নূর বিবির নূরানী কর্ম! লেখক পাকিস্তানের এক কালো মেয়ের জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন। নূর বিবি তার রূপ সৌন্দর্য দিয়ে নয়, স্বামীর মন জয় করে নিয়েছেন তার আচরণ ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে। পড়ুন নূর বিবির সেই নূরানী কর্ম। তাহলে আসুন নূর বিবির জীবনের গল্প পড়া শুরু করা যাক…
নূর বিবির নূরানী কর্ম! The life story of one black woman.
মাওলানা তারিক জামিল একজন বিশ্বখ্যাত দা’ঈ–দীন প্রচারক।
মাওলানা বলেন-এক ইন্সপেক্টর-পুলিশ অফিসার। উচ্চশিক্ষিত। আমাদের আত্মীয়। সেই সাথে আমার পিতার ঘনিষ্ট বন্ধুও। তাঁর দৈহিক গঠন খুবই সুন্দর। গায়ের রঙ ঈষৎ লালবর্ণ। উচ্চতা সাড়ে ছয় ফুট। সব মিলিয়ে দেখার মতো সুপুরুষ।
এদিকে আমাদের খান্দানে ছিল একটি মেয়ে। নাম নূর বিবি। দেখতে মোটেও সুন্দর নয়। এলাকার সবাই তাকে শ্রীহীন মেয়ে হিসেবে জানত। সুন্দরী মেয়ে বলতে যা বুঝায়, উহার ছিটেফোটাও তাঁর মধ্যে ছিল না। তাছাড়া নূর বিবি ছিল অশিক্ষিত। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, ইন্সেপেক্টর সাহেবের মা ছেলের জন্য এই নূর বিবিকেই পছন্দ করলেন। ছেলেকে বললেন- আমার মন খুশি করতে চাইলে এই নূর বিবিকেই বিয়ে করতে হবে।
ইন্সপেক্টর সাহেব বড় অফিসার। তাঁর কথায় উঠাবসা করে কত মানুষ! তাকে সম্মান জানায় কত বনী আদম!! আর তাঁর জন্য কিনা এই অশিক্ষিত কুশ্রী মেয়ে!
বড় বিপাকে পড়লেন ইন্সপেক্টর সাহেব। একদিকে কালো কুশ্রী মেয়ে অন্য দিকে মায়ের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা। কোন দিকে যাবেন তিনি? তিনি কি মায়ের তামান্না পূর্ণ করতে গিয়ে অশিক্ষিত কালো মেয়েকে বিয়ে করবেন? নাকি নিজের পছন্দমত সুশ্রী-শিক্ষিত মেয়ে তালাশ করবেন? কিন্তু কী করবেন তিনি কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। অবশেষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে পরামর্শের জন্য চলে এলেন আমার পিতার কাছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বল্লেন-বন্ধু! যদি মায়ের কথা মানি, তাঁর ইচ্ছাকে পূর্ণ করি, তবে জীবনে কখনো এই বিপদ থেকে আমি মুক্ত হতে পারব না। কোনোদিন ওই মেয়েকে আমি আপন করে নিতে পারব না। আর যদি মায়ের কথা না মানি, তাহলে তিনি আজীবন আমার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন। মোট কথা আমি এখন উভয় সংকটে নিপতিত। অতএব, তুমিই এবার বলো-কী করব আমি।
আমার বাবা ভেবে-চিন্তে পরামর্শ দিলেন। বললেন-মায়ের কথা মেনে নিয়ে নূর বিবিকেই বিয়ে করেও নাও।
অফিসার সাহেব বললেন-ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, মায়ের কথাই মেনে নিচ্ছি।
এরপর বিয়ের তারিখ হলো। নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হলো। শুরু হলো নতুন জীবন। জীবনের নতুন অধ্যায়।
অফিসার সাহেব মায়ের মন রক্ষার্থে নূর বিবিকে বিয়ে করলেও মন থেকে ওকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আর স্বামী তাঁর স্ত্রীকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ না করলে, মন থেকে ভালো না বাসলে, দাম্পত্য জীবনে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা-তাদের বেলায়ও তাঁর ব্যতিক্রম হলো না। অবস্থা এই দাঁড়াল যে, নূর বিবি যদি ঘরের ভিতরে থাকে, তাহলে তাঁর স্বামী থাকে বাইরে। আর নূর বিবি বাইরে থাকলে স্বামী থাকে ঘরে। মোট কথা কোনো ভাবেই ওদের মধ্যে খাপ খাচ্ছিল না।
পাঠকদের কাছে নূর বিবির আরেকটি দিক এখনো অজানা রয়ে গেছে। সেটি হলো, নূর বিবি দেখতে ফর্সা না হলে কী হবে, চারিত্রিক গুণাবলীর দিক দিয়ে সে ছিল সত্যিই নূর-নূরের মতোই উজ্জ্বল’ দীনদার-পরহেজগার। সে চিন্তা করে দেখল, আমি তো আসলে এই উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন স্বামীর উপযুক্ত নই। অতএব, আমি যদি প্রথমেই তাঁর কাছ থেকে স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করতে চাই, স্ত্রীর যাবতীয় অধিকার কড়ায় গণ্ডায় আদায় করতে চাই তাহলে এই ইচ্ছা আমার জন্য কোনোদিন সুফল বয়ে আনবে না। বরং বলা যায়, চাওয়া পাওয়ার এই ইচ্ছা ও আকাঙ্খা হবে আমার জন্য আত্মঘাতী। এরূপ করলে স্ত্রীর মর্যাদা পাব তো দূরের কথা, তাঁর সাথে ঘর-সংসার করাও সম্ভব হবে না। একদিন হয়তো তালাক দিয়ে ‘দূর দূর’ করে আমাকে বিদায় করে দিবেন। সুতরাং স্বামীর মন পেতে হলে আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। আর সে পথ হলো-স্বামী থেকে কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা না করে শুধুই দেওয়া আর দেওয়া। অর্থাৎ আমি কী পেলাম তাঁর হিসেব না করে আমি কী দিলাম সেই হিসেব করা। স্বামীর মন জয় করতে হলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া আমার সামনে দ্বিতীয় আর কোনো পথ খোলা নেই।
এসব কথা চিন্তা করে নূর বিবি তাঁর উচ্চশিক্ষিত সুন্দর সুপুরুষের স্বামীর জন্য নিজেকে স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন না করে দাসী হিসেবে পেশ করল। স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিল সম্পূর্ণরূপে।
স্বামী পুলিশ অফিসার। বাসায় ফিরেন গভীর রাতে। বিয়ের প্রথম প্রথম নূর বিবি এতরাত পর্যন্ত জেগে থাকত না। ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু এখন? এখন রাত যত গভীরই হোক না কেন, স্বামী না আসা পর্যন্ত তাঁর অপেক্ষায় সে বসে থাকে। ঘুমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। মনকে শসিয়ে বলে-হে আমার মন! ত্যাগ ছাড়া দুনিয়াতে বড়কিছু অর্জন করা যায় না। যায় না স্বামীর হৃদয়রাজ্যের রাণী হওয়া। তাই কষ্ট যতই হোক না কেন, ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা তোমাকে প্রদর্শন করতেই হবে। স্বামীর মন জয়ের জন্য যে কোনো কষ্টকে বরদাশত করতে হবে-অম্লান বদনে, হাসি মুখে।
প্রতিদিন গভীর রাতে স্বামী যখন বাসায় ফিরে দরজায় নক করেন তখন নূর বিবি সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতে তাঁর মুহূর্তকাল বিলম্ব হয় না। আর বিলম্ব হবেই বা কেমন করে? সে তো দরজার পাশেই বসে থাকে স্বামীর দিল জয়ের আশায়!
দরজা খুলে দিয়ে নূর বিবি স্বামীর হাত থেকে হাসিমুখে মাল ছামানা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। স্বামী ঘরে প্রবেশ করার পর নূর বিবির মনে চায় মোসাফাহা-মোয়ানাকা করতে। মনে চায় ব্যবহারিকভাবে ভালোবাসার কিছু আদান-প্রদান করতে। কিন্তু সে তো দাসী! দাসী হিসেবেই সে নিজেকে সঁপে দিয়েছে স্বামীর পদতলে। আর মোসাফাহা-মোয়ানাকা? ভালোবাসার বিনিময়ে? সে তো স্বামী স্ত্রীর কাজ। তাদের জন্যেই এসব মানায়। এসব কথা ভেবে দূর বিবি তাঁর এ ইচ্ছাকে জোর খাটিয়ে দমন করে রাখে।
তারপর স্বামীর জন্য অজুর পানি এগিয়ে দিয়ে তাজা রুটি বানিয়ে গরম গরম খেতে দেয়। খাওয়া দাওয়া শেষে স্বামী শুয়ে পড়ে। নূর বিবি তখন পরম আন্তরিকতা নিয়ে স্বামীর মাথায় বিলি কাটে। গোটা শরীর টিপে দেয়। অতঃপর স্বামী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলে সেও খানিক দুরত্ব বজায় রেখে পাশে শুয়ে পড়ে। কারণ, দাসীর জন্য তো এ-ই বড় পাওয়া!
নূর বিবির এভাবেই কাটে গোটা রাত। আহা! কত ইচ্ছা জাগে স্বামীএক একান্ত করে কাছে পাওয়ার। কত তামান্না জাগে স্বামীর সোহাগ লাভের। কিন্তু…….। কারণ ঐ একটিই–স্বামীর মন জয় করা।
সকালে স্বামীর অনেক আগেই ঘুম থেকে ওঠে নূর বিবি। তারপর স্বামীর জন্য জুতো পালিশ করে, কাপড় চোপড় প্রস্তুত করে রাখে। আর প্রস্তুত করে রাখে বিভিন্ন প্রকার নাস্তা। আর স্বামী বেচারা নাস্তা খেয়ে চুপচাপ ডিউটিতে চলে যায়। নূর বিবির সাথে একটা কথাও বলে না। কী অদ্ভূত এই জগত! কত শক্ত মানুষের হৃদয়!!
এভাবে অবিরাম তিন বছর সাধনা চালায় নূর বিবি। খুশির কথা হলো, নূর বিবি তাঁর সাধনায় কামিয়াব হয়। সফল হয় পরিপূর্ণভাবে। এবং তাঁর এই সফলতা ছিল এমন সফলতা যা কল্পনাকেও হার মানায়। কেননা, তিন বছর পর দেখা গেল, নূর বিবি তাঁর স্বামীর মন এভাবে জয় করে নিয়েছে যে, স্বামী তাঁর গোলাম বনে যায়। যে নূর বিবির দিকে স্বামী ঘৃণাভরে চোখ তোলে তাকাত না, যার সাথে একটি কথাও হাসিমুখে বলত না, যাকে দীর্ঘকাল দেখিয়েছে তাচ্ছিল্যের ভাব-সেই নূর বিবিই এখন ঘরের নূর, স্বামীর হৃদয় জগতের নূর। যে নূর আলোকিত করে আছে স্বামীর গোটা হৃদয়াকাশ। যে নূর ছাড়া স্বামী একটি দিনও একা থাকতে পারে না। যে নূরের কথা সারাদিন তাঁর মনে পড়ে। যে নূরের চেহারা সারাদিন ভাসে মনের আয়নায়। ওহ! সেবার কত শক্তি! খেদমতের কত পাওয়ার!!
এরপর এক এক করে নূর বিবি তিন সন্তানের মা হয় এবং এক সময় তাঁর হায়াত শেষ হয়ে যায়। সে চলে যায় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে।
মাওলানা আরো বলেন-নূর বিবির কথা আমার মনে নেই। কারণ, আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। তবে এতটুকু পরিস্কার মনে আছে যে, নূর বিবি মারা যাওয়ার পর তাঁর তিন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে তাঁর ইন্সপেক্টর স্বামী স্ত্রীর কথা মনে করে ছোট্ট শিশুর মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত।
নূর বিবি মারা যাওয়ার দীর্ঘদিন পর সেই অফিসার তাঁর বংশের আরেক রূপসী নারীকে বিয়ে করে ঘরে আনেন। কিন্তু সেই রূপসী নারী একটি দিনও তাকে শান্তি দেয় নি। দেয়নি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে। আর দিবেই বা কী করে? সে তো ব্যবহার-চরিত্রে ছিল নূর বিবির সম্পূর্ণ উল্টো। যদিও খোলসটা ছিল বড়ই মোহনীয় ও চিত্তাকর্ষক। কিন্তু হৃদয় তো আর খোলসের সৌন্দর্য দিয়ে জয় করা যায় না! আমরা দেখেছি, এই রূপসী নারীকে বিয়ে করার পর আজীবন ঐ অফিসার কপাল চাপড়ে ফিরেছে এবং ‘নূর বিবি’ বলে মাতম করতে করতে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! তাই আমি বলি, রূপের পাখায় ভর করে পরিবারে সুখ আসে না। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে মনে প্রশান্তি লাভ হয় না। বরং প্রকৃত সুখ-শান্তি লাভের জন্য প্রয়োজন-দীনদার, চরিত্রবর্তী, অনুগত স্ত্রী। চাই তাঁর রূপ-সৌন্দর্য কমই হউক কিংবা না-ই থাকুক। অতএব, আসুন আমরা নিজেরাও এসব গুণে গুণান্বিত হই আর ছেলে-মেয়েকেও দীনদার এবং উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন!!
[সূত্রঃ বেহনূঁ ছে খেতাব]
লেখকঃ মাওলানা মুফীজুল ইসলাম (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১ বই থেকে)
এরপর পড়ুন >> অশিক্ষিত স্বামী মুখরা স্ত্রী (স্বামী স্ত্রীর গল্প)
Image by pixabay
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.