শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের জন্য ইসলামিক শিক্ষণীয় গল্প “সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়”। গল্পের লেখক হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনকালের একটি সত্য ঘটনা গল্প আকারে বর্ণনা করেছেন এবং শিক্ষণীয় দিকগুলো উপস্থাপন করেছেন।
সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় : ইসলামিক শিক্ষনীয় সত্য গল্প!
বলিষ্ঠ এক যুবক। আরবের মরু এলাকায় তার বাস। মদীনা থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করে সে। বিশেষ প্রয়োজনেই কেবল মদীনায় যায়। কয়েকদিন থাকে । আবার ফিরে আসে।
তখন চলছিল সিংহ পুরুষ হযরত ওমর (রা.) এর শাসনকাল । একদিন যুবকের মদীনায় যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। বিশেষ প্রয়োজন । যেতেই হবে । না যেয়ে উপায় নেই ।
দিনক্ষণ ঠিক করে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল যুবক। যেতে হবে তাকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে অনেক দূরে। সুদূর মদীনায়। সফর সঙ্গী হিসেবে একটি উট ছাড়া অন্য কেউ নেই । হাতে সময় ছিল খুবই কম । সেজন্য জরুরি বিশ্রাম ব্যতীত বাকি সময়টুকুতে বিরামহীন ভাবে চলছিল সে ।
চলার পথে ক্লান্ত দেহটাকে খানিক চাঙ্গা করে নেওয়ার জন্য এক সময় বিশ্রাম নিচ্ছিল যুবক। ভীষণ পিপাসা ও ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে সঙ্গে নিয়ে আসা সামান্য খাদ্য ও পানি বিশ্রামের শুরুতেই গলার নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। এবার উটটাকে খেজুর বাগানে ছেড়ে দিয়ে একটি গাছের ছায়ায় মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আরব দেশে প্রচুর খেজুর বাগান রয়েছে। ছোট বড় মাঝারি সব ধরনের বাগানই আছে সেখানে। যে বাগানটিতে যুবক বিশ্রাম নিচ্ছিল সেটি খুব বেশি একটা বড় ছিল না। একজন মালি বাগানটি দেখাশুনা করত । পানি দিত। আগাছা পরিস্কার করত। ভাল ফলনের জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করত সে।
সেদিন মালি বাগানে কাজ করছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল, একটি উট এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। উটের পায়ে পিষ্ঠ হয়ে কিছু চারা গাছ ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে মালি রেগে যায় । সঙ্গে সঙ্গে উটটিকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে উহার প্রতি একটি পাথর নিক্ষেপ করে। উটটিকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছা মালির ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তার নিক্ষেপিত পাথরটি উটটির ঠিক বুক বরাবর প্রচন্ড বেগে আঘাত হানে। এতে ছটফট করতে করতে তৎক্ষণাৎ উটটি মারা যায় ।
মালি ভয়ে কাঁপতে থাকে । এক অজানা আশংকায় তার বুক দুরু দুরু করে । চেহারায় ফুটে উঠে উৎকণ্ঠার ভাব। একটু দূরে হঠাৎ এক যুবককে দেখতে পেয়ে ভাবে, উটের মালিক হয়তো সেই হবে। মালি দেরি করে না। সে ছুটে যায় বেদুঈন যুবকের নিকট। খুলে বলে সবকিছু। তারপর বিনীত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করে যুবকের নিকট ।
যুবক উটটিকে সীমাহীন ভালবাসত। সেটি ছিল তার সবচাইতে প্ৰিয় উট। তদুপরি এ মুহূর্তে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এটি। তাই উটের মৃত্যুর কথা শুনে যুবক দিশেহারা হয়ে পড়ল। হারিয়ে ফেলল হিতাহিত জ্ঞান। ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মালির দাড়ি ধরে সজোরে ঝাকুনি দিতে লাগল। এ সময় মালি ছিল বেশ অসুস্থ। তাই যুবকের ঝাকুনি সহ্য করতে না পেরে সেও এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ।
এবার যুবক কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কি করল, কি করা তার উচিত কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে সেও কেঁদে ফেলল । অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল, একি করলাম আমি! অন্যায়ভাবে আমি একজন মানুষকে হত্যা করলাম!
এতক্ষণে মালির ছেলেরা বাগানে এসে উপস্থিত। তারা যুবকের মুখ থেকে সবকিছু শুনল । তারপর বিচারের জন্য তাকে নিয়ে গেল খলীফার দরবারে। খলীফা উভয় পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করলেন। যুবক তার বক্তব্য প্রদানে বিন্দুমাত্রও মিথ্যার আশ্রয় নিল না। সে অকপটে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করল ।
বাদী বিবাদীর কথা শুনে খলীফা কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন। যুবকের সত্যবাদিতায় তিনি মুগ্ধ হলেন। কিন্তু হত্যার পরিবর্তে হত্যা- ইসলামের এই বিধানের কারণে যুবককে কতল করার নির্দেশ দিলেন ।
যুবক বলল, খলীফার নির্দেশ শিরোধার্য। তার ফায়সালা অবশ্যই কার্যকর হবে । তবে আমার একটি আবেদন ছিল ।
: বল তোমার কী আবেদন? খলীফা গম্ভীর কন্ঠে বললেন ।
: আমীরুল মুমেনীন! হুকুম তামীলের পূর্বে পরিবার পরিজনকে একনজর দেখতে চাই। চির বিদায় আনতে চাই তাদের কাছ থেকে। এটিই আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা ।
: তোমার এ আবেদন পূর্ণ হতে পারে । তবে এজন্য প্রয়োজন একজন জামিনদারের । তুমি না এলে তোমার পরিবর্তে তাকেই কতল করা হবে ।
খলীফার দরবার লোকে লোকারণ্য। চতুর্দিকে কেবল মানুষ আর মানুষ । যুবককে চিনে এমন কেউ এখানে নেই । উপস্থিত সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় যুবক। তার দৃষ্টি যেন এ কথাই বলছিল- হে উপস্থিত জনতা! তোমরা যে কেউ আমার জামিন হতে পার। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত সময়ে এখানে আমি উপস্থিত হবোই ।
নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। কেউ কোন কথা বলছে না। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে তারা । সময় বয়ে চলছে তার আপন গতিতে।
উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন ছিলেন আবু যর গিফারী (রা.)। তিনি এতক্ষণ সকলের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। যুবকের সত্যবাদিতায় ইতোমধ্যেই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। এবার জামিনের প্রশ্ন আসায় তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এ যুবকের জামিন হব। তাকে জীবনের শেষ আকাঙ্খা পূর্ণ করার সুযোগ দেওয়া হোক।
জামিন পেয়ে যাওয়ায় খলীফা যুবককে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। যুবক বিলম্ব করল না। ছুটে চলল স্বজনদের পানে। কয়েকদিন পূর্বে এক সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করেছিল সে। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কিভাবে তাকে চির বিদায় জানাবে, কি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হবে-চলার পথে এ চিন্তাটিই বারবার ঘোরপাক খাচ্ছিল তার মাথায়।
যুবক কখনো মিথ্যা বলে নি। প্রতারণা করে নি। আজীবন সে গেয়েছে সত্যের জয়গান। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সে গোটা জীবন সংগ্রাম করেছে। সততা, সত্যবাদিতা ও ওয়াদা পালনে সে ছিল সর্বদা সচেষ্ট ।
পথ চলতে গিয়ে যুবক ভাবে, আজ যদি আমি সততার পরিচয় না দিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করে পুনরায় ফিরে না যাই তবে আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাব। রক্ষা পাব আক্রমণ থেকে। সুখে শান্তিতে আরো কিছুদিন বসবাস করতে পারব একান্ত আপনজনদের সাথে। কিন্তু না, জীবনের চেয়ে ওয়াদার মূল্য, জীবনের চেয়ে সততার মূল্য অনেক, অনেকগুণ বেশি। সুতরাং জীবনের মায়ায় প্রিয়জনদের কান্না ভেজা চেহারা পানে তাকিয়ে কখনো মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। ভঙ্গ করা যাবে না প্রতিশ্রুতি, গুড়িয়ে দেওয়া যাবে না সততার সুরম্য প্রাসাদ ।
যুবক বাড়ির দিকে যতই এগিয়ে চলছে ততই মনকে শক্ত করে নিচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয় । ভনিতা না করে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে সবার নিকট বলে ফেলে খলীফার ফয়সালার কথা। সেই সাথে এও বলে যে, বিলম্ব করা যাবে না, আমাকে এখনই যেতে হবে।
যুবকের কথায় পিতা-মাতা, আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের চোখেই পানি দেখা দেয়। বারবার হুঁশ হারায় নব বিবাহিতা যুবতী স্ত্রীও। সে এক করুণ ও মর্মান্তিক দৃশ্য!
খলীফার নিকট ফিরে যেতে অনেকে যুবককে বাধা দেয়। যুক্তির মারপ্যাচে বিভিন্ন উপায়ে বুঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু যুবক নাছোড় বান্দা । সে তার ওয়াদা পালনে এক পায়ে খাড়া। জীবন রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে কিছুতেই সে রাজি নয়। সুতরাং সবাইকে শেষ বারের মত বিদায় জানিয়ে দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে খলীফার নিকট উপস্থিত হল সে।
খলীফা বললেন, হে যুবক! তোমার প্রতিশ্রুতি পূরণ, তোমার কর্তব্য নিষ্ঠা ও সততায় আমি যারপর নাই খুশি হয়েছি, কিন্তু নিজের পক্ষ থেকে তোমাকে সহযোগিতা করার কোন উপায় আমার নেই। একথা বলে মালীর ছেলেদের দিকে তাকালেন তিনি। অতঃপর জানতে চাইলেন তাদের মতামত।
এ মুহূর্তে মালীর ছেলেরা যেমন যুবকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে, ঠিক তেমনি ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে তাকে রক্ষাও করতে পারে। মজলিসে পিন পতন নীরবতা। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছেলেদের মুখের দিকে । তারা কি বলে, সে কথা শুনার জন্য সকলেই এখন উন্মুখ হয়ে আছে। যুবক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মাথানত করে।
যুবকের সততায় কেবল খলীফা ও উপস্থিত জনতাই নয়, মালীর ছেলেরাও অত্যধিক মুগ্ধ হয়েছিল। তাই খলীফার প্রশ্নের জবাবে এক বাক্যে তারা বলে উঠল, আমরা যুবককে ক্ষমা করে দিলাম। তাদের এ উদারতায় মহানুভব খলীফা খুশি হয়ে বললেন, আমি দেশ জয়ে যে আনন্দ পাইনি, সে আনন্দ আজ তোমাদের মধ্যে পেলাম।
অতঃপর খলীফা হযরত আবু যর গিফারী (রা.) কে কাছে ডাকলেন । বললেন, হে রাসূলের প্রিয় সাহাবী! আপনি কেন এ অপরিচিত যুবকের জামিন হতে গেলেন? যদি সে না ফিরত তবে আপনার অবস্থা কি হত তা একটু ভেবে দেখেছেন কি?
উত্তরে তিনি বললেন, হে মান্যবর খলীফাতুল মুসলিমীন! যুবকের সত্যবাদিতার প্রতি আমার আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমি এতবড় ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। মালী হত্যার ঘটনাকে সে যেভাবে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে, তাতেই আমার মনে হয়েছে যে, সে এক সত্যবাদী যুবক । জীবন বাঁচানোর জন্য কখনোই সে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিবে না । এক কথায়, সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়েই আমি তার জামিন হয়েছি।
গল্প থেকে শিক্ষা : সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! মিথ্যা নয়, সত্যই যে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, টেনে তুলতে পারে ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে-বর্ণিত ঘটনাটি তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ । তাই আসুন, সদা সত্য কথা বলি মিথ্যা পরিহার করে চলি । দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সত্য কথা বলে যাব। আমৃত্যু বেঁচে থাকব, মিথ্যা ও ধোকা নামক ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে । হে দয়ার আধার! তুমি আমাদের শুধু প্রতিজ্ঞাই নয়, তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দেওয়ারও তাওফীক দাও । আমীন । [সূত্র : দিলকাশ ওয়াকিয়াত]
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। গল্পের বই: সাড়া জাগানো সত্য কাহিনী!
আরও পড়তে পারেন: সাহসী মায়ের অমর কাহিনী (কাদেসিয়ার যুদ্ধের গল্প)
Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.