ভুল শােধরানাের আগে নিশ্চিত হোন

কেনো মানুষের ভুল শোধরানোর আগে তাঁর ভুল সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে তা সম্মানিত লেখক এখানে বর্ণনা করেছেন। আপনার জীবনকে উপভোগ করতে সম্মানিত লেখকের এই আর্টিকেলটি পড়ুন। 

ভুল শােধরানাের পূর্বে ভুল সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নিন

ভুল শােধরানাের আগে

একদিন একজন পরিচিত ব্যক্তি আমাকে ফোন করলাে। তার আঁঝালাে কণ্ঠস্বর শুনে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, সে প্রচণ্ড রেগে আছে এবং সে তার রাগ দমিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি সবসময় তার যে কণ্ঠস্বর শুনে অভ্যস্ত, এতাে তা নয়! যেভাবে সে কথা বলছে তাতে বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে।

সে তার কথা শুরু করলাে একটি অপপ্রচারকে কেন্দ্র করে। এরপর তার কণ্ঠ আরাে তীব্র হল। সে বলতে লাগল, আপনি একজন দাঈ, একজন আলেম । আপনার কাজ-কর্মের দায়-দায়িত্ব আপনার ওপরই বর্তাবে ..।

আমি বললাম, ‘ভাইজান! কী হয়েছে সরাসরি বলুন।

লােকটি বললাে, “আপনি অমুক জায়গায় যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাতে আপনি বলেছিলেন..।’

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কত দিন আগের ঘটনা?

‘তিন সপ্তাহ আগের।

‘তিন সপ্তাহ? আমি তাে গত এক বছরেও সেখানে যাই নি।

‘অবশ্যই গেছেন এবং বৃক্ততায় এ এ বিষয়ে আলােচনা করেছেন।

এতক্ষণে আমার কাছে স্পষ্ট হলাে যে, সে কোনাে অপপ্রচারের শিকার হয়েছে এবং তা বিশ্বাস করে নিয়েছে। সে অপপ্রচারের ওপর ভিত্তি করেই আমাকে ফোন করেছে এবং আমার সাথে এ ধরনের কথা বলছে। আমি তাকে ভালােবাসি এবং ভবিষ্যতেও তাকে ভালােবেসে যাব। কিন্তু আমার কাছে তার ওজন কিছুটা হলেও কমে গেছে। আজ বুঝতে পেরেছি যে, লােকটা গুজবে কান দেয়। কেউ যদি বলে চিল তােমার কান নিয়ে গেছে’ তাহলে কানে হাত দিয়ে না দেখেই চিলের পেছনে দৌড়াতে শুরু করে।

বহুলােক আছে, যারা গুজব ও অপপ্রচারের ওপর ভিত্তি করেই অবস্থান নেয় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আপনাকে এমন অনেকেই উপদেশ দিতে আসবে। পরবর্তীতে দেখা যাবে, সে কোনাে গুজব বা অপপ্রচারের ওপর ভিত্তি করে আপনাকে উপদেশ দিতে এসেছে।

গুজব ও অপপ্রচার অনেকের অন্তরেই বদ্ধমূল হয়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে তারা আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন কিছু ভাবতে শুরু করে। অথচ এসব ভাবনার ভিত্তিই সম্পূর্ণ অবাস্তব।

মাঝে মধ্যে শােনা যায়, অমুক ব্যক্তি এই এই কাজ করেছে। তখন এটা প্রচার করার আগে সংবাদটা বাস্তব কি-না, তা নিশ্চিত হয়ে নিন। এতে তার কাছে আপনাকে লজ্জিত হতে হবে না। আর এটাই মহানবী (সাঃ)-এর নিয়ম। 

একবার জনৈক ব্যক্তি মহানবী (সাঃ)-এর কাছে এলাে। মহানবী (সাঃ) লক্ষ্য করলেন, লােকটির বেশভূষা জীর্ণ শীর্ণ, চুল এলােমেলাে। মহানবী (সাঃ) তার সংশােধন করতে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন, লােকটি যদি আসলেও দরিদ্র হয়ে থাকে তাহলে সে চাইলেও সবকিছু ঠিক করতে পারবে না।

তাই মহানবী (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমার কি ধন সম্পদ আছে?

সে বললাে, হ্যা, আছে।’

‘কী ধরনের সম্পদ আছে?

‘উট ঘােড়া, ভেড়া বকরি সবই আছে।

রাসূল (সাঃ) বললেন, যেহেতু আল্লাহ তাআলা তােমাকে সম্পদ দিয়েছেন তাই তােমার দেহে যেন এর নিদর্শন থাকে।

তারপর বললেন, “তােমাদের উটগুলাে তাে নিখুত অবস্থাতেই জন্মগ্রহণ করে। তারপর তােমরা ক্ষুর দিয়ে সেগুলাের কান কেটে ফেল। আর বল, এটি হলাে বুহাইরা। অথবা তার শরীরে বা চামড়ার কেনাে জায়গায় ছিদ্র করে বল, এটা হলাে ‘সম’। এরপর এগুলােকে নিজেদের ও পরিবারের জন্য হারাম সাব্যস্ত কর।’

সে বললাে, হ্যা, আমরা তাে এমনই করি।’

রাসূল (সাঃ) তখন বললেন, তাহলে আল্লাহ যা তােমাকে দিয়েছেন, তা তাে অবশ্যই তােমার জন্য বৈধ। আর মনে রেখ, আল্লাহর ক্ষুর অনেক বেশি ধারাল!’ (মুসতাদরাকে হাকিম:৭৪৭১)

নবম হিজরিতে আরব ও অন্যান্য জনপদের বিভিন্ন গােত্র থেকে তাদের প্রতিনিধিরা রাসূলের কাছে আসত। কেউ তাে মুসলমান হয়ে আসত। তারা এসে বায়াত গ্রহণ করত। আবার কিছু লােক আসত কাফের অবস্থাতেই । তারা এসে ইসলাম গ্রহণ করত কিংবা সন্ধি করত। একদিন রাসূল (সাঃ) সাহাবিদের নিয়ে বসা ছিলেন। এমন সময় দশ বারােজন সওয়ার এলাে। তারা রাসূলের মজলিসে এসে বসল। কিন্তু সালাম দিল না।

রাসূল তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা কি মুসলমান?

তারা বললেন, হ্যা, আমরা মুসলমান।

রাসূল বললেন, তাহলে তােমরা সালাম দিলে না কেন?

তারা কোনাে কিছু না বলে দাড়িয়ে সালাম দিল। রাসূল (সাঃ) এর উত্তর দিয়ে তাদেরকে বসতে বললেন। এরপর তারা নামাযের সময় সম্পর্কে রাসূলকে জিজ্ঞেস করলাে।

ওমর (রাঃ)-এর যুগের ঘটনা। ইসলামি ভূখণ্ডের সীমা তখন অনেক বিস্তৃত। ওমর (রাঃ) সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করলেন।

কুফায় তখন বিভিন্ন দল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছিল। তাদের একটা দল ওমরের নিকট সা’দের বিরুদ্ধে অভিযােগ জানিয়ে চিঠি লিখল। চিঠিতে তারা তার অনেক দোষ ত্রুটির কথা উল্লেখ করলাে। এসবের মধ্যে একটি হলাে, তিনি নামাযের প্রতি যত্নবান নন। ওমর (রাঃ) চিঠি পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন না কিংবা তাকে কোনাে নসিহতও করলেন ; বরং তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে একটি চিঠি দিয়ে সা’দের কাছে পাঠালেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে লােকজনের কাছ থেকে তার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে নির্দেশ দিলেন।

মুহাম্মদ বিন মাসলামা সা’দের কাছে পৌছে খলিফার নির্দেশ শোনালেন। এরপর তার সঙ্গে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে লাগলেন এবং লােকজনের কাছ থেকে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। সবাই তাঁর সুনাম করলাে।

অবশেষে তারা বনু আবসের একটি মসজিদে প্রবেশ করলেন। মুহাম্মদ বিন মাসলামা সেখানকার মানুষের কাছে তাদের গভর্নর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সবাই তার ভূয়সী প্রশংসা করলাে।

মুহাম্মদ বললেন, আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, তােমরা তার ব্যাপারে ভিন্ন কিছু জেনে থাকলে বল। সবাই বললাে, আমরা যা বলেছি, ঠিক বলেছি। আমরা তাকে ন্যায়পরায়ণ গভর্নর হিসেবেই পেয়েছি।’

তিনি আবার ভালােভাবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন মসজিদের শেষ প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়াল। তার নাম ওসামা বিন কাতাদাহ।

সে দাঁড়িয়ে বললাে, আপনি যেহেতু শপথ করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাহলে শুনুন, সা’দ সর্বক্ষেত্রে সমতা বিধান করে না অর্থাৎ পক্ষপাতিত্ব করে এবং ন্যায়ভাবে বিচার করে না!

এ কথা শুনে সাদ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি বললেন, আমি কি এমন?

লােকটি বললাে, হ্যা, এমনই।

এ কথা শুনে সা’দ বললেন, হে আল্লাহ! তােমার এই বান্দা যদি মিথ্যা বলে থাকে, খ্যাতি অর্জন ও প্রচার লাভের আশায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তার হায়াত বাড়িয়ে দাও, তার দরিদ্রতা প্রলম্বিত কর এবং তাকে ফেতনা কবলিত কর।

এরপর সা’দ (রাঃ) সেই মসজিদ থেকে এসে মদিনায় ফিরে গেলেন। এ ঘটনার কয়েক বছর পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

অপরদিকে সেই লােকটি সা’দের বদদোয়ার কুফল ভােগ করতে লাগল। তার অভাবী জীবন দীর্ঘ হলাে। অস্থি-মজ্জা দুর্বল হয়ে পড়ল, পিঠ কুঁজো হয়ে গেল। দুঃসহ দীর্ঘ জীবনের যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে পড়ল। এছাড়া প্রচণ্ড দরিদ্রতা তাকে ঘিরে ধরল । সে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করত । বার্ধক্যের কারণে তার ভ্রুযুগল চোখের ওপর ঝুলে পড়েছিল। যখনই তার কাছ দিয়ে মহিলারা পথ অতিক্রম করত সে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিত এবং তাদের পিছু নিত। এ অবস্থা দেখে মানুষ তাকে নিয়ে হৈচৈ করত এবং তাকে গালি দিত।

সে আফসােস করে বলত, হায়, আমি কী করব! সৎ ও মহৎ গভর্নর সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের বদদোয়ার কবলে পড়ে আমি শেষ হয়ে গেলাম!

নববী সতর্কবাণী ..

যে কারাে কথা যাচাই না করে গ্রহণ করা উচিত নয়। যা শুনেছে তা বলা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৩২১ ও ৪৩৪০)

♦♦♦♦♦

উৎসঃ জীবনকে উপভোগ করুন (Enjoy your life in bangla)

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment