যুদ্ধের গল্প – মুসলমানদের যুদ্ধ জয়ের গল্প

প্রতিভাবান মুসলিম সেনাপতিদের যুদ্ধ জয়ের গল্প ও ঘটনাগুলি পড়ুন। আমরা সেরা ইসলামিক যুদ্ধ জয়ের গল্প ও ঘটনাগুলি এখানে তুলে ধরেছি। মুসলিম সেনাপতিদের যুদ্ধ জয়ের কৌশল ও বিচক্ষণতার দিকগুলো আবিষ্কার করতে এই যুদ্ধের গল্প ও ঘটনা গুলো পড়ুন। তাহলে চলুন আমরা সামনে এগিয়ে যায়.. 

যুদ্ধের গল্প - মুসলমানদের যুদ্ধ বিজয়ের গল্প

উমর রা. ও হুরমুযানের কথোপকথন : যুদ্ধের গল্প ১!

যিয়াদ ইবনে যোবায়ের বলেন হযরত ওমর রা. এক নওমুসলিম হুরমুযানকে জিজ্ঞাসা করলেন, দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্য। একসাথে উভয়কে পরাস্থ করা মুশকিল। তোমার অভিমত কী ? আগে কোন শক্তির মোকাবেলা করা উচিৎ।

হুরমুযান কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, আমিরুল মুমিনীন, আমাদের শত্রুর দৃষ্টান্ত একটি পাখির মতো। যার মাথা, দুটি ডানা, দুটি পা আছে ।

যদি আপনি একটি ডানা কেটে দেন তাহলে আরো এক ডানা ও দুই পা নিরাপদে থাকবে। আর যদি দুটি ডানাই কেটে দিতে পারেন তবুও মাথা ও দুই পা নিয়ে হেঁটে হলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

কিন্তু আপনি যদি মাথাটা কেটে দিতে পারেন তাহলে দুই ডানা দুই পা কোনোটাই আর কাজে আসবে না। সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে যাবে। আমার ধারণায় ‘কায়সার’ হলো ডানা সমতুল্য। কিন্তু ‘কিসরা’ মাথা সমতুল্য । তাই আপনি আগে ‘কিসরার’ দত্ত চুর্ণ করে দিন।

 

সম্রাট সিকান্দারের রণকৌশল : যুদ্ধের গল্প ২!

দিগ্বীজয়ী সম্রাট সিকান্দার ও দারার মাঝে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। উভয় দল যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তখন সিকান্দার প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে দেয়ার এক কৌশল প্রয়োগ করলেন। তিনি দারার সৈন্যদের সামনে ঘোষণা করে দিলেন, তোমাদের সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছিল তা তো আমি পালন করেছি। এখন তোমাদেরটা তোমরা পালন করো।

আসলে সিকান্দারের সাথে দারার কোন সৈন্যের বিন্দুমাত্রও যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু এ ঘোষণা শোনামাত্রই সৈন্যরা একে অন্যের প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়ল ।

সবাই ভাবছিলো কোন বিশ্বাসঘাতকের সাথে সিকান্দারের কি গোপন চুক্তি হয়েছে? সে বা তারা কখন কি করে বসে এই দুশ্চিন্তায় তাদের মনোবল ভেঙে গেল । এবং দারা যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হলো।

কৃত্রিম ঘোড়া বানিয়ে যুদ্ধ জয় : যুদ্ধের গল্প ৩!

সিকান্দার ইরানের পরে হিন্দুস্থানে হামলা করেছিলেন। সেখানকার রাজা বীর বিক্রমে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এক হাজার হাতি যুদ্ধের ময়দানে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। তাদের পিঠে অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যরা বসেছিল। হাতির শুঁড়ের ভিতরে তলোয়ার ও গুর্জ রাখা ছিলো ।

যুদ্ধ শুরু হলে সিকান্দারের অশ্ব বিশালাকার হাতি দেখে ভড়কে গেল তারা আগে কখনো হাতি দেখেনি। ভয়ঙ্কর দর্শন হস্তিবাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। ময়দান ছেড়ে লেজ গুঁটিয়ে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।

সিকান্দার এ দৃশ্য দেখে পেরেশান হয়ে পড়লেন। অনেক চিন্তা গবেষণা করে একটা সমাধান বের করলেন। তিনি কৃত্রিমভাবে তামার হাতি তৈরী করলেন। যার ভিতরে ফাঁপা ছিল। ঘোড়াগুলো যুদ্ধের ময়দানে হাতির চেহারা দেখে যেন ভড়কে না যায় এজন্য কৃত্রিম হাতির সাথে ঘোড়াগুলোকে ভালভাবে পরিচিত করে তুললেন।

কিছুদিন পরে দেখলেন ঘোড়াগুলো হাতি দেখে আর ভীত হচ্ছে না। কয়েকদিন পর দুই দল পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হলো । এবার আর সিকান্দারের ঘোড়াগুলো হাতি দেখে পালিয়ে গেল না ।

সিকান্দার অদ্ভুত এক কৌশল প্রয়োগ করলেন। তিনি তামার তৈরী কৃত্রিম হাতিগুলোর মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য ভরে দিলেন। দুই হাতির মাঝখানে কয়েকজন সৈন্য থাকতে বললেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হাতির ভিতরে আগুন জালিয়ে দিলেন। ভিতরের আগুনে তামা ভয়াবহ উত্তপ্ত হয়ে গেলে তখন সৈন্যদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

তামার হাতিগুলোকে হিন্দুস্থানি হাতি এসে ঘেরাও করে ফেলল । প্রচণ্ড বেগে সুঁড়ের আঘাত হানল। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ময়দান কাঁপিয়ে বিকট চিৎকার করে পালাতে লাগল। কারণ তামার হাতিগুলো ভিতরের আগুনের তাপে ভয়াবহ গরম হয়ে উঠেছিল। হিন্দুস্থানি হাতি আগুনের তাপে দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পালাতে গিয়ে হিন্দুস্থানি সৈন্যদের পায়ের তলায় পিষে মারতে লাগল । এভাবে সিকান্দার দক্ষ রণকৌশল প্রয়োগ করে যুদ্ধ জয় করলেন ।

খাদ্য পুড়িয়ে যুদ্ধজয়! যুদ্ধের গল্প ৪।

সিকান্দার একটি শহর অবরোধ করলেন। শহরের অধিবাসীরা দূর্গে আশ্রয় নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। গুপ্তচর মারফত তিনি জানতে পারলেন দূর্গে খাদ্য সামগ্রীর কোন অভাব নেই । মাসের পর মাস তারা দূর্গে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে। তিনি অবরোধ উঠিয়ে এলাকায় ফিরে এলেন।

কিছুদিন পর ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে নিজস্ব কয়েকজন লোক পাঠালেন। তাদের নিকট প্রচুর পরিমাণে বিলাসী সামগ্রী ছিল । খুব স্বল্প মূল্যে তারা তা বিক্রি করছিলেন। আর শহরবাসীর খাদ্য সামগ্রী ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করছিলেন। যখন প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী তারা ক্রয় করে ফেললেন । আকস্মিক সিকান্দারের নির্দেশ এসে পৌঁছালো, খাদ্য সামগ্রীর স্তুপে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দাও এবং যথাশীঘ্র শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাও।

তারা বের হওয়ার সাথে সাথেই তিনি হামলা চালালেন। শহরবাসী যথারীতি দূর্গে আশ্রয় নিয়ে দূর্গের দরজা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু এবার বেশিদিন অবরোধ স্থায়ী হলো না কারণ তাদের স্বল্প খাদ্য সামগ্রী দ্রুত শেষ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করলো। সিকান্দার শহর জয় করে নিলেন।

কিসরার রণকৌশল! যুদ্ধের গল্প ৫।

ইরান সম্রাট কিসরা আরেক পরাশক্তি কায়সারের মোকাবিলা করার জন্য সেনাপতি আসহাদ এর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অপ্রতিরোধ্য সেনাবাহিনী পাঠালেন।

আসহাদ অত্যন্ত দক্ষতায় একের পর এক শহর জয় করে সম্মুখে এগিয়ে চললেন। বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ মালে গণীমত কিসরার রাজ দরবারে পাঠাতে লাগলেন ।

কয়েকদিন পর কিসরার মনে আশঙ্কা জাগলো একের পর এক ধারাবাহিক যুদ্ধজয়ে আসহাদের মনে আত্মগরিমা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।

এরপর দেখা গেল সেনাবাহিনীকে কব্জায় এনে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল। আমাকেই ক্ষমতাচ্যুত করতে আমার বিরুদ্ধে অভিযান চালালো । কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই তিনি আসহাবকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্বস্ত এক ব্যক্তিকে এ কাজের ভার অর্পণ করলেন ।

সেই ব্যক্তি ছিলেন বিচক্ষণ। তিনি বুঝতে পারলেন সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে একজন দক্ষ সেনাপতিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

তিনি আসহাদের নিকট গিয়ে সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিলেন। আসহাদ এতে যারপরনাই ব্যথিত হলেন। এতো দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার প্রতিদান তাহলে এই। আমিও এই অকৃতজ্ঞ কিসরার পক্ষে আর জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবো না । কিসরাকে হত্যা করেই এর প্রতিশোধ নিতে হবে।

সে কায়সারের সাথে সাক্ষাতের উপায় খুজতে লাগলো। এক পর্যায়ে কায়সারের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হলো। কায়সারকে বলল, কিসরা আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। এখন আমি তাকে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নিতে চাই। তার জুলুম নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এবার তার প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে। আপনি আমাকে কোন নিশ্চয়তা বা জামানত প্রদান করুন। যাতে আমি আপনার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারি। আমি আমার সেনাবাহিনী নিয়ে কিসরার উপর হামলা করবো। আপনি আপনার সেনাবাহিনী দ্বারা আমার সহযোগিতা করুন। কথা দিচ্ছি বিজয়ী হলে কিসরার সীমাহীন ধনরাশি থেকে আপনাকে ঐ পরিমাণ প্রদান করবো যা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিসরাকে পাঠিয়েছিলাম। আমার সাহায্যে পাঠানো আপনার সেনাবাহিনীর সকল ব্যয়ভার আমার উপর ন্যস্ত থাকবে। আপনাকে কিছুই খরচ করতে হবে না। কায়সার সব শর্ত মেনে নিজ স্বাক্ষরিত চুক্তি নামা তাকে দিয়ে দিলেন। আসহাদ নিশ্চিন্ত মনে কিসরার মোকাবেলায় রওয়ানা হয়ে গেলেন। সঙ্গে চল্লিশ হাজার সৈন্য কায়সার তার পক্ষ থেকে আসহাদ এর সাহায্যে দিয়ে দিলেন ।

এদিকে গুপ্তচর মারফত সবকিছু শুনে কিসরার হুঁশ হলো । তিনি বুঝলেন চুপচাপ বসে থাকলে আসহাদ এবং কায়সারের সম্মিলিত বাহিনী তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। বুদ্ধির মারপ্যাচেই এই বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব। সম্মুখ সমরে জয়ী হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে ।

তিনি এক খ্রীষ্টান পাদ্রীকে রাজদরবারে ডেকে রেশমী কাপড়ে এক চিঠি লিখে তা আসহাদের নিকট যে করেই হোক পৌঁছে দিতে বললেন। সাবধান করতে ভুললেন না যে, খবরদার কাকপক্ষীও যেন এই চিঠি সম্পর্কে জানতে না পারে।

কিসরা পাদ্রীকে এক হাজার দিনার পারিশ্রমিক বাবদ দিয়ে দিলেন। সে চিঠি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল ।

কিসরা নিশ্চিত ছিলেন। এই চিঠি আসহাদের হাতে পৌঁছবেনা। কারণ পাদ্রী খ্রিষ্টান আর কায়সার ও খ্রীষ্টান। সে কিছুতেই আসহাদের হাতে চিঠি পৌঁছিয়ে কায়সারের ক্ষতি করবে না। বাস্তবে তাই হলো।

পাদ্রী চিঠি সোজা কায়সারের হাতে পৌঁছে দিল । চিঠি পেয়ে তো কায়সার হতভম্ব। তাতে লেখা ছিল। হে আসহাদ, আমার নির্দেশানুযায়ী তুমি কায়সারের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছ জেনে আনন্দিত হয়েছি। তোমার বুদ্ধির জন্যই আমরা কায়সারকে হাতের মুঠোয় পেয়েছি। তুমি রোমকদের শক্তি চূর্ণ করে দিয়েছ। পথিমধ্যে সময় ক্ষেপনের চেষ্টা করো। কায়সার মাদায়েন পৌঁছা মাত্রই তোমার এবং আমার বাহিনী সম্মিলিত ভাবে হামলা করে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। তাকে আরও কয়েকদিন এই বিভ্রান্তিতে রেখে দাও যে, আমি তোমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলাম। আর মাত্র কয়েকদিন এরপরই আমরা রোমানদের সলিল সমাধি রচনা করবো ।

চিঠি পড়া মাত্র কায়সার পুরো বিষয়বস্তু সঠিক মনে করে নিজ সেনাবাহিনী আসহাদ থেকে ফিরিয়ে নিলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে আসার পথে কিসরা, ইয়াস ইবনে কবিসার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠালেন। যারা পিছন থেকে কায়সারের বাহিনীতে আকস্মিক হামলা চালালো। কিছু বুঝে উঠার আগেই কায়সারের অনেক সৈন্য নিহত হলো। কায়সার কোনোরকম পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কায়সারের সেনা এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল।

সম্রাট শিমর ফুলজানাহের রণকৌশল – যুদ্ধের গল্প ৬!

সম্রাট শিমর ফুলজানাহ সমরকন্দে হামলা করে শহরবাসীকে অবরুদ্ধ করলেন, তারা দুর্গের দরজা বন্ধ করে দিলো । অবরোধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিলো। কিন্তু চূড়ান্তজয় অর্জিত হচ্ছিল না। সম্রাট চিন্তা ভাবনা করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না।

একদিন সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে শহরে বের হলেন। শহরের অধিবাসী একজনের সাথে সাক্ষাত হলো। একথা সেকথা বলে তার সাথে ভাব জমিয়ে তুললেন। এক পর্যায়ে লোকটি সম্রাটকে আপন ভাবতে লাগলো । তখন সুযোগ বুঝে সম্রাট লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের শহরতো শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত । তাই না?

: হ্যাঁ তাই। দুশমন আমাদের শহর অবরোধ করে রেখেছে। কেউ শহর ছেড়ে বের হতে পারছে না ।

: কি মনে হয়। শত্রু কি শহর দখল করতে পারবে? তোমাদের সম্রাট এ নিয়ে কি ভাবছেন? কোন অনুমান করতে পারো।

: ধুর! আমাদের সম্রাটের কথা ছেড়ে দাও। শত্রু শহর হামলা করেছে এতে তার বয়েই গেছে। তিনি তো মদ, মেয়ে মানুষ, নাচ-গান আনন্দ ফুর্তিতেই সব সময় ব্যস্ত থাকেন। শহরের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়?

: বলো কি? তাহলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা কে সামলায়?

লোকটি বিরক্ত হয়ে বললো, তুমি তো দেখি একেবারেই বুদ্ধ, কিছুই জানোনা। সম্রাটের মেয়ে শাহজাদী এগুলো সামলাচ্ছেন। 

: ঠিক আছে ভাই আজ তাহলে চলি। তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম।

প্রকৃত অবস্থা জেনে নিয়ে সম্রাট শাহজাদীর কাছে দূত মারফত মূল্যবান উপহার সহ চিঠি পাঠালেন। তাতে লিখলেন ‘আমি ধন-সম্পদের প্রত্যাশী নই। আমার নিকটই স্বর্ণ-রূপা পরিপূর্ণ চার হাজার সিন্দুক বিদ্যমান আছে। সেগুলো আপনাকে পাঠিয়ে আমি চীনে হামলা করতে চাই। চীনের যুদ্ধে বিজয়ী হলে এরপর আপনাকে বিবাহ করতে চাই। আর যদি যুদ্ধে নিহত হই তাহলে চার হাজার সিন্দুক স্বর্ণ-রূপা আপনার কাছেই থাকবে। যা খুশি তাই করতে পারবেন।

এই চিঠি শাহাজাদীর নিকট পৌঁছলে তার আনন্দের সীমা রইল না। দুই এক সিন্দুক নয়, চার হাজার সিন্দুক ভর্তি স্বর্ণ-রূপা। ওরে বাবা রো ইচ্ছা করলেই এ সব কিছুর মালিক হতে পারি শুধু আমি । না, এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না।

তিনি জবাবে লিখলেন, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি। আপনি স্বর্ণ-রূপা আমার নিকট প্রেরণ করুন।

সে অনুযায়ী সম্রাট চার হাজার সিন্দুক পাঠালেন। কিন্তু তার ভিতর স্বর্ণ রূপার পরিবর্তে দুই জন করে সৈন্য রেখে দিলেন। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যখনই তীব্র হুইসেলের শব্দ কানে যাবে, সিন্দুক থেকে বের হয়ে প্রধান ফটক দখল করতে ছুটে যেতে হবে।

পরিকল্পনা মাফিক যখন তারা শহরের মাঝখানে পৌঁছে গেলো সম্রাট তীব্র হুইসেল বাজালেন। শুনার সাথে সাথেই সিন্দুকের সৈন্যরা একযোগে বাইরে এসে প্রধান ফটক দখল করে নিলো। তারা প্রধান ফটক খুলে দেয়ার সাথে সাথেই স্রোতের ন্যায় অবশিষ্ট সৈন্য ভিতরে প্রবেশ করলো ।

ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। অবশেষে সম্রাট শিমরের সৈন্যরা জয়লাভ করলো। সম্রাট শহর দখল করে নিলেন। এরপর চীন অভিমুখে রওয়ানা হলেন ।

কিসরা কর্তৃক হত্যাকারীকে হত্যা – যুদ্ধের গল্প ৭!

ইরান সম্রাট কিসরা, নাম তার খসরু পারভেজ। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক সম্রাট। কাউকে পরোয়া করেনা।

নবী কারীম সা. তার নিকট ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পবিত্র চিঠি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই খবর শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। বদদোয়া করলেন, খসরু যে ভাবে আমার চিঠি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে তার রাজত্ব মুসলমানদের হাতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

নবীজীর ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। পুরো ইরান সাম্রাজ্য মুসলমানদের হাতে পদানত হয়েছিল।

খসরু পারভেজকে একবার তার দরবারের জ্যোতিষীরা জানালো, আমাদের ধারণানুযায়ী আপনার ভাগ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু নেই। আপনি আততায়ী কর্তৃক প্রাণ হারাবেন। আপনাকে নৃশংভাবে হত্যা করা হবে।

কিসরা এ ভবিষ্যবাণী শুনে বিচলীত হয়ে পড়লেন। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন মৃত্যুতো তো অনিবার্য। তা ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই। কিন্তু স্বেচ্ছায় যে আমাকে হত্যা করবে। আমিতো তাকে ছেড়ে দিব না। এর প্রতিশোধ নিব। কিন্তু কিভাবে। রাত-দিন এই ভাবনায় লেগে রইলেন।

হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মতো মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। স্বাভাবিক ভাবেই ধারণা করা যায় আমার হত্যাকারী পুরুষ হবে। তারও মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ থাকবে। সুতরাং যৌন উত্তেজনা বর্ধক কোন ঔষধ পেলে সে না খেয়ে পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি অতি ভয়াবহ বিষ যার এক ফোটা কারো পেটে গেলে তার আর রক্ষা নেই। মৃত্যু অবধারিত। সেই বিষ কোন ঔষধের সাথে মিশিয়ে ব্যক্তিগত ঔষধের সাথে রেখে দিলেন। বোতলের গায়ে লিখলেন ‘ যৌ*ন শক্তির অতি কার্যকরী ঔষধ। যা সেবনে দীর্ঘক্ষণ মিলন করা সম্ভব।’

খসরু শুধু মহানবীর পত্র ছিঁড়েই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে গ্রেফতারের জন্য ইয়ামানের তৎকালীন প্রশাসক বাজানের নিকট নির্দেশ পাঠালো, শক্তিশালী দুই জন লোক পাঠিয়ে যে আমাকে চিঠির দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে তাকে ধরে আমার সামনে উপস্থিত করবে।

বাজান তৎক্ষণাৎ দুইজন লোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে একটি চিঠি সহ মদীনায় পাঠালো লোক দুটি যখন বাজানের পত্র নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আসলো । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রভাবে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এ অবস্থায়ই চিঠি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিঠির বিষয়বস্তু শুনে মুচকি হাসলেন। চিঠির বিষয়বস্তুর ধার দিয়েও না গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন। চিঠির বিষয়ে এতটুকু বললেন, আগামীকাল এসো তখন কথা হবে।

তারা পরদিন নবীজীর খেদমতে হাজির হলে তিন বললেন, গত রাতে আল্লাহ তাআলা কিসরার পুত্রকে তার পিতার উপর ক্ষমতাশালী করে দিয়েছেন। সে তার পিতাকে হত্যা করেছে।

এটি ছিল সপ্তম হিজরীর জুমাদাল উলার দশ তারিখ, সোমবার দিবাগত রাত্রের ঘটনা । পুত্রের নাম ছিল শেরওয়া, সে পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিল। অন্যান্য নির্দেশের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে নির্দেশ দিল, আরবের যে ব্যক্তি নবী দাবী করেছেন তাকে গ্রেফতারের কোন পদক্ষেপ নিবেন না ।

যাই হোক, একদিন শেরওয়া তার পিতা খসরুর খাস কামড়ায় গিয়ে জিনিস পত্র দেখছিলেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো পূর্বালোচিত সেই শিশি যাতে খসরু বিষ মিশিয়ে যৌনবর্ধক লেভেল লাগিয়ে দিয়েছিল। এ শিশি পেয়ে শেরওয়া মনে মনে বললো, এবার বুঝতে পেরেছি, খসরু একের পর এক বাঁদীগুলোর সাথে কিভাবে মিলন করতে সক্ষম হতো। এবার আমিও তার মতো অনেকগুলো মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে পারবো।

অতি সন্তর্পণে শিশিটি নিয়ে এসে রাতে পুরো শিশি পান করে ফেললো। কিছুক্ষণ পরেই বিষক্রিয়া শুরু হলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সারা শরীর বেঁকে গেলো। অল্পক্ষণ তড়পাতড়পি করে চিরদিনের জন্য দেহ নিস্তেজ হয়ে গেলো ।

এ ভাবে খসরু বুদ্ধিমত্তার জোরে নিজ হত্যাকারীকেও হত্যা করতে সমর্থ হলো ।

খাদ্যে বিষমিশিয়ে আত্মরক্ষা – যুদ্ধের গল্প ৮!

এক সম্রাটের উপর পাশ্ববর্তী দেশের সম্রাট বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো । আক্রান্ত সম্রাট এ খবর জানতে পেরে কৌশলে তা প্রতিহত করার ফন্দি আঁটলো ।

উৎপন্ন প্রচুর পরিমাণ যবে বিষাক্ত এক ধরণের উদ্ভিদ মিশিয়ে পানিতে আচ্ছামতো জাল দিলেন। তারপর শুকিয়ে একটি জানোয়ারকে পরীক্ষামূলক খাওয়ালেন। বেচারা জানোয়ার খাওয়ার কিছু সময় পরই মাটিতে শুয়ে পড়লো। মুখ দিয়ে ক্রমাগত ফেনা বের হয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেলো ।

সম্রাট বিষাক্ত প্রচুর পরিমাণ যব স্তুপাকারে সীমান্তবর্তী এলাকায় রেখে দিয়ে এলেন। শত্রুর বিশাল সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছিল। সীমান্তে পৌঁছে চোখের সামনে বড় বড় যবের স্তুপ দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলো। ভাবলো, সাওয়ারী জানোয়ারগুলোর খাদ্যের উত্তম ব্যবস্থা হয়ে গেলো। এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। মহা উৎসাহে জানোয়ারগুলোকে তা খাওয়াতে লাগলো ।

যখন দেখলো অল্পক্ষণের মধ্যে একে একে সকল জানোয়ার মরে পড়ে রয়েছে তখন দুই চোখে শর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। হামলার ইচ্ছা ত্যাগ করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নিজ এলাকায় ফিরে গেল ।

হাতির শুঁড়ে শুকর ছুঁড়ে যুদ্ধ জয় – যুদ্ধ জয়ের গল্প ৯!

দুই দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। একদলের নিকট হাতি ছিল। এজন্য তারা যুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছিল। বিজয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। অপর দল তা আঁচ করতে পেরে কোথা থেকে শুকর ধরে আনলো । একটি শুকরকে কয়েকজন মিলে ধরে হাতির শুঁড়ের উপর ছুঁড়ে মারছিল। শূকর ভয়ে আকাশ ফাটানো চিৎকার জুড়ে দিলে তা শুনে হাতির পিলে চমকে গেল । ভয় পেয়ে উল্টো দিকে ছুটে চললো। প্রতিপক্ষ বিজয়ী হয়ে গেলো ।

বিড়াল ছুঁড়ে যুদ্ধ জয় – যুদ্ধের গল্প ১০!

মুসলমান আর কাফেরের লড়াই চলছে। কাফেরদের নিকট হাতি ছিল। এক মুসলমান এক হাতে তলোয়ার অপর হাতে একটি বিড়াল উঁচু করে ধরলো। তলোয়ার দিয়ে হাতির শুঁড়ে আঘাত আনলো । আর বিড়াল হাতির মুখে জোরে ছুঁড়ে দিল। হাতি এতে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে হাওদা সহ সাওয়ারকে নিচে ফেলে দিল। মুসলমানরা নারায়ে তাকবীর ধ্বনি দিলেন। কাফেররা পালিয়ে গেল ।

গল্পের উৎস: প্রতিভার গল্প ২ বই থেকে। 

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, অতীতে মুসলমানেরা দুর্বল ছিলনা! তারাও একসময় বীর দর্পে যুদ্ধ করতো, শত্রুদের দম্ভ অহংকার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিত। মুসলমানদের বহু যুদ্ধ জয়ের গল্প আছে, আমরা আগামীতে সেসব তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। ভালো থাকবেন, জাযাকাল্লাহ খাইর। 

আরও পড়তে পারেন : অভিভূত জার্জিস রাজকন্যা – যুদ্ধ জয়ের গল্প!

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading