“আপন পর সবই সমান” এটি প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলের একটি ঘটনার গল্প। এই প্রখ্যাত সাহাবীর শাসন আমলের ন্যায় পরায়ন বিচারের একটি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:
আপন পর সবই সমান – ইসলামিক সত্য ঘটনা!
সেদিন ছিল বাজারের দিন। হযরত ওমর (রা.) কি এক কাজে বাজারে গেছেন। এ গলি সে গলি দিয়ে হাঁটছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন সমস্ত বাজারটা । বাজারে প্রচুর সওদা এসেছে। হরেক রকমের সওদা । কেউ কিনছে, কেউ বিক্রি করছে। দূর দূর অঞ্চল থেকে লোকজন বাজারে এসেছে। অসংখ্য লোকের আগমনে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে গোটা বাজার ।
যারা খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর (রা.)কে চেনে তারা বিনীত ভাবে সালাম জানিয়ে একটু সরে দাঁড়ায়। তাঁর চলার পথকে সহজ করে দেয়। আর যারা চেনে না তারা অর্ধ জাহানের অধিপতি হযরত ওমর (রা.) কে ঠেলে ঠুলে পাশ কেটে সামনে এগিয়ে যায়। বেচা-কেনা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সবার মধ্যে বিরাজ করছে একটু চঞ্চলতা। বাজার থেকে সদাই- পাতি কিনে কার আগে কে বাড়ি ফিরবে এ যেন তারই প্রতিযোগিতা।
একটু পর। ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড় ঠেলে অলিগলি পার হয়ে হযরত ওমর (রা.) বাজারের অপর প্রান্তে একটু খোলামেলা জায়গায় এসে থামলেন। সেখানে ছিল অনেকগুলো উট। বিক্রির জন্যই এগুলো বাজারে আনা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে তিনি উটগুলো দেখছিলেন। হঠাৎ খানিকটা দূরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা একটি উট দেখে একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন । উটটি যেমন সুন্দর, তেমনি হৃষ্টপুষ্ট। উচ্চতার পরিমানও অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশী। এমন মোটা-সোটা স্বাস্থ্যবান উট দেখে খুবই খুশি হলেন তিনি। মনে মনে বললেন, বাজারের সবগুলো উটই যদি এমন মোটা তাজা হত, সবাই যদি এমন নিভাবে গৃহপালিত পশুর যত্ন নিত।
এতক্ষণ তিনি দূর থেকে উটটি দেখছিলেন। এবার এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলেন সেই উটটির কাছে। তারপর উটের রশি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এ উটটি কার? এটি কি বিক্রি হয়ে গেছে?
লোকটি কার সঙ্গে কথা বলছে, কতটুকু তার মর্যাদা, কি পরিমাণ তার প্রভাব প্রতিপত্তি সে তা মোটেও জানত না। তাই সে ওমর (রা.)কেও একজন ক্রেতা বলে ভাবল । বলল-
: না, এখনও বিক্রি হয় নি। দামদর চলছে। আপনার কি তা পছন্দ হয়েছে?
কথাগুলো এক শ্বাসে বলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোককে দেখিয়ে বলল, উনিই হলেন এ উটের মালিক । উটের মালিকের দিকে তাকাতেই হযরত ওমর (রা.) একেবারে ‘থ’ হয়ে গেলেন। এ যে তাঁরই পুত্র আব্দুল্লাহ! মাথা নীচু করে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ।
এ সময় হযরত উমর (রা.) এর সুন্দর দীপ্ত মুখ মন্ডলে চিন্তার সুষ্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল । ভাবতে লাগলেন, আব্দুল্লাহ উট পেল কোথায়? তার উট এত মোটাতাজা হল কি করে? ঘাস খাওয়ানোর জন্য চারণ ভূমিই বা পেল কোথায়? হযরত ওমর (রা.) এসবের কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না ৷ শুধু একরাশ প্রশ্ন এসে তার মনের কোণে ভীড় জমাতে লাগল ।
খানিক পর। পুত্র আব্দুল্লাহ নত মস্তকে এসে পিতার সামনে দাঁড়ালেন। হযরত ওমর (রা.) বললেন, আব্দুল্লাহ! ঠিক করে বলতো আসলে এ উটটি কার?
: এটি আমারই । হযরত আব্দুল্লাহ নরম সুরে জবাব দিলেন । : এমন সুন্দর ও নাদুস নুদুস উট কোথায় পেলে তুমি?
: অনেক আগে আমি এটি কিনে ছিলাম ।
ধীরে ধীরে হযরত ওমর (রা.) এর মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। পূর্বের হাসি আর আনন্দ ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন-
: তুমি উটটি এত মোটা তাজা করলে কিভাবে? কখনই বা এর সেবা যত্ন করলে?
: চারণক্ষেত্র থেকে ঘাস খাইয়েছি। একটু মোটা সোটা হওয়ার পরই বিক্রির জন্য বাজারে এনেছি। ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) এর উত্তর ।
স্তব্ধ নিঃশ্বাসে হযরত ওমর (রা.) কথাগুলো শুনলেন । সমস্ত মুখমন্ডল তাঁর কঠিন হয়ে উঠেছে। কণ্ঠে দৃঢ়তার ছাপ। চাহনিতে কঠোর শাসনের সুস্পষ্ট আভাস। তিনি বললেন, আব্দুল্লাহ! এটা তোমার অন্যায় হয়েছে। তুমি যে চারণক্ষেত্রে উট লালন পালন করেছ তা সরকারি চারণক্ষেত্র । এটি জনগণের সম্পত্তি। আর জনগণের সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত উট চরানোর অধিকার তোমার নেই ।
কথা কয়টি বলে হযরত ওমর (রা.) থামলেন। বাজারের বহু লোক ততক্ষণে জড়ো হয়েছে সেখানে। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে খলীফার কথাগুলো শুনে। কিন্তু মুখ খুলে ভাল মন্দ দু কথা বলার সাহস পায় না। খলীফা পুত্র আব্দুল্লাহ সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন । লজ্জায় তার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। করুণ কাতর আঁখি দুটি তুলে ধরেন খলীফার মুখে ।
কিছুক্ষণ থেমে হযরত ওমর (রা.) আবার বলতে শুরু করলেন, আব্দুল্লাহ! উটটি মোটা তাজা বলে বেশ চড়া দামে বিক্রি হবে । উটের দাম তুমি পাবে ঠিক, কিন্তু বাড়তি মুনাফা যাবে বায়তুল মাল তথা সরকারী কোষাগারে। কারণ তুমি সরকারী চারণভূমির সতেজ ঘাস খাইয়েই একে এমন স্বাস্থ্যবান ও হৃষ্টপুষ্ট করে তুলেছ। হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) নিজের ভুল বুঝতে পারেন । নীরবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পিতার কথা শেষ হলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান ।
উপস্থিত জনতা হযরত ওমর (রা.)এর আচরণে খুবই মুগ্ধ হয় । নিজেরা বলাবলি করে-খলীফার মত খলীফাই বটে। নইলে নিজের ছেলেকে কেউ এভাবে শাসন করতে পারে?
একজন বলে উঠল, দেশের শাসক এমনই হওয়া চাই। খলীফা ঠিক কাজটিই করেছেন। হোক না আব্দুল্লাহ নিজের ছেলে। তাই বলে তো সরকারি সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যায় না। সরকারি সম্পদের এমন অপব্যবহার খলীফা সইবেন কেন?
আরেকজন বলল, তোমরা তো কেবল খলীফার প্রশংসায় পঞ্চমুখ । আব্দুল্লাহর ব্যাপারটি একটুও খেয়াল করছ না। আব্দুল্লাহ কি এজন্য প্রশংসার দাবিদার নয় যে, সে একটুও মিথ্যা বলল না, সামান্য প্রতিবাদও করল না। বরং অকপটে নিজের দোষ স্বীকার করে বাড়তি আয়টুকু বায়তুল মালে জমা দেওয়ার জন্য সম্মত হয়ে গেছেন?
হ্যাঁ, তাই তো! এ দিকটি আমরা এতটা তলিয়ে চিন্তা করি নি ৷ অন্যজন বলল।
প্রিয় পাঠক! আজকেও যদি পৃথিবীর দিকে দিকে এমন শাসক জন্ম নিতেন যাদের নিকট ইনসাফের মানদন্ডে আপন পর, আত্মীয় অনাত্মীয় সবই সমান, তবে কি এ ভূপৃষ্টের উপরে শান্তির হাওয়াটা আরেকটু প্রবল বেগে প্রবাহিত হত না? দেশের জনগণ কি আরামে দুটো আহার করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারত না?
তাই আসুন, নেতৃত্বের আসনে কাউকে বসানোর পূর্বে একটু চিন্তা করে নেই তার মধ্যে খোদাভীরুতা ও ন্যায়পরায়ণতার গুণ পূর্ণ মাত্রায় আছে তো? তার শাসনে সত্য, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে তো?
মুহতারাম পাঠক! ভোট কিংবা অন্য কোন উপায়ে কারো প্রতি আপনার সমর্থন ব্যক্ত করার পূর্বে এ বিষয়টি যাচাই বাছাই করে দেখা আপনার অপরিহার্য কর্তব্য। নচেৎ অবশ্যই আপনি আল্লাহর দরবারে পাকড়াও হবেন ।
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। গল্পের বই: সাড়া জাগানো সত্য কাহিনী।
“আপন পর সবই সমান” গল্পটি ডাউনলোড করতে চান? তাহলে Get Download pdf এ ক্লিক করুন।
Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.