যখনই “গার্হস্থ্য নির্যাতন” বা “পারিবারিক সহিংসতা” কথাটি শোনা যায়, অধিকাংশ মানুষ নারীদের ভুক্তভোগী হিসেবে কল্পনা করে। তবে বাস্তবতা হলো, পুরুষেরাও শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক নির্যাতনের শিকার হন। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে সমাজে আলোচনা কম হয়, যার ফলে অনেক পুরুষ তাদের কষ্টের কথা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেন।
এখানে পুরুষ নির্যাতনের প্রকৃতি, আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিকার, বাস্তব কেস স্টাডি এবং এর বিরুদ্ধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
আরও পড়তে পারেন: বাংলাদেশের শ্রমআইন: কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার
পুরুষ কিভাবে নির্যাতনের শিকার হন?

- স্ত্রী বা প্রেমিকা দ্বারা মারধর, কামড়, ছুরি বা অন্য অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা।
- সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনে হেনস্থা করা।
- মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে হুমকি দেওয়া।
- একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিনজন গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার ব্যক্তির মধ্যে একজন পুরুষ।
- যুক্তরাজ্যেও প্রতি বছর প্রায় ৭০০,০০০ পুরুষ গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হন।
২. মানসিক ও আবেগিক নির্যাতন: শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতন আরও ক্ষতিকর হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- দীর্ঘমেয়াদী অপমান ও গালাগালি করা।
- মিথ্যা অভিযোগ এনে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা।
- সন্তানদের দেখা থেকে বঞ্চিত করা।
- আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়া বা হুমকি দেওয়া।
- অনেক পুরুষ এই মানসিক নির্যাতনের কারণে বিষণ্নতা, আত্মহত্যার প্রবণতা এবং কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতার শিকার হন।
৩. আর্থিক নির্যাতন: নারীরা অনেক সময় পুরুষের উপার্জনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। যেমন:
- ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যয়বহুল জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া।
- আদালতের মাধ্যমে অবৈধভাবে অধিক পরিমাণে খোরপোষ দাবি করা।
- চাকরি বা ব্যবসায় বাধা দেওয়া।
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের চিত্র!
১. শারীরিক নির্যাতন: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশেও অনেক পুরুষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। স্ত্রী, শ্বশুরবাড়ির সদস্য বা অন্যদের দ্বারা মারধর, অপমান, এমনকি মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা ঘটে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৫-৩০% বিবাহিত পুরুষ গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না।
২. মানসিক ও সামাজিক নির্যাতন:
- স্ত্রীরা অনেক সময় স্বামীদের প্রতি অবিচার করে, যা মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
- মিথ্যা যৌতুক মামলা বা নারী নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়।
- সন্তানদের দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
৩. অর্থনৈতিক নির্যাতন:
- কিছু স্ত্রী স্বামীকে পুরো পরিবারের খরচের জন্য চাপ দেন, কিন্তু স্বামীর উপার্জন কম হলে তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
- অনেক সময় স্বামীর সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালানো হয়।
আন্তর্জাতিক আইনে পুরুষ নির্যাতনের প্রতিকার:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইন থাকলেও, পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত। তবে কিছু দেশে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে বিশেষ আইন রয়েছে:
১. যুক্তরাষ্ট্র: “Violence Against Women Act (VAWA)” নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেও, পুরুষ নির্যাতনের বিষয়েও কিছুটা অন্তর্ভুক্তি আছে। কিছু রাজ্যে পুরুষদের জন্য সুরক্ষা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
২. যুক্তরাজ্য: “Domestic Abuse Act, 2021-এর আওতায় পুরুষদেরও সুরক্ষা দেওয়ার বিধান রয়েছে। পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হলে তারা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন এবং আইনি সহায়তা নিতে পারেন।
৩. ভারত: ভারতে Section 498A, IPC-এর আওতায় নারীরা যদি স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেন, তবে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু রায় দিয়েছে যেখানে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে পুরুষদের রক্ষা করা হয়েছে।
৪. কানাডা: Family Law Act-এর অধীনে পুরুষদের গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং তারা আশ্রয়কেন্দ্র ও মানসিক পরামর্শ পেতে পারেন।
আইনি ব্যবস্থা ও সীমাবদ্ধতা; বাংলাদেশের প্রচলিত আইন:
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইন থাকলেও, পুরুষ নির্যাতন নিয়ে সরাসরি কোনো আইন নেই। যেসব আইনের অপব্যবহার করে পুরুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়, সেগুলো হলো:
- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০,যা অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলায় ব্যবহৃত হয়।
- যৌতুক প্রতিরোধ আইন, ২০১৮, কিছু ক্ষেত্রে স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
আইনি সীমাবদ্ধতা:
- বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই।
- পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে ভয় পান, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না।
- পুরুষদের জন্য কোনো হেল্পলাইন বা আশ্রয়কেন্দ্র নেই।
কিছু বাস্তব উদাহরণ ও কেস স্টাডি:
১. ভারতের রামচন্দ্র কেস: রামচন্দ্র নামে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা যৌতুক মামলা দায়ের করেন, কিন্তু পরে আদালতে প্রমাণ হয় যে এটি মিথ্যা ছিল। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে উল্লেখ করে, “মিথ্যা মামলা দায়ের করা গার্হস্থ্য সহিংসতার একটি নতুন রূপ হতে পারে।”
২. যুক্তরাজ্যের মার্ক ব্রুক কেস: মার্ক ব্রুক নামে এক ব্যক্তি ১০ বছরেরও বেশি সময় তার স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। তার স্ত্রী তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন এবং সমাজের কাছে তাকে ছোট করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি পুলিশের সহযোগিতায় আইনি ব্যবস্থা নেন এবং আদালত তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
৩. যুক্তরাষ্ট্রের জন স্মিথ কেস: জন স্মিথ তার স্ত্রীর দ্বারা মানসিকভাবে নির্যাতিত হন। স্ত্রীর কারণে তার কর্মস্থলে সমস্যা হয় এবং তাকে তার সন্তানদের থেকে দূরে রাখা হয়। পরে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নেন এবং আইনের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন।
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের কিছু বাস্তব ঘটনা:
১. মিথ্যা মামলার শিকার একজন ব্যাংকার: ঢাকার একজন ব্যাংকারকে তার স্ত্রী মিথ্যা যৌতুক মামলায় ফাঁসান। পরে আদালতে প্রমাণিত হয়, তিনি নির্দোষ। কিন্তু মামলার কারণে তার চাকরি এবং সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়।
২. সন্তান দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত এক বাবা: চট্টগ্রামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। বিচ্ছেদের পর তিনি সন্তানদের দেখার অধিকার পাননি। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরেও সন্তানের সাথে যোগাযোগের অনুমতি পাননি।
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন রোধে করণীয় কি?
১. সচেতনতা বৃদ্ধি:
- সমাজে পুরুষ নির্যাতন সম্পর্কিত আলোচনা বাড়াতে হবে।
- মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে তথ্য প্রচার করতে হবে।
২. আইনি সংস্কার:
- পুরুষদের জন্য আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র ও সহায়তা হটলাইন চালু করা উচিত।
- গার্হস্থ্য নির্যাতন আইন পুরুষদের ক্ষেত্রেও কার্যকর করতে হবে।
৩. মানসিক সহায়তা:
- পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কাউন্সেলিং ও সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করা প্রয়োজন।
- আত্মহত্যার ঝুঁকি কমাতে হেল্পলাইন চালু করা উচিত।
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের প্রতিকার কী হতে পারে:
১. আইনি সংস্কার প্রয়োজন:
- পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে একটি আলাদা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
- মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করা দরকার।
২. সচেতনতা বৃদ্ধি করা:
- পুরুষ নির্যাতন নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে।
- মিডিয়া ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়, কারণ সামাজিকভাবে পুরুষদের শক্তিশালী ও নির্যাতনের উর্ধ্বে ভাবা হয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক পুরুষ শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হলেও সামাজিক লজ্জা ও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে তারা অভিযোগ করতে সাহস পান না। বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন একটি মেজর লুকায়িত সমস্যা।
পুরুষ নির্যাতন একটি বাস্তব সমস্যা, যা এখনো অনেকাংশে অগ্রাহ্য করা হয়। সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণার কারণে অনেক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েও অভিযোগ জানাতে দ্বিধা করেন। তবে আন্তর্জাতিকভাবে কিছু আইন পুরুষদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যদিও এখনো অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে সমাজকে এ বিষয়ে আরও সচেতন করা, পুরুষদের জন্য সমান আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য সহায়তার পথ উন্মুক্ত করা।
নির্যাতন নির্যাতনই, সেটা পুরুষের হোক বা নারীর। ন্যায়বিচার সবার প্রাপ্য।
লেখক: প্রকৌশলী অর্পণ পাল, বাংলাদেশ।
লেখককে অনেক ধন্যবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরুষেরাও ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু নারী নির্যাতন যেভাবে আলোচনা পায় সেভাবে পুরুষেরা নির্যাতনের শিকার হলে আলোচনায় তেমন স্থান পায় না এবং পুরুষদের রক্ষায় কোনো আইন দেশে আদৌও আছে কি না তাও দেশের মানুষ জানে না। জনসচেতনতায় এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারীদের মতো পুরুষদেরও রক্ষা করতে পারবে।