ছেঁড়া ব্লাউজ, লেখক মামুন মুনতাসির এর একটি বাস্তবধর্মী গল্প। লেখক এক গ্রাম্য মেয়ের জীবনের ঘটনা তাঁর গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাহলে চলুন লেখকের ছেঁড়া ব্লাউজ গল্পটি পড়া শুরু করি…
গল্প : ছেঁড়া ব্লাউজ
বিয়ের জন্য পাত্রী হিসেবে ষোল-আঠারো বয়সের মেয়েদের প্রথম চয়েসে রাখে যে কোন পুরুষ। মুছাপুর গ্রামে বাস করতো জারিনা নামের সদ্য বিধবা এক নারী। তার স্বামী কৃষি কাজ করে জীবিকা চালাতো। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার চালাতে একটা গার্মেন্টসে কাজ নেয় জারিনা। জারিনার একমাত্র ভাবনা তার মেয়ে সায়মাকে নিয়ে। তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তোলা। সায়মা নয় ক্লাস ডিঙিয়ে দশ ক্লাসে উঠেছে। লেখাপড়ায় বেজায় ভাল। লোকে বলতো জারিনা অনেক লাকি। ভাগ্যগুণে এমন মেয়ে পেয়েছে।
সেবার যখন সায়মাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়েছিল তখন সেরা ছাত্রের পুরস্কার পায় সায়মা। পুরস্কার তুলে দেয় স্কুলের সভাপতি আউয়াল তালুকদার। সায়মার বাড়ন্ত যৌবনে তালুকদারের নেশা জেগে বসলো। চামচা আনিসকে জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটি কে? কোথায় থাকে? কার মেয়ে?
আনিস বলল, হুজুর! মেয়েটি আমাদের একই গ্রামের। বিধবা জারিনার মেয়ে, যে গার্মেন্টসে কাজ করে।
আউয়াল তালুকদারের গ্রামে বউ পিটানোর অনেক সুনাম আছে। এর আগে তিনটে বউকে পিটিয়ে বিদায় করেছে। শেষ বউটা কিভাবে যে গুম হয়ে গেছে সে হদিস এলাকাবাসী আজো পায় নি। এমন চরিত্রের মানুষ ও যে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে থাকতে পারে সেটা জেনে মোটেও অভাক হয় না কেউ। কেননা, প্রভাব আর প্রতিপত্তির জোরে অমানুষরাও মানুষদের শাসন করতে পারে।
রাতের বেলা চামচা আনিস মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে যায় জারিনার ঘরে। সায়মা তখন মেঝেতে উপুর হয়ে লিখছে। এতে আনিসের দৃষ্টি দাঁড়িয়ে যায় সায়মার উপর। আনিস দশ বছর হলো আউয়াল তালুকদারের চামচামি করছে। কত মেয়েকে এর আগে আউয়ালের বিছানায় পাঠিয়েছে সে হিসেব তার নিজের ও অজানা। সায়মাকে দেখার পর তার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। আনিসের বউ মারা যায় বছর পাঁচেক হয়। লোকে বলত, আনিস যখন বাহিরে থাকতো তখন তার বউয়ের সাথে জোর পূর্বক অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হতো তালুকদার। এক পর্যায়ে বউ তার স্বামীকে সব ফাঁস করে দিবে বললে, তালুকদার বালিশ চাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলে। আনিস সম্পূর্ন ঘটনা জানা সত্তেও না জানার ভান করে তালুকদারকে জি হুজুর, জি হুজুর বলে সম্বোদন করছে। এতে তালুকদারও নিশ্চিত যে, আনিস তার বউয়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না।
কথায় বলে, ফণাওয়ালা সাপ কখনোই চুপ থাকতে পারে না। আজ না হয় কাল ফোঁস করে উঠবেই। তাই আনিস তালুকদারের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে নিজেই ভোগ করতে চায়লো। তাই সে জারিনার হাতে মিষ্টির হাঁড়ি আর কিছু টাকা দিয়ে বলল, এটা আমার তরফ থেকে সায়মার জন্য উপহার। সে আমাদের গ্রামের গর্ব। তার বাবা নেই তাতে কি হয়েছে আমরা তো আছি। তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি সব সময় সায়মার খেয়াল রাখবো। এ বলে সায়মার লম্বা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে ঘর ছাড়লো।
জারিনা ব্যাপারটাকে খুব সহজ ভাবেই নিলো। এভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন বাহানায় ঘরে আসতে থাকে আনিস। সায়মার পাশ ঘেঁষে বসে তার গায়ে হাত দেয়। এতে সায়মা অস্বস্তি অনুভব করে। এ দিকে আউয়াল তালুকদার কোন সাড়া না পেয়ে একদিন রাতেই চলে আসে সায়মাদের উঠুনে। তার একটু আগেই আনিস ঘরে ডুকেছে। এতে তালুকদারের সন্দেহ বেড়ে গেল। সে বুঝতে পারলো আনিস তার মুখের খাবারে ভাগ বসাতে চাচ্ছে, কিংবা একাই ভোগ করতে চাচ্ছে। তাই তালুকদার কিছুই না বলে তার ঘরে চলে যান। রাতে আনিসকে কিছুই বললেন না।
পরের দিন আনিসকে নিয়ে হাজির হলেন সায়মাদের ঘরে। জারিনা তালুকদারকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। কি বলবে, কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। তালুকদার আনিসকে বলল, তুই প্রতিদিন এ ঘরে এসে কি করিস?। আনিস বলল, হুজুর আমি আসি কেবল আপনার হুকুম তামিল করার জন্য। এতে জারিনাও সায়মা আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। তালুকদার চোখ রাঙিয়ে বলল, বদমাইশ ! আমার হুকুম তামিল করতে আসিস, নাকি আমার মুখের খাবার কেড়ে নিতে আসিস? এ বলে তার গলা দিয়ে সঙ্গে করে আনা ছুরিটা চালিয়ে দিল। মুহুর্তেই গলাকাঁটা মুরগির মত ছটফট করতে করতে নীরব হয়ে গেলো।
এসব দেখে মা-মেয়ে ভয়ে আঁতকে উঠল। তালুকদার জারিনাকে বলল, আমি পুলিশকে আসতে বলছি। জারিনা কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলো, ক্যানো হুজুর? পুলিশ আসবে ক্যানো? তালুকদার শয়তানি হাসি হেসে বলল, তোমার মেয়ের ইজ্জত রক্ষার্থে তুমি আনিসকে খুন করেছো। আমি তার স্বাক্ষী। এ কথা শুনার পর সায়মা তালুকদারের পায়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, দোহায় আপনার আপনি এমনটি করবেন না। আমার মা খুন করে নি। খুন করছেন আপনি। এবার তালুকদার তার খায়েস মিটানোর জন্য বলল, ঠিক আছে আমি সবাইকে বাঁচিয়ে দিবো বিনিময়ে তুমি আমাকে বিয়ে করতে হবে।
তালুকদারের বয়স পঁঞ্চাশ পেরিয়ে একান্নতে ঠেকছে। আর সায়মা কেবল ষোলতে পা রেখেছে। বুড়ো শালিকের সুকনো যৌবন নদীতে জোয়ার এসেছে। অবশেষে সায়মা বুড়ো শালিকের চার দেয়ালে নিজেকে উজার করতে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ষোল বছরের যৌবন নদীতে একান্ন বছরের পুরনো ইঞ্জিনে বৈঠা দিল। কালের গর্ভে কে কাকে বিলিন করতে পেরেছে সেটা না হয় পাঠকের অনুভূতির মাঝেই ছেড়ে দিলাম। সায়মা এখন পুরোদমে সংসারি হয়ে গেছে। কেবল হারিয়ে গেছে তার স্বপ্ন, লেখাপড়া, আর কোন তরুণের প্রথম আর শেষ স্পর্শ।
নারী চায় প্রেম। আদর। সোহাগ। ভালবাসা। আর ভালবাসা দিয়েই ভালবাসাকে বুঝতে হয়। নারীকে বিবাহের মাধ্যমে পুরুষের উপভোগের জন্য হালাল করা হয়েছে। তবুও এর মধ্যে কিছু কিছু সময় নারীর সঙ্গে সঙ্গম করা সম্পূর্ণ রূপে হারাম। আর এটা যদি বুঝতে না পারেন তবে পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়ার পরও আপনি পুরুষ হতে পারেন নি। বিয়ের ছয় মাস গত হলো। নিষিদ্ধ সময়টাও তার উপর নির্যাতন চালাতো তালুকদার। প্রতিটা রাত তার কাছে ছিল এক একটা মৃত্যু যন্ত্রণা। আকাশে যখন অন্ধকার নেমে আসতো তখন সায়মার বুক কেঁপে কেঁপে উঠতো। প্রথম থেকে শেষ রাতটি পর্যন্ত সে একটি বারের জন্যেও প্রেম খুঁজে পায় নি। পেয়েছে শুধু নির্যাতন আর নির্যাতন। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে সে। আর পেরে উঠছে না শক্ত শরীরের পাষণ্ড মানুষটির সাথে। যে থেঁথলে দিয়েছে কোমল শরীর আর তুলতুলে গাল দুটিও। বিষে বিষে বিষাক্ত হয়ে গেছে প্রেমে ভর্তি ষোল বছরের তনুটি। আজ এটি বিশ্রাম খুঁজে পেতে চায়, প্রেম নয়।
এখন মধ্যরাত। রাত যতই শেষ হয়ে আসবে বুড়োর খামচানো ততই কমতে থাকবে। আজ নখের আঁচর কেঁটেছে বুকের মাঝে। তাই ব্যথায় টনটন করছে পুরো শরীর। মুখে কোন শব্দ নেই সায়মার। তালুকদারের সাথে দিব্বি রেসপন্স করে যাচ্ছে। একটু পরে ফজরের আযান দিবে। আচমকা বিকট শব্দ করে উঠল তালুকদার। চেঁচিয়ে উঠল বারবার। তালুকদারের চিৎকারে আশেপাশের ঘরগুলিতে ঘুমে থাকা বাচ্চাটিও জেগে গেলো। হঠাৎ নীরব হয়ে গেল সব। সবাই কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো। না। আর কোন আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না। দু চারজন তালুকদারের ঘরের দিকে দৌড়ে এলো। দরজা খোলা। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। ভেতরে ডুকে দেখলো তালুকদার শুয়ে আছে অচেতন হয়ে। তার মুষ্ঠি বদ্ধ হাতে ব্লাউজের ছেঁড়া টুকরো। একজন এগিয়ে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে জানাল, তালুকদার আর নেই। পরে অবশ্যই ফরেনসিক থেকে জানা গেল অন্তকোষ থেঁথলে গেছে।
ফাঁকা রাস্তা। দু একটা রিক্সা চলাচল করতে শুরু করেছে কেবল। এখনো আবছা অন্ধকারে ঢাকা চারোদিক, তাই পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সায়মার এলোমেলো খোলা চুল হালকা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহ! কতকাল পরে এমন হাওয়া গায়ে মাখছে সে। নির্মল বাতাস। লাল শাড়ীর ছেঁড়া আঁচলখানি বুক বেয়ে বার বার খসে পড়ছে। সে ঘুমাতে চায়। বড্ড ক্লান্ত সে। মেইন সড়ক পাড় হতেই হর্ন শুনতে পেলো। এরই মধ্যে পুলিশকে খবর দিয়েছে কেউ। এখন সে স্বাধীন, তবে বড্ড ক্লান্ত। সাড়ে ষোলতে পা রাখা দুটি পা হেঁটে চলছে এক অজানা অচেনা স্পর্শের দিকে। আঁধার কাটতেই নজর গেলো তার বুকের উপর, একি! ব্লাউজের ছেঁড়া টুকরোটা কৈ? তবে কি পুলিশ সূত্র পেয়ে গেছে?
লেখক – মামুন মুনতাসির (৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ খ্রি.)
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি লেখকের ছেঁড়া ব্লাউজ গল্পটি পড়ে ভালো লেগেছে। ভালো লাগলে এটি শেয়ার করতে ভুলবেন না।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.
Very good story…
আপনার সুন্দর মতামতের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের প্রতেকটি মন্তব্যই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্ব পূর্ন ।
হ্যাঁ, পাঠকদের প্রতেকটি মন্তব্যই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অসাধারণ
আপনার মতামত প্রদানের জন্য ধন্যবাদ। আশা করি আমরা আপনাকে নিয়মিত পাবো।