এক সাহসী বীরঙ্গনা (মহিলা সাহাবীর যুদ্ধের গল্প)

ভূমিকা: এটি এক সাহসী নারী বীরঙ্গনা সাহাবিয়ার গল্প যিনি খন্দক যুদ্ধের বিজয়ে অবধান রেখেছিলেন। সম্মানিত লেখক খন্দক যুদ্ধের ছোট্ট একটি ঘটনা গল্পাকারে তুলে ধরেছেন।

এক সাহসী বীরঙ্গনা (মহিলা সাহাবীদের যুদ্ধের গল্প)

পুরুষ ও নারী মহান আল্লাহর এক আজব সৃষ্টি। সৃষ্টিগতভাবে নারীরা পুরুষের চেয়ে দুর্বল। কিন্তু তাই বলে তারা ভীরুর জাতি নয়। তাদের মাঝেও রয়েছে শৌর্যবীর্য, শক্তি- সাহস ও ঈমানী চেতনা। রয়েছে ইসলামের শত্রু ও মুসলিম বিদ্বেষী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা। এ এক ঐতিহাসিক সত্য কথা। যুগে যুগে এমন অনেক নারী অতিবাহিত হয়েছেন যাদের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসী কর্মকাণ্ড দ্বারা এ সত্যটিই উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায় ৷

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফু হযরত সুফিয়া (রা.) ছিলেন একজন নির্ভীক মহিলা। ছিলেন অকুতোভয় নারী। বীর যোদ্ধা হযরত হামযা (রা.) ছিলেন তাঁর সহোদরা ভাই । ঐতিহাসিক খন্দক যুদ্ধে যে শক্তি ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনি তা কেয়ামত পর্যন্ত আগত নারীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে ।

সাহসী বীরঙ্গনা। মহিলা সাহাবিদের যুদ্ধের গল্প ও ছবি
ছবিঃ তলোয়ার হাতে এক সাহসী মুসলিম নারী। ছবি: pexels থেকে। ফটোগ্রাফার: Azis Js

খন্দকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিরাপত্তার জন্য সকল মহিলাকে একটি দূর্গে আবদ্ধ করে সবল ও সাহসী পুরুষদের নিয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আর হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) কে রেখে গিয়ে ছিলেন মহিলাদের পাহারাদার হিসেবে।

ইসলামের চির দুশমন ইহুদি গোষ্ঠী এ সংবাদ জানতে পেরে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। ভাবলো, মুসলিম মেয়েদের হত্যা ও নাস্তানাবুদ করার এই তো সুযোগ। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না ।

মহিলাদের উপর কখন কিরূপে আক্রমণ করা যায় এ নিয়ে তারা পরামর্শ করলো। সিদ্ধান্ত হলো, দূর্গের অনতিদূরে আমরা শিবির স্থাপন করবো এবং এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য পর্যবেক্ষক হিসেবে একজন লোক পাঠাবো, সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা একদল সৈন্য নিয়ে মহিলাদের দূর্গের কাছে এসে শিবির স্থাপন করলো এবং একজনকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য গুপ্তচর হিসেবে পাঠালো। তাকে বলে দিলো, তুমি যে কোনো উপায়ে এ খবর নিয়ে ফিরে আসবে যে, দূর্গে শুধু মহিলারাই আছে নাকি সঙ্গে পুরুষ লোকও আছে ।

মুসলিম মেয়েদের মাঝে হযরত সুফিয়া (রা.)ও ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে সতর্ক দৃষ্টি ফেলছিলেন চতুর্দিকে। এক সময় হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেলো গুপ্তচরের প্রতি। তিনি দেখলেন, ইহুদি গুপ্তচরটি অতি সংগোপনে ধীর গতিতে দূর্গের দিকে এগিয়ে আসছে ।

শত্রু নিধন কিংবা শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য শক্তির সাথে বুদ্ধিরও প্রয়োজন। তাই তো দেখা যায়, হযরত সুফিয়া (রা.) গুপ্তচর ইহুদিকে দেখে হৈ চৈ করলেন না। এমনকি ভয়ে ভীতও হলেন না । বরং তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.)কে বললেন, আপনি দ্রুত ঐ গুপ্তচরকে আঘাত করুন। কিন্তু তিনি ছিলেন দুর্বল। দুর্বলতার কারণে এ-কাজে তার সাহস হলো না। তিনি বলতে লাগলেন- আরে, আমার যদি এরূপ শক্তি সাহসই থাকতো, তবে আর আমি এখানে কেন? আমি তো তাহলে যুদ্ধের ময়দানেই থাকতাম ।

এবার হযরত সুফিয়া (রা.) চিন্তা করলেন, দূর্গে যেহেতু হাসসান ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষ নেই সুতরাং গুপ্তচরকে সমুচিত শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হবে। তাই তিনি দেরি করলেন না । সজোরে তাবুর একখানা খুঁটি তুলে নিয়ে দ্রুত গুপ্তচরের দিকে এগিয়ে গেলেন । তারপর প্রচণ্ড এক আঘাত হানলেন গুপ্তচরের মাথায়।

ইহুদি গুপ্তচরটি এমন একটি পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। সে ভাবতেও পারেনি, কোনো মহিলা তাকে আঘাত করতে পারে । আঘাত খেয়ে গুপ্তচর ধরাসায়ী হলো। মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত বেরুতে লাগলো ফিনকি দিয়ে। তারপর একসময় নীরব নিথর হয়ে গেলো চিরদিনের মতো।

গুপ্তচরকে হত্যা করে হযরত সুফিয়া (রা.) পুনরায় হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) এর নিকট ফিরে এলেন। বললেন, নিহত লোকটি বেগানা পুরুষ বিধায় আমি তার যুদ্ধের পোষাক ও অস্ত্র-সস্ত্র খুলে আনতে পারি নি, আপনি গিয়ে এ কাজটি করে আসুন। কিন্তু দুর্বলতার কারণে হযরত হাসসান (রা.) এ কাজটি করতেও সাহস পেলেন না। অগত্যা নিরুপায় হয়ে হযরত সুফিয়া (রা.) পুনরায় সেখানে গেলেন। অতঃপর ঐ ইহুদি চরের মাথা কেটে দেয়ালের উপর দিয়ে ইহুদি শিবিরের ভিতরে নিক্ষেপ করলেন ।

হযরত সুফিয়া (রা.)-এর উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসিকতায় দারুণ কাজ হলো। শিবিরের ইহুদিরা গুপ্তচরের ছিন্ন মস্তক দেখে যথেষ্ট ভয় পেলো । তারা ভাবলো, নিশ্চয় দূর্গের অভ্যন্তরে মহিলারা একা নয়। তাদের সাথে পুরুষ যোদ্ধাও রয়েছে। কারণ মহিলাদের পক্ষে একজন প্ৰশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচরকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার ছিন্ন মস্তক শিবিরের ভিতর নিক্ষেপ করা কখনোই সম্ভব নয় । এই ভেবে তারা ষড়যন্ত্রের সকল চিন্তা বাদ দিয়ে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। ফলে মুসলিম মহিলারাও একটি অবশ্যম্ভাবী হামলা থেকে বেঁচে গেলেন ৷

প্রিয় পাঠক! খন্দকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় ৫ম হিজরিতে। এ সময় হযরত সুফিয়া (রা.) এর বয়স হয়েছিল আটান্ন বছর। এই বৃদ্ধ বয়সে সাধারণতঃ মেয়েরা ঘরের কাজকর্মেরও অযোগ্য হয়ে যায় । অথচ হযরত সুফিয়া (রা.) একাকী তাবুর খুঁটি তুলে নিয়ে শুধু ইহুদি গুপ্তচরকে হত্যাই করেন নি, তার কর্তিত মাথাও শিবিরের অভ্যন্তরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন । একি বাস্তবিক পক্ষেই বিরাট দুঃসাহসের কথা নয়?

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! বর্তমান পৃথিবীর আনাচে কানাচেও ছড়িয়ে আছেন এমন অনেক সাহসী বীরঙ্গনা। যারা শয়তানী চক্রান্ত ও দুশমনের ভয়ে ভীতু নন। যারা দীন ও ঈমানের সংরক্ষণ এবং ইসলাম ও মুসলমানদের হিফাজতের জন্য পেশ করতে পারেন সর্বোচ্চ কুরবানি। যারা হতে পারেন বীরঙ্গনা নারী হযরত সুফিয়া (রা.)-এর সুযোগ্য উত্তরাধীকারিণী। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন তারা সকল শক্তি সামর্থ নিয়ে ইসলাম সম্মত পন্থায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন সকল কুচক্রি শক্তির মোকাবেলায় । সূত্র ঃ উসদুল গাবা ৷

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। গল্পের বইঃ নারী জীবনের চমৎকার কাহিনী থেকে।

আরও যুদ্ধের গল্প ও ঘটনা:

০১. দুই কিশোর (বদর যুদ্ধের গল্প)

০২. অভিভূত জার্জিস কন্যা (ইসলামিক যুদ্ধের গল্প)

০৩. মুসলমানদের যুদ্ধ জয়ের গল্প

০৪. অপূর্ব রাসূল প্রেম (রাসূলের প্রতি ভালোবাসার গল্প)

০৫. প্রিয়তমা : প্রিয়তমাকে হৃদয়স্পর্শী চিঠি!

প্রিয় পাঠকা পাঠিকা, আশা করি এই সাহসী বীরঙ্গনা নারীর গল্পটি পড়ে আপনাদের ভালো লেগেছে এবং এটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।

Leave a Comment