এমন সন্তানের পিতা যেন কেউ না হন

এটি একজন বাবার কষ্টের গল্প। সম্মানিত লেখক গল্পটিকে সত্যি ঘটনা হিসাবে তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি অনেক আগের হলেও আজকের দিনের সাথে মিলে যাচ্ছে। লেখকের সাথে আমাদেরও চাওয়া, এমন সন্তানের পিতা যেন কেউ না হন। তাহলে চলুন এক হৃদয়হীন সন্তানের পিতার কষ্টের গল্প’টি পড়ি এবং শিক্ষা গ্রহণ করি!

এমন সন্তানের পিতা যেন কেউ না হন (এক বাবার কষ্টের গল্প)

বাবার কষ্টের গল্প

আমি এখন যে কাহিনী লিখতে বসেছি, আর দশটি কাহিনীর মতো এটিও একটি সত্য কাহিনী। যে কাহিনী এক সময় দেশের কোনো এক এলাকার চেনা জানা মহলে কিংবদন্তীর মতো আলোচিত হত, সেই কাহিনী প্রথম যিনি শুনতেন, তিনি বিশ্বাস করতে চাইতেন না। শুনেই মন্তব্য করতেন -“এমন কি কখনো হতে পারে?” অবিশ্বাসের এই আবরণ অপসারিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে বিশ্বাসের শিকড় মেলত । এখনও যারা এ ঘটনা প্রথম শুনেন, তারাও সংশয়ে পড়েন, তারপর বিশ্বাস করেন। কারণ এখন তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করার মতো এমন বহু ঘটনা ঘটছে । জমানা অনেক বদলে গেছে ।

কাহিনীর মূল চরিত্রের নাম আব্দুল জাব্বার। প্রায় সফেদ দাড়ি, সুদর্শন চেহারা, হালকা-পাতলা গড়ন, মধ্যম উচ্চতার মানুষ। বৃটিশ আমলের এনট্রেন্স পাস। বয়স আনুমানিক ষাট-এর কাছাকাছি । এককালে তিনি স্থানীয় বাস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী ছিলেন। এলাকার প্রায় সবাই তাকে চিনতো ।

কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট আরো দু’ব্যক্তির নাম যথাক্রমে আরমান ও আফজাল । আফজাল সাহেব আরমানের সম্পর্কে দুলাভাই হন । আরমানের বয়স ১৬/১৭ হবে। চার বছর পূর্বে পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে এতিম হয়েছে। এজন্য সে পিতা-মাতার বয়সী কোনো দম্পতিকে দেখলেই হৃদয়ের গহীন কোণে তীব্র বেদনা অনুভব করেন ।

জাব্বার সাহেবের সঙ্গে আফজাল সাহেবের বন্ধুত্ব বেশ পুরনো। তাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথা সকলের মুখে মুখে। সেই সুবাদে জাব্বার সাহেব আরমানকেও চিনেন। তাকে দেখলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর- স্নেহ করেন । কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বাড়ির খোঁজ খবর নেন । আরমান বহু বার জাব্বার সাহেবের অফিসেও গিয়েছে।

জাব্বার সাহেবের অফিস সংলগ্ন ছিল একটি বিরাট মসজিদ । আজো সেই মসজিদটি আছে। রাস্তার কাছে মসজিদটি থাকার কারণে প্রতি ওয়াক্তের নামাজেই মুসল্লীদের বিপুল সমাগম ঘটতো। আরমান প্রায়ই ঐ মসজিদে নামাজ পড়ে ৷

একদিনের ঘটনা। আরমান সবেমাত্র আছরের নামাজ শেষ করেছে। মসজিদে মুসল্লীদের কোনো ভীড় নেই । কেননা মসজিদের নিয়মিত জামাত সমাপ্ত হয়েছে বহু আগেই। আরমান দোয়া শেষে যেই বের হওয়ার জন্য বাইরে পা বাড়িয়েছে ঠিক এমন সময় একটি পরিচিত কন্ঠের আওয়াজ তাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। সে দেখল জাব্বার সাহেব তাকে নাম ধরে ডেকে কাছে আসার আহবান জানাচ্ছেন ।

আরমান জাব্বার সাহেবের ডাক শুনার সাথে সাথে দ্রুত তার নিকট উপস্থিত হয়ে সালাম দিল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। জাব্বার সাহেবও পূর্বের অভ্যাস মতো তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। অত:পর কোনো ভূমিকা ছাড়াই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন-

আচ্ছা আরমান! তোমাকে জিজ্ঞেস করি, তোমার পিতার চেয়ে সুন্দর, শিক্ষিত, মূল্যবান পোষাকে সুসজ্জিত ঠিক তোমার পিতার বয়সী কোনো লোক দেখলে কি তোমার পিতার সঙ্গে তাকে তুলনা করে নিজের পিতাকে নিকৃষ্ট মনে করবে?

: না, কখনো না। তাঁর কথার আগাগোড়া না বুঝেই আরমান জবাব দিল ।

: তোমার পিতার চেয়ে যদি তুমি অধিক বিদ্বান হয়ে যাও, অনেক বড় চাকুরি পাও এবং তোমার পদটা যদি হয় ঈর্ষণীয়; আর তোমার পিতা যদি লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পড়ে তোমার মায়ের হাতের বানানো পিঠা নিয়ে তোমার বাসায় বেড়াতে আসেন, তাহলে কি তুমি বাসার লোকজনকে এই বলে পরিচয় দেবে যে, এই লোকটি তোমার গ্রামের মানুষ?

: অবশ্যই না । কিন্তু আমার তো পিতা নেই ৷

: না থাক তোমার পিতা। আমি তো জানি তোমার পিতা নেই । সকলের তো পিতা থাকে না। চাচা, মামা, খালু, ফুফা, ভাই তো তোমার আছে। তারা তোমার বাসায় গেলে কি তাদের ‘গ্রামের মানুষ‘ বলে পরিচয় দেবে? তারা গরিব হওয়ার কারণে তুমি কি তাদের আসল পরিচয়টা গোপন রাখেবে?

: না, যার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সে পরিচয়ই দেব। আরমান জবাব দিল ।

: কিন্তু…..।

: কিন্তু বলে তিনি আর বলতে পারলেন না । একটা চাপা দীর্ঘ নিশ্বাস তার বুকের ভেতরটায় যেন সম্যক মন্থন করে দুমড়িয়ে-নিংড়িয়ে বের হয়ে এলো । নিদারুণ নৈরাশ্যে তার ব্যথা-ভারাক্রান্ত অন্তর ভেঙ্গে চুরে খান খান হয়ে গেল । তার নয়ন পথে অঝোরে নেমে এলো বাঁধন হারা অশ্রুধারা ।

এরপর তিনি ছোট্ট শিশুটির মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আরও কিছুক্ষণ কাঁদলেন । তারপর ক্রন্দনরত অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হয়ে পড়লেন । কেন এই জিজ্ঞাসা, কেন এই ক্রন্দন এর কিছুই বুঝল না আরমান । কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে সে তাঁর চলে যাওয়ার দৃশ্যই শুধু দেখল ।

বেশ কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে থেকে এক সময় আরমান বাসায় ফিরল। মনটা তার ভীষণ খারাপ। কোনো কাজেই মন বসছেনা তার। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর দুলাভাই আফজাল সাহেবের নিকট পুরো ঘটনা বর্ণনা করল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি ঘটনা শুনে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো কথা বলছেন না । তার চোখ দু’টো ক্রমেই অশ্রু সজল হয়ে উঠছে। এমন কি দু’ফোটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়তেও দেখা গেল ।

আরমানের কাহিনী বলা যখন শেষ, তখন দুলাভাই একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন-বন্ধু আব্দুল জাব্বার কম দুঃখে কাঁদেনি। এ কান্নার ইতিহাস আছে। বড়ই করুন সেই ইতিহাস । শুনবে তুমি সেই ইতিহাস?

আরমান বলল অবশ্যই শুনব। এ কথা বলে সে একটু নড়েচড়ে বসল ।

জাব্বার সাহেবের একমাত্র ছেলে মানিক। আফজাল সাহেব বলতে শুরু করলেন । আসল নাম আমি জানি না। মানিককে ঘিরে তিনি নানা স্বপ্ন দেখতেন। স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে এই তিন জনের ছোট্ট সংসার। জাব্বার সাহেবের আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না । পিতার রেখে যাওয়া যে সম্পত্তি তিনি ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছিলেন তা বর্গা দিয়ে মোটামুটিভাবে সংসার চলতো ৷

মানিক পড়াশুনায় খুব ভাল। সে মেট্রিক পরীক্ষার চমৎকার রেজাল্ট করে। এতে জাব্বার সাহেবের কি যে আনন্দ! সে দৃশ্য না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি শপথ নিলেন, যে করেই হোক ছেলেকে অনেক বড় বিদ্বান বানাবেন। এ যেন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হল । শেষ পর্যন্ত সত্যি-সত্যিই তিনি জায়গা জমি যা ছিল তার প্রায় শেষ করে মানিককে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও এম.এ পাশ করিয়ে আনেন। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর মানিক একটা ভাল চাকুরি পায়। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। আন্দোলন চলছে সর্বত্র। তার চাকুরি পাওয়ার সম্ভবত এক বছর পর দেশ ভাগ হয়। মানিক প্রথমে শিলং পরে করাচী ও সর্বশেষে ঢাকায় বদলী হয়ে আসে।

তারপর কি হলো? দারুণ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল আরমান। দুলাভাই আফজাল সাহেব এবারও আরেকটি দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন-

মানিক ঢাকায় বদলী হয়ে আসার পর কিভাবে কার পরামর্শে যেন এক বিত্তবান পরিবারের উচ্চ শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, মা-বাবাকে তার বিয়ের খবরটা পর্যন্ত জানায় নি । শুনেছি বিয়ের আলাপের সময় তার ভাবী শ্বশুর তার পিতা-মাতার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত আলাপ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মানিক নাকি তার শ্বশুরকে দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছিল, তার পিতা জীবিত নেই। বহু আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন ।

আর মায়ের ব্যাপারে বলেছিল, তিনি অসুস্থ এবং খুবই দুর্বল। বৃদ্ধ বয়সে এই শরীর নিয়ে ঢাকায় আসা সম্ভবও নয়। এ কথা শুনার পর মানিকের শ্বশুর-শ্বাশুরী আর এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন নি। তারা মনে করলেন এমন তো হতেই পারে। এ পৃথিবীতে অমর তো কেউ নয় । সুতরাং এ বিষয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । অবশেষে বিয়ের আয়োজন চলে ।

যথারীতি একদিন বিয়েও সম্পন্ন হয়। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঘুর্ণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেন নি যে, জামাই বাবাজি তার পিতাকে জিন্দা রেখেই মৃত বলে ঘোষণা করেছেন ।

বিয়ের পর মানিক পিতার নিকট পত্র লিখে। পত্রের মূল কথা ছিল “সরকারি নির্দেশে দু’একদিনের মধ্যেই সে করাচী চলে যাচ্ছে। সময় নেই, তাই দেখা করতে পারছে না। ছুটি নিয়ে দু’তিন মাস পর বাড়ি আসবে।”

সত্যিই কি তিনি করাচী চলে যান? কথার মাঝখান দিয়ে আরমান প্রশ্ন করল।

‘বিলকুল ধাপ্পা । বদলীর জরুরি সরকারি নির্দেশ তার বানোয়াটি কথা । বিবাহোত্তর জীবন নির্বিবাদে ভোগ করার জন্য এটা ছিল তার একটা ফন্দি মাত্র।’ আফজাল সাহেব জবাব দিলেন ।

মানিকের চিঠি পেয়ে তার পিতা-মাতা খুব একটা মন খারাপ করেন নি । ভাবলেন, এখন না হয় আগের তুলানায় একটু দূরে গেছে। দু’ তিন মাস পর তো ফিরে আসবেই। অবশ্য এজন্য তারা সরকারকে কিছুটা দোষারোপ করেছেন। কারণ সরকার তো ইচ্ছে করলে পিতা-মাতাকে দেখে যাওয়ার জন্য দু’ চার দিন সময় দিতে পারতেন।

এই পত্র পাওয়ার পর প্রায় দেড়-দু’মাস অতিবাহিত হয়ে গেল । জাব্বার সাহেব আর কোনো পত্র মানিক থেকে পান নি। মানিকের করাচীর ঠিকানা (!) না জানায় তিনিও পত্র খিলতে পারেন নি। ফলে পিতা-মাতা উভয়েই রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েন।

এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক দিন। জাব্বার সাহেব ও মানিকের আম্মার চিন্তা-পেরেশানী ক্রমেই বাড়তে থাকে। ছেলের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায় এ নিয়ে তারা চেষ্টা ফিকির করছেন। কিন্তু কিছুই করা হলো না ।

একদিন জাব্বার সাহেব বিষন্ন মনে বসে আছেন। এমন সময় এক ভদ্র লোকের সাথে তার সাক্ষাত ঘটল । ভদ্র লোক ঢাকায় থাকেন । ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। এক সপ্তাহের ছুটি। তন্মধ্যে তিন দিন কেটে গেছে । মানিকের অফিসেই এই ভদ্র লোক চাকরি করেন ৷

লোকটি প্রথমে প্রাথমিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তারপর অপরাধীর মতো বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। আসার সময় সাহেবকে বলে আসিনি। তবে তিনি ভাল আছেন। সরকার তাকে বিরাট এক বাসা দিয়েছে। সে বাসায়ই তিনি এখন থাকেন। বিয়ের কথাটা তিনি হয়তো জানতেন না । তাই সে কথা উত্থাপন করেন নি ।

জাব্বার সাহেব ভদ্র লোকের কথা শুনে অবাক! তার ছেলে থাকে করাচী, আর এই লোকটা বলছে ঢাকায়, ব্যাপারটা তাহলে কি? মানিকের চিঠি কি তাহলে মিথ্যা! নাকি এই লোকটিই মিথ্যা কথা বলছে? মানিক তো মিথ্যাবাদী নয়, মিথ্যা কথা সে লিখতে পারে না। হয়ত বদলীর অর্ডার হয়েছিল, আবার সে অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এ জন্য তার আর করাচী যাওয়া হয়নি। বদলা বদলীর চাকরি । অহরহ তো এ কারবারই চলে ।

জাব্বার সাহেব এ কথাগুলো বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও মনের মধ্যে উদিত একটি প্রশ্নের জবাব কিছুতেই মিলাতে পারছেন না। তার অন্তরে বারবার কেবল এ প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে যে, মানলাম বদলীর অর্ডার ক্যানসেল করা হয়েছে বা মুলতবি রাখা হয়েছে, কিন্তু গত দু’মাসের মধ্যে এ খবরটা জানাবার একটু সময়ও কি সে পায়নি? ফোনেও কি সে কথাটি জানাতে পারেনি?

জাব্বার সাহেব গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। সামনে দন্ডায়মান লোকটির কথা তিনি যেন ভুলেই গেছেন। লোকটি তাকে চিন্তিত দেখে বললেন, কি এমন ভাবছেন? খবর থাকলে বলে দিন অথবা একটি চিঠি লিখে দিন। আমি হাতে হাতে সাহেবের কাছে পৌঁছে দেব।

জাব্বার সাহেব বললেন না, চিঠি আর দিচ্ছি না। আমি নিজেই ঢাকা যাব। আপনি আমার আগে ঢাকা চলে গেলে তাকে বলবেন। তার মা ও আমি ভাল আছি ।

জী বলবো, এ কথা বলে একটি সালাম জানিয়ে ভদ্রলোক কেটে পড়লেন ।

জাব্বার সাহেব কোনো অবস্থাতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না । ব্যাপারটি তার নিকট কেমন যেন লাগছে । অবশেষে বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর কাছে বললেন, একজন লোকের মাধ্যমে জানতে পারলাম মানিক আবার ঢাকায় চলে এসেছে। আমি ঢাকায় গিয়ে তাকে দেখে আসি । মানিকের মা একথা শুনে তো মহাখুশি। স্বামীকে বললেন, আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করুন । ঢাকা যখন এসেছে তখন বাড়ি আসবে, না হয় একটি পত্র তো লিখবে । খবরটা ভাল করে জেনে নিন। ২/৪ দিনের মধ্যে কোনো চিঠিপত্র না পেলে ঢাকায়ই চলে যান। গিয়ে তাকে নিয়ে আসবেন। অনেক দিন হয় বাছাকে দেখিনি ।

স্ত্রীর কথায় জাব্বার সাহেব কয়েকদিন অপেক্ষা করলেন । কিন্তু কোনো পত্র এলো না। এরই মধ্যে অন্য এক মাধ্যম থেকে জানতে পারলেন, সরকারি একটি অনুষ্ঠানে মানিক বক্তৃতা দিয়েছে। সুতরাং মানিক যে এখন ঢাকায় আছে এ ব্যাপারে জাব্বার সাহেবের আর কোনো সংশয় রইল না। তাই এবার তিনি নিজেই ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্ত্রীকে বললেন, ছেলের জন্য কিছু পিঠা বানিয়ে দিও। মানিক কবে বাড়ি আসবে তা তো বলা যায় না । বড় চাকরি, কাজের চাপ, নতুন দেশ । দায়িত্ব তো অনেক ।

মানিকের মা ছেলের জন্য হরেক রকম পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরদিন নানা জাতের পিঠা দিয়ে একটি ব্যাগ ভর্তি করে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন আজই চলে যান। নিজ হাতে ছেলেকে খাইয়ে আসবেন। জাব্বার সাহেব বললেন-আজই যাচ্ছি। আরো একটা সংবাদ শুনলাম । মানিক নাকি বড় একটি সরকারি বাসা পেয়েছে। এত বড় বাসায় সে একা থাকবে কি করে? এত করে বললাম বাবা! তুমি একটা বিয়ে কর। কিন্তু সে শুনলো না ৷

মা বললেন, বাসা যখন পেয়েছে তখন বিয়েও করবে। বউমা নিয়ে আমিই সে বাসায় থাকবো । আমার মানিক কি পছন্দ করে, কি না করে না, তার স্বাস্থ্য কিভাবে কি করলে ভাল থাকবে এসব আমার চেয়ে বেশি কে জানে? আমি বউমাকে সব বুঝিয়ে দেব। আমি যেমন মানিককে নিজ হাতে গড়ে তুলেছি, তেমনি বউমাকেও নিজহাতে গড়বো সোহাগ আর শাসন দিয়ে।

জাব্বার সাহেব বললেন, ঠিক আছে! ইচ্ছে করলে আজই তুমি ছেলের কাছে যেতে পার । চল না আমার সঙ্গে ।

মানিকের মা আর কথা বলেন নি । শুধু একটি মিষ্টি হাসি স্বামীকে উপহার দিয়ে যাবার সময় বললেন, যাবো গো যাব । আল্লাহর হুকুম থাকলে সময় হলে অবশ্যই যাব। আর একটা কথা শুনুন, আপনি তো ছেলের বাসা চিনেন না। শুধু অফিসের ঠিকানা পেয়েছেন। তাই আগে অফিসে গিয়ে উঠবেন। অফিস থেকেই বাসার ঠিকানা নেবেন।

জাব্বার সাহবে বললেন, ঠিক আছে। আগে ঢাকা যাই। তারপর অবস্থা বুঝে যা করা দরকার করবো ।

জাব্বার সাহেব ট্রেন ধরবেন। সময় আর বেশি হাতে নেই । ব্যাগ হাতে নিয়ে দেখেন ওজন তো অনেক। তথাপি স্ত্রীকে কিছু বললেন না । শুধু মনে মনে ওজনের ব্যাখ্যাটা এভাবে করলেন – মায়ের মন, ছেলেকে কি দিলে, কি খাওয়ালে মায়ের মন ভরে, তা মাও জানে না ।

জাব্বার সাহেব অফিস হয়ে মানিকের বাসায় গিয়ে উঠলেন। তখন মানিক অফিসের পথে। সুতরাং পিতা পুত্রের সে সময় সাক্ষাত হয়নি। তিনি পিঠার ব্যাগটা কাজের ছেলের মাধ্যমে ভিতরে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর নাস্তা এলে তিনি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার পর্ব সেরে নিলেন। তার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমাচ্ছেন না । ছেলের সাথে দেখা না হলে ঘুমই তার আসবে না। কখন যে মানিক আসে সেই অপেক্ষা-ই করছেন। এই অপেক্ষার সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য কাজের ছেলেটির সাথে আলাপ জুড়ে দেন তিনি। এক পর্যায়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, আপনি সাহেবের কি হন । রসিকতা করা জাব্বার সাহেবের একটি স্বভাব । তাই ঐ ছেলেটির সংগেও তা এস্তেমাল করতেও ভুলে যান নি। ছেলেটির প্রশ্নের জবাবে বললেন, তোমার সাহেবের আমি কি হই তা তুমি তোমার সাহেবের কাছ থেকেই জেনে নিও। কাজের মেয়েটিও একই প্রশ্ন করেছে। কিন্তু রসিকতা করে একই জবাব দিয়েছেন তিনি ৷

ছেলেটির সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জাব্বার সাহেব বললেন, আমার জন্য নাস্তা কি হোটেল থেকে কিনেছ?

: হোটেল থেকে আনতে যাব কেন? বেগম সাহেবইতো বানিয়েছেন । ছেলেটির সাদামাটা জবাব ।

: তুমি বেগম সাহেব কাকে বলছো? বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন জাব্বার সাহেব ।

: আর কাকে বলবো। আমাদের বেগম সাহেবকেই তো বেগম সাহেব বলছি। আপনি বুঝলেন না? আপনি যার জন্য পিঠা নিয়ে এসেছেন সেই সাহেবের স্ত্রী। সাহেব দু’মাস আগে বিয়ে করেছেন । আপনি তার গ্রামের মানুষ। সাহেবের বিয়ের খবরটাও জানেন না? আপনাকে বুঝি সাহেব দাওয়াত দেন নি। সাহেবের বাপ তো নেই, তা না হলে নিশ্চয়ই জানতেন ।

ছেলেটির কথায় জাব্বার সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন । তিনি মনে মনে বললেন-ছেলেটি বলছে কি? “বেগম সাহেবা” “সাহেবের বাপ নেই” এসবের অর্থ কি? আমি কি তাহলে অন্য বাসায় প্রবেশ করে পিঠার ব্যাগটা হারালাম?

জাব্বার সাহেবের মনে নানা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। একে একে তিনি দারোয়ান, কাজের ঝি ও বাগানের মালীকে নানা প্রশ্ন করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন যে, তিনি বাসার ঠিকানা ভুল করেন নি। এসব চাকর-বাকর মানিকেরই এবং মানিক দু’মাস আগেই বিয়ে করেছে। সুতরাং ছেলেটি ভুল বলেনি। ‘সাহেবের বাপ নেই’ -এটা হয়তো তার বানানো কথা । আমাকে কখনো আসতে দেখেনি তো তাই একথা ছেলেটি বানিয়ে বলেছে ।

বিয়ের কথা শুনে জাব্বার সাহেব বুকের কোথাও যেন প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলেন। ভাবলেন, মানিক তাহলে এখন বিবাহিত? তাও প্রায় দু’মাস আগে? বাসায় এখন তার বউ? করাচীর বদলীর চিঠি তাহলে ভুয়া? এত বাহানার কি প্রয়োজন ছিল মানিক! বিয়ে করবি তো কর, নিষেধ তো করিনি, অনুমতি তো আগেই দিয়ে রেখেছি। শুধু তোর বিয়ের আগে খবরটা জানাতে বলেছিলাম, তোর বিয়ের মুরব্বী হতে চেয়েছিলাম । সেই প্রয়োজনও কি তুই বোধ করলি না? আমার কথা না হয় না-ই ভাবলি, তোর মায়ের কথাটা কি ভাবা তোর উচিত ছিল না?

জাব্বার সাহেব এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভাবনার আরেক জগতে প্রবেশ করলেন। নিজেকে প্রশ্ন করলেন, এত সব ভাবছি কেন? এসব ভেবে লাভটাই বা হবে কি? যা হবার তো হয়েই গেছে। তাছাড়া তেমন মন্দ হয়েছে কি? ভালই তো হায়েছে। ছেলে মানুষ তো! হয়ত বন্ধু- বান্ধবদের চাপে পড়ে বিয়ে করেছে। আমাদের জানাবার সময় সুযোগ বোধ হয় পায়নি । এজন্য লজ্জা পেয়েছে। কিসের লজ্জা? আমি তো এসে গেছি। বউমাকে বরণ করে নেব। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। জাব্বার সাহেব যখন এসব ভাবছিলেন তখন মানিক বাসায় ফিরে। সে বৈঠক খানায় পিতাকে একা দেখে অবাক হয়। এমন পরিস্থিতির জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তথাপি নিজেকে সামলে নিয়ে পিতাকে সালাম করল এবং কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। তারপর পিতা কিভাবে এখানে পৌঁছলেন তাও জিজ্ঞেস করে জেনে নিল ।

জাব্বার সাহেব এক পর্যায়ে পুত্রকে প্রশ্ন করলেন তুমি চিঠি লিখেছ যে, করাচী বদলী হয়ে যাচ্ছ অথচ লোক মুখে শুনতে পেলাম, তুমি নাকি ঢাকায় আছ। ব্যাপারটা কি? তা জানতে আসলাম ।

: বদলীর অর্ডার মুলতবি আছে । মানিকের সহজ সংক্ষিপ্ত উত্তর । : শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ? পিতার সরল জিজ্ঞাসা ।

: হ্যাঁ, হঠাৎ হয়ে গেল। তাই কাউকে জানাতে পারিনি। মানিকের জবাবে কোনো জড়তা নেই, আফসোসও নেই ৷

: ভালই হলো। বউমাকে দেখবো। জাব্বার সাহেবের সরল সম্মতি আর উদার ইচ্ছার প্রকাশ ।

: ঠিক আছে। দেখবেন তো অবশ্যই। এখানে বসুন বাসার ভিতরে গিয়ে দেখি, বাসার কি অবস্থা ।

মানিক ম্লান মুখে অন্দর মহলে প্রবেশ করতেই মানিকের স্ত্রী বললো, আপনাদের দেশ থেকে একজন বুড়ো লোক এসেছেন, বৈঠকখানায় আছেন। উনার সাথে আপনার দেখা হয়েছে তো? আজব এই লোকটা নিজের পরিচয় দিতে চায় না। শুধু বলে, তোমাদের সাহেব থেকেই আমার পরিচয়টা জেনে নিও। তিনি দেশ থেকে আমাদের জন্য ব্যাগ ভর্তি নানা জাতের পিঠা নিয়ে এসেছেন ।

মানিক সাহেব কি বললেন? আরমান তার দুলাভাই আফজাল সাহেবকে কথার মাঝে জিজ্ঞেস করল ।

মানিক বউকে হালকা একটা ধমক দিয়ে বলল, বাজে বক বক করো না। পরিচয় থাকলে তো পরিচয় দিবে। ইনি আমাদের গ্রামের মানুষ । ছোট বেলা থেকে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মা তাকে দিয়ে এই পিঠা পাঠিয়েছেন ।

: আপন পিতাকে তিনি গ্রামের মানুষ বলতে পারলেন? আরমান বিস্ময় ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ।

: হ্যাঁ , আপন পিতাকে মানিক গ্রামের মানুষ বলেই পরিচয় দিল। সে তার ইজ্জত-সম্মান ও সুনাম (!) রক্ষার্থে একজন সাধারণ বেশের গরিব লোককে পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও কুণ্ঠিত হল।

: তারপর কি ঘটলো? আরমানের পরবর্তী জিজ্ঞাসা ।

: কি আর ঘটবে। মানিক তো আর ভুল বলেনি! পিতা-পুত্র তো এক গ্রামের মানুষই হয় । স্নেহের কথা আর পিঠা পাঠানোর কথায়ও ভুল নেই । শুধু সাধারণ পরিচয়টা দিয়ে আসল পরিচয়টা ঢেকে রাখাটাই ছিল তার মস্ত বড় ভুল। আর এই ভুলই মানিকের জীবনের সবকিছুকে ভন্ডুল করে দিল ।

মানিক বেশিক্ষণ বাসায় থাকেনি। সে চাকর-বাকরকে একই পরিচয় দিয়ে যাওয়ার বেলায় বলে গেল, তোরা লোকটির প্রতি খেয়াল রাখিস।

দুপুরের খানাপিনা শেষে জাব্বার সাহেব একটু ঘুমিয়ে নিলেন। তারপর মসজিদ থেকে আসরের নামাজ পড়ে আবার বাসায় ফিরে চা- নাস্তার পর্ব শেষ করলেন। এ সময় চাকর ছেলেটি জাব্বার সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো, এইবার আপনাকে চিনলাম। আপনার যাতে কোনো কষ্ট বা অসুবিধা না হয় সেদিক খেয়াল রাখতে সাহেব আমাদের বলে গেছেন । আপনাকে কত ভালবাসেন আমাদের সাহেব!

: ভাল বাসবেই তো। জাব্বার সাহেবের সরল-সহজ স্বীকৃতি। এ ভালবাসা যে খোদার দান। আল্লাহর দেওয়া অধিকার। আল্লাহর গড়া একটি ব্যবস্থা মাত্র । বাপের হক ছেলে আদায় করে থাকে । জাব্বার সাহেব তার সরল স্বীকৃতি দিয়ে এ কথাই কাজের ছেলেকে বুঝিয়েছেন। ছেলেটি জাব্বার সাহেবের কথা বুঝল না । সে বললো –

-আপনি সাহেবের গেরামের মানুষ। সাহেবকে ছোট বেলা থেকে অনেক স্নেহ করতেন। সাহেবের পিতা নেই বলে আম্মা তাই আপনাকে দিয়েই পিঠা পাঠিয়েছেন ।

কাজের ছেলের মুখ থেকে একথা শুনে জাব্বার সাহেবের বাক রুদ্ধ হয়ে এলো । ছেলেটির কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি । বাসার ঝিকে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারলেন, মানিক তাকে গেরামের মানুষ পরিচয় ছাড়া আর কোনো পরিচয় দেয়নি। এতে তিনি আরো বেশি বেদনাহত হলেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, মানিক যখন তার বউকে এখনো দেখাল না, ঠিক আছে না-ই বা দেখলাম, তবে তার স্ত্রীর কাছে আমার পরিচয়টা কি দিয়েছে তা তো জানা দরকার ।

জাব্বার সাহেব মানিকের স্ত্রীর সাথে দেখা করলেন। কিন্তু বউমাকে ‘বউ মা’ বলে ডাকতে তার সাহস হল না। কারণ মানিক যদি বউমার নিকটও পিতাকে ‘গ্রামের মানুষ‘ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে ।

যা হোক জাব্বার সাহেব মানিকের স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে বুঝলেন, তার নিকটও তিনি এই পরিচয়েই পরিচিত করেছেন। বেচারীর কি দোষ। সে তো এসব জানত না। বরং সে জানে মানিকের বাপ নেই, চাচা নেই । একথা মানিকই বিয়ের আগে সকলকে জানিয়েছে।

জাব্বার সাহেব মানিকের স্ত্রীকে বললেন, বেগম সাহেবা! আপনি সাহেবকে বলবেন, তার গ্রামের বুড়ো লোকটি চলে গেছে। সাহেবকে স্নেহ করতাম, তাই দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, খাওয়া দাওয়া করেছি, প্রয়োজনীয় ঘুমও সেরে নিয়েছি। এখন ষ্টেশনের পথ ধরি। আস্সালামু আলাইকুম ।

মানিকের স্ত্রী বলল এসব আপনি কি বলছেন? সাহেব এসে যদি দেখেন আপনি চলে গেছেন তাহলে আমাদের উপর খুব রাগ করবেন। তাছাড়া আপনি তো আর সাহেবের পর নন, গ্রামের মানুষ । এতদূরের পথ পাড়ি। বৃদ্ধ বয়স। দুদিন তো থাকবেন। আমার শাশুরীর জন্য কিছু কেনাকাটা করব তা নিয়ে যাবেন ।

মানিকের বউ এসব কথা বলেও জাব্বার সাহেবকে আটকাতে পারল না। তিনি ঐ রাতেই ট্রেন চেপে বাড়ি আসলেন। ছেলের নতুন প্রেষ্টিজের দূর্গে পিতার প্রবেশ নিষেধ, পিতার নতুন পরিচয় ‘গ্রামের মানুষ’ এসব কথা তিনি মানিকের মাকে এসে বলেননি বরং ছেলের কুশল সংবাদই শুধু জানালেন । এমনকি বিয়ের খবরটাও গোপন রাখলেন । ঢাকা থেকে আসার পর একদিন আমার বাসায় এসে জাব্বার সাহেব গোটা কাহিনী বলেছিলেন । আর কেঁদেছিলেন শিশুর মতো । তাকে অনেক প্রবোধ দিয়েছি কিন্তু তিনি কোন প্রবোধই মানেন নি ।

যে ছেলেকে নিয়ে জাব্বার সাহেব এত স্বপ্ন দেখে ছিলেন, সে ছেলের এমন নির্মম ও অপমানকর আচরণ তিনি সহ্য করতে পারেন নি। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিল। মাঝে মাঝে খাপ ছাড়া কথা বলেন। কখনো হাসেন, কখনো কাঁদেন। আবার অনেক সময় সুস্থ লোকের মতোও কথা বলেন। বাস এসোসিয়েশন থেকে তার চাকরি এখনো যায়নি। হয়ত যাবেও না। সবাই তাঁর প্রতি সংবেদনশীল। অফিসে আসেন। যতক্ষণ কাজ করেন মনোযোগের সঙ্গেই করেন । যখন কাজ কর্মে মন বসেনা, তখন মসজিদে চলে যান। তুমিইতো দেখেছো তিনি মসজিদে বসে আছেন ।

– জাব্বার সাহেবের স্ত্রীর অবস্থা কেমন? আরমান জানতে চাইলো । এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আফজাল সাহেব আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস টানলেন । তারপর বললেন-

কেমন করে যেন ঘটনাটা মানিকের মার কানেও গেল । তিনি এ ঘটনা শুনে প্রথমে কিছুটা কান্নাকাটি করলেন । তারপর চুপ হয়ে গেলেন । শরীরটা ভেঙ্গে পড়লো। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শয্যা গ্রহণ করলেন। এই ছিল তার শেষ শয্যা। এ শয্যা থেকে তিনি আর উঠতে পারেন নি। পনের দিনের মধ্যেই ইন্তেকাল করেন ।

মায়ের মৃত্যুর সময় মানিক ঢাকায় ছিল না। যে করাচীর ধোঁকা দিয়ে নববধূকে নিয়ে পরম আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটানোর জন্য মানিক স্বীয় পিতা-মাতার নিকট মিথ্যে চিঠি লিখেছিল, মায়ের ইন্তেকালের সময় সেই করাচীতেই সে ছিল । মায়ের মুখ দেখার কপাল তার হয়নি।

এ ঘটনার কয়েকদিন পর থেকেই মানিকের পতন শুরু হয়। শুরু হয় আপন পিতাকে অপমান করার নির্মম পরিণতি। কথায় বলে- ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। মানিকের বেলায়ও এ সত্যটি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। সে এবার পদে পদে বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে উপরস্থ-অধিনস্থ সকলের দ্বারাই অপমানিত হতে লাগলো। যে মানিককে এককালে সবাই সমীহ করে চলতো, শ্রদ্ধা করতো, সে মানিকই আজ সকলের চক্ষুশূলে পরিণত হল । আজ কারো অন্তরেই মানিকের জন্য শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, নেই কোন দয়া-মায়া । কি এক অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে যেন সকলেই তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠল । সকলের মনেই জন্ম নিল ঘৃণা আর বিদ্বেষ ।

এ অবস্থা মানিকের সহ্য হয় না। তার সুন্দর-সুঠাম স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। কাজে কর্মে মন বসাতে পারে না। কোনো কিছুতেই ভাল লাগে না তার। জীবনকে দুর্বিসহ মনে হয়। সে এখন বুঝতে পারে, আপন পিতা-মাতাকে সীমাহীন কষ্ট দেওয়ার ফলেই তার এই চরম পরিণতি। এভাবে কয়েক বছর দুর্বিসহ জীবন যাপনের পর জীবনের প্রতি মানিকের চরম অনীহা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে চলাফেরা, উঠাবসা ও বেঁচে থাকাকে মনে হয় অর্থহীন-অসাড়। মনে হয় ভূ-পৃষ্ঠ যেন তার পদভার সইতেও নারাজ । এমনকি প্রিয়তম স্ত্রীর চোখেও সে আজ চরম ঘৃণিত এক নরঘাতক । কেননা বিশ্বস্তসূত্রে সেও ঘটনাটা জেনে গিয়েছিল ।

কিছুদিন পর এক মোটর দূর্ঘটনায় মানিক মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ। তবে এ রহস্য আজও উদ্‌ঘাটিত হয় নি যে, মানিকের এই মৃত্যু কি নিছক দূর্ঘটনা ছিল, নাকি এটি ছিল দুঃসহ জীবন অবসানের জন্য স্বেচ্ছায় জীবন দান-আত্মহত্যা ।

প্রিয় পাঠক! এই হলো জাব্বার সাহেবের কান্নার ইতিহাস। যাকে আপনারা বলতে পারেন লায়েক (!) সন্তানের প্রেষ্টিজ কাহিনীর মর্মান্তিক ইতিহাস । প্রাণভরে দোয়া করি, এমন মানিকদের পিতা যেন আল্লাহ পাক কোন জাব্বার সাহেবকে না করেন। পাশাপাশি ঐ শিক্ষা থেকেও আল্লাহর দরবারে পানাহ চাই- যে শিক্ষা জন্মদাতা পিতাকেও সঠিক পরিচয় দিতে বাধা দেয়। এমন শিক্ষায় শিক্ষিত ও বড় পদের চাকুরীজীবি থেকে মূর্খ ও কৃষক যুবক কি অধিকতর মহান নয়, যে তার পিতা-মাতাকে পরম ভালবাসায় আব্বা-আম্মা বলে ডাকে?

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিজের পিতার পরিচয় দিতে অনীহা বোধ করো না। কারণ যে ব্যক্তি নিজের পিতার পরিচয় দিতে অনিহা বোধ করল, সে কুফরি করল ।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের পিতা ছাড়া অন্য লোকদের নিজের পিতা বলে পরিচয় দেয়, অথচ সে জানে ঐ ব্যক্তি তার পিতা নয়, এমন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, আল্লাহ তা’আলা আপন ইচ্ছানুযায়ী সকল গুনাহ মার্জনা করেন, কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ মার্জনা করেন না। বরং এইরূপ পাপিষ্ঠকে তিনি মৃত্যুর পূর্বে পার্থিব জীবনে যথাশীঘ্র শাস্তি প্রদান করে থাকেন। – (বায়হাকী)

মুহতারাম পাঠক! এ পর্যায়ে আমাদের আরেকটি কথা খুব ভাল করে স্মরণ রাখা উচিত। তা হলো, সন্তান থেকে ভাল ব্যবহার পাওয়ার জন্য তাকে তো সেভাবে গড়ে তোলা পিতা-মাতারই অন্যতম দায়িত্ব । সন্তানকে শিষ্টাচার না শিখিয়ে, উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত না করে তার থেকে সুন্দর ব্যবহার আশা করার দৃষ্টান্ত তো ঠিক তেমন- যেমন কোনো ব্যক্তি তেতুল গাছ রোপণ করে মিষ্টি আম পাওয়ার আশা করে। অর্থাৎ তেতুল গাছ রোপণ করে যেমন মিষ্টি আমের আশা করাটা অমূলক ও হাস্যকর, ঠিক তেমনি সন্তানকে সদাচরণ শিক্ষা না দিয়ে, সুশাসন না করে, ধর্মীয় শিক্ষা না দিয়ে তার থেকে উত্তম আচরণের প্রত্যাশা করাটা চরম বোকামী বৈ কিছুই নয় ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পিতার উপর সন্তানের প্রথম দায়িত্ব হলো, সে আপন সন্তানের সুন্দর নাম রাখবে এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে । – (বায়হাকী)

সুন্দর নাম রাখার অর্থ হলো, নামটি চমৎকার অর্থবহ হওয়ার সাথে সাথে তাতে ফুটে উঠবে ধর্মীয় পরিচয়ও। নাম হবে ইসলামি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একজন প্রকৃত মুসলমান তার সন্তানের নাম কখনো মিন্টু, পিন্টু, স্বপ্না, রত্না, হাসি, জুটি, অনু, তনু ইত্যাদি রাখতে পারেন না । কেননা এসব নামের কোনো কোনোটির তো ভাল অর্থই নেই। আর যেগুলোর মোটামুটি অর্থ আছে, সেগুলোও এমন, যদ্বারা মুসলমানের পরিচয়টাও পাওয়া যায় না । অর্থাৎ নাম শুনে বুঝার কোনো উপায় নেই যে, সে কি মুসলমান? না অন্য ধর্মাবলম্বী? আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন ।

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ হাদিসের শেষাংশে বলেন, তোমরা নিজেরা পরিবারস্থ লোকদের জন্য সাধ্যনুযায়ী ব্যয় করবে এবং তাদের উপর থেকে কখনোই শাসনের লাঠি উঠিয়ে নিবে না । – (আহমদ)

শাসনের লাঠি না উঠানোর অর্থ হলো, ছেলে-মেয়ে ও পরিবারের অধিনস্থ লোকদের প্রতি উদাসীন না থাকা । যার ফলে তারা নির্ভীক হয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করতে থাকে। বরং শরিয়তের গন্ডির মধ্যে থেকে সন্তানদেরকে আদব ও সুশিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে মাঝে মধ্যে হালকা মারধর করা উচিত । কারণ মার ব্যতীত অনেক সময় সাবধান হয় না ।

বর্তমান যুগের অবস্থা হলো, প্রথম অবস্থায় ছেলে-মেয়েদেরকে অত্যধিক আদর করা হয়। শাসন করা হয় না। এতে তারা নির্ভীক হয়ে বদ অভ্যাসে মজবুত হয়ে গেলে পরে তাদের জন্য কান্না করতে থাকে ৷ অথচ সন্তানকে কু-কর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখা বা মারপিটকে আদর যত্নের পরিপন্থি মনে করা তাদের সাথে শত্রুতা ছাড়া আর কিছুই নয়। হযরত লোকমান (আঃ) বলেন- পিতার শাসন সন্তানের জন্য এমন প্রয়োজন, যেমন ক্ষেতের জন্য পানি। – (দুররে মানসুর) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক ছা’ (সাড়ে তিন কেজি) খাদ্য সদকা করার চেয়েও সন্তানকে শাসন করা অধিকতর পূণ্যের কাজ। অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি পরিবার পরিজনকে শাসন করার জন্য ঘরে বেত লটকিয়ে রাখে আল্লাহ তার উপর রহমত বর্ষণ করেন। অপর এক হাদীসে আছে, কোনো কোনো পিতার পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য সর্বাধিক মূল্যবান পুরস্কার হলো, তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দান করা ।

মুহতারাম পাঠক! প্রত্যেক পিতা-মাতাই তাদের সন্তানকে ভালবাসে। তাদের জন্য যে কোন ধরণের কুরবানি দিতে প্রস্তুত থাকে । কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, যে প্রিয় সন্তানদের কল্যাণে আমরা নিজেদের সহায়-সম্পত্তি এমনকি প্রয়োজনে জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হইনা, তাদেরকে যদি সদাচারী বানাতে না পারলাম, তাদের চিরস্থায়ী মঙ্গলের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষাটুকু দিতে না পারলাম, তবে আমাদের এ ভালবাসার দাবি কতটুকু যথার্থ? পিতা হয়ে, মাতা হয়ে যদি সন্তানদের দায়িত্ব পালনে অক্ষম প্রমাণিত হলাম, তবে এ ব্যর্থ পিতৃত্বের ও ব্যর্থ মাতৃত্বের কি সার্থকতা রয়েছে? আমি যদি আমার সন্তানকে সত্যিকার অর্থেই ভালবেসে থাকি, তাহলে আমার ভালবাসার দাবী কি এটা নয় যে, আমি তার জন্য এমন কিছু করব যা সত্যিকার অর্থেই তার জন্য মঙ্গলজনক? তাই আসুন, পিতা-মাতার হকগুলো জেনে নেওয়ার পাশাপাশি সন্তানের হকগুলো জেনে নেই। তারপর এগুলোর উপর আমল করতে সচেষ্ট হই । তাহলে ফলাফল এই দাঁড়াবে যে, সন্তান থেকে চেয়ে শ্রদ্ধা আদায় করার প্রয়োজন পড়বে না। মোটকথা, আমি পিতা কিংবা মাতা হিসেবে যদি আমার দায়িত্ব একশত ভাবে আদায় করতে পারি, তবে সন্তানরাও তাদের দায়িত্ব পালন করবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের বুঝবার তাওফীক দিন । আমীন৷ * সূত্র : প্রেস্টিজ কনসার্ড, ফাযায়েলে নামাজ।

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। গল্পের বই: ঈমানদীপ্ত কাহিনী – হৃদয় গলে সিরিজ ৭ থেকে। 

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আশা করি এই বাবার কষ্টের গল্প কাহিনীটি পড়ে আপনিও ব্যথিত হয়েছেন। আল্লাহ পাক ক্ষমা করুন, এমন সন্তানের পিতা মাতা যেন কেউ না হন। আমীন।

Leave a Comment