মা হাফসা! তুমি নাকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে সমানে সমানে উত্তর দিয়ে থাক? হাফসা বললেন, হ্যাঁ, অনেক সময় তাই হয়। আমি বললাম, খবরদার! কখনো এরূপ করবে না। তুমি মনে কর না যে, তোমার রূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে মুগ্ধ করেছে, বরং তুমি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি বিনয়ীভাব প্রকাশ করবে।’
উন্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা) জান্নাতী ।
عن أنس (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ جِبْرِيلُ رَاجِعُ حَفْصَةَ فَإِنَّهَا صَوَّامَةٌ قَوْامَةً وَإِنَّهَا زَوْجَتُكَ فِي الْجَنَّةِ .
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন : জিবরীল আমাকে বলেছে যে, আপনি হাফসা (রা) থেকে প্রত্যাবর্তন করুন, কেননা সে অধিক রোযাদার ও অধিক নফল সালাত আদায়কারী এবং সে জান্নাতে আপনার স্ত্রী। (হাকেম : সহীহ আল জামে আস্সাগীর লি আলবানী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৪৭২৭ )
ওমর (রা)-এর উক্তি :
মা হাফসা! তুমি নাকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে সমানে সমানে উত্তর দিয়ে থাক? হাফসা বললেন, হ্যাঁ, অনেক সময় তাই হয়। আমি বললাম, খবরদার! কখনো এরূপ করবে না। তুমি মনে কর না যে, তোমার রূপ রাসূলুল্লাহকে মুগ্ধ করেছে, বরং তুমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি বিনয়ীভাব প্রকাশ করবে।
নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম হাফসা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর পিতা ছিলেন। মায়ের নাম যয়নব বিনতে মাযউন । তাঁর বংশ তালিকা হাফসা বিনতে ওমর ইবনে খাত্তাব ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযযা ইবনে রিবাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে কুরাত ইবনে রিযাহ ইবনে আদী ইবনে লুয়াই ইবনে ফিহির ইবনে মালিক।
জন্ম ও ইসলাম গ্রহণ : হাফসা (রা) নবুওয়্যাতের পাঁচ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় কোরাইশগণ কা’বাঘর পুন:নির্মাণ করছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ছিলেন তাঁর সহোদর। তিনি কবে, কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা পরিষ্কার করে জানা যায় না। শুধু এতটুকু জানা যায় যে, ওমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব সমগ্র পরিবারের ওপর পড়ে। ফলে তাঁর গোটা বংশের লোক ইসলাম কবুল করে। হাফসাও এ সময়ে পিতা-মাতা ও স্বামীসহ ইসলাম কবুল করেন।
প্রথম স্বামী : তাঁর স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী খুনাইস ইবনে হুযাইফা ইবনে কায়েস ইবনে আদী। তিনি বনু সাহম বংশের লোক ছিলেন। মদীনায় হিজরতকালে স্বামী খুনাইস (রা)-এর সাথে হাফসা (রা)ও মদীনায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হলে খুনাইস (রা) তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
বিধবা হয়ে পিতার গৃহে : তার স্বামী অল্প কয়েকদিন পর ইন্তেকাল করেন । সময়টা ছিল দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমযান। স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা হাফসা (রা) পিতৃগৃহে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
মেয়ের বিবাহের জন্য ওমরের প্রস্তাব : হাফসা (রা) বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসার পর পিতা হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ওমর (রা) মেয়ের পুনরায় বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে তিনি আবূ বকর সিদ্দিক (রা)-এর সাথে তাঁকে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং আবূ বকর (রা)-এর সাথে সরাসরি কথা বলেন। কিন্তু আবূ বর (রা) কোন উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ চুপ থাকেন। আবূ বকর (রা)-এর এ নীরবতা ওমর (রা) ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাই ওসমান (রা)-এর নিকট তাঁর কন্যা হাফসাকে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এ সময়ে ওসমান (রা) বিপত্নীক ছিলেন। মানে তাঁর স্ত্রী নবী নন্দিনী রোকাইয়া (রা) কিছুদিন আগে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তবুও ওসমান (রা)-এ প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়ে জানিয়ে দেন যে আপাতত তিনি বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করছেন না ।
হাফসার স্বভাব : আসলে হাফসা (রা) ছিলেন রাগী মেজাজের মানুষ যা আবূ বকর (রা) বা ওসমান (রা)-এর মতো নরম স্বভাবের মানুষেরা পছন্দ করতেন না। যে কারণে তাঁরা উভয়েই ভদ্রভাবে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন। সকলের তো জানা- স্বয়ং ওমর (রা) নিজেই ছিলেন অসম্ভব কঠোর প্রকৃতির মানুষ। কথায় বলে না, ‘বাপকা বেটা, সিপাহীকা ঘোড়া।’ ঠিক তেমনি হাফছা (রা) ছিলেন ‘বাপকা বেটি’। যা হোক হাফসা (রা)-কে বিয়ে করার ব্যাপারে আবূ বকর (রা) ও ওসমান (রা)-এর অনীহা ওমর (রা)-কে বেশ লজ্জায় ফেলেছিল । এ জন্য তিনি বিষয়টি সবিস্তারে রাসূল (সাঃ) কে অবহিত করেন।
সকলের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, এ সেই ওমর (রা) যাঁর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে জিবরাইল (আ) উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘মুহাম্মদ (সাঃ) ওমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছেন।’ আর ইতোপূর্বে ইসলাম গ্রহণকারীরা তো খুশিতে ফেটে পড়লেন। কারণ তারা জানতেন, ওমরের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাস ভিন্ন দিকে মোড় নিবে। সত্যিই তাই ওমর ইসলাম গ্রহণের পর পরই অন্য মুসলমানদেরকে নিয়ে কা’বায় গিয়ে সালাত আদায় করলেন— যা ছিল মুসলমানদের জন্য অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর। কারণ ইতোপূর্বে ৪০/৫০ জন ইসলাম কবুল করলেও প্রকাশ্যে তাঁরা কা’বা ঘরে গিয়ে সালাত আদায় করার সাহস করেননি। ওমর (রা) এখানেই ক্ষান্ত হননি, তিনি আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামের প্রধান শত্রু আবূ জেহেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন । তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবূ জেহেল বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি মনে করে?’ আমি বললাম, ‘আপনাকে এ কথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ তোমার-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান বাণীকে মেনে নিয়েছি।’ এ কথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল এবং বলল, ‘আল্লাহ তোকে কলঙ্কিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলঙ্কিত করুক।’
বুঝতেই পারছেন অবস্থা কি। মূলত এখান থেকেই ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়। তারপর! তারপর তো কত ঘটনা, কত সংঘর্ষ-সংগ্রাম, কত বিজয়। আর এ জন্যই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওমর (রা) সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওমরের জিহ্বা ও অন্ত:করণে আল্লাহ তা’আলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক‘। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন।
রাসূল (সাঃ) নিজেই প্রস্তাব দেন বিবাহের : মুহাম্মদ (সাঃ) সব দিক ভেবে চিন্তে ওমর (রা)-এর মর্ম বেদনার কথা উপলব্ধি করলেন এবং তাঁকে কন্যাদায়গ্ৰস্ততা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজেই হাফসাকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। হিজরী তৃতীয় সনে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে করে ওমর (রা) যার পরনাই খুশি হন। অন্যদিকে একজন বিশিষ্ট শহীদ সাহাবীর নিঃসন্তান বিধবা স্ত্রীর দুঃখময় নিঃসঙ্গ জীবনের অবসান ঘটে !
রাসূল (সা:) যখন হাফসা (রা)-কে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলেন, তখন একদিন আবূ বকর (রা) ওমর (রা)-এর সাথে দেখা করে বললেন, ‘ওমর! যখন তুমি আমার নিকট হাফসার বিয়ের প্রস্তাব করেছিলে, তখন আমার নীরবতা তোমাকে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু আমার নীরব থাকার কারণ ছিল এই যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা:) হাফসা সম্পর্কে নিজেই আলোচনা করেছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) অবশ্যই হাফসাকে স্বীয় পত্নীত্বে বরণ করে নেবেন। এ গোপন কথাটি আমি আর কারও নিকট প্রকাশ করিনি। যদি রাসূল (সা:) হাফসাকে বিয়ে না করতেন, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে বিয়ে করতাম।’
হাফসাকে বিবাহ করার কারণ : ঐতিহাসিকদের মতে, রাসূল (সা:) হাফসা (রা)-কে প্রধানত তিনটি কারণে বিয়ে করেছিলেন :
১. মুহাম্মদ (সা:) ইসলামের বিজয় নিশানকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবেন তা তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন এবং আল্লাহ তাঁকে এ বিষয়ে অবহিত করেছিলেন। ওমর (রা)-কে পুরস্কারস্বরূপ ও তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা:) হাফসা (রা)-কে বিয়ে করেন এবং উভয়ের মধ্যকার আত্মীয়তার বন্ধনকে সুদৃঢ় করেন। শুধুমাত্র রাসূল (সা:) এর সাথে এ আত্মীয়তার বন্ধনের কারণেই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ ওমর (রা)-কে স্মরণ করবে। এটি একটি সুদূর প্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ মর্যাদা।
২. হাফসা (রা)-কে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহর রাসূল (সা:) হাফসা (রা) এর মর্যাদাকে এত উচ্চে সমুন্নত করেছেন যে, শুধুমাত্র রাসূল (সা:) এর সাথে বিয়ে হওয়ার কারণে হাফসা (রা) মুহাম্মদ (সা:) এর অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবেন এবং সে নিশ্চয়তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদান করেছেন ৷
৩. আল্লাহর রাসূল (সা:) হাফসা (রা)-কে বিয়ে করার মাধ্যমে ওমর (রা)-কে কন্যাদায়মুক্ত করেন এবং সকল প্রকার নিন্দার হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করেন।
রাসূলের সাথে হাফসার আচরণ : পূর্বেই জানিয়েছি যে, হাফসা (রা) একটু কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন। এমনকি তিনি অনেক সময় রাসূল (সা:) এর সাথেও কথা কাটাকাটি করতেন। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, ‘একদা ওমর (রা) কোন একটি বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। এমন সময় ওমরের স্ত্রী এসে বললেন, তুমি কি নিয়ে বেশি চিন্তা করছ? ওমর (রা) বললেন, আমার বিষয় সম্পর্কে খোঁজ নেবার অধিকার তুমি কোথায় পেলে? প্রত্যুত্তরে ওমরের স্ত্রী বললেন, তুমি আমার কথা পছন্দ কর না। কিন্তু তোমার মেয়ে হাফসা সমানে সমানে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাথে প্রতিবাদ করে থাকে। ওমর (রা) বলেন, আমি তখনই হাফসার নিকট চলে আসলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা হাফসা ! তুমি নাকি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাথে সমানে সমানে উত্তর দিয়ে থাক? হাফসা বললেন, হ্যাঁ, অনেক সময় তাই হয়। আমি বললাম, খবরদার! কখনো এরূপ করবে না। তুমি মনে কর না যে, তোমার রূপ রাসূলুল্লাহ (সা:) মুগ্ধ করেছে, বরং তুমি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি বিনয়ীভাব প্রকাশ করবে।
হাফসা (রা)-এর এ ধরনের আচরণের কারণে একবার তো রাসূল (সা:) তাঁকে এক তালাক পর্যন্ত দিয়ে বসেন। অবশ্য হাফসার রাতভর নফল ইবাদত ও দিনের বেলা রোযা রাখার কথা স্মরণ করিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল(সা:) কে তাঁকে (হাফসাকে) গ্রহণ করে নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। রাসূল (সা:) নির্দেশ মতো কাজ করেন।
হাফসার সাথে রাসূলের ভালোবাসা : এত কিছুর পরও রাসূল হাফসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। অনেক গোপন কথাও তাঁকে বলতেন। একবার তিনি হাফসার সাথে একটি গোপন বিষয়ে আলাপ করেন এবং অন্য কারো কাছে না প্রকাশ করার জন্য বলেন। কিন্তু নারীসুলভ মানসিকতার কারণে তিনি তা আয়েশা (রা)-এর কাছে বলে দেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাসূল (সা:) হাফসা (রা)-এর ওপর রাগান্বিত হন। এরপর এ বিষয়কে কেন্দ্র করে সূরা তাহরীমে আল্লাহ ঘোষণা করেন-
وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَباتُ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرْفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَنْ بَعْضٍ ، فَلَمَّا نباها به قَالَتْ مَنْ أَنْبَاكَ هذَا ، قَالَ نَبانِي الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ .
অর্থ: ‘আর রাসূল যখন তাঁর এক স্ত্রীর কাছে একটি গোপন কথা বলেন, আর তিনি তা ফাঁস করে দেন, আল্লাহ তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করেন । তিনি তাঁর স্ত্রীর নিকট প্রকাশ করলে তিনি বলেন, কে আপনাকে এটা বলে দিয়েছে? তিনি বললেন, যিনি মহাজ্ঞানী সর্বজ্ঞ, তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন।’
(সূরা তাহরীম : আয়াত-৩) এ ঘটনাটিই হলো তাহরীমের ঘটনা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে যখন আয়েশা (রা) ও হাফসা (রা) একমত হয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিলেন, তখন এ আয়াত নাযিল হয়-
إِنْ تَنُونَ إِلَى اللهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا ، وَإِنْ تَظْهَرَا عَلَيْهِ . فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ ، وَالْمَلَئِكَةُ A بَعْدَ ذلِكَ ظَهِيرٌ .
অর্থ : ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহ্র নিকট তওবা করলে তা তোমাদের জন্য উত্তম । কেননা তোমাদের দিল সঠিক ও নির্ভুল পথ থেকে সরে গিয়েছে। আর তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহই তো তাঁর প্রভু, জিবরাঈল এবং নেককার ঈমানদারগণ তো আছেই, এসবের পর আল্লাহ্ ফেরেশতারা তাঁর সহায়ক রয়েছেন।’ [সূরা তাহরীম: আয়াত-৪]
মুনাফিকরা সব সময় তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য নানা ধরনের ফাঁক ফোকর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এ আয়াতে ঐসব মুনাফিকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং তাদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, “হাফসা আর আয়েশা যদি বিরোধ চায় আর মুনাফিকরা যদি ষড়যন্ত্র করে তা দিয়ে ফায়দা হাসিল করতে চায়, তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সাহায্য করবেন। আর আল্লাহ্ তার সাথে আছেন, জিবরাঈল ফেরেশতা এবং দুনিয়ার নেককার মু’মিনগণ।
আয়েশা ও হাফসার সাময়িক দ্বন্দ্ব : তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে, ‘একদা উম্মুল মু’মিনীন সাফিয়া (রা) কাঁদতে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে হাফসা বলেছে যে, আমি ইয়াহুদীর মেয়ে। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি নবী বংশের মেয়ে। তোমার বংশে বহু নবী আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমানে তুমি নবীর স্ত্রী। সুতরাং হাফসা তোমার ওপর কোন বিষয়ে গৌরব করতে পারে?’
আরো বর্ণিত আছে, ‘একদিন আয়েশা ও হাফসা সাফিয়াকে বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর নিকট তোমার চেয়ে অধিক প্রিয় ও মর্যাদাশালীনী। আমরা তাঁর স্ত্রী এবং একই রক্তধারার অধিকারিণী। সাফিয়া এ কথায় ক্ষুণ্ন হলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) এর নিকট অভিযোগ পেশ করলেন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তুমি একথা কেন বলনি যে, তোমরা আমার চেয়ে অধিক সম্মানিতা কেমন করে হতে পার? আমার স্বামী স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) আমার পিতা হারুন (আ) ও আমার চাচা মূসা (আ)।
আসলে হাফসা ও আয়েশা (রা)-এর মধ্যে খুবই মধুর সম্পর্ক ছিল। অনেক সময় তাঁরা একত্রে রাসূল (সা:) এর সফর সঙ্গী হতেন।
ইতিহাস খ্যাত হবার কারণ : হাফসা (রা)-এর নাম যে কারণে ইতিহাসের পাতায় ও মু’মিনদের মনে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে লেখা হয়ে আছে তাহলো তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনের সংরক্ষক বা হেফাজতকারী। ইয়ামামার যুদ্ধে বহুসংখ্যক কারী ও কুরআনের হাফেজ শহীদ হয়েছিলেন। ‘আবূ বকর (রা)-এর খেলাফতকালে ১১ হিজরী সালে যিলহজ্জ মাসে ইয়ামামা নামক স্থানে কিছুসংখ্যক ধর্মত্যাগীর সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
এ যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) এবং ধর্মত্যাগী সেনাপতি ছিল মুসায়লামা কাযযাব। এ যুদ্ধে এত বেশি সংখ্যক কুরআনের হাফেজ শহীদ হয়েছিলেন যে, এর ফলে মক্কা মদীনায় হাফেজের সংখ্যা অনেক কমে যায়। ওমর (রা) এ ঘটনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আবূ বকর (রা)-এর কাছে আসলেন আল কুরআন সংকলনের সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। অনেক আলাপ আলোচনা ও চিন্তা ভাবনার পর যায়েদ ইবনে সাবিতের ওপর কুরআন সংকলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যায়েদ (রা) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তৎকালীন আরবের প্রখ্যাত কারী ও হাফিজদের সহায়তায় কঠোর পরিশ্রমে পবিত্র কুরআনের একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। এটি ছিল আবূ বকর (রা)-এর খেলাফতকালে সর্বজন স্বীকৃত সরকারি পাণ্ডুলিপি।
আবূ বকর (রা) জীবদ্দশায় পাণ্ডুলিপিটি তাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কুরআনের এ পাণ্ডুলিপিটি ওমর (রা)-এর অধিকারে সংরক্ষিত থাকে। তাঁর ইন্তেকালের পর হাফসা (রা) কুরআনের এ পাণ্ডুলিপিটি অত্যন্ত যত্নসহকারে নিজের কাছে সংরক্ষিত করে রাখেন। খলিফা ওমর (রা)-এর খিলাফতকালে পবিত্র কুরআনের এ মূল পাণ্ডুলিপি থেকে নকল করে এক লক্ষ পাণ্ডুলিপি তৈরি করে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।
কিন্তু ওসমান (রা)-এর খেলাফতের সময় হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান নামক এক সাহাবী যুদ্ধ উপলক্ষে আযারবাইজান গমন করে ইরাক ও সিরিয়াবাসীদের মধ্যে কুরআন পাঠে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করেন। পরে তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে এ বিষয়ে ওসমান (রা)-কে অবহিত করেন এবং কুরআনের উচ্চারণে এ পার্থক্য দূরীভূত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেন। ওসমান (রা) বিষয়টির গুরুত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ওসমান (রা) জানতেন যে আবূ বকর (রা)-এর সময়ে তৈরিকৃত কুরআনের মূল পাণ্ডুলিপিটি হাফসা (রা)-এর কাছে সংরক্ষিত আছে। ফলে তিনি হাফসার নিকট এ মর্মে খবর পাঠান যে, তিনি যেন অবিলম্বে তাঁর কাছে সংরক্ষিত পবিত্র কুরআনের পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়ে দেন এবং হাফসা (রা)-এর পাঠানো পাণ্ডুলিপিটির ভিত্তিতে কুরআনের নকল তৈরি করে তাঁর পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দেয়া হবে।
হাফসা (রা) তাঁর পাণ্ডুলিপিটি খলিফা ওসমানের কাছে পাঠিয়ে দেন। ওসমান কয়েকজন লেখক যেমন- যায়েদ ইবনে সাবিত (রা) আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) এবং আবদুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশামকে কুরআনের নকল তৈরির কাজে নিয়োজিত করেন। ওসমান (রা) এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন যে, কুরআনের লিখন ও পঠনে যদি মত পার্থক্য সৃষ্টি হয় তাহলে যেন কোরায়শী রীতিতেই কুরআন লেখা হয় কেননা কোরায়শী ভাষায়ই আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
ওসমান (রা)-এর নির্দেশে এমনিভাবে কোরায়শী রীতিতেই পবিত্র কুরআনকে সংরক্ষিত করা হয় যার অবিকল পাণ্ডুলিপি আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এমনিভাবে পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই মুসলমানরা যখন পবিত্র কুরআনের লিখন ও পঠনে চরম এক অনিশ্চয়তার মাঝে ছিল তখন হাফসা (রা)-এর নিকট সংরক্ষিত কুরআনের মূল পাণ্ডুলিপিটিই মুসলমানদের সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। যদি হাফসা (রা) যত্নসহকারে এ পাণ্ডুলিপিটি সংরক্ষণ না করতেন তবে ওসমান (রা)-এর পক্ষে হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হতো না। হাফসা (রা) পবিত্র কুরআনের সর্বজন স্বীকৃত পাণ্ডুলিপিটি এমনিভাবে সংরক্ষণ করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের অন্তরে অম্লান ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
হাফসা (রা)-এর সাদা-সিধে জীবন : হাফসা (রা) ব্যক্তিগত জীবনে রাগী স্বভাবের হলেও তিনি ছিলেন অসম্ভব ইবাদত বন্দেগী করার একজন মানুষ । এ আল্লাহভীরু মহীয়সী নারী রাত্রি জেগে যেমন তাহাজ্জুদ আদায় করতেন, তেমনি দিনের বেলা রোযা রাখতেন। যে কারণে তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দীতে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তিনি খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। মৃত্যুকালে তিনি সহোদর আবদুল্লাহকে ডেকে বলেন, ‘যৎসামান্য আসবাবপত্র যা আছে, বিষয়-সম্পত্তি সবই যেন আল্লাহর রাহে গরীব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয় ৷’
শিক্ষার প্রতি হাফসা (রা)-এর গভীর আগ্রহ : তৎকালীন আরবে নারীগণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন অনেক পিছিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন তখন নারী ও পুরুষ কারো ক্ষেত্রেই তেমন ছিল না। হাফসা (রা)-এর পক্ষেও অন্যান্যদের ন্যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ হয়নি, কিন্তু মহান শিক্ষক ও প্রিয় স্বামী রাসূল (সা:) এবং পিতা ওমর (রা)-এর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানে থেকে ধর্মীয় বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়েও জ্ঞান অর্জনের অপূর্ব সুযোগ পান। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহও ছিল প্রবল। দ্বীনী বিষয়ে যে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল বিভিন্ন ঘটনা থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায় ।
একদা রাসূল (সা:) বললেন, আমি আশা করি বদর ও হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারী কোন সাহাবী জাহান্নামে যাবে না। হাফসা (রা) এতে আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, আল্লাহ তা’আলা তো বলেছেন- وَ إِنْ مِّنْكُمْ إِلَّا وَارِدَهَا অর্থ: “তোমাদের সকলকে জাহান্নামে হাযির করা হবে।” [সূরা মারইয়াম-৭১]
নবী করীম (সা:) বললেন, হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে এ কথাও তো আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-
ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا
অর্থ: “অতঃপর আমি আল্লাহ ভীরু লোকদের নাজাত দেব এবং জালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।” [সূরা মারইয়াম : ৭২]
হাফসা (রা)-এর এ বাক্যালাপে মুগ্ধ হয়ে এবং তাঁর মধ্যে শেখা ও জানার প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করে রাসূল (সা:) সব সময় তাঁকে বিভিন্ন জিনিস শেখানো এবং জ্ঞানীরূপে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। শিফা বিন্ত আবদুল্লাহ (রা) নামে এক মহিলা সাহাবী লেখাপড়া জানতেন। হাফসা (রা) তাঁর নিকট থেকেই লেখা শিখেন। রাসূল (সা:) তার সকল স্ত্রীর শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে মহান ও আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন ।
এ শিফা (রা) নামলা নামক এক প্রকার ক্ষতরোগ নিরাময়ের ঝাড়-ফুঁক জানতেন। জাহিলী যুগে তিনি এ ঝাড়-ফুঁক করতেন। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর নিকট এসে বললেন, আমি জাহিলী জীবনে ঝাড়-ফুঁক করতাম। আপনি অনুমতি দিলে সে মন্ত্র আপনাকে শুনাবো। রাসূল (সা:) শুনে বললেন, এ ঝাড়-ফুঁকটি তুমি হাফসাকে শিখিয়ে দাও। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা:) শিফা (রা)-কে বলেন : তুমি কি হাফসা (রা)-কে এ ‘নামলার’ মন্ত্রটি শিখিয়ে দেবে না, যেমন তাঁকে লেখা শিক্ষা দিয়েছ? এসব বর্ণনা হতে হাফসা (রা)-এর জ্ঞান চর্চার আগ্রহ-উদ্দীপনা এবং এ বিষয়ে নবী (সা:) এর ভূমিকা অবগত হওয়া যায়।
হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনায় তাঁর অবদান!
পিতা ওমর (রা)-এর কাছে লেখাপড়া শিখেছিলেন হাফসা (রা)। রাসূল স্বয়ং ছিলেন তাঁর শিক্ষক। হাফসা (রা) রাসূল (সা:) এর নিকট থেকে কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূল এবং শরীয়তের অন্যান্য বিষয় আদ্যপান্থ শিক্ষা লাভ করেন। যে কারণে নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব জ্ঞানে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি পারদর্শী ছিলেন। অনেক প্রখ্যাত সাহাবীই তাঁর ছাত্রদের পর্যায়ভুক্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে পুরুষদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, হামযা ইবনে আবদুল্লাহ, হারেসা ইবনে ওয়াহাব, আবদুর রহমান ইবনে হারেস (রা) প্রমূখ এবং মহিলাদের মধ্যে সাফিয়া বিনতু আবূ ওবায়দা এবং উম্মে মুবাশশির আনসারিয়ার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। হাফসা (রা)-এর জ্ঞান ও প্রতিভা সারা বিশ্বে এখনো মশহুর হয়ে আছে যা মুসলিম জাহানের কল্যাণ সাধনে অকল্পনীয় সহায়ক হয়েছে।
শিফা (রা)-এর নিকট থেকে হাফসা (রা) যেখানে রাসূলের নির্দেশে নামলার মন্ত্র শিখেছেন, সে ক্ষেত্রে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হাদীসের জ্ঞান রাসূল আলা আলাদা থেকে অর্জন করবেন, এটাই স্বাভাবিক ।
নবীপত্নী হিসেবে রাসূল সালালা কে কাছ থেকে দেখার, তাঁর থেকে অনেক কিছু জানার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনায় তিনি উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন ।
তাঁর থেকে মোট ৬০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলো তিনি খোদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং স্বীয় পিতা ওমর (রা) থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে চারটি হাদীস মুত্তাফাকুন আলাইহি এবং ছয়টি হাদীস ইমাম বুখারী (রা) এককভাবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীস পুনরুক্তিসহ সহীহ বুখারীতে ১১টি, সহীহ মুসলিমে ১৪টি, জামি আত-তিরমিযীতে ১২টি, সুনান আবূ দাউদে ৬টি, সুনান আন-নাসাঈতে ৪০টি এবং সুনান ইবন মাজায় ৭টি সংকলিত হয়েছে।
হাফসা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. হাফসা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ ! মানুষের কি হলো যে তারা ওমরার ইহরাম হতে হালাল হয়ে গেল, অথচ আপনি উমরা হতে হালাল হননি। তিনি বললেন : আমার কুরবানীর জন্তুর গলায় চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছি। কুরবানী না করা পর্যন্ত আমি হালাল হবো না । (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ.-২১২)
২. হাফসা (রা) হতে বর্ণিত । তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন : পাঁচটি জন্তু হত্যা করায় কোন পাপ নেই। সেগুলো হলো : কাক, চিল, ইঁদুর, বিষ্ণু এবং দু’চোখের উপর কালো দাগ বিশিষ্ট পাগলা কুকুর। (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ.-২৪৬)
৩. ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, হাফসা (রাঃ) তাঁকে সংবাদ দিয়েছেন যে, মুয়াযযিন যখন ফজরের আযান শেষ করতেন এবং সকালের উদয় হতো তখন নবী (সাঃ) ফরয সালাতে দাঁড়াবার পূর্বে হালকাভাবে দু’রাক’আত সালাত পড়তেন। (মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ: ২৪৬)
৪. হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিয়ামদার অবস্থায় (স্ত্রীদেরকে চুম্বন করতেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড পৃ: ২৪৬)
৫. সালিম ইবন আবদুল্লাহ তাঁর হতে তিনি হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে দৃঢ়ভাবে সিয়ামের নিয়ত বা সংকল্প না করবে, তার সিয়াম হবে না। (সুনানে আবু দাউদ ১ম খণ্ড, পৃ: ৩৩৩)
৬. হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন বিছানায় শুতে আসতেন তখন তিনি তাঁর ডান হাতকে গালের নিচে রেখে এ দোয়া তিনবার পড়তেন– رَبِّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تُبْعَثُ عِبَادَكَ
অর্থঃ “হে প্রভু! তোমার বান্দাদেরকে যে দিন উথিত করবে সে দিনের আযাব হতে আমায় রক্ষা কর। (মুসনাদে আহমদ ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯)
ওফাত : আমীর মুয়াবিয়ার শাসনামলে হিজরী ৪৫ সনে ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর দিনেও হাফসা (রা) রোযা ছিলেন এবং রোযা অবস্থায়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তৎকালীন মদীনার শাসনকর্তা মারওয়ান বিন হাকাম তাঁর জানাযার সালাত পড়ান। আবূ হোরায়রা (রা) কবর পর্যন্ত তাঁর লাশ বহন করে নিয়ে যান। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও তাঁর পুত্রগণ লাশ কবরস্থ করেন । জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। রাসূল (সাঃ) ঔরসে তাঁর কোন সন্তান জন্মলাভ করেনি। মূলত তিনি ছিলেন নিঃসন্তান ।
উৎস: কুরআন হাদীসের আলোকে রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীগণ যেমন ছিলেন বই থেকে। সৌজন্য: পিস পাবলিকেশন -ঢাকা।