পাপের সাজা (বউ শাশুড়ীর বাস্তব গল্প)

পাপের সাজা, লেখক এক অসৎ বউ ও অসহায় শাশুড়ীর জীবনের বাস্তব ঘটনা গল্প আকারে তাঁর বইতে তুলে ধরেছেন। কথায় আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। তাই যেনো সত্যি হলো জোবেদা খাতুনের বেলায়। তাহলে আসুন পাপের সাজা গল্পটি পড়া শুরু করি…

পাপের সাজা ( শিক্ষণীয় গল্প)

বউমাকে ডাকতে ডাকতে গলা ব্যথা হয়ে যায় সখিনা বেগমের। তবু কোনো সাড়া নেই। এক পর্যায়ে দারুণ বিরক্তিবোধ করেন তিনি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ডাকতে থাকেন একমাত্র নাতী আব্দুর রহীমকে—আব্দুর রহীম! ও আব্দুর রহীম!!

পাপের সাজা ( বউ শাশুড়ির বাস্তব গল্প)বাড়ির পিছনে একটি বিরাট ময়দান। সঙ্গীদের সাথে সেখানেই খেলা করছিল আব্দুর রহীম। দাদীর ডাক শুনে ‘আসছি দাদী’ বলে দৌড় দেয় সে। কাছে এসে বলে-দাদী! আমাকে ডেকেছেন?

বয়সের ভারে বৃদ্ধা সখিনা বেগম। তার চোখের জ্যোতি হারিয়ে গেছে সেই কবে! তিনি এখন কিছুই দেখতে পান না। তাই আব্দুর রহীমের উপস্থিতি টের পেয়ে মমতার সুরে বললেন—দেখ তো দাদু ভাই! তোমার আম্মু কোথায় গেল। ও যে আমার পান-সুপারি কোথায় রেখেছে! অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাচ্ছি না।

“ঠিক আছে দাদী। আমি দেখছি”—বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আব্দুর রহীম। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এল মাকে সঙ্গে নিয়ে।

আব্দুর রহীমের মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। ঘরে এসেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। বললেন, কী অসহ্য! কোথাও গিয়ে একটু দম ফেলারও সুযোগ নেই। মুহূর্তের মধ্যেই চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। শুনি, হয়েছেটা কি? কোথায় কোন বিপত্তি ঘটল যে, যেতে না যেতেই খবর পাঠিয়ে আনতে হলো?

সখিনা বেগম কোনো কথা বললেন না। প্রতিবাদ জানালেন না। কারণ তিনি জানেন, এটা বউমার নিত্যদিনের অভ্যাস। তাই তিনি শান্তভাবেই বললেন, পান-সুপারি গুলো খুঁজে পাচ্ছি না। মুখটা খুব তিতা লাগছে। পান চিবালে হয়তো একটু ভাল লাগতো। একটু পান বানিয়ে দিলে খুব ভাল হতো।

বুঝলাম, মুখটা তেতো হইয়ে গেছে। তাই বলে একটু দেরি করলে মুখটা ক্ষয় হয়ে যেত নাকি? আমি তো আপনার চাকরাণী নই যে, নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু এনে হাজির করব!

এভাবেই বক বক করে আরো কিছু ধারাল কথা বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন জোবেদা খাতুন। কিন্তু যে পানের জন্য ডেকে আনা, যে পানের জন্য এত কথা শুনা, সে পান আর বানিয়ে দিলেন না। মুখ গোমরা করে হন হন করে চলে গেলেন তিনি।

সখিনা বেগম নিশ্চুপ বসে রইলেন। সেই আগের মতই। ভেবেছিলেন, বকাঝকা যাই করুক, পানটা ঠিকই দিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় পান? এক ঘন্টা হয়ে গেল, পানের কোনো খোঁজ নেই। তাই আবারও ডাকলেন বউমাকে। বললেন, বউমা! পান তো দিয়ে গেলে না। আমার দাঁতে যে ব্যথা উঠেছে!

জুবেদা খাতুন নিজকে নিয়েই আজ ব্যস্ত। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে পরিপাটি হচ্ছিলেন তিনি। এমতাবস্থায় শাশুড়ীর ডাক শুনে আবার একরাশ বিরক্তি এসে ভিড় জমায় তার মনে। তাই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এমন করে ষাড়ের মত চেচাচ্ছেন কেন? দেখছেন না, আমি কাজে ব্যস্ত? নিজ কাজ বাদ দিয়ে আপনার পিছনে দৌড়াব নাকি? এত প্রয়োজন হলে ছেলেকে আরেকটি বিয়ে করিয়ে চাকরাণী নিয়ে আসুন। সেই সব করবে। আমি এতকিছু পারব না। এই বলে সে আবারও সাজ-সজ্জার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সখিনা বেগমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও তিনি বড় কষ্ট করে নিজেকে সংবরন করলেন। বউমাকে আর কিছু না বলে মনের দুঃখ মনেই রেখে বসে রইলেন।

সেদিন রাতেই আব্দুর রহীমের পিতা আবুল কাসেম বাড়িতে এলেন। তিনি ঘরে ঢুকতেই জিবেদা খাতুন একদম চুপসে গেলেন। যেন তার মত সাধু নারী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। স্বামীকে নাস্তা-পানি দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন শাশুড়ীর জন্য পান বানাতে।

আবুল কাসেম জিজ্ঞেস করলেন, মায়ের কি অবস্থা? ঠিকমতো তার সেবাযত্ন করছ তো? জুবেদা খাতুন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি তার সেবা-যত্ন না করলে কে আছে যে, তার সেবা-যত্ন করবে? তিনি তো চোখেই দেখেন না। তার সবকিছু তো আমাকেই করতে হয়। চাওয়ার আগেই সবকিছু প্রস্তুত করে রাখি। এই তো তার পান ফুরিয়ে গেছে দেখে নতুন পান বানিয়ে দিচ্ছি। খাওয়া-পরা, বিছানা করে দেওয়া, বাথরুমের আনা-নেওয়া করা, সব তো আমিই করি। আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন, আমি তার যত্ন নিচ্ছি কি না?

আহা, তুমি রাগ করছ কেন? মায়ের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য আমি কি এতটুকু জিজ্ঞেস করতে পারিনা? এতে রাগ করার কি আছে?

রাগ করব না তো কি করব? আমি ছাড়া তার যত্ন নেওয়ার আর কে আছে? কে তার জন্য এতসব করবে?

ঠিক আছে, আর জিজ্ঞেস করব না। এখন পান দিয়ে এসো।

জুবেদা খাতুন মনে মনে এটাই চেয়েছেন। তাই স্বামীর মুখে থেকে তা শুনতে পেয়ে খুব খুশী হলেন এবং দ্রুতবেগে শাশুড়ীর কাছে পান নিয়ে হাজির হলেন।

সখিনা বেগম এতক্ষণ ধরে ওদের কথোপকথন শুনছিলেন। তাই জুবেদা খাতুন পান দিতে এলে তিনি আস্তে করে বললেন, এই হলো তোমার সেবা-যত্নের অবস্থা? বারবার চাওয়ার পরও একটু পান দিলে না। আর এখন ছেলেকে দেখানোর জন্য হন্তদন্ত হয়ে পান নিয়ে এলে! তোমাদের সংসার ভেঙ্গে যাক, তা আমি কখনোই চাই না। তাই তোমার সব কথা বার্তা শুনেও চুপ হয়ে রইলাম। তবে মনে রেখো, আল্লাহ যখন তোমাকে একটি ছেলে দিয়েছেন, বেঁচে থাকলে তোমাকেও একদিন শাশুড়ি হতে হবে। সেদিন নিশ্চয় এর প্রতিফল পাবে। যেভাবে আমার ছেলেকে বোবা বানিয়ে নিয়েছো, একদিন তোমার ছেলেও এরচেয়ে বেশি বোবা হয়ে যাবে।

শাশুড়ীর কথা শুনে এক মুহুর্তও দেরি করলেন না জুবেদা খাতুন। হন হন করে স্বামীর কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, ওগো! শুনছো, তোমার নাস্তা দিতে গিয়ে একটু দেরি হওয়ায় তিনি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। হায়রে কপাল আমার! এত সেবা-যত্ন করেও কোনো নাম নেই!!

আমি আর এই বাড়িতে থাকব না। আমাকে তুমি আমার বাবার বাড়িতে দিয়ে এসো বলে আরো জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন জুবেদা খাতুন।

স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে আবুল কাসেম উঠে এসে বললেন, পাগলের মত এমন করছ কেন? কি হয়েছে, পরিষ্কার করে বলবে তো?

কি হবে আবার? তোমরা সবাই এক। তোমাদের কাছে কিছু বলে কোনো লাভ নেই। জানি, তোমাদের কাছে কোনো দিন সুবিচার পাব না। তাই এই বাড়িতে আমি আর এক মুহুর্তও থাকতে চাই না।

আবুল কাসেম মায়ের কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে মা! ওকে অভিশাপ দিচ্ছেন কেন?

সখিনা বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, কিছু হয়নি বাবা! একটু বকা দিয়েছি মাত্র। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি গিয়ে শুয়ে থাক।

আবুল কাশেম ঘটনার আগা-গোড়া কিছুই বুঝতে না পারে বাইরে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে বিছানায় এসে শুয়ে রইলেন।

কয়েকদিন পর সখিনা বেগম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। এতে মনে মনে বেশ খুশি হলেন জুবেদা। অস্ফুটে স্বরে বললেন, যাক, বালা দূর হয়েছে। এবার ইচ্ছে মতো সবকিছু করা যাবে। তারপর থেকে জুবেদা খাতুনের দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল। কিন্তু কথায় বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না।

জুবেদা খাতুনের বয়স এখন বিয়াল্লিশ। হঠাৎ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিলেন তিনি। অসহায় হয়ে পড়লেন সম্পূর্ণরূপে। কাউকে দেখলেই ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। ক’দিন আগে ঘরে এসেছে ছেলের বউ। বউমার খেদমত পাওয়ার আশায় ছেলে আব্দুর রহীমকে বিয়ে দিয়েছিলেন  তিনি। কিন্তু সে আশা, আশাই রয়ে গেল। পূরণ হলো না বিন্দুমাত্রও।

আব্দুর রহীমের বউ উচ্চ শিক্ষিতা। ডাক নাম ছবি। ছবির মতই সুন্দরী সে। কিন্তু সুন্দরী হলে কি হবে? মনটা তার বড়ই কুৎসিত। শাশুড়ী জুবেদা খাতুনের দিকে ফিরেও তাকায় না সে। ছেলে আব্দুর রহীমও মায়ের খুব একটা খোঁজ খবর নেয় না। ফলে প্রায় সময়ই তাঁকে ময়লা আবর্জনার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে হয়। দুর্গন্ধে কেউ তার ধারে-কাছেও ভিড়ে না।

জুবেদা খাতুনের ছিল এক অন্তরঙ্গ বান্ধবী। একদিন সে বাপের বাড়িতে এসে জুবেদাকে দেখতে এলো। বান্ধবীকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠল সে। বলল, একি অবস্থা তোর? তারপর কয়েকমুহুর্ত নীরব থেকে আবার বলল—হ্যাঁ, বুঝেছি। এ সব তোর পাপের ফল। তুই তোর মাটির মত শাশুড়ীকে সারাটি জীবন কষ্ট দিয়েছিস। যন্ত্রণার আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিস। সে জন্যেই তোর এই অবস্থা। আল্লাহ তাআলা মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলেছেন। আর তুই আল্লাহ তাআলার সেই হুকুম সারা জীবন অমান্য করে এসেছিস। বিয়ের পর মেয়েদের শাশুড়ীই হলেন মা। তুই সেই মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিস। তাঁকে যথেচ্ছা কষ্ট দিয়েছিস। সুতরাং আজকের এই অবস্থা তোর হাতেরই কামাই। তোর হাতেরই রূপিত ফসল। মনে রাখিস, আল্লাহ তাআলা কারো উপর অবিচার করেন না। যার যা পাওনা, তাই তাঁকে দিয়ে থাকেন।

যাক, এখন আর কেঁদে-কেটে কোনো লাভ নেই। বরং মনে মনে তাওবা কর। আল্লাহর দরবারে কান্না-কাটি করে দেখ, তিনি কিছু করেন কি না? তোর ক্ষমার জন্য কোনো ব্যবস্থা হয় কি না?

 বান্ধবীর প্রত্যেকটি কথা খুব শক্তভাবে আঘাত হানে জুবেদা খাতুনের হৃদয়ে। এসব কথা শুনে অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করেন তিনি। খুলে যায় তার মনের অহমিকার পর্দা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের পাতাগুলো। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারে জুবেদা খাতুন। বলে, তুই ঠিকই বলেছিস! আমি আমার শাশুড়ীর সাথে চরম বে-আদবী করেছি। তাঁকে কষ্ট দিয়ে আমি বড় অন্যায় করেছি। আমি আজ মৃত্যুর দুয়ারে প্রায়। হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না। এহেন ক্রান্তিলগ্নে তোদের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে তুই আমাকে আমার শাশুড়ীর কবরের কাছে নিয়ে চল। তোর দু’টি পায়ে পড়ি, জীবনের শেষ মুহূর্তে আমাকে এই উপকার টুকু করে দে। তিনি আমার মা। আমি তার কাঁছে আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেব…।

এটুকু বলতেই শুরু হয়ে যায় বুকফাটা আর্তনাদ। জোরে চিৎকার করতে শুরু করেন জুবেদা খাতুন। কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়েন বিছানায়। একসময় বন্ধ হয়ে যায় তার কান্নার আওয়াজ। এভাবে পাপের সাজা ভোগ করে চিরদিনের জন্য মাটির সাথে মিশে যান তিনি। রেখে যান অনাগত কালের পুত্রবধূদের জন্য এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত!! (সহযোগিতায়ঃ সাদিয়া ইয়ামিন, কালিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা)

লেখকঃ মাওলানা মুফীজুল ইসলাম (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১)

এরপর পড়ুন : পরকালীন সুখই আসল সুখ

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, লেখকের পাপের সাজা গল্পটি পড়ে ভালো লাগলে এটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Punishment of sin, the author tells the real story of the life of a dishonest wife and helpless mother-in-law in the form of a story in his book.

Leave a Comment