ইরানের বলখ রাজ্য। বহুদিন পূর্বে এ এলাকার শাসনকর্তা ছিলেন শাহ সুলতান নামক এক খােদাভীরু ও ধার্মিক ব্যক্তি। তার কেবল একটি মাত্র সন্তান ছিল। নাম মাহমুদ। পিতার একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে শৈশব থেকে তিনি অত্যন্ত আদর-যত্নে লালিত পালিত হন। ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি বিলাস প্রিয় হয়ে উঠেন। আরাম-আয়েশের প্রতি গড়ে উঠে এক দুর্বার আকর্ষণ।
পিতার মৃত্যুর পর, পুত্র মাহমূদ সিংহাসনে আরােহণ করেন। অত্যধিক বিলাসী হওয়ার কারণে তিনি বহু সংখ্যক সুন্দরী নারীকে আপন খেদমতের জন্য নিয়ােজিত করেন। তবে খুব বেশিদিন তিনি বিলাসিতার জীবন কাটাতে পারেননি। পর পর কয়েকটি ঘটনার কারণে তার জীবনের মােড় পরিবর্তন হয়ে যায়। এবার পাঠকবৃন্দের সম্মুখে সে চমকপ্রদ ঘটনাগুলােই তুলে ধরছি।
প্রথম ঘটনা : ফুল শয্যায় দাসীর শয়ন!
সুলতান মাহমুদের বাস ভবন। শয়ন কক্ষে জনৈকা সুন্দরী দাসী। হৃদয়ের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে বিচিত্র বর্ণের ফুল দিয়ে সুলতানের শয়নকক্ষ সুসজ্জিত করছে সে। এটা তার নিয়মিত কাজ। সুলতান ঘুমােতে আসার পূর্বে সুশােভিত ফুল দিয়ে প্রতিদিন রাত্রে সে পুরাে কক্ষটিকে বিমােহিত করে তুলে। নরম তুলতুলে বিছানা বালিশগুলােকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। অন্য কাজে সে যতই ব্যস্ত থাকুক কেন, এ কাজে সে কোনােদিন অবহেলা করে না। গাফলতি করে না। প্রতিদিন ঘর গােছানাের কাজে তার বেশ সময় ব্যয় হয়। আজকে খানিক আগে এসে আরেকটু সময় বেশি নিয়ে সে মনের মতাে করে রুমটি সাজিয়েছে। সুলতান আসার আর কিছু সময় বাকি আছে। এই ফাঁকে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় তার মুখ থেকে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ভাবে, হায়! আজ কতদিন যাবত সুলতানের শয়ন কক্ষ সাজিয়ে-গুছিয়ে দেই। ফুলশয্যা তৈরি করি। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও এ শয্যায় শােয়ার মজা উপভােগ করতে পারলাম না। হায় আফসােস! তারা বাদশাহ আর সুলতান বলে দুনিয়াতে কত আনন্দ উপভােগ করল। যা ইচ্ছে তাই করল।
কিন্তু আমাদের মতাে দাসীদের ভাগ্যে তাদের খেদমত করা ও মন যুগিয়ে চলা ছাড়া আর কিছুই জুটল না। যাক আজকে যখন অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই কাজ শেষ করে ফেলেছি এবং কক্ষটিও মনের মতাে করে সাজিয়েছি, সুতরাং সুলতান আসার আগে অল্প সময়ের জন্য এ বিছানায় একটু শুয়ে নেই। সুলতান তাে প্রতিদিন এ শয্যায় শয়ন করেন। আমি অল্প সময় এতে শুয়ে নিলে তেমন কি ক্ষতি হয়!
কথাগুলাে ভাবতে ভাবতে সত্যিই সে নিজের হাতে তৈরিকৃত ফুল শয্যায় শুয়ে পড়ল। ঘুমানাের কোনাে ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু এত সুন্দর আরামের বিছানায় তাে জীবনে সে কোনােদিন শােয়নি। তাই ইচ্ছে না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। নিজেকে সঁপে দেয় নিদ্রার কোলে।
এদিকে সুলতান যথাসময়ে বিশ্রাম নিতে এসে দেখলেন, তার দাসী তারই শয্যায় বড়ই আরামের সাথে ঘুমুচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। রাগে আগুন হয়ে চোখ লাল করে ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ সিংহের মতাে গর্জন করে বললেন, কত বড় স্পর্ধা! সুলতানের ফুলশয্যায় দাসীর ঘুম! সাহস তাে দেখছি কম নয় !!
একথা বলে সুলতান জল্লাদকে ডেকে এনে নির্মম নির্দেশ দিলেন। বললেন, এই দাসীকে আচ্ছামত বেত্রাঘাত কর। বুঝিয়ে দাও, সুলতানের ফুল শয্যায় শয়নের স্বাদ! | সুলতানের নির্দেশ শিরােধার্য। তার বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্রই জল্লাদ দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ঘুমন্ত দাসীর উপর একের পর এক বেত্রাঘাত করতে লাগল।
প্রথম বেত্রাঘাতের পর, দাসী চমকে উঠে বসতেই সুলতানকে সামনে দন্ডায়মান দেখতে পেল। ক্ষণকালের জন্য সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে শাস্তির প্রকৃত কারণ বুঝতে সক্ষম হলাে। সাথে সাথে সে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সুলতানকে কিছু বলতে যাবে, ঠিক এ মুহূর্তে প্রচন্ড বেগে আরেকটি বেত্রাঘাত তার পিঠের উপর এসে পড়ল । ফলে তার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব হলাে না। সে জমিনে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু তথাপি তার শাস্তি বন্ধ হলাে না।
এভাবে বিরামহীন ভাবে বেত্রাঘাতের ফলে দাসীর পরিহিত বস্ত্র ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বারতে লাগল। তার আর্ত-চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল । তবু সুলতানের মনে সামান্যতম দয়ার উদ্রেক হল না ।
এ অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ চলল। অতঃপর হঠাৎ করেই এক অভাবনীয় দৃশ্যের সূচনা হলাে। যা এ মুহূর্তে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু হ্যাঁ, যা অসম্ভব, অবাস্তব ও কল্পনারও অতীত, এ মুহূর্তে দাসী সে কাজটিই করে দেখাল। সে বেত্রাঘাতের এক পর্যায়ে হঠাৎ করে খিল খিল করে হেসে দিল। তার হাসির শব্দ দূরে অবস্থানরত অন্যান্য দাসীরাও শুনতে পেল।
>দাসীর এ হাসিকে সুলতান চরম বেয়াদবী মনে করলেন। তাই তিনি আরাে রাগান্বিত হয়ে আরাে প্রচন্ড জোড়ে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিলেন। এতদ্বশ্রবনে দাসী আরাে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই একটু কেঁদে আবার পূর্বের ন্যায় খিল খিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল
কিছুক্ষণ ক্রন্দন, কিছুক্ষণ হাসি এরূপ অবস্থা কয়েকবার হলাে । সুলতান ভাবলেন, ঘটনা কি? তার এরূপ করার কারণ কি? তবে কি দাসীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? হয়ত তাই হবে। নচেৎ এমন করার তাে কথা নয়। বেত্রাঘাত তাে এমন কোনাে মজার জিনিস নয়, যা খেয়ে মুখে হাসি আসে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে হৃদয়-মন ।
এভাবে ক্ষণকাল চিন্তা করার পর সুলতান ভাবলেন, এ নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার প্রয়ােজন কি? দাসী তাে আমার সামনেই আছে । হাসিকান্নার এ বিপরীতধর্মী আচরণের কারণ, তার কাছ থেকেই তাে জেনে নিতে পারি ।
সুলতান দাসীকে লক্ষ্য করে বললেন, কি হে দাসী! তােমার এই রহস্যময় আচরণের কারণ কি? পরিস্কার করে খুলে বল। নইলে এক্ষুণি তােমার গােশত ও চামড়া পৃথক করে ফেলব। জল্লাদের নিষ্ঠুর শাস্তি তােমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেবে। সুতরাং যদি বাঁচতে চাও, তবে সব কিছু খুলে বর্ণনা কর।
দাসী অনেক কষ্ট করে দাঁড়াল। সে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, মহারাজ! আমার যে বলতে ভয় হচ্ছে।
সুলতান বললেন, তােমার কোনাে ভয় নেই, শংকা নেই। তুমি নির্ভয়ে বলতে পার।।
দাসী বলল, জাহাপনা! আমাকে বেত্রাঘাত শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমি কখনাে হেসেছি, কখনাে কেঁদেছি। আর এটাই হলাে আপনার বিস্ময়ের কারণ। জনাব! আমি হেসেছি এজন্য যে, আপনার ফুল শয্যায় মাত্র একবার অল্প ক্ষণের জন্য শুয়ে যে অপরাধ করেছিলাম, সেই অপরাধের নির্মম শাস্তি আমি ভােগ করছিলাম, আর পাপমুক্ত হচ্ছিলাম। পাশাপাশি আখেরাতের জীবনে এর থেকে কোটি কোটি গুণ উত্তম বেহেশতের একটি ফুল শয্যার নেয়ামত অন্তর চোখে দেখে আনন্দে হাসছিলাম।
আর কাঁদছিলাম এজন্য যে, ভুলবশতঃ আপনার ফুলশয্যায় সামান্য সময় শয়নের অপরাধে আমি কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি ভােগ করছি, কিন্তু গােটা জীবন আপনি ফুল শয্যায় শুয়ে কাটাচ্ছেন, তার অপরাধে মাওলা পাক আপনার জন্য কতই না কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করছেন, কত নির্মম ও মর্মন্তুদ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে আপনাকে। আপনার সেই ভয়াবহ শাস্তির কথা চিন্তা করেই আমি বার বার কেঁদে উঠেছিলাম। কথা শেষ করে মেয়েটি পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ।
দাসীর কথাগুলাে সুলতান অত্যন্ত মনযােগ সহকারে শ্রবণ করলেন। তার মনে জ্বলে উঠল অনুতাপের আগুন । ভাবলেন, সত্যিই তাে! সামান্য অপরাধের কারণে একটি দুর্বল নারীর উপর আমি এত বেশি অত্যাচার করলাম । আর আমার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীনের হুকুম দিবা-রাত্রি আমি লঙ্ঘন করে চলছি, তার নিষিদ্ধ কাজগুলােতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রয়েছি, সুতরাং পরকালে না জানি আল্লাহ তা’আলা আমার জন্য কত ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন!
দ্বিতীয় ঘটনা : মুসাফীর!
প্রথম ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর সুলতান মাহমুদ একদিন সিংহাসনে বসে আছেন। গণ্যমান্য পরিষদবর্গ নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। শত-সহস্র প্রহরী বেষ্টিত সভাকক্ষ। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কারাে পক্ষেই পূর্ব অনুমতি ব্যতীত ভিতরে প্রবেশের সুযােগ নেই। স্বয়ং সুলতান বাদশাহী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
সুলতান বিভিন্ন বিষয়ে সভাসদদের সাথে মত বিনিময় করছেন । একের পর এক দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় এক সুন্দর সুদর্শন পুরুষ এসে সুলতানকে সালাম দিলেন। সুলতান জবাব দিয়ে সবিস্ময়ে আগন্তুকের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন–
: আপনি এখানে কেন এসেছেন?
: আপনার এই মুসাফির খানায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে চাই। আগন্তুক শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন।
: জনাব! আপনি ভুল করেছেন। এটা মুসাফিরখানা নয়। এটা আমার শাহী দরবার।
: মহামান্য সুলতান! ভুল বােধ হয় আপনিই করেছেন। আমি করিনি। আগন্তুক মৃদু হেসে বললেন।
: এটা আমার প্রাসাদ। দীর্ঘদিন যাবত এখানে থাকি। সুতরাং ভুল হওয়ার তাে প্রশ্নই উঠে না।
: জাহাপনা! তাহলে আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন।
: বলুন, আপনার কি প্রশ্ন?
: আপনার আগে এ প্রাসাদে কে বাস করত?
: আমার আব্বা।
: তার আগে?
: আমার দাদা
: তার আগে?
: আমার দাদার আব্বা।
: আপনার পরে এ প্রাসাদে কে বাস করবেন?
: কেন, আমার ছেলে।
: তারপর?
: আমার নাতি।
: তারপর?:
: তার ছেলে।
:বাদশাহ মহােদয়! আপনার কথায় বুঝা যাচ্ছে, কেউ এখানে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করেননি এবং করবেনও না।
: হ্যা। বাস্তবতা তাে তাই।
: বাস্তবতা যদি তা-ই হয়, তবে এমন প্রাসাদকে মুসাফিরখানা ছাড়া আর কী বলা যায়? সুতরাং এর জন্য চিন্তা-চেতনা, শক্তি-সামর্থ, সহায়-সম্পত্তি খরচ না করে চিরস্থায়ী প্রাসাদের জন্য চিন্তা-ফিকির করা উচিত নয় কি?
এতটুকু বলে আগন্তুক দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুলতান অনেক চেষ্টা করেও তাকে রুখতে পারলেন না। তিনি চিৎকার করে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। আগন্তুক দূর থেকে বললেন, আমি খিজির (আ.)। সুলতান খুব দ্রুত তার দিকে দৌড়ালেন, কিন্তু তাকে আর দেখতে পেলেন না। এ ঘটনা সুলতানের মনে গভীর রেখাপাত করল। জীবনের মােড় পাল্টে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করল।
তৃতীয় ঘটনা : সুলতানের স্বপ্ন!
দ্বিতীয় ঘটনার কয়েকদিন পরেই সুলতানের জীবনে ঘটে গেল আরেকটি অভূতপূর্ব ঘটনা। সেই ঘটনাই তার জীবনে চূড়ান্ত পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ-
গভীর রাত। নিকষ কালাে অন্ধকার গােটা পৃথিবীকে গ্রাস করে নিয়েছে বহু আগেই। সুলতান আপন প্রাসাদের নির্দিষ্ট কক্ষে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ ছাদের উপর কিসের যেন খট খট শব্দে সুলতানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সুলতান আশ্চর্য হলেন। ভাবলেন, ছাদের উপর এমন সময় এরূপ শব্দ তাে জীবনে কোনােদিন শুনিনি। আওয়াজটা মানুষ চলার শব্দের ন্যায়। তবে কি ছাদে কোনাে চোর-ডাকাত এলাে? না, তা হতে পারে না। চারিদিকে প্রহরী বেষ্টিত প্রাসাদ, মজবুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, চতুস্পর্শে লৌহ প্রাচীর-এতকিছু ডিঙ্গিয়ে প্রাসাদের ছাদে কারাে আগমন করা মােটেই সম্ভব নয়। যদি তাই হয়, তবে কি আমি স্বপ্ন দেখছি?
সুলতানের চিন্তা শেষ হয়নি। এমন সময় পূর্বের ন্যায় আওয়াজ আবারাে ভেসে এল সুলতানের কানে। তিনি আওয়াজের প্রতি মনােযােগ দিলেন। কয়েকবার একই ধরনের আওয়াজ শুনে তিনি নিশ্চিত হলেন এটা কোনাে মানুষের চলার শব্দ। এবার সুলতানের মনে ভয় ঢুকে গেল। তিনি ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন-
: ছাদের উপর কে?
: আমি একজন উটের রাখাল । অপরদিক থেকে শান্ত কণ্ঠের শংকাহীন জবাব।
: এখানে কেন এসেছ?
: আমি একটি উট হারিয়েছি। সেটা খোজার জন্যই এখানে এসেছি।
: আহমক কোথাকার! গভীর রাতে ছাদের উপর উট পাওয়া যায় নাকি? সুলতানের কন্ঠে বিস্ময়। সেই সাথে ক্রোধও।
: মহামান্য সুলতান! আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন। আমি আপনার নিকট কেবল একটি প্রশ্নের জবাব চাই। আমার জিজ্ঞাসা হলাে, যদি গভীর রাতে ছাদের উপর উট পাওয়া না যায়, তবে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুশােভিত প্রাসাদের ফুলশয্যায় শয়ন করে কেমন করে মহান আল্লাহকে পাওয়া যাবে?
: ভাই! তুমি তাে ঠিক কথাই বলেছ? এবার বল, তােমার আসল পরিচয় কি? |
: আমি আল্লাহর এক নগণ্য বান্দা । একথা বলেই লােকটি চলে গেল।
সুলতান দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে ছাদে গিয়ে দেখলেন, সেখানে কোনাে মানুষ নেই। তিনি বুঝে নিলেন, এ লােক আল্লাহর ফিরিশতা ছাড়া আর কিছুই হবে না। আল্লাহ পাক দয়া করে আমাকে সতর্ক করার জন্য ফেরেশতাকে মানুষের রূপে আমার নিকট পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমার আর বসে থাকার সময় নেই। একথা বলে সুলতান সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহকে পাওয়ার আশায় অজানার পথে বেড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার সাধনায় পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছিলেন। |
প্রিয় পাঠক! আলােচ্য ঘটনাগুলাে আমাদের জন্য বড় শিক্ষনীয় ঘটনা নয় কি? আমাদের মধ্যে কি এমন লােকের অভাব আছে, যারা বাদশাহী হালতে জীবন যাপন করছি? আরাম আয়েশের যাবতীয় উপকরণ ঘরে আছে। জীবনে কোনােদিন অভাবের মুখ দেখিনি। অথবা এক সময় অভাবী থাকলেও বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক। গাড়ী আছে। বাড়ি আছে। মিল-ফ্যাক্টরী আছে। খেদমতের জন্য খাদেম আছে। বাসার সামনে মনমুগ্ধকর বাগান আছে। মােটকথা, একটি মানুষ সুখী হওয়ার জন্য বাহ্যত যা প্রয়ােজন, সবই আছে।
কিন্তু অভাব কেবল একটি জিনিসের। তা হলাে, যে খােদা আমাকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাকে এত নিয়ামত দিয়েছেন, যার অনুগ্রহ আর দয়া ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, সেই খােদাকে আমি চিনি নি। চিনতে চেষ্টাও করিনি। দিন রাত অহরহ তার নাফরমানি করে চলছি। তার হুকুমগুলাে পদদলিত করছি। তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন সেগুলাে নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছি। কথায় কথায় মিথ্যা বলছি। সুদ খাচ্ছি। ঘুষ গ্রহণ করছি। অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভােগ দখল করে খাচ্ছি। অধীনস্থ লােকদের উপর অত্যাচারের স্টীম রােলার চালাচ্ছি। তাদেরকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও কুণ্ঠাবােধ করছি। তাদের অধিকারগুলােকে পায়ের তলায় পিষ্ট করছি। ছােট বড় কারাে হক আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হচ্ছি। না। টাকা আর ক্ষমতার দাপটে যা ইচ্ছে তাই করছি। শােষণ করছি। নির্যাতন চালাচ্ছি। চিত্ত-বিনােদনের নামে অশ্লীল কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়ছি। ডিস এন্টিনার সংযােগ দিয়ে, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা পাঠ করে কিংবা সিডি চালিয়ে নিজের চরিত্রকে কলুষিত করছি। আপন সন্তানদের জীবনকেও ধ্বংস করছি। উপরন্তু এগুলাের শেষ পরিণতি কি হবে- একথা একটি বারের জন্য চিন্তাও করছি না।
মুহতারাম ভাইগণ! এই যাদের অবস্থা, উপরােক্ত ঘটনাগুলাে পাঠ করে জীবনের পরিবর্তন আনার সময় কি তাদের এখনাে হয়নি? আমার প্রাণের ভাইগণ! মনে রাখবেন, দুনিয়ার জীবন খুবই অল্প। একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। যে কোনাে মুহূর্তে আপনার জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে আপনার সকল কর্ম কোলাহল। কিন্তু শত আফসােস আর দুঃখ হবে তখন, যখন আপনি উপরে বর্ণিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবেন; জীবনকে নতুন করে, নতুন রূপে ঢেলে সাজানাের পূর্বেই যদি আপনার ডাক এসে যায়; সুলতান মাহমুদের মতাে জীবনের গতি পরিবর্তনের আগেই যদি আপনি মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করেন।
প্রিয় ভাইটি আমার! মৃত্যু কোন্ সময় আসে বলা যায় না। সুতরাং অতীত জীবনের যাবতীয় গহিত কর্মের জন্য আজই তওবা করুন। সুদ, ঘুষ ছাড়ুন। চোখের হেফাজত করুন। আলেম উলামাদের সাথে সম্পর্ক কায়েম করুন। একজন হক্কানী পীরের হাতে বাইয়াত হােন। অতঃপর তার নিকট নিজ জীবনের সকল ইতিহাস বর্ণনা করুন। তারপর তিনি যেবে চলতে বলবেন, সেভাবে চলতে থাকুন। চিত্ত-বিনােদনের নামে গােটা জীবন অশ্লীল রং তামাশা করে আপনি যা কিছু পেয়েছেন, হক্কানী পীরের কথামত অল্প কিছুদিন জীবন যাপনে অভ্যস্থ হওয়ার পর দেখবেন, প্রতি মুহূর্তে আপনি সে রকম শান্তি, আত্মতৃপ্তি ও সুখ অনুভব করবেন। সে এক স্বর্গীয় প্রশান্তি! যা কেবল অনুভব করা যায়, অন্যকে বুঝানাে যায় না।
ভাইজান! আমি আপনাদের হাতে পায়ে ধরে করজোড় নিবেদন করে বলছি, হেলায় হেলায় আর সময় নষ্ট করবেন না। আজই এবং এ মুহূর্তেই আপনি জীবনকে খােদায়ী বিধান মােতাবেক সুন্দর করে গড়ে তােলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করুন। দাড়ি পাকুক, সন্তানাদি হউক’, ‘বুড়াে হয়ে নেই’ ইত্যাদি থােকা সম্বলিত বাক্যগুলাে আজই মন থেকে ঝেরে ফেলুন। মনে রাখবেন, আগামীকাল শব্দটি মস্তবড় থােকা। বিরাট বড় প্রতারণা। সুতরাং কাল থেকে নামাজ ধরব, অমুক তারিখ থেকে ভাল হয়ে যাব, হজ্জ্বের পরে দাড়ি রাখব- এ সমস্ত ভবিষ্যত কাল জ্ঞাপক শব্দমালা বাদ দিন। কারণ এগুলাে শয়তানের ধােকা। তাই এ মুহূর্তেই শয়তানের গালে খুব জোরে একটি চপেটাঘাত করে, তার মুখে লাথি মেরে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের খুশির জন্য তাদের প্রদর্শিত পথে চলার জন্য প্রতিজ্ঞা করুন। শুধু প্রতিজ্ঞাই নয়, কাজও শুরু করে দিন।
যেমন, পাক-পবিত্র লুঙ্গি বা জামা না থাকলে এখুনি তা ধুয়ে পরিস্কার করে শুকাতে দিন। পরবর্তী নামাজের জন্য তৈরি নিন। কোন হুজুরের হাতে বাইআত হবেন সে বিষয়ে পরিচিত হক্কানী আলেমদের সাথে পরামর্শের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এভাবে ধীরে ধীরে একটির পর একটি শরিয়তের করণীয় কাজগুলাে করতে শুরু করুন। বর্জনীয় কাজগুলাে বর্জন করতে থাকুন। কোনাে বিষয় না জানলে বা অস্পষ্টতা থাকলে খাটি আলেমদের শরণাপন্ন হউন।
মােট কথা, আপনি যদি আখেরাতের অন্তহীন নিয়ামত লাভ ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার দৃঢ় আশা নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হউন যে, আমি আমার জীবনকে সুন্দর করবই, তবে দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার সব ঠিক হয়ে গেছে। যখন যা প্রয়ােজন, যা দরকার সবই আপনি পেয়ে যাবেন। এটি পরীক্ষিত সত্য কথা। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এ মুহূর্ত থেকে জীবনকে নতুন করে গড়ার দৃঢ় সংকল্প করার তাওফীক দিন। আমীন । ]
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বইঃ যদি এমন হতাম থেকে।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.