ডিজিটাল অটিজম: প্রযুক্তির ছায়ায় শিশুর বিকাশের সংকট

ডিজিটাল অটিজম। বর্তমান যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, টেলিভিশন  এ সমস্ত গ্যাজেট আজকাল শিশুর হাতের মুঠোয় পৌঁছে যাচ্ছে প্রায় জন্মের পর থেকেই। অথচ গবেষণা বলছে, অতিমাত্রায় স্ক্রিনের প্রতি নির্ভরশীলতা শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এর একটি ভয়াবহ রূপ হচ্ছে “ডিজিটাল অটিজম”।

ডিজিটাল অটিজম কী?

ডিজিটাল অটিজম বলতে বোঝানো হয় গ্যাজেট বা স্ক্রিন নির্ভরতার কারণে সৃষ্ট এমন কিছু উপসর্গ, যা আচরণগতভাবে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের (ASD) মতো । যদিও এটি ক্লিনিক্যাল অটিজম নয়, তবে লক্ষণগুলি অত্যন্ত মিল খায় এবং শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কখন এবং কাদের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৬ মাস (প্রায় ৩ বছর) বা তার পরবর্তী বয়সী শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাজেট ব্যবহারের কারণে এই ধরনের উপসর্গ প্রদর্শন করতে পারে। এই বয়সের শিশুরা ভাষা শেখা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, আবেগের প্রকাশ ইত্যাদি বিকাশের সবচেয়ে সংবেদনশীল পর্যায়ে থাকে। এসময় যদি তারা বাস্তব সামাজিক যোগাযোগের পরিবর্তে স্ক্রিনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তবে তাদের প্রকৃত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

ডিজিটাল অটিজমের কিছু সাধারণ লক্ষণ

  • চোখে চোখে যোগাযোগের অভাব

  • ভাষা বিকাশে বিলম্ব বা সম্পূর্ণ ভাষাহীনতা

  • অতিরিক্ত আবেশ বা স্ক্রিন ছাড়া অস্বাভাবিক বিরক্তি

  • অন্য শিশুদের সাথে মিশতে অনাগ্রহ

  • আচরণগত পুনরাবৃত্তি বা স্টেরিওটাইপিক আচরণ

  • চারপাশের প্রতি আগ্রহের অভাব

কেন এটি ঘটে?

স্ক্রিন বা গ্যাজেট ব্যবহারের সময় শিশুর মস্তিষ্কে দ্রুতগতির ভিজ্যুয়াল ও অডিও ইনপুট প্রবাহিত হয়। এটি তাদের মস্তিষ্ককে অতিমাত্রায় উত্তেজিত করে এবং প্রাকৃতিক ইন্টার‌্যাকশন, সামাজিক শিক্ষা ও মনোযোগ উন্নয়নের ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। ফলে, বাস্তব পরিবেশের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যায় এবং তারা একটি “ডিজিটাল বুদবুদ”-এর মধ্যে আটকে পড়ে।

সমাধান ও প্রতিরোধ

  • ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের স্ক্রিন এক্সপোজার একেবারে এড়িয়ে চলা উচিত।

  • ৩-৫ বছরের শিশুদের জন্য স্ক্রিন টাইম প্রতিদিন ১ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।

  • বাস্তব জীবনের খেলা, গল্প বলা, শিল্পকলা, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর উপর জোর দিতে হবে।

  • পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

  • গ্যাজেট ব্যবহারের সময় অভিভাবকের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকতে হবে, একা একা শিশুকে গ্যাজেটের সাথে ছেড়ে দেয়া যাবে না।

উপসংহার

ডিজিটাল অটিজম কোনো কল্পিত বিষয় নয়, এটি আজকের বাস্তবতা। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক দক্ষতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সময় এসেছে, শিশুকে প্রযুক্তির দাস নয়, প্রযুক্তিকে শিশুর বিকাশের সহায়ক করে তোলার।

আরও পড়তে পারেনশিশুর মূল্যবোধ ও আচরণ গঠনে পরিবারের ভূমিকা

লেখিকা: আনিকা জেরিন চৌধুরী। 

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading