এই গল্পটি একজন প্রখ্যাত চোর ও দরবেশ জুনাইদ বাগদাদী (রহঃ) এর। চোর ব্যক্তিটি সুফী জুনাইদ বাগদাদী’র বাড়িতে চুরি করে এবং এই সুফী সাধকের সাথে অত্যান্ত খারাপ আচরণ করে থাকে। কিন্তু এই সাধক এই চোর ব্যক্তির সাথে খুবই অমায়িক আচরণ করে এবং সাধকের আচরণে মুগ্ধ হয়ে একজন সোনার মানুষে রূপান্তর হয়। সম্মানিত লেখক, এই চোর ব্যক্তিটি সোনার মানুষ হবার ইসলামিক কাহিনীটি গল্পাকারে উত্থাপন করেছেন।
চোর হল সোনার মানুষ ( সুফী দরবেশের ইসলামিক কাহিনী )
বাগদাদের এক প্রসিদ্ধ চোর। তার মূল নাম অনেকেই জানে না । ইবনে সাবাত নামেই সর্বত্র তার পরিচিতি। চুরির অপরাধে সে অনেক আগেই একটি হাত হারিয়েছে। কিন্তু তারপরেও চুরির অভ্যাস ছাড়তে পারেনি সে ৷
এক রাতের ঘটনা ৷
চুরির উদ্দেশ্যে বাগদাদের অলিতে-গলিতে আপন মনে হাটছিল ইবনে সাবাত। এভাবে হাটতে হাটতে অনেক রাত হয়ে গেল। কিন্তু চুরি করার মত পছন্দসই কোন ঘর সে খুঁজে পেল না। এতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ একটি ঘরের দিকে চোখ পড়তেই তার হৃদয়-মন আনন্দে নেচে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় এটা কোন অভিজাত গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকের বাসস্থান হবে। যদি কোন রকম উহা থেকে চুরির কাজটি সমাধা করে ফিরতে পারি তাহলে আজকের রাতে বেশ কামাই হবে । বিবি-বাচ্চা নিয়ে দুচার দিন আচ্ছা মত আমোদ-প্রমোদ করা যাবে । সাথে সাথে উন্নত মানের মুখরোচক খাবারও ভাগ্যে জুটবে।
এসব চিন্তা করতে করতে এক সময় সে অতি সন্তর্পনে ঘরের বিশাল দরজায় হাত রাখল । অতঃপর সামান্য ধাক্কা দিয়ে বুঝল দরজা ভিতরে খোলা । ভিতরের দিক থেকে তা লাগানো হয়নি ।
সে মনে মনে বেশ খুশি হল । দরজা খোলা পেয়ে অত্যন্ত চুপিসারে ঘরে ঢুকে সে দেখল, একটি কক্ষে খেজুর পাতার একটি চাটাই বিছানো । তার এক পার্শ্বে চামড়ার একটি বালিশ। কোনায় রয়েছে দামী-দামী কাপড়ের একটি বিশাল স্তুপ। সে বুঝল, বাড়ীটি নিশ্চয়ই কোন বড় ব্যবসায়ীর হবে ।
মূল্যবান কাপড়-চোপড় দেখে প্রথমে সে খুশিতে আটখানা হলেও পরক্ষণেই একথা ভেবে চিন্তিত হলো যে, এগুলো সে নিবে কিভাবে? এগুলো বাধার জন্য রশি পাবে কোথায়?
হঠাৎ তার মনে হল, আরে, আমার গায়ের চাদর দিয়ে পেচিয়ে তো নিতে পারি । একথা মনে আসতেই সে গায়ের চাদর খানা খুলে চাটাইয়ের উপর বিছাল। এরপর কাপড়ের থানগুলো একটি একটি করে তার উপর রেখে গাট্টি বাধতে চেষ্টা করল । কিন্ত সফল হল না । কারণ এক হাত দিয়ে কি গাট্টি বাধা যায়? অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আবারো বাধতে চেষ্টা করল । কিন্তু এবারও সে ব্যৰ্থ হল ।
এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করার পর ভয়, উৎকণ্ঠা ও ক্লান্তিতে সে হাঁপাতে শুরু করল । মনে মনে আফসোস করে বলল, হায়! এত মূল্যবান জিনিষ পেয়েও শুধু বাধতে না পারার কারণে বুঝি নিতে পারব না। আহা, যদি আমার আরেকটি হাত থাকত!
হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে সে উৎকর্ণ হল। সোজা হয়ে দাড়িয়ে দৌড় দেয়ার মনস্থ করল। কিন্তু ততক্ষণে একজন লোক বাতি হাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল। এতে সে ঘাবড়ে গেলে লোকটি অভয় দিয়ে মুচকী হেসে বলল, আরে বন্ধু! এ কাজ তো একা করা যায় না। আমাকে সাথে নিলে অনেক সুবিধা হবে ।
একথা বলে সে বাতিটিও নিভিয়ে দিল। তারপর চোরকে লক্ষ্য করে বলল, ভাই! তুমি দেখছি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। একটু বিশ্রাম নাও তুমি । আমি খুঁজে দেখি কোন খাবার পাওয়া যায় কি না । এতে তোমার ক্লান্তি দূর হবে। এরপর আমরা দুজনে মিলে এ কাজ সমাধা করব। আর শোন- এ বাড়ীতে আমার জানামতে আর কেউ নেই । সুতরাং তোমার ভয় পাওয়ারও কোন কারণ নেই । এতটুকু বলে লোকটি চলে গেল ।
এবার ইবনে সাবাত ভাবতে লাগল, লোকটি আবার এ বাড়ীর মালিক নয়তো? সে আমার সাথে কোন চালাকী করছে না তো? এমনও তো হতে পারে যে, সে আমাকে বসিয়ে লোক ডাকতে গেছে । কিংবা আমাকে মারার জন্য হাতিয়ার তালাশ করতে গেছে। সুতরাং আমার এখান থেকে এক্ষুনিই কেটে পড়া উচিত ।
এতটুকু চিন্তা করে সে এক কদম এগুতেই লোকটি এক পেয়ালা দুধ হাতে সেখানে এসে উপস্থিত হল। সে পেয়ালাটি চোরের হাতে দিয়ে বলল, নাও ভাই! এই দুধটুকু পান করে নাও। এতে তোমার ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে ।
লোকটির কথা শুনে চোরের মনে স্বস্তি ফিরে এল। সে তার হাত থেকে পেয়ালাটি নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু দুধ সাবাড় করে ফেলল। তারপর ভাবতে লাগল, হয়ত সেও আমার মত একজন চোর । আমি আগে মালপত্র গুছিয়ে ফেলেছি বিধায় সে এতে ভাগ বসানোর জন্যই আমাকে এতটা আদর আপ্যায়ন করছে ।
একথা মনে আসতেই সে লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, মনে হয় তুমি আমি একই পথের যাত্রী। একই বিদ্যায় উভয়ে পারদর্শী। তবে শুনে রেখ, আজকে তোমার কোন আশাই পূর্ণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সুতরাং তুমি যদি মালে ভাগ বসানোর আশায় বসে থাক তবে সে আশা আশাই থেকে যাবে। পূরণ হবে না কখনো। অবশ্য ভবিষ্যতে যদি তুমি আমার সাথে কাজ কর তবে যা মাল পাব তা ফিফটি ফিফটি করে ভাগ করে নেব, আজকে কিন্তু ভাগ নেয়ার অপেক্ষায় থেকো না । কারণ আজকে এখানে আমি আগে এসেছি এবং কাজও প্রায় সেরে ফেলেছি।
লোকটি তার একথা শুনে বলল, ঠিক আছে আগামীতেই আমি আপনার সাথে কাজ করব। আজ আপনি যা ভাল মনে করেন তাই হবে। এখন জলদি কাজ সারা প্রয়োজন। দেরী করলে ধরা পড়ার আশংকা আছে। একথা বলে লোকটি নিজেই দুটি গাট্টি বাধল। তন্মধ্যে একটি ছোট একটি বড়। সে ছোট গাট্টিটি চোরের মাথায় উঠিয়ে দিয়ে নিজে বড় গাট্টিটি মাথায় নিল। অতঃপর বাড়ী থেকে চুপিসারে বের হয়ে তারা উভয়েই একদিকে রওয়ানা করল ।
অপরিচিত লোকটি বোঝা বহনে অভ্যস্থ ছিল না। তাছাড়া তার বোঝাটি অপর বোঝার তুলনায় বেশ বড়ও বটে। ফলে বাধ্য হয়েই তাকে আস্তে আস্তে চলতে হচ্ছিল ।
লোকটির এই মন্থর গতিতে চলা ইবনে সাবাতের মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। সে কয়েকবার তাকে তাড়াতাড়ি হাটার জন্য ধমক দিল। ধমক খেয়ে লোকটি একটু দ্রুত হাটার চেষ্টা করল। কিন্তু সামান্য পথ অগ্রসর হওয়ার পরই তার গতি পূর্বের ন্যায় স্লো হয়ে গেল। এতে ইবনে সাবাত রাগতঃ স্বরে বকতে বকতে তাকে জোড়ে একটি ধাক্কা মেরে বলল, লোভী কোথাকার! চুরি করতে এসেছিস্ অথচ বোঝা বহন করতে পারিস না ।
নিতে না পারলে এত বড় গাট্টি বাধলে কেন?
লোকটি এতই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ছিলো যে, সে কোন জবাব দিতেও সক্ষম ছিলো না। তারপরেও সে চুপচাপ আরেকটু জোরে হাটার আপ্রাণ চেষ্টা করল ।
কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর পথে একটি পুল পড়ল। পুলের উভয় পার্শ্ব ছিল অনেকটা ঢালু। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকটি পুলে উঠার সময় দূর্বলতার কারণে বিশাল বোঝা নিয়ে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারল না। ফলে বোঝাটি মাথা থেকে নীচে পড়ে গেল। বোঝাকে রক্ষা করতে গিয়ে সে নিজেই বোঝার উপর আছড়ে পড়ল। এতে ইবনে সাবাত ক্রোধে লাল হয়ে তার গায়ে একটি প্রচন্ড লাথি বসিয়ে দিল। বলল, বর্বর কোথাকার! পারবে না তো এত বড় বোঝা বানিয়েছ কেন?
লোকটি জবাবে বিনয়ের সাথে বলল, ভাই! আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। এজন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। একথা বলে অসহায়ের মত হাঁপাতে হাঁপাতে অনেক কষ্ট করে পুনরায় বোঝাটি মাথায় উঠিয়ে আবার চলতে শুরু করল ।
অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়ায় লোকটির দেহ কাঁপছিল । সোজা হয়ে হাটতে পারছিল না সে। তারপরেও ইবনে সাবাতের অশ্লীল বকুনী ও মারধরের ভয়ে সে দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দাঁত কামড়িয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। এভাবে চলতে চলতে এক সময় তারা শহর অতিক্রম করে একটি বিরান জঙ্গলে এসে পৌঁছল ।
জঙ্গলের মাঝামাঝি গিয়ে ইবনে সাবাত দাঁত কটমট করে ব্যাঙ্গ স্বরে বলল, থাম্ বেটা! আর যেতে হবে না তোর। সারাটা পথ তুই আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছিস। বয়সে দেখা যায় তুই আমার অনেক বড় হবি। নইলে তোর আজ রক্ষে ছিল না । যা হোক তুই তোর পথ ধর । কোথায় যাবি যা । তোর আর এখানে কোন কাজ নেই ।
লোকটি ভীষণ কাঁপছিল । শীতের রাত্রি হওয়ায় পথ চলার সময় শীত ততটা অনুভব না হলেও এখন প্রচন্ড শীতে তার দাতগুলো ঠক্ ঠক্ করছিল। ইবনে সাবাতের কথা শুনে সে একটু এগিয়ে গিয়ে তার সাথে বিদায়ী মোসাফাহা করল এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল, ভাই! আপনার কাজে আমার যথেষ্ট ত্রুটি হয়ে গেছে। ফলে আপনার সীমাহীন কষ্ট হয়েছে। আপনি দয়া করে আমায় মাফ করে দিন। বলে লোকটি আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল ।
ইবনে সাবাত ছিল অত্যন্ত লোভী। লোকটিকে ভাগ দিতে তার মন চাইছিল না। কিন্তু তা সত্বেও অপরিচিত লোকটির কথায় সে বেশ প্রভাবিত হল । ভাবল এতো দেখছি আশ্চর্য রকমের চোর । এমন ভাল চোর তো জীবনেও দেখিনি আমি। সে এতো কষ্ট করল, অথচ কিছু না নিয়েই চলে যাচ্ছে। সে আমার নিকট কিছুই চাইল না। কথাগুলো চিন্তা করতেই ইবনে সাবাতের মানবতাবোধ কিছুটা জাগ্রত হল ।
ইবনে সাবাত লোকটিকে পুনারায় ডাকল। বলল, আরে! তুমি কি তোমার ভাগ নেবে না?
লোকটি বলল, ভাই! আমাকে কোন অংশ দিতে হবে না। অংশের কোন প্রয়োজনও নেই আমার। আপনি আমার মেহমান ছিলেন । সাধ্যমত আমি আপনার খেদমত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। তবে বাস্তব সত্য হল, আমি আপনার তেমন কোন খেদমত করতে পারিনি। আশা করি এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ।
ইবনে সাবাত হতভম্ব হয়ে লোকটির মুখপানে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থেকে কোন কথা সরল না । ভাবছিল সে ।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর সে বলল, তাহলে কি তুমিই ওই বাড়ীর মালিক? তুমিই কি সেখানকার প্রধান কর্তা?
লোকটি বলল, জ্বী ভাই, ওটা আমারই গরীবালয়। এখন তো আপনি চিনতে পারলেন । আপনার দাওয়াত রইল । আশা করি যখনই সুযোগ হবে তখনই আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসবেন। আমি যথাসাধ্য আপনার খেদমত করার চেষ্টা করব । একথা বলে লোকটি সালাম দিয়ে চলে গেল ।
লোকটির গমন পথের দিকে ইবনে সাবাত অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইল। কথা বলার ভাষাও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। চিন্তা সাগরের অতল গহবরে হারিয়ে গেল সে। হঠাৎ অনেকটা আনমেই অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল-
এ কেমন আশ্চর্য মানব ।
চোরের সাথে এমন উত্তম আচরণ।
আবার ভবিষ্যতের জন্য সবিনয় দাওয়াত !!
নিজের দীনতা ও বিনয়ের এ কেমন অদ্ভুত নযীর!!!
রাস্তায় আমি তাকে কত গালমন্দ করলাম। ধমক দিলাম । ধাক্কা মারলাম। প্রচন্ড লাথির আঘাতে জর্জরিত করলাম। এতদসত্ত্বেও সে আমাকে সীমাহীন ভদ্রতা ও অপূর্ব বিনয়ের সাথে বলল, আমার ত্রুটি হয়ে গেছে। আমায় ক্ষমা করে দিন। এতো কোন মানুষের আচরণ হতে পারে না । সে ফেরেশতা কিংবা অন্য কিছু হবে ।
গভীর রাত থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল সে। এক অদ্ভুত অনুশোচনা তার ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। বারবার মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, হায়! আমি একি দেখলাম । হায়! আমি একি শুনলাম । হায়! আমি এ কি করলাম ।
এভাবে চিন্তা করতে করতে তার মনের মধ্যে এক অভাবনীয় অবস্থার সৃষ্টি হল । ফলে চুরি করার মালামাল লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করল না সে। ধরা পড়ার কোন ভীতিও সৃষ্টি হল না তার মাঝে ।
তার মনের গহীন কোনে সৃষ্টি হল এক ব্যতিক্রমধর্মী বিপ্লব, অন্তরে সৃষ্টি হল এক অদ্ভুত জ্বালা। সার্বক্ষণিক অস্থিরতা অনুভব করতে লাগল সে।
ইবনে সাবাত নিজের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করল। লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় তার মস্তক আপনা-আপনি অবনত হয়ে এল । ভাবল, আহা! যদি এ মহৎ সদাচরণকারী লোকটিকে আবার দুচোখ ভরে দেখতে পারতাম। হায়, যদি তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারতাম, এত সুন্দর ও উত্তম আচরণ কিভাবে, কোত্থেকে শিখলেন তিনি! হায়, যদি তার সংস্পর্শে আজীবন কাটাতে পারতাম!
কথাগুলো ভাবতে না ভাবতেই সে সমস্ত মালামাল আপন স্থানে রেখে ঐ বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিল। হাজারো জিজ্ঞাসা আর এক বুক কৌতুহল নিয়ে সে সম্মুখপানে এগিয়ে চলছে। লোকটির সাথে সাক্ষাত করার এক অদম্য স্পৃহা তার চলার গতিকে ক্রমান্বয়ে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সে লোকটির বাড়ীর কাছে এসে পৌঁছল । পাশেই এক ঝুপড়ীর আড়ালে এক কাঠুরিয়াকে দেখতে পেয়ে সে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা ভাই! ঐ সামনের বাড়ীটি কার? আপনি কি তার নাম বলতে পারেন?
কাঠুরিয়া প্রসিদ্ধ চোর ইবনে সাবাতকে আগেই চিনত। তাই ইবনে সাবাতের প্রশ্ন শুনে মনে মনে ভাবল, এটা তো আমাদের বড় হুজুরের বাড়ী। এ চোরা আবার হুজুরের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? সে আবার হুজুরের কোন ক্ষতি করবে না তো? আল্লাহ তাকে হেফাযত করুন ।
কাঠুরিয়া কোন কথা বলছে না দেখে ইবনে সাবাত আবারও জিজ্ঞেস করল, ভাই না জানা থাকলে বলুন জানি না। চুপ হয়ে বসে থাকার তো কোন মানে নেই ।
কাঠুরিয়া বলল, এ বাড়ীর মালিক তো বাগদাদের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ । আপনি কোত্থেকে এসেছেন যে, এত বড় বুযুর্গের নামটি পর্যন্ত আপনার জানা নেই । আর আপনার তা জানবার দরকারই বা কি?
ইবনে সাবাত এবার রাগ হয়ে গেল । তার চেহারায় ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল । বলল সে রাগত স্বরেই- মিয়া! এত কথা বলছ কেন? যা জিজ্ঞেস করছি জটপট এর উত্তর দাও। নইলে….।
: নইলে আবার কি? তোমাকে আমি ভয় পাই নাকি? সুন্দর করে কথা বলতে শিখ ।
: ঠিক আছে। সুন্দর করেই বললাম। এবার বলে দাও ঐ বাড়ীর মালিকের নাম কি?
: এ বাড়ীর মালিক হযরত জোনায়েদ বোগদাদী । তিনিই বাগদাদের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ।
জোনায়েদ বোগদাদী (র.) এর নাম ইবনে সাবাত অনেক শুনেছে। তিনি যে একজন মহান বুযুর্গ তাও সে জানে। কিন্তু তার বাড়ী সে চিনতো না । চিনার চেষ্টাও করেনি কোন দিন। চোরের কাজ চুরি করা। এসব বুযুর্গ সাধকদের খোঁজ নেয়া তাদের প্রয়োজনই বা কি?
হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (র.) এর নাম শুনার সাথে সাথে ইবনে সাবাতের মাথা প্রচন্ড বেগে চক্কর খেল। ভাবল, তাহলে কি আমি এত বড় আল্লাহর অলীর বাড়ীতে চুরি করতে এসেছিলাম? যিনি এত বড় কাপড়ের বোঝা বহন করে জংগল পর্যন্ত দিয়ে এলেন তিনিই কি তাহলে এই মহান বুযুর্গ? যাকে আমি ধমক দিলাম, লাথি মারলাম তিনি কি সেই আল্লাহর অলী?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তার দুচোঁখে নামল অশ্রুর বন্যা। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে কাঠুরিয়ার কাছ থেকে দ্রুত প্রস্থান করল সে। তারপর এক মুহূর্তও দেরী না করে সোজা গিয়ে হযরত জোনায়েদ বোগদাদীর ঘরে প্রবেশ করল ।
গত রাতে ইবনে সাবাত যে কক্ষ থেকে কাপড় চুরি করেছিল আজও সে ঐ কক্ষেই প্রবেশ করল। দেখল, কাপড়ের বোঝা বহনকারী লোকটি ঐ কক্ষেই বসা আছেন। আশে পাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, ইনিই হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (রা.)।
হযরত জোনায়েদ বোগদাদীর চেহারায় তখন ঈমানের নূর ঝলমল করছিল। তার চেহারার সর্বত্র যেনো স্বগীয় এক আলোকচ্ছটা খেলাধুলা করছিল। খোদার প্রেমে ভরপুর উজ্জ্বল দুখানা চোখ থেকে তখন হিদায়েতের নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তার রোব তথা ভক্তি প্রযুক্ত ভয়ে উপস্থিত লোকজন নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে অত্যন্ত নম্রতার সাথে কথা- বার্তা বলছিল ।
ইবনে সাবাত কক্ষে প্রবেশ করে বেশীক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এক সময় সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হযরত জোনায়েদ বোগদাদীর পায়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সকলেই হতবাক হয়ে গেল। হঠাৎ কেন এমন হলো কেউ তা বুঝতে পারল না। সকলেই অপলক নেত্রে ইবনে সাবাতের মুখ পানে তাকিয়ে রইল। তার দুচোখ বেয়ে তখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগল ৷
হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (র.) স্বস্নেহে তার মাথায় হাত রাখলেন । তারপর ধীরে ধীরে মাথা উপরে তুলে বললেন, ভাই! মানুষতো কেবল মহান আল্লাহর দরবারেই মাথানত করতে পারে। আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নোয়ানো ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয় । যা হোক, এবার বলো, তুমি কি জন্যে এসেছ?
ইবনে সাবাত কিছু বলতে যেয়ে আবারও কেঁদে ফেলল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, হুজুর! আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। অনেক অবিচার করেছি আপনার প্রতি। সীমাহীন বেয়াদবী করেছি আমি । মেহেরবানী করে আমায় ক্ষমা করে দিন । না হয় ইবনে সাবাতের ধ্বংস অনিবার্য ।
হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (র.) বললেন, বাবা! তুমি তো কোন অন্যায় করনি। আমি নিজ দায়িত্ব পালনে কিছুটা ত্রুটি করেছিলাম এজন্য তুমি আমাকে কিছুটা সতর্ক করেছ মাত্র। এতে আমি কিছুই মনে করিনি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন ।
ইতিমধ্যে ইবনে সাবাতের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন এসে গেছে। আলোচ্য ঘটনার মাধ্যমে সে এক নতুন জগতের সন্ধান পেল । মহা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো তার হৃদয় মন ।
অবশেষে হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (র.) এর নিকট বাইআতের আবেদন জানালে তিনি তাকে বাইআত করে নেন। অতঃপর তাকে কিছু উপদেশ দিয়ে সেদিনের মতো তাকে বিদায় করেন ।
এরপর থেকে ইবনে সাবাত আপন শায়েখের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে লাগল । অপরিসীম ত্যাগ ও রিয়াযত মোজাহাদার মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি হযরত বোগদাদী (র.) এর বিশিষ্ট মুরীদদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলেন। অবশেষে এক পর্যায়ে তার নাম ইতিহাসের সোনালী পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হল। একজন প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র তার নাম ছড়িয়ে পড়লো । হাজারো মানুষ তার হাতে দীক্ষা নিয়ে সত্য-সুন্দরের পথে চলতে শুরু করল ।
এভাবেই আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গ ও সৎলোকগণ নিজেদের সুমধুর আচরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন। মাটির মানুষ গোমরাহী, ভ্রষ্টতা আর পাপ-পংকিলতা থেকে মুক্তি পেয়ে পরিণত হয় সোনার মানুষে ।
শত্রু-বন্ধু সকলের সাথেই সদাচরণ করব- এই প্রতিজ্ঞাই হোক আলোচ্য ঘটনার মূল শিক্ষা। (সূত্রঃ বেহেশতী হুর)
লেখক: মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের যে গল্পে অশ্রু ঝরে – হৃদয় গলে সিরিজ ৮ থেকে সংগ্রহিত।
Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.