পুরো আরবে আমাদের মানহানি করেছ। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে যে, কোরাইশদের মাঝে একজন যাদুকরের আর্বিভাব ঘটেছে। কোরাইশদের মাঝে একজন গণকের উদ্ভব হয়েছে।  আমাদের এ অবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি হলো, একদিন আমরা সবাই একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাব এবং ভ্রাতৃঘাতী লড়াই করতে করতে সবাই একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাব।’

কথাগুলো বলতে বলতে ওতবা ক্রোধে ফেটে পড়ছিল। রাগে ক্ষোভে তার চেহারা আগুনের পরিগ্রহ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল দীঘির জলের ন্যায় শান্ত হয়ে বসে বসে নীরবে ও মনোযোগ সহকারে তারা সব কথা শুনতে লাগলেন।

এরপর ওতবা রাসূলকে দাওয়াতের মিশন থেকে নিবৃত করতে একে একে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব পেশ করতে লাগলো। 

সে বললো,  ‘মুহাম্মদ! তুমি যা করেছ, এগুলো যদি সম্পদ লাভের জন্য হয়ে থাকে তাহলে আমাদের কথা শোনো, আমরা তোমাকে এত বিপুল পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করে দেব যে, তুমিই হবে কুরাইশের সবচেয়ে বড় ধনী।’ 

‘তোমার মনে যদি নেতৃত্বের বাসনা জেগে থাকে,  তাহলে বল। আমরা তোমাকে আরবের নেতা বানিয়ে দেব। তোমার কথায় সবাই উঠবে আর বসবে।’

‘সম্পদ বা নেতৃত্ব যদি তোমার কাম্য না হয়ে থাকে তাহলে তোমার আরাধ্য বস্তুটা কী? অপরূপ সুন্দরী কোনো নারী? নিঃসংকোচে তাও বলতে পারো। কোরাইশদের যে নারীকেই তুমি পেতে চাও তাকেই পাবে। তুমি যদি বল অপরূপা সুন্দরী নারী দেখে তোমাকে দশটি বিয়ে করিয়ে দেব।’

তুমি যদি মনে কর এগুলো কিছুই তোমার কাম্য নয়; বরং তুমি যা করছ তা কোনো বদ জ্বিন বা ক্ষতিকর কোনো অশরীরি সত্তার প্রভাবে হচ্ছে , যা তুমি নিজে নিজে দূর করতে পারছ না তাহলে তাও বল। আমরা আরবের সেরা কবিরাজ খুঁজে বের করে এর চিকিৎসা করব। এজন্য যত টাকা দরকার আমরা সব ব্যবস্থা করব।’

ওতবা এভাবে অশালীন ভাষায় কথা বলতে লাগল এবং একের পর এক রাসূলকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখাতে লাগল। রাসুল (সাঃ) শান্তভাবে তার কথা শুনে যাচ্ছিলেন। অর্থ সম্পদ, নেতৃত্ব ক্ষমতা, সুন্দরী নারী, জিনের তদবির তার এসব লোভনীয় প্রস্তাবপূর্ণ বক্তব্য শেষ হলো ।

দীর্ঘসময় কথা বলে একসময় ওতবা থামল। কাঙ্খিত উত্তরের অপেক্ষায় সে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগল। এক একটি মুহূর্ত তাঁর কাছে অনেক দীর্ঘ।

রাসূল (সাঃ) তাঁর দিকে মাথা উঁচু করে তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘ওতবা! তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?’

ওতবা সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত রাসূলে আরাবির এ সৌজন্যবোধ ও ভদ্রতায় একটুও বিস্মিত হলো না। শুধু সংক্ষেপে বললো, ‘হ্যাঁ’।

রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তাহলে আমার কথা শোনো।’

সে বললো, ‘ঠিক আছে, আমি শুনছি।’

রাসূল (সাঃ) বলতে শুরু করলেন। তবে একটি কথাও নিজ থেকে বললেন না। পাঠ করতে লাগলেন কুরআনে কারীম থেকে—

“অর্থঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।।…মানুষকে সুন্দর কথা বলুন…।। (সূরা বাকারাঃ আয়াত-৮৩)

রাসূল (সাঃ) তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন আত ওতবা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছে। একসময় ওতবা হাত পা ছেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। সে পেছনে হাত নিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে শুনতে লাগল রাসূলের তিলাওয়াত। তাঁর শরীর দুলে উঠল। হৃদয় নড়ে উঠল। মনের রাজ্যে বয়ে গেল তুমুল ঝড়। রাসূল (সাঃ) একমনে নিবিষ্ট চিত্তে তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন। এভাবে তিলাওয়াত করতে করতে তিনি পৌঁছলেন এ আয়াতে—

“অর্থঃ তারা যদি আপনার কথা প্রত্যাখ্যাত করে তাহলে বলুন, আমি তোমাদেরকে বজ্রপাতের ভীতি প্রদর্শন করছি, যেমন বজ্রপাত হয়েছিল আদ ও সমুদ সম্প্রদায়ের ওপর।’ (সূরা হা মীম সাজদাঃ ১৩)

কঠিন আজাবের এ সতর্কবাণী শুনে ওতবা ঘাবড়ে গেল এবং রাসূল (সাঃ) এর মুখের ওপর হাত রাখল, যেন তিনি তিলাওয়াত বন্ধ করে দেন। কিন্তু তিনি তিলাওয়াত করতে থাকলেন। তিলাওয়াত করতে করতে তিনি সিজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছে সিজদা করলেন।

সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে তিনি ওতবার দিকে তাকালেন। বললেন, ওতবা! তুমি কি আমার তিলাওয়াত শুনেছ?’

সে বললো, হ্যাঁ, শুনেছি।’

‘এবার তুমি কি করবে ভেবে দেখ।’

ওতবা উঠে তাঁর দলবলের কাছে গেল। তারাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর আগমনের পথ চেয়েছিল। ওতবা তাদের কাছে পৌঁছতেই একজন আরেকজনকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! এ ওতবা তো সে ওতবা নয়। তাঁর চেহারায় পরিবর্তনের আবহ দেখা যাচ্ছে।’

ওতবা কাছে এসে বসল। তারা বললো, ‘কী ব্যাপার! কী করে এলে?’

ওতবা বললো, ‘আল্লাহর কসম! আমি মুহাম্মাদের কাছে এমন কিছু শুনেছি, যা জীবনে কখনো শুনে নি। আল্লাহর কসম! এগুলো না কবিতা না যাদু না গণবিদ্যা।’

‘হে কুরাইশের নেতৃবৃন্দ! তোমরা আমার কথা শুন। সে যা করছে, তাকে তা করতে ব্দাও। সে যা বলছে, তা অবশ্যই বড় কোনো কিছু হবে।’

‘সে আমার সামনে বেশ কিছু আয়াত তিলাওয়াত করলো। সে পড়ল, আরবী…

অর্থঃ ‘হা-মীম। এটি পরম করুণাময় অতি দয়ালু সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব। এটি এমন কিতাব, যার আয়াতগুলোকে আলাদা আলাদা করে করে বর্ণনা করা হয়েছে। আরবি কুরআন বুঝতে পারে এমন সম্প্রদায়ের জন্য। মানুষকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী।… এক পর্যায়ে পড়ল, আরবী…

অর্থঃ “তারা যদি আপনার কথা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাদেরকে বলুন, আমি তোমাদেরকে বজ্রপাতের ভীতি প্রদর্শন করছি, যেমন বজ্রপাত হয়েছিল আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের ওপর।’

তখন আমি তাঁর মুখ চেপে ধরলাম এবং আত্মীয়তার শপথ দিয়ে তাকে সামনে তিলাওয়াত বন্ধ করতে বললাম। আর তোমরা তো জান, মুহাম্মদ যখন কিছু বলে ফেলে তখন তাঁর ব্যতিক্রম হয় না। তাই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, তোমাদের ওপর আজাব নেমে আসে কি-না।’

এরপর ওতবা একটু নীরব রইল। সে ভাবনার সাগরে ডুবে গেল। বৈঠকের লোকেরা গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইল।

ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে ওতবা বললো, ‘আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদের কথায় এক ধরনের মধু আছে। তাঁর কথায় এক রকমের রসও আছে। তাঁর কথায় থাকে উপকারী ফলের সমাহার। আর গোড়ায় থাকে সুমিষ্ট পানির প্রস্রবণ। কথার আসরে সে থাকে সবার ওপরে। তাঁর ওপরে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। সে প্রতিপক্ষের সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। সে যা বলছে, এরূপ কথা কোনো মানুষ বলতে পারে না। ’

তারা বললো, ;ওতবা! তুমি যা শুনেছ, তা তো কবিতা।’

ওতবা বললো, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা এখানে যারা আছ, তাদের কেউ আমার চেয়ে কবিতা সম্পর্কে বেশি জান না। কবিতার অন্তঃমিল এবং ছন্দের কলকজার ব্যাপারে আমার চেয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ এখানে কেউ নেই। এমনকি জ্বিনদের কবিতা সম্পর্কেও আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এখানে কেউ নেই। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ যা বলেছে সেগুলো এর কোনোটির সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।’

ওতবা রাসূল (সাঃ)-এর ব্যাপারে তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ করতে লাগল। ওতবা ইসলাম গ্রহণ করে নি ঠিক, তবে ইসলামের প্রতি তাঁর মন ঝুঁকে গিয়েছিল। ইসলামর প্রতি তাঁর ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছিল।

একটু ভাবুন। উত্তম ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণের এবং উন্নত ব্যবহারের প্রভাব কত গভীর। অথচ ওতবা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের চরম দুশমন।

আরেক দিনের ঘটনা। কুরাইশের লোকেরা সমবেত হয়ে হুসাইন বিন মুনযির খোযায়ীকে আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে কথা বলার জন্য পাঠালো। সে ছিল প্রসিদ্ধ সাহাবী ইমরান বিন হুসাইনের পিতা।

আবূ ইমরান রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলো। রাসূলকে ঘিরে সাহাবায়ে কেরাম বসে আছেন। আবূ ইমরান রাসূলের সাথে কথা বলতে শুরু করলো। তাঁর কথায় নতুনত্ব ছিল না। সে তাই বললো, যা কোরাইশরা সবসময় বলতো। ‘তুমি আমাদের গোত্রীয় সংহতি নষ্ট করেছ। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করেছ। আমাদের পরিবারগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে…।’

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মনোযোগের সঙ্গে তাঁর কথা শুনলেন। সে যখন তাঁর কথা শেষ করলো তখন রাসূল (সাঃ) নরম সুরে বললেন, ‘আবূ ইমরান! তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?’

সে বললো, হ্যাঁ’।

রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘এবার তাহলে আমি যা জিজ্ঞেস করি, তাঁর উত্তর দাও। আবূ ইমরান বললো, ‘ঠিক আছে, বলুন আমি শুনছি।’

রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তুমি প্রতিদিন কতজন মাবুদের ইবাদত কর?’

: ‘সাতজনের। পৃথিবীতে আছেন ছয়জন, আর আকাশে আছেন একজন’!

: ‘আচ্ছা, এদের মধ্যে কাকে ভয় কর এবং ভালোবাস?

: ‘যিনি আকাশে আছেন  কেবল তাকে!’

: ‘হুসাইন! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে আমি তোমাকে এমন দু’টি বাক্য শেখাব, যা সবসময় তোমার জন্য উপকার বয়ে আনবে।

আল্লাহর রাসূলের এই কথা শুনে হুসাইন আর দেরি করলো না। সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইসলাম গ্রহণ করেই সে বললেন, ‘ইয়া রাসূল্লাল্লাহ! আমাকে সে বাক্য দু’টি শিখিয়ে দিন।’

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি সবসময় বলবে-

আরবী…

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সৎ পথের দিশা দিন এবং আমাকে আমার রিপুর অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন।’

আহ! কী চমৎকার ছিল তাঁর আচরণ! কি অমায়িক ছিল তাঁর ব্যবহার। কাফেরদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করার ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই।

জনৈক মুসলিম যুবক পড়াশোনা করতে জার্মানিতে গিয়েছিল। সেখানে সে একটি ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকত। তাঁর পাশের ফ্ল্যাটেই থাকত একজন জার্মান যুবক। দু’জনের মাঝে তেমন সম্পর্ক ছিল না। একজন আরেকজনের প্রতিবেশী, শুধু এতটুকু সম্পর্কই ছিল।

জার্মান যুবকটি একদিন কোথাও সফরে গেল। হকার এসে প্রতিদিন তাঁর দরজার সামনে পত্রিকা দিয়ে যেত। প্রতিবেশী মুসলিম যুবক একদিন দেখলো, তাঁর সামনের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে অনেক পত্রিকা জমা হয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারল, তাঁর প্রতিবেশি যুবক কোথাও সফরে গেছে। তখন সে পত্রিকা সংগ্রহ করে সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দিত।

দু’ তিন মাস পর জার্মান যুবকটি ফিরে এল। মুসলিম যুবকটি এর অপেক্ষায়ই ছিল। সে সুযোগমতো গিয়ে তাকে সালাম দিল এবং নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করায় তাকে অভিনন্দন জানাল। এরপর তাকে পত্রিকাগুলো দিয়ে বললো, ‘আমার মনে হয় আপনি কোনো প্রবন্ধ নিয়মিত পড়েন অথবা পত্রিকার কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। আপনার প্রবন্ধ পাঠ বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ যেন ব্যাহত না হয় তাই আমি এগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছি।

তাঁর এ কাজ দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি এর জন্য কোনো বিনিময় বা প্রতিদান চান?’

সে বললো, ‘না, না। কোনো বিনিময়ের জন্য আমি এ কাজ করি নি। আমাদের ধর্মই আমাদেরকে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করার শিক্ষা দেয়। আপনি আমার প্রতিবেশি। আপনার সঙ্গে সদাচরণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’

এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে তাঁর সঙ্গে সদাচরণ করে যেতে লাগল। একসময় সে জার্মান যুবক ইসলাম গ্রহণ করলো।

প্রিয় পাঠক! আল্লাহর কসম, এভাবেই জীবনকে উপভোগ করতে হয়। ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। আপনার আচরণ যদি সুন্দর করেন তাহলে আপনার জীবন হবে উপভোগ্য ও সুখময়। উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন, ডানদিকের সংখ্যার মতো আপনারও মূল্য আছে। আপনি সবকাজ আল্লাহর ইবাদত হিসেবে করবেন। এমনকি মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণকেও যদি আপনি আপনার ইবাদতেরই অংশ মনে করেন তাহলে তাতেও আপনি পাবেন সীমাহীন প্রতিদান।

অমুসলিমদের একটি বড়ে অংশ কোনো কোনো মুসলমানদের অনৈতিক আচরণের কারণে ইসলাম থেকে দূর সরে রয়েছে। মুসলমানরা কখনো তাদের অমুসলিম কর্মচারীর ওপর অত্যাচার করে, কখনো লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদেরকে ধোঁকা দেয়, আবার কখনো কাফের প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়।

তাই আসুন, আজ থেকে জীবনের পথচলা নতুন করে শুরু করি। চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে অমুসলিমদের হৃদয় মন জয় করতে চেষ্টা করি।

আলোকচ্ছটা….

শুধু কথা নয় যার আচরণ মানুষকে আকৃষ্ট করে সেই তো শ্রে’দাঈ।

উৎস : জীবনকে উপভোগ করুন বই থেকে।

এরপর পড়ুন : পশু পাখির প্রতিও সদয় হোন!

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment