বাংলার এক মহিয়সী নারী (পতিপ্রাণা স্ত্রীর গল্প)

বাংলার এক মহিয়সী নারী, লেখক বাংলা এক পতিপ্রাণা নারীর জীবনের ছোট একটি ঘটনা গল্প আকারে তাঁর বইতে তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন আমরা এই মহিয়সী নারী’র গল্প টি পড়া শুরু করি…

বাংলার এক মহিয়সী নারী! (জীবনের ঘটনা)

মহীয়সী নারীবর্তমানে অনেক মহিলাই এমন আছেন যারা দাবী করেন যে, “আমরা স্বামীর হুকুম ছাড়া কোথাও যাই না। স্বামীর খেদমত করি। স্বামীর কথামত চলি। স্বামীর মনে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলি না। স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করি না। যেভাবে চললে বা যে কথা বললে স্বামী খুশি হবেন, তা-ই করি।’

আমিও একথা বলি না যে, তাঁদের দাবী মোটেও সত্য নয়। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি—বর্তমান পৃথিবীতে এমন অনেক স্ত্রী-ই আছেন যারা সত্যিকার অর্থেই পতিপ্রাণা। যারা স্বামী ছাড়া আর কিছুই বুঝেন না। স্বামীর ছোট-বড় যে কোনো নির্দেশ পালনের জন্য এক পায়ে খাড়া থাকেন। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে হলেও সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কখনোই বাড়ির বাইরে পা রাখেন না।

বস্তুতঃ এসব মহিয়সী নারী জগতে আছেন বলেই আজো টিকে আছে এই পৃথিবী, আজো জন্ম নিচ্ছেন তাঁদের গর্ভে বড় বড় আলেম, গাউস কুতুব ও মনীষী। তবে একথা সত্য যে, কিছু কিছু স্ত্রী এমন আছেন, যারা অনুকুল পরিবেশ ও মন-মেজাজ ভালো থাকা অবস্থায় তো স্বামীর কথা মেনে চলেন, স্বামীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন, সম্মান দেন, কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা মন বিগড়ানো অবস্থায় স্বামীর কথা মোটেও মানেন না। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় তাঁরা মুখ দিয়ে এমন শক্ত কথাও বলে ফেলেন যা স্বামীর মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি; যা একজন স্বামী তার স্ত্রী থেকে কখনোই আশা করেন না। প্রকৃতপক্ষে যেসব নারী প্রথম প্রকারের অর্থাৎ যারা ভালো-মন্দ, খুশি-নাখোশ, অনুকূল-প্রতিকূল—এক কথায় সর্বাবস্থায় সকল পরিবেশে স্বামীর স্বামীর বড়ত্ব ও মহত্বকে হৃদয়ে ধারণ করে তার নির্দেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করেন, তারাই মূলতঃ আদর্শ স্ত্রী। তারাই জগতের গর্ব। তাঁদের দ্বারাই জগতের অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। তারাই লাভ করবে বেহেশতের সুউচ্চ মাকাম। পাঠকবৃন্দ! সর্বপ্রথম আমি এ ধরনের একজন আদর্শ স্ত্রীর শিক্ষণীয় ও সত্য একটি ঘটনাই আপনাদের শোনাব।

আজ থেকে প্রায় চব্বিশ পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। একবার পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা হযরত মুফতি আজীজুল হক (রহঃ)-এর সুযোগ্য স্ত্রী তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে যাওয়ার দু’তিন দিন পর থেকেই প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। এই যে শুরু, আর শেষ হওয়ার নামগন্ধ নেই। একটানা চলছে তো চলছেই। এভাবে কয়েকদিন অবিরাম ভারী বর্ষণের ফলে বন্যা নেমে আসে। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়তে থাকে বন্যার পানি। এক পর্যায়ে বন্যার পানি বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ে। ফলে কাঁচা ঘরগুলো ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। পানিতে ভেসে যায় হাজার হাজার একর ফসলের জমি। সহায়-সম্পত্তি আর জান বাঁচানোর তাগিদে মানুষের মাঝে শুরু হয় হাহাকার আর কলিজা ফাটা আর্তনাদ। এসময় অসহায় পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন শত শত নৌকা নিয়ে আসে। এবং নারী-পুরুষ শিশুসহ মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে থাকে।

এদিকে হুজুরের স্ত্রীর বাপের ভিটাটিও ছিল মাটির তৈরি। পানি বেশি হওয়ায় অন্যান্য মাটির ঘরের ন্যায় এটিও ভেঙ্গে যায়। ঘরের ভিতরে হয়ে যায় কোমর পরিমাণ পানি। খাটের উপরও পানি চলে আসে। নিজেকে শুকনো রাখার মতো কোনো জায়গা আর বাকী নেই। এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে সকল প্রকার আশ্রয়। তাই বাড়ির লোকজন প্রাণের মায়ায় কাঁদতে শুরু করে। এমতাবস্থায় শহরের একটি নৌকা সেই পরিবারের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে।

উক্ত নৌকাটি বাড়িয়ে ঢোকার সাথে সাথে বাড়ির লোকজন তাতে উঠে পড়ে। কিন্তু হুজুরের স্ত্রী সেই নৌকায় উঠতে রাজী হলেন না। তাঁকে নৌকায় উঠা জন্য বারবার বলা হলো, অনেক বুঝানো হলো। কিন্তু তার একটিই কথা—আমার হুজুর (স্বামী) না এলে কিংবা আমাকে যাওয়ার জন্য কারো মাধ্যমে অনুমতি না পাঠালে কিছুতেই আমি এ বাড়ি ত্যাগ করব না। কারণ তার অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করি না। কোথাও যাই না।

এ সময় কয়েকজন মহিলা তাঁকে বলল, আপনি কি তাহলে এখানে থেকে মরবেন? জীবন দিবেন? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, প্রয়োজনে  আমি মরতে রাজি আছি। প্রস্তুত আছি জীবন দিতে। তবু হুজুরের অনুমতি ব্যতীত আমি কোথাও যাব না। আমি যেমন তার অনুমতি নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছি, তেমনি তার অনুমতি নিয়েই যেখানে যাওয়ার যাব। তবে আমার একান্ত বিশ্বাস যে, মুহতারাম হুজুর আমাকে নেওয়ার জন্য পটিয়া থেকে চলে আসবেন, অথবা অল্প সময়ের মধ্যেই কোনো নৌকা পাঠাবেন অথবা কারো মাধ্যমে আমার জন্য কোনো নির্দেশ প্রেরণ করবেন। যদি তিনি না এসে আমার জন্য কোনো নির্দেশ পাঠান তাহলে আমি সেই নির্দেশ মোতাবেকই কাজ করব। আমার জন্য আপনাদের বসে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। মেহেরবানী করে আপনারা চলে যান। আল্লাহ পাক অতি শীঘ্রই আমার জন্য কোনো উত্তম ফয়সালা করবেন।

হুজুরের স্ত্রীর এই শক্ত মোনোভাব দেখে পরিবারের লোকজন অবশেষে অপারগ হয়ে তাঁকে রেখেই চলে যেতে বাধ্য হলেন। আর হুজুরের স্ত্রী একা একা আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে স্বামী কিংবা তার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন।

এদিকে বন্যার পানি বেড়েই চলছে। সেই সাথে উপর থেকে পড়ছে টুপটুপ বৃষ্টি।

খানিক পর এই পতিপ্রাণা মহীয়সী নারীর জন্য আল্লাহর সাহায্য নেমে এল। আসলে যে নারী স্বামীর জন্য এরুপ নিবেদিত, স্বামীর ভক্তি-শ্রদ্ধা যার অন্তরে এর শক্তভাবে প্রোথিত, যে নারী স্বামীর নির্দেশ ছাড়া আজ পর্যন্ত নিজ বাড়ির বাইরে যাননি, সেই নারীকে মহান আল্লাহ পাক কি সাহায্য না করে পারেন? পারেন কি সেই নারীর আবেদন পূর্ণ না করে থাকতে?

দূর থেকে দেখা গেল, একটি নৌকা ধীরে ধীরে এদিকে আসছে। কাছে আসার পর দেখা গেল, এটি হলো ঐ নৌকা যা তার হুজুর অর্থাৎ হযরত মুফতি আজীজুল হক সাহেব (রহঃ) তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পটিয়া থেকে পাঠিয়েছেন। তিনি সেই নৌকায় আরোহন করলেন এবং স্বামীর কাছে চলে গেলেন।

হুজুরের কাছে যাওয়ার পর হুজুর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তোমার পরিবারের লোকদের সাথে কেন আসলে না?

উত্তরে তিনি বললেন, আপনি কিভাবে ভাবলেন যে, আপনার অনুমতি ছাড়া আমি সেখান থেকে চলে আসব?

হুজুর বললেন—হ্যাঁ, আমি জানতাম, তুমি মরে গেলেও আমার অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কোথাও যাবে না। তাই আমি তাড়াতাড়ি করে তোমার জন্য নৌকা পাঠিয়ে দিয়েছি।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! একটু লক্ষ্য করে দেখুন, এই মহিলা কতটা সতী-সাধ্বীও  পতিপ্রাণা নারী ছিলেন। যিনি জীবনের এমন ঝুকিপুর্ণ অবস্থায়ও স্বামীর হুকুমকে উপেক্ষা করে জীবন বাঁচাতে চাননি। বরং স্বামীর হুকুম না পেলে জীবনটাও বিলিয়ে দেওয়ার জন্য রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামীর হুকুমের অপেক্ষায় কোমর পরিমাণ পানির নীচে একা নিরাশ্রয় হয়ে অবস্থান করেছেন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাক সকল স্ত্রীকে এরূপ পতিপ্রাণা স্ত্রী হওয়ার তাওফীক দান করুণ। আমীন।

[সহায়তায়ঃ পারভীন আক্তার, উত্তর আমীরবাদ, চট্টগ্রাম]

এরপর পড়ুন : স্বামীর পরশে বদলে গেল স্ত্রীর জীবন

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, লেখকের বাংলার এক মহিয়সী নারী গল্পটি পড়ে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই এটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment