রোম স্মৃতি: রোম ভ্রমণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস!

আমার অনেকগুলো শখ এর  মধ্যে একটি হচ্ছে বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করা, তারই ধারাবাহিকতাই এবার কিছু দিন রোমে কাটিয়ে এলাম, রোম—যে শহরকে বলা হয় “চিরন্তন নগরী,” সেখানে কাটানো তিনটি দিন ছিল সত্যিই স্মরণীয়। ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর খাবারের এক অনন্য মিশ্রণ আমাকে অভিভূত করেছে। কলোসিয়ামের পুরনো ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে যেন এক মুহূর্তে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। চিরন্তন শহর রোম আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল তার বিস্ময়কর ইতিহাস, মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য এবং সুস্বাদু খাবারের মাধ্যমে। তিন দিনের এই ভ্রমণে আমি কলোসিয়াম, ত্রেভি ফোয়ারা, প্যানথিয়ন, এবং মহিমান্বিত ভ্যাটিকান সিটি ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। শহর ঘোরার জন্য আমি হপ-অন হপ-অফ বাস ব্যবহার করি, যা আমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সুযোগ দেয়। এছাড়াও, রোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ভালোভাবে সংযুক্ত। একবারের যাত্রার জন্য বাস বা মেট্রো টিকিট €1.50, আর তিন দিনের (৭২ ঘণ্টার) পাস €18, যা পর্যটকদের জন্য দারুণ লাভজনক।
রোম স্মৃতি
ছবি: রোম স্মৃতি কিছু ফটোগ্রাফি।

প্রথম দিন: হপ-অন হপ-অফ বাসে রোমের আকর্ষণীয় স্থান ঘোরা!

আমরা প্রথম দিন রোম শহর ঘুরতে হপ-অন হপ-অফ বাস ব্যবহার করি। এটি পর্যটকদের জন্য বেশ সুবিধাজনক, কারণ এটি শহরের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলোর সামনে থামে, এবং আপনি ইচ্ছামতো বাস থেকে নেমে জায়গাগুলো ঘুরে আবার বাসে উঠতে পারেন।

বাস আমাদের প্রথমে নিয়ে যায় কলোসিয়াম, যেখানে আমরা বিশাল এই রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারের গৌরবময় অতীতের সাক্ষী হই। এরপর বাস থামে রোমান ফোরাম ও পালাটাইন হিল-এ, যা একসময় রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা আবার বাসে উঠি এবং পিয়াজা ভেনেজিয়া, সান্তা মারিয়া মাগিওরে, কাস্তেল সান্ত’আঞ্জেলো ও সার্কাস ম্যাক্সিমাস-এর মতো বিখ্যাত স্থানে থেমে ঘুরে দেখি।

দ্বিতীয় দিন: রোমান সৌন্দর্যের খোঁজে!

পরদিন সকালে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল ভ্যাটিকান সিটি, ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পবিত্রতম স্থান। সেন্ট পিটার্স বাসিলিকা এবং ভ্যাটিকান মিউজিয়াম ঘুরে আমি মাইকেলেঞ্জেলোর অসাধারণ শিল্পকর্মের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাই। বিশেষ করে সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদচিত্র এক কথায় অভূতপূর্ব।

রোমের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি খেয়ে নিলাম সাপ্লি, যা একটি ভাজা রাইস বলের মতো, যার ভেতরে মোজারেলা চিজ থাকে—খুব মজাদার এবং পকেট-সাশ্রয়ী! দুপুরে আমি খেয়েছিলাম এক বিখ্যাত ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে, যেখানে কাচিও এ পেপে নামে এক বিশেষ পাস্তার স্বাদ নিলাম। মাত্র কয়েকটি উপাদানে তৈরি এই পাস্তা যেমন সহজ, তেমনই সুস্বাদু।

বিকেলে আমি গেলাম ত্রেভি ফোয়ারা দেখতে। রোমে এলে এখানে কয়েন না ছুঁড়লে যেন ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়! প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ফোয়ারার পানিতে কয়েন ফেললে আবার রোমে ফেরার সুযোগ হয়। আমি সে বিশ্বাসে এক ইউরোর কয়েন ছুঁড়ে দিলাম!

তৃতীয় দিন: স্থানীয় জীবন ও কেনাকাটা!

শেষ দিনে আমি একটু ধীরে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং রোমের স্থানীয় বাজার ও ছোট গলিগুলো ঘুরে দেখলাম। কাম্পো দে ফিরি এবং পিয়াজা নভোনা এলাকায় অনেক ক্যাফে আর দোকান আছে, যেখানে স্থানীয়দের মতো সকালটা উপভোগ করা যায়। ছোট এক ক্যাফেতে বসে ক্যাপুচিনো আর ক্রোয়াসাঁ খেতে খেতে শহরের পরিবেশ উপভোগ করছিলাম।

স্মৃতিচিহ্ন কেনার জন্য আমি গেলাম ভিয়া দেল করসো ও পিয়াজা দি স্পাগনা-তে। এখানে ছোটখাট চমৎকার উপহার পাওয়া যায়, যেমন মিনিয়েচার কলোসিয়াম, রোমান ম্যাগনেট, চামড়ার ব্যাগ ইত্যাদি। এছাড়া, রোমের বিখ্যাত জেলাতো না খেলে কি চলে? ভ্যানিলা আর পিস্তাচিও ফ্লেভারের জেলাতো নিয়ে শেষবারের মতো রোমের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

রোম ভ্রমণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস!

  • পরিবহন: হপ-অন-হপ-অফ বাস ট্যুর খুবই সুবিধাজনক। একক বাস টিকিট €১.৫০, আর ৭২ ঘণ্টার ট্র্যাভেল পাস €১৮
  • খাবার: ক্যাফেতে ক্যাপুচিনো €১.৫০, তবে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে বেশি পড়তে পারে। পিজ্জার দাম €৬ থেকে শুরু।
  • থাকাটার্মিনি স্টেশনের আশেপাশে হোটেল বা এয়ারবিএনবি নিলে যাতায়াতের সুবিধা হয়।
  • সুভেনির: স্মৃতিচিহ্ন কেনার জন্য ছোট দোকান বা বাজার থেকে কিনলে দাম তুলনামূলক কম পড়ে।

রোমের খাবার সত্যিই অসাধারণ। আমি দুটি বাংলা রেস্টুরেন্ট, সোনার বাংলা এবং টেস্ট অব ইন্ডিয়াতে খাওয়ার সুযোগ পাই, যেখানে সুস্বাদু বিরিয়ানি, কারি এবং নান পরিবেশন করা হয়। যারা বিদেশে থেকেও পরিচিত স্বাদ পেতে চান, তাদের জন্য এই রেস্টুরেন্টগুলো উপযুক্ত। এছাড়া, আমি ইতালির কিছু বিখ্যাত খাবারের স্বাদ নিয়েছি। পিজ্জা সাধারণত €৬ থেকে শুরু হয়, এবং জনপ্রিয় আইটেমগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্গারিটা, ডিয়াভোলা (মশলাদার সালামি), এবং কোয়াত্রো ফরমাজি (চার ধরনের পনির)। পাস্তা ইতালির অন্যতম প্রধান খাবার, এবং এর মধ্যে কাচিও এ পেপে (চিজ ও গোলমরিচ) এবং কার্বনারা (ডিম, প্যানচেটা ও পেকোরিনো চিজ) খুবই জনপ্রিয়।  

ডেজার্টের মধ্যে তিরামিসু ছিল দারুণ, তবে এটি কেনার আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে এতে অ্যালকোহল রয়েছে কি না। জেলাতো (ইতালিয়ান আইসক্রিম) অত্যন্ত মজাদার, এবং এক স্কুপের দাম €২-৪ এর মধ্যে। রোমের ক্যাফেগুলো খুব সুন্দর এবং এখানকার ক্যাপুচিনো মাত্র €১.৫০ থেকে পাওয়া যায়, তবে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে এটি আরও বেশি হতে পারে। রাস্তার খাবারের মধ্যে সাপ্লি (ভাজা মোজারেলা ভরা রাইস বল) এবং আরাঞ্চিনি (মাংস ও পনির ভরা রাইস বল) বেশ জনপ্রিয়, যা দ্রুত কিছু খেতে চাইলে দারুণ অপশন।

থাকার জন্য টার্মিনি স্টেশনের কাছাকাছি থাকা সবচেয়ে ভালো, কারণ এখান থেকে পরিবহন ব্যবস্থা সহজে পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও দোকানও কাছাকাছি থাকে। স্মৃতিচিহ্ন (সুভেনির) কেনার জন্য অসংখ্য দোকান রয়েছে, যেখানে মিনিয়েচার কলোসিয়াম, চাবির রিং, ম্যাগনেট, চামড়ার জিনিসপত্র, এবং হস্তশিল্পের গহনা পাওয়া যায়। রোমের বাজারগুলোতে ন্যায্য মূল্যে সুন্দর উপহার কেনার সুযোগ থাকে।

সব মিলিয়ে, রোম এক অনন্য শহর, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সুস্বাদু খাবারের অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে। প্রাচীন স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করা, ত্রেভি ফোয়ারায় কয়েন ছোঁড়া, কিংবা একটি আসল ইতালিয়ান পিজ্জার স্বাদ নেওয়া প্রতিটি মুহূর্তই মনে রাখার মতো। যদি কখনও রোমে ভ্রমণের সুযোগ হয়, তবে পরিকল্পনা করে ঘুরুন, বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিন এবং এই চিরসবুজ শহরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করুন!

লেখিকা: আনিকা জেরিন চৌধুরী, শিক্ষিকা। 

আরও পড়তে পারেন: শিশুর মূল্যবোধ ও আচরণ গঠনে পরিবারের ভূমিকা

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading